ঈশান সব সময় হাসিখুশি থাকে কিন্তু পড়াশোনায় মন নেই। তবে বিদ্যালয়ের যেকোনো কাজে তার আগ্রহ অনেক । উচ্ছল ঈশান একদিন খুব মনমরা হয়ে ক্লাসে বসে আছে দেখে ওর শিক্ষক খুব অবাক হয়ে জানতে চাইলেন, 'কী ব্যাপার, তোমার মন খারাপ কেন?' ঈশান মাথা নিচু করে ফেলল। এরপর কাচুমাচু হয়ে বলল, আসার পথে একটি কুকুরকে পানি খাওয়াচ্ছিলাম, তাই দেখে পাড়ার পরিচিত একজন ভেংচি কেটেছে আর বলেছে, এসব নিয়ে থাকলে আমার জীবনটাই নাকি বরবাদ হয়ে যাবে, আর আমাকে দিয়ে নাকি কিচ্ছু হবে না। শিক্ষক কাছে গিয়ে ঈশানের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, 'মোটেই না, তুমি ঠিক কাজটাই করেছ, উনি তোমাকে ভুল বুঝেছেন।
তবে ঈশানের ফলাফল নিয়ে তার শ্রেণিশিক্ষকও খুব চিন্তিত। তিনি অনেক ভেবেচিন্তে একটা ছক বানালেন, ছকটির নাম দিলেন, আমার পথ'। টিফিনের সময় ঈশানকে ডেকে ছকটি দিয়ে বললেন, 'এটি তুমি নিজে পূরণ করবে এবং তোমার ক্ষেত্রে যা সত্যি, তা-ই লিখবে। দুই দিন পর আমার কাছে জমা দিবে'।
ঈশান এটি পূরণ করতে গিয়ে খুব মজা পেল। শিক্ষক ঈশানের পূরণ করা ছকটি হাতে পেয়ে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে বুঝলেন, প্রাণির প্রতি ঈশানের অন্যরকম ভালো লাগার অনুভূতি রয়েছে, ভবিষ্যতে অ্যানিম্যাল কেয়ার বা প্রাণির উপর গবেষণা সংক্রান্ত পড়াশোনা করলে সে পূর্ণ মনোযোগ ও আগ্রহ নিয়ে কাজ করতে পারবে। শিক্ষক এই ধরনের কিছু বই লাইব্রেরি থেকে এনে ঈশানকে বাড়িতে পড়ার জন্য দিলেন। কিছুদিনের মধ্যেই ঈশানের আচরণে একটা পরিবর্তন চলে এল। সে তার নিজের পড়াশোনায় অনেক মনোযোগী হয়ে উঠল।
দলগত কাজ উপরের গল্পটি ভালোভাবে পড়ো এবং ঈশানের আচরণে কেন পরিবর্তন এল, তা দলগতভাবে আলোচনা করে ক্লাসে নিজেদের মতামত ব্যাখ্যা করো। |
নিজের পছন্দ বা আগ্রহ ও যোগ্যতা
পছন্দ হলো কোনো কিছু ভালো লাগা, অর্থাৎ কোনো কাজ করতে যদি আমাদের ভালো লাগে, তাহলে সেটিকেই আমাদের পছন্দের কাজ বলা যায়। আর আগ্রহ হলো, কোনো কাজ করার ইচ্ছা । সাধারণত পছন্দের কাজ করতে সবাই আগ্রহ প্রকাশ করে থাকে। অন্যদিকে কোনো ব্যক্তির যোগ্যতা হলো-শারীরিক, মানসিক সামর্থ্য বা সক্ষমতা বা পারদর্শিতা। সহজ কথায় বলা যায়, যোগ্যতা হলো কাজ করার শারীরিক ও মানসিক সামর্থ্য বা ক্ষমতা। আমাদের যদি কোনো বিষয়ে বা কাজে আগ্রহ থাকে, তাহলে সে কাজ দ্রুত শেখা যায় অর্থাৎ কাজে আগ্রহ থাকলে যোগ্যতা অর্জন সহজ হয়। অদম্য আগ্রহ তখন নিয়মিত প্রচেষ্টা আর অনুশীলনের মাধ্যমে যোগ্যতা অর্জন নিশ্চিত করতে অনেক সহায়তা করে। আবার উল্টোটাও হতে পারে, সামর্থ্য না থাকলে অনেক আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও কাজটি করা সম্ভব না-ও হতে পারে। যেমন, আমাদের কেউ হয়তো অ্যানিমেশন খুব পছন্দ করে এবং তার খুব শখ বড় হয়ে সে এনিমেটেড কার্টুন মুভি বানাবে। কিন্তু আঁকাআঁকিতে সে ভীষণ অদক্ষ, একদম আনাড়ি ধরনের; সেক্ষেত্রে তার শখ বা আগ্রহ থাকলেও এই বিষয়ে নিজেকে যোগ্য করে তোলা অনেক কঠিন।
