ই-কমার্স বর্তমান সময়ের সবচেয়ে আলোচিত বিষয়। কেননা বর্তমানে বিশ্বের যেকোনো প্রান্ত থেকে ব্যবসায় কার্যক্রম পরিচালনা করা যায়। আর এ সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে আধুনিককালের ব্যবসায় জগতের নতুন আবিষ্কার ই-কমার্স। নিচে ই-কমার্স-এর সুবিধাসমূহ সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো-
ক. ই-কমার্স-এর ক্ষেত্রে ভোক্তার সুবিধা (Consumer's Advantages in E-commerce):
১. ক্রেতা সেবা ত্বরান্বিত করা (Expedites customer service): ক্রেতারাই প্রথম এ ধারণাকে গুরুত্ব দিয়ে ক্রেতাদের জন্য যেকোনো সেবা তরান্বিত করা হয় ই-কমার্স-এর মাধ্যমে। ক্রেতাদের যেকোনো সেবা দ্রুত সময়ের মধ্যে পৌঁছে দেওয়াই ই-কমার্স-এর অন্যতম কাজ।
২. ক্রেতাবান্ধব পরিষেবা (Customer friendly service): ক্রেতারা কোন ধরনের পণ্য পেতে চায়, সে পণ্য কীভাবে পেতে পারে এবং পণ্যটি কখন কিনবে ইত্যাদি বিষয় জানা যেকোনো ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের জন্য জরুরি। আর এ সব তথ্য জানার পরে খুব সহজে ই-কমার্স পদ্ধতিতে ক্রেতাদের পরিষেবা দেওয়া যায় ।
৩. ২৪/৭ ভিত্তিতে কার্যক্রম পরিচালনা (Operating activities based on 24/7 ) : ই-কমার্স-এর অন্যতম সুবিধা হলো ক্রেতারা সপ্তাহের প্রতিদিন দিন-রাত ২৪ ঘন্টার যেকোনো সময় তারা তাদের প্রয়োজনীয় সেবা পেতে পারে। ক্রেতা তার সুবিধামতো সময়ে ই-কমার্স-এর মাধ্যমে পণ্য বা সেবার কেনা-বেচা করতে পারে।
৪. ব্র্যান্ড সচেতনতা বাড়াতে সহায়তা (Assist to increase brand awareness): ই-কমার্স-এর মাধ্যমে ক্রেতারা সহজেই বিভিন্ন নতুন নতুন পণ্যের পরিচিতি লাভ করতে পারে। এক্ষেত্রে পণ্যের ব্র্যান্ড নাম সম্পর্কে তারা অবগত হতে পারে। বিভিন্ন ব্র্যান্ডের পণ্য বিচার-বিশ্লেষণ করে ক্রেতারা সহজেই তাদের পছন্দের পণ্যটি কেনার অর্ডার করতে পারে।
৫. অত্যধিক তথ্য সরবরাহ (Providing more information): ই-কমার্স-এমন একটি প্রক্রিয়া যেখানে ক্রেতারা সহজেই তাদের প্রয়োজনীয় তথ্য পেয়ে থাকে। এক্ষেত্রে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো ক্রেতাদের পণ্য পছন্দের সুবিধার্থে পর্যাপ্ত তথ্য সরবরাহ করে থাকে। পণ্য বা সেবার ধরণ, বৈশিষ্ট্য, কার্যকারিতা, মেয়াদ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য তথ্য ওয়েবসাইটে তুলে ধরা হয়।
৬. সহজ প্রবেশাধিকার (Easy entrance): যেকোনো সময় বিশ্বের যেকোনো প্রান্ত থেকে ক্রেতারা কেনা- বেচাসহ লেনদেন কার্যক্রম সম্পন্ন করতে পারে। ই-কমার্স-এ ২৪/৭ দিনই গ্রাহকরা পণ্যের অর্ডার করতে পারে। এমনকি, সারা বছর জুড়ে একজন গ্রাহক তার ব্যালেন্স চেক ও অর্থ দেওয়া সংক্রান্ত যাবতীয় কাজ করতে পারে।
খ. ই-কমার্স-এর ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানসমূহের সুবিধা (Organization's Advantages in E-commerce) :
১. বিশ্বময় বাজার (Worldwide market): বর্তমান যুগ আধুনিক ও ডিজিটাল মার্কেটিং এর যুগ। এ যুগে এক দেশে উৎপাদিত পণ্য বিশ্বের যেকোনো প্রান্তে পৌঁছে যাচ্ছে নিমিষেই। কেননা ই-কমার্স ওয়েবভিত্তিক বা ইন্টারনেটভিত্তিক হওয়ায় ক্রেতারা যেকোনো স্থানে বসেই পণ্য অর্ডার করতে পারে। তাই এর বাজার বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত।
