ঢাকা জেলার একটি বাৎসরিক প্লাবন অঞ্চল । শীতলক্ষ্যা নদীর দু-তীর ধরে মাইল দু-মাইল ভেতর পর্যন্ত ডোবে না। বর্ষায় আরও ভেতরে প্রবেশ করা মুশকিল। দু-মাইল যেতে পাঁচ মাইল ঘুরতে হয়। কোনো কোনো গ্রাম রীতিমতো দ্বীপ হয়ে যায়। ঢুকতে নাও-কোন্দা লাগে। ছোট পানি পারাপার হওয়ার জন্য কোথাও বাঁশের সাঁকো, কোথাও কাঠের পুল আছে। ওগুলো পারাপার হতে ট্রেনিং আবশ্যক। অনভ্যস্তের জন্য প্রায় ক্ষেত্রে ওগুলো পুলসেরাত। সাঁকোতে ঊর্ধ্বপক্ষে দুটো বাঁশ পাশাপাশি পাতা, নিচে জোড়ায় জোড়ায় আড়াআড়ি পোঁতা বাঁশের খুঁটি। ধরে চলার জন্য পাশে হালকা বাঁশ কখনো থাকেও না। মধ্যপথে যাওয়ার পর হয় দেখা গেল পায়ের নিচে মাত্র একটি বাঁশ, অন্যটি উধাও হয়ে গেছে। চড়ামাত্র সাঁকো মাঝিমাল্লাহীন ডিঙি নৌকার মতো বেসামাল নড়তে থাকে । কাঠের পুলের অবস্থাও প্রায় ওরকম। গরু-ছাগল পারাপার হওয়ার ফলে এক বছরের মধ্যেই পুলের বারোটা বাজে। পায়ের নিচের চার তক্তা ভেঙে দু-তক্তা এমনকি এক তক্তাও হয়ে যায় । কোথাও তক্তা অদৃশ্য হয়ে যায়, পাশাপাশি দু-খণ্ড বাঁশ স্থাপন করে সংযোগ স্থাপন করা হয়। দুর্বল খুঁটির ওপর স্থাপিত এসব কাঠের পুলে চড়ামাত্র বুড়ো মানুষের দাঁতের মতো খটখট নড়ে। মোটকথা, শতকরা আশিজন গ্রামবাসীর আর্থিক স্থিতির মতো সাঁকোর স্থিতিও বড় নড়বড়ে। পুলের নিচে অথৈ পানির স্রোত। পা ফসকে পড়লে বিপদ । সাঁতার না জানলে আরও বেশি বিপদ।
কলিমদ্দি এলাকার দফাদার। বিশ বাইশ বছর বয়সে ইউনিয়ন বোর্ডের দফাদারিতে ঢুকেছিল। তখন হতে সে কলিমদ্দি দফাদার নামে পরিচিত। এখন বয়স প্রায় ষাট, চুল দাড়িতে পাক ধরেছে। বয়সকালে সে লাঠি খেলত। এখন সে লাঠি খেলে না, কিন্তু ঐতিহ্যরূপে বাবরি চুল রাখে। চৌকিদারের সর্দার দফাদার। গ্রামাঞ্চলের একটি মর্যাদাবান পদ। মর্যাদা সে পায়ও। লোকেরা তাকে দফাদার সাব ডাকে। কিন্তু পদমর্যাদার ভার তার বাড় বাড়ায়নি। তার আচার-আচরণ সহজ, সরল। হালকা রসিকতায় রসপটু। যৌবনে রাত জেগে পুঁথি পড়ত। সপ্তাহে একদিন তাকে থানায় হাজিরা দিতে হয়। সেখানেও চৌকিদারের ওপরে তার মানমর্যাদা । বড় দারোগা এবং ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট মেম্বাররা তাকে ‘তুমি’ বলেন, শেষোক্তদের কেউ কেউ আপনি বলেও সম্মান করেন। চৌকিদারদের করেন তুই-তোকারি— এমনকি যাচ্ছেতাই গালিগালাজও ।
