হৃৎপিণ্ডের সংকোচন এবং প্রসারণের ফলে হৃৎপিণ্ড থেকে রক্ত ধমনির মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার সময় ধমনিপ্রাচীরে যে পার্শ্বচাপ সৃষ্টি হয়, সেটাকে রক্তচাপ বলে। তাই রক্তচাপ বলতে সাধারণভাবে ধমনির রক্তচাপকেই বুঝায়। রক্তচাপ হৃৎপিণ্ডের কার্যকারিতা, ধমনির প্রাচীরের স্থিতিস্থাপকতা এবং রক্তের ঘনত্ব এবং পরিমাণের উপর নির্ভর করে। নিলয়ের সিস্টোল অবস্থায় ধমনিতে যে চাপ থাকে তাকে সিস্টোলিক রক্তচাপ এবং ডায়াস্টোল অবস্থায় যে চাপ থাকে, তাকে ডায়াস্টোলিক রক্তচাপ বলে। স্বাভাবিক এবং সুস্থ একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের সিস্টোলিক রক্তচাপ পারদ স্তম্ভের ১১০ - ১৪০ মিলিমিটার (mm Hg) এবং ডায়াস্টোলিক রক্তচাপ পারদ স্তম্ভের ৬০-৯০ মিলিমিটার (mm Hg)। স্বাভাবিক রক্তচাপকে ১২০/৮০ (mm Hg) এভাবে প্রকাশ করা হয়। স্ফিগমোম্যানোমিটার নামক যন্ত্রের সাহায্যে রক্তচাপ নির্ণয় করা যায়।
৩.৪.১ উচ্চ রক্তচাপ
উচ্চ রক্তচাপকে ডাক্তারি ভাষায় হাইপারটেনশন বলে। শরীর আর মনের স্বাভাবিক অবস্থায় রক্তচাপ যদি বয়সের জন্য নির্ধারিত মাত্রার উপরে অবস্থান করতে থাকে, তবে তাকে উচ্চ রক্তচাপ বা হাইপারটেনশন বলে। রক্তের চাপ যদি কম থাকে তা হলে তাকে নিম্ন রক্তচাপ বলে। হৃৎপিণ্ডের সংকোচন আর প্রসারণের ফলে হৃৎপিণ্ড থেকে ধমনির মাধ্যমে রক্ত প্রবাহকালে ধমনি গায়ে কোনো ব্যক্তির সিস্টোলিক রক্তচাপ যদি সব সময় ১৬০ মিলিমিটার পারদস্তম্ভ বা তার বেশি এবং ডায়াস্টোলিক সব সময় ৯৫ মিলিমিটার পারদস্তম্ভ বা তার বেশি থাকে, তবে তার উচ্চ রক্তচাপ আছে বলা যায়। উত্তেজনা, চিন্তা, বিষণ্ণতা, নিদ্রাহীনতা বা অন্য কোনো কারণে যদি রক্তচাপ সাময়িকভাবে নির্দিষ্ট সীমানা অতিক্রম করে, তবে তাকে হাইপারটেনশন বলা যাবে না এবং তার জন্য বিশেষ কোনো ঔষধেরও প্রয়োজন হয় না।হাইপারটেনশন হাওয়ার প্রকৃত কারণ আজও জানা যায়নি। তবে অতিরিক্ত শারীরিক ওজন, মেদবহুল শরীর, অতিরিক্ত লবণ খাওয়া, অপর্যাপ্ত শারীরিক পরিশ্রম, ডায়াবেটিস, অস্থিরচিত্ত এবং মানসিক চাপগ্রস্ত, রক্তে কোলেস্টেরলের আধিক্য— এরকম ব্যক্তিদের মাঝে এ রোগের আশঙ্কা সবচেয়ে বেশি। হাইপারটেনশন রোগীদের যেসব জটিলতা দেখা দিতে পারে তার মধ্যে রয়েছে স্ট্রোক, প্যারালাইসিস, হৃৎপিণ্ড বড় হয়ে যাওয়া, হার্ট অ্যাটাক এবং ফেইলিউর, কিডনির কার্যক্ষমতা কমে যাওয়া, দৃষ্টিশক্তির ব্যাঘাত প্রভৃতি। নিম্ন রক্তচাপ উচ্চ রক্তচাপের মতো এত মারাত্মক নয়। তবে রক্তচাপ যথেষ্ট কমে গেলে নানা রকম অসুবিধা সৃষ্টি হতে পারে।
