'জোঁক' গল্পের আলোকে নিচে কয়েকটি প্রশ্ন দেওয়া হলো। ১০০-১৫০ শব্দের মধ্যে প্রশ্নগুলোর উত্তর প্রস্তুত করো এবং পরে সহপাঠীদের সঙ্গে আলোচনা করে প্রয়োজনে নিজের উত্তর সংশোধন করো।
১। কৃষক ওসমানের জীবনের আনন্দ ও বেদনার কয়েকটি দিক তুলে ধরো।
২। দশ বছর বয়সী তোতা তার পিতা ওসমানের সঙ্গে কাজ করে এ ব্যাপারে তোমার মতামত কী?
৩। 'রক্ত চুইষ্যা খাইছে। অজম করতে দিমু না, যা থাকে কপালে।'-কে কেন বলেছে ব্যাখ্যা করো।
৪। 'জোঁক' গল্পে লেখক সমাজের কোন বিষয়ের দিকে ইঙ্গিত করেছেন? এই কাহিনির সঙ্গে বাস্তব জীবনের কোনো সাদৃশ্য তোমার চোখে পড়ে কি না?
আনোয়ারা সৈয়দ হক (১৯৪০) একজন বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক। শিশুসাহিত্যিক হিসেবে তিনি সুপরিচিত। শিশু- কিশোরদের জন্য রচিত তাঁর উল্লেখযোগ্য বইয়ের নাম 'ছানার নানাবাড়ি', 'বাবার সঙ্গে ছানা', 'ছানা ও মুক্তিযুদ্ধ' ইত্যাদি। নিচের গল্পটি তাঁর 'কত রকমের গল্প' বই থেকে নেওয়া হয়েছে।
গল্পটি প্রথমে নীরবে পড়ো। পড়ার সময়ে বোঝার চেষ্টা করো। এরপর সরবে পড়ো।
ফাল্গুন মাস। বেশ ফুরফুরে বাতাস বইছে। ঘুম থেকে উঠে শিউলি ভাবল, এই যাঃ, আজ না আমার ফুল কুড়োতে যাবার কথা! যেমনি ভাবা, তেমনি কাজ। মুখ না ধুয়েই শিউলি একেবারে এক দৌড়ে তাদের বাড়ির বাগানে গিয়ে হাজির। কত রকমের যে ফুল গাছ আছে তাদের বাগানে। আছে কদম, শেফালি, স্বর্ণচাঁপা; আছে রক্তকরবী, টগর, বেলফুল, গন্ধরাজ। শিউলির খুবই ভালো লাগে এই সব ফুলগাছের নিচে গিয়ে ফুল কুড়োতে। শিউলির কোনো ভাইবোন নেই, তাই বেচারি একা একাই ফুল কুড়িয়ে বেড়ায়, একা একাই ফুল দিয়ে মালা গাঁথে, খেলা করে। সে সবেমাত্র নতুন ক্লাসে উঠেছে। পড়াশোনার বেশি চাপ নেই। আর চাপ থাকলেও শিউলির পড়া শিখে ফেলতে বেশি দেরি লাগে না। ওর মাথায় খুব বুদ্ধি তো। যা পড়ে তাই মনে রাখতে পারে।
এই ভোরবেলাটা শিউলির খুব ভালো লাগে। তখন সবাই ঘুমিয়ে থাকে, এমনকি শিউলির পুষি বেড়ালটা পর্যন্ত। আর চারদিকে কোনো হইচই নেই। শুধুমাত্র পাখিদের হইচই ছাড়া। শিউলি আজ হেঁটে হেঁটে একেবারে বাগানের পশ্চিম দিকে চলে গেল। এদিকে বুনো গাছগাছালির ঝোপ আর তার ভিতরে একটা ফুলে-ভরা গন্ধরাজ গাছ। অনেক ফুল সেই গাছে। শিউলি ভাবল, যাই আজ গন্ধরাজের মালা গাঁথি।
এই কথা ভাবতে ভাবতে শিউলি ঝোপের ভেতরে হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকে পড়ল; তারপর গন্ধরাজ গাছটার দিকে উঠে দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে দিল। এমন সময়ে সে চমকে গিয়ে শুনতে পেল, কে যেন সরু গলায় চিৎকার করে বলছে, 'ওরে বাবা রে, মরে গেলাম রে! আমাকে বাঁচাও রে!
