চিংড়ি আহরণ

এসএসসি(ভোকেশনাল) - শ্রিম্প কালচার এন্ড ব্রিডিং-১ - প্রথম পত্র (নবম শ্রেণি) | NCTB BOOK

চিংড়ি খুবই স্পর্শকাতর জলজ প্রাণী। নতুন পানির স্পর্শ পেলেই এরা অধিক অক্সিজেনযুক্ত পানিতে এসে একত্রিত হয়। দিনে প্রচন্ড রোদের সময় পানি ঢোকানো হলে এরা পানি প্রবেশ গেটের মুখে চলে আসে। অনেক সময় পানি গরম হয়ে গেলে চিংড়ি দুর্বল হয়ে পড়ে এবং কোন কোন ক্ষেত্রে মারা যেতে পারে। পানির গভীরতা কম এমন স্থানে চিংড়ি চলে আসার সম্ভাবনা থাকলে এ সময় চিংড়ি ধরা বন্ধ করা উচিত। চিংড়ি প্রতি অমাবশ্যা ও পূর্ণিমার পর দেহ বৃদ্ধির জন্য প্রাকৃতিক নিয়মে খোলস বদলায়। এ সময় চিংড়ি অত্যন্ত নরম থাকে। বাজারে নরম চিংড়ির চাহিদা ও দর তুলনামূলকভাবে কম থাকে। এছাড়াও খাবারের অভাব বা চিংড়ির খাদ্যে ক্যালসিয়ামের অভাব হলে চিংড়ির খোলস নরম হতে পারে। এসব কারণেই চিংড়ি ধরার পূর্বে নমুনায়ন করে পরীক্ষা করা ভালো। চিংড়ি ধরার পূর্বে চিংড়ি বাজারজাতকরণের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি আগাম প্রস্তুত রাখা উচিত। যাতে সময়মত চিংড়ি বাজারজাত করা সম্ভব হয়। সময়মত চিংড়ি বাজারজাত করা সম্ভব না হলে গুণগতমান বিনষ্ট হয় এবং বাজারে চাহিদা থাকে না।

Content added By

চিংড়ি আহরণ পদ্ধতি

চিংড়ি আহরণের ক্ষেত্রে চিংড়ির ঘেরের পারিবেশিক অবস্থা, ঘের বা জমির পরবর্তী ব্যবহার, পরবর্তী ফসলের সময়, চিংড়ির বাজারদর, পরিবহণ ব্যবস্থার সুবিধা, প্রক্রিয়াজাতকরণের সুবিধা, প্রভৃতি বিবেচনা করে চিংড়ি আহরণ করা উচিত। সাধারণত চিংড়ির বয়স ৩ থেকে ৪ মাস হলে চিংড়ি আহরণ করা আরম্ভ হয়। চিংড়ির খামার বা ঘেরে পর্যাপ্ত খাবার বিদ্যমান থাকলে এবং ঘেরের পরিবেশ চিংড়ির বৃদ্ধির অনুকুল হলে ৪ থেকে ৫ মাসের মধ্যে প্রতিটি চিংড়ির ওজন ৩০ থেকে ৫০ গ্রাম হয়ে থাকে। আমাদের দেশে প্রধানত দু'ভাবে চিংড়ি আহরণ করা হয়ে থাকে, যেমন- আংশিক আহরণ ও সম্পূর্ণ আহরণ।

Content added By

এ পদ্ধতিতে ঘেরের চিংড়ি ১৫ থেকে ২০ গ্রেডের মধ্যে এলেই অমাবশ্যা ও পূর্ণিমার জোয়ারে নতুন পানি ঢোকানোর সময় বড় আকারের চিংড়ি ধরা আরম্ভ হয়। জোয়ারের সময় নির্দিষ্ট স্থানে চিংড়ি আটকিয়ে ঝাঁকি জাল দিয়ে বা অন্য কোন প্রকার ছোট জাল ব্যবহারের মাধ্যমে আংশিক চিংড়ি ধরা যেতে পারে। এ পদ্ধতিতে শুধু বড় আকারের চিংড়ি ধরে ছোট চিংড়িসমূহ বড় হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করা হয়।

সুবিধা

  • সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে বাজারজাত করা যায়।
  • গ্রেড অনুযায়ী চিংড়ির আকার মোটামুটি একই রকম করা যায়।
  • বাজারজাতকরণের ঝুঁকি কম থাকে।
  • ঘেরের ছোট চিংড়ি বড় হওয়ার সুযোগ পায়। 
  • পরিবহণ পাত্র ও আনুষঙ্গিক অন্যান্য জিনিসপত্র কম লাগে।

অসুবিধা

  •  চিংড়ি ধরার ক্ষেত্রে অতিরিক্ত শ্রম ব্যয় হয়।
  • কিছুটা সময় অপচয় হয়।
  • পরিবহণ খরচ বেশি লাগে।
Content added By

এ পদ্ধতিতে খামারের পানি নিষ্কাশনের মাধ্যমে গেটে জাল পেতে ছোট-বড় সব রকম চিংড়ি ধরা হয়। চিংড়ি সম্পূর্ণভাবে ধরার জন্য ব্যাগ নেট, বেহুন্দি জাল, হাপা নেট প্রভৃতি ব্যবহার করা যেতে পারে। ঘেরের পানি সম্পূর্ণ নিষ্কাশনের পর স্কুপ নেট (scoop net) বা হাতের মাধ্যমেও চিংড়ি ধরা যেতে পারে।

সুবিধা

  • খামারে নতুন ফসলের জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ করতে সুবিধা হয়।
  •  চিংড়ি ধরার কাজে শ্রম বিনিয়োগ কম লাগে।
  • ফসল পর্যায়ক্রম (crop rotation) করতে সুবিধা হয়।
  • একসাথে সমস্ত চিংড়ি বাজারজাত করা যায়।

অসুবিধা

  • অনেক চিংড়ি ছোট অবস্থায় থেকে যায় বা বড় হওয়ার সুযোগ পায় না।
  • খামারে মোট উৎপাদন কিছুটা কম হয়ে থাকে।
  • ছোট চিংড়ির বাজার চাহিদা কম হয়ে থাকে।
  • চিংড়ি ধরার কাজে বেশি বিনিয়োগের প্রয়োজন পড়ে।

চিত্র-৪.১: আহরণকৃত বাগদা চিংড়ি

Content added By

চিংড়ি আহরণ সরঞ্জাম

ৰাপদা চিংড়ি সাধারণত ৩ থেকে ৪ মাসের মধ্যেই আহরণের উপযুক্ত হয়ে থাকে। জলাশয়ের অবকাঠামোগত বৈচিত্রতা ও আহরণ উপকরণের কার্যকারিতার ওপর ভিত্তি করে চিংড়ি ধরার জন্য বিভিন্ন ধরনের বাহন ও উপকরণ ব্যবহৃত হরে থাকে। চিংড়ি আহরণ বলতে প্রধানত বাজারজাতকরণের উপযোগী চিংড়ি ধরাকে বোঝানো হয় এবং চিংড়ি ধরার জন্য যেসব উপকরণ ব্যবহার করা হয় তাকে আহরণ উপকরণ বলা হয়। চিংড়ি আহরণ উপকরণসমূহকে প্রধানত দু'ভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে, যেমন- চিংড়ি আহরণ ৰাহন বা ক্রাফট (craft) এবং চিংড়ি আহরণ উপকরণ বা গিয়ার (gear)। চিংড়ি আহরণ উপকরণসমূহকে এক কথায় ক্রাফট ও গিয়ার বলা হয়। মূলত একটি অপরটির সাথে সম্পর্কযুক্ত। চিংড়ি আহরণ পদ্ধতি সাধারণত জলাশয়ের প্রকৃতি ও ধরনের ওপর নির্ভর করে। জলাশয়ের ধরন, প্রকৃতি ও কারিগরি বৈশিষ্ট্য ও উপযোগিতা অনুসারে চিংড়ি আহরণ বাহন ও উপকরণ উভয়েরই প্রয়োজন হয়। কখনো কখনো বাহনের প্রয়োজন হয় না । বাণিজ্যিকভাবে মুক্ত জলাশয় ও বৃহৎ চিংড়ি ঘের থেকে চিংড়ি আহরণের ক্ষেত্রে বাহন ও উপকরণ উভয়েরই প্রয়োজন হয়।

বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেই চিংড়ি ধরার বা আহরণের জন্য বিভিন্ন ধরনের ফাঁদ, জাল ও বড়শি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। কৌশলগত দিক থেকে এসব আহরণ উপকরণসমূহের মধ্যে ভিন্নতা রয়েছে। তবে আমাদের দেশে বাগদা চিংড়ি আহরণে সাধারণত ৪টি পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়, সেগুলো হলো-

আটলকীন পদ্ধতি: অটল বাঁশের তৈরি এক ধরনের ফাঁদ বা ব্যবহার করে চিংড়ি ধরা যায়। এই সমস্ত আটল বিভিন্ন জাকারের হয়ে থাকে (২ থেকে ৩ ফুট)। আটল ঘেরের বিভিন্ন স্থানে এবং একটি থেকে আরেকটির দুরত্ব প্রায় ৮ থেকে ১০ ফুট হয়ে থাকে। আটল সাধারণত জোয়ারের সময় যেস্থান দিয়ে পানি প্রবেশ ও নির্গমন হয় সেখানে বা ঘেরের গভীরতম স্থানে স্থাপন করা হয়। ইহা একটি সহজ ও ব্যয় সাশ্রয়ী ব্যবস্থা। পাটা বা নেটের পার্শ্বে স্থাপন করা হয়। এই ছাল গোনের সময় ঘেরের গতীর স্থানে এবং গেঁই (বেরের যে স্থান দিয়ে জোয়ারের পানি ঢুকে ও বাহির হয়) এর ধারে স্থাপন করা হয়। এ পদ্ধতিতে চিংড়ি আহরণ অনেক সহজ এবং কম লোকবল দরকার হয়। কাঙ্ক্ষিত আকারের মেস সাইজ ব্যবহার করলে ছোট মাছ ধরা পড়ার সম্ভাবনা কম থাকে।

চিত্র-৪.২: আটল ব্যবহার করে চিংড়ি আহরণ

ঝাঁকি জাল পদ্ধতি: গোঁই বা ফাঁদে ধৃত চিংড়ির পরিমাণ কমে গেলে তখন ঝাঁকি জাল ব্যবহার করে চিংড়ি আহরণ করা যায়। এ পদ্ধতিতে ছোট চিংড়ি বার বার আসার সুযোগ থাকে। তাছাড়া শ্রমিকও বেশি লাগে। তবে এ পদ্ধতিতে চিংড়ি ধরার ১০-১৫ মিনিট পূর্বে খাদ্য নির্দিষ্ট কয়েকটি স্থানে প্রয়োগ করে চিংড়ি ধরা যায়।

বেড় জাল পদ্ধতি: যদি ঘের আয়তনে বড় হয় এবং বেশি পরিমাণ চিংড়ি ধরার প্রয়োজন হয় সেক্ষেত্রে বেড় জাল ব্যবহার করা উত্তম। কারণ জালের দৈর্ঘ্য বেশি হলে একদিকে যেমন জাল টানা সহজ হয়, তেমনি বেশিরভাগ চিংড়ি জালে ধরা পড়ে। এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে একই ঘেরে একদিনে দুই বারের বেশি বেড় জাল টানা উচিত নয়।

পানি নিষ্কাশন পদ্ধতি: আবদ্ধ ব্যবস্থাপনা পদ্ধতিতে চিংড়ি আহরণের জন্য সবশেষে পানি নিষ্কাশনের মাধ্যমে ঘের শুকিয়ে অবশিষ্ট চিংড়ি ধরা হয়। এ পদ্ধতিতে ভোর বেলায় চিংড়ি আহরণ করা বাঞ্ছনীয়।