কলিমদ্দি দফাদারের বাড়ি বলতে একটি ছনের ঘর এবং তালপাতার ছাউনি দেয়া একটি একচালা পাকঘর, সামনে এক ফালি উঠোন । তার সামনে পাঁচ কাঠা পরিমাণ জায়গা । সেটিতে সে ‘আগুইনা’ চিতার চাষ করে । লতার নিচের মূল কবিরাজি ওষুধের উপাদান। শহরের কারখানায় ভালো দাম পাওয়া যায়। চাষের জমি সামান্য। মাস দু-মাসের খোরাকি হয় । বাকি সংবৎসর কিনে খেতে হয়। স্ত্রী ও পুত্রকন্যা নিয়ে পাঁচজনের সংসার, বেতন সামান্য । কয়েকটি আম, কাঁঠাল, পেয়ারা ও পেঁপে গাছ অতিরিক্ত আয়ের উৎস । আর আছে একটি ছোট গাভি এবং স্ত্রীর একটি ছাগল ও মোরগ, হাঁস দু-চারটি। বিয়োলে গাভিটি দেড় দু-সের দুধ দেয়। আধ সের রেখে বাকি সে সকালের বাজারে বেচে। এভাবে কায়ক্লেশে সংসার চলে। ধান-চালের দাম বাড়লে উপোস-কপোসও করতে হয়। কিন্তু কারো কাছে ধারকর্ডের জন্য হাত পেতে দফাদার তার মর্যাদা খোয়ায় না। চরম দুর্দিনেও যে স্ফূর্তিবাজ মানুষ। বাজারের চা দোকানে বসে সে সকলের মতো রসিকতা করে, রসিকতার জাহাজ তার মস্তিষ্ক ।
১৯৭১ সাল। ভাদ্রের শেষ। কানায় কানায় ভরা প্লাবনের পানি। যুদ্ধের প্রথমদিকেই খান সেনারা থানা সদর দখল করে নিয়েছিল। থানার কাছাকাছি ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলওয়ে। কিছুদিন যেতে নদীর ওপর পুল। অঞ্চলের নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও দৃঢ় করার লক্ষ্যে সম্প্রতি ওরা ভেতরেও প্রবেশ করেছে। কলিমদ্দি দফাদারের বোর্ড অফিস শীতলক্ষ্যার তীরে, বাজারে। নদীর এপারে-ওপারে বেশ কিছু বড় বড় কল-কারখানা। ওগুলো শাসনের সুবিধার্থে একদল খান সেনা বাজারসংলগ্ন হাইস্কুলটিকে ছাউনি করে নিয়েছে। নদীর ওপারে মিলের রেস্ট হাউসে আর একটি ছাউনি। বাঁধন খুবই শক্ত। তবু কোনো কোনো রাত্রে গুলিবিনিময় হয়। কোথা হতে কোন পথে কেমন করে মুক্তিফৌজ আসে, আক্রমণ করে এবং প্রতি আক্রমণ করলে কোথায় হাওয়া হয়ে যায়, খান সেনারা তার রহস্য ভেদ করতে পারে না। কখনো কখনো খতরনাক অবস্থার মধ্যে পড়তে হয়। হাটবাজারের লোকজন, মিল ফ্যাক্টরির শ্রমিক, দোকানদার, স্কুলমাস্টার, ছাত্র সকলকে কাতারবন্দি করে বন্দুকের নল উঁচিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে, ‘মুক্তি কিধার হ্যায় বোলো।' এক উত্তর, ওরা জানে না ।