ষষ্ঠ শ্রেণিতে আমরা ‘নিজেকে চেনা' নামের একটি ছক পূরণ করেছিলাম। এরপর নিজের ইচ্ছা তালিকা তৈরি করেছিলাম, তা নিশ্চয়ই তোমাদের মনে আছে। আমরা নিজেকে আবিষ্কারের জন্য অর্থাৎ নিজের আগ্রহ ও যোগ্যতা সম্পর্কে আরও সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়ার জন্য এবার নিচের ছকটি পূরণ করব।
ছক ৫.১ : নিজেকে জানা
পছন্দের কাজ | কাজটি করতে যা যা প্রয়োজন হয় | গত দুইমাসে কতবার কাজটি করেছি | কাজটি করতে গিয়ে কী কী বাধা/সমস্যা/চ্যালেঞ্জে পড়েছি | কাজের মান নিয়ে মতামত |
---|---|---|---|---|
ফুল বানানো (উদাহরণ) | কাচি, রঙ্গিন কাগজ, আঠা, স্টিলের তার শক্ত সরু কাঠি, সুতলি | ৩/৪ বার | শেখার মতো হাতের কাছে কোনো বই পাইনি, শেখানোর মতো পাশে কেউ নেই, ইউটিউব দেখে শেখার সুযোগ পাইনি | বাড়িতে কেউ কেউ প্রশংসা করেছে। |
১/ | ||||
২/ | ||||
৩/ | ||||
সহপাঠীর মতামত: |
জোড়ায় কাজ ছক ৫.১ পূরণ করার পর ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করো। তোমার পাশের সহপাঠীকে তোমার ছকটি দাও এবং তুমি তার ছকটি পর্যবেক্ষণ করো। বুঝতে অসুবিধা হলে একজন অন্যজনকে প্রশ্ন করে অথবা আলোচনা করে জেনে নাও। এরপর তোমার সহপাঠীর কোন কাজটিতে আগ্রহ ও যোগ্যতা দুটিই আছে তা খুঁজে বের করো এবং তা ছকের সর্বশেষ ঘরে মতামতসহ লেখো। |
পছন্দ ও আগ্রহের পরিবর্তন এবং পারিবারিক প্রভাব
আমাদের আগ্রহ, পছন্দ, ইচ্ছা ইত্যাদি সময়ের সঙ্গে বদলে যেতে পারে। এমন হতে পারে, ষষ্ঠ শ্রেণিতে আমরা যা করতে পছন্দ করতাম, কিংবা যে কাজটি আগ্রহ নিয়ে করতাম, এখন সেটাতে তেমন উৎসাহ অনুভব করি না। পছন্দ বা আগ্রহের ক্ষেত্র বদলাতেই পারে। নিজেদের বয়স, পরিবেশ ও সময়ের সঙ্গে এগুলো বদলে গেলে আমাদের লক্ষ্যও বদলে যেতে পারে। একই সঙ্গে বদলে যেতে পারে আমাদের ক্যারিয়ার পরিকল্পনাও। এই পরিবর্তনকে স্বাভাবিক হিসেবেই আমাদের ধরে নিতে হবে। আমাদের আগ্রহের ক্ষেত্র বদলেছে কি না তা এবার অতীত ও বর্তমান পছন্দের সঙ্গে তুলনা করে দেখি।
ছক ৫.২ : অতীত ও বর্তমানের পছন্দ
আগে আমি যা যা করতে পছন্দ করতাম/ ভালোবাসতাম | |
---|---|
এখন আমি যা যা করতে পছন্দ করি / ভালোবাসি | |
আমার পছন্দের ধরন বদলে যাওয়ার কারণ | |
পারিবারিক সহায়তা বা সমর্থন কোনটাতে আছে? |
