পরমাণু খুব ক্ষুদ্র কণা। তাই এর গঠন সম্পর্কে ধারণা পাওয়া সহজ নয়। তবে বিভিন্ন বিজ্ঞানীদের পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর পরমাণুর গঠন সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পাওয়া গেছে। পরমাণুতে ইলেকট্রন, প্রোটন ও নিউট্রনের সংখ্যার ভিন্নতার কারণে পরমাণুর ধর্মে পার্থক্য দেখা যায়৷
এ অধ্যায় পাঠ শেষে আমরা-
• পরমাণুর গঠন ব্যাখ্যা করতে পারব;
• পারমাণবিক সংখ্যা ও ভর সংখ্যা ব্যাখ্যা করতে পারব;
• আইসোটোপ ব্যাখ্যা করতে পারব;
• ইলেকট্রন বিন্যাস ব্যাখ্যা করতে পারব;
• আয়ন কীভাবে সৃষ্টি হয় ব্যাখ্যা করতে পারব;
• ক্যাটায়ন ও অ্যানায়নের পার্থক্য করতে পারব;
• অ্যানায়ন ও ক্যাটায়ন ব্যবহার করে রাসায়নিক সংকেত প্রণয়ন করতে পারব;
• আইসোটোপের ব্যবহার বর্ণনা করতে পারব; আমাদের জীবনে আইসোটোপের অবদান উপলব্ধি করতে পারব।
তোমরা জেনেছ যে, পদার্থ ক্ষুদ্র কণা দ্বারা গঠিত। এ ক্ষুদ্র কণা দুই রকমের- অণু ও পরমাণু। পরমাণু ক্ষুদ্রতম কণা। একের অধিক পরমাণু পরস্পরের সাথে যুক্ত হয়ে অণু গঠন করে। ক্ষুদ্রতম কণার বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে বিজ্ঞানী ও দার্শনিকগণ নানা রকম মতবাদ ব্যক্ত করেছেন। গ্রীক দার্শনিক ডেমোক্রিটাস খ্রিস্টপূর্ব ৪০০ অব্দে সর্বপ্রথম পদার্থের ক্ষুদ্রতম কণা নিয়ে মতবাদ পোষণ করেন। তার মতে সকল পদার্থই ক্ষুদ্ৰ ক্ষুদ্ৰ অবিভাজ্য (যা আর ভাঙ্গা যায় না) কণা দ্বারা গঠিত। তিনি এই ক্ষুদ্রতম কণার নাম দেন পরমাণু বা এটম। এটম কথাটি তিনি নিয়েছিলেন গ্রীক শব্দ এটোমোস (Atomos) থেকে যার অর্থ হলো অবিভাজ্য। তার সমসাময়িক সময়ের আরও দুজন দার্শনিক প্লেটো (Plato) এবং অ্যারিস্টটল ( Aristotle) তার মতবাদের সাথে দ্বিমত পোষণ করেন। অ্যারিস্টটলের মতে পদার্থসমূহ নিরবচ্ছিন্ন (Continuous), একে যতই ভাঙ্গা হোক না কেন, পদার্থের কণাগুলো ক্ষুদ্র হতে ক্ষুদ্রতর হতে থাকবে।
১৮০৩ সালে ইংরেজ বিজ্ঞানী জন ডাল্টন (John Dalton) পরীক্ষালব্ধ তথ্যের উপর ভিত্তি করে পদার্থের ক্ষুদ্রতম কণা সম্পর্কে বলেন—
পরমাণু হলো মৌলিক পদার্থের ক্ষুদ্রতম কণা এবং একে আর ভাঙ্গা যায় না।
ডাল্টনের এ মতবাদ সকলে গ্রহণ করে। ফলে অ্যারিস্টটলের মতবাদটি পরিত্যক্ত হয়। আসলে পরমাণু অবিভাজ্য নয় বা ক্ষুদ্রতম কণিকাও নয়। পরমাণু বিভাজ্য। এরা ইলেকট্রন, প্রোটন ও নিউট্রন দ্বারা গঠিত।
