বাণিজ্যিক ব্যাংক আমানতকারী। ও ঋণগ্রহীতার মাঝে আর্থিক মধ্যস্থ ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান হিসাবে নানাবিধ কার্য সম্পাদন করে থাকে। আর এসব কাজের মধ্যে অন্যতম প্রধান কাজ হলো ঋণ আমানত সৃষ্টি করা বা ঋণ সম্প্রসারণ করা।
বাণিজ্যিক ব্যাংক নগদ অর্থ ছাপাতে পারে না। কিন্তু মঞ্জুরিকৃত ঋণ থেকে বিভিন্ন কৌশলে অর্থের উপযোগ ও ক্রয়ক্ষমতা বহুগুণ বৃদ্ধি করে। এই কৌশলকেই ঋণ আমানত সৃষ্টি করা বা ঋণ সম্প্রসারণ করা বলে। এভাবেই ঋণ সম্প্রসারণে বাণিজ্যিক ব্যাংক ভূমিকা রাখে। নিচে ঋণ সম্প্রসারণে বাণিজ্যিক ব্যাংকের ভূমিকা বর্ণনা করা হলো-
ক. ঋণ মঞ্জুরের মাধ্যমে আমানত সৃষ্টি (Creation of deposits through loan disbursement) : বাণিজ্যিক ব্যাংক যখন কোনো ঋণগ্রহীতাকে ঋণ মঞ্জুর করে সম্পূর্ণ ঋণের অর্থ নগদে প্রদান না করে গ্রাহককে পৃথক ঋণ হিসাব খুলতে বলে এবং সেই হিসাবে ঋণের অর্থ জমা করে। ঋণগ্রহীতা প্রয়োজনমতো চেক কেটে উক্ত হিসাব থেকে অর্থ উঠিয়ে তা ব্যবহার করে। এখানে প্রদত্ত ঋণ থেকে আমানত সৃষ্টি হয়েছে। এক্ষেত্রে বাণিজ্যিক ব্যাংক তিন ধরনের ঋণ মঞ্জুর করে থাকে। যথা—
১. তলবি ও স্বল্পমেয়াদি ঋণ (Callable and short-term loan) : বাণিজ্যিক ব্যাংক তলবি ঋণ ও স্বল্পমেয়াদি ঋণ মঞ্জুর করে। ঋণগ্রহীতা আমানত হিসাবের মাধ্যমে সেখান থেকে চেক কেটে বা ইস্যু করে অর্থ ব্যবহার করে। ফলে প্রদত্ত ঋণের সমপরিমাণ আমানতের সৃষ্টি হয়।
২.অগ্রিম প্রদান (Advance payment) : নগদ ঋণের মাধ্যমে প্রদত্ত অগ্রিম যখন ঋণগ্রহীতাকে দেওয়া হয় তখন তা ঋণগ্রহীতার হিসাবে জমা করা হয়। ঋণগ্রহীতা সেই হিসাব থেকে টাকা উত্তোলন করলেও সর্বনিম্ন একটি পরিমাণ জমা থাকে। সেই পরিমাণই ঋণ আমানত সৃষ্টি করে ।
৩. জমাতিরিক্ত ঋণ প্রদান (Excess lending) : বাণিজ্যিক ব্যাংক অনেক সময় স্বনামধন্য ব্যবসায়ীকে তার চলতি হিসাবে রক্ষিত অর্থের অতিরিক্ত অর্থ উত্তোলনের সুযোগ দেয়, যা জমাতিরিক্ত ঋণ হিসাবে বিবেচিত। এ ঋণের অর্থও গ্রাহকের হিসাবে জমা হয় এবং আমানত সৃষ্টি করে বা ঋণ সম্প্রসারিত হয়।
খ. আমানত গ্রহণের মাধ্যমে ঋণ আমানত সৃষ্টি (Creation of loan deposit through acceptance of deposit) :
বাণিজ্যিক ব্যাংক দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সঞ্চয়গুলোকে আমানত হিসাবে ব্যাংকে জমা করে। এই জমাকৃত অর্থের কিছু অংশ নগদে রেখে বাকি অংশ শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্যে ঋণদানের মাধ্যমে বিনিয়োগ করে থাকে। ঋণদানকৃত অর্থ ঋণগ্রহীতাকে নগদে না দিয়ে তার ব্যাংক হিসাবে জমা করে। ফলে ঋণগ্রহীতার হিসাবে আবার আমানত সৃষ্টি হয়, যা দ্বারা ঋণ সম্প্রসারণ করা হয়। এভাবে আমানতের মাধ্যমে প্রথমে ঋণ, আবার সেই ঋণ থেকে আমানতের সৃষ্টি হয়। ব্যাংক জনগণের অর্থ আমানত হিসাবে ব্যাংকে জমা রাখে এবং জমাকৃত অর্থের কিছু অংশ ঋণগ্রহীতাকে প্রদান করে, যা পুনরায় গ্রাহকের ব্যাংক হিসাবে আমানত আকারে জমা হয়। এর মাধ্যমে আমানত থেকে ঋণ, ঋণ থেকে আমানত সৃষ্টি হয়। অর্থাৎ ঋণ সম্প্রসারিত হয়। উদাহরণ : X তার হিসাবে ২০,০০০ টাকা জমা দিল। ব্যাংক তা থেকে ২০% তারল্য জমা রেখে বাকি ১৬,০০০ টাকা Y-কে দিলে তা Y-এর ব্যাংক হিসাবে জমা হলো। তা থেকে ব্যাংক ২০% তারল্য জমা রেখে ১২,৮০০ টাকা Z-কে ঋণ দিল। Z উক্ত অর্থ ব্যাংক একাউন্টে জমা রাখল। এভাবে ২০,০০০ টাকার একটি আমানত হতে বারবার ঋণ ও আমানত সৃষ্টি হচ্ছে। এক্ষেত্রে ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা হবে নিম্নরূপ :
এভাবে ব্যাংক ঋণদান কার্য চালাতে থাকলে এক পর্যায়ে ২০,০০০ টাকার মূল আমানত থেকে ১,০০,০০০ টাকা পর্যন্ত ঋণ আমানত সৃষ্টি করতে পারে, তবে ঋণ আমানতের পরিমাণ নির্ভর করে তারল্য সংরক্ষণের ওপর।
গ. ঋণ আমানত সৃষ্টির অন্যান্য কৌশল (Other strategies for creating debt deposits ) :
১ . শেয়ার ও সিকিউরিটিজ ক্রয় (Purchase of shares & securities) : বাণিজ্যিক ব্যাংক শেয়ার, সিকিউরিটি, বন্ড ইত্যাদি ক্রয় করে নগদ অর্থে মূল্য পরিশোধ না করে চেকের মাধ্যমে তা প্রদান করে। পরবর্তীতে বিক্রেতা উক্ত চেক ব্যাংকে জমা দেয়। ফলে আমানতের সৃষ্টি হয়।
২. বিনিময় বিল বাট্টাকরণ (Discounting bill of exchange) : ব্যবসায়ীদের নগদ অর্থের প্রয়োজন মিটাতে ব্যাংক বিনিময় বিল বাট্টা করে। বাট্টাকৃত অর্থ নগদে না দিয়ে চেকে পরিশোধ করে এবং গ্রাহক চেকটি ব্যাংকে তার হিসাবে জমা দেয়। এতে আবার আমানত সৃষ্টি হয়।
৩. সম্পদ ক্রয় (Purchase of assets) : সম্পদ ক্রয় করে চেকে মূল্য পরিশোধ করলে বিক্রেতা ব্যাংকে তা জমা দিয়ে আমানত সৃষ্টি করে।
সুতরাং, অর্থনৈতিক কাজ সচল রাখার জন্য ঋণের পরিমাণ সম্প্রসারণ করা প্রয়োজন। ঋণ বাড়লে অর্থনৈতিক কাজ বেড়ে নতুন ঋণ চাহিদা সৃষ্টি করে। এ ঋণ চাহিদা পূরণ করার জন্য ক্রমাগতভাবে অধিক ঋণযোগ্য তহবিলের প্রয়োজন। তাই ঋণ আমানত সৃষ্টি ক্রমাগত চাহিদা পূরণে একটি নির্ভরযোগ্য কৌশল ।
▪️জেনে রাখো বাণিজ্যিক ব্যাংকের ঋণ আমানত সৃষ্টির সীমাবদ্ধতাবাণিজ্যিক ব্যাংক ঋণদানের মাধ্যমে আমানত সৃষ্টি করার পাশাপাশি প্রকৃত আমানতের অনেক বেশি ঋণ সৃষ্টি করে। কিন্তু ব্যাংকের এ ঋণ বা আমানত সৃষ্টির ক্ষমতা সীমাহীন নয়। বাণিজ্যিক ব্যাংকের ঋণ আমানত সৃষ্টির ক্ষমতায় নিম্নলিখিত সীমাবদ্ধতাসমূহ দেখা যায়— → অপর্যাপ্ত নগদ তহবিল (Insufficient cash fund) : বাণিজ্যিক ব্যাংকের ঋণ সৃষ্টির ক্ষমতা তার নগদ তহবিলের ওপর নির্ভর করে। নগদ তহবিল বেশি হলে ঋণ বা আমানত সৃষ্টির ক্ষমতা কমে। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকে মোট আমানতের একটি অংশ বাধ্যতামূলকভাবে জমা রাখে। আবার গ্রাহকদের চাহিদা মিটানোর জন্য মোট আমানতের একটি অংশ নগদে জমা রাখতে হয়। এজন্য ব্যাংকের ঋণ সৃষ্টির কাজ অনেকটা বাধা পায়। → বাজারে ঋণের চাহিদা (Credit demand in market): বাজারে ঋণের পর্যাপ্ত চাহিদা না থাকলে বাণিজ্যিক ব্যাংক ইচ্ছানুযায়ী ঋণ সৃষ্টি করতে পারে না। ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দাভাব তৈরি হলে বা ব্যাংকের সুদের হার বেশি হলে ব্যবসায়ীরা ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে উৎসাহী হয় না। ফলে স্বাভাবিকভাবেই বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহের ঋণ সৃষ্টির ক্ষমতা কমে যায়। → ঋণের নিরাপত্তা (Security of loan) : বাণিজ্যিক ব্যাংক উপযুক্ত জামানতের অভাব হলে ঋণ দেয় না। তাই গ্রহণযোগ্য জামানতের পরিমাণ বেশি হলে ঋণের পরিমাণও বেশি হয়। → ঋণগ্রহীতার ইচ্ছা (Willingness of borrower): সমাজে ঋণ গ্রহণকারী ব্যক্তির সংখ্যা কম হলে ঋণ সৃষ্টির ব্যাপকতা ব্যাহত হয়। বিনিয়োগের ব্যাপক সুযোগ-সুবিধা না থাকলে মুনাফা অর্জনের সম্ভাবনা কমে যায়। ফলে ঋণ আমানত সৃষ্টি হয় না। → নগদ অর্থ জমানোর প্রবণতা (Cash savings tendency) : সমাজের মানুষ বেশি নগদ অর্থ হাতে ধরে রাখলে ব্যাংকের আমানত ও ঋণ সৃষ্টির ক্ষমতা কমে যায়। অর্থাৎ মানুষের সঞ্চয়ের প্রবণতা না থাকলে ঋণ আমানত সৃষ্টি এমনিতেই কমে যায়। → নগদ সংরক্ষণ অনুপাত ( Ratio of cash reserve): কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঋণ নিয়ন্ত্রণের একটি মাধ্যম হলো তারল্য সংরক্ষণ অনুপাত। এ অনুপাত বাড়িয়ে দিলে আমানতের বড় একটা অংশ কেন্দ্রীয় ব্যাংকে রাখার ফলে ঋণ আমানত সৃষ্টির ক্ষমতা কমে যায়। এ হার বেশি হলে ব্যাংকের ঋণ আমানত সৃষ্টির ক্ষমতা কম হয়। যেমন : তারল্য সংরক্ষণ অনুপাত ১০% থেকে বাড়িয়ে ২০% করা হলে বাণিজ্যিক ব্যাংক ৯০ টাকার পরিবর্তে মাত্র ৮০ টাকা ঋণ দেয় । → কু-ঋণের প্রভাব (Effect of bad debt) : প্রদত্ত ঋণ আদায় করা না হলে অথবা গ্রাহক ঋণ পরিশোধ করতে ব্যর্থ হলে তাকে কু-ঋণ বলে। এই কু-ঋণের কারণে ঋণ আমানত সৃষ্টি করা যায় না । → কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঋণ নিয়ন্ত্রণ নীতি (Credit control policy of central bank): দেশে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দিলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে বাণিজ্যিক ব্যাংকের ঋণদান ক্ষমতাকে সংকুচিত করে। এতে বাণিজ্যিক ব্যাংকের নগদ জমার হার বেড়ে যায়। ফলে এদের ঋণ বা আমানত সৃষ্টির ক্ষমতা কমে যায়। তাই বলা যায়, ব্যাংক ব্যবস্থা এর নগদ আমানত অপেক্ষা কত বেশি ঋণ সৃষ্টি করে তা নির্ভর করে নগদ সংরক্ষিত অর্থের অনুপাতের ওপর। নগদ সংরক্ষিত অর্থের অনুপাত বেশি হলে ব্যাংকের ঋণ সৃষ্টির ক্ষমতা কম হয় । আবার নগদ সংরক্ষিত অর্থের অনুপাত কমে গেলে ব্যাংকের ঋণ সৃষ্টির ক্ষমতা বাড়ে । |
---|
Read more