বাংলাদেশে ব্যবহৃত কতিপয় চিংড়ি আহরণ উপকরণের নাম ও তার বর্ণনা দেয়া হলো-

Content added By

চিংড়িকে জীবন্ত অবস্থায় ফাঁদের অভ্যন্তরে আটকে রেখে পানির উপরিভাগে তুলে চিংড়ি আহরণ করা হয়। সাধারণত অগভীর জলাশয়ে বা জোয়ার-ভাটার অঞ্চল বা জলাশয়ে পানি প্রবেশের মুখে ফাঁদ পেতে মাছ বা চিংড়ির পরিভ্রমণ পথে বাঁধা সৃষ্টি করা হয়। ফাঁদ তৈরির মৌলিক দিক হিসেবে ফাঁদের মধ্যে চিংড়ি পানির গতির মাধ্যমে সহজেই ফাঁদের মুখ দিয়ে ফাঁদের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে বাধ্য হয়। কিন্তু চিংড়ি পুনরায় উক্ত প্রবেশ পথ দিয়ে বের হতে পারে না। উল্লেখ্য, ফাঁদের পশ্চাৎভাগ বন্ধ থাকে এবং চিংড়ি সংগ্রহের সময় ফাঁদের পিছন দিক খুলে বা নির্দিষ্ট পথে চিংড়ি সংগ্রহ করা হয়। ফাঁদের মাধ্যমে সাধারণত স্বল্প পরিমাণে বা পারিবারিক চাহিদা মিটানোর জন্য চিংড়ি আহরণ করা হয়। চিংড়ির প্রাপ্যতার ওপর ভিত্তি করে কখনো কখনো তা সংশ্লিষ্ট আহরণকারীর পেশা হিসেবেও গণ্য হয়।

বাংলাদেশে ব্যবহৃত অধিকাংশ ফাঁদই বাঁশের তৈরি। তবে অনেক দেশেই বর্তমানে প্লান্টিক নির্মিত সরু দন্ডের মাধ্যমে ফাঁদ নির্মাণ করা হয়। এলাকা বা অঞ্চলভেদে এবং চিংড়ির আহরণ উৎসের ধরন অনুসারে ফাঁদের আকৃতি ও প্রকৃতি বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। বাংলাদেশে চিংড়ি ধরার জন্য প্যারন, ডারকি, বেনকি, ইচা চাই, আহকা প্রভৃতি ফাঁদ হিসেবে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। নিচে চিংড়ি ও অন্যান্য ছোট আকৃতির মাছ আহরণের ফাঁদের বিবরণ দেয়া হলো:

ক. অ্যান্টা (Anta)

গঠন প্রকৃতি: আকৃতিতে আয়তাকার এবং সাধারণত উচ্চতা প্রস্থের কিছুটা বেশি। মুলত বাঁশ দিয়ে অ্যান্টা তৈরি করা হয়। ফাঁদের উচ্চতা অংশের একদিকে চিংড়ি ও অন্যান্য জলজ প্রাণী প্রবেশের জন্য এমনভাবে প্রবেশ পথ তৈরি করা হয়, যাতে অতি সহজেই পানির গতির মাধ্যমে চিংড়ি ফাঁদের মধ্যে প্রবেশ করতে পারে। কিন্তু সহজে বের হতে পারে না। প্রবেশ পথ লম্বায় প্রায় অ্যান্টার মোট দৈর্ঘ্যের সমান হয়ে থাকে। ফাঁদের একাংশে চিংড়ি আহরণের জন্য নির্দিষ্ট স্থান রাখা হয়। নির্দিষ্ট স্থান বন্ধ ও খোলার জন্য সহজ ব্যবস্থা রাখা হয়।

ব্যবহার পদ্ধতি: সাধারণত এ ধরনের ফাঁদের মাধ্যমে ছোট মাছ ও চিংড়ি ধরা হয়। গতিশীল পানিতে চিংড়ি ধরার জন্য এ ধরনের ফাঁদ জলাশয়ে পানি প্রবেশের মুখে বা মোহনাঞ্চলের নদী-নালা বা মুক্ত জলাশয়ে পানির গতির বিপরীত দিকে মুখ করে প্রতিস্থাপন করা হয়। নির্দিষ্ট সময় পরে ফাঁদ পানির উপরে তুলে চিংড়ি আহরণ করা হয়। মুক্ত জলাশয়ে ফাঁদ ব্যবহারের ক্ষেত্রে বাঁশের খুঁটির মাধ্যমে নির্দিষ্ট গভীরতায় স্থাপন করা হয়। কোথাও কোথাও চিংড়ির গতি নির্দিষ্ট পথে পরিচালনার জন্য ফাঁদের দু'পাশে ১২০ ডিগ্রি কোণ করে বানার ব্যবস্থা করা হয়। এ ক্ষেত্রে একই সাথে অনেকগুলো ফাঁদ বিভিন্ন গভীরতায় স্থাপন করা হয়।

বিস্তৃতি: বাংলাদেশের প্রায় সকল জেলায় এ ধরনের ফাঁদ ব্যবহারের প্রচলন রয়েছে। এছাড়া ভারত, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড, শ্রীলংকা প্রভৃতি দেশে এ ধরনের ফাঁদের প্রচলন রয়েছে।

 

খ. বেনকি (Benki)

গঠন প্রকৃতি: আকৃতিতে আয়তকার, নিচের অংশ বেশ চ্যাপ্টা, তবে উপরের অংশ সরু হয়ে থাকে। অগ্রবর্তী ও পশ্চাৎবর্তী অংশ কিছুটা লম্বা এবং চিংড়ি প্রবেশের জন্য এক বা একাধিক প্রবেশ পথ থাকে। ফাঁদের উপরের অংশ কিছুটা লম্বা এবং চিংড়ি প্রবেশের অংশে চিংড়ি আহরণ পথ এমনভাবে তৈরি করা হয়, যাতে পথের ঢাকনা সহজেই খোলা এবং বন্ধ করা যায়।

ব্যবহার পদ্ধতি: বেনকি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সহজপ্রাপ্য বাঁশের ফালি দিয়ে বিভিন্ন আকারের তৈরি করা হয়। ফাঁদ ব্যবহারের ক্ষেত্রে জলাশয়ের ধরন ও প্রকৃতি অ্যান্টা ফাঁদের অনুরুপ। তবে এ ধরনের ফাঁদ এককভাবে বা একাধিক ফাঁদ কৌণিকভাবে সংযোগ করে একত্রে মাছ আহরণের জন্য স্থাপন করা হয়। সাধারণত এ ফাঁদের মাধ্যমে চিংড়ি ও ছোট প্রজাতির মাছ ধরা হয়।

বিস্তৃতি: বাংলাদেশের প্রায় সকল জেলায় এ ধরনের ফাঁদ ব্যবহারের প্রচলন রয়েছে। বিভিন্ন অঞ্চলে বেনকি ফাঁদের বিভিন্ন নাম লক্ষ্য করা যায়, যেমন- বেঞ্চি (benchi), দেউর ( dheur), ধাইর (dhiar) ইত্যাদি।

 

গ. ডারকি (Darki)

গঠন প্রকৃতিঃ আকৃতিগত দিক থেকে এটি আয়তাকার হয়ে থাকে এবং এলাকাভেদে বিভিন্ন আকারের ডারকি প্রধানত বাঁশের চঞ্চুর সাহায্যে তৈরি করা হয়। ফাঁদের দরজা এর বক্ষ পাশের (উভয়দিকে) তলদেশে অবস্থিত। ফলে উভয়দিক থেকেই অর্থাৎ পানির গতিপথ পরিবর্তীত হলেও এ ফাঁদ লম্বালম্বিভাবে তলদেশ থেকে উপরিভাগ পর্যন্ত বিস্তৃত থাকে। পার্শ্বভাগে মাছ আহরণের দরজা বিদ্যমান।

ব্যবহার পদ্ধিতি: হাওর-বাঁওড়, নদী-নালা, খাল-বিল প্রভৃতি জলাশয়ে পানি প্রবেশ ও বের হওয়ার পথে এই ফাঁদ পেতে চিংড়ি সংগ্রহ করা হয়। প্রবাহমান পানিতে চিংড়ি ও অন্যান্য মাছ ধরার ক্ষেত্রে এ ফাঁদের ব্যাপক প্রচলন দেখা যায়।

বিস্তৃতি: বাংলাদেশের সকল জেলায় এ ধরনের ফাঁদ ব্যবহৃত হয়ে থাকে। তবে বরিশাল, খুলনা, ফরিদপুর, ময়মনসিংহ, গোপালগঞ্জ প্রভৃতি জেলাসমূহে এ ফাঁদের প্রচলন বেশি দেখা যায়।

 

ঘ. দোয়ার (Doir).

গঠন প্রকৃতি: দেখতে অনেকটা আয়তাকার, তলদেশ প্রশস্ত ও শীর্ষদেশ সরু এবং পাশের দুই প্রাপ্ত একই রেখা বরাবরে অবস্থান করে। এ ধরনের ফাঁদে দু'টি ফাঁদ দরজা থাকে। ফাঁদ দরজা দু'টি একই পাশে বা উভয় পাশে হতে পারে। ফাঁদ দরজা ফাঁদের তলদেশ থেকে শীর্ষদেশ পর্যন্ত বিস্তৃত। ফাঁদের উপরিভাগে মাছ আহরণের একটি ছিদ্র থাকে, যা অতি সহজেই খোলা ও বন্ধ করা যায়।

ব্যবহার পদ্ধতি: সাধারণত প্রবাহমান পানি এবং প্লাবনভূমি থেকে চিংড়ি আহরণের ক্ষেত্রে দোয়ার ব্যবহৃত হয়ে থাকে। ফাঁদ নালা বা জলাশয়ে পানি উঠা-নামার স্থানে প্রতিস্থাপন করা হয়। ফাঁদের সম্মুখভাগের দিকে গাছের ডাল-পালা বা বানা দিয়ে এমনভাবে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করা হয়, যাতে মাছ ও চিংড়ি প্রবাহমান পানির গভির মাধ্যমে ফাঁদে প্রবেশ করতে বাধ্য হয়। গ্রাম্যঞ্চলে বানার পরিবর্তে খেজুর গাছের শাখা-প্রশাখাও ব্যবহার করা হয়।

বিস্তৃতি: বাংলাদেশের প্রায় সব অঞ্চলে এ ধরনের ফাঁদের সাহায্যে প্লাবনভূমির মাছ ও চিংড়ি আহরণ করা হয়।

 

ঙ. ইচা- চাই (Icha Chai )

গঠন প্রকৃতি; ইচা চাই অনেকটা ড্রাম আকৃতির এবং স্থানীয়ভাবে এটি বাঁশের চক্ষু দিয়ে তৈরি করা হয়। পশ্চাৎভাগ অগ্রভাগের চেয়ে কিছুটা সরু। এ ফাঁদে পর পর দু'টি ফাঁদ দরজা থাকে। ফাঁদের পশ্চাৎ দিকে মাছ আহরণের দরজা থাকে। 

চিত্ৰ ৪.৩ ইচা- চাই

ব্যবহার পদ্ধতি: সাধারণত প্রবাহমান পানি ও প্লাবনভূমি থেকে চিংড়ি আহরণ করার ক্ষেত্রে এটি ব্যবহার করা হয়। নালা ও জলাশয়ের পানি উঠানামার স্থানে এ ধরনের ফাঁদ ব্যবহার হয়। ফাঁদের সম্মুখভাগের দিকে গাছের ডালপালা বা বানা দিয়ে এমনভাবে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করা হয় যাতে চিংড়ি ও অন্যান্য প্রাণী প্রবাহমান পানির পতির মাধ্যমে ফাঁদে প্রবেশ করতে বাধ্য হয়।

বিস্তৃপ্তি: বাংলাদেশের সকল জেলায় এ ফাঁদের ব্যবহার দেখা যায়। তবে দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে এ চাইয়ের প্রচলন বেশি। সাধারণত এ চাইয়ের মাধ্যমে ইচা ও অন্যান্য ছোট মাছ ধরা হয়।

 

চ. আকা (Ahuka)

স্থানীয় নাম: বরিশাল, পটুয়াখালী, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, বগুড়া, পাবনা, ঢাকা, ফরিদপুর, যশোর এবং কুষ্টিয়া, অঞ্চলে হোনচা (honcha), ময়মনসিংহ অঞ্চলে উচা (ucha), নোয়াখালী এবং রংপুর অঞ্চলে ঝাওই (jhari) নামে পরিচিত।

