প্রথমে বসন্ত ঋতু নবীন পল্লব ।
দুই পক্ষ আগে পাছে মধ্যে সুমাধব ৷৷
মলয়া সমীর হৈলা কামের পদাতি ।
মুকুলিত কৈল তবে বৃক্ষ বনস্পতি ৷৷
কুসুমিত কিংশুক সঘন বন লাল ৷
পুষ্পিত সুরঙ্গ মল্লি লবঙ্গ গুলাল ৷৷
ভ্রমরের ঝঙ্কার কোকিল কলরব।
শুনিতে যুবক মনে জাগে অনুভব ৷৷
নানা পুষ্প মালা গলে বড় হরষিত ।
বিচিত্র বসন অঙ্গে চন্দন চৰ্চিত ৷৷
নিদাঘ সমএ অতি প্রচণ্ড তপন ।
রৌদ্র ত্রাসে রহে ছায়া চরণে সরণ ॥
চন্দন চম্পক মাল্য মলয়া পবন ।
সতত দম্পতি সঙ্গে ব্যাপিত মদন ৷৷
পাবন সময় ঘন ঘন গরজিত।
নির্ভয়ে বরিষে জল চৌদিকে পূরিত ৷৷
ঘোর শব্দে কৈলাসে মল্লার রাগ গাত্র ।
দাদুরী শিখীনি রব অতি মন ভাএ ॥
কীটকুল রব পুনি ঝঙ্কারে ঝঙ্কারে ।
শুনিতে যুবক চিত্ত হরষিত ডরে ৷
আইল শারদ ঋতু নির্মল আকাশে ।
দোলাএ চামর কেশ কুসুম বিকাশে ৷
নবীন খঞ্জন দেখি বড়হি কৌতুক ।
উপজিত যামিনী দম্পতি মনে সুখ ৷
প্রবেশে হেমন্ত ঋতু শীত অতি যায় ।
পুষ্প তুল্য তাম্বুল অধিক সুখ হয় ৷৷
শীতের তরাসে রবি তুরিতে লুকাএ ।
অতি দীর্ঘ সুখ নিশি পলকে পোহাএ ॥
পুষ্প শয্যা ভেদ ভুলি বিচিত্র বসন ।
উরে উরে এক হৈলে শীত নিবারণ ৷৷
কাফুর কস্তুরী চুয়া যাবক সৌরভ।
দম্পতির চিত্তেত চেতন অনুভব ৷৷
আলাওল সতেরো শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি। আনুমানিক ১৬০৭ খ্রিষ্টাব্দে ফতেহাবাদ পরগনার (বর্তমান ফরিদপুর জেলা) জালালপুরে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তরুণ বয়সে জলপথে চট্টগ্রাম যাওয়ার সময়ে তাঁর পিতা ও তিনি পর্তুগিজ জলদস্যুদের কবলে পড়েন। এই আক্রমণে তাঁর পিতা নিহত হন। তিনি ভাগ্যক্রমে বেঁচে আরাকানে উপস্থিত হন। সেখানে প্রথমে আরাকান রাজের সেনাদলে কাজ পান তিনি; ক্রমে রাজদরবারের প্রধান অমাত্য মাগন ঠাকুরের কৃপাদৃষ্টি লাভ করেন এবং রাজসভাসদভুক্ত হন। তাঁরই পৃষ্ঠপোষকতায় এবং কাব্যপ্রতিভা ও বিদ্যাবুদ্ধির গুণে আলাওল ‘পদ্মাবতী' কাব্য রচনা করেন। রাজসভার শিক্ষিত ও পদস্থ ব্যক্তিদের সাহচর্যে থেকে তিনি কাব্যচর্চা করেছেন। তাঁর রচনায় নাগরিক চেতনা ও রুচির ছাপ সুস্পষ্ট। সংস্কৃত, আরবি, ফারসিসহ বিভিন্ন ভাষায় ব্যুৎপন্ন আলাওল অসামান্য পাণ্ডিত্যের অধিকারী ছিলেন। শিল্পকুশলী এই কবির অন্যান্য রচনার মধ্যে রয়েছে— কাব্য : ‘সয়ফুলমুলক বদিউজ্জামাল', ‘হপ্ত পয়কর', ‘সিকান্দরনামা'; নীতিকবিতা : ‘তোফা”; সঙ্গীতবিষয়ক কাব্য : ‘রাগতালনামা' । আলাওল ১৬৮০ খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন।
সুমাধব - উত্তম বসন্তকাল; সুবন বসন্তকাল।
মলয়া সমীর - দখিনা স্নিগ্ধ বাতাস ।