আমাদের জীবনের লক্ষ্য নির্বাচনে পারিবারিক সহায়তা বা সমর্থন একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। অনেক ক্ষেত্রেই পারিবারিক ঐতিহ্য, অর্থনৈতিক সামর্থ্য, মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গি ইত্যাদি আমাদের পছন্দ ও আগ্রহের ওপর প্রভাব বিস্তার করে। সে ক্ষেত্রে পরিবারের সবার সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করে নিজের আগ্রহের ক্ষেত্র ও যোগ্যতার বিষয়টি উপস্থাপন করা যেতে পারে। নিজের পছন্দ বা আগ্রহের ক্ষেত্রটি বেছে নেওয়ার যৌক্তিক কারণ পরিবারের কাছে স্বচ্ছভাবে তুলে ধরে সহায়তা চাওয়া যেতে পারে। পরিবারের যুক্তিও ভালোভাবে বিবেচনা করে দেখতে হবে। তারা আমাদের কোন কাজে বেশি যোগ্য মনে করছেন, কেন মনে করছেন সেটিও অলোচনা করে দেখতে হবে। গ্রহণযোগ্য মনে হলে তাদের মতামতও আমাদের ভেবে দেখতে হবে। তা ছাড়া, সময়ের সঙ্গে হয়তো আমাদের লক্ষ্যেও পরিবর্তন আসতে পারে। তাই এখনই একক লক্ষ্য স্থির করে ফেলতে হবে বিষয়টি তেমন নয়। চলো, জীবনের লক্ষ্য নিয়ে আমরা ক্লাসে একটি বিতর্কের আয়োজন করি।
জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণে যোগ্যতাই হলো একমাত্র বিবেচ্য বিষয়।
নিয়ম
শিক্ষার্থীরা দুটি দলে ভাগ হয়ে যাও। লটারির মাধ্যমে পক্ষ ও বিপক্ষ দল নির্বাচন করো। প্রতি দল থেকে আলোচনার মাধ্যমে তিন জন করে ভালো বক্তা নির্বাচন করো। ১ম, ২য় ও ৩য় বক্তা এবং দলনেতা কে হবে তা ঠিক করে নাও। বাকিরা সবাই নিজ দলের বক্তাদের জন্য তথ্য, যুক্তি ইত্যাদি সরবরাহ করো। নিজ নিজ দলে আলোচনা করে তিন বক্তার জন্য বক্তব্যের স্ক্রিপ্ট বানাও। (একটি ক্লাসে তোমরা আলোচনা করে স্ক্রিপ্ট তৈরি করবে। পরের ক্লাসে বিতর্কের আয়োজন করবে।)
সময় বন্টন
পক্ষ ও বিপক্ষ উভয় দল থেকে ৩ জন বক্তার প্রত্যেকেই ৪ মিনিট করে সর্বমোট ১২ মিনিট করে সময় পাবে 8 (মোট সময় দুই দলের জন্য, ১২×২ = ২৪ মিনিট)। উভয় দলের ৬ জনের বক্তব্য শেষ হলে দুই দল থেকে দলনেতা যুক্তি খণ্ডনের জন্য দুই মিনিট করে অতিরিক্ত সময় পাবে।
সময় সতর্ককারী
একজন সময় সতর্ককারীর দায়িত্ব নাও। প্রত্যেক বিতার্কিকের সময় শেষ হবার ১ মিনিট আগে সতর্ক সংকেত এবং সময় সম্পূর্ণ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পূর্ণ সংকেত দিবে।
বিচারক
দুইজন শিক্ষক এবং তিনজন শিক্ষার্থী নিয়ে বিচারক প্যানেল তৈরি করো। শিক্ষার্থীরা অন্য ক্লাসেরও হতে পারে । তবে নিজেদের ক্লাসের শিক্ষার্থী হলে নিরপেক্ষতা বজায় রাখে এমন হতে হবে।
নম্বর প্রদানের জন্য প্রত্যেক বিচারকের হাতে একটি ছক সরবরাহ করো (অপর পৃষ্ঠায় নমুনা রয়েছে)।
বিতর্কের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা এবার নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছি, যেকোনো কাজে সফল হওয়ার জন্য ঐ কাজটির প্রতি পছন্দ ও আগ্রহ যেমন থাকতে হবে, তেমনি যোগ্যতাও থাকতে হবে। কোনো কাজে আগ্রহ থাকলে প্রচেষ্টার মাধ্যমে যোগ্যতার উন্নয়ন করা সম্ভব। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে কাজের জন্য যোগ্যতা পূর্বশর্ত হিসেবে ভূমিকা রাখে ।
নিজের জন্য পেশা নির্বাচন