গঠন প্রকৃতি: আকৃতিগত দিক থেকে ত্রিকোণাকৃতির এবং বাঁশের মাদুরের মাধ্যমে তৈরি করা হয়। এটি সাধারণত লম্বায় ১.২ থেকে ৩.০ মিটার এবং গ্রন্থে ০.৮ থেকে ১.২ মিটার হয়ে থাকে। মূল ফাঁদের পশ্চাৎভাগ বন্ধ থাকে। ফাঁদ হাতের মাধ্যমে পরিচালনার জন্য এক খন্ড বাঁশ মূল ফাঁদের সম্মুখভাগের মধ্যবর্তী অংশে এবং পশ্চাৎভাগের সাথে সংযুক্ত থাকে। বাঁশ খণ্ডের পিছনের অংশ ফাঁদের হাতল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ফাঁদের হাতা ফাঁদের মোট দৈর্ঘ্যের প্রায় অর্ধেকের সমান।

ব্যবহার পদ্ধতি: স্বল্প গভীর জলাশয়ে চিংড়ি ধরার ক্ষেত্রে এ ধরনের ফাঁদ ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এ ফাঁদের মাধ্যমে চিংড়ি ধরার ক্ষেত্রে প্রধানত হাতের মাধ্যমে ফাঁদ পরিচালনা করা হয়। ফাঁদের অগ্রভাগ মাটির সাথে বা পানির তলদেশে পানির কাছাকাছি স্থাপন করে দ্রুত গতিতে সম্মুখের দিকে টানা হয় এবং কিছু সময় পর পর ফাঁদের মাথা পানির উপরিভাগে তুলে ফাঁদে চিংড়ি বা মাছ পড়েছে কি-না তা পরীক্ষা করে দেখা হয়। সাধারণত ছোট আকৃতির চিংড়ি ধরার জন্য এ ধরনের ফাঁদ ব্যবহার করা হয়। পারিবারিক পর্যায়ে চিংড়ি বা মাছ আহরণের ক্ষেত্রে এ ধরনের ফাঁদ ছোট-বড় সকলেই ব্যবহার করতে সক্ষম।

বিস্তৃত: বরিশাল, পটুয়াখালী, বগুড়া, চট্টগ্রাম, ঢাকা, ফরিদপুর, যশোর, কুষ্টিয়া, রাজশাহী, পাবনা, ময়মনসিংহ, নোয়াখালী এবং রংপুর অঞ্চলে এটি পাওয়া যায় ।

Content added By

চিংড়ি আহরণের জন্য বিভিন্ন ধরনের জাল ব্যবহার করা হয়ে থাকে। বাংলাদেশে চিংড়ি ও মাছ ধরার জন্য সাধারণত যে সমস্ত জাল ব্যবহৃত হয়ে থাকে তার বিবরণ নিয়ে দেয়া হলো:

ক. বেহুন্দি জাল

স্থানীয় নাম: বেহুন্দি জাল, বিউটি জাল, খোর জাল ইত্যাদি ।
ব্যবহারিক উপযোগিতা ও স্থান: খুলনা, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী এবং বরিশাল অঞ্চলের উপকূলবর্তী এলাকায় এর সর্বাধিক ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। মূলত এ জালের সাহায্যে জুন থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত চিংড়ি ও চিংড়ির পোনা ধরা হয়।

জাল তৈরির উপকরণ: সাধারণত নাইলন সুতা দ্বারা বেহুন্দি জাল তৈরি করা হয়।

জালের ধরন ও প্রকৃতি: আকৃতিগত দিক থেকে এ ধরনের জাল মোচাকৃতি বা নলাকৃতির। লম্বায় বা দৈর্ঘ্যে ১৫ থেকে ৬০ মিটার এবং প্রস্থে ১০ থেকে ৪৫ মিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে। এ জালের ফাঁসের আকার ১.২৫ থেকে ২.৫ সেমি. হয়ে থাকে। অন্যান্য থলে জালের মতো এ জালের মুখের অগ্রভাগে পাখনা বা ডানা বিদ্যমান এবং ডানার দৈর্ঘ্য ৯ মিটার হয়ে থাকে। জালের থলের দৈর্ঘ্য ২০ মিটারের অধিক এবং জালের মুখের দিকের ফাঁসের আকৃতি ৪ সেমি. পর্যন্ত হয়ে থাকে। মাছ ও চিংড়ি আহরণের কৌশল হিসেবে এ ধরনের জাল উপকূলবর্তী অঞ্চলের জোয়ার-ভাটা প্রভাবিত নদ- নদীসমূহে স্রোতের বিপরীতে নৌকার মাধ্যমে স্থাপন করা হয়। একটি বড় ধরনের জাল প্রতিস্থাপনে ২০ থেকে ৩০ জন জেলের প্রয়োজন হয়। অগভীর অঞ্চলে জাল প্রতিস্থাপনের জন্য দু'টি বাঁশ বা কাঠের খুঁটি ব্যবহার করা হয়। জালের ডানা প্রতিস্থাপনের জন্য দৃঢ় কাঠের ফ্রেমের প্রয়োজন হয়। অপেক্ষাকৃত গভীর পানিতে এ ধরনের জাল প্রতিস্থাপনের জন্য নোঙর ব্যবহার করা হয়। জালের মুখ খোলা রাখার জন্য বাঁশের পুল বা খুঁটি ব্যবহার করা হয়।

আহরণকৃত চিংড়ি প্রজাতি: হন্নি চিংড়ি, রোয়াই চিংড়ি, ছটকা চিংড়ি, ঢাকা চিংড়ি, বাগদা চিংড়ি ইত্যাদি। ৩০ জন জেলের প্রয়োজন হয়। অগভীর অঞ্চলে জাল প্রতিস্থাপনের জন্য দু'টি বাঁশ বা কাঠের খুঁটি ব্যবহার করা হয়। জালের ডানা প্রতিস্থাপনের জন্য দৃঢ় কাঠের ফ্রেমের প্রয়োজন হয়। অপেক্ষাকৃত গভীর পানিতে এ ধরনের জাল প্রতিস্থাপনের জন্য নোঙর ব্যবহার করা হয়। জালের মুখ খোলা রাখার জন্য বাঁশের পুল বা খুঁটি ব্যবহার করা হয়।

আহরণকৃত চিংড়ি প্রজাতি: হন্নি চিংড়ি, রোয়াই চিংড়ি, ছটকা চিংড়ি, ঢাকা চিংড়ি, বাগদা চিংড়ি ইত্যাদি।

চিত্র-৪.৫: বেহুন্দি জাল (behundi jal)

খ. বেহতি জাল

স্থানীয় নাম: বিউটি জাল।

ব্যবহারিক উপযোগিতা ও স্থান: বরিশাল, পটুয়াখালী, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী ও খুলনা অঞ্চলের উপকূলবর্তী এলাকায় এ ধরনের জালের মাধ্যমে চিংড়ি ও অন্যান্য মাছ আহরণ করা হয়। জুন থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত এ জালের প্রচলন অধিক পরিমাণে দেখা যায়।

জাল তৈরির উপকরণ: সুতা বা নাইলন তন্তু দিয়ে এ ধরনের জাল তৈরি করা হয়।

জালের ধরন ও প্রকৃতি: আকৃতিগত দিক থেকে এটি নলাকৃতি বা মোচাকৃতির। এ জালের মুখের দু'পাশে মুখের ব্যাসের সমান প্রস্থ বিশিষ্ট পাখনা বা ডানা বিদ্যমান। ডানার দৈর্ঘ্য উভয়দিকে ৪ থেকে ৬ মিটার পর্যন্ত হতে পারে। এ ধরনের জালের দৈর্ঘ্য ১২ থেকে ১৫ মিটার এবং প্রস্থ ১০ থেকে ১২ মিটার পর্যন্ত হতে পারে। এ জালের ফাঁসের আকার সম্মুখভাগে প্রায় ১.২৫ সেমি.। জাল পরিচালনা ও প্রতিস্থাপনের জন্য ৩ থেকে ৪ জন আহরণকারী প্রয়োজন হয় এবং বাঁশের খুঁটি ও কাঠের ফ্রেমের মাধ্যমে স্রোতের বিপরীতে প্রতিস্থাপন করা হয়।

গ. টার জাল

ব্যবহারিক উপযোগিতা ও স্থান: সাধারণত মে থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত এ জালের সাহায্যে চিংড়ি ধরা হয়। চট্টগ্রাম, খুলনা, পটুয়াখালী ও বরিশাল অঞ্চলের উপকুলবর্তী এলাকায় এ ধরনের জাল দিয়ে চিংড়ি পোনা ধরা হয়।

জালের ধরন ও প্রকৃতি: আকৃতিগত দিক দিয়ে এ জাল আয়তাকার এবং নৌকার সাহায্যে পরিচালনা করা হয়। জালের লম্বা দিক বাঁশের খুঁটির সাহায্যে দৃঢ় করা হয় এবং জালের খর্বাকার দিক নৌকার সম্মুখভাগের সাথে সংযুক্ত থাকে। আয়তনগত দিক থেকে এ জালের দৈর্ঘ্য ৪.৫ থেকে ৫.৫ মিটার, প্রস্থ ৩.৫ থেকে ৪.৫ মিটার এবং জালের ফাঁসের আকার ০.৬ থেকে ১.২৫ সেমি হয়ে থাকে। চট্টগ্রাম ও খুলনা অঞ্চলে মশারির নেট দিয়ে এ জাল তৈরি করা হয়।

জাল পরিচালনা পদ্ধতি: চিংড়ি ও অন্যান্য ছোট মাছ ধরার সময় জালের খুঁটি হাতের সাহায্যে জালের অগ্রভাগ পানির নিচে পেতে রাখা হয় এবং কিছু সময় পর পর মাছের উপস্থিতির ওপর নির্ভর করে পানির উপরিভাগে তোলা হয় এবং মাছ আহরণ করা হয়। প্রকৃতিগতভাবে এ ধরনের জাল ছাঁকি জালের (dip net) অন্তর্ভুক্ত।

ঘ. চইন জাল

ব্যবহারিক উপযোগিতা ও স্থান: বরিশাল, পটুয়াখালী ও আন্যান্য উপকূলবর্তী অঞ্চলে এ ধরনের জাল দিয়ে অগভীর জলাশয়ের মাছ ও চিংড়ি এবং চিংড়ি পোনা ধরা হয়।

জালের ধরন ও প্রকৃতি: আকৃতিগত দিক থেকে এ ধরনের জাল ইংরেজি অক্ষর V এর অনুরূপ। সাধারণত তিনটি বাঁশের খুটি সংযুক্ত করে এ জালের অবকাঠামো বা ফ্রেম তৈরি করা হয় এবং অবকাঠামোর সাথে ঘন ফাঁসের মশারী নেট বা নাইলনের সুতা দিয়ে জাল তৈরি করা হয়। আকৃতিগত দিক থেকে জালের মুখ ফ্রেমের আয়তন অনুসারে ত্রিকোণাকার হয়ে থাকে। জালের দৈর্ঘ্য সাধারণত ১.০ থেকে ১.৫ মিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে।

জাল ব্যবহার পদ্ধতি: এ জাল সাধারণত জলজ ভাসমান উদ্ভিদের নীচে স্থাপন করে হঠাৎ করে উপরের দিকে তুলে জালের মধ্য থেকে জলজ উদ্ভিদসমূহ সরিয়ে ফেলে মাছ আহরণ করা হয়। চিংড়ির পোনা আহরণের জন্য খুলনা অঞ্চলে জালের আকৃতি ডিম্বাকার বা চামুচাকৃতি হয়ে থাকে।

 

ঙ. আটনা জাল

ব্যবহারিক উপযোগিতা ও স্থান: উপকূলবর্তী অঞ্চলে বিশেষ করে চট্টগাম অঞ্চলে এ ধরনের জালের প্রচলন অধিক দেখা যায়। সাধারণত এ জালের সাহায্যে ছোট আকৃতির মাছ ও চিংড়ি ধরা হয়।

চ. চরপাতা জাল 

ব্যবহারিক উপযোগিতা ও স্থান: খুলনা, বরিশাল ও পটুয়াখালী অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে এ জালের প্রচলন বেশি দেখা যায়। সাধারণত জোয়ার-ভাটা বাহিত অগভীর নদীসমূহে পানির গতিপথে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে এ জালের সাহায্যে মাছ ধরা হয়।