কথা শুনে তো ভয়ে শিউলির মাথার চুল দাঁড়িয়ে গেল। এসব আবার কী কাণ্ড! ঝোপের মধ্যে কে আবার কোথায় সাহায্য চাইছে। দরকার কি বাবা আমার এখানে থাকার, এই ভেবে শিউলি ঝোপ ছেড়ে পালিয়ে আসতে যাবে যেই, ওমনি আবার শুনতে পেল, 'ওগো মেয়ে, তুমি চলে যেও না, দয়া করে আমাকে বাঁচাও!'
শিউলি থেমে গিয়ে হতভম্বের মতো এদিকে ওদিকে চেয়ে বলল, 'তুমি কে? কোথেকে চিৎকার করছ?'
তখন সে শুনল, কে যেন বলছে, আমি তোমার পায়ের কাছে, ইট-পাটকেলের নিচে চাপা পড়ে আছি। আমাকে বাঁচাও।'
স্পষ্ট গলায় এই কথা শুনে শিউলি লাফিয়ে উঠে পায়ের দিকে তাকাল। দেখল, সত্যি, তার পায়ের কাছে এক গাদা আস্ত আর ভাঙা থান ইট স্তূপ হয়ে পড়ে আছে। কতকগুলো থান ইট তো বেশ বড়ো আর ভারী। শিউলি উবু হয়ে বসে অনেক কষ্টে চার-পাঁচটা ইট সরাতে তার নিচ থেকে হলুদ বিবর্ণ কতকগুলো পাতা আর একটি মোটা শিকড় বেরোল। তারপর স্বরটা আবার ভেসে এল কানে।
'বাঝাঃ, বাঁচালে! একেবারে প্রাণে মারা পড়েছিলাম আর কি। আজ তিন মাস এই ইটগুলোর নিচে। ভাগ্যিস তুমি আজ এদিকে ফুল কুড়োতে এলে। রোজই তো দেখি অন্য দিকে বসে ফুল কুড়োও, মালা গাঁথো, আমাদের এদিকে ফিরেও তাকাও না। আমি মনে মনে ভাবি, আমার মতো অসহায়ের দিকে কে বা ফিরে তাকায়!'
শিউলি অবাক হয়ে কথাগুলো শুনে মাটির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, 'তুমি কে?'
উত্তর শুনল, 'তুমি কি আমাকে দেখতে পাচ্ছো না? কী দুঃখের কথা। খামোকাই আমি এতোক্ষণ কথা বললাম!'
এই কথা শুনে শিউলি থতমত খেয়ে বলল, 'আমার পায়ের কাছে কিছু হলুদ গোল পাতা আর তার মোটা একটা শিকড় ছাড়া আর কিছুই তো দেখতে পাচ্ছিনে। এটাকেই তো আমি এখন ইট সরিয়ে বের করলাম।'
শিউলির কথা শোনামাত্র, ও মা, শিউলির চোখের সামনেই শিকড়টা নড়েচড়ে বলে উঠল, 'আহা, আমাকে শিকড় বলে ডেকো না, আমি মনে দুঃখ পাব। আমি একটা গাছের চারা। আর যে সে গাছ নয়, বটগাছ। আমার ভাগ্য খারাপ, তাই পাখি এসে আমাকে এখানে বীজ অবস্থায় ফেলে গেছে। কী আর করব। কপালের গেরো, এখন ভুগতেই হবে।'
শিউলি তার কথা শুনে তাজ্জব বনে গেল! আরে গাছের শিকড় এভাবে কথা বলে নাকি? এ তো ভারি আশ্চর্য কথা! একটু ভয়ও পেল সে। কাজ কি বাবা আমার এতো ঝামেলায়, মা টের পেলে বকবে এই ভেবে সে টিপি টিপি পায়ে পালাবার উপক্রম করতেই, শিকড়টা বলে উঠল, 'আমাকে ঘেন্না করে দূরে সরে যাচ্ছ, না?' আমার চেহারা খারাপ বলে আমাকে ঘেন্না করছ? তাহলে শোনো আমার এই চেহারার জন্যে আমি দায়ী নই। দায়ী তোমাদের বাসার কাজের ছেলেটা। সে বেগম সাহেবার কথা শুনে বাগান পরিষ্কার করতে এসে প্রথমেই আমার ঘাড়ে গন্ধমাদন পর্বত চাপিয়ে দিয়েছে, অর্থাৎ ওই থান ইটগুলো। নইলে এই রকম আঁকাবাঁকা, কোঁকড়ানো কোঁকড়ানো, রক্তহীন হলুদ চেহারা আমার কোনো দিন ছিল না। কিন্তু আমার প্রাণশক্তি সূর্যের আলো আর মাটির নির্যাস থেকে আমাকে বঞ্চিত করায় আজ আমার এই অবস্থা। হায়, সবই আমার ভাগ্য!'
