পাঠাগার/ ধর্মীয় বই এর দোকান/কোনো বিহার এর পাঠাগারে যে সকল ধর্মীয় বই/ত্রিপিটক/বিনয় পিটক ইত্যাদি দেখলাম এবং পড়লাম সেই অভিজ্ঞতাটি নিচে লিখে ফেলি।
অভিজ্ঞতা
|
** এই পৃষ্ঠায় জায়গা না হলে একটি আলাদা কাগজে লিখে কাগজটি বইয়ের পৃষ্ঠার এক পাশে আঠা দিয়ে যুক্ত করতে পারি/খাতায় লিখতে পারি।
'বিনয়' অর্থ নিয়ম, নীতি, শৃঙ্খলা। পূর্বের শ্রেণিতে ত্রিপিটক বিষয়ে পাঠের সময় 'পিটক' শব্দটির অর্থ আমরা জেনেছি; আর তা হলো- ঝুড়ি বা পাত্র। সুতরাং, 'বিনয় পিটক' বলতে ত্রিপিটকের যে অংশে নিয়মনীতি ও শৃঙ্খলাপূর্ণ জীবনবিধি সংরক্ষিত হয়েছে সে অংশকে বোঝায়। নিয়ম রক্ষার জন্য প্রবর্তিত বিধি-বিধান বা আইন বিনয়ের অন্তর্ভুক্ত। তথাগত বুদ্ধের বিনয় বিধান মূলত ভিক্ষু-শ্রমণদের জন্য। সংসার ত্যাগী বৌদ্ধ ভিক্ষু- শ্রমণদের সুষ্ঠু, সুন্দর ও পরিশীলিত জীবন গঠনের জন্য, এবং নৈমিত্তিক জীবনাচারে পরিশুদ্ধতা বজায় রাখার লক্ষ্যে মহাকারুণিক বুদ্ধ বিনয়ের প্রবর্তন করেছিলেন। এতে পরোক্ষ ও প্রচ্ছন্নভাবে সাধারণ মানুষের জন্যও রয়েছে অনেক শিক্ষণীয় বিষয়।
বিনয় পিটক- ত্রিপিটকের অন্তর্গত তিনটি পিটকের একটি। নিয়ম-কানুন, আচার ও অনুশাসন এ পিটকে আলোচিত হয়েছে। নিয়মানুবর্তিতা, নৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক শিক্ষাই এর মূল উদ্দেশ্য। বুদ্ধ ভিক্ষুসংঘ প্রতিষ্ঠার পর তাঁর অনেক অনুসারী এ সংঘে অন্তর্ভুক্ত হন। সংঘভুক্ত হয়ে তাঁরা বুদ্ধের শিক্ষা প্রচার ও প্রসারের জন্য দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়েন। বিভিন্ন অঞ্চলের বিভিন্ন বিহারে বৌদ্ধ ভিক্ষুগণ অবস্থান করেন। সেই সাথে উপসম্পদা গ্রহণ করে ভিক্ষুসংঘে নিয়মিত যুক্ত হয় নতুন সদস্য। তাঁদের অনেকে সন্ধর্মের গভীর বিষয় অনুশীলনের জন্য বন-জঙ্গলেও অবস্থান করেন। এরকম একজন বৌদ্ধভিক্ষুর অবস্থান যেখানেই হোক না কেন; প্রত্যেকেই নির্দিষ্ট বিধিবদ্ধ নিয়মে নিজের জীবন পরিচালনা করবেন। তথাগত বুদ্ধ এ লক্ষ্যেই বিনয় পিটকের প্রবর্তন করেন। এখানে বিধি-বিধান পালনের নির্দেশনা যেমন আছে, তেমনি ইচ্ছা বা অনিচ্ছায় এই নিয়ম লঙ্ঘনজনিত অপরাধের পরিত্রাণ বিধিও বর্ণিত হয়েছে। বিষয়ের ভিত্তিতে বিনয় পিটক তিন ভাগে