এবার আমরা একটু ভিন্ন ধরনের কাজ করব। আমার পছন্দ, আগ্রহ ও যোগ্যতার বিবেচনা করে আগামীতে আমি নিজেকে কী হিসেবে দেখতে চাই তার একটি চিত্রকল্প তৈরি করব।
লক্ষ্য পূরণে বিভিন্ন মেয়াদের পরিকল্পনা
আগামীতে সফল ব্যক্তিত্ব হিসেবে নিজেকে দেখতে কার না ভালো লাগে! আমরা সবাই চাই, যার যার স্বপ্ন যেন পূরণ হয়। সে ক্ষেত্রে স্বপ্নকে ছোঁয়ার জন্য আমাদের একটা সুন্দর, যৌক্তিক পরিকল্পনা করে এগিয়ে যেতে পারবে। স্বপ্নের সেই পেশার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে হলে, ধাপে ধাপে কী ধরনের পরিকল্পনা করতে হবে, তা তোমরা ষষ্ঠ শ্রেণিতে লক্ষ্য পূরণের পরিকল্পনা ছকের মাধ্যমে অনুশীলন করেছ।
আৰু ও শিলা যেমন চঞ্চল, তেমনি বুদ্ধিমান ও করিৎকর্মা। সারাবেলা বন্ধুদের সঙ্গে খুনসুটি করে ক্লাসটাকে আনন্দে ভরিয়ে তোলা, নিজেদের মধ্যকার ঝগড়া মেটানো, বাড়ির পাশে গাছে চড়া, পুকুরে সাঁতরে চোখ লাল করে বাড়ি ফেরা তাদের রোজকার কীর্তি। শুধু তাই নয়, স্কুলে তাদের ব্যাপক জনপ্রিয়তাও রয়েছে। মজার বিষয় হলো, তাদেরকে কোনো দায়িত্ব দেওয়া হলে সেটাও তারা খুবই সুচারুরূপে সম্পন্ন করে । এই গুণের জন্য স্কুলের স্কাউট শিক্ষক তাদেরকে বেশ বাহবা দেন। তাদের স্কুলে একটা আমগাছ আছে, এবছর প্রচুর আম ধরেছে। প্রধান শিক্ষক সিদ্ধান্ত নিলেন, এবার আমগুলো পাকলে স্কুলের সব শিক্ষার্থীদের মাঝে বিতরণ করবেন। স্কাউট শিক্ষক আবু আর শিলাকে তথ্যটা দিয়ে বললেন, “একটা কমিটি করে কাজটা কীভাবে করবে তা আলোচনা করে ঠিক করো এবং আমি হেডস্যারের স্বপ্নের সুন্দর বাস্তবায়ন দেখতে চাই। যেকোনো কাজে আমাকে তোমাদের পাশে পাবে।
দলগত কাজ নিজেকে আবু ও শিলা ভেবে নাও। দলগত আলোচনার মাধ্যমে গল্পের হেডস্যারের স্বপ্ন পূরণের একটি পরিকল্পনা সাজাও । |
লক্ষ্য ও পরিকল্পনা
নদীতে নৌকা ছেড়ে দিলে বাতাসে তা হেলেদুলে একেক সময় একেক দিকে চলতে থাকবে। কিন্তু যদি নৌকার কোনো গন্তব্য স্থির করা থাকে, তাহলে মাঝি চেষ্টা করেন স্রোতের সঙ্গে যুদ্ধ করে হলেও নিজ গন্তব্যে পৌঁছানোর। প্রতিটি কাজেরই কোনো না কোনো লক্ষ্য থাকে। এমনকি পাহাড় থেকে গড়িয়ে যে নদীর পথ চলা শুরু হয়, তারও একটা গন্তব্য থাকে সাগরে মিলে যাওয়ার। এই গন্তব্যই হলো লক্ষ্য। সহজ কথায়, লক্ষ্য হলো ভবিষ্যৎ বা আগামীর প্রত্যাশিত ফল, যা কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান অর্জন করতে চায়। আর লক্ষ্যে পৌঁছানোর যাবতীয় প্রচেষ্টা বা কৌশলই হলো পরিকল্পনা। যেকোনো কাজের ফলাফল নির্ভর করে পরিকল্পনার ওপর। এজন্যে ব্যবস্থাপনার ভাষায় পরিকল্পনার অভিপ্রেত বা প্রত্যাশিত ফলকে লক্ষ্য নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য কখন, কোথায়, কীভাবে, কোন কাজ করা হবে তার নকশা বা প্রতিচ্ছবি তৈরি করাই হলো পরিকল্পনা। একটি পরিকল্পনার কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য বা দিক থাকে, যেমন-