জালের ধরন ও প্রকৃতি: এ ধরনের জাল দৈর্ঘ্যে ৬ থেকে ১২ মিটার এবং প্রস্থে ৩ থেকে ৪ মিটার হয়ে থাকে। জালের ফাঁসের আকার ১.২৫ থেকে ২.৫০ সেমি হয়ে থাকে। জালের উপরিভাগে ও পার্শ্বদেশে শক্ত দড়ি লাগানো থাকে, যাতে পানির অধিক গতিবেগের কারণে জাল ছিড়ে না যায়। ভাটার সময় এ জালের নিম্নপ্রান্ত জলাশয়ের তলদেশে খুঁটির সাহায্যে স্থাপন করা হয় এবং উপরের অংশ প্রান্তভূমির উপর ফেলে রাখা হয়। জোয়ারের সময় জালের উপরের প্রান্ত তুলে খুঁটির উপরের প্রান্তের সাথে বাঁধা হয়। পানি কমিয়ে হাতের সাহায্যে জালের মধ্য থেকে মাছ/ চিংড়ি সংগ্রহ করা হয়।

 

Content added By

চিংড়ির আহরণ পরবর্তী ব্যবস্থাপনা

চিংড়ি অত্যন্ত পচনশীল জীব। সাধারণত চিংড়ি ধরার ৩ থেকে ৫ ঘন্টার মধ্যেই চিংড়ির পচনক্রিয়া শুরু হয়। সেজন্য আহরণকৃত চিংড়ি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাজারজাত করা উচিত। তবে চিংড়ি ধরার পরে বাজারজাতকরণের পূর্ব মুহুর্ত পর্যন্ত চিংড়ির গুণগতমান বজায় রাখার জন্য নিম্নে উল্লিখিত পদক্ষেপসমূহ ধারাবাহিকভাবে অনুসরণ করা যেতে পারে-

  • আহরণকৃত চিংড়ির সাময়িক সংরক্ষণ স্থানের ঘরের মেঝে অবশ্যই পাকা হওয়া উচিত।
  • সংরক্ষণ স্থানে পানি সরবরাহের ব্যবস্থা রাখতে হয়। 
  • চিংড়ি বাজারজাত করতে বা বিক্রয় স্থানে পৌঁছাতে ২ থেকে ৩ ঘন্টা দেরি হলে পূর্ব থেকেই বরফের ব্যবস্থা করে রাখতে হয়।
  • চিংড়ি পরিবহণের জন্য ঝুঁড়ি, পাতা, দড়ি ও চটের ব্যবস্থা করতে হয়।
  • ধৃত চিংড়ি পরিষ্কার পানিতে ধুয়ে ছায়াযুক্ত স্থানে রাখতে হয়।
  • ছোট-বড় অনুযায়ী চিংড়ি গ্রেডে আলাদা করতে হয়।
  •  চিংড়ির মাথায় মুলত ব্যাক্টেরিয়া অবস্থান করে। কোনো কারণে চিংড়ি দুর্বল হয়ে পড়লে বা মারা গেলে ব্যাক্টেরিয়াজনিত পচনক্রিয়া শুরু হয় এবং ধৃত চিংড়ির পচন ধরে। এ কারণেই যথাশীঘ্র
    চিংড়ির মাথা আলাদা করতে হয়। 
  • পরিষ্কার ঠান্ডা (৬.০ থেকে ৮.০ ডিগ্রি সে.) পানিতে ৫ থেকে ১০ মিনিট চিংড়ি ভিজিয়ে রাখলে চিংড়ির গুণগতমান ভাল থাকে। এ প্রক্রিয়াকে চিলিং বলা হয়।
  • চিলিং করার পর পরিবহণ করার পূর্বে পরিবহণ পাত্র ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র পরিষ্কার পানিতে ধুয়ে নিতে হয়। 
  • চিংড়ি বরফজাত করার পূর্বে পাত্রের তলায় ও পাশে নরম কলার পাতা কিংবা ভেজা চট বিছিয়ে দিতে হয়, যাতে করে চিংড়ির গায়ে চাপ না লাগতে পারে।
  • পাত্রে চিংড়ি ভরার সময় পাত্রের তলায় প্রথমে বরফ এবং পরে চিংড়ি পর্যায়ক্রমিকভাবে সাজাতে হবে। এ ক্ষেত্রে চিংড়ি ও বরফের অনুপাত ২:১ হওয়া উচিত।
  •  পাত্রের মুখ ভেজা চট দিয়ে ভালভাবে বেঁধে দিতে হয়।
  • অতঃপর স্থানীয় বাজারে বা চিংড়ি প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানায় পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অল্প সময়ের মধ্যে পাঠাতে হবে।
Content added By

চিংড়ি সংরক্ষণ পদ্ধতি

সাধারণ অর্থে বেশি সময়ের জন্য চিংড়ি সংরক্ষণকে প্রক্রিয়াজাতকরণ বলা হয়। এ পদ্ধতিতে গুণগত ও অবস্থানগত গঠনের কোনো পরিবর্তন হয় না। ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে প্রক্রিয়াজাত করা গুণগত মানসমৃদ্ধ চিংড়ি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করা হয়। চিংড়ি প্রক্রিয়াজাতকরণের বিভিন্ন পদ্ধতি নিম্নে বর্ণনা করা হলো-

ক. ভাজা বা অবিকৃত অবস্থায় সংরক্ষণ

চিংড়ির মৃত্যুর পর প্রধানত দু'টি কারণে চিংড়ি নষ্ট হয়ে থাকে, যেমন- রাসায়নিক বিক্রিয়ার কারণে নষ্ট হওয়া ও ব্যাক্টেরিয়া বা জীবাণুর আক্রমণে নষ্ট হওয়া। রাসায়নিক দৃষ্টিকোণ থেকে চিংড়ির মৃত্যুর পর দেহের কোষ থেকে অ্যামাইনো এসিড নিঃসৃত হয়। ফলে চিংড়ির খাদ্যগুণ ও স্বাদ বিনষ্ট হয় এবং ওজন হ্রাস পায়। অপরদিকে ব্যাক্টেরিয়া বা জীবাণুর আক্রমণে চিংড়ির মাংসল অংশে এনজাইমের জলায়ন (hydrolysis ) ক্রিয়ার সাহায্যে নানা ধরনের ফ্যাটি এসিড নিঃসৃত হয়, যা স্বজারণ পদ্ধতিতে (auto oxidation) কার্বনিল যৌগ উৎপন্ন করে, ফলে মাংসল অংশের পচনক্রিয়া শুরু হয় ও দুর্গন্ধযুক্ত হয়। এ কারণেই চিংড়ি ধরার ৫ থেকে ৬ ঘন্টার মধ্যে চিংড়ির প্রক্রিয়াজাতকরণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা উচিত।

রফের সাহায্যে দীর্ঘ মেয়াদে চিংড়ি সংরক্ষণের ক্ষেত্রে চিংড়ি ও বরফের অনুপাত ১:১ (ওজনে) হওয়া বাঞ্ছনীয়। প্রক্রিয়াজাতকরণের কাজে বরফ ব্যবহারের ক্ষেত্রে বরফের টুকরো অত্যন্ত ছোট বা পাতলা আবরণের মত হওয়া উচিত। অনেক সময় ব্যাক্টেরিয়াযুক্ত অপরিশোধিত পানি দিয়ে তৈরি বরফ ব্যবহার বা ব্যাক্টেরিয়াযুক্ত পাত্র ব্যবহারে চিংড়ির মান নষ্ট হতে পারে। এ ক্ষেত্রে চিংড়ি প্রক্রিয়াজাতকরণে ক্লোরিন মিশ্রিত পরিশোধিত পানির সাহায্যে তৈরি বরফ ব্যবহার করা উচিত এবং চিংড়ি সংরক্ষণে ও পরিবহণে ব্যবহৃত সকল প্রকার প্রয়োজনীয় উপকরণসমূহ ক্লোরিন মিশ্রিত পানি (৫ থেকে ১০ পিপিএম) দিয়ে ধোয়া উচিত। এ প্রক্রিয়ায় সংরক্ষিত চিংড়ির ব্যাক্টেরিয়া দ্বারা আক্রমণের সম্ভাবনা কম থাকে। চিংড়ি দীর্ঘকালীন সময়ের জন্য সংরক্ষণে সমুদ্রের পরিষ্কার লোনা পানি ০ থেকে ১ ডিগ্রি সে. তাপমাত্রায় ব্যবহার করে ভাল ফল পাওয়া যায়। অনেক সময় গ্লুকোজ সিরাপ বা কর্ন সিরাপ প্রয়োগ করে তাপমাত্রা আরো কমানো হয়। এ ধরনের সংরক্ষণ পদ্ধতিতে চিংড়ির আকার অপরিবর্তিত থাকে এবং খরচও অপেক্ষাকৃত কম হয়।

বর্তমান বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জেট ফ্রিজিং পদ্ধতিতে চিংড়ি সংরক্ষণ করা হয়। এ পদ্ধতিতে ক্রায়োজেনিক নাইট্রোজেন (cryogenic nitrogen) মাইনাস ৩২ ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপমাত্রায় মাল্টিজুম (multi- (zoom) ফ্রিজারের মাধ্যমে প্রতি মিনিটে সাত হাজার ফুট হারে সঞ্চালিত করা হয়। ফলে ঠান্ডা জমানো হাওয়া এক মিনিটেরও কম সময়ের মধ্যে চিংড়ি কোষের মধ্যে সঞ্চালিত হয় এবং অতি দ্রুত চিংড়ি সংরক্ষিত হয়।

খ. সিদ্ধ করা

এ পদ্ধতিতে প্রতি পাউন্ডে ১০০ টির অধিক সংখ্যক চিংড়ি লবণ জলে সিদ্ধ করা হয় এবং পরে ফ্রিজে সংরক্ষণ করা হয়। এ প্রক্রিয়ায় এক সাথে বেশ কিছু পরিমাণ চিংড়ি বড় তারের ঝুড়িতে রেখে সেগুলো ফুটন্ত ব্রাইন বা লোনা জলে ১ থেকে ২ মিনিট সিদ্ধ করা হয় এবং পরে তারের পাত্রটি তুলে কোন বড় তারের জালের উপর ভালভাবে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। ফলে অতি দ্রুত সেগুলো ঠান্ডা হয়। এ প্রক্রিয়াকে ব্লাঞ্চিং (blanching) বলা হয়। ব্লাঞ্চিংকৃত চিংড়িগুলো অল্প সময়ের জন্য ২০ ডিগ্রি সে. তাপমাত্রায় ঠান্ডা জলে ডুবানো হয়। এ প্রক্রিয়াকে গ্লেজিং (glazing) বলা হয়।

গ. কৌটাজাতকরণ

মৎস্যসম্পদ সংরক্ষণে কৌটাজাতকরণ একটি প্রচলিত ও প্রাচীন প্রথা। এ প্রক্রিয়ায় ঠান্ডা করা চিংড়ি ব্রাইন বা লবণাক্ত পানি সহযোগে বায়ু নিরোধক পাত্র বা ক্যানে আবদ্ধ করে রপ্তানি করা হয়। ক্যান বা আবদ্ধ পাত্রে চিংড়ির গুণগতমান অবিকৃত রাখার উদ্দেশ্যে লবণপানিতে সাইট্রিক এসিড (০.২%) মিশানো হয়। এ সময়ে দ্রবণের পিএইচ (pH) এর মান ৬.৪ হয়ে থাকে। ক্যানগুলো পরবর্তী ধাপে প্রতি বর্গ সেন্টিমিটারে ০.৭ কিলোগ্রাম ব্যাসযোগে ও ১১৫.৩ ডিগ্রি সে. তাপমাত্রায় ১৮-২০ মিনিট প্রক্রিয়াকরণ করা হয়। কৌটাজাতকরণের ক্ষেত্রে লোহা বা তামার তৈরি ক্যান পরিহার করা উচিত। আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখার উদ্দেশ্যে কৌটাজাতকরণ প্রক্রিয়ায় বা লবণাক্ত পানিতে প্রতি কিলোগ্রাম চিংড়ির জন্য ২৫০ মিলিগ্রাম ডাইসোডিয়াম যৌগ ব্যবহার করা হয়। এ প্রক্রিয়ায় প্রক্রিয়াজাতকৃত চিংড়ি বা মাছ বিভিন্ন অবস্থায় রপ্তানি করা হয়, যেমন- মস্তকবিহীন, সম্পূর্ণ খোসা ছড়ানো, লেজ ছাড়া বাকী অংশের খোলস ছড়ানো, প্রভৃতি। মস্তকবিহীন চিংড়ি গ্রেড অনুসারে প্যাকিং করা হয়।

