কোন বিজ্ঞানী ক্রোমোসোম আবিষ্কার করেন?

Created: 2 years ago | Updated: 11 months ago
Updated: 11 months ago

ক্রোমোজোম (Chromosome):

কোষ বিভাজনকালে ক্রোমাটিন তন্তু থেকে সৃষ্ট, নিউক্লিক এসিড ও প্রোটিন দিয়ে গঠিত, স্বপ্রজননশীল, সূত্রাকার যে বস্তু জীবের বংশগতির বৈশিষ্ট্যগুলো বংশানুক্রমে পরিবহন করে এবং প্রজাতির পরিব্যক্তি, প্রকরণ ও বিবর্তনে মূখ্য ভূমিকা পালন করে তাকে ক্রোমোজোম বলে।

আবিষ্কার : উনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে একাধিক বিজ্ঞানীর নিরলস গবেষণার ফলে ক্রোমোজোম আবিষ্কৃত হয়।  ১৮৭৫ সালে E. Strasburger সর্বপ্রথম নিউক্লিয়াসে ক্রোমোজোম আবিষ্কার করেন, কিন্তু তিনি এর কোন নামকরণ করেননি । ১৮৭৯ সালে Walter Flemming ক্রোমোজোমের দ্বিবিভাজন লক্ষ করেন এবং বর্ণ ধারণযোগ্য এ বস্তুকে MAT নাম দেন ক্রোমাটিন । W. Waldeyer ১৮৮৮ সালে সর্বপ্রথম ক্রোমোজোম (গ্রিক chroma = বর্ণ; soma = দেহ বা বস্তু) শব্দটি ব্যবহার করেন। কাজেই ক্রোমোজোেম অর্থ হলো 'রঞ্জিত দেহ' বা 'বর্ণ ধারণকারী দেহ'।)

সংখ্যা : প্রজাতির বৈশিষ্ট্যভেদে এর 2n সংখ্যা ২ থেকে ১৬০০ পর্যন্ত হতে পারে। অপুষ্পক উদ্ভিদ, Mucor heimalis- এ 2n = ২। পুষ্পক উদ্ভিদে সর্বনিম্ন সংখ্যক ক্রোমোজোম পাওয়া গিয়েছে Haplopappus gracilis, 2n = ৪ এবং সর্বাধিক সংখ্যক Ophioglossum reticulatum নামক ফার্নে 2n = ১২৬০। প্রাণীতে সর্বনিম্ন 2n = ২ (গোলকৃমি : | = Ascaris megalocephalas sub. sp. univalens) এবং সর্বাধিক 2n = ১৬০০ Aulacantha sp. তে। জীবজগতের ১০ ভাগ প্রজাতিরও ক্রোমোজোম সংখ্যা গণনা করা যায়নি। উচ্চতর জীবে সাধারণত প্রতি দেহকোষে ক্রোমোজোম সংখ্যা ২ থেকে ৫০-এর মধ্যে হয়ে থাকে।

ক্রোমোজোমের ভৌত গঠন (Physical structure of chromosome):

একটি কোষের ক্রোমোজোম একই দৈর্ঘ্যের হয় না। প্রজাতিভেদে এগুলোর দৈর্ঘ্য সাধারণত 0.25-50um এবং প্রস্থ 0.2-2um । মাইটোসিস বিভাজনের মেটাফেজ ধাপে ক্রোমোজোমগুলো স্থুল, প্যাঁচানো ও দন্ডাকার সূত্র হিসেবে দেখা যায়। তাই ক্রোমোজোমের আঙ্গিক গঠন পর্যবেক্ষণের উপযুক্ত সময় মেটাফেজ ধাপ।

একটি আদর্শ ক্রোমোজোমে 
নিম্নোক্ত অংশগুলো দেখা যায়।

১. ক্রোমাটিন (Chromatin) DNA ও হিস্টোন জাতীয় প্রোটিন দিয়ে গঠিত ক্রোমোজোমের মূল গঠন উপাদান (নিউক্লিওপ্রোটিন) হলো ক্রোমাটিন। এটি ক্ষারকীয় বন্ধক (ফুলজিন রক্ষক) দ্বারা গাঢ়ভাবে রঞ্জিত হয়। প্রাথমিকভাবে নিউক্লিওপ্রোটিন যৌগের সূত্রটি ১১০ পুরু যা ক্রমান্বয়ে কুরুলী পাকিয়ে ২০০ nm পুরু ক্রোমাটিনে পরিণত হয়। হিস্টোন প্রোটিনের সাথে সংযুক্ত অবস্থায় DNA কে বলা হয়। নিউক্লিওজো (nucleosome) Heitz (1928) ক্রোমাটিন ভল্লুকে দুভাগে ভাগ করেন। যথা- হেটেরোক্রোমাটিন (সক্রিয় জিন ধারণ করেনা) ও ইউক্রোমাটিন (সক্রিন জিন ধারণ করে)।