বিভক্ত। যথা- ১. সুত্তবিভঙ্গ, ২. খন্ধক এবং ৩. পরিবার পাঠ। আবার গ্রন্থ হিসেবে বিনয় পিটক পাঁচ খণ্ডে সমাপ্ত। প্রত্যেক খণ্ডের স্বতন্ত্র নাম - আছে। যেমন সুত্তবিভঙ্গের দুটি খণ্ড। সেগুলো হলো যথাক্রমে পারাজিক ও পাচিত্তিয়া। তেমনি খন্ধকের দুটি অংশ। মহাবগ্ন ও চুল্লবন্ধ। সুতরাং সুত্তবিভঙ্গে দুটি ও খন্ধকে দুটি এবং পরিবার পাঠ মিলে মোট পাঁচটি-বিনয় - পিটকের গ্রন্থ।
পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে বিনয় পিটকের মূল বিষয় নিয়ম, নীতি ও অনুশাসন। এই অনুশাসন বহুমাত্রিক। যেহেতু, প্রাত্যহিক জীবনাচার নিয়ন্ত্রণের সাথে অন্তর্জগৎ পরিশুদ্ধ করাও আবশ্যক। সে লক্ষেই তথাগত বুদ্ধ এই বিধি-বিধানের প্রচলন করেন। কারণ, সুষ্ঠুভাবে দৈনিক কর্ম সম্পদনই একজন ভিক্ষুর একমাত্র উদ্দেশ্য নয়, তাঁর লক্ষ্য মহৎ। তিনি নির্বাণ সাধনার অভিযাত্রী। তাই, তাঁর দৈনন্দিন জীবনে যেমন নিয়ম-নীতির প্রয়োজন রয়েছে, তেমনি অনবধানবশত কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ও অযাচিত ঘটনার সম্মুখীন না হওয়ার জন্য চিত্ত নিয়ন্ত্রণের শিক্ষাও প্রয়োজন। আবার কোনো অপ্রত্যাশিত ঘটনার সম্মুখীন হলে সে পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের প্রতিবিধানও বিনয় পিটকের গ্রন্থগুলোতে বর্ণিত হয়েছে। এভাবে বিষয় বৈশিষ্ট্যের আলোকে গ্রন্থেরও নামকরণ হয়েছে। নিচে গ্রন্থগুলোর বিষয়বস্তুর সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেওয়া হলো।
'সুত্তবিভঙ্গ' শব্দের অর্থ হলো- নীতিমালাসমূহের বিস্তৃত ব্যাখ্যা। এখানে 'সুত্ত' শব্দের অর্থ হলো 'ধারাবাহিক বর্ণনা'; আর 'বিভঙ্গ' শব্দের অর্থ হলো 'বিশ্লিষ্ট করণ'। অর্থাৎ বিধির বিশ্লেষণ করে নিখুঁতভাবে ব্যাখ্যা করা। আলোচিত বিষয়ের ভিত্তিতে গ্রন্থের অধ্যায়গুলোর নামকরণ করা হয়েছে। সে অনুযায়ী প্রত্যেক অধ্যায়ের শিরোনাম নির্দিষ্ট। সুত্ত বিভঙ্গের দুটি অংশ; পারাজিক এবং পাচিত্তিয়া।
এখানে পারাজিক খণ্ডে পারাজিক ও সংঘাদিসেস নামে দুটি বিষয়ের বিশদ বর্ণনা রয়েছে। এগুলো দৈনন্দিন জীবনের সম্ভাব্য দোষ বা আপত্তিমূলক কর্মের ব্যাখ্যা। এ বিষয় জানা থাকলে নিজেকে সম্ভাব্য দোষগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা থেকে দূরে রাখা যায়। এখানে 'পারাজিক' মানে পরাজয়। অর্থাৎ, নীতির চ্যুতি বা নিয়ম পালনে অপারগ বা অযোগ্য হওয়াকেই পরাজয় বলা হয়। এই খণ্ডে এরকম গুরুতর আপত্তি বিষয় বর্ণিত হয়েছে।