গ্রেড: গ্রেড হলো প্রতি পাউন্ড চিংড়িতে কত সংখ্যক চিংড়ি বিদ্যামান। যেমন- গ্রেভ ইউ-৫ এর অর্থ হলো প্রতি পাউন্ডে ৫টি বা তার কম সংখ্যক চিংড়ি বিদ্যমান। রপ্তানির ক্ষেত্রে চিংড়ির প্রচলিত গ্রেডগুলো হলো ইউ-১০, ইউ-১১ থেকে ইউ-১৫, ইউ-১৬ থেকে ইউ-২০, ইউ-২১ থেকে ইউ-২৫, ইত্যাদি

 

Content added By

চিংড়ি প্রক্রিয়াজাতকরণ পদ্ধতি

সাধারণ অর্থে প্রক্রিয়াজাতকরণ বলতে বৈজ্ঞানিক উপায়ে চিংড়িকে দীর্ঘসময় গুণগত মানসম্পন্ন অবস্থায় সংরক্ষণ প্রক্রিয়াকে বোঝানো হয়। চিংড়ি সুষ্ঠু বিপণনের ক্ষেত্রে চিংড়ি প্রক্রিয়াজাতকরণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মূলত চিংড়ি প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে চিংড়ি নষ্ট বা পচে যাওয়ার উৎপাদকসমূহ বিশেষ করে জ্যামাইনো অ্যাসিডের ক্রিয়া, ব্যাক্টেরিয়া ও অন্যান্য ক্ষতিকর জীবাণুর আক্রমণ রোধ করা হয় এবং চিংড়ি সম্পদকে অবিকৃত অবস্থায় বিপণনের জন্য দীর্ঘ সময়ের জন্য সংরক্ষণ করা হয়। ব্যবসায়িকভাবে প্রক্রিয়াজাতকৃত চিংড়ি বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করা হয় এবং দূরত্ব নির্বিশেষে অভ্যন্তরীণ চাহিদা পুরণের জন্য বাজারজাত করা হয়ে থাকে। চিংড়ি প্রক্রিয়াজাতকরণের ক্ষেত্রে প্রধানত ৪টি ধাপ অনুসরণ করা হয়। উদ্দেশ্যগত দিক থেকে এ চারটি ধাপ অনুসরণের মাধ্যমে চিংড়ি জীবাণুমুক্ত করে সংরক্ষণ করা হয়। চিংড়ি প্রক্রিয়াজাতকরণের ধাপসমূহ নিচে উল্লেখ করা হলো।

ক. আহরণোত্তর চিংড়ি প্রক্রিয়াজাতকরণের উপযোগীকরণ 

চিংড়ি প্রক্রিয়াজাতকরণের প্রথম ধাপ হলো তাজা বা টাটকা চিংড়ি সংগ্রহ করে মাথা ছাড়ানো। সাধারণত প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানায় চিংড়ি নিয়ে আসার পূর্বেই ফড়িয়া বা বেপারি বা আড়তদারগণ চিংড়ির মাথা ছাড়িয়ে ফেলে। সরাসরি খামার বা বাজার থেকে প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানায় আস্ত চিংড়ি আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে প্রক্রিয়াজাত কারখানায়ও চিংড়ির মাথা ছাড়ানো হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে চিংড়ি পরিবহণ ও সাময়িক সংরক্ষণের ক্ষেত্রে বরফ সমৃদ্ধ গাড়ী বা পরিবহণ ব্যবহার করা হয়ে থাকে।

মাথা ছাড়ানোর উদ্দেশ্য হলো চিংড়ির মৃত্যুর পর মাথা সর্বপ্রথম ব্যাক্টেরিয়া দ্বারা আক্রান্ত হয়, কেননা চিংড়ির মাথা ও তার কলাসমূহ মাংসপেশীর চেয়ে অধিক নরম। ফলে মাথা দ্রুত ব্যাক্টেরিয়া দিয়ে আক্রান্ত হয়। এছাড়াও চিংড়ি দেহের গঠনগত কারণে পরিবেশ থেকেই মাথার খোলসের মধ্যে কোন না কোন ধরনের ব্যাক্টেরিয়া বিদ্যমান থাকে। সেগুলো চিংড়ির মৃত্যুর পর পরই অধিক সক্রিয় হয়ে উঠে এবং চিংড়ির পচনক্রিয়া শুরু হয়।

খ. জীবাণুমুক্ত করা ও পচন রোধ করা

বরফে সংরক্ষণ করা: মাথা ছাড়ানোর পর চিংড়ি লেজসহ বাঁশ, কাঠ বা প্লাস্টিকের তৈরি ক্রেটস বা বাক্সের মধ্যে বরফ দিয়ে সংরক্ষণ করা হয়। উদ্দেশ্যগত দিক থেকে এ প্রক্রিয়ায় চিংড়ি ব্যাক্টেরিয়া মুক্ত থাকে এবং পচনক্রিয়া সংগঠিত হতে পারে না। বরফ দিয়ে চিংড়ি সংরক্ষণের ক্ষেত্রে চিংড়ি ও বরফের অনুপাত ১:১ রাখা হয়। সাধারণত বাজার থেকে বা নির্দিষ্ট এলাকা থেকে চিংড়ি সংগ্রহকারীরা এভাবে চিংড়ি সাময়িক সংরক্ষণ করে ২-৩ দিন পর পর প্রক্রিয়াজাত কারখানায় সরবরাহ করে থাকে।

মাথা ছাড়ানো চিংড়ি পরিষ্কার পানিতে ধৌত করা: চিংড়ি প্রক্রিয়াজাত কারখানায় পৌঁছানোর পর মাথা ছাড়ানো বরফ সমৃদ্ধ চিংড়িকে ছিদ্রযুক্ত টেবিলের উপর রাখা হয় এবং পরিষ্কার পানি দিয়ে ধোয়া হয়। চিংড়ি ধোয়ার কাজে প্রধানত গভীর নলকুপের পানি ব্যবহার করা হয়। উল্লেখ্য চিংড়ির পরিষ্কার বা ধোয়ার কাজটি যাতে দ্রুত শেষ করা সম্ভব হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হয়।

চিংড়ি বাছাই ও ওজন করা: পরিষ্কার পানিতে চিংড়ি ধোয়ার পর গ্রেড অনুযায়ী চিংড়ি বাছাই ও ওজন করা হয়। চিংড়ি বাছাই-এর ক্ষেত্রে চিংড়ির গুণগতমান যথার্থ রয়েছে কী না তা পরীক্ষা করে নেয়া হয়। চিংড়ির গ্রেড নির্ধারণের পদ্ধতি নিচে উল্লেখ করা হলো-

ক্রম

মাথাবিহীন অবস্থায় প্রতি পাউন্ডে চিংড়ির সংখ্যা

১ থেকে ২০
২১ থেকে ৩০
৩১ থেকে ৫০
৫১ থেকে ৭০

উল্লেখ্য চিংড়ির গুণগতমান যথার্থ থাকা সত্ত্বেও যদি চিংড়ির খোলস ভেঙে যায় বা খোলসের রঙের পরিবর্তন হয়, তাহলে বাছাই করার সময় এ ধরনের চিংড়ি বাদ দেয়া হয়, যা পিএন্ডডি নামে অভিহিত।

ঠান্ডা ঘরে সংরক্ষণ: চিংড়ি প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানায় চিংড়ির গুণগতমান অক্ষুন্ন রাখার জন্য বাছাইকৃত চিংড়ি প্রক্রিয়াজাতকরণের পরবর্তী ধাপে যাওয়ার পূর্বে ০ (জিরো) ডিগ্রি সে. তাপমাত্রায় নিয়ন্ত্রিত ঘরে রাখা হয়। প্রক্রিয়াজাত কারখানায় এ ধরনের সাময়িক সংরক্ষণ ঘরকে চিল কক্ষ বলা হয়। চিংড়ি আহরণের উৎসের ওপর ভিত্তি করে এ ধরনের কক্ষে ৩টি প্রকোষ্ঠ থাকে-

১) স্বাদুপানির চিংড়ি সংরক্ষণ কক্ষ (গলদা চিংড়ি)

২) লোনাপানির চিংড়ি সংরক্ষণ কক্ষ (মূলত বাগদা চিংড়ি)

৩) লোনাপানির অন্যান্য চিংড়ি সংরক্ষণ কক্ষ

উল্লেখ্য, গলদা চিংড়ি সংরক্ষণের ক্ষেত্রে স্বাদুপানির বরফ এবং লোনাপানির চিংড়ি সংরক্ষণের জন্য লবণাক্ত পানির বরফ ব্যবহার করা হয়। কখনো চিংড়ি বাছাই ও ওজন নেওয়া দ্রুত সম্ভব না হলে এ ধরনের কক্ষে সংগৃহীত চিংড়ির সংরক্ষণ করা হয়।

ক্লোরিন মিশ্রিত পানিতে ধোয়া চিল রুমে সাময়িক সংরক্ষিত চিংড়ি পরবর্তীতে ক্লোরিন মিশ্রিত পানিতে (৫ থেকে ১০ পিপিএম) ধোয়া হয়। বর্তমানে অধিকাংশ চিংড়ি প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানায় চিংড়ি সংরক্ষণের জন্য সেন্ডো কীপ (sendo keep) পাউডার ব্যবহার করা হয়। ক্লোরিন মিশ্রিত পানির মাধ্যমে চিংড়িকে বিশুদ্ধ বা জীবাণুমুক্ত করা হয়ে থাকে।

বাছাইক্রত চিংড়ি পুনঃপরীক্ষা: চিংড়িকে ক্লোরিন মিশ্রিত পানিতে জীবাণুমুক্ত করার পর পুনরায় চিংড়িকে গ্রেড অনুসারে ওজন ও বাছাই করা হয়। এ সময় চিংড়ির উদরাংশের পাতলা পর্দা ও শ্লেষ্মা ভালভাবে পরিস্কার করা হয় এবং নির্দিষ্ট ওজন অনুসারে স্ত্রী ও পুরুষ আলাদাভাবে বরফ পানিতে ধোয়ার জন্য ছিদ্রযুক্ত টেবিলে রাখা হয়। বরফ পানিতে উত্তমরুপে ধোয়ার পর ড্রেসিং টেবিলে সাজানো হয়।

চিংড়ি ড্রেসিং ও হিমায়িতকরণ পদ্ধতি: চিংড়ি ড্রেসিং করার ক্ষেত্রে ৩০ সেমি. x ২০ সেমি. মাপের টিনের
ট্রেতে ৭০ সেমি. × ৭৫ সেমি. মাপের পলিথিন পেপার বিছানো হয়। অতঃপর বরফ ধোয়া চিংড়িগুলো লম্বালম্বিভাবে দু'টি সারিতে এমনভাবে সাজানো হয়, যাতে দু'টি সারির চিংড়ির লেজগুলো পরস্পর মুখোমুখি থাকে। পরবর্তী ধাপে ট্রে সমেত চিংড়িগুলো ৫ প্রকোষ্ট বা ৩ প্রকোষ্ঠ ট্রেতে রাখা হয় এবং পুনরায় বরফ মিশ্রিত পানি চিংড়ির উপর দেয়া হয়। ট্রেগুলো বরফের পানি দিয়ে পূর্ণ হলে পলিথিন পেপার ভাঁজ করে চিংড়ির প্যাকিং ব্লক তৈরি করা হয় এবং এয়ারব্লাস্ট ফ্রিজারের ধারণক্ষমতা অনুযায়ী সংরক্ষণ করা হয়। ফ্রিজারে সংরক্ষণের ক্ষেত্রে ৩ থেকে ৫ প্রকোষ্ঠ লম্বা ট্রে ব্যবহার করা হয়। এয়ারব্লাষ্ট ফ্রিজারে সাধারণত লম্বা ট্রের পরিবর্তে ছোট ট্রে ব্যবহার করা হয়। ফ্রিজারের চিংড়ি হিমায়িতকরণের ক্ষেত্রে তাপমাত্রা মাইনাস ৩৭ ডিগ্রি সে. থেকে মাইনাস ৪০ ডিগ্রি সে. এ রাখা হয়। এভাবে হিমায়িতকরণ প্রক্রিয়া ১২ থেকে ১৩ ঘন্টা চলমান থাকে।