যে পরিকল্পনাই আমরা করি না কেন, তা হতে হবে সুস্পষ্ট। পরিকল্পনাটি বাস্তবায়ন সম্ভব কি না, তা-ও ভালোভাবে পর্যালোচনা করে নিতে হবে। পরিবার ও সমাজের সবার কাছে এর গ্রহণযোগ্যতা আছে কি না, অতীতের অভিজ্ঞতার আলোকে পদক্ষেপগুলো সঠিকভাবে সাজানো হয়েছে কি না, উক্ত পরিকল্পনার সঙ্গে জড়িত অন্যান্য বিষয়ের যোগসূত্র কীভাবে রাখা যায় এবং এই পরিকল্পনার কারণে প্রভাবিত হতে পারে এমন বিষয়গুলোর সঙ্গেও সুষ্ঠু সমন্বয় করতে হবে। এছাড়াও কোনোরকম অনিশ্চয়তা থাকলে কীভাবে তা মোকাবিলা করা যেতে পারে সেই সংক্রান্ত সম্ভাব্য নির্দেশনাও থাকতে হবে। তবে কোনো বিষয়ে অনড় থাকা যাবে না। পরিস্থিতি অনুযায়ী নমনীয়তার সুযোগ থাকতে হবে। পরিকল্পনা বিভিন্ন মেয়াদের হতে পারে। মেয়াদের ওপর ভিত্তি করে পরিকল্পনাকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে। যেমন-
ক) স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনা (১ বছর বা তার কম সময়ের জন্য)
খ) মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনা (১ বছরের অধিক বা সর্বোচ্চ ৫ বছর সময়ের জন্য)
গ) দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা (৫ বছরের অধিক সময়ের জন্য)
পরিকল্পনা যে মেয়াদেরই হোক না কেন, এটি নকশা করার সময় কৌশলগত বিশ্লেষণ প্রয়োজন হয়। সে ক্ষেত্রে বহুল প্রচলিত একটি টার্ম রয়েছে, সেটি হলো- SWOT বিশ্লেষণ। SWOT এর প্রতিটি বর্ণের একেকটি অর্থ রয়েছে-
S - Strength (শক্তি/ সামর্থ্য/সবল দিক)
W -Weakness (দুর্বলতা)
O- Opportunity (সুযোগ)
T- Threat (চ্যালেঞ্জ/প্রতিবন্ধকতা)
জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণ এবং পরিকল্পনা প্রণয়নের ক্ষেত্রে এই ধরনের বিশ্লেষণ আমাদেরকে কর্মপন্থা নির্ধারণে অনেক সহায়তা করে। আমরা আবু ও শিলার পরিকল্পনায় আবার একটু ফিরে যাই। তাদের দুজনের সামর্থ্য (S), তাদের দুর্বলতা (W), কাজটি সুষ্ঠুভাবে করার ক্ষেত্রে সুযোগ (O) এবং চ্যালেঞ্জ (T) গুলো খুঁজে বের করি-
নিজেদের জন্য কোনো পরিকল্পনা করার ক্ষেত্রে শুরুতেই সোয়াট অ্যানালাইসিস করে নিয়ে সামনে অগ্রসর হলে পুরো কাজটি অনেকখানি সহজ হয়ে যায়। কোনো প্রতিষ্ঠান যদি তার উন্নয়নের জন্য অথবা কোনো সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনের জন্য স্বল্প বা দীর্ঘমেয়াদি কোনো পরিকল্পনা করতে চায়, সে ক্ষেত্রেও এই ধরনের বিশ্লেষণ, উক্ত পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের পথকে সুগম করে দেয়। লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য কী কী সামর্থ্য আমাদের রয়েছে এবং আরও কী কী সামর্থ্য তৈরি (Build) ও উন্নয়ন (Enhance) করা প্রয়োজন, কী কী ঘাটতি বা সমস্যা রয়েছে তা সমাধান বা হ্রাস করা দরকার তা পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব হয়। পাশাপাশি যেসব সম্ভাবনা বা সুযোগ আমাদের হাতের কাছে রয়েছে, সেগুলোর সর্বোচ্চ সুবিধা আদায় এবং সম্ভাব্য অনিশ্চয়তা বা ঝুঁকি এড়ানোর কৌশল নির্ধারণ করাও সহজ হয়।