গাছের শিকড়টার এই রকম হা-হুতাশ শুনে শিউলির মনে দুঃখ হলো। সে বলল, 'আহা, তা মন খারাপের কী আছে? এই তো আমি এখন তোমার মাথা থেকে ইট সরিয়ে দিলাম। এখন তুমি হও না দেখতে সুন্দর, হও না বড়ো, কে তোমাকে মানা করছে?'
শিউলির কথা শুনে শিকড়টা খুশি হবে কি, উলটো মাটিতে আছাড় খেলো দুবার। করুণ স্বরে বলল, 'বড়ো হতে চাইলেই কি ভাই বড়ো হওয়া যায়? বড়ো হবার পথে যে কত বাধা তা যদি তুমি জানতে। আর বড়ো হবার পরেও যে আমাদের মতো বড়ো জাতের গাছদের কত বিপদ, তা তুমি কী বুঝবে?'
শিউলি বলল, 'ও মা, তাই বলে তুমি বড়ো হবে না নাকি? যারা বড়ো হয় তারা তো সমস্ত বাধা-বিপত্তি দুপায়ে দলেই বড়ো হয়।'
তার কথা শুনে শিকড়টা বলল, 'কারা দু পায়ে বাধা দলে বড়ো হয়, সে বাপু আমি জানিনে। আমি বরং দেখেছি আমিই অন্য লোকের পায়ের নিচে পড়ে চিড়ে-চ্যাপটা হয়ে যাচ্ছি। একদম বেড়ে উঠতে পারছিনে।'
শিউলি তাই শুনে তড়িঘড়ি করে বলল, 'আহা, সে তো খুব দুঃখের কথা! তোমার বয়স কত গো?'
শিকড়টা বলল, 'আমার বয়স অবশ্য খুবই কম, মাত্তর পঞ্চাশ বছর তিন দিন, তোমার চেয়েও সামান্য ছোটো আমি।'
তার কথা শুনে শিউলি চোখ কপালে তুলে বলল, 'বলো কি, কী সর্বনাশ! তুমি তো দেখি আমার বড়ো চাচার চেয়েও বড়ো, আর বলছ, তুমি আমার চেয়েও ছোটো?'
শিউলির কথা শুনে শিকড়টা একটু বিরক্ত হয়ে বলল, 'গাছ হিসেবে আমি ছোটো না তো কী? আমাদের এক একজনের জীবনের আয়ু কত জানো? তোমাদের দশ পুরুষের চেয়েও বেশি। আমার তো সেই হিসেবে দুধের দাঁত বেরিয়েছে মাত্র। অবশ্য আমার বুদ্ধি খুব বেশি। তাই এই অল্প বয়সেই অনেক কিছু জানতে পেরেছি।'
শিউলি তার কথা শুনে অবাক হয়ে বলল, 'তার মানে এই পঞ্চাশ বছর তুমি এইখানে পড়ে আছ? আমার জন্মেরও আগে থেকে?'
তার কথা শুনে যেন মন খারাপ হয়ে গেল শিকড়টার। সে বিমর্ষ গলায় বলল, 'তাই বটে। আমার যে ভাগ্য খারাপ তা তো আগেই তোমাকে বলেছি। যদি ভাগ্য ভালো থাকত তাহলে হয়তো আজ আমি দাঁড়িয়ে থাকতাম হাইকোর্টের মোড়ে, কিংবা শহিদ মিনারের পাশে। অবশ্য তা হলেও যে খুব নিরাপত্তা থাকত এ কথা জোর গলায় বলতে পারিনে। আচ্ছা বলতে পারো, তোমরা মানুষেরা এত নিষ্ঠুর কেন?'
শিউলি তার কথা শুনে ব্যতিব্যস্ত হয়ে বলল, 'কেন, কেন?'
শিকড় বলল, 'নিষ্ঠুর নয়?' যেভাবে তোমরা আমাদের নিধন করছ, অচিরেই তো দেখি পুরো পৃথিবীটাকেই বিরান একটা এবড়ো-খেবড়ো মাঠ করে ছেড়ে দেবে। সেখানে একটা গাছ নেই, একটা পাখি নেই।'
তার কথা শুনে শিউলি ঘাবড়ে গিয়ে বলল, 'কেন পাখি নেই কেন?'