গ. বাক্সে প্যাক করা

প্রক্রিয়াজাতকৃত চিংড়ি হিমায়িত করার পর বর্গাকৃতির চিংড়ির ব্লকগুলো দ্রুত পলিথিন ব্যাগে ভরে সিল করা হয় এবং পরবর্তী ধাপে পলিথিন ব্যাগগুলো মাস্টার কার্টুনে ঢোকানো হয়। মাস্টার কার্টুনে ২০ থেকে ৫০ কেজির অধিক চিংড়ির ব্লক করা হয় না এবং কার্টুনগুলো সিনথেটিক গজ দিয়ে প্যাক করা হয়। পরবর্তী ধাপে কার্টুনের উপর চিংড়ির নাম, ওজন, গ্রেড প্রভৃতি উল্লেখ করা হয়।

ঘ. হিমাগারে সংরক্ষণ করা

পরবর্তী ধাপে মাস্টার কার্টুনগুলো মাইনাস ২০ ডিগ্রি সে.-এর নিম্ন তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করা হয়। হিমাগারে এ অবস্থায় চিংড়ি বহুদিন সংরক্ষণ করা হয়। 

Content added By

বাগদা চিংড়ি প্যাকিং ও পরিবহণ

আদিকাল থেকেই মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য পরিবহণ করার জন্য বিভিন্ন ধরনের প্যাকিং ব্যবস্থা চালু রয়েছে। কাঠের বাক্স, চামড়া ও কাপড়ের ব্যাগ, মাটির পাত্র ও বান্ডিল তৈরির জন্য রশি ব্যবহার করা হয়। প্যাকিং করার উদ্দেশ্য হলো যথাযথ সংরক্ষণ, সুষ্ঠ পরিবহণ ও হ্যান্ডলিং-কে সহজতর করা ও সর্বোপরি পণ্যের সুরক্ষা নিশ্চিত করা। মৎস্য পণ্য পরিবহণ করার জন্য বর্তমানে ধাতুর তৈরি পাত্রের সাথে সাথে গ্লাস, কাগজ ও প্লাষ্টিক দ্বারা তৈরি পাত্র ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। প্যাকিং প্রযুক্তি উন্নয়নের জন্য নিম্নলিখিত বিষয়গুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ 

ক) প্যাকিং প্রযুক্তি এমন হবে যাতে চর্বির জারণ বন্ধ হয়

খ) হিমায়িত মৎস্য পণ্য পানিমুক্ত করা বন্ধ করবে যাতে ফ্রোজেন অবস্থায় গঠন ঠিক থাকে।

গ) ব্যাক্টেরিয়া জনিত ও রাসায়নিক পচন বন্ধ করবে। 

ঘ) চিংড়ি থেকে গন্ধ বের হওয়া বন্ধ করবে।

তাজা চিংড়ি প্যাকিং: তাজা চিংড়ি সাধারণত প্লাস্টিক বাক্স বা খাদযুক্ত বাক্সে প্যাকিং করা হয়। প্লাস্টিক বাক্স অধিক ব্যবহৃত হচ্ছে কারণ প্লাস্টিক বাক্স হালকা, শক্ত ও স্বাস্থ্যসম্মত। চিংড়ি বাক্স নির্বাচনের ক্ষেত্রে নিম্নলিখিত বিষয়াদি বিবেচনায় নেয়া উচিত-

ক) বাক্সের আকার এমন হবে যাতে নির্দিষ্ট পরিমাণ চিংড়ি রাখা যায়।

খ) চিংড়িতে পূর্ণ বাক্স যাতে খুব সহজেই পরিবহণ করা যায়।

গ) বাক্স ব্যবহারের পর সহজেই পরিষ্কার করা যায়। 

ঘ) চিংড়ি থেতলে যাওয়া, পচন, পরিবেশ দূষণ ও ছোটখাটো চুরি থেকে রক্ষা পাবে। 

ঙ) বাক্সের আকৃতি এমন হবে যাতে বাক্সের ভিতরের চিংড়ির পরিমাণ সহজেই নির্ণয় করা যায়। 

চ) চিংড়ি সহজেই বিক্রয় কেন্দ্রে প্রদর্শন করা যায়।

ছ) যদি বরফ ব্যবহৃত হয় তবে বরফ গলিত পানি বের হওয়ার সুযোগ থাকতে হবে। 

জ) সর্বোপরি বাক্স তৈরির উপকরণ সহজপ্রাপ্য ও কম দামী হতে হবে।

পাইকারী বিক্রয়ের ক্ষেত্রে প্যাকিং: এক্ষেত্রে তাজা মাছ ও ফ্লোজেন চিংড়ি প্যাকিং করা হয়। সাধারণত রেসিন করা কাগজের মন্ডের বাক্স ব্যবহৃত হয়। তবে ফাইবার বোর্ড বাক্স ও করুগেটেড বোর্ড কার্টুন বেশি ব্যবহৃত হয়, কারণ এগুলোর উপর পলিথিনে আবৃত থাকে। কোন কোন ক্ষেত্রে অধিক পূর্ণতার জন্য পলিস্টাইরিন লাইনিং ব্যবহৃত হয়।

ব্লক ফ্রোজেন প্যাকিং: এ পদ্ধতিতে চিংড়ি (খোলস ছাড়ানো) ফাইবার বোর্ড কার্টুন দিয়ে প্যাকেট করা হয়। সমস্ত প্যাকেটটি প্লেট ফ্রোজেন করা হয়। প্যাকেট শক্ত হওয়াতে পণ্যকে রক্ষা করে এবং শক্ত বৈশিষ্ট্যের কারণে ব্লক ফ্রোজেন প্যাক খুব সহজেই স্টোর ও পরিবহণ করা যায়। এ পদ্ধতির অসুবিধা হলো প্যাকেটের একটা চিংড়ি বের করতে হলে সমস্ত বরফ গলাতে হয়।

আইকিউএফ (Individual Quick Freezing - IQF): প্যাকেট করা বস্তুর বৈশিষ্ট্য হলো ফ্রোজেন, গ্রেজড ও পলিথিন দ্বারা আবৃত বাক্সে ভর্তি। এ পদ্ধতিটি খুব উপযোগী কারণ খুব সহজেই খুচরা বিক্রির জন্য নুতুনভাবে প্যাকেট করা যায়। সরবরাহকারীদের নিকটও খুব উপযোগী কারণ প্রয়োজন অনুযায়ী সরবরাহ করা যায়। আইকিউএফ পদ্ধতিতে খোলস ছাড়ানো চিংড়ি ও মাছ প্যাকেট করা হয়।

লেয়ারড প্যাক: পলিকোটেড ফাইবার বোর্ড বাক্স দ্বারা প্যাক করা হয়। ফিলেটগুলো পলিথিন লেয়ার দ্বারা পৃথক করা এবং প্রয়োজন অনুসারে ফিলেটগুলো আলাদা করা যায়। লেয়ারড প্যাক, আইকিউএফ প্যাকের চেয়ে গাদাগাদি করে রাখা, গুদামজাত করা ও পরিবহণ করা সহজ।

স্যাটার প্যাকিং: সাধারণত হোটেল ও রেস্তোরায় মৎস্যজাত পণ্যের এই প্যাকেটগুলো ব্যবহৃত হয়, কারণ সমস্ত প্যাক থেকে ডিফ্রোস্টিটিং ছাড়া ফিলেটগুলো আলাদা করা যায়।

সারণি: সচারচর ব্যবহৃত প্যাকিং পাত্রের বৈশিষ্ট্যসমূহ

বাগদা চিংড়ি পরিবহণের ক্ষেত্রে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো বিবেচনায় রাখতে হবে-

ক) পরিবহণের সময় ও দূরত্ব অনুসারে প্রয়োজনীয় বরফ ব্যবহার করতে হবে, যাতে গন্তব্য স্থানে পৌছার পরও চিংড়ির গায়ে বরফ থাকে।

খ) হোগলার চাটাই, ছালার চটে মুড়িয়ে বাঁশ নির্মিত ঝুড়িতে ও বরফবিহীন অবস্থায় চিংড়ি পরিবহণ পরিহার করা।

গ) ইনসুলেটেড/ তাপ নিরোধক পাত্র বা প্লাস্টিকের ঝুড়িতে বরফ মিশ্রিত করে চিংড়ি পরিবহণের ব্যবস্থা
করা।

ঘ) পরিবহণকালে পাত্র বা বাক্সে চিংড়ি রাখার সময় খেয়াল রাখতে হবে যাতে উপরের চিংড়ির চাপে বা বাক্সের ভালা লাগাবার সময় অধিক চাপ না পড়ে। অধিক চাপে নিচের চিংড়ি তাড়াতাড়ি নষ্ট হয়ে যেতে পারে, কেননা চিংড়ির মাংসপেশী অন্যান্য উচ্চতর প্রাণীর চাইতে নরম।

ঙ) ডিপো থেকে পরিবহণের ভাড়া সাশ্রয়ের প্রতি অধিক গুরুত্ব না দিয়ে ট্রাকে বরফ সহকারে চাটাই বা ত্রিপল দিয়ে ঢেকে যতদ্রুত সম্ভব চিংড়ি কারখানায় স্থানান্তর করা।

চ) অপর্যাপ্ত ও নিম্নমানের বরফ ব্যবহার করে খোলা ট্রাকে স্তুপাকারে অধিক পরিমাণ চিংড়ি পরিবহণ না করা। পরিবহণে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার দিকে অধিক গুরুত্ব দিতে হবে।

ছ) চিংড়ি বোঝাই ট্রাকে চাটাই বা ত্রিপলের উপর ট্রাকের সাহায্যকারীরা অবাধে চলাফেরা করার ফলে চিংড়ি থেতলে যায়, নরম হয়, সতেজতা হারায় এবং পচনকারী অণুজীব দ্বারা সহজেই সংক্রমিত হয়। চাটাই বা ত্রিপলের উপর দিয়ে ট্রাকের সাহায্যকারীরা অবাধে চলাফেরা করতে না পারে সেদিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখা।

Content added By

আমাদের দেশে চিংড়ি সম্পদ বিপণনের ক্ষেত্রে এখনো কোনো ব্যবস্থা গড়ে উঠেনি বলেই প্রতীয়মান হয়। মূলত চিংড়ি উৎপাদনকারীদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা, পরিবহণ ব্যবস্থা, সম্পদ সংরক্ষণ সুযোগ-সুবিধা ও মধ্য-সুবিধাভোগীদের (ফড়িয়া, আড়তদার, বেপারী) ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। খুব কম পরিমাণ চিংড়িই চিংড়ি উৎপাদনকারীদের কাছ থেকে সরাসরি ক্রেতার হাতে পৌঁছে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মধ্য- সুবিধাভোগীদের একটা ধারাবাহিক পর্যায়ের মাধ্যমে তা বাজারে আসে। আমাদের দেশে চিংড়ি বিপণন প্রক্রিয়া ধারাবাহিক পর্যায় বা ধাপসমূহ নিচে বর্ণনা করা হলো :

ক. চিংড়ি উৎপাদনকারী ও আহরণকারী বা জেলে সম্প্রদায়

চিংড়ি বিপণন প্রক্রিয়ায় সাধারণত দু'টি উৎস থেকে সরাসরি বাজারে চিংড়ি আসে, যেমন- খামারে উৎপাদিত চিংড়ি (পুকুর, স্বাদুপানির জলাশয় ও উপকূলবর্তী চিংড়ি খামার) এবং প্রাকৃতিক জলজসম্পদ থেকে আহরিত চিংড়ি (নদী-নালা, খাল-বিল, সমুদ্র উপকূলীয় জলাশয়)। চিংড়ি উৎপাদনকারী ও আহরণকারী বা জেলে সম্প্রদায় অনেক সময় সরাসরিভাবে চিংড়ি বিপণন করে থাকে।

খ. মধ্যস্বত্বভোগী (দালাল, ফড়িয়া, নিকারী)