বছর সাতেক আগের কথা। মেরিনাদের বাড়ি ছিল হাওর এলাকায়। ভালোই দিন কাটাচ্ছিল তাদের পরিবার। বিশাল বড় হাঁসের খামার ছিল তাদের। দিনের বেলা হাঁসগুলো হাওরের পানিতে ভেসে বেড়াত আর রাতে এসে খামারে কাটাতো। কিন্তু সাত বছর আগে দীর্ঘমেয়াদি এক বন্যায় তাদের ঘরবাড়ি ডুবে যায়। হাঁসগুলো সব হারিয়ে যায়। আশ্রয়কেন্দ্র থেকে ওরা যখন নিজেদের বাড়িতে ফিরে আসে, সব হারিয়ে তখন একেবারে নিঃস্ব। তাদের পক্ষে একবেলা খাবার জোগাড়ই কঠিন হয়ে পড়ে।
এ রকম একদিন মেরিনা ওর বাবার সঙ্গে ইউনিয়ন পরিষদে যায় রিলিফ আনতে। ওর বাবা লাইনে দাঁড়ান আর মেরিনা গিয়ে অফিসের এক কোনোয় বসে অপেক্ষা করছিল। এমন সময় ওর চোখে পড়ল টেবিলে রাখা একটি পত্রিকার ওপর, তাতে লেখা ‘ডিমের খোসার বিকল্প ব্যবহার'। এক নিঃশ্বাসে সবটা খবর পড়ে ফেলে সে। তারপর বাড়ি ফিরে পরিবারের সবাইকে নিয়ে শুরু করে পরিকল্পনা।
প্রায় বিনা পুঁজিতে মেরিনার পরিবার ব্যবসাটা শুরু করে। প্রথমে তারা আশপাশের বাড়িগুলো থেকে ডিমের খোসা সংগ্রহ করে নিয়ম অনুযায়ী গুঁড়া করে শহরের পার্লার, নার্সারি আর একটা ওষুধের ফ্যাক্টরিতে নিয়ে যায়। বছরখানেক এভাবেই ঘুরে ঘুরে এগুলো বিক্রি করার পর কিছুটা অভাব ঘুচতে শুরু হয় তাদের। স্কুলের এক শিক্ষকের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে সে আলাপ করলে, শিক্ষক তাকে মোবাইল ফোনে বেশ কিছু ভিডিও দেখান। সেখান থেকে মেরিনা দারুণ কিছু আইডিয়া পায়।
বাড়ি গিয়ে সবার সঙ্গে আলোচনা করে নতুন করে ব্যবসার জন্য পরিকল্পনা করে। এর পরেরটুকু ইতিহাস ! বদলে যায় মেরিনাদের জীবনকাহিনি। তারা ডিমের খোসা গুঁড়া করার জন্য একটা বড় ব্লেন্ডিং মেশিন তৈরি করে। ডিমের খোসা জমানোর জন্য গ্রামের সব বাড়িতে তারা একটা করে ঝুড়ি দিয়ে আসে। সপ্তাহে তিন দিন মেরিনার বাবা-মা সেগুলো সবার বাড়ি থেকে সংগ্রহ করে আনেন। স্কুল থেকে ফেরার পথে মেরিনা আর তার ভাই শহরের হোটেলগুলো থেকে খোসা সংগ্রহ করে আনে। গুঁড়ার মান ভালো হওয়ায় তাদের এখন আর দোকানে ঘুরে ঘুরে বিক্রয় করতে হয় না। তার বাবার মোবাইল ফোনে অর্ডার আসে বিভিন্ন শহর থেকে, চাহিদামতো তারা সরবরাহ করে। কখনও দেখা যায় কোম্পানি থেকে লোক এসে সংগ্রহ করে নিয়ে যায়। ব্যবসা সামলানোর জন্য বেশ কিছু লোকও নিয়োগ দিতে হয় তাদের। এভাবে কেটে যায় বছর পাঁচেক। মেরিনাদের পরিবার এখন স্বপ্ন দেখে ডিমের খোসার গুঁড়া বিদেশে রপ্তানি করার! শুরু করে নতুন পরিকল্পনা!