রক্তচাপ প্রতিরোধ করার জন্য কিংবা প্রতিকার হিসেবে নিচের সতর্কতামূলক নিয়মগুলো পালন করলে উপকার পাওয়া যায় :
১. ডায়াবেটিস থাকলে সেটি নিয়ন্ত্রণে রাখা।
২. দেহের ওজন না বাড়ানো।
৩. চর্বিযুক্ত খাদ্য বর্জন করা। (যেমন: ঘি, মাখন, গরু ও খাসির মাংস, চিংড়ি ইত্যাদি)
৪. সুষম খাদ্য গ্রহণ করা।
৫. পরিমাণের অতিরিক্ত খাদ্য গ্রহণ থেকে বিরত থাকা।
৬. ধূমপান থেকে বিরত থাকা।
৭. নিয়মিত ব্যায়াম করা।
b. দৈনিক ৭/৮ ঘণ্টা ঘুমানো।
৯. মানসিক চাপমুক্ত ও দুশ্চিন্তামুক্ত জীবনযাপন করা।
১০. খাবারের সাথে অতিরিক্ত লবণ গ্রহণ থেকে বিরত থাকা।
৩.৪.২ কোলেস্টেরল
কোলেস্টেরল এক বিশেষ ধরনের জটিল স্নেহ পদার্থ বা লিপিড এবং স্টেরয়েড-এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। মানুষের প্রায় প্রত্যেক কোষ ও টিস্যুতে কোলেস্টেরল থাকে। যকৃৎ এবং মগজে এর পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। কোলেস্টেরল অন্যান্য স্নেহ পদার্থের সাথে মিশে রক্তে স্নেহের বাহক হিসেবে কাজ করে। স্নেহ এবং প্রোটিনের যৌগকে লাইপোপ্রোটিন বলে। স্নেহের পরিমাণের ওপর ভিত্তি করে লাইপোপ্রোটিন দুই রকম— উচ্চ ঘনত্ব বিশিষ্ট লাইপোপ্রোটিন (High Density Lipoprotein-HDL) এবং নিম্ন ঘনত্ববিশিষ্ট লাইপোপ্রোটিন ( Low Density Lipoprotein — LDL)। রক্তের LDL-এর পরিমাণের
বৃদ্ধির সাথে কোলেস্টেরলের আধিক্যের সম্পর্ক আছে। রক্তে LDL-এর পরিমাণ বেশি থাকা শরীরের জন্য ক্ষতিকর। রক্তে HDL-এর পরিমাণ বেশি থাকা শরীরের জন্য উপকারী। রক্তে কোলেস্টেরলের স্বাভাবিক পরিমাণ ১০০-২০০ mg/dL। রক্তে কোলেস্টেরলের আধিক্য হৃদরোগের আশঙ্কা বাড়ায়। স্বাভাবিক মাত্রা থেকে রক্তে কোলেস্টেরল বেশি হলে রক্তনালি অন্তঃপ্রাচীরের গায়ে কোলেস্টেরল ও ক্যালসিয়াম জমা হয়ে রক্তনালি গহ্বর ছোট হয়ে যায়। এ কারণে ধমনির প্রাচীরের স্থিতিস্থাপকতা কমে যায় এবং শক্ত হয়ে যায়। এ অবস্থাকে ধমনির কাঠিন্য বা arteriosclerosis বলে। আর্টারিওস্কেলরোসিসের কারণে ধমনির প্রাচীরে ফাটল দেখা দিতে পারে। ধমনির গায়ে ফাটল দিয়ে রক্তক্ষরণ হয়ে জমাট বেঁধে রক্তপ্রবাহ বাধাপ্রাপ্ত হয়। হৃৎপিণ্ডের করোনারি রক্তনালিকায় রক্ত জমাট বাঁধলে তাকে করোনারি থ্রম্বোসিস বলে এবং মস্তিষ্কের রক্তনালিতে রক্ত জমাট বাঁধলে তাকে সেরিব্রাল থ্রম্বোসিস বলে। এতে আক্রান্ত ব্যক্তির মৃত্যু ঘটতে পারে। রক্তে কোলেস্টেরল বেড়ে গেলে LDL-এর পরিমাণ বেড়ে যায় আর HDL-এর পরিমাণ কমে যায়। LDL-এর পরিমাণ ১৫০ mg /dL থেকে বেশি হলে তাকে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া আবশ্যক ।