আত্মবিশ্লেষণের মাধ্যমে উদ্যোক্তার গুণাবলি শনাক্তকরণ

একাদশ- দ্বাদশ শ্রেণি - ব্যবসায় সংগঠন ও ব্যবস্থাপনা - ব্যবসায় সংগঠন ও ব্যবস্থাপনা ১ম পত্র | | NCTB BOOK

একজন উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য যে সকল গুণ থাকা প্রয়োজন ব্যক্তির মধ্যে তা আছে কি না, থাকলে কোন মাত্রায় রয়েছে, ঘাটতি থাকলে তা কতটা পূরণ সম্ভব- এ সকল বিষয়ে ব্যক্তির নিজস্ব বিচার-বিশ্লেষণকে উদ্যোক্তার আত্মবিশ্লেষণ বলে।

ব্যবসায় ঝুঁকিপূর্ণ পেশা। একজন নতুন মানুষ নতুন চিন্তা নিয়ে যখন ব্যবসায়ে নামে তখন তার ঝুঁকির মাত্রা স্বভাবতই বেশি হয় । তাই একজন উদ্যোক্তাকে আবেগপ্রবণ না হয়ে অত্যন্ত সচেতনভাবে তার নিজের অবস্থা মূল্যায়ন করে সিদ্ধান্ত নেয়ার প্রয়োজন পড়ে। তাকে বুঝতে হয় এর সাফল্যের সকল কৃতিত্ব ও মুনাফার দাবি যেমনি তার তেমনি ব্যর্থতার সকল দায়ভারও তাকেই বহন করতে হবে। তাই উদ্যোক্তাসুলভ গুণ তার মধ্যে কোন মাত্রায় কতটা আছে, বা আছে কী নেই এবং ঘাটতি থাকলে তা কতটা পূরণ সম্ভব যথাযথ আত্মবিশ্লেষণের মাধ্যমে তা চিহ্নিত করার প্রয়োজন পড়ে। এরূপ বিশ্লেষণের বিভিন্ন ধাপ নিম্নে তুলে ধরা হলো:

ধাপ-১: কৃতিত্বার্জন চাহিদা নির্ণয় : একজন ব্যক্তির মধ্যে কৃতকর্মে সাফল্যলাভের আকঙ্ক্ষাকেই কৃতিত্বার্জন চাহিদা বলে । একজন ব্যক্তি কর্মক্ষেত্রে কতটা সাফল্যলাভের কথা ভাবেন না শুধুমাত্র সকলের সাথে নিজেকে জুড়ে রাখতে চান-এর বিচারে ব্যক্তির কৃতিত্বার্জন চাহিদার মাত্রা বিবেচনা করা যায়। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর বিশিষ্ট শিল্পমনোবিজ্ঞানী ডেভিড ম্যাকলিল্যান্ড এর মতে, 'কৃতিত্বার্জনের চাহিদা হলো ভালো কিছু করার আকাঙ্ক্ষা, স্বীয় কার্য সম্পাদনের মাধ্যমে কৃতিত্বের আভ্যন্তরীণ অনুভূতি অর্জন।' একজন নতুন উদ্যোক্তা তার মধ্যে কৃতিত্বার্জনের চাহিদা কী পরিমাণে আছে তা বিশ্লেষণের জন্য নিজেই নিজের নিম্নোক্ত প্রশ্নের উত্তরগুলো বিবেচনা করতে পারে :

  • কোনো কাজ সম্পাদন করার ক্ষেত্রে আমি ব্যক্তিগতভাবে দায়িত্ব গ্রহণ করতে পছন্দ করি কি না?
  • আমি কী দক্ষতার সাথে খেলতে পছন্দ করি, না কী সুযোগ গ্রহণ করে থাকি?
  • নিয়ন্ত্রিত ঝুঁকি নিতে পছন্দ করি, নাকি তার চেয়ে কম বা বেশি ঝুঁকি নিতে পছন্দ করি? 
  • কোনো কাজ সম্পাদনের সাথে সাথে তার ফলাফল জানতে চাই কি না?
  • প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হলে আমি নিজেই তা মোকাবেলা করে এগুতে পারি কি না? 
  • কর্মব্যস্ত থাকার মধ্যে আমি আনন্দ পাই কি না?
  • আমি কতটা ধৈর্য ধরে ক্রমাগত চেষ্টা চালিয়ে যেতে পারি? 
  • একটা বিষয়কে স্বভাবগতভাবে আমি কতটা ইতিবাচকভাবে দেখি?
  • আমি কী সবসময়ে কিছুটা অসন্তুষ্ট থাকি?
  • আমি কী সমস্যা সমাধান করতে চেষ্টা করি?
  • নিজের কাজে সহযোগিতার জন্য বন্ধু-বান্ধব বা আত্মীয়-স্বজন অপেক্ষা দক্ষব্যক্তিকে কী আমি মনোনীত করি? 
  • আমি কী আমার বর্তমান কার্যাবলি ভবিষ্যৎ উন্নয়নের গুরুত্বপূর্ণ ধাপ বলে মনে করি?