মেরিনার চরিত্রে নিজেকে কল্পনা করে নিচের ছকটি দলগত আলোচনার মাধ্যমে পূরণ করো।
প্রথম বছরের জন্য (স্বল্পমেয়াদি ) তোমাদের পরিকল্পনা | |
পরবর্তী ৫ বছরের জন্য (মধ্যমেয়াদি) তোমাদের পরিকল্পনা | |
বিদেশে রপ্তানির জন্য ( দীর্ঘমেয়াদি) তোমাদের পরিকল্পনা | |
উক্ত পরিকল্পনার একটি করে সামর্থ্য, দুর্বলতা, সুযোগ ও চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করো (আত্মপ্রতিফলন) | |
শিক্ষকের মন্তব্য |
একক কাজ তোমাদের এলাকার/পরিবারের/গ্রামের যেকোনো একজনের কর্মে সফলতার কাহিনি শুনে নাও। প্রশ্ন করে জেনে নাও তার বিভিন্ন ধাপের পথ চলার গল্প। তার লক্ষ্য কী ছিল, কীভাবে তিনি লক্ষ্যে পৌঁছান, তিনি কী কী বাধার সম্মুখীন হয়েছেন, কীভাবে সেসব বাধা অতিক্রম করেছেন, এখনকার অবস্থান নিয়ে তার অভিব্যক্তি ইত্যাদি জেনে নাও। এরপর তার গল্প দিয়ে একটি জীবন নদী আঁক অথবা ক্লাসে সবার সঙ্গে অভিজ্ঞতা বিনিময় করো। |
(কারও জীবনে উত্থান ও পতন থাকতে পারে, কারও জীবনে শুধুই উত্থান থাকতে পারে, আবার কারও জীবনে বাধা বিপত্তি কাটানোর পরিকল্পনার সফল বাস্তবায়নও থাকতে পারে। একেক ব্যক্তি ভিন্নধর্মী পথ পাড়ি দিয়ে গন্তব্যে পৌঁছায়। তোমরা যে যেমন গল্প শুনবে সে রকম একটি ফ্লোচার্ট/ গতিপথ এঁকে নাও। গতিপথের প্রতিটি ধাপে ছোট ছোট বর্ণনা থাকতে পারে।)
জীবন নদী
|
নতুন পরিস্থিতিতে নিজেকে দ্রুত খাপ খাইয়ে নেওয়ার যোগ্যতা অর্থাৎ প্রয়োজনীয় জ্ঞান, দক্ষতা, দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যবোধ অর্জন করতে হয়। নিজেকে আগামী দিনের উপযোগী করে তোলার জন্য এ সব গুণ ও দক্ষতার উন্নয়নও জরুরি। আর এ সব কিছুর জন্য নিজের সম্পর্কে ভালোভাবে জেনে নিতে হয়। প্রত্যেকেরই নিজস্বতা বা স্বাতন্ত্র্যবোধ রয়েছে। একেকজনের চিন্তা, চাহিদা, রুচিবোধ, পছন্দ, অপছন্দ, আগ্রহ ও দক্ষতার সঙ্গে অন্যজনের পার্থক্য রয়েছে। কেউ হয়তো গণিত করতে ভালোবাসে, কেউ আছে গণিতকে অপছন্দ করে, তবে সাহিত্য পড়তে পছন্দ করে। কেউ হয়তো বাইরের প্রকৃতি দেখতে ভালোবাসে, কেউ হয়তো ল্যাবরেটরিতে কাজ করে আনন্দ পায়। অনেকেই আছে সবাইকে নিয়ে হৈচৈ করে কাটাতে পছন্দ করে, কেউ হয়তো নিরিবিলি সময় কাটাতে ভালোবাসে। প্রতিটি ব্যক্তির বৈশিষ্ট্য, গুণ, পছন্দের ধরন আলাদা। তাই কোন কাজে নিজের আগ্রহ আছে, সেই আগ্রহের পিছনে পটভূমি