২. ক্রোমাটিড (Chromatid) : মাইটোসিস কোষ বিভাজনের প্রোফেজ MAT পর্যায়ে ক্রোমোজোম প্রথম দৃষ্টিগোচর হয় এবং মেটাফেল পর্যায়ে ক্রোমোজোমকে লম্বালম্বিভাবে দুটি অংশে বিভক্ত দেখা যায় যার প্রতিটির নাম ক্রোমাটিড থাকে। এরা (প্রতিটি ক্রোমোজোমে সমান ও সমান্তরাল একজোড়া ক্রোমাটিড সাধারণত সিস্টার ক্রোমাটিড নামে পরিচিত। আধুনিক ধারণা অনুযায়ী ক্রোমাটিড একটি একক DNA অণু দিয়ে গঠিত। প্রতিটি ক্রোমাটিড অনুদৈর্ঘ্যভাবে সাজানো দুই বা ততোধিক সুক্ষ্ণ সুত্রাকার ক্রোমোনেমাটা (chromonemata; একবচনে-ক্রোমোনেনা) নিয়ে গঠিত। আসলে প্রতিটি ক্রোমোনেমা তন্তু কুণ্ডলীকৃত ও ঘনীভূত হয়ে মেটাফেজ ধাপে এক একটি ক্রোমাটিড গঠন করে। তাই ক্রোমাটিড ও ক্রোমোনেমাটা একই সংগঠনের ভিন্ন ভিন্ন দুটি নামমাত্র অবস্থা।

৩. ক্রোমোমিয়ার (Chromomere): প্রতিটি ক্রোমোনেমা দৈর্ঘ্য বরাবর কতগুলো নির্দিষ্ট আকার এবং আয়তনের পুতির দানার মতো (bead চিত্র ১.২৫ : একটি ক্রোমোজোমের স্থল গঠন like) বস্তু ধারণ করে। এগুলোকে ক্রোমোমিয়ার বলে। DNA অণু কুন্ডলিত হয়ে এগুলো সৃষ্টি হয় বলে বিজ্ঞানীদের ধারণা।

৪. সেন্ট্রোমিয়ার (Centromere ) দুটি ক্রোমাটিড যে গোলাকার, বর্ণহীন ও সংকুচিত বিন্দুতে যুক্ত থাকে তার নাম সেন্ট্রোমিয়ার। এটিকে মুখ্য খাঁজ বা মুখ্য কৃষ্ণন (primary constriction) বলে। কারণ ক্রোমোজোমে সেন্ট্রোমিয়ারের মতো আরও সংকুচিত স্থান থাকতে পারে। (মুখ্য কুঞ্চনের উভয় দিকের সম বা অসম আকৃতির অংশকে বাহু (arm) বলে।) সেন্ট্রোমিয়ার এক বা একাধিক ক্ষুদ্র ক্রোমোমিয়ার এবং সূক্ষ তত্ত্ব নিয়ে গঠিত। স্বল্পসংখ্যক ব্যতিক্রম ছাড়া প্রতিটি ক্রোমোজোমে সাধারণত একটি মাত্র সেন্ট্রোমিয়ার থাকে। তবে একটি ক্রোমোজোমে ২টি বা অধিক সেন্ট্রোমিয়ার থাকতে পারে, আবার একটিও না থাকতে পারে। সেন্ট্রোমিয়ারের সংখ্যা অনুযায়ী ক্রোমোজোম তিন প্রকার। যথা-


মনোসেন্ট্রিক (Monocentric): এক সেন্ট্রোমিয়ার বিশিষ্ট ক্রোমোজোম। অধিকাংশ প্রজাতিতে মনোসেন্ট্রিক ক্রোমোজোম দেখা যায়।

ডাইসেন্ট্রিক (Dicentric) : দুই সেন্ট্রোমিয়ার বিশিষ্ট ক্রোমোজোম। গমের কয়েকটি প্রজাতিতে এধরনের ক্রোমোজোম দেখা যায়।

পলিসেন্ট্রিক (Polycentric) : দুই এর অধিক সেন্ট্রোমিয়ার বিশিষ্ট ক্রোমোজোম। কলা গাছের (Musa sp) কয়েকটি প্রজাতিতে পলিসেন্ট্রিক ক্রোমোজোম দেখা যায় ।


