ঘৃণা অর্থ কাউকে অত্যধিক অপছন্দ করা, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা, হীন ও নীচ মনে করা। ঘৃণার আরবি প্রতিশব্দ আল বুগনু )البغض(, এর বিপরীত শব্দ الحب বা ভালোবাসা। অহংকার বশত নিজেকে বড় মনে করে অন্যকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা ও তার সাথে দুরত্ব বজায় রাখাই হলো ঘৃণা। কাউকে ঘৃণা করলে, তার কোনো কিছুই সহ্য হয় না। উভয়ের মাঝে শত্রুতা সৃষ্টি হয়।
মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। আল্লাহ তা'আলা মানুষকে মর্যাদাবান করে সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, আমাদের সমাজের অনেকেই মানুষকে পেশাগত কারণে ও অর্থবিত্তের কারণে সম্মান করে বা ঘৃনা করে। আমাদের আশেপাশে লক্ষ করলেই দেখতে পাবো, অনেকে কথা-বার্তায় ও আচার-অন্তরণে অন্যের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করে। যেমন, অনেকে জুতো সেলাইকারী, রিক্সাচালক, ভ্যানগাড়ি চালক, পরিচ্ছন্নতা কর্মীকে অবজ্ঞা করে কথা বলে তাদেরকে উপেক্ষা করে, তারা নিকটাত্মীয় হওয়ার পরও শুধু দরিদ্র হওয়ার কারণে তাদের সাথে সম্পর্ক রক্ষা করে না।
কুরআন মাজিদে আল্লাহ তা'আলা মানুষকে ঘৃণা ও ঘৃণা প্রকাশক কার্যকলাপ থেকে দূরে থাকতে আদেশ দিয়ে বলেন, 'হে মুমিনগণ। কোনো সম্প্রদায় যেন অপর সম্প্রদায়কে উপহাস না করে। কেননা, তারা উপহাসকারী অপেক্ষা উত্তম হতে পারে। কোনো নারী যেন অন্য নারীকে বিদ্রূপ না করে। সে বিদ্রূপকারিণী অপেক্ষা উত্তম হতে পারে। আর তোমরা একে অপরের প্রতি দোষারোপ করো না ও একে অপরকে মন্দ নামে ডেকো না' (সুরা আল-হুজুরাত, আয়াত: ১১)। ক্ষণস্থায়ী দুনিয়ায় পদ-পদবি, সামাজিক পদমর্যাদাও হ্রাস বা বৃদ্ধি পায়। তাই এসব কারণে কাউকে ঘৃণা করা উচিত নয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কাউকে ঘৃণা করলে, পরবর্তীকালে লজ্জা পেতে হয়। চাই সে ঘৃণিত ব্যক্তি ঘৃণাকারীকে লজ্জা দিক বা ঘৃণাকারী নিজে ঘৃণিত ব্যক্তির উন্নতি দেখে লজ্জা পাক।
সমাজে ঘৃণার প্রভাব ও পরিণতি
পারস্পরিক ঘৃণা-বিদ্বেষ সমাজের একটি ভীষণ নিন্দনীয় দিক। ঘৃণার কারণে সমাজে বিভেদ তৈরি হয়, অশান্তি ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। বেশিরভাগ সময় অহংকারবশত মানুষ অন্যকে ঘৃণা করে। অহংকারী মানুষ নিজেকে বড় মনে করে অন্যকে হেয় করে কথা-বার্তা বলে, তাকে অপমান-অপদস্থ করে। এভাবেই সমাজে ঘৃণার প্রসার ঘটে। মানুষ যাতে নিজের উঁচু পদ-পদবি, অর্থ-বিত্ত, সামাজিক পদমর্যাদার কারণে অহংকার না করে, সে জন্য আল্লাহ তা'আলা কুর'আন মাজিদে মানুষকে তাঁর সৃষ্টি সম্পর্কে সারণ করিয়ে দিয়েছেন। আল্লাহ তা'আলা বলেন, 'আমি কি তোমাদেরকে তুচ্ছ পানি থেকে সৃষ্টি করিনি?' (সুরা মুরসালাত, আয়াত: ২০)
ঘৃণার প্রসার ঘৃণাকারী ও ঘৃণিত উভয়কে কষ্ট দেয়। যাকে ঘৃণা করা হয় তিনি লজ্জিত ও অপমানিত বোধ করেন। অন্যদিকে ঘৃণাকারী অন্যকে ঘৃণা করার কারণে মানসিক অস্থিরতায় ভোগে। তার অন্তরের প্রশান্তি দূর হয়ে যায়। ঘৃণ্য কোনো কল্যাণ বয়ে আনে না বরং সৎকর্মকে ধধ্বংস করে দেয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, 'তোমাদের পূর্ববর্তী উম্মাতের রোগ তোমাদের মাঝে সংক্রমিত হয়েছে। তা হলো হিংসা-বিদ্বেষ ও ঘৃনা। আর ঘৃনা (সৎকর্ম) ধাংস করে দেয়।' (তিরমিযি )
রাসুলুল্লাহ (সা.) আরো বলেন-
لَا تَبَاغَضُوا ، وَلَا تَحَاسَدُوا ، وَلَا تَدَابَرُوْا، وَكُونُوا عِبَادَ اللَّهِ إِخْوَانًا
وَلَا يَحِلُّ لِمُسْلِم أَن يَهْجَرَ أَخَاهُ فَوْقَ ثَلَاثِ لَيَالٍ
অর্থ: 'তোমরা পরস্পরকে ঘৃণা করো না, হিংসা করো না, ষড়যন্ত্র করো না। তোমরা পরস্পর আল্লাহর বান্দা হিসাবে ভাই ভাই হয়ে যাও। কোনো মুসলিমের জন্য বৈধ নয় যে, সে তাঁর ভাইয়ের সাথে তিন রাতের অধিক সম্পর্ক ছিন্ন করে থাকবে।' (বুখারি)
ইবলিস শয়তান অহংকারবশত হযরত আদম (আ.) এর প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করেছিল। তাই আল্লাহ তা'আলা তাকে জান্নাত থেকে বিতাড়িত করেছিলেন। শয়তানের প্ররোচনায় আমরা অন্যকে অবজ্ঞা ও ঘৃণা করি। আমরা আল্লাহ তা'আলার নিকট দোয়া করব যেন, আমরা কাউকে অন্যায়ভাবে ঘৃণা না করি। কখনো ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় কারো প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করলে, তার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিব।
আমাদের ভালোবাসা ও ঘৃণা হবে আল্লাহর জন্য। রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, 'যে আল্লাহর জন্য কাউকে ভালোবাসে, আর আল্লাহর জন্য কাউকে ঘৃণা করে এবং আল্লাহর জন্যই দান-সদাকা করে আবার আল্লাহর জন্যই দান-সদাকা করা থেকে বিরত থাকে তাঁর ঈমান পরিপূর্ণ হলো' (আবু দাউদ)। আমরা মু'মিন ও সৎকর্মপরায়ণ মানুষকে ভালোবাসবো, তাদের সাথে ওঠাবসা করবো। যারা পাপ কাজ করে ও পাপ কাজের প্রসারে সাহায্য করে, তাদের থেকে দূরে থাকবো।
আরও দেখুন...