ডাল্টনের পরমাণুবাদের এই সীমাবদ্ধতা দূর করার জন্য পরবর্তীতে আরও অনেকে পরমাণু মডেলের প্রস্তাব করেন। এদের মধ্যে রাদারফোর্ড ও বোরের পরমাণু মডেল গ্রহণযোগ্যতা পায়৷
একসময় বিজ্ঞানী রাদারফোর্ড ও তাঁর সহকর্মীরা একটি পরীক্ষা করেন যা পরমাণুর গঠন সম্পর্কে ভালো ধারণা দেয়। পরীক্ষালব্ধ ফল থেকে রাদারফোর্ড বলেন যে, পরমাণুতে ধনাত্মক আধান ও ভর একটি ক্ষুদ্র জায়গায় আবদ্ধ। তিনি এর নাম দেন নিউক্লিয়াস। তিনি আরও ব্যাখ্যা দেন যে, পরমাণুর বেশিরভাগ জায়গা ফাঁকা, আর ঋণাত্মক আধানযুক্ত কণার তেমন কোনো ভর নেই এবং তারা নিউক্লিয়াসকে কেন্দ্র করে ঘুরছে।
রাদারফোর্ডের মডেল সৌরজগতের মতো। কিন্তু রাদারফোর্ড নির্দিষ্ট কোনো কক্ষপথের কথা বলেননি। বিজ্ঞানী বোর পরবর্তীকালে ধারণা দেন যে, ঋণাত্মক আধানযুক্ত কণা কিছু নির্দিষ্ট কক্ষপথে ঘুরে। উপরিউক্ত আলোচনা থেকে বলা যায় যে, পরমাণু অবিভাজ্য নয়। পরমাণু ইলেকট্রন, প্রোটন ও নিউট্রনের সমন্বয়ে গঠিত। পরমাণুর কেন্দ্রে রয়েছে নিউক্লিয়াস। নিউক্লিয়াসে ধনাত্মক আধানযুক্ত প্রোটন ও আধান নিরপেক্ষ নিউট্রন রয়েছে। পরমাণুর ভরের প্রায় পুরোটাই নিউক্লিয়াসে থাকে। ঋণাত্মক আধানযুক্ত ইলেকট্রন নিউক্লিয়াসকে কেন্দ্র করে নির্দিষ্ট কক্ষপথে ঘুরে। ইলেকট্রন ও নিউক্লিয়াসের মধ্যবর্তী জায়গা ফাঁকা। প্রকৃতপক্ষে পরমাণুর বেশিরভাগ জায়গা ফাঁকা।
প্রতিটি মৌলের আলাদা আলাদা পরমাণু রয়েছে, যেমন হাইড্রোজেন গ্যাসের পরমাণু অক্সিজেন গ্যাসের পরমাণু থেকে আলাদা। একটি মৌলের পরমাণু থেকে আরেকটি মৌলের পরমাণুর মধ্যে আকার, ভর ও ধর্মে পার্থক্য হয়ে থাকে। কেন এই পার্থক্য? পরমাণুতে প্রোটন বা ইলেকট্রনের সংখ্যার পার্থক্যের কারণে পরমাণুসমূহের মধ্যে পার্থক্য হয়ে থাকে। পরমাণুতে ইলেকট্রন ও প্রোটনের সংখ্যা সমান থাকে। তবে কোনো মৌলের পরমাণুর বৈশিষ্ট্যকে বোঝানোর জন্য প্রোটনের সংখ্যা ব্যবহার করা হয়।
কোনো মৌলের একটি পরমাণুতে প্রোটনের সংখ্যাকে পারমাণবিক সংখ্যা বলা হয়। হাইড্রোজেনের একটি পরমাণুতে একটি প্রোটন আছে। তাই হাইড্রোজেনের পারমাণবিক সংখ্যা ১। অক্সিজেনের একটি পরমাণুতে ৮টি প্রোটন আছে। তাই অক্সিজেনের পারমাণবিক সংখ্যা ৮। পারমাণবিক সংখ্যা থেকে কী কী তথ্য পাওয়া যায় বলতে পার?