২. গণ কাস্টমাইজেশন (Public customization): ই-কমার্স প্রক্রিয়ায় খুব সহজেই গ্রাহকদের প্রয়োজন অনুযায়ী তাদের পণ্য ও পরিষেবা তাৎক্ষণিকভাবে কাস্টমাইজ করা যায়। যেমন- ই-কমার্স চালু হবার আগে ক্রেতারা ফোর্ড-এর মোটরগাড়ি কিনতে চাইলে ক্রেতাদের পছন্দ অনুযায়ী নির্দিষ্ট রঙের গাড়ি অর্ডার করতে পারত না। কিন্তু ই-কমার্স ওয়েবসাইটভিত্তিক হওয়ায় ক্রেতারা সহজেই এক মিনিটের মধ্যে তাদের পছন্দ অনুযায়ী গাড়ি কেনার অর্ডার করতে পারে।
৩. সময় এবং ব্যয় কমায় (Reducing time & cost) : ই-কমার্স আধুনিক বিশ্বের সবচেয়ে টেকসই পণ্য কেনা-বেচার ধরন। এ ধরনের পদ্ধতিতে তেমন কোনো অর্থ বা সময় ব্যয় করতে হয় না। কেননা কেউ সাহস করে উদ্যোগী হতে চাইলেই ই-কমার্স চালু করা সম্ভব।
৪. অনলাইন সংযোগ প্রতিষ্ঠা (Establishing online connectivity): যারা কোনো দিন অনলাইন সম্পর্কে তেমন কোনো ট্রেনিং প্রাপ্ত নন, তারাও বর্তমানে নিজ উদ্যোগে অনলাইন ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছেন। বিশ্বের সব দেশের অধিকাংশ মানুষ অনলাইনে পণ্য কেনা-বেচায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে বিশ্বব্যাপী করোনাকালীন সময়ে অনলাইন বা ই-কমার্স-এর মাত্রা ঈর্শান্বিতভাবে বেড়েছে।
৫. নতুন গ্রাহকদের আকর্ষণ (Attracting new customer): যেকোনো ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান নতুন ক্রেতা আকর্ষণে সমর্থ না হলেও ই-কমার্সে ক্রেতা আকর্ষণ করা অত্যন্ত সহজ। কেননা অনলাইন বাজারে ঢুকলেই দেশি-বিদেশি অসংখ্য ক্রেতা উপস্থিতি দেখা যায়। উল্লেখ্য যে, এক্ষেত্রে নতুন ক্রেতা আকর্ষণে সার্চ ইঞ্জিন এবং কনটেন্টের ওপর নির্ভর করতে হয়।
১. চাকরির সুযোগ সৃষ্টি (Creating job opportunity): ই-কমার্স মানুষকে ব্যবসায় স্থাপনে উদ্যোগী করে তুলতে ও সমাজের লোকদের জন্য চাকরির সুযোগ তৈরিতে সহায়তা করে। যেমন- ই-কমার্স যদি কেউ শুরু করে সেক্ষেত্রে তার কিছু মানবসম্পদের প্রয়োজন হয়। এমন কিছু ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান আছে যারা তাদের কর্মচারীদের বাড়িতে বসেও কাজ করার অনুমতি দিয়ে থাকে।
২. সরকারি সেবা দেওয়ার মাধ্যম (Medium of providing government service): অনলাইন বা ই- কমার্স প্রক্রিয়ায় জনসাধারণকে বিভিন্নভাবে সরকারি সেবা দেওয়া যায়। যেমন— ট্যাক্স রিটার্ন দাখিল করা। এছাড়াও গ্যাস, পানি ও বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করাও ই-কমার্স বা অনলাইন বিজনেস-এর আওতাভুক্ত ।
৩. কার্যকর গ্রাহক সেবা (Effective customer service): গ্রাহকরা যখন-তখন অনলাইনে তাদের প্রয়োজনীয় তথ্য পেয়ে থাকে। কোনো গ্রাহকের কোনো প্রশ্ন থাকলেও তার উত্তর অনলাইনে তাৎক্ষণিকভাবে জানানো যায়। ই-কমার্স-এর মাধ্যমে কার্যকর যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করে খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে পণ্য ডেলিভারি করা সম্ভব হয়।
৪. ভৌগোলিক সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করা (Crossing geographical boundaries): ই-কমার্স মানেই হলো পুরো পৃথিবী একটি মাত্র গ্রাম (Village)। ই-কমার্স-এর প্রভাবে এক দেশের পণ্য বা সেবা ভৌগোলিক সীমানা অতিক্রম করে বিশ্বের যেকোনো দেশে পৌঁছে যাচ্ছে।