শিকড়টা বলল, 'পাখি কী করে থাকবে? গাছ ছাড়া কি পাখিরা বাঁচতে পারে? গাছের ডাল ছাড়া কোথায় বসে ওরা গান গাইবে, বাসা বাঁধবে?'
শিকড়টার এমন বুড়োটেপনা কথা শুনে শিউলি ঠোঁট উলটে বলল, 'ইস, তুমি বললেই হলো, না? এত গাছ পৃথিবীতে কেউ কি কেটে সাফ করতে পারে?"
শিকড়টা বলল, 'পারে না? পৃথিবীর কত বড়ো বড়ো দেশের জঙ্গল সাফ হয়ে গেছে জানো? জঙ্গল কেটে, গাছ কেটে, কী বিচ্ছিরি সব ইমারত, কলকারখানা মানুষ তৈরি করছে তুমি তার খোঁজ রাখো? আমাদের মতো নিরীহ গাছেরা কীভাবে বড়ো হতে না হতে এই ধূলার ধরণীতে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করছে তোমাদের অত্যাচারে, তার কোনো খবর রাখো?'
শিকড়টার কথা শুনে শিউলি হঠাৎ করে কেন জানি লজ্জা পেল। সে মাথা চুলকে বলল, 'সেসব তো অন্য দেশে। আমাদের এই বাংলাদেশে শুধু গাছের শোভা, পাখির কাকলি, ঝরনার গান!'
শিউলির কথা শুনে শিকড়টা হঠাৎ ফোঁস ফোঁস করে শব্দ করতে লাগল। ভয় পেয়ে শিউলি পিছিয়ে গিয়ে বলল, 'ও কি, সাপের মতো ফোঁস ফোঁস করছ কেন, কামড়ে দেবে নাকি?'
শিকড়টা তাই শুনে তাড়াহুড়ো করে উত্তর দিয়ে বলল, 'না, না, কামড়াব কেন, আমি কি সাপ? তোমার কথা শুনে একটু আপন মনে হেসে নিলাম আর কি! আমাদের আবার তোমাদের মতো মুখ নেই কিনা, তাই হাসিটা অমন সুন্দর আসে না। তা যাই হোক, নিজের দেশ সম্পর্কে এত উঁচু ধারণা তোমার কবে থেকে হলো বলতে পারো?'
শিউলি তার প্রশ্ন শুনে বিরক্ত হয়ে বলল, 'এ তুমি কী বলছ?'
শিকড় বলল, 'বলছি এই জন্যে যে নিজের দেশ সম্পর্কে তোমার কোনো ধারণা নেই বলে। গাছগাছালি বিষয়ে তো আরো নেই। নইলে খবরের কাগজ খুললেই চোখে দেখতে পেতে কীভাবে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, একরের পর একর জমির গাছপালা সব ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। তোমাদের সরকার আইন করেও কিছু ঠেকাতে পারছে না। যে দেশে মানুষের মনে গাছদের জন্য একটুও মায়া-মমতা নেই, সে দেশে কোন আইন এই ধ্বংসযজ্ঞ ঠেকাতে পারে?'
শিউলি এ কথা শুনে আবার মাথা চুলকে বলল, 'তা বাড়িঘর তৈরি করতে গেলে, কলকারখানা ঠিকমতো গড়তে গেলে কিছু গাছপালা তো কচুকাটা হবেই, এতে আর আশ্চর্য হবার কী আছে?
শিকড় এই কথার প্রতিবাদে মুখর হয়ে আবার জোরে আছাড় খেল মাটিতে। শিউলি ব্যস্ত হয়ে বলল, 'আরে, করো কী, করো কী? মাথা ফেটে আমচুর হয়ে যাবে তোমার! এই দেখো, তোমার লাফানিতে তোমার মাথার একটা হলুদ পাতা খসে মাটিতে পড়ে গেল।'
'যাক খসে, মাথা ফাটলেই বা কী আসে যায়? তাই বলে কি প্রতিবাদ করব না? মাইলের পর মাইল বৃক্ষনিধন করাটাকে কি কিছু-গাছ-কাটা বলে? সে কথা না হয় ছেড়ে দাও, তোমার নিজের শহর এই ঢাকায় কোথায় কোন গাছটা বাঁচিয়ে রেখেছ বলো তো? সব কি নির্মূল করে ফেলোনি? কত পুরনো বনেদি আমাদের প্রপিতামহদের তোমরা কি নির্বংশ করে দাওনি? আমাদের ঐতিহ্য ধ্বংস করে দাওনি? এ যেন পাকিস্তানি মিলিটারিদের অত্যাচারের মতো নির্মম। আর যারা বেঁচে আছে তাদেরও কি কম নির্যাতন করছ? তাদের গায়ে পেরেক ঠুকে, সাইনবোর্ড টাঙিয়ে, গর্ত করে, ডাল ভেঙে, তাদের গায়ের ছাল ছিঁড়ে তোমাদের নাম লিখে কম নির্যাতন করছ তোমরা?'