পাচিত্তিয়া খণ্ডে পাচিত্তিয়াসহ ছয়টি বিধি বর্ণিত হয়েছে। অন্যগুলো হল অনিয়ত, নিসন্ধিয়া পাচিত্তিয়া, পটিদেসনীয়, সেখিয়া ও অধিকরণ সমথ। এখানে পাচিত্তিয়া মানে প্রায়শ্চিত্ত করণ। অর্থাৎ কৃত দোষ ত্রুটি স্বীকার পূর্বক পরিত্রাণের সাধনা করার প্রয়োজনীয় অনুষঙ্গ বিষয় এই খন্ডে আলোচিত হয়েছে।
খন্ধক বিনয় পিটকের দ্বিতীয় ভাগ। এতে রাজকুমার সিদ্ধার্থ থেকে বুদ্ধতে উপনীত হওয়ার পথে অনুশীলিত রীতি-নীতি ও ঘটনা প্রবাহের বর্ণনা সংযুক্ত হয়েছে। খন্ধকের বিশেষত্ব হলো এখানে বিনয়ের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিধানসমূহ প্রবর্তনের কারণ গুরুত্ব দিয়ে প্রেক্ষাপটসহ বর্ণিত হয়েছে। এতে সময়ের প্রেক্ষাপট হিসেবে প্রাচীন ভারতের ধর্ম, সমাজ, অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও সভ্যতার ইতিহাসের ধারাবাহিক তথ্যও পাওয়া যায়। এগুলো খন্ধকের মহাবগ্ন ও চুল্লবগ্ন দুটি খন্ডে বিন্যস্ত আছে।
বহু বিষয়ের সমন্বিত মূল্যবান গ্রন্থ এটি। এ গ্রন্থের প্রত্যেকটি অধ্যায় অত্যন্ত বিস্তৃত বলে এটি মহাবগ্ন হিসেবে পরিচিত। মহাবগ্ন গ্রন্থে দশটি স্কন্ধ বা অধ্যায় আছে। অন্তর্গত বিষয়বস্তুর ভিত্তিতে প্রত্যেকটি অধ্যায়ের রয়েছে স্বতন্ত্র নাম। বিধি-বিধান প্রবর্তনের বিবিধ ঐতিহাসিক তথ্যসহ প্রায় সাড়ে তিনশ বিষয় এতে বর্ণিত হয়েছে।
এই গ্রন্থের মূল আলোচ্য বিষয়সমূহ হলো সিদ্ধার্থ গৌতমের বুদ্ধত্বলাভ ও তাঁর ধর্মপ্রচারের ইতিহাস। যেমন- ভিক্ষু সংঙ্ঘের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ, ধর্মচক্র প্রর্বতন, পঞ্চবর্গীয় শিষ্যদের দীক্ষা, শ্রেষ্ঠীপুত্র যশ এবং তাঁর সহচরদের দীক্ষা, রাজা বিম্বিসারের সাথে বুদ্ধের সাক্ষাৎ ও রাজার সপারিষদ বুদ্ধের ধর্ম গ্রহণ, সারিপুত্র ও মৌদগল্যায়নসহ কীর্তিমান ভিক্ষুদের উপসম্পদা ও তথাগত বুদ্ধের পারিল্যেয় বনে যাত্রার প্রেক্ষাপটসহ বুদ্ধের জীবনের কালের বহু বিরল ঘটনা এখানে স্থান পেয়েছে।
