বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৪-১৯৫০) একজন বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক। তাঁর সবচেয়ে জনপ্রিয় উপন্যাস 'পথের পাঁচালি'। এই উপন্যাস থেকে সত্যজিৎ রায় একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন যা আন্তর্জাতিক খ্যাতি পায়। বিভূতিভূষণের উল্লেখযোগ্য বইয়ের মধ্যে রয়েছে 'অপরাজিত', 'আরণ্যক', 'চাঁদের পাহাড়', 'ইছামতী', 'অশনি সংকেত' ইত্যাদি। নিচের অংশটুকু 'পথের পাঁচালি' থেকে নেওয়া।
অপু জন্মিয়া অবধি কোথাও কখনো যায় নাই। এ গাঁয়েরই বকুলতলা, গোঁসাইবাগান, চালতেতলা, নদীর ধার, বড়ো জোর নবাবগঞ্জ যাইবার পাকা সড়ক- এই পর্যন্ত তাহার দৌড়। মাঝে মাঝে বৈশাখ কি জ্যৈষ্ঠ মাসে খুব গরম পড়িলে বৈকালে দিদির সঙ্গে নদীর ঘাটে গিয়া দাঁড়াইয়া থাকিত। আজ সেই অপু সর্বপ্রথম গ্রামের বাহিরে পা দিল। কয়েকদিন হইতেই উৎসাহে তাহার রাত্রিতে ঘুম হওয়া দায় হইয়া পড়িয়াছিল। দিন গনিতে গনিতে অবশেষে যাইবার দিন আসিয়া গেল।
তাহাদের গ্রামের পথটি বাঁকিয়া নবাবগঞ্জের সড়ককে ডাইনে ফেলিয়া মাঠের বাহিরে আষাঢ় দুর্গাপুরের কাঁচা রাস্তার সঙ্গে মিশিয়াছে। দুর্গাপুরের রাস্তায় উঠিয়াই সে বাবাকে বলিল-বাবা যেখান দিয়ে রেল যায়, সেই রেলের রাস্তা কোন দিকে? তাহার বাবা বলিল- সামনেই পড়বে এখন, চল না! আমরা রেললাইন পেরিয়ে যাব এখন।
সেবার তাদের রাঙ্গী-গাইয়ের বাচ্চুর হারাইয়াছিল। নানা জায়গায় দুই-তিন দিন ধরিয়া খুঁজিয়াও কোথাও পাওয়া যায় নাই। সে তাহার দিদির সঙ্গে দক্ষিণ মাঠে বাছুর খুঁজিতে আসিয়াছিল।
তাহার দিদি পাকা রাস্তার ওপারে বহুদূর ঝাপসা মাঠের দিকে একদৃষ্টে চাহিয়া কী দেখিতেছিল, হঠাৎ সে বলিয়া উঠিল-এক কাজ করবি অপু, চল যাই আমরা রেলের রাস্তা দেখে আসি, যাবি?
অপু বিস্ময়ের সুরে দিদির মুখের দিকে চাহিয়া বলিল- রেলের রাস্তা, সে যে অনেক দূর! সেখানে কী করে যাবি?
তাহার দিদি বলিল-বেশি দূর বুঝি! কে বলেছে তোকে? ঐ পাকা রাস্তার ওপারে তো!
অপু বলিল কাছে হলে তো দেখা যাবে। পাকা রাস্তা থেকে দেখা যায় যদি, চল গিয়ে দেখি।
দুইজনে অনেকক্ষণ নবাবগঞ্জের সড়কে উঠিয়া, চারিদিকে চাহিয়া দেখিল। তাহার দিদি বলিল-বড্ড অনেক দূর, বোধ হয় যাওয়া যাবে না! কিছু তো দেখা যায় না-অত দূরে গেলে আবার আসব কী করে?
তাহার সতৃষ্ণ দৃষ্টি কিন্তু দূরের দিকে আবদ্ধ ছিল; লোভও হইতেছিল, ভয়ও হইতেছিল। হঠাৎ তাহার দিদি মরিয়াভাবে বলিয়া উঠিল-চল যাই, গিয়ে দেখে আসি অপু-কতদূর আর হবে? দুপুরের আগে ফিরে আসব এখন। হয়তো রেলের গাড়ি দেখা যাবে এখন। মাকে বলব বাচ্চুর খুঁজতে দেরি হয়ে গেল।
প্রথম তাহারা একটুখানি এদিক ওদিক চাহিয়া দেখিল কেহ তাহাদিগকে লক্ষ করিতেছে কি না। পরে পাকা রাস্তা হইতে নামিয়া পড়িয়া দুপুর রোদে ভাইবোনে মাঠ-বিল-জলা ভাঙ্গিয়া সোজা দক্ষিণ মুখে ছুটিল।
দৌড়, দৌড়, দৌড় . . . . . .