শিকড়টার এই অভিযোগ শুনে শিউলি অপ্রস্তুত হয়ে গেল। কে জানত যে গাছপালাও মানুষের মতো চিন্তাভাবনা করতে পারে! সে একটু থেমে ভেবে নিয়ে বলল, 'তা আর কী করা যাবে বলো তো? মানুষের প্রয়োজন'
শিউলি কথা শেষ না করতেই শিকড়টা আবার লাফিয়ে উঠল। আবার আছাড় খেলো মাটিতে, ফলে তার মাথার উপর থেকে খসে পড়ল আরো একটা হলুদ পাতা। নির্যাতিতের গলায় শিকড়টা বলে উঠল, 'তুমি আমাকে প্রয়োজনের কথা বলছ? তোপখানার মোড়ে সেই বেগুনি ফুলের শতাব্দী পুরনো গাছটাকে উপড়ে ফেলাটা তোমাদের প্রয়োজন ছিল? কীসের প্রয়োজন ছিল শুনি? একটা কৃত্রিম ঝরনা তৈরি করার প্রয়োজন ছিল? নাক হারিয়ে নরুন নিয়ে তোমরা এমন সন্তুষ্ট থাকতে পারো, তোমরা কি মানুষ হে? ছিঃ ছিঃ।'
শিউলি এ কথা শুনে থতমত খেয়ে বলল, 'মানে, তুমি ঠিক বুঝতে পারছ না।'
'আমি বুঝতে পারছিনে, তুমি বলো কি? আমি ঠিকই বুঝতে পারছি। এরপর যখন তোমাদের দুর্গতি হবে, আমরা খুশিতে ডুগডুগি বাজাব। এখনই বা মজাটা কেমন টের পাচ্ছ? এখন যখন বৈশাখ মাসে আকাশে গনগনে রাগী সূর্য তার রাগ ঢেলে দেয় তোমাদের মাথার ওপর, তখন তোমরা ইয়া নবসি ডাক ছেড়ে কোথায় আশ্রয় নাও? আগে যেমন দরকার হলে গাছের ছায়ায় ছায়ায় হেঁটে চলে যেতে দূরে, এখন কেমন লাগে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেতে? হু হু বাবা, একে বলে ওস্তাদের মার। এ মার খাবে তোমরা একেবারে শেষ রাতে।'
এই কথা শোনার পর শিউলির রাগ হয়ে গেল। শিউলি বলল, 'কেন, মার খাব কেন? আবার গাছ লাগাব। গাছ বড়ো হতে আর কতদিন?'
শিকড়টা শিউলির কথায় আবার দুবার ফোঁস ফোঁস করে উঠল। অর্থাৎ হাসল। তারপর বলল, 'সেই গাছ বড়ো হতে হতে তোমার নাতি-নাতকুড় হয়ে যাবে। সেই যে অনাদি কাল থেকে তোমরা কিছু শৌখিন গাছ লাগিয়ে রেখেছ পথের দু ধারে, কটা গাছ আদর করে তোমাদের ব্যজন করছে বলো তো?
এবার সত্যিই রেগে গেল শিউলি। ধমক দিয়ে বলল, 'তুমি তো ভারি বকবক করো দেখছি। তোমার নাম কি বকুয়া বুড়ো? আমি এই ভোরবেলা মন ভালো করে ফুল কুড়োতে এলাম, তুমি দিলে সেটা একেবারে মাটি করে। এটা কি তোমার উচিত হলো?'
তার কথা শুনে শিকড়টা চুপ করে থাকল। শিউলি জোর গলায় বলল, 'কী, কথা বলছ না যে?'
শিকড় বলল, 'ভাবছি। আসলে বাস্তবে যা ঘটছে, তা থেকে কি দূরে সরে থাকা যায় বেশি দিন, তুমিই বলো?'