আহরিত চিংড়ি ও মাছ কোন কোন ক্ষেত্রে সরাসরি বাজারে বিক্রয় হলেও উৎপাদক বা আহরণকারী কর্তৃক বাজার নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নেই বললেই চলে। অধিকাংশ আহরিত চিংড়ি দালাল বা নিকারীদের মাধ্যমে বড় ব্যবসায়ী বা আড়তদারের নিকট এসে পৌঁছে। কখনো কখনো দালালদের মাধ্যমে সরাসরি খুচরা বিক্রয়কারীর নিকট পৌঁছে থাকে। প্রাকৃতিক উৎস থেকে চিংড়ি আহরণের ক্ষেত্রে নিকারী মৎস্য ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে চিংড়ি আহরণকারীদের (জেলে) অগ্রিম ধার দিয়ে থাকে। ফলে আহরণকারীগণ চুক্তিভিত্তিক ধার্যকৃত মূল্যে উৎপাদিত মাছ বিক্রয় করতে বাধ্য থাকেন। এক্ষেত্রে প্রকৃত চিংড়ি উৎপাদক বা আহরণকারীরা যেমন- আহরিত চিংড়ির প্রকৃত মূল্য থেকে বঞ্চিত হন, তেমনি পরোক্ষভাবে ক্রেতারাও অধিক মূল্যে চিংড়ি ক্রয় করে থাকেন। এক্ষেত্রে মধ্যস্বত্বভোগীরাই উৎপাদিত চিংড়ি বিপণনের মাধ্যমে অধিক লাভবান হয়ে থাকে।

গ. চালানী

চিংড়ি বিপণন প্রক্রিয়ায় এরা হল প্রকৃত মৎস্য ব্যবসায়ী বা মহাজন। এরা নিকারি বা দালালদের মাধ্যমে মৎস্য উৎপাদন এলাকা থেকে চিংড়ি সংগ্রহ করে মহাজন বা শহরের বড় ব্যবসায়ীদের নিকট পৌঁছে দিয়ে থাকেন। দালাল বা নিকারীরা এদের কাছ থেকে মূলধন ও সংরক্ষণ উপকরণ পেয়ে থাকেন।

ঘ. আড়তদার

চিংড়ি বিপণন প্রক্রিয়ায় চালানী, দালাল বা চিংড়ি উৎপাদনকারী ও আহরণকারীদের মাধ্যমে আহরিত চিংড়ি আড়তদারের কাছে পৌঁছায়। আড়ত বলতে মূলত আধুনিক সুযোগা-সুবিধা সম্বলিত চিংড়ি সংরক্ষণ ও বিক্রয় কেন্দ্রকে বুঝানো হয়। এখান থেকেই মাছ বা চিংড়ি উন্মুক্ত ডাকের মাধ্যমে পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতার নিকট বিক্রয় করা হয়। বিক্রীত টাকার ওপর আড়তদার নির্দিষ্ট হারে কমিশন পেয়ে থাকেন। কমিশনের পরিমাণ এলাকাভেদে ও আড়তের সুযোগ-সুবিধা অনুসারে বিভিন্ন হয়ে থাকে। মূলত আড়তদার পাইকারি বিক্রেতার নিকট চিংড়ি বিক্রয় করে থাকেন।

চিত্র ৪.৭: বাংলাদেশের সাধারণ চিংড়ি বিপণন প্ৰক্ৰিয়া

ঙ. পাইকারী বিক্রেতা

পাইকারী বিক্রেতা দর কষাকষির মাধ্যমে খুচরা বিক্রেতার কাছে মাছ বিক্রয় করে। খুচরা বিক্রেতা ভোক্তা বা ক্রেতার কাছে মাছ বা চিংড়ি পৌঁছে দেন। এ ক্ষেত্রেও দালাল বা মধ্যস্বত্বভোগীদের বিচরণ লক্ষ্য করা যায়। বর্তমানে চিংড়ি বিপণন প্রক্রিয়ায় রপ্তানি একটি প্রতিযোগিতামূলক ব্যবসা হিসেবে আন্তর্জাতিক অর্থনীতিতে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশও ইতোমধ্যে বিশ্ব বাজারে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। কিন্তু এ উন্মুক্ত বিশ্ববাজারে বাংলাদেশকে টিকে থাকতে হলে সংশ্লিষ্ট সকলকে ক্রেতাদের চাহিদানুযায়ী চিংড়ির গুণগতমান উন্নতকরণের লক্ষ্যে চিংড়ি বিপণন প্রক্রিয়াকে অধিকতর কার্যক্ষম করতে হবে। এ প্রক্রিয়া বাস্তবায়নে চিংড়ি বিপণন প্রক্রিয়ার বিভিন্ন ধাপসমূহের মধ্যে বিরাজমান সমস্যাসমূহ চিহ্নিত করা প্রয়োজন এবং সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে চিংড়ি বিপণন নীতিমালা ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন।

Content added By

চিংড়ি বিপণন প্রক্রিয়ার সমস্যা ও সমাধানের সম্ভাব্য উপায়

চিংড়ির বিপণন প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে আমাদের দেশে এখনও উপযুক্ত কার্যকর ব্যবস্থা গড়ে উঠেনি। চিংড়ি রপ্তানিযোগ্য পণ্য হওয়ায় মুলত চিংড়ি চাষ সমৃদ্ধ উপকুলবর্তী এলাকায় আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত চিংড়ি প্রক্রিয়াজাতকরণ প্ল্যান্ট বা শিল্প গড়ে উঠেছে। চিংড়ি বিপণন প্রক্রিয়ায় প্রধান প্রধান সমস্যা ও তা থেকে উত্তরণের সম্ভাব্য উপায়সমূহ নিচে বর্ণনা করা হলো-

ক. চিংড়ি উৎপাদন সংক্রান্ত সমস্যা

বাংলাদেশে রপ্তানিকৃত চিংড়ির মধ্যে বাগদা ও গলদা চিংড়িই প্রধান। উপকুলীয় এলাকায় চিংড়ি চাষের খামার বৃদ্ধি পেলেও হেক্টর প্রতি চিংড়ি উৎপাদন খুবই কম। ফলে চিংড়ি চাষের অভীষ্ট এলাকায় এখনও চিংড়ি দ্রুত সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণের ওপর পর্যাপ্ত আধুনিক সুযোগ-সুবিধা গড়ে উঠেনি। এছাড়াও বিক্ষিপ্তভাবে খামার স্থাপনের কারণেও চিংড়ি উৎপাদনকারীরা উপযুক্ত মূল্যে বাজারে বিক্রয় করতে পারে না এবং কোন কোন ক্ষেত্রে চিংড়ি চাষের আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে, যা ভবিষ্যতে চিংড়ি চাষ সম্প্রসারণের অন্তরায় স্বরুপ।

খ. পরিবহণ সমস্যা

বাংলাদেশের উপকূলবর্তী এলাকায় ঘেরে চিংড়ি চাষ সম্প্রসারিত হলেও আধুনিক চিংড়ি খামারের সংখ্যা খুবই নগণ্য এবং চিংড়ি উৎপাদন এলাকার সাথে যোগাযোগ ব্যবস্থাও ভাল নয়। ফলে ক্রেতা বা ভোক্তাদের অবস্থান অনেকটা এলাকাভিত্তিক হিসেবেই গড়ে উঠেছে। অপরদিকে চিংড়ি দ্রুত পচনশীল পণ্য হওয়া সত্ত্বেও বিপণন প্রক্রিয়াকে সুসংগঠিত করার জন্য পর্যাপ্ত তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রিত কোন পরিবহণ ব্যবস্থাও গড়ে উঠেনি।

গ. দীর্ঘ বিপণন প্রক্রিয়াগত সমস্যা

আমাদের দেশে মৎস্যসম্পদ বিপণনের ক্ষেত্রে ফড়িয়া, বেপারী, দালাল ও আড়তদারগণ মূখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে। এদের মাধ্যমেই তা পুনরায় পাইকারী ও খুচরা বিক্রেতাদের মাধ্যমে ক্রেতা বা ভোক্তাদের হাতে পৌঁছে। ফলে পচনশীল চিংড়িসম্পদ দীর্ঘসময় ধরে হাত বদলের কারণে বিভিন্ন উপায়ে পণ্যের গুণগতমান বিনষ্ট হয়। অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে এ প্রক্রিয়ায় ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়ই যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তেমনি বিপণন প্রক্রিয়াও বাধাগ্রস্ত হয়ে থাকে।

ঘ. প্রক্রিয়াজাতকরণ সমস্যা

চিংড়ি সম্পদের সুষ্ঠু বাজারজাতকরণের ক্ষেত্রে চিংড়ি প্রক্রিয়াজাতকরণ একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ। অভ্যন্তরীণ বাজারে চিংড়ি বিপণনের ক্ষেত্রে শুধু বরফ ব্যবহার করে হিমায়িতকরণের মাধ্যমে ক্রেতার কাছে পৌঁছানো হয়। প্রাপ্ত তথ্যানুসারে দেখা গেছে, প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানায় সরবরাহকৃত চিংড়ির প্রায় ২৫ শতাংশেরও অধিক চিংড়ি বিবর্ণ, অপরিষ্কার এবং কালো দাগযুক্ত। সংশ্লিষ্ট চিংড়ি সরবরাহকারীদের অনভিজ্ঞতা ও প্রক্রিয়াজাতকরণ সম্পর্কে সম্যক ধারণা না থাকার কারণেই চিংড়ির গুণগতমান নষ্ট হয় এবং বাজারমূল্য কম হয়ে থাকে। ফলে একদিকে সরবরাহকারীরা যেমন ব্যবসায়িক দিক থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে অপরদিকে দেশও প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

সাধারণত আমাদের দেশে এপ্রিল থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত উপকূলীয় অঞ্চলের ঘের এবং মুক্ত জলাশয় থেকে পর্যাপ্ত পরিমাণে বাজারজাতকরণের উপযুক্ত চিংড়ি আহরণ করা হয়। এ সময়ে আমাদের দেশের আবহাওয়া উষ্ণ থাকার কারণে এবং চিংড়ি দ্রুত প্রক্রিয়াজাত কারখানায় সরবরাহ না করার ফলে অধিকাংশ চিংড়ির গুণগতমান নষ্ট হয়ে যায়। অনুরুপভাবে ট্রলারে আহরিত চিংড়ি অনেক সময় অসচেতনতার কারণে দিনের সুর্যালোকে উত্তপ্ত ডেকে ফেলে রাখা হয়। ফলে চিংড়ির দেহে কালো দাগ দেখা দেয়, যা চিংড়ি রপ্তানির ক্ষেত্রে প্রধান সমস্যা হিসেবে দাঁড়ায়। চিংড়ি বিপণনের ক্ষেত্রে উপরোক্ত সমস্যাসমূহ ছাড়াও চিংড়ি হিমায়িতকরণ ও চিংড়ি উৎপাদন এলাকায় প্রক্রিয়াজাতকরণের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণগত সমস্যা, প্রযুক্তিগত সমস্যা, বিশ্ববাজারে চিংড়ির অস্থিতিশীল মূল্য, বিপণন প্রক্রিয়ার সাথে সংশ্লিষ্ট প্রক্রিয়ায় অর্থসংস্থানগত সমস্যা, চিংড়ির সংরক্ষণের উপযুক্ত স্থানগত সমস্যা প্রভৃতি অন্যতম। দক্ষ বিপণন প্রক্রিয়া পরিচালনার ক্ষেত্রে উপরোক্ত সমস্যাসমূহকে প্রধান অন্তরায় হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে।

Content added By

বাগদা চিংড়ির গুণগতমান সংরক্ষণ

মাছ বা চিংড়ি মৃত্যুর পর যে প্রক্রিয়ায় বাহ্যিক বৈশিষ্ট্যগুলো যেমন- স্বাভাবিক গঠন, স্বাদ, গন্ধ, বর্ণ ইত্যাদির অবনতি ঘটে তাকে পচন ক্রিয়া বলে। পচন সংঘটিত হয় মূলত অণুজীবের কর্মতৎপরতা ও দেহ অভ্যন্তরস্থ জৈব পদার্থে বিদ্যমান এনজাইমের বিক্রিয়ার ফলে। মাছ বা চিংড়ি মৃত্যুর পর তার পেশীতে পর্যায়ক্রমে সংঘটিত জটিল রাসায়নিক পরিবর্তনের ফলে দেহ শক্ত হয়ে যাওয়ার পরপরই পচন শুরু হয়। চিংড়ি আহরণ করার পর এবং প্রক্রিয়াজাত করার পূর্ব পর্যন্ত সময়ের মাঝে নিম্নলিখিত কারণে চিংড়ির পচন হয়ে থাকে।