অল্পদিন আগেই একটা খতরনাক ঘটনা ঘটেছে। বাজারের পশ্চিম-দক্ষিণে কয়েক ঘর গন্ধবণিক বাড়ুই জাতীয় হিন্দুর বাস। সে গ্রামের লোকেরা নদীর ঘাটে স্নান করে, কাপড় ধোয় এবং ভরা কলসি কাঁখে বাড়ি ফেরে। বাজারের অল্প দক্ষিণে ওদের ঘাট। ছায়াঘন বাঁশঝাড়, সুপারিগাছ, কলাগাছ, পানের বরজ প্রভৃতির ভেতর দিয়ে ইউনিয়ন বোর্ডের অপ্রশস্ত সড়ক এঁকেবেঁকে এসে নদীঘাটে নেমেছে। খান সেনারা বাজারের উত্তরে স্কুল ঘরে। হাট-বাজার এখন আর তেমন জমে না । খান সেনাদের গতিবিধি ও অবস্থানের খোঁজখবর নিয়ে বউঝিরা ঘাটে আসে। খোঁজখবর নিয়েই সেদিন মধ্যাহ্নে ঘাটে এসেছিল গরিব বিধবা হরিমতি এবং তার যুবতী মেয়ে সুমতি । জায়গা-জমি নেই । ওরা রাতভর ঢেঁকিতে চিড়া কোটে, দিনে মুড়ি ভাজে। চিড়া-মুড়ি বেচে ওরা দিন গুজরান করে। অভাগা যেখানে যায় সাগর শুকিয়ে যায়, এ রকম একটা কথা আছে। দুর্ভাগ্য ওদের; সবে ভরা কলসি কাঁখে আর্দ্র বস্ত্রে নদীর ভাঙ্গুনতি ভেঙে ওপরে উঠে বাড়ির পথ ধরেছে ঠিক সে সময়টাতেই পাঁচজন যমদূতের চোখে পড়ে ওরা— মা মেয়ে। বন্দুক কাঁধে পাঁচজন খান সেনা সড়কপথে দক্ষিণ দিক থেকে এসে উপস্থিত হয় চৌরাস্তার সংযোগস্থলে ।
হরিমতি ও সুমতি মাটির কলসি কাঁখ থেকে ফেলে পশ্চিম দিকে দৌড়! দৌড়! ছায়াঘন আঁকাবাঁকা পথে ওরা জীবনপণ দৌড়োচ্ছে তো দৌড়োচ্ছেই। আত্মরক্ষা করতেই হবে।
বন্দুক কাঁধে নিয়েই খান সেনারা ওদের পশ্চাদ্ধাবন করে। হরিমতি ও সুমতি একনজর পশ্চাদ্দিকে তাকিয়ে আরও বেগে দৌড়ায়। আশপাশের লোকজন ওই দৃশ্য দেখে বাড়িঘর ছেড়ে ঝোপে জঙ্গলে আত্মগোপন করে । পোয়াতি মেয়েরা ক্রন্দনরত শিশুর মুখ চেপে ধরে । আর্দ্র বস্ত্রে মাইলখানেক দৌড়োবার পর মা মেয়ে দু-জনের একজনও আর দৌড়োতে পারে না। রাস্তার ডান দিকে প্রাইমারি স্কুল। আশ্রয়ের আশায় ওরা স্কুলঘরে প্রবেশ করে। স্কুলঘর জনপ্রাণীশূন্য। দেয়ালে টাঙানো ব্ল্যাকবোর্ডে খড়ি মাটিতে কষা একটা অর্ধসমাপ্ত অঙ্ক ছাড়া আর কিছু চোখে পড়ে না । একটা ছুঁচো ইঁদুর ওদের দেখে পালিয়ে যায়। চার চারটা দরজা এবং সবগুলো জানালা খোলা । হরিমতি, সুমতি ঢুকে দম নেয়ার আগেই খান সেনাদের বুটের দাপট শুনতে পায়। ওরাও কিছুক্ষণ দম নেয়। চারিদিকে প্রাচীর । সশস্ত্র শিকারি এবং শিকার দুটোই ভেতরে । কিছুক্ষণ মা মেয়ের আর্তনাদ ওঠে। পরে নিঃশব্দ হয়ে যায় স্কুলঘর। হরিমতি সুমতিকে ওরা হত্যা করে না । রক্তাক্ত অজ্ঞান অবস্থায় ফেলে খান সেনারা রাইফেল কাঁধে স্কুলঘর ত্যাগ করে ।
রাস্তায় পড়ে কয়েক পা এগোতেই গুলির শব্দ হয়। কোন দিক থেকে আসছে ঠাহর করার আগেই একজনের মাথার খুলি উঠে যায়। ‘মুক্তি আ গিয়া, ইয়া আলী' চিৎকার করতে করতে বাকি চারজন ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ায়। আরও একজনের উরুর মাংস ছিঁড়ে গুলি বেরিয়ে যায়। নিহত সঙ্গীকে পশ্চাতে ফেলে রেখে বাকি চারজন কোনোক্রমে ছাউনিতে ফিরে আসে।
সেদিন থেকে এলাকায় মুক্তিফৌজ নিধন কাজ শুরু হয়। রোজ দল বেঁধে বেরোয় খান সেনারা। বাজারে মিলিটারি ঢোকার পর থেকেই কলিমদ্দি দফাদারের ওপর বোর্ড অফিস খোলার ভার পড়েছে। অপেক্ষাকৃত কমবয়স্ক চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান মিলিটারির ভয়ে পারতপক্ষে এদিকে আসেন না। মেম্বারগণও আত্মগোপন করেছেন। কিন্তু বোর্ড অফিস নিয়মিত খোলা রাখার হুকুম জারি আছে। কলিমদ্দি এ কাজ করার জন্য বাজারে আসে। খান সেনারা ওকেই ওদের অভিযানের সঙ্গী করে নেয়। সে সরকারি লোক, নিয়মিত নামাজ পড়ে এবং যা হুকুম হয় তা পালন করে। সুতরাং সন্দেহের কারণ নেই ।
সেদিন থেকে দফাদার দিনের বেলা বাড়ি যেতে পারে না। বাজারেই খেতে হয় তাকে। খাওয়ার জন্য রোজ তিন টাকা পায় সে । খান সেনারা কি তাকে রাজাকারে ভর্তি করে নিয়েছে? কলিমদ্দি তার কিছু জানে না। সে তার স্বাভাবিক হাসিমুখে খান সেনাদের সঙ্গী হয়ে যেদিক যেতে বলে যায়। সে আড়-কাঠি, আগে আগে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাওয়া তার ডিউটি। বাজারের লোকজন কখনো কখনো তাকে অনুযোগ দেয়, দফাদার ভাই আপনেও?
কলিমদ্দি স্মিত হেসে সহজ উত্তর দেয়, আমি ভাই সরকারি লোক, যখনকার সরকার তখনকার হুকুম পালন করি। এর বেশি একটি কথাও তার মুখ থেকে বের করা যায় না।
বুধবার। আশপাশে কোথাও হাটবার নেই। সকাল দশটায় কলিমদ্দি দফাদারের ডিউটি পড়ে। আজ ইউনিয়ন বোর্ডের কাঁচা সড়কপথে পশ্চিম দিকে মুক্তিবিরোধী অভিযান। আট-দশজন সশস্ত্র খান সেনা । কলিমদ্দি আগে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। লক্ষ্যস্থান গ্রাম । সেখানে নাকি বহু হিন্দুর বাস, আরও হিন্দু বাইরে থেকে এসে আশ্রয় নিয়েছে। মুসলমানগুলোও ভারতীয় চর- কাফেরদের সঙ্গে এক জোট। আজ ওই গ্রামটা শায়েস্তা করতে হবে । আগুন দেয়ার মালমসলা, অস্ত্রও সঙ্গে আছে।
বেলা এগারোটা। মাঠের ওপর দিয়ে অপ্রশস্ত মেটে সড়ক। মাঠ পেরিয়ে একটি ছোট গ্রাম। তারপরেই লক্ষ্যস্থল।
