নির্বাচন-পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ

নবম-দশম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - বাংলাদেশের ইতিহাস ও বিশ্বসভ্যতা - ভাষা আন্দোলন ও পরবর্তী রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ | NCTB BOOK

যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রিসভা গঠন:
শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট ১৪ সদস্যবিশিষ্ট মন্ত্রিসভা গঠন করে । প্রাদেশিক প্রধানমন্ত্রী ছাড়াও তিনি অর্থ, রাজস্ব ও স্বরাষ্ট্র বিভাগের দায়িত্ব নেন। অন্যান্য সদস্যের মধ্যে আবু হোসেন সরকার বিচার, স্বাস্থ্য ও স্থানীয় সরকার; সৈয়দ আজিজুল হক শিক্ষা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি, সমবায় ও পল্লি উন্নয়ন বিভাগের দায়িত্ব লাভ করেন ।

যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রিসভা বাতিল ও পূর্ব বাংলায় কেন্দ্ৰীয় শাসন:
যুক্তফ্রন্টের নিরঙ্কুশ জয় শুরু থেকেই মুসলিম লীগ সুনজরে দেখেনি । তারা যুক্তফ্রন্ট সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র আরম্ভ করে । এ সময় শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক কলকাতা সফরে এসে দুই বাংলা নিয়ে আবেগপ্রবণ বক্তব্য দিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের বিরাগভাজন হন । নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ২১শে ফেব্রুয়ারিকে সরকারি ছুটি ও বর্ধমান হাউসকে বাংলা ভাষার গবেষণা প্রতিষ্ঠান ঘোষণা দিলে কেন্দ্রীয় সরকার ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। কেন্দ্রীয় সরকার সুযোগ খুঁজতে থাকে যে কোনো অজুহাতে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা বাতিল করতে । এমতাবস্থায় মে মাসে কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে কারা কর্তৃপক্ষ ও স্থানীয় জনগণের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ এবং আদমজী জুট মিলে বাঙালি ও বিহারি শ্রমিকদের মধ্যে ব্যাপক গোলযোগ হয় । ফলে কেন্দ্রীয় সরকার যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভাকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করতে ব্যর্থ বলে দায়ী করতে থাকে ।

একই সময় ‘নিউইয়র্ক টাইমস'-এ ফজলুল হকের এক সাক্ষাৎকার বিকৃত করে প্রকাশিত হয় যে, তিনি পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা চান। এতে মুসলিম লীগ সরকার তাঁকে রাষ্ট্রদ্রোহী বলে ঘোষণা দেয় । অবশেষে কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগ সরকার ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের ৯২ (ক) ধারা বলে ১৯৫৪ সালের ৩০শে মে যুক্তফ্রন্ট সরকার বাতিল করে পূর্ব বাংলায় গভর্নরের শাসন জারি করে। এ শাসন ১৯৫৫ সালের ২রা জুন পর্যন্ত বহাল থাকে। মাত্র ৫৬ দিনের শাসনের পর যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভার অবসান হয় । মূলত মুসলিম লীগ ও পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের ষড়যন্ত্র এবং যুক্তফ্রন্টের শরিক দলের মধ্যে কোন্দলের কারণে ঘন ঘন সরকার বদল হতে থাকে। মাত্র চার বছরে সাত মন্ত্রিসভার পতন হয় । কেন্দ্ৰীয় সরকার তিনবার গভর্নরের শাসন জারি করে । যুক্তফ্রন্টের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ও কেন্দ্রীয় সরকারের চক্রান্তের ফলে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা গড়ে উঠতে পারেনি ।

১৯৫৬ সালের সংবিধান:
সংবিধান একটি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন । সংবিধানের মাধ্যমে একটি রাষ্ট্রের শাসনকার্য পরিচালিত হয় । ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্র জন্ম নেওয়ার পর থেকেই বিভিন্ন পর্যায়ে দ্রুত সংবিধান রচনার দাবি ওঠে । পূর্ব বাংলা থেকে এ দাবি ছিল আরও জোরালো । পূর্ব বাংলার জন-দাবিই ছিল নতুন সংবিধানের মাধ্যমে পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন যেন অর্জিত হয়। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানি ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ সরকার পূর্ব বাংলাকে উপনিবেশে পরিণত করতে চাইল। প্রথম অবস্থায় নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তান ১৯৪৭ সালের ভারত স্বাধীনতা আইন দ্বারা পরিচালিত হতে থাকে । ১৯৪৬ সালের নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের সমন্বয়ে পাকিস্তান গণপরিষদ গঠন করা হয়। এই গণপরিষদের দায়িত্ব ছিল কেন্দ্রীয় আইনসভা হিসেবে কাজ করা এবং নতুন সংবিধান প্রণয়ন করা । কিন্তু শাসকগোষ্ঠীর অনীহায় গণপরিষদের কাজ ব্যাহত হতে থাকে ।

অবশেষে ১৯৪৯ সালের মার্চ মাসে সংবিধান রচনার জন্য গণপরিষদ কর্তৃক একটি মূলনীতি কমিটি গঠন করা হয় । এ মূলনীতি কমিটিতে পূর্ব বাংলার প্রতিনিধি ছিল নগণ্য । সময়ক্ষেপণ করে মূলনীতি কমিটি ১৮ মাস পরে তার সুপারিশ ও প্রতিবেদন পেশ করে । এ কমিটির সুপারিশে পূর্ব বাংলার জনগণকে সব দিক থেকে বঞ্চিত করা হয় । ফলে ১৯৫০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হলে পূর্ব বাংলায় ব্যাপক প্রতিবাদ ওঠে এবং তারা কমিটির সুপারিশকে প্রত্যাখ্যান করে । এরপর মূলনীতি কমিটি ১৯৫২ সালে দ্বিতীয় এবং ১৯৫৩ সালে তৃতীয় প্রতিবেদন প্রকাশ করে । কিন্তু সংবিধান প্রণয়নের বিষয়টি অমীমাংসিত রয়ে যায়। অবশেষে ১৯৫৫ সালের মার্চ মাসে গভর্নর জেনারেল পাকিস্তানের সংবিধান প্রণয়নের উদ্যোগ নেন । পশ্চিম ও পূর্ব অংশের নেতারা একটি সমঝোতায় আসতে সক্ষম হন । তারই ভিত্তিতে ১৯৫৬ সালের সংবিধান রচিত হয় । এই সংবিধান দুই বছর পর্যন্ত কার্যকর ছিল । ১৯৫৮ সালে প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইসকান্দর মির্জা সামরিক শাসন জারি করলে সংবিধান স্থগিত করা হয় এবং সেই সঙ্গে পাকিস্তানে সাংবিধানিক শাসনের অবসান ঘটে।

Content added || updated By

আরও দেখুন...

Promotion