কম্পিউটার একটি মাইক্রোইলেকট্রনিক্স ডিভাইস। মাইক্রোইলেকট্রনিক্স ডিভাইস কিন্তু অল্পদিনের মধ্যে তৈরি হয়নি। এটি তৈরি হতে যুগের পর যুগ সময় লেগেছে। এর পিছনে বিজ্ঞানী, স্বপ্নদ্রষ্টা, প্রকৌশলী এবং নির্মাতাদের অবদান রয়েছে। একেক সময়ে এক একটি ইলেকট্রনিক্স বিকাশ হয়েছে যা কম্পিউটার প্রজন্ম হিসেবে পরিচিত। একইসাথে কম্পিউটারের বিভিন্ন ইলেকট্রনিক্স বিকাশের সাথে সাথে বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন কাজের জন্য বিভিন্ন শ্রেণির কম্পিউটার ডিজাইন করেছেন। এই ডিজাইনকৃত কম্পিউটারগুলোর কাজের বৈশিষ্ট্য অনুসারে কম্পিউটার শ্রেণিবিভাগ করা হয়েছে।
আইবিএম (IBM) কম্পিউটারের একটি বিজ্ঞাপন থেকে কম্পিউটার প্রজন্ম হিসাব করার প্রথা চালু হয়। কম্পিউটার বিভিন্ন পর্যায়ে পরিবর্তিত হয়ে বর্তমান অবস্থায় এসেছে। পরিবর্তন, উন্নয়ন ও বিকাশের একেকটি পর্যায় বা ধাপকে কম্পিউটার প্রজন্ম বা জেনারেশন (Generation) বলে। নিম্নে কম্পিউটারের বিভিন্ন প্রজন্ম সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো।
(ক) প্রথম প্রজন্ম কম্পিউটার (First Generation Computer)
১৯৫১ থেকে ১৯৫৯ সাল পর্যন্ত সময়কালকে কম্পিউটারের প্রথম প্রজন্ম বলে। প্রথম প্রজন্মের কম্পিউটারগুলোতে ভ্যাকুয়াম টিউব ব্যবহার করা হতো। অসংখ্য ডায়োড, ট্রায়োড, ভালব (valve), রেজিষ্টার ও ক্যাপাসিটর ইত্যাদি দিয়ে তৈরি হতো বলে প্রথম প্রজন্মের কম্পিউটারের আকৃতি ছিল বড় ও স্বল্প গতি সম্পন্ন। এই প্রজন্মের কম্পিউটারে বিদ্যুৎ খরচ বেশি হতো এবং প্রচুর তাপ উৎপন্ন করতো ফলে কম্পিউটার ঠান্ডা রাখতে মাঝে মাঝে শীতল পানি ব্যবহার করা হতো। এ প্রজন্মের কম্পিউটারের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য নিচে দেয়া হলো—
প্রথম প্রজন্মের কম্পিউটারের বৈশিষ্ট্য—
১. ধীর গতি সম্পন্ন ও গতি পরিমাপ করা হতো মি.লি. সেকেন্ডে।
২. আকৃতিতে খুবই বড় এবং ওজনে ভারী ছিল।
৩. ভ্যাকুয়াম টিউব (Vacuum Tube) ও বিভিন্ন ধরনের বৈদ্যুতিক বর্তনীর ব্যবহার।
৪. মেমোরি হিসাবে ম্যাগনেটিক ড্রাম (Magnetic Drum) এর ব্যবহার।
৫. দাম অনেক বেশি ছিল এবং মেশিন ভাষায় প্রোগ্রাম লিখতে হতো।
৬. ইনপুট-আউটপুট ব্যবস্থার জন্য পাঞ্চকার্ডের ব্যবহার।
৭. তথ্য ধারণের জন্য ইলেকট্রোস্ট্যাটিক টিউব (CRT) এর ব্যবহার এবং সীমিত তথ্য ধারণ করতে পারতো।
৮. রক্ষণাবেক্ষণ সমস্যা ছিল।
উদহারণ : UNIVAC 1, IBM 650, IBM 704, IBM 709, Mark II, Mark IV ইত্যাদি।
জেনে রাখো: ইলেকট্রনিক্সের প্রকৃত যাত্রা শুরু হয় ১৮৮৩ সালে এডিসন ক্রিয়া আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে। তিনি লাইট বাল্বে দেখতে পান ফিলামেন্ট সাপেক্ষে প্লেটকে যখন ধনাত্বক বিভব দেওয়া হচ্ছে ভ্যাকুয়াম টিউবের মধ্য দিয়ে একটি তড়িৎপ্রবাহ চলে। কিন্তু প্লেটকে ঋণাত্নক বিভব দিলে তড়িৎপ্রবাহ চলে না। বৃটিশ পদার্থবিজ্ঞানী ফ্লেমিং এডিসনের এই ধারণাটিকে কাজে লাগিয়ে প্রথম ভ্যাকুয়াম টিউব আবিষ্কার করেন। এই টিউব রেকটিফায়ার বা একমুখিকারক হিসেবে কাজ করে অর্থাৎ এটি দিক পরিবর্তী তড়িৎ প্রবাহকে একমুখি তড়িৎ প্রবাহতে পরবর্তিত করে। ভ্যাকুয়াম টিউবে দুটি ইলেকট্রোড ছিল বলে এর নাম ডায়োড । তিনটি থাকলে তার নাম ট্রায়োড । |
---|
(খ) দ্বিতীয় প্রজন্মের কম্পিউটার (Second Generation Computer)
১৯৬০ থেকে ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত সময়কালকে কম্পিউটারের দ্বিতীয় প্রজন্ম বলে বিবেচনা করা হয়। ১৯৪৭ সালে আমেরিকার বেল ল্যাবরেটরিতে কর্মরত বিজ্ঞানী জন বারডেন (John Bardeen ), উইলিয়াম শকলি (William Shockley) এবং ওয়াল্টার ব্রাটেন (Walter Brattain) ট্রানজিস্টর আবিষ্কার করেন। ভ্যাকুয়াম টিউবের পরিবর্তে ট্রানজিস্টর ব্যবহার করার ফলে দ্বিতীয় প্রজন্মের কম্পিউটার, প্রথম প্রজন্মের কম্পিউটার থেকে আকৃতিতে ছোট, দ্রুতগতি ও অধিক নির্ভরযোগ্য ছিল। দ্বিতীয় প্রজন্মের কম্পিউটারের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা হলো-
দ্বিতীয় প্রজন্মের কম্পিউটারের বৈশিষ্ট্য
১. ভ্যাকুয়াম টিউবের পরিবর্তে ট্রানজিস্টরের প্রচলন।
২. ম্যাগনেটিক কোর মেমোরির ব্যবহার।
৩. আকৃতির সংকোচন ও অধিক নির্ভরযোগ্যতা।
৪. মেশিন ভাষার পরিবর্তে উচ্চস্তরের ভাষার প্রচলন।
৫. টেলিফোন লাইন ব্যবহার করে ডেটা প্রেরণের ব্যবস্থা।
৬. উচ্চগতি সম্পন্ন ও উন্নতমানের ইনপুট-আউটপুট ব্যবস্থার প্রচলন।
৭. তাপ সমস্যার সমাধান।
উদাহরণ : IBM 1401, CDC 1604, RCA 301, RCA 501, NCR 300, GE 200, Honey well 200, IBM 1620 ইত্যাদি।
১৯৬৪ সালে দ্বিতীয় প্রজন্মের IBM 1620 কম্পিউটার দিয়ে বাংলাদেশে কম্পিউটারের ব্যবহার শুরু হয়। ঢাকা পরমাণু শক্তি কেন্দ্রে দীর্ঘ কয়েক বছর এটি চালু ছিল।
(গ) তৃতীয় প্রজন্মের কম্পিউটার (Third Generation Computer)
১৯৬৪ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত সময়কে কম্পিউটারের তৃতীয় প্রজন্ম বলে। রবার্ট নইসি ( Robert Noyce) এবং জ্যাক কিলবি (Jack Kilby) বড় সার্কিট ক্ষুদ্র করার জন্য IC (Integrated Circuit) আবিষ্কার করেন। ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট অনেকগুলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অর্ধপরিবাহী, ডায়োড, ট্রানজিস্টর এবং অন্যান্য ইলেকট্রনিক যন্ত্রের সমন্বয়ে গঠিত। ফলে তৃতীয় প্রজন্মের কম্পিউটারে IC ব্যবহার শুরু হয়। ফলে কম্পিউটারের আকার ও দাম কমে গেলেও গতি বেড়ে যায়। তৃতীয় প্রজন্মের কম্পিউটারের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য নিচে দেয়া হলো-
তৃতীয় প্রজন্মের কম্পিউটারের বৈশিষ্ট্য
১. কম্পিউটারে ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট এর ব্যবহার।
২. আকৃতি সংকোচন ও অধিক নির্ভরযোগ্যতা।
৩. কম্পিউটারের কাজের ক্ষমতা ও গতিবৃদ্ধি ।
৪. সহজে বহনযোগ্য ও বিদ্যুৎ শক্তি কম খরচ হয়।
৫. মুদ্রিত আকারে লাইন প্রিন্টারের ব্যবহার।
৬. আউটপুট হিসেবে ভিডিও ডিসপ্লে ইউনিটের প্রচলন।
৭. উচ্চতর ভাষার উন্নয়ন ও ব্যবহার।
৮. মিনি কম্পিউটারের উদ্ভাবন শুরু হয়।
৯. অর্ধপরিবাহী স্মৃতির ব্যবহার।
১০. কম্পিউটারের দাম অনেক কমে যায়।
উদাহরণ : IBM 360, 370, PDP 8, PDP || ইত্যাদি তৃতীয় প্রজন্মের কম্পিউটার ।
(ঘ) চতুর্থ প্রজন্মের কম্পিউটার (Forth Generation Computer )
১৯৭১ সাল থেকে বর্তমানকাল পর্যন্ত সময়কে চতুর্থ প্রজন্ম বলে। কম্পিউটারের চতুর্থ প্রজন্ম বলতে সাধারণভাবে মাইক্রোকম্পিউটার বা পার্সোনাল কম্পিউটারকেই বোঝানো হয়। Large Scale Integration (LSI) ও Very Large Scale Integration (VLSI) মাইক্রোপ্রসেসর এবং Semiconductor Memory দিয়ে এ প্রজন্মের কম্পিউটারগুলো তৈরি হয়। এ প্রজন্মেই কম্পিউটার স্মৃতি উদ্ভাবিত হতে থাকে। ফলে কম্পিউটারের আকার আয়তন ও দাম কমে যায় এবং কাজ করার ক্ষমতা কয়েকগুণ বেড়ে যায়।
চতুর্থ প্রজন্মের কম্পিউটারের বৈশিষ্ট্য
১. মাইক্রোপ্রসেসর ভিত্তিক কম্পিউটার বা মাইক্রোকম্পিউটারের প্রচলন ।
২. বৃহদাকার একীভূত বর্তনী বা VLSI এর ব্যবহার।
৩. বর্তনীগুলোতে অপটিক্যাল ফাইবারের ব্যবহার।
৪. উন্নত মেমোরি তথা ম্যাগনেটিক বাবল মেমোরির (Magnetic Bubble Memory) ব্যবহার।
৫. অত্যন্ত শক্তিশালী ও উচ্চগতি সম্পন্ন মাইক্রোপ্রসেসরের ব্যবহার।
৬. সুপার কম্পিউটারের উন্নয়ন।
উদাহরণ : IBM-3033, IBM 4341, TRS 40, IBM PC ইত্যাদি এ প্রজন্মের কম্পিউটার।
(ঙ) পঞ্চম প্রজন্মের কম্পিউটার (Fifth Generation Computer)
পঞ্চম প্রজন্মের কম্পিউটারগুলোতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (Artificial Intelligence) প্রয়োগ করা হচ্ছে। Super VLSI (Very Large Scale Integration) চিপ ও অপটিক্যাল ফাইবারের সমন্বয়ে পঞ্চম প্রজন্মের কম্পিউটার তৈরি হবে। শক্তিশালী মাইক্রোপ্রসেসরও অনেক বেশি তথ্য ধারণক্ষমতা সম্পন্ন মেমোরি উদ্ভাবনের জন্য গবেষণা চলছে। মানুষের কণ্ঠস্বর শনাক্ত করার ক্ষমতা ও কণ্ঠে দেওয়া নির্দেশ বুঝতে পারে এমন ক্ষমতাসম্পন্ন বৈশিষ্ট্য থাকবে এই প্রজন্মের কম্পিউটারে। এটি প্রতি সেকেন্ডে ১০ – ১৫০ কোটি যৌক্তিক সিদ্ধান্ত নিতে পারবে।
পঞ্চম প্রজন্মের কম্পিউটারের বৈশিষ্ট্য
১. কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার এবং যোগাযোগ করার জন্য অপটিক্যাল ফাইবারের ব্যবহার।
২. তথ্য ধারণক্ষমতা ব্যাপক উন্নতি।
৩. অনেকগুলো মাইক্রোপ্রসেসর বিশিষ্ট Integrated circuit (IC) এর ব্যবহার ।
৪. মানুষের কণ্ঠস্বর শনাক্ত করার ক্ষমতা থাকবে।
৫. অধিক শক্তিসম্পন্ন সুপার কম্পিউটারের উন্নয়ন।
৬. চৌম্বক কোর স্মৃতির ( Magretic Core Memory) ব্যবহার ।
৭. উচ্চতর ভাষায় প্রোগ্রাম সামগ্রীর উন্নতি।
নিজে করো : কম্পিউটারের বিভিন্ন প্রজন্মে ব্যবহৃত বর্তনী/ইলেকট্রনিক্স প্রযুক্তির নাম লিখো। |
---|