৫. সেবা নিশ্চিতকরণ- শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য (Ensuring service education and health): ই-কমার্স বা অনলাইন প্রক্রিয়ায় বর্তমান সময়ে শিক্ষার্থীরা ঘরে বসেই গুগল ক্লাসরুমে অনলাইন ক্লাস কিংবা খান একাডেমির মাধ্যমে বিভিন্ন বিষয় জানতে পারছে। এছাড়া ঘরে বসেই অনলাইনে ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করে মানুষ স্বাস্থ্যসেবা নিতে পারছে।
উপরের আলোচনা থেকে বলা যায় যে, ই-কমার্স বিশ্বব্যাপী এক অপার সম্ভাবনা তৈরি করেছে যার দ্বারা প্রতিষ্ঠান, ভোক্তা ও সমাজ উপকৃত হচ্ছে।
বিশ্বের উন্নত দেশের ন্যায় আমাদের প্রিয় বাংলাদেশও ই-কমার্স কার্যক্রমে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে। তারপরও ই-কমার্স কার্যক্রমের প্রসার ও গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করতে আরেকটু সময় লাগবে। কতিপয় আগ্রহী, সাহসী ও উদ্যোগী মানুষ এ ধরনের অনলাইন ব্যবসায়িক কার্যক্রমে সম্পৃক্ত হলেও এখনও অনেক মানুষ সাহস ও ব্যবসায়িক পরিবেশের অভাবে ই-কমার্স থেকে দূরে আছে। যেকোনো নতুন ব্যবসায়ে সফল হতে একটু বেশি সময় লাগেই। ই-কমার্স ইন্টারনেট ভিত্তিক ব্যবসায় তাই ইন্টারনেটের গতি সন্তোষজনক না হলে এ ব্যবসায়ের প্রতি অনেকেই আগ্রহ প্রকাশ করে না। ইতোমধ্যে আমাদের দেশে সবার জন্য ইন্টারনেট সহজলভ্য করার প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপই নেওয়া হয়েছে। তারপরও ইন্টারনেট নিয়ে ব্যবহারকারীরা সন্তুষ্ট না। এছাড়া '5G' চালু হওয়ার পরেও অনেক গ্রাহকই এর ব্যবহার উপযোগিতা নিয়ে সন্তুষ্ট না। নিচে ই- কমার্স-এর অসুবিধাগুলো আলোচনা করা হলো-
১. নিশ্চয়তা ও নিরাপত্তার অভাব (Lack of security & safety): ই-কমার্স-এ নিরাপত্তার ঘাটতি থাকায় অনেকেই এ ধরনের ব্যবসায়ে সম্পৃক্ত হতে চায় না ।
২. ব্যক্তিগত স্পর্শ বা সম্পর্কের অভাব (Lack of personal touch and relationships): ই-কমার্স-এর অন্যতম প্রধান অসুবিধা হলো এখানে সরাসরি ও ব্যক্তিগতভাবে তেমন কোনো কার্যক্রম সম্পর্ক সৃষ্টি হয় না। এছাড়া পণ্যের স্পর্শ ছাড়া পণ্য সম্পর্কে তেমন কোনো ধারণাও লাভ করা সম্ভব হয় না। যার ফলে পণ্যের প্রকৃত স্বাদ বা বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে ক্রেতারা তেমন কোনো ধারণা লাভ করতে পারে না।
৩. বিলম্বে পণ্য সরবরাহ (Delay in product delivery): ই-কমার্স প্রক্রিয়ায় সরাসরি বা সাথে সাথে পণ্য ডেলিভারি করা সম্ভব হয় না। আন্তর্জাতিক ব্যবসায়ে পণ্য সরবরাহের ক্ষেত্রে বিলম্বের মাত্রা আরও বেশি।
৪. সুনির্দিষ্ট গ্রাহক চিহ্নিত করা (Identifying specific customer): ই-কমার্স প্রক্রিয়ায় সুনির্দিষ্ট গ্রাহক বা ক্রেতা খুঁজে পাওয়া ততোটা সহজ ব্যাপার না। আবার সম্ভাব্য ক্রেতা খুঁজে পেলেও সে প্রকৃত ক্রেতায় পরিণত হবে কি-না তাও বিচার-বিশ্লেষণের ব্যাপার।
৫. অনাগ্রহ (Disinterest): আমাদের দেশের কমার্স-এর আরেকটি বড় সমস্যা হলো ক্রেতাদের অনাগ্রহ। ইন্টারনেটভিত্তিক ব্যবসায় হওয়ায় অনেকেই ই-কমার্স থেকে দূরে থাকতে চায়। তবে ধীরে ধীরে এর জনপ্রিয়তা বাড়ছে।
৬. নকল পণ্য সরবরাহ (Delivery of fake product): ই-কমার্স-এর একটি বড় অসুবিধা হলো আসল পণ্য সরবরাহ না করা। অনেক সময় ক্রেতারা যে পণ্য বা সেবা অর্ডার করে তাদেরকে সেটি দেওয়া হয় না। নকল বা অন্য একটি পণ্য সরবরাহ করা হয়। এক্ষেত্রে সরাসারি যোগাযোগ ব্যবস্থা না থাকায় অনেক সময় ক্রেতা অভিযোগ জানাতে পারে না। এভাবে ক্রেতা স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হয় ।
আরও দেখুন...