পরে যাহা হইল, তাহা সুবিধাজনক নয়, খানিক দূরে গিয়া একটা বড়ো জলা পড়িল একেবারে সামনে হোগলা আর শোলা গাছে ভরা; এইখানে আসিয়া তাহারা পথ হারাইয়া ফেলিল। কোনো গ্রামও চোখে পড়ে না-সামনে ও দুপাশে কেবল ধানখেত, জলা আর বেতঝোপ। ঘন বেতবনের ভিতর দিয়া যাওয়া যায় না, পাঁকে পা পুঁতিয়া যায়। শেষে রৌদ্র এমন বাড়িয়া উঠিল যে, শীতকালেও তাহাদের গা দিয়া ঘাম ঝরিতে লাগিল। দিদির পরনের কাপড় কাঁটায় নানা স্থানে ছিঁড়িয়া গেল, তাহার নিজের পায়ের তলা হইতে দু-তিনবার কাঁটা টানিয়া টানিয়া বাহির করিতে হইল। শেষে রেলরাস্তা দূরের কথা, বাড়ি ফিরাই মুশকিল হইয়া উঠিল। অনেক দূরে আসিয়া পড়িয়াছে, পাকা রাস্তাও আর দেখা যায় না। জলা ভাঙ্গিয়া ধানখেত পার হইয়া যখন তাহারা বহু কষ্টে আবার পাকা রাস্তায় উঠিয়া আসিল, তখন দুপুর ঘুরিয়া গিয়াছে। বাড়ি আসিয়া তাহার দিদি ঝুড়ি ঝুড়ি মিথ্যা কথা বলিয়া তবে নিজের ও তাহার পিঠ বাঁচাইল।
সেই রেলের রাস্তা আজ এমনি সহজভাবে সামনে পড়িবে সেজন্য ছুটিতে হইবে না, পথ হারাইতে হইবে
না-বকুনি খাইতে হইবে না!
কিছুদূর গিয়া সে বিস্ময়ের সহিত চাহিয়া দেখিল নবাবগঞ্জের পাকা সড়কের মতো একটা উঁচুমতো রাস্তা মাঠের মাঝখান চিরিয়া ডাইনে-বাঁয়ে বহুদূর গিয়াছে। রাঙ্গা রাঙ্গা খোয়ার রাশি উঁচু হইয়া ধারের দিকে সারি দেওয়া। সাদা সাদা লোহার খুঁটির উপর যেন একসঙ্গে অনেক দড়ির টানা বাঁধা; যতদূর দেখা যায় ঐ সাদা খুঁটি ও দড়ির টানা বাঁধা দেখা যাইতেছে।
তাহার বাবা বলিল-ঐ দেখ খোকা রেলের রাস্তা।
অপু একদৌড়ে ফটক পার হইয়া রাস্তার উপর আসিয়া উঠিল। পরে সে রেলপথের দুই দিকে বিস্ময়ের চোখে চাহিয়া চাহিয়া দেখিতে লাগিল। দুইটা লোহা বরাবর পাতা কেন?... উহার উপর দিয়া রেলগাড়ি যায়? ... কেন? মাটির উপর দিয়া না গিয়া লোহার উপর দিয়া যায় কেন? ... পিছলাইয়া পড়িয়া যায় না কেন? ... ওগুলোকে তার বলে? তারের মধ্যে সোঁ সোঁ কীসের শব্দ?... তারে খবর যাইতেছে? ... কাহারা খবর দিতেছে? ... কী করিয়া খবর দেয়?... ওদিকে কি ইস্টিশান? এদিকে কি ইস্টিশান?-কিছুক্ষণ এইভাবে ক্রমাগত প্রশ্ন চলিল।
শেষে অপু বলিল-বাবা, রেলগাড়ি কখন আসবে? আমি রেলগড়ি দেখব বাবা।
- রেলগাড়ি এখন কী করে দেখবে? সেই দুপুরের সময়ে রেলগাড়ি আসবে, এখনো চার-পাঁচ ঘণ্টা দেরি।
- তা হোক বাবা, আমি দেখে যাব, আমি কখনো দেখিনি। হ্যাঁ বাবা?
-ও রকম কোরো না, ঐজন্যে তো তোমায় কোথাও আনতে চাইনে-এখন কী করে দেখবে? সেই দুপুর অবধি বসে থাকতে হবে তাহলে এই ঠায় রোদ্দুরে! চল, আসবার দিন দেখাব। অপুকে অবশেষে জলভরা চোখে বাবার পিছনে পিছনে অগ্রসর হইতে হইল।
অগ্রসর: সামনে যাওয়া।
অবধি: পর্যন্ত।
আবদ্ধ থাকা: আটকে থাকা।
একদৃষ্টে: অপলক চোখে।
গনিতে গনিতে: গুনতে গুনতে।
ঝাপসা: অস্পষ্ট।
ফটক: সদর দরজা।
রাঙ্গী গাই: লাল রঙের গাভি।
শোলা গাছ: জলাভূমিতে উৎপন্ন গুল্ম জাতীয় গাছ।
সতৃষ্ণ দৃষ্টি: আগ্রহী চোখ।
হোগলা: জলাভূমিতে উৎপন্ন তৃণ জাতীয় উদ্ভিদ।
'রেলের পথ' গল্প থেকে সর্বনাম শব্দ খুঁজে বের করো এবং নিচের ছকের বাম কলামে লেখো। এরপর সর্বনামগুলোর প্রমিত রূপ ডান কলামে লেখো। কাজ শেষে সহপাঠীদের সঙ্গে মিলিয়ে নাও এবং প্রয়োজনে সংশোধন করো। একটি নমুনা উত্তর করে দেওয়া হলো।
গল্পে ব্যবহৃত সর্বনাম শব্দ | শব্দের প্রমিত রূপ |
তাহার | তার |
|
|
|
|
|
|
|
|
একইভাবে গল্প থেকে ক্রিয়া শব্দ খুঁজে বের করো এবং নিচের ছকের বাম কলামে লেখো। এরপর ক্রিয়াগুলোর প্রমিত রূপ ডান কলামে লেখো। কাজ শেষে সহপাঠীদের সঙ্গে মিলিয়ে নাও এবং প্রয়োজনে সংশোধন করো। একটি নমুনা উত্তর করে দেওয়া হলো।
গল্পে ব্যবহৃত সর্বনাম শব্দ | শব্দের প্রমিত রূপ |
আসিয়াছিল | এসেছিল |
|
|
|
|
|
|
|
|
সাধুরীতি হলো লিখিত বাংলা ভাষার একটি সেকেলে রূপ। এই রীতিতে কেউ কথা বলত না, এটি ছিল কেবল লেখার ভাষা। এক সময়ে লিখিত ভাষার আদর্শ রূপ হিসেবে এটি ব্যবহৃত হতো। এই রীতিতে সর্বনাম ও ক্রিয়া শব্দের রূপ মুখের ভাষার তুলনায় অপেক্ষাকৃত দীর্ঘ। উনিশ ও বিশ শতকের প্রচুর সাহিত্যকর্ম এই রীতিতে লেখা হয়েছে। ১৯৭২ সালে গৃহীত বাংলাদেশের সংবিধানও সাধুরীতিতে রচিত। 'রেলের পথ' গল্পটি সাধুরীতির একটি নমুনা।
'রেলের পথ' গল্প থেকে সাধুরীতির কয়েকটি বাক্য নিচের ছকে লেখো এবং একইসঙ্গে বাক্যগুলোকে প্রমিত গদ্যরীতিতে রূপান্তর করো। কাজ শেষে সহপাঠীদের সঙ্গে আলোচনা করো এবং প্রয়োজনে সংশোধন করে নাও। একটি নমুনা-উত্তর করে দেওয়া হলো।
সাধুরীতির বাক্য | প্রমিত রূপ |
১. দিন গনিতে গনিতে অবশেষে যাইবার দিন আসিয়া গেল।
| ১. দিন গুনতে গুনতে অবশেষে যাওয়ার দিন এসে গেল।
|
২.
| ২.
|
৩.
| ৩.
|
৪.
| ৪.
|
৫.
| ৫.
|
৬.
| ৬.
|
৭.
| ৭.
|
৮.
| ৮.
|
৯.
| ৯.
|
১০.
| ১০.
|
নিচের বিষয়গুলো প্রমিত ভাষায় উপস্থাপন করতে হবে। প্রথমে তার একটি লিখিত খসড়া তৈরি করো। তারপরে প্রমিত উচ্চারণে সেগুলো পাঠ করো।
১. সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বা আলোচনা অনুষ্ঠান সঞ্চালনা
২. স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস কিংবা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে বক্তৃতা
৩. টেলিভিশন বা রেডিওর সংবাদ উপস্থাপন
৪. নিজের কোনো অভিজ্ঞতার বিবরণ
৫. লাইব্রেরিয়ান, ডাক্তার বা অপরিচিত লোকের সঙ্গে আলাপ।
আরও দেখুন...