শিউলি তখন বলল, 'খুব যায়। তুমি এখনো ছেলেমানুষ। মাত্তর পঞ্চাশ বছর তিন দিন হচ্ছে তোমার বয়স। এখন তোমার কাজ হচ্ছে লেখাপড়া শেখা, বড়ো হওয়া, বংশের মুখ রক্ষা করা। তোমার লেখাপড়া তো আমার মতো স্কুলে গিয়ে কষ্ট করে করতে হয় না, এখানে বসে বসেই ঝোপের ফাঁকে ফোঁকে চোখ চালিয়ে তুমি বিদ্যা অর্জন করো। প্রকৃতি হচ্ছে তোমার হেড স্যার। সকাল থেকে সন্ধে অব্দি বিদ্যা অর্জন হচ্ছে তোমার কাজ। তোমার এমনিতেই ঘিলুতে সূর্যের আলো কম লাগার জন্যে বুদ্ধি কমে যাচ্ছে, তার ওপর এতো আজেবাজে চিন্তা তোমার মাথার জন্যে খুব খারাপ, বুঝলে?'
শিকড় নাছোড়বান্দার মতো গলা মোটা করে বলল, 'বুঝলাম কিন্তু -
শিউলিও গোঁ ধরে বলল, 'কোনো কিন্তু টিন্তু নেই। যদি তা না করো, তাহলে আবার আমি এই থান ইটটা তোমার ঘাড়ে ফেলে চলে যাব, আর কোনোদিন এদিকে আসব না। তখন বুঝবে মজা।'
শিউলির এই হুমকিতে, ও মা, ম্যাজিকের মতো কাজ হলো। শিকড়টা হঠাৎ আকাশের দিকে মুখ তুলে গলা সরু করে আপন মনে বলতে লাগল 'তাইতো, আমি তো এখনো ছেলেমানুষ, মোটে পঞ্চাশ বছর তিন দিন আমার বয়স। তবু যাও বা মাথায় বড়ো হতুম, ইট চাপা পড়ে আমি বামন হয়ে গেছি! ভালো করে পাতা ছাড়তে পারিনি, পাতায় সবুজ রঙ লাগাতে পারিনি, মাটি থেকে রস শুষতেও পারিনি, কোনোরকমে উমড়ো-দুমড়ো হয়ে বেঁচে আছি। কাজ কি বাপু আমার বড়ো বড়ো কথা নিয়ে মাথা ঘামাবার! এর জন্যে কেউ কি আমাকে খেতে দেবে, না পরতে দেবে? খামোকা এই অল্প বয়সে সত্যি কথা বলতে গিয়ে প্রাণটা খোয়াব নাকি? না বাপু, আমি অত বোকা নই।'
এই বলে সেই গাছের শিকড়টা সরু গলায় দুলে দুলে করুণ স্বরে গান গাইতে লাগল,
যেদিন হবে দুখের শেষ
নেচে গেয়ে
নেয়ে গেয়ে
সত্যি কথা বলব বেশ
বলব বেশ
আহা, যেদিন হবে দুখের শেষ।
শিউলি মন দিয়ে যখন গানটা শুনছে, এমন সময়ে তার কানে ভেসে এল মায়ের ডাক, 'শিউলি কোথায় তুই, ঘরে ফিরে আয় মা।'
মায়ের ডাক শুনে চমকে গেল শিউলি। ভাবল, তাই তো, কোথায় সে? এই ঝোপের ভিতরে গন্ধরাজ গাছের কাছে দাঁড়িয়ে কী সে ভাবছে? ভালো করে তাকিয়ে দেখল তার পায়ের কাছে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে পাতা-ছেঁড়া এক বটগাছের চারা। ইট চাপা পড়ে হলুদ হয়ে গেছে তার শরীর? আর কোনো দিকে কোনো শব্দ নেই। শিউলির গা কেমন শিরশির করে উঠল। 'সব আমার চোখের ভুল'- এই ভেবে এক দৌড়ে ঘরে ফিরে এল সে।
উপক্রম: প্রস্তুতি।
ইমারত: দালান।
উমড়ো-দুমড়ো: দুমড়ানো মোচড়ানো।
নরুন: নখ কাটার হাতিয়ার।
নাছোড়বান্দা: সহজে ছাড়তে চায় না এমন।
প্রপিতামহ: পিতামহের পিতা।
বিমর্ষ: মন-মরা।
বুড়োটেপনা: পাকামো।
মাত্তর: মাত্র।
মিলিটারি: সেনাবাহিনী।
শতাব্দী: একশো বছর।
হাইকোর্ট: উচ্চ আদালত।
আরও দেখুন...