চকচকে রোদ । সড়কের উত্তরে রাইফেল রেঞ্জের মধ্যে গামছা-পরা এক কিশোর তিন চারটে গরু খেদিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তার মাথায় ছালা বোঝাই ঘাস। কাঁধে লাঙল-জোয়াল। সম্ভবত সে মাঠ থেকে বাড়ি ফিরছে। ‘মুক্তি! মুক্তি!' একজন সৈনিক চিৎকার করে ওঠে।
‘কাঁহা? কাঁহা?’- অপরেরা প্রশ্ন করে।
‘ডাহনা তরফ দেখো।'
কলিমদ্দি দফাদার সবিনয়ে বলতে চায়, ‘মুক্তি নেহি ক্যাপ্টিন সাব, উয়ো রাখাল হ্যায়, মেরা চেনাজানা হ্যায়। ' ‘চুপ রাও সালে কাফের কা বাচ্চা কাফের। মুক্তি, আলবৎ মুক্তি।' বলেই সকলে একসঙ্গে গুলি ছোড়ে। এলাকা কেঁপে ওঠে। ধ্বনি প্রতিধ্বনি হয়ে দূরে ছড়িয়ে পড়ে।
কলিমদ্দি দফাদারের বাল্যকালের পাতানো দোস্ত সাইজদ্দি খলিফার ষোল বছরের ছেলে একবার মাত্র ‘মা’ বলে। ধরাশায়ী দেহটা থেকে আর কোন ধ্বনি কানে আসে না।
‘এক মুক্তি খতম । আভি সামনে চলো দফাদার ।
‘জি, হুজুর,’ বলে সে হুকুম পালন করে।
ইতোমধ্যে খান সেনাদের পশ্চিমমুখী অভিযানের সংবাদ মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছে। গোলাগুলির শব্দ শোনার পর আশপাশের লোকজন ঘরবাড়ি ফেলে যে যেখানে পারে পালাতে শুরু করে। মাঠ পাড়ি দেয়ার আগেই সামনের গ্রাম সাফ হয়ে যায়।
পরের গ্রামে সেদিনের মূল যুদ্ধক্ষেত্র। সে গ্রামের পশ্চিমে অথই জলের বিস্তীর্ণ মাঠ । পানির ওপর বাওয়া ধানের সবুজ শীষ। গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে যাওয়ার জন্য ধান-ক্ষেতের ওপর দিয়ে নাওদাঁড়া। গ্রামবাসীরা উঠিপড়ি নাও—কোন্দা বেয়ে অথই পানিতে ভাসমান উদ্ধত ধানের শীষের আড়ালে আত্মগোপন করে। যারা নাও- কোন্দা পায় না তারা বিলে নামে এবং মাথার ওপরে কচুরিপানা চাপিয়ে নাক জাগিয়ে ডুবে থাকে ।
মুক্তি নিধন অভিযান এগিয়ে চলে। সামনে একটি লোকও পড়ে না। বাড়িঘর জনশূন্য, কলেরা মহামারীতে বিরল জায়গার মতো মনে হয় পল্লি । হাঁস-মোরগ কুকুর-বিড়ালও গোলাগুলির শব্দ শুনে আত্মগোপন করেছে । দড়িতে বাঁধা ছাগল-গোরু দু-চারটা দেখা যায় ।
‘ইয়ে বকরি বহুত খুবসুরত আওর তাজা, ওয়াপস জানে কে ওয়াকত... সমজে খান সেনাদের একজন
সঙ্গীদের বলে । ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, এক ফিস্ট হু জায়েগা,' অন্যেরা হেসে সমর্থন জানায়। ওরা পথের দু-ধারের বাড়িঘরে উঁকিঝুঁকি এবং ঝোপে জঙ্গলে গুলি ছুড়ে হদ্দ হয়। একজন মুক্তির সন্ধানও পাওয়া যায় না ৷
বেলা তখন বারোটা, হঠাৎ কমান্ডার নির্দেশ দেয়, ‘হল্ট! এক, দো!