কামের - কামদেব-এর। প্রেমের দেবতার । সংবাদ বাহক।
পদাতি - পদচারী সৈনিক।
কৈল - করিল ।
বনস্পতি - যে বৃক্ষে ফুল ধরে না শুধু ফল হয়। অশ্বত্থ, বট ইত্যাদি বৃক্ষ ।
কিংশুক - পলাশ ফুল বা বৃক্ষ
সুরঙ্গ - সুন্দর রঙ । শোভন বৰ্ণ ।
মল্লি - বেলিফুল। বেলফুল।
লবঙ্গ - একপ্রকার ফুল। মসলা ।
গুলাল - আবির। ফাগ।
ঝঙ্কার - বীণাযন্ত্রের শব্দ। গুঞ্জন ।
নিদাঘ - গ্রীষ্মকাল। উত্তাপ।
সরণ - শরণ অর্থে ব্যবহৃত । আশ্রয়।
বরিষে - বর্ষিত হচ্ছে। অজস্র ধারায় বৃষ্টিপাত ।
পূরিত - পূর্ণ। ভরা। ভরপুর ।
কৈলাস - শিবের বাসস্থান। হিমালয় পর্বতের একটি অংশ।
মল্লার - মালহার; সংগীতের একটি রাগ; রাত্রির দ্বিতীয় প্রহরে গাওয়া হয়।
দাদুরী - মাদি ব্যাঙ। ভেকী ।
শিখিনী - ময়ূরী ।
অতি মন ভাএ - মনে অনেক ভাব জাগে ।
পুনি - পুনরায় ।
চামর - পাখা বিশেষ। চমরী- গরুর পুচ্ছ দিয়ে তৈরি পাখা ।
খঞ্জন - এক জাতীয় চঞ্চল পাখি ।
উপজিত - উপস্থিত হয়। উৎপন্ন
তাম্বুল - পান। একপ্রকার পাতা যা সুপারি চুন ইত্যাদি সহযোগে খাওয়া হয় ।
তরাসে - ভয়ে। ত্রাসে।
তুরিতে - দ্রুত। শীঘ্র। তাড়াতাড়ি।
কাফুর - কর্পূর। শুভ্র গন্ধদ্রব্য বিশেষ ।
কস্তুরী - মৃগনাভি ৷
চুয়া - গন্ধদ্রব্য। একপ্রকার সুগন্ধি ঘন নির্যাস।
যাবক - আলতা ।
আলাওলের “ঋতু বর্ণন” কবিতাটি তাঁর বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ ‘পদ্মাবতী'র ঋতু বর্ণন খণ্ড থেকে সংক্ষেপিত আকারে
সংকলিত। প্রকৃতির বিচিত্র রূপ অভিব্যক্ত হয় আবহাওয়া ও ষড়ঋতুর প্রভাবে। বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে যুগে যুগে মানুষ হয়েছে মুগ্ধ। মুগ্ধ হয়েছেন সংবেদনশীল কবিগণও । ঋতু বর্ণনা মধ্যযুগের কাব্যের এক স্বাভাবিক রীতি।
কবি আলাওল এই ঋতু বর্ণনায় প্রকৃতির রূপবৈচিত্র্যের সাথে মানব মনের সম্পর্ক ও প্রভাব তুলে ধরেছেন। বসন্তের নবীন পত্রপুষ্প, মলয় সমীর, ভ্রমর গুঞ্জন ও কোকিলের কুহুতান; গ্রীষ্মের প্রচণ্ড তপনের রৌদ্র ত্রাস ও ছায়ার গুরুত্ব; বর্ষার মেঘ গর্জন, অবিরল বৃষ্টিজলে স্নাত প্রকৃতি, একটানা দাদুরী শিখীনি রব; শরতের নির্মল আকাশ, ফুলের চামর দোলা, খঞ্জনার নাচ; শরৎ বিদায়ে হেমন্তে পুষ্পতুল্য তাম্বুলের সুখ এবং শীতের ত্রাসে ত্বরিত সূর্য ডুবে যাওয়া, রজনীতে সুখী দম্পতির চিত্তসুখ ইত্যাদি চমৎকারভাবে বর্ণিত হয়েছে কবিতাটিতে। ষড়ঋতুর বর্ণনার ভেতর দিয়ে কবি বাংলার প্রকৃতির রূপ-মাধুরী তুলে ধরেছেন। ষড়ঋতুর বৈচিত্র্য বাংলার নিসর্গ-রূপকে যে সমৃদ্ধ করেছে তা এ কাব্যাংশ থেকে স্পষ্টভাবে বোঝা যায় ।
Read more