কী, দক্ষতা বা সামর্থ্য আছে কি না, কোনো ধরনের দুর্বলতা আছে কি না, কীভাবে তা পরিচর্যার মাধ্যমে উন্নয়ন ঘটানো যায়, তা জানা প্রয়োজন। এতে নিজের ওপর আস্থা ও আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি পায়। সে ক্ষেত্রে নিজেকে প্রস্তুত করার উৎসাহ, উদ্দীপনা ও কর্মস্পৃহা বেড়ে যায়। ফলে লক্ষ্যে পৌঁছানোর পথ সুগম হয়।
আগ্রহ ও যোগ্যতা অনুযায়ী লক্ষ্যে পৌঁছানোর সুন্দর একটা পরিকল্পনা আমাদের পথ চলার পুঁজি, তবে মনে রাখতে হবে লক্ষ্যে পৌছানোর মূল চাবিকাঠি হলো কাজের প্রতি আমাদের নিষ্ঠা, একাগ্রতা, পরিশ্রম ও দৃঢ় প্রত্যয় । পরিকল্পনা হাতে আছে তাই অলৌকিকভাবে লক্ষ্যে পৌঁছানো যাবে এ রকম ভাবনা অমূলক। উদ্যোগী হয়ে কাজে মনোনিবেশ করতে হবে। কথায় আছে, পরিশ্রমীদের সৃষ্টিকর্তা সৌভাগ্য দান করেন। অতএব আমরা নিজের সম্পর্কে জেনে লক্ষ্য নির্ধারণ করব এবং যোগ্যতার উন্নয়নের মাধ্যমে দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে স্বপ্ন ছোঁয়ার পথে পাড়ি জমাব ।
১. নিজের জন্য একটি লক্ষ্য স্থির করো এবং উক্ত লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য ব্যক্তিগত সোয়াট অ্যানালাইসিস করো।
২. এই অধ্যায়ে আমরা যা যা করেছি। (√ টিক চিহ্ন দাও)
কাজসমূহ | করতে পারিনি (১) | আংশিক করেছি (২) | ভালোভাবে করেছি (৩) |
---|---|---|---|
ঈশানের বদলে যাওয়ার কারণ বিশ্লেষণ | |||
আত্মজিজ্ঞাসার মাধ্যমে নিজেকে জানার চেষ্টা করা | |||
নিজের অতীত ও বর্তমানের পছন্দের তুলনা করা | |||
জীবনের লক্ষ্য নিয়ে বিতর্কে অংশগ্রহণ করা ও অবদান রাখা | |||
নিজের জন্য পেশা (আপাত) নির্বাচন করা | |||
গল্পের আবু ও শিলার লক্ষ্য পৌঁছানোর জন্য পরিকল্পনা করা | |||
গল্পের আবু ও শিলার লক্ষ্য পৌঁছানোর পরিকল্পনার বিশ্লেষণ | |||
মেরিনার গল্প অবলম্বনে স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করা | |||
এলাকার/পরিবারের/গ্রামের যেকোনো একজনের সফলতার গল্প শোনা/সংগ্রহ করা | |||
সফলতার কাহিনি পর্যালোচনা করে জীবন নদীর ধাপ অঙ্কন | |||
মোট স্কোর: ৩০ | আমার প্রাপ্ত স্কোর : | ||
আমার অভিভাবকের মন্তব্য: | |||
শিক্ষকের মন্তব্য: |
এই অধ্যায়ের যেসব বিষয় আমাকে আরও ভালোভাবে জানতে হবে তা লিখি-
|
যে কাজগুলোর নিয়মিত চর্চা আমাকে চালিয়ে যেতে হবে সেগুলো লিখি-
|
Read more