'চুল্ল' শব্দের অর্থ হচ্ছে ছোট বা ক্ষুদ্র। এই গ্রন্থের স্কন্ধ বা পরিচ্ছেদগুলো আকারে মহাবগ্নের স্কন্ধগুলোর তুলনায় ছোট। সে কারণে এই গ্রন্থটিকে চুল্লবগ্ন নামে অভিহিত করা হয়েছে। চুল্লবগ্নকে মহাবন্ধের বর্ধিত রূপ হিসেবে গণ্য করা যায়। কেননা, মহাবশ্বের অনেক বিষয় ধারাবাহিকভাবে এই গ্রন্থেও আলোচনা করা হয়েছে। এ কারণে, মহাবগ্ন ও চুল্লবগ্নকে একত্রে খন্ধক বলা হয়।
চুল্লবগ্নে ১২টি অধ্যায় আছে। যথা, ১. কর্ম স্কন্ধ; ২. পারিবাসিক স্কন্ধ; ৩. সমুচ্চয় স্কন্ধ: ৪. শমথ স্কন্ধ; ৫. ক্ষুদ্রবস্তু স্কন্ধ; ৬. শয়নাসন স্কন্ধ; ৭. সংঘভেদক স্কন্ধ; ৮. ব্রত স্কন্ধ; ৯. প্রাতিমোক্ষ স্কন্ধ: ১০. ভিক্ষুণী স্কন্ধ: ১১. পঞ্চশতিকা স্কন্ধ এবং ১২. সপ্তশতিকা স্কন্ধ।
প্রথম থেকে দশম অধ্যায় পর্যন্ত বুদ্ধ জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে কী উদ্দেশ্যে যেসব বিধি বিধান প্রবর্তন করেছিলেন, সেগুলোর ঐতিহাসিক ভিত্তি আলোচিত হয়েছে। এছাড়া ভিক্ষুণীসংঘ গঠনের ইতিহাস, ভিক্ষুণীদের নিয়ম- কানুন এবং বুদ্ধ কী কী শর্তে ভিক্ষুণী সংঘ প্রতিষ্ঠায় সম্মতি দিয়েছিলেন, সে সম্পর্কিত বর্ণনাও এতে রয়েছে। একাদশ ও দ্বাদশ অধ্যায়ে প্রথম ও দ্বিতীয় বৌদ্ধসঙ্গীতির বিবরণ ধারাবাহিকভাবে চুল্লবন্ধে বর্ণনা করা হয়েছে। তাই মহাবগ্ন ও চুল্লবগ্ন এ দুটি শুধু অনুশাসনমূলক গ্রন্থ নয়, তথাগত বুদ্ধের সমকালীন বিবিধ ইতিহাসের আকর গ্রন্থ হিসেবেও এগুলোর অসাধারণ গুরুত্ব রয়েছে।
এটি বিনয় পিটকের শেষ গ্রন্থ। ভিক্ষু ভিক্ষুণীদের আচরণ বিধি সম্পর্কিত বিষয়াবলি এ গ্রন্থে বর্ণনা করা হয়েছে। বিনয়ের জটিল এবং দুর্বোধ্য অনেক বিষয় প্রশ্নোত্তরে সংক্ষিপ্ত আকারে সহজ ভাষায় এ গ্রন্থে তুলে ধরা হয়েছে। এতে প্রবর্তিত বিধি-বিধানের প্রয়োজনীয়তা ও উপযোগিতা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। নতুন শিক্ষানবিশ ভিক্ষুদের বিনয় শিক্ষার উপকরণ হিসেবে এ গ্রন্থটি অত্যন্ত মূল্যবান। এ গ্রন্থে ছোট-বড় সব মিলে সর্বমোট ২১টি অধ্যায় আছে। এগুলো গদ্যে ও পদ্যে রচিত। প্রত্যেক অধ্যায়ে প্রাসঙ্গিকতার আলোকে বিনয় বিধির বিভিন্ন ছবি শিক্ষাপদের ব্যাখ্যা যুক্ত হয়েছে। বিনয় পিটকের অন্য গ্রন্থগুলোর চেয়ে পরিবার পাঠ গ্রন্থটি অনেক সহজবোধ্য। এটিকে বিনয় পিটকের সারবস্তু বলা হয়।
Read more