কার্বনের পারমাণবিক সংখ্যা ৬, এ থেকে কী তথ্য পাওয়া যায়? পারমাণবিক সংখ্যা যেহেতু কোনো মৌলের প্রোটনের সংখ্যা, তাই বোঝা যায় কার্বনের একটি পরমাণুতে ৬টি প্রোটন আছে। একটি পরমাণুতে যেহেতু প্রোটন আর ইলেকট্রনের সংখ্যা সমান, তাই বোঝা যায় কার্বনের একটি পরমাণুতে ৬টি ইলেকট্রন আছে।
কোনো মৌলের পারমাণবিক সংখ্যা থেকে বোঝা যায় কি ঐ মৌলের পরমাণুতে কয়টি নিউট্রন আছে? না, নিউট্রন সংখ্যা জানা যায় না। নিউট্রন সংখ্যা জানতে হলে মৌলের পারমাণবিক সংখ্যা ও ভরসংখ্যা জানতে হবে। একটি পরমাণুতে ইলেকট্রনের ভর নগণ্য। পরমাণুর প্রায় সবটুকু ভর তার নিউক্লিয়াসে থাকে। অর্থাৎ কোনো পরমাণুর ভর তার প্রোটন ও নিউট্রনের ভর। আবার নিউট্রন ও প্রোটনের ভর প্রায় সমান। কোনো মৌলের পরমাণুতে প্রোটন ও নিউট্রনের সমষ্টিকে ভরসংখ্যা হিসাবে প্রকাশ করা হয়। অর্থাৎ
কোনো মৌলের ভরসংখ্যা ঐ মৌলের পরমাণুতে প্রোটনের সংখ্যা + নিউট্রনের সংখ্যা
যেমন অক্সিজেন পরমাণুতে ৮টি প্রোটন আর ৮টি নিউট্রন থাকে। তাই অক্সিজেনের ভরসংখ্যা ১৬। আবার সোডিয়ামের একটি পরমাণুতে ১১টি প্রোটন আর ১২টি নিউট্রন আছে। তাই সোডিয়ামের ভরসংখ্যা ১১+১২=২৩। পূর্বেই বলা হয়েছে যে, পারমাণবিক সংখ্যা ও ভরসংখ্যা জানা থাকলে নিউট্রন সংখ্যা জানা যায়। নিচের উদাহরণ থেকে তোমরা এটি ভালোভাবে বুঝতে পারবে।
উদাহরণ : ক নামক একটি মৌলের পারমাণবিক সংখ্যা ১৭ ও ভরসংখ্যা ৩৫। ঐ মৌলের একটি পরমাণুতে কয়টি করে ইলেকট্রন, প্রোটন ও নিউট্রন আছে?
সমাধান : ক মৌলটির পারমাণবিক সংখ্যা ১৭। কোনো মৌলের পারমাণবিক সংখ্যা আসলে ঐ মৌলের একটি পরমাণুতে প্রোটনের সংখ্যা। তাই এক্ষেত্রে ক মৌলটির পরমাণুতে প্রোটন আছে ১৭টি।
আবার কোনো পরমাণুতে প্রোটন আর ইলেকট্রনের সংখ্যা সমান। তাই ক মৌলের একটি পরমাণুতে ইলেকট্রন রয়েছে ১৭টি।
কোনো পরমাণুর প্রোটনের সংখ্যা + নিউট্রনের সংখ্যা ঐ মৌলের ভরসংখ্যা
অর্থাৎ ক মৌলের নিউট্রনের সংখ্যা = ক মৌলের ভরসংখ্যা – ক মৌলের প্রোটন সংখ্যা
অতএব, ক মৌলের নিউট্রনের সংখ্যা = ৩৫ – ১৭ = ১৮
আইসোটোপ : তোমরা ইতোমধ্যেই জেনেছ যে, একটি মৌলের প্রতিটি পরমাণুতে নির্দিষ্ট সংখ্যক প্রোটন ও ইলেকট্রন থাকে। কিন্তু একটি মৌলের সকল পরমাণুর ভর এক নাও হতে পারে। কারণ একটি মৌলের পরমাণুতে বিভিন্ন সংখ্যায় নিউট্রন থাকতে পারে। যেমন হাইড্রোজেনের সকল পরমাণুতে একটি করে প্রোটন ও ইলেকট্রন থাকে। নিচের চিত্রগুলো দেখ।