উপরোক্ত প্রশ্নের উত্তরগুলোতে যদি 'না' অপেক্ষা 'হ্যাঁ' বেশি হয়, তাহলে বুঝতে হবে ব্যক্তির মধ্যে উচ্চমাত্রার কৃতিত্বার্জনের চাহিদা বিদ্যমান। তাই উক্ত উদ্যোক্তার জন্য একজন ভাল উদ্যোক্তা হওয়া অসম্ভব নয় । 

ধাপ-২: প্রশ্নের উত্তরের আলোকে প্রতিবেদন তৈরি : প্রথম ধাপের প্রশ্নের উত্তরগুলোর আলোকে একটা তালিকা বা প্রতিবেদন প্রস্তুত করলে দেখা যাবে যে, তা থেকে ইতিবাচক ও নেতিবাচক মিলিয়ে একটা ধারণার সৃষ্টি হবে। প্রতিটা ইতিবাচক উত্তরকে ১ এবং নেতিবাচক উত্তরকে ০ ধরলে একটা মান বেরিয়ে আসবে। অতঃপর উদ্যোক্তার যে সকল গুণ; যেমন- প্রজ্ঞা, সাহস, ধৈর্য, সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা ইত্যাদি সাধারণভাবে থাকার প্রয়োজন বলে মনে করা হয় তার সাথে প্রতিবেদনের ধারণাকে মিলালে প্রতিটা ক্ষেত্রে ব্যক্তির শক্তি ও দুর্বলতা চিহ্নিত হবে । যা তাকে পরবর্তী কার্যক্রম গ্রহণে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রদান করবে।

ধাপ-৩: প্রতিষ্ঠিত উদ্যোক্তার সাথে মত বিনিময় এ পর্যায়ে স্থানীয় একজন সফল উদ্যোক্তার সাথে মতবিনিময় করা হলে পূর্বে তৈরিকৃত প্রতিবেদনে উল্লেখিত প্রতিটি বিষয় সম্পর্কে আরো বাস্তবসম্মত ধারণা লাভ সম্ভব হবে। এক্ষেত্রে মত বিনিময়ে ব্যক্তিকে নিম্নোক্ত কাজগুলো করতে হয় :

  • পূর্ববর্তী পদক্ষেপগুলো থেকে প্রাপ্ত ধারণা এবং সফল উদ্যোক্তার ধারণার মধ্যে তুলনামূলক বিশেষণ;
  • সফল উদ্যোক্তার ধারণার সাথে যে সকল বিষয় মেলে এবং যেগুলো মেলে না তা চিহ্নিতকরণ;
  • যে সকল বিষয়ে ব্যক্তির দুর্বলতা আছে, সেগুলো মোকবেলা করার উপযুক্ত উপায় নিরূপণ;
  • সমস্যা সমাধানের জন্য একটি কার্যকর পরিকল্পনা তৈরি;
  • কোনো বিশেষ দুর্বলতা পূরণের জন্য কত সময় লাগবে এবং কত খরচ হবে তা নিরূপণ করে কার্যক্রম তৈরি ।

ধাপ-৪: প্রশিক্ষকের সহায়তা গ্রহণ : এ পর্যায়ে একজন সম্ভাব্য উদ্যোক্তা আত্মবিশ্লেষণের মাধ্যমে সফল উদ্যোক্তার ইতিবাচক যে সকল গুণ তার মধ্যে দেখতে পায় সেগুলোকে সার্বিকভাবে কাজে লাগানোর উপায় সম্পর্কে প্রশিক্ষক বা পরামর্শকের এ পর্যায়ে সহায়তা নিতে পারে। এক্ষেত্রে প্রশিক্ষকের নিকট থেকেও গুণাবলির তালিকা সংগ্রহ করে ব্যক্তি তার চিন্তাকে আরও ফলদায়ক করতে পারে। দুর্বল দিকগুলো এক্ষেত্রে কাটিয়ে উঠে গুণগুলোকে আরও কিভাবে বিকশিত করা যায় সে সম্পর্কেও সে এ পর্যায়ে ধারণা নিতে পারে। এক্ষেত্রে প্রশিক্ষকের নিকট থেকে নিম্নোক্ত বিষয় জানলে সুবিধা হয়:

  • ব্যবসায়ের জন্য প্রধান কী কী দক্ষতার প্রয়োজন? 
  • নতুন ধারণা নিয়ে ব্যবসায়ে নামার ক্ষেত্রে বাধাসমূহ কী কী ?
  • সিদ্ধান্ত গ্রহণের সাথে কী কী বিষয় সংশ্লিষ্ট?
  • ব্যবসায় শুরু করার ক্ষেত্রে প্রধান সমস্যা কোনগুলো? 
  • চিহ্নিত সমস্যাবলি দূরীকরণে প্রশিক্ষকের পরামর্শ কী?

প্রশিক্ষকের নিকট থেকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও দিকনির্দেশনা লাভের পর একজন সম্ভাব্য উদ্যোক্তা তার গুণাবলি শনাক্তকরণের সাথে তার করণীয় বিষয়েও একটা সুস্পষ্ট ধারণা লাভ করেন। যা তাকে উদ্যোগ গ্রহণে সাহসী করে তোলে ।

Content added By
Promotion