সামনে কাঠের পুল। দু-দিক থেকে তিরিশ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে খাড়া হয়ে কিছু দূরে ওঠার পর মাঝভাবে সমতল, নিচে প্লাবিত খাল এবং দু-দিকের বাওয়া ধানের ক্ষেত, উদ্ধত ধানের শিষ পানির সঙ্গে তাল রেখে বেড়ে চলছে। পুলের উত্তর-দক্ষিণে যতদূর দৃষ্টি যায় খাল এবং প্লাবিত ধানক্ষেত এঁকেবেঁকে স্থানে স্থানে অশ্বখুরের আকারে ভিতরে প্রবেশ করে এগিয়ে চলেছে। পুলের ওপর দিয়ে মানুষ এবং ছাগল-গরু পারাপার হয়, নিচ দিয়ে চলে নাও-কোন্দা। ঘন গাছপালা-বেষ্টিত দু-পারের গ্রাম বেশ উঁচুতে। নবাগতের কাছে পার্বত্য অঞ্চল মনে হতে পারে। আসলে এটাই ভাওয়াল পরগনার ভূমিবিন্যাস বৈশিষ্ট্য। স্থানীয় লোকদের কাছে উঁচু টিলাগুলো টেক নামে পরিচিত। যুদ্ধস্থলরূপে নির্দিষ্ট সামনের গ্রামের অবস্থাপন্ন ঘরবাড়ি এপারে দাঁড়িয়েও দেখা যায়। চৌচালা টিনের ঘরের টুয়া সুস্পষ্ট। পুলটা না পেরিয়ে ওগ্রামে প্রবেশ করার কোনো উপায় নেই। বর্ষাকালে গ্রামটা জলবেষ্টিত দ্বীপ। ‘চলিয়ে হুজুর!” কলিমদ্দি দফাদার বলে।
‘মগর! আওর কুই রাস্তা নেহি দফাদার?' কমান্ডার জিজ্ঞাসা করে ।
‘নেহি হুজুর! সেরেফ একহি রাস্তা। বাকি চারো তরফ পানি।' দফাদার জানায়। ‘ইয়ে পুল আচ্ছা হ্যায়!”
‘জি, হ্যাঁ, হুজুর, বহুত আচ্ছা হ্যায় । মানুষ গরু হামেশা পার হোতা হ্যায় ।
‘মালুম হোতা পুলসেরাত। ঠিক হ্যায়; তুম আগে চলো দফাদার।'
‘বহুত আচ্ছা হুজুর।'
কলিমদ্দি দফাদার পুলের ওপর ওঠে। দু-তিন বছর আগে কিছু ইউনিয়ন বোর্ডের সাহায্যে, কিছু গ্রামবাসীর চাঁদায় তৈরি তিন তক্তার পুল। প্রায় জায়গায় নাট-বল্টু ঢিলা হয়ে গেছে। জায়গায় জায়গায় গায়েবও হয়ে গেছে। ধরে চলার জন্য দু-দিকে বাঁশের ধরনি নেই। কাঠের খুঁটির গোড়ায় পচন ধরায় স্থানে স্থানে বাঁশের ঠিকা দেয়া হয়েছে। ওর ওপর বিছানো তক্তাও নরম, পচেও গেছে দু-এক জায়গায়, কিন্তু গ্রামের লোকের কাছে বিপজ্জনক নয়, আর যদি কখনও তক্তাসুদ্ধ নিচে পড়েই যায় কেউ সাঁতার কেটে পাড়ে উঠবে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা পুলের ওপর থেকে লাফিয়ে পড়ে খালের জলে ঝাঁপুড়ি খেলে। আসলে পুলটা তেমন একটা নড়বড়ে নয়, মানুষ গরু ওপরে উঠলে কিছু কাঁপে- কাঁপালে আরও বেশি কাঁপে— কাঁপনি একটা সংক্রামক ব্যাধি কিনা তাই ।
কলিমদ্দি এক-পা দু-পা করে অতি সাবধানে এগিয়ে যায় এবং পিছন দিকে মুখ ফিরিয়ে বলে, আইয়েন হুজুর । হুজুরেরা ওপরে ওঠেন না, পুলের গোড়ায় দাঁড়িয়ে কলিমদ্দির পা দু-টোর দিকে মনোযোগ দেয়। কলিমদ্দি দফাদার যত এগিয়ে যায়, তার পদযুগল নিপুণ অভিনেতার পদযুগলের মতো ঠকঠক কাঁপে, পুল কাঁপে দ্বিগুণ তালে ।