হাইড্রোজেনের বেশিরভাগ পরমাণুতে কোনো নিউট্রন নেই (ক চিত্রের পরমাণু)। তাই এদের ভরসংখ্যা ১ । কিন্তু খ চিত্রের পরমাণুটির মতো হাইড্রোজেনের কিছু পরমাণুতে একটি নিউট্রন থাকে। এদের ভরসংখ্যা ২। আবার গ চিত্রের পরমাণুটির মতো হাইড্রোজেনের কিছু পরমাণুতে দুটি নিউট্রন থাকে। এদের ভরসংখ্যা ৩। চিত্রের তিনটি পরমাণু হাইড্রোজেনের তিনটি আইসোটোপ। এরকমভাবে, কোনো মৌলের ভিন্ন ধরনের পরমাণু
যাদের প্রোটন বা পারমাণবিক সংখ্যা সমান কিন্তু ভরসংখ্যা ভিন্ন তাদেরকে ঐ মৌলের আইসোটোপ বলে।
কার্বনের বেশিরভাগ পরমাণুতে ৬টি প্রোটন ও ৬টি নিউট্রন রয়েছে। কিন্তু কার্বনের কিছু পরমাণুতে ৭টি বা ৮টি নিউট্রনও থাকে। তাই কার্বনের তিনটি আইসোটোপ রয়েছে।
একই মৌলের বিভিন্ন আইসোটোপের প্রোটন ও ইলেকট্রন সংখ্যা সমান বলে আইসোটোপগুলোর মধ্যে ধর্মে তেমন পার্থক্য নেই। তবে যেহেতু তাদের ভর আলাদা তাই তাদের সহজেই শনাক্ত করা যায়।
সাধারণত আইসোটোপ অস্থায়ী। অস্থায়ী আইসোটোপ বিভিন্ন তেজস্ক্রিয় রশ্মি ও কণা বিকিরণ করে। তাই এদেরকে তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ বলা হয়। বিভিন্ন ক্ষেত্রে তেজস্ক্রিয় আইসোটোপের এ ধর্ম কাজে লাগানো হয়। নিচে বিভিন্ন ক্ষেত্রে আইসোটোপের ব্যবহার উল্লেখ করা হলো।
চিকিৎসা ক্ষেত্রে : বিভিন্ন রোগ নির্ণয়ে ও নিরাময়ে আইসোটোপের ব্যবহার করা হয়। কোনো ক্ষুদ্র রক্তনালি ক্ষতিগ্রস্ত হলে রক্তের মাধ্যমে আইসোটোপ পাঠিয়ে তা শনাক্ত করা যায়। একইভাবে ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীর কোন কোষ ক্যান্সার আক্রান্ত, তা আইসোটোপ দিয়ে নির্ণয় করা যায়। আবার ক্যান্সার আক্রান্ত কোষ ধ্বংস করা যায় আইসোটোপের তেজস্ক্রিয় বিকিরণ ব্যবহার করে। এছাড়াও তেজস্ক্রিয় রশ্মি ব্যবহার করে ডাক্তারি যন্ত্রপাতি জীবাণুমুক্ত করা হয়।
চিকিৎসা ক্ষেত্রে : বিভিন্ন রোগ নির্ণয়ে ও নিরাময়ে আইসোটোপের ব্যবহার করা হয়। কোনো ক্ষুদ্র রক্তনালি ক্ষতিগ্রস্ত হলে রক্তের মাধ্যমে আইসোটোপ পাঠিয়ে তা শনাক্ত করা যায়। একইভাবে ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীর কোন কোষ ক্যান্সার আক্রান্ত, তা আইসোটোপ দিয়ে নির্ণয় করা যায়। আবার ক্যান্সার আক্রান্ত কোষ ধ্বংস করা যায় আইসোটোপের তেজস্ক্রিয় বিকিরণ ব্যবহার করে। এছাড়াও তেজস্ক্রিয় রশ্মি ব্যবহার করে ডাক্তারি যন্ত্রপাতি জীবাণুমুক্ত করা হয়।
কৃষিক্ষেত্রে : কৃষিক্ষেত্রে পতঙ্গ নিয়ন্ত্রণে আইসোটোপের তেজস্ক্রিয় রশ্মি ব্যবহার করা হয়। এছাড়া কখন কোন সার কী পরিমাণ ব্যবহার করতে হবে তা জানতে তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ ব্যবহার করা হয়।
খাদ্যদ্রব্য সংরক্ষণে : ব্যাকটেরিয়াসহ অনেক জীবাণু তেজস্ক্রিয় রশ্মিতে মারা যায়। তাই তেজস্ক্রিয় রশ্মি ব্যবহার করে খাদ্যদ্রব্য বা ফলমূলকে জীবাণুমুক্ত করে সরক্ষণ করা হয়।
ভূ-তাত্ত্বিক বৈজ্ঞানিক গবেষণা কাজে : তোমরা অনেক সময় খবরে শুনে থাক যে, কোনো দেশে কয়েক কোটি বছরের পুরনো ফসিল পাওয়া গেছে। কীভাবে বিজ্ঞানীরা জানেন যে, ফসিলটি কত বছরের? এটি জানা যায় আইসোটোপের ক্ষয় থেকে। কোনো ফসিলে স্থায়ী ও অস্থায়ী আইসোটোপের অনুপাত থেকে বোঝা যায় ফসিলটি কত বছরের পুরনো।
তোমরা জেনেছ যে, পরমাণুতে ইলেকট্রন নিউক্লিয়াসকে কেন্দ্র করে ঘুরে এবং তাদের সুনির্দিষ্ট কক্ষপথ রয়েছে। এখন প্রশ্ন হলো, একটি কক্ষপথে কয়টি ইলেকট্রন থাকবে? চিত্র ৬.২ এর হাইড্রোজেনের ক চিত্রটি দেখ। হাইড্রোজেন পরমাণুতে ১টি ইলেকট্রন থাকে। যা নিউক্লিয়াসকে কেন্দ্র করে ঘুরে । হিলিয়াম পরমাণুতে (চিত্র ৬.১) ২টি ইলেকট্রন নিউক্লিয়াসকে কেন্দ্র করে একটি কক্ষপথে ঘুরে । কক্ষপথগুলোতে 2n2 (যেখানে n = 1, 2, 3 ........ কক্ষপথের ক্রমিক নম্বর) সূত্রানুযায়ী ইলেকট্রন বিন্যাস থাকে। সে অনুযায়ী, ১টি লিথিয়াম পরমাণুতে ৩টি ইলেকট্রন আছে। এদের মধ্যে ২টি ইলেকট্রন প্রথম কক্ষপথে থাকে আর তৃতীয়টি দ্বিতীয় কক্ষপথে থাকে। একইভাবে কার্বন পরমাণুতে ৬টি ইলেকট্রন থাকায় এদের ২টি ইলেকট্রন প্রথম কক্ষপথে এবং বাকি ৪টি ইলেকট্রন দ্বিতীয় কক্ষপথে থাকে। এভাবে প্রথম কক্ষপথে সর্বোচ্চ ২টি, দ্বিতীয় কক্ষপথে সর্বোচ্চ ৮টি এবং তৃতীয় কক্ষপথে সর্বোচ্চ ১৮টি ইলেকট্রন থাকতে পারে। কক্ষপথগুলোকে শক্তিস্তরও বলা হয়।
এবার সোডিয়াম পরমাণুর ইলেকট্রন বিন্যাস দেখা যাক। সোডিয়ামের ১টি পরমাণুতে ১১টি ইলেকট্রন থাকে। তাহলে এর ইলেকট্রনগুলো কয়টি কক্ষপথে থাকবে? নিশ্চয়ই ২, ৮, ১ এভাবে ৩টি কক্ষপথে থাকবে। অর্থাৎ প্রথম কক্ষপথে ২টি, দ্বিতীয় কক্ষপথে ৮টি এবং তৃতীয় কক্ষপথে ১টি থাকবে।
চিত্রের সাহায্যে ইলেকট্রন বিন্যাস বোঝা বেশ সহজ। কিন্তু সহজে এবং সংক্ষেপে সোডিয়াম পরমাণুতে ইলেকট্রন বিন্যাস বোঝাতে হলে ২, ৮, ১ এভাবে লেখা হয়। প্রদত্ত উদাহরণ থেকে নিচের ছকে বাকি মৌলগুলোর প্রতীক ও ইলেকট্রন বিন্যাস লেখ।
মৌল | পারমাণবিক সংখ্যা | প্রতীক | ইলেকট্রন বিন্যাস |
---|---|---|---|
হাইড্রোজেন | ১ | ||
হিলিয়াম | ২ | ||
লিথিয়াম | ৩ | Li | ২, ১ |
বেরিলিয়াম | ৪ | ||
বোরন | ৫ | ||
কার্বন | ৬ | ||
নাইট্রোজেন | ৭ | N | ২,৫ |
অক্সিজেন | ৮ | ||
ফ্লোরিন | ৯ | ||
নিয়ন | ১০ | ||
সোডিয়াম | ১১ | Na | ২, ৮, ১ |
ম্যাগনেসিয়াম | ১২ | ||
অ্যালুমিনিয়াম | ১৩ | ||
সিলিকন | ১৪ | ||
ফসফরাস | ১৫ | ||
সালফার | ১৬ | ||
ক্লোরিন | ১৭ | C1 | ২, ৮, ৭ |
আগন | ১৮ |
মৌলিক পদার্থের ধর্ম মূলত তাদের পরমাণুর ইলেকট্রন বিন্যাসের উপর নির্ভর করে। এ ইলেকট্রন বিন্যাসের ভিন্নতার কারণে সাধারণত মৌলগুলো কখনো নিষ্ক্রিয়, কখনো সক্রিয় বা আধান যুক্ত হয়।
১টি পরমাণুর সর্বশেষ কক্ষপথে যে কয়টি ইলেকট্রন থাকতে পারে, ঠিক সেই কয়টি যদি থাকে তাহলে কক্ষপথটি পূর্ণ থাকে। এরকম পরমাণুগুলো বেশ নিষ্ক্রিয় হয়। যেমন হিলিয়াম পরমাণুতে ২টি ইলেকট্রন থাকে। প্রথম কক্ষপথে যেহেতু সর্বোচ্চ ২টি ইলেকট্রন থাকতে পারে, সেহেতু হিলিয়াম পরমাণু বেশ স্থিতিশীল বা নিষ্ক্রিয়। প্রতিটি পরমাণুই এরকম স্থিতিশীল অবস্থায় থাকতে চায় ৷
১টি পরমাণুর শেষ কক্ষপথে বা শক্তিস্তরে যদি প্রয়োজনের চেয়ে বেশি বা কম ইলেকট্রন থাকে তাহলে কী হবে? ঐ পরমাণু অন্য পরমাণু থেকে ইলেকট্রন গ্রহণ করে বা অন্য পরমাণুকে ইলেকট্রন দিয়ে বা অন্য পরমাণুর সাথে ভাগাভাগি করে স্থিতিশীল বা পূর্ণ অবস্থায় আসতে চায়। যেমন সোডিয়াম পরমাণুর প্রথম শক্তিস্তরে ২টি, দ্বিতীয় শক্তিস্তরে ৮টি এবং তৃতীয় শক্তিস্তরে ১টি ইলেকট্রন থাকে। এটি কি স্থিতিশীল অবস্থা? নিশ্চয়ই না। তৃতীয় শক্তিস্তরে মাত্র ১টি ইলেকট্রন থাকায় এটি স্থিতিশীল নয়। কীভাবে এটি স্থিতিশীলতা অর্জন করতে পারে? সোডিয়াম পরমাণু যদি ১টি ইলেকট্রন অন্য কোনো পরমাণুকে দিয়ে দিতে পারে তাহলে সোডিয়াম পরমাণুতে প্রথম শক্তিস্তরে ২টি এবং দ্বিতীয় শক্তিস্তরে ৮টি ইলেকট্রন থাকে। এটি একটি স্থিতিশীল অবস্থা। তবে ১টি ইলেকট্রন বর্জন করে বা হারিয়ে নিজে কিছুটা পরিবর্তিত হয়ে যায়। তোমরা জানো পরমাণু আধান নিরপেক্ষ। কিন্তু সোডিয়াম পরমাণু ১টি ইলেকট্রন হারিয়ে কি আধান নিরপেক্ষ থাকে? না থাকে না।
১টি ইলেকট্রন হারানোর পর সোডিয়াম পরমাণু আর আধান নিরপেক্ষ নেই, আধানযুক্ত হয়েছে। এরকম আধানযুক্ত পরমাণুকে বলে আয়ন। যে আয়নে ধনাত্মক আধান আছে তাকে ক্যাটায়ন বলে। তাহলে সোডিয়াম পরমাণু ১টি ইলেকট্রন হারানোর পর ক্যাটায়নে পরিণত হয়েছে।
এবার আরেকটি উদাহরণ দেখা যাক। ফ্লোরিন পরমাণুর ইলেকট্রন বিন্যাস ২,৭। এটি কি স্থিতিশীল অবস্থা? নিশ্চয়ই না। কারণ দ্বিতীয় শক্তিস্তরে ৮টি ইলেকট্রন নেই। তাহলে স্থিতিশীল অবস্থায় যেতে চাইলে ফ্লোরিন পরমাণুকে কী করতে হবে? এটি কি সোডিয়াম পরমাণুর মতো ইলেকট্রন অন্যকে দিয়ে দেবে? না, ৭টি ইলেকট্রন দেওয়া বেশ কঠিন। বরং ফ্লোরিন পরমাণু যদি ১টি ইলেকট্রন কারো কাছ থেকে নিতে পারে তাহলে এটি স্থিতিশীল হতে পারে কারণ তখন এটির দ্বিতীয় শক্তিস্তরে ৮টি ইলেকট্রন থাকবে। দেখা যাক, ১টি ইলেকট্রন যদি কারো কাছ থেকে পায় (ধরা যাক সোডিয়াম পরমাণু থেকে) তাহলে এটি আধান নিরপেক্ষ থাকে না, আধানযুক্ত হয়ে যায় ৷
ফ্লোরিন পরমাণু ১টি ইলেকট্রন গ্রহণ করার পর ঋণাত্মক আধান যুক্ত হয়েছে। অর্থাৎ ঋণাত্মক আয়নে পরিণত হয়েছে। এরকম ঋণাত্মক আধানযুক্ত পরমাণুকে অ্যানায়ন বলে।
ইলেকট্রন গ্রহণ বা বর্জনের মাধ্যমে পরমাণু আয়নে পরিণত হয়। ২টি পরমাণুর মধ্যে যেটি ইলেকট্রন বর্জন করে সেটি ক্যাটায়নে বা ধনাত্মক আয়নে এবং যেটি ইলেকট্রন গ্রহণ করে সেটি ঋণাত্মক আয়নে বা অ্যানায়নে পরিণত হয়। ফলে তাদের মধ্যে একটি আকর্ষণ বল কাজ করে এবং তারা একে অন্যের সাথে বন্ধনে আবদ্ধ হয়। এভাবে ২টি ভিন্ন মৌলের পরমাণু থেকে যৌগ তৈরি হয়। এ সম্পর্কে তোমরা পরবর্তীকালে আরও জানবে।
এ অধ্যায় পাঠ শেষে যা শিখলাম-
- পরমাণু অবিভাজ্য নয়। পরমাণু ইলেকট্রন, প্রোটন ও নিউট্রনের সমন্বয়ে গঠিত।
- পরমাণুর কেন্দ্রে রয়েছে নিউক্লিয়াস। নিউক্লিয়াসে ধনাত্মক আধান বিশিষ্ট প্রোটন ও আধান নিরপেক্ষ নিউট্রন রয়েছে। পরমাণুর ভরের প্রায় পুরোটাই নিউক্লিয়াসে থাকে।
- প্রথম কক্ষপথে সর্বোচ্চ ২টি, দ্বিতীয় কক্ষপথে সর্বোচ্চ ৮টি এবং তৃতীয় কক্ষপথে সর্বোচ্চ ১৮টি ইলেকট্রন থাকতে পারে। কক্ষপথগুলোকে শক্তিস্তর বলা হয়।
- সর্বশেষ কক্ষপথে যে কয়টি ইলেকট্রন থাকতে পারে, ঠিক সেই কয়টি ইলেকট্রন যদি ঐ শক্তিস্তরে থাকে তাহলে সেই কক্ষপথ পূর্ণ থাকে। এরকম পরমাণুগুলো বেশ নিষ্ক্রিয় হয়।
- ইলেকট্রন গ্রহণ বা বর্জনের মাধ্যমে পরমাণু স্থিতিশীলতা অর্জন করে এবং আয়নে পরিণত হয়।