৫. কাইনেটোকোর (Kinetochore) : প্রতিটি সেন্ট্রোমিয়ারে একটি ছোট গাঠনিক অবকাঠামো থাকে। যার না কাইমেটোকোর। এতে মাইক্রোটিউবিউল সংযুক্ত থাকে। এটি স্পিন্ডল তন্তুর সাথে যুক্ত হয়ে কোষ বিভাজনের সময় ক্রোমোজোমের অ্যানাফেজিক চলনকে নিয়ন্ত্রণ করে।

৬. গৌণ বা সেকেন্ডারি কুঞ্চন (Secondary constriction) : সেন্ট্রোমিয়ারের মুখ্য কৃপান ছাড়াও ক্রোমোজোমের কোন কোন বাহুতে এক বা একাধিক গৌণ কুঞ্জন থাকতে পারে। এ কুঞ্জনকে নিউক্লিওলাস পুনর্গঠন অঞ্চলও বলে।

৭. স্যাটেলাইট (Satellite) : কোন কোন ক্রোমোজোমের এক বাহুর প্রান্তে ক্রোমাটিন সূত্র দিয়ে সংযুক্ত বা গোলাকার একটি অংশ দেখা যায়। এ গোলাকার অংশকে স্যাটেলাইট বলে। এরূপ স্যালো ইটযুক্ত ক্রোমোজোমকে স্যা ক্রোমোজোম (SAT-chromosome) বলা হয়।

৮. টেলোমিয়ার (Telomere = গ্রিক, lelos = প্রাপ্ত এবং merus = অংশ) (প্রতিটি ক্রোমোজোমের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ প্রান্তদ্বয়কে টেলোমিয়ার বলে) টেলোমিয়ারের অবস্থানের কারণেই ক্রোমোজোমের প্রান্তদুটি কখনও পরস্পর সংযুক্ত হয়ে পারে না।

৯. পেশিকল (Pellicle) ও মাতৃকা (Matrix): পূর্বে ধারণা করা হতো যে, প্রতিটি ক্রোমোজোম পাতলা একট আবরণ বা পেলিকলে আবৃত এবং এর অভ্যন্তর ভাগে রয়েছে প্রোটিন ও RNA পদার্থের স্তর বা মাতৃকা। আধুনিক গবেষণায় ইলেকট্রন অণুবীক্ষণযন্ত্রে এদের কোন অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি।

বিভিন্ন আকৃতির ক্রোমোজোমঃ
কোষ বিভাজনের অ্যানাফেজ পর্যায়ে ক্রোমোজোমগুলো কোষের বিষুবীয় অঞ্চল থেকে মেরুর দিকে যাত্রা করে। এসময় সেন্ট্রোমিয়ার অগ্রগামী হয়, ফলে সেন্ট্রোমিয়ারের অবস্থান অনুযায়ী ক্রোমোজোম বিভিন্ন আকৃতি প্রাপ্ত হয়। সেন্ট্রোমিয়ারের অবস্থান অনুযায়ী নিম্নলিখিত চার আকৃতির ক্রোমোজোম দেখা যায় ।

ক. মেটাসেন্ট্রিক (Metacentric) বা মধ্যকেন্দ্রিক : এধরনের ক্রোমোজোমের সেন্ট্রোমিয়ার ঠিক মাঝখানে অবস্থিত। ফলে মেটাসেন্ট্রিক ক্রোমোজোমের বাহু দুটি প্রায় সমান হয়। কোষ বিভাজনের অ্যানাফেজ দশায় মেটাসেন্টিক ক্রোমোজোমকে ইংরেজী 'V' অক্ষরের মত দেখায়।

খ. সাবমেটাসেন্ট্রিক (Submetacentric) বা উপমধ্যকেন্দ্রিক : এ ধরনের ক্রোমোজোমের সেন্ট্রোমিয়ার মাঝখানে না থেকে সামান্য দূরে থাকে। অ্যানাফেজ দশায় এ ধরনের ক্রোমোজোমকে ইংরেজী 'L' অক্ষরের মত দেখায় করণ ক্রোমোজোমের একটি বাহু অন্য বাহুর চেয়ে কিছুটা বড় থাকে।

গ. অ্যাক্রোসেট্রিক (Acrocentric) বা উপ-প্রান্তকেন্দ্রিক : এসব ক্রোমোজোমে সেন্ট্রোমিয়ারটি একেবারে প্রান্তের কাছাকাছি থাকে। অ্যাক্রোসেন্ট্রিক ক্রোমোজোমের বাহু দুটির দৈর্ঘ্যের ব্যবধান বেশি। অ্যানাফেজ দশায় এ ধরনের ক্রোমোজোমকে ইংরেজী অক্ষরের মত দেখায়।

ঘ. টেলোসেন্ট্রিক (Telocentric) বা প্রান্তকেন্দ্রিক : সেন্ট্রোমিয়ারটি একেবারে প্রান্তভাগে এ ক্রোমোজোমে অবস্থিত। অ্যানাফেজ ধাপে টেলোসেন্ট্রিক ক্রোমোজোমকে ইংরেজী 'I' অক্ষরের মত কিংবা একটি দন্ডের মত দেখায়।

ক্রোমোজোমের ধরণঃ
প্রকৃত কোষের ক্রোমোজোমসমূহকে কাজের উপর নির্ভর করে দুভাগে ভাগ করা যায়; যথা-

• অটোজোম (Autosome) : এসব ক্রোমোজোম দৈহিক বৈশিষ্ট্য নিয়ন্ত্রণকারী জিন বহন করে। অক্টোজোমের সেটকে A চিহ্ন দ্বারা প্রকাশ করা হয়। মানুষে ২৩ জোড়া ক্রোমোজোমের মধ্যে ২২ জোড়া অটোজোম থাকে।

• সেক্স ক্রোমোজোম (Sex chromosome) এসব ক্রোমোজোম জীবের লিঙ্গ নির্ধারণ করে। সেক্স ক্রোমোজোম প্রকার: যথা - XY। মানুষের একজোড়া সেন্স ক্রোমোজোম থাকে। স্ত্রীদেহে দুটি সেক্স ক্রোমোজোম একই ধরনের (XX) এবং পুরুষদেহে সেক্স ক্রোমোজোম দুটি ভিন্ন ধরনের (XY) হয়।

ক্রোমোজোমের উপকরণঃ
নিউক্লিক এসিড ও প্রোটিনের সমন্বয়ে ক্রোমাটিন পদার্থ তৈরি হয়। ক্রোমাটিন পদার্থ ক্রোমোজোম গঠন করে। এক ধারণের উপর ভিত্তি করে ক্রোমাটিন পদার্থকে দুভাগে ভাগ করা হয়েছে।

১. ইউক্রোমাটিন (Euchromatin) ইন্টারফেজ দশায় ক্ষারীয় রঞ্জক (অ্যাসিটোকারমিন, ক্ষারীয় ফুসকিন) দিয়ে রঞ্জিত করলে ক্রোমোজোমের যে অংশ হালকা বর্ণ ধারণ করে তাকে ইউক্রোমাটিন বলে। এ অঞ্চলে অধিক পরিমাণে DNA থাকে এবং বংশগতিতে সক্রিয় ভূমিকা রাখে। এটি ক্রোমোজোমের বিস্তৃত অংশ এবং mRNA সংশ্লেষণে অংশগ্রহণ করে থাকে।

২. হেটারোক্রোমাটিন (Heterochromatin) : ইন্টারফেজ পর্যায়ে ক্ষারীয় রঞ্জক দিয়ে রঞ্জিত করবে ক্রোমোজোমের যে অংশ গাঢ় বর্ণ ধারণ করে তাকে হেটারোক্রোমাটিন বলে। এ অংশে স্বল্প পরিমাণ DNA থাকে এব বংশগতিতে সক্রিয় ভূমিকা রাখেনা। এটি নিবিড়ভাবে কুণ্ডলিত থাকে এবং mRNA সংশ্লেষণে অংশগ্রহণ করে না।

ক্রোমোজোমের রাসায়নিক গঠন বা উপাদান (Chemical structure of chromosome) ক্রোমোজোমের রাসায়নিক গঠন বেশ জটিল। এর প্রধান উপাদান হচ্ছে-নিউক্লিক এসিড ও প্রোটিন। অন্যান্য উপাদানের মধ্যে রয়েছে-লিপিড, ক্যালসিয়াম, আয়রণ, ম্যাগনেসিয়াম আয়ন, এনজাইম ও অন্যান্য রাসায়নিক পদার্থ থাকে।

ক্রোমোজোমের কাজ :
* ক্রোমোজোম পিতামাতার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সন্তান-সন্ততিতে সঞ্চারিত করে। 
* নিউক্লিয়াসের আকার-আকৃতি প্রদান করে।  *DNA-এর ছাঁচ অনুযায়ী তৈরি mRNA-এর মাধ্যমে প্রোটিন সংশ্লেষ নিয়ন্ত্রণ করে। 
*ক্রোমোজোমে অবস্থিত জিন প্রজাতির বংশাণুক্রমিক বৈশিষ্ট্যের ধারক ও বাহক হিসেবে কাজ করে।
* বিভক্তির মাধ্যমে ক্রোমোজোম কোষ বিভাজনে প্রত্যক্ষ অবদান রাখে।
* সেক্স ক্রোমোজোম জীবের লিঙ্গ নির্ধারণে বিশেষ ভূমিকা রাখে ।

Content added || updated By
Promotion