ক. এনজাইমের বিক্রিয়া ঘটিত পচন: জীবিত অবস্থায় যেসব এনজাইম বিপাকীয় কাজে সহায়তা করে সেগুলো মাছ/চিংড়ির মৃত্যুর পর দেহ অভ্যন্তরস্থ কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন ও চর্বির ব্যাপক ভাঙ্গন ঘটায়, ফলে দেহে পচন শুরু হয়। এই পচনকে স্বয়ংক্রিয় পচনও বলা হয়। এনজাইমের বিক্রিয়ার ফলে পেশী দুর্বল হয়ে যায়, ফলে ব্যাক্টেরিয়ার কর্মতৎপরতা বৃদ্ধির জন্য সহায়ক পরিবেশ তৈরি হয়। এনজাইমের বিক্রিয়ার ফলে পেশীর প্রোটিন ভেঙ্গে বিভিন্ন এসিড ও নাইট্রোজেন ঘটিত পদার্থে রূপান্তরিত হয়, যা থেকে পরবর্তীতে বিভিন্ন দূর্গন্ধ সৃষ্টিকারী পদার্থ উৎপন্ন হয়।

খ. র‍্যানসিডিটি চর্বিযুক্ত মাছের ক্ষেত্রে এ ধরনের রাসায়নিক পচন হয়ে থাকে। মাছ/চিংড়ির চর্বি অসম্পৃক্ত ফ্যাটি এসিড দ্বারা গঠিত হওয়ায় বাতাসের অক্সিজেনের উপস্থিতিতে এগুলো জারিত হয়। এর ফলে মাছ বিবর্ণ হয়ে যায় এবং মাছ বা চিংড়ির স্বাদ বা গন্ধ অগ্রহণযোগ্য হয়ে যায়। বিশুদ্ধ লবণ ব্যবহার করে চর্বিযুক্ত মাছ বা চিংড়ির র‍্যানসিডিটি কমানো যায়।

গ. ব্যাক্টেরিয়ার কর্মতৎপরতা ঘটিত পচন: তাজা মাছের দেহে কোন ব্যাক্টেরিয়া না থাকলেও মাছ বা চিংড়ি ফুলকা, অন্ত্র ও ত্বৰ্কীয় শ্লেষ্মায় প্রচুর পরিমাণে ব্যাক্টেরিয়া থাকে। এই ব্যাক্টেরিয়া মাছ বা চিংড়ির পচনে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। জলীয় পরিবেশ ব্যাক্টেরিয়ার ক্রমবিকাশের জন্য একটি উত্তম মাধ্যম। ফলে মাছ বা চিংড়ি আহরণের সময়েই ব্যাক্টেরিয়া দেহের বিভিন্ন অংশে আশ্রয় গ্রহণ করে থাকে। প্রকৃতিগতভাবেই মাছ বা চিংড়ি জীবিত অবস্থায় ব্যাক্টেরিয়ার বিরুদ্ধে দেহে একটি প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা বজায় রাখে, যা মৃত্যুর পর আর কার্যকর থাকে না। ফলে দেহ অভ্যন্তরস্থ এনজাইমের স্বয়ংক্রিয় বিক্রিয়ার ফলে ক্ষতিগ্রস্ত পেশী ব্যাক্টেরিয়ার প্রবেশ উপযোগী হয় এবং বংশবৃদ্ধির জন্য অনুকূল পরিবেশ লাভ করে। মাছ বা চিংড়ির দেহস্থিত ব্যাক্টেরিয়া ছাড়াও অবতরণ কেন্দ্র ও আহরণোত্তর পরিচর্যাকালীন সময়ে প্রচুর ব্যাক্টেরিয়া মাছ বা চিংড়ির দেহে প্রবেশ করে। মাছ বা চিংড়ির দেহে পচন সৃষ্টিকারী ব্যাক্টেরিয়াগুলো হলো- এ্যারোমোব্যাক্টর, সিউডোমোনাস, মাইক্রোকক্কাস ইত্যাদি।

পচন রোধের উপায়সমূহ

১. অণুজীব কর্তৃক সৃষ্ট পচনকে বাধা দেয়ার জন্য নিম্নল্লিখিত কার্যক্রমগুলো গ্রহণ করা যেতে পারে- 

ক) অণুজীবকে চিংড়ি বা খাদ্যে ঢুকাতে না দেওয়া বা দূরে রাখা। 

খ) অণুজীবকে অপসারণ করা।

গ) অণুজীবের বৃদ্ধি বা কার্যাবলীতে বাধা প্রদান বা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা। যেমন- খুব ঠান্ডা করে বা শুষ্ক করে এনেরোবিক অবস্থা সৃষ্টি করে (অক্সিজেনের অভাব ঘটিয়ে), রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করে ইত্যাদি।

২. চিংড়ির স্বপচন (self decomposition) বন্ধকরণের লক্ষ্যে নিচের পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করা যেতে পারে 

ক) ড্রেসিং-এর মাধ্যমে পরিপাকীয় এনজাইমের অপসারণ।

খ) সত্যিকারের রাসায়নিক বিক্রিয়াকে বাধা দেয়া বা বিলম্ব করা। 

গ) চিংড়ির এনজাইমকে ধ্বংস করে বা সম্পূর্ণভাবে নিস্ক্রিয় করে।

ঘ) পোকা মাকড়, অন্যান্য প্রাণী, যান্ত্রিক কারণ ইত্যাদির ফলে খাদ্য বিনষ্ট হয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করে।

নিম্ন তাপমাত্রায় মাছ বা চিংড়ি সংরক্ষণ তাপমাত্রার ওপর ভিত্তি করে নিম্ন তাপমাত্রায় মাছ বা চিংড়ি সংরক্ষণ পদ্ধতিকে দু'ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন-

ক) শীতলীকরণ: এ প্রক্রিয়ায় মাছ বা চিংড়ির দেহের তাপমাত্রা ০ (শূন্য) ডিগ্রি সে. এর কাছাকাছি আনা হয় এবং সপ্তাহখানেক পর্যন্ত মাছ বা চিংড়ির গুণগতমান ভাল অবস্থায় থাকে।

খ) হিমায়িতকরণ: এ প্রক্রিয়ায় মাছ বা চিংড়ির দেহের তাপমাত্রা মাইনাস ৩০ ডিগ্রি সে. থেকে মাইনাস ৪০
ডিগ্রি সে. এর কাছাকাছি রাখা হয় এবং মাছ বা চিংড়ির গুণগতমান ৬ থেকে ২৪ মাস পর্যন্ত ভাল
অবস্থায় থাকে।

ক. শীতলীকরণ প্রক্রিয়ায় চিংড়ি সংরক্ষণ

চিলিং বা শীতলীকরণ এমন একটি পদ্ধতি যে পদ্ধতিতে চিংড়ির দেহের তাপমাত্রা কমিয়ে হিমায়ন বিন্দুর প্রায় কাছাকাছি নিয়ে আসা হয়। তবে কখনই এর নিচে নয়। হিমায়ন বিন্দু বিভিন্ন প্রজাতিতে ০.৬ থেকে ২ ডিগ্রি সে. এর মধ্যে পরিবর্তিত হয়। তবে সচরাচর একে ১ ডিগ্রি সে. ধরা হয়।

অতি শীতলীকরণ (Supper Chilling): চিংড়ির দেহের তাপমাত্রা কমিয়ে হিমায়ন বিন্দুর ঠিক নিচের তাপমাত্রায় নিয়ে আসাকে অতি শীতলীকরণ বুঝায়। এখানে চিংড়ির মাংস হিমায়িত হতে শুরু করে।

চিলিং এর উদ্দেশ্য
চিলিং সাধারণত চিংড়ি বা অন্য কোন খাদ্যদ্রব্য স্বল্প সময়ের জন্য সংরক্ষণের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। কারণ এটি

ক) অনুজীবের বৃদ্ধির হারকে কমিয়ে দেয়।

খ) চিংড়ির মৃত্যুর পর বিভিন্ন বিপাকীয় কার্যাবলীকে হ্রাস করে। 

গ) রাসায়নিক কর্মকান্ডের ফলে চিংড়ির পচনকে রোধ করে।

চিলিং বা শীতলীকরণ পদ্ধতি

চিংড়ি সংরক্ষণের ক্ষেত্রে আমাদের দেশে শীতলীকরণ সবচেয়ে পরিচিত সংরক্ষণ পদ্ধতি। সাধারণত চিংড়িকে স্বল্প সময়ের জন্য সংরক্ষণ করার ক্ষেত্রে শীতলীকরণ পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। সাধারণত নিম্নোক্ত পদ্ধতির মাধ্যমে চিলিং করা হয়। যথা-

১. বরফের সাহায্যে শীতলীকরণ (Chilling with Ice )

বরফ একটি আদর্শ শীতলীকরণ মাধ্যম। একটি নির্দিষ্ট ওজনের বা আয়তনের বরফের ঠান্ডাকরণ ক্ষমতা খুব বেশি নিরাপদ, তুলনামূলকভাবে সস্তা এবং চিংড়ির ঘনিষ্ট সংস্পর্শে এসে চিংড়িকে দ্রুত শীতল করে। কার্যকর শীতলীকরণের জন্য বরফকে অবশ্যই গলতে দিতে হবে। অধিকন্তু গলিত বরফ চিংড়িকে আর্দ্র ও চকচকে রাখে।

আমরা জানি, পানি থেকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ তাপ সরিয়ে নিলে পানি বরফে পরিণত হয় এবং একই পরিমাণ তাপ যোগ করা হলে বরফ পুনরায় পানিতে পরিণত হয়। কঠিন অবস্থা থেকে তরল অবস্থায় আসতে যে পরিমাণ তাপ প্রয়োজন হয় তাকে সুপ্ত তাপ বলে। ১ কেজি বরফ গলতে ৮০ কিলোক্যালরি তাপের প্রয়োজন হয়। তাই ৮০ কিলোক্যালরি তাপমাত্রাকে বরফ গলনের সুপ্ততাপ বলে। বরফ গলতে বেশি তাপের প্রয়োজন হয় বলে এটি ভালো ঠান্ডাকরণ বাহক হিসেবে কাজ করে। এখানে উল্লেখ্য, ১ কেজি পানির তাপমাত্রা ১ ডিগ্রি সে. বৃদ্ধি করতে যে পরিমাণ তাপের প্রয়োজন হয় সেই পরিমাণ তাপকে ১ কিলোক্যালরি বলা হয়।

পানির আপেক্ষিক তাপ ১ এবং অন্যান্য পদার্থের আপেক্ষিক তাপ ১ অপেক্ষা কম। নিম্নে কয়েকটি পদার্থের আপেক্ষিক তাপ উল্লেখ করা হলো।

চিত্র ৫.৮: বরফের সাহায্যে চিংড়ি শীতলীকরণ

বরফ কিভাবে চিংড়িকে ঠান্ডা করে: শীতলীকরণ করার জন্য যখন বরফকে চিংড়ির সংস্পর্শে রাখা হয়, তখন গরম বা উষ্ণ চিংড়ি থেকে তাপ বরফে স্থানান্তরিত হয়। এভাবে চিংড়ির তাপমাত্রা কমতে থাকে এবং বরফ গলতে থাকে। একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ চিংড়িকে শীতল করার জন্য কি পরিমাণ তাপ অপসারণ করতে হবে এবং কি পরিমাণ বরফ প্রয়োজন তা সহজেই হিসাব করা যায়।

কোন পদার্থ ঠান্ডা হতে কি পরিমাণ তাপ বর্জন করে তা আপেক্ষিক তাপ ব্যবহার করে বের করা যায়। যেমন- বর্জিত তাপ= বস্তুর ওজন x তাপমাত্রার পার্থক্য x আপেক্ষিক তাপ

উদাহরণ: ১০ কেজি মাছ যার তাপমাত্রা ২৫ ডিগ্রি সে. এবং মাছের আপেক্ষিক তাপ ১। এখন ১০ কেজি মাছকে ২৫ ডিগ্রি সে. থেকে ০ ডিগ্রি সে. তাপমাত্রায় ঠান্ডা হতে বর্জিত তাপ হলো- = ××= কিলোক্যালরি, কিন্তু ১ কেজি বরফ গলতে ৮০ কিলোক্যালরি তাপ গ্রহণ করে। সুতরