জীবনকে সুন্দর করতে হলে সৌন্দর্যের নিদর্শন শিল্পকে সাধারণ জীবনে বিশিষ্ট একটু স্থান দেওয়া দরকার । আমাদের বাড়ি সুন্দর হওয়া চাই, বাড়ির প্রাঙ্গণ সুন্দর হওয়া চাই, বাড়ির আসবাবপত্র সুন্দর হওয়া চাই,বাড়ির সাজ-সরঞ্জাম সুন্দর হওয়া চাই, বাড়ির বেষ্টনীও সুন্দর হওয়া চাই। তারপর আমরা যা পরি, আমরা যা ব্যবহার করি, সবই সুন্দর হওয়া চাই। কেবল তাই নয়- আমাদের বসবার ভঙ্গি সুন্দর হওয়া চাই, আমাদের উঠবার ভঙ্গি সুন্দর হওয়া চাই, আমাদের কথা বলবার ভঙ্গি সুন্দর হওয়া চাই, আমাদের প্রত্যেকটি অঙ্গভঙ্গি, আমাদের প্রত্যেকটি আচার, প্রত্যেকটি ব্যবহার সুন্দর হওয়া চাই। যা অসুন্দর, যা কদর্য, যা কুৎসিৎ, যা কদাকার সে সবকে কোন-না-কোন উপায়ে জীবন থেকে আমাদের তাড়াতে হবে। সত্য যেমন বাঞ্ছনীয় জীবনের অপরিহার্য একটি অঙ্গ, শ্রেয় যেমন বাঞ্ছনীয় জীবনের অপরিহার্য একটি অঙ্গ, সুন্দরও তেমনি সেই বাঞ্ছনীয় জীবনেরই অপরিহার্য একটি অঙ্গ। প্রাচীন গ্রীকেরা যে একান্তভাবে সৌন্দর্যপ্রিয় ছিলেন পাঠক সে কথা জানেন। তাঁরা যুদ্ধ-কুশল এবং যুদ্ধপ্রিয়ও ছিলেন। তাদের বিষয় আমি পড়েছি, যুদ্ধের সময় সর্বাঙ্গ লাল কাপড়ে আবৃত করে তাঁরা যুদ্ধে যেতেন, রক্তের দাগ দেহকে তাদের যাতে কুৎসিৎ, কদাকার করে না তোলে সেই উদ্দেশ্যে। আমাদেরও তাঁদেরই মতো জীবনকে সর্বপ্রকার কদর্যতা থেকে দূরে রাখবার চেষ্টা করতে হবে।
বাংলাদেশের গ্রামে এবং শহরে কি দৃশ্য আমরা দেখতে পাই? আমার নিজের এবং আশেপাশের গ্রামগুলির কথাই এখন বলি। মোটরযোগে কিংবা পদব্ৰজে District Board-এর রাস্তা বেয়ে গ্রামের দিকে অগ্রসর হই, তখন স্পষ্টই মনে হয়, District Board-এর কর্তারা জীবনে সৌন্দর্যের প্রয়োজনীয়তা মোটে উপলব্ধি করেন না! সরু, অসমান পথ, দুধারে তার আগাছার রাশ। পথের পাশ দিয়ে চলে গেছে নর্দমা, তাতে কতরকম আবর্জনা যে পড়ে আছে তা বর্ণনা করা যায় না। অদূরে বাঁশের বন, তাতে মানুষও প্রবেশ করতে পারে না, আলোকও প্রবেশ করতে পারে না। ডোবা, পুষ্করিণী, মজানদী সবই লতাগুল্মে ভরা— কোনো সৌন্দর্য সৃষ্টির প্রয়াসের চিহ্ন পর্যন্ত পাওয়া যায় না। আমরা দেশ নিয়ে গর্ব করতে ভালোবাসি। বক্ষ স্ফীত করে সব সময়ে আমরা বলে থাকি বাংলাদেশের মতো সুন্দর দেশ কোথাও নাই । কিন্তু সত্যই কি তাই!
এই সেদিন আমি শিমুলতলায় গিয়েছিলাম। সেখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আমায় মুগ্ধ করেছিল। আমার সঙ্গে এক তরুণ বন্ধু ছিলেন। বাংলাদেশকে তিনি বড়োই ভালোবাসেন। শিমুলতলায় যাবার পূর্বে তাঁর কাছে বাংলা দেশের সৌন্দর্যের প্রশংসা অহরহ শুনতে পেতুম । ফেরবার সময় যখন আমাদের ট্রেন বাংলার মাটিতে প্রবেশ করলে তখন দেখলুম আমার তরুণ বন্ধু মাতৃভূমির সৌন্দর্যের বিষয়ে তাঁর মত সম্পূর্ণরূপে বদলে ফেলেছেন। সত্যই, বর্ধমান থেকে কলকাতায় আসতে যে কদর্যতা আমাদের দৃষ্টিকে ব্যথায় জর্জরিত করে, তা দেখে মনে হয় না যে আমাদের দেশের লোকেরা জীবনের সৌন্দর্যের প্রয়োজনীয়তা কিছুমাত্র উপলব্ধি করছেন।
আমার গ্রামের কথায় ফেরা যাক্। District Board-এর রাস্তা থেকে যে পথ গ্রামে গিয়েছে সে পথ এত সরু যে, তার উপর দিয়ে কোন রকম যানবাহন চালান একান্ত কঠিন ব্যাপার। সেই সরু রাস্তাকে গ্রামবাসীদের সৌন্দর্য অনুভূতিহীন স্বার্থপরতা নিত্যই আরও সরু করে তুলছে। সকলেই সাধারণের রাস্তার এক ইঞ্চি, দুই ইঞ্চি কিংবা ততোধিক পরিমাণ জমি নিজের এলাকাভুক্ত করবার জন্য ব্যগ্র। রাস্তার সৌন্দর্যের দিকে কারও দৃষ্টি নাই, সৌন্দর্য নামক জিনিসটার দিকেই কারও দৃষ্টি নাই। গ্রামে অনেকগুলি কোঠাবাড়ি আছে। সে সব প্রস্তুত করতে যথেষ্ট অর্থ ব্যয় হয়েছে। কিন্তু সৌন্দর্যানুভূতির কোন নিদর্শন বাড়িগুলির ভিতরেও পাওয়া যায় না আর বাইরেও পাওয়া যায় না। এক কাঠা জমি ও কেউ সুন্দরভাবে সাজাতে চেষ্টা করেনি। কেউ হয়তো কিছু ফার্নিচার, দু’একখানা ছবি একটা ঘরে রেখেছে। কিন্তু সে ঘরে প্রবেশ করলেই বোঝা যায়, যে গৃহস্বামী Taste বা রুচি জিনিসটার সঙ্গে দূর সম্পর্কও রাখে না। মাটির বাড়ির অবস্থা কোঠাবাড়ির চেয়েও শোচনীয়,আর বাগান, পুষ্করিণী প্রভৃতির বিষয়ে কিছু না বলাই ভালো ।
পল্লিগ্রামের বিষয় যা বলা হলো, শহরের বেলাতেও তাই বলা চলে। শহরের ঘরবাড়ি, আসবাবপত্র, বাড়ির বেষ্টনী প্রভৃতি দেখলে স্পষ্টই বোঝা যায় যে, আমাদের দেশবাসীরা জীবনে সৌন্দর্যের প্রয়োজন মোটেই অনুভব করেন না, সুন্দর কি আর অসুন্দর কি সে বিষয়ে তাঁদের ধারণা একান্তই কুহেলিকাবৃত ৷
আমি এক স্থানে বলেছি, পুনরায় বলি, সবচেয়ে বড়ো শিল্প হচ্ছে জীবন-শিল্প। অন্য সব রকমের শিল্প হচ্ছে সেই বিরাট জীবন শিল্পেরই এক একটি বিভাগমাত্র। প্রত্যেকটি বিভাগের দিকে আমাদের দৃষ্টি রাখা দরকার, জীবন-শিল্পকে সার্থক করার জন্যে । আর যদি সত্যই তা করতে হয়, তবে আমাদের কাজকর্মকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, আমাদের নাগরিক জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, আমাদের রাষ্ট্রীয় জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, এক কথায় আমাদের জীবনের প্রত্যেকটি বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। আর সেজন্য দরকার ব্যাপক এবং ঐকান্তিক সমবায়িক প্ৰচেষ্টা ।পাঠক বলবেন, এত বড়ো প্রচেষ্টার কথা বলা সহজ, করা সহজ নয়। ক্ষুদ্র আমি এতে কী করতে পারি? তবে বলি শুনুন । আপনি এতে অনেক কিছু করতে পারেন। আপনার বাড়িকে সুন্দর করে সাজান। আপনার বাড়ির উঠানকে, আশ-পাশের জমিকে পত্রেপুষ্পে শোভিত করে তুলুন । আপনার পোশাক - পরিচ্ছদ আর্টের এক একটি নিদর্শন হোক। সুন্দর এক বেষ্টনী আপনার জীবনে ঘিরে থাকুক। সুন্দরের প্রশংসায় আপনার কণ্ঠ মুখরিত হোক। দেখবেন নিজেকে যতটা ক্ষুদ্র মনে করেছিলেন ততটা ক্ষুদ্র আপনি নন। আর দেখবেন, আপনার স্তব-স্তুতিতে, আপনার সাধনায় তুষ্ট হয়ে সৌন্দর্যদেবী আপনার গ্রামে, আপনার পাড়ায় সশরীরে আবির্ভূত হয়েছেন।
হুগলি জেলার শ্রীরামপুরস্থ বড়তাজপুর গ্রামে ১৮৯০ সালের ৪ঠা সেপ্টেম্বর এস. ওয়াজেদ আলি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা শেখ বেলায়েত আলী পেশায় ছিলেন একজন ব্যবসায়ী। শিলং-এর মোখার হাইস্কুল থেকে স্বর্ণপদকসহ এন্ট্রান্স পাসের পর তিনি আলীগড় কলেজ থেকে আই. এ. এবং ১৯১০ সালে এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় থকে বি.এ. পাস করেন । ১৯১৫ সালে কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বার অ্যাট-ল ডিগ্রি লাভ করে তিনি কলকাতা হাইকোর্টে আইন ব্যবসা শুরু করেন। ১৯২৩ সালে তিনি কলকাতা প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট নিযুক্ত হন । ১৯২৫ সালে তিনি বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হন। সত্য ও সুন্দরের সাধনায়, নীতিজ্ঞান, ধর্মবোধ ও প্রেমের শাশ্বত মহিমায় মার্জিত রুচি ও পরিচ্ছন্ন রসবোধে তাঁর সাহিত্যকর্ম সমৃদ্ধ। তাঁর উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধ গ্রন্থ : জীবনের শিল্প (১৯৪১), প্রাচ্য ও প্রতীচ্য (১৯৪৩), ভবিষ্যতের বাঙালি (১৯৪৩); গল্পগ্রন্থ : গুলদাস্তা (১৯২৭), মাশুকের দরবার (১৯৩০), বাদশাহী গল্প (১৯৪৪), গল্পের মজলিশ (১৯৪৪); ভ্রমণকাহিনী : মোটরযোগে রাঁচির সফর (১৯৪৯), পশ্চিম ভারত (১৩৫৫)। প্রকৃতপক্ষে এস. ওয়াজেদ আলি ছিলেন বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী একজন মনীষী। ১৯৫১ সালের ১০ই জুন তিনি কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।
পদব্রজ - পায়ে হাঁটা। নর্দমা – পয়ঃপ্রণালি, ড্রেন। মজানদী - জলহীন নদী, এমন, শুকিয়ে যাওয়া নদী। স্ফীত – ফুলে বা ফেঁপে উঠেছে গর্বিত। কোঠাবাড়ি পাকাবাড়ি, - - অট্টালিকা, দালান। ফার্নিচার – আসবাবপত্র। কুহেলিকাবৃত – কুয়াশা আবৃত, প্রচ্ছন্ন। সমবায়িক - - সম্মিলিত উদ্যোগে কোনো কিছু গড়ে তোলার প্রয়াস, দলবদ্ধ প্রচেষ্টা ।
বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত এস. ওয়াজেদ আলি রচনাবলি থেকে, ‘জীবনে শিল্পের স্থান' শীর্ষক প্রবন্ধটি সংকলিত হয়েছে। সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ। তবে মন না থাকলে মানুষ হয় না। আর এ মনকে সর্বদা মানস-সৌন্দর্যের চর্চায় নিবেদিত হতে হয়। কথাবার্তা, আচরণ, খাদ্য গ্রহণ, পোশাক নির্বাচন, গৃহসজ্জা, গৃহের চারপাশের পরিচ্ছন্নতা প্রভৃতি মানুষের জীবনকে সুন্দর ও আনন্দময় করে তোলে । এর ফলে পরিবার, সমাজ, জাতি, দেশ নির্বিশেষে একটি সুদৃঢ় ব্যবস্থাপনার নিদর্শনরূপে গড়ে ওঠে। ‘জীবন শিল্পের স্থান' প্রবন্ধটিতে এস. ওয়াজেদ আলি জীবন ও সৌন্দর্যবোধের সম্পর্ক দেখিয়েছেন। প্রবন্ধটি সৌন্দর্যবোধে উদ্বুদ্ধ হবার শিক্ষা দেয়।
আরও দেখুন...