ঊর্ধ্বারোহণ শেষে ওপরের সমতল জায়গাটুকু। সেখানকার তিন তক্তার একপাশেরটি পচে গেছে। তার একটি নাট-বল্টুও নেই। নিচের বরগাটির কানা জায়গাটাও ফেটে গেছে।
কলিমদ্দি দফাদার কী ভেবে নিচের দিকে একনজর তাকায়- খালের তীব্র স্রোত ছাড়া আর কোনো ঝামেলা নেই সেখানে। পরমুহূর্তে আর্তনাদের মতো কন্ঠস্বরে ‘মুক্তি মুক্তি' বলতে বলতে পচা তক্তাসমেত নিচে পড়ে যায়। খালের জলে একটা ঝুপ শব্দ হয়। সঙ্গে সঙ্গে বিপরীত দিক থেকে গুলিবর্ষণ শুরু হয়। পজিশন নিয়ে পাল্টা গুলিবর্ষণের আগেই ধরাশায়ী হয় দু-তিনজন। তারপরেও কিছুক্ষণ গোলাগুলি চলে, কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে নয়, পলায়ন পথের দু-দিকে এলোপাতাড়ি। যে কজন যুদ্ধ করতে গিয়েছিল ছাউনিতে সে কজন অক্ষত ফেরে না ।
কলিমদ্দিকে আবার দেখা যায় ষোলই ডিসেম্বর সন্ধ্যায় বাজারের চা স্টলে। তার সঙ্গীরা সবাই মুক্তি, সে-ই শুধু তার পুরনো সরকারি পোশাকে সকলের পরিচিত কলিমদ্দি দফাদার ।
আবু জাফর শামসুদ্দীনের জন্ম বৃহত্তর ঢাকার গাজীপুর জেলার কালিগঞ্জে ১৯১১ খ্রিষ্টাব্দের ১১ই মার্চ । প্রতিষ্ঠানিকভাবে উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণ না করলেও তিনি ছিলেন স্বশিক্ষিত। সাংবাদিকতার পাশাপাশি তিনি সরকারি চাকরিও করেছেন। সমাজ-সচেতন ও রাজনীতি-সচেতন ব্যক্তি হিসেবে তিনি ছিলেন সংস্কারমুক্ত, প্রগতিকামী ও মুক্তবুদ্ধিসম্পন্ন।
বাংলাদেশের অগ্রগণ্য কথাসাহিত্যিক আবু জাফর শামসুদ্দীন পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় ধরে সাহিত্যসাধনায় ব্রতী ছিলেন। কেবল গল্পকার ও ঔপন্যাসিক হিসেবে তিনি পরিচিত নন; তিনি নাটক লিখেছেন, অনুবাদ করেছেন। প্রখ্যাত সাংবাদিক হিসেবেও তিনি সুপরিচিত।
তিনি বাংলাদেশের সাহিত্য অঙ্গনে বিশেষ পরিচিত ও আলোচিত হন ‘ভাওয়াল গড়ের উপাখ্যান' নামের উপন্যাস লিখে। তাঁর অন্যান্য উপন্যাস হচ্ছে : 'পদ্মা মেঘনা যমুনা', ‘সংকর সংকীর্তন', ‘প্রপঞ্চ', 'দেয়াল'। তাঁর উল্লেখযোগ্য গল্পগ্রন্থ হচ্ছে : ‘শেষ রাত্রির তারা’, ‘এক জোড়া প্যান্ট ও অন্যান্য’, ‘রাজেন ঠাকুরের তীর্থযাত্রা’, ‘আবু জাফর শামসুদ্দীনের শ্রেষ্ঠ গল্প”, ইত্যাদি। তাঁর রচিত ‘আত্মস্মৃতি’ও অসামান্য গ্রন্থ ।
সাহিত্যে ও সাংবাদিকতায় কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার, একুশে পদকসহ বিভিন্ন পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। তাঁর মৃত্যু ১৯৮৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৪এ আগস্ট ঢাকায় ।
কোন্দা - তালগাছ দিয়ে তৈরি নৌকা।
পুলসেরাত - ইসলামি ধর্মবিশ্বাস অনুযায়ী পরকালের বিপজ্জনক সাঁকোবিশেষ
দফাদার - গ্রামে পাহারায় নিয়োজিত চৌকিদারের সরদার।
বাড় বাড়া - ঔদ্ধত্য। বাড়াবাড়ি। স্পর্ধা।
‘আগুইনা’ চিতা - ভেষজ উদ্ভিদবিশেষ।
খতরনাক - বিপজ্জনক । মারাত্মক ।
গন্ধবণিক - মশলা-ব্যবসায়ী।
বাড়ুই - ঘরের চাল ছাওয়া মিস্ত্রি ।
খান সেনা - খান পদবিধারী সেনা অর্থাৎ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী।
ভাঙ্গুনতি - নদীর পাড়ের ভাঙনশীল অংশ ।
মুক্তি আ গিয়া - মুক্তিবাহিনী এসে পড়েছে।
রাইফেল রেঞ্জ - রাইফেলের গুলিবিদ্ধ করার আওতা।
কাঁহা ? কাঁহা ? - কোথায়? কোথায়?
ডাইনা তরফ দেখো - ডান দিকে দেখ ।
উয়ো রাখাল হ্যায় - ও হচ্ছে রাখাল।
মেরা চেনাজানা হ্যায় - আমার পরিচিত (আছে)।
আভি - এখন ।
নাওদাঁড়া - নৌকা চলার ছোট খালের মতো পথ।
ইয়ে বকরি বহুত খুবসুরত আওর তাজা, ওয়াপস জানে কে ওয়াকত... সমজে... - এই বকরি ভারি সুন্দর আর তাজা, ফেরার সময়ে... বুঝেছ...।
এক ফিস্ট হু জায়েগা - একটা ভালো ভোজ হয়ে যাবে ।
টুয়া - ঘরের চালের শীর্ষ ।
মগর! আওর কুই রাস্তা নেহি দফাদার? - কিন্তু, অন্য কোনো রাস্তা কি নেই, দফাদার?
নেহি হুজুর! সেরেফ একহি রাস্তা। বাকি চারো তরফ পানি - না হুজুর! কেবল একটিই রাস্তা। বাকি চারপাশে পানি ।
ইয়ে পুল আচ্ছা হ্যায়? - এই পুল কি ঠিক আছে?
মালুম হো পুলসেরাত - মনে হচ্ছে যেন পুলসেরাত।
ধরনি - ধরার অবলম্বন ।
বরগার কানা জায়গা - আড়াআড়ি লাগানো কাঠের ভাঙা মুখ ।
আবু জাফর শামসুদ্দীনের “কলিমদ্দি দফাদার” গল্পটি সংকলিত হয়েছে আবুল হাসনাত সম্পাদিত মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গল্প-সংকলন ‘মুক্তিযুদ্ধের গল্প' থেকে। এই গল্পে বর্ণিত হয়েছে বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নিষ্ঠুর বর্বরতার ছবি। পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র মুক্তিবাহিনীর বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের প্রত্যক্ষ ছবি এই গল্পে বর্ণিত না হলেও তাদের দুর্বার প্রতিরোধমূলক তৎপরতার বিষয়টি স্পষ্টভাবে অনুভব করা যায়। ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে গ্রাম এলাকার আনসার, চৌকিদার-দফাদাররাও যে কখনো প্রত্যক্ষ কখনো পরোক্ষ কৌশলে অত্যন্ত গোপনে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের নানাভাবে সহায়তা করেছিল, সেই বাস্তবতাই শিল্প-সত্য হয়ে দেখা দিয়েছে “কলিমদ্দি দফাদার” গল্পে। গ্রামবাংলার একজন সাধারণ মানুষের দেশপ্রেম ও বুদ্ধিমত্তার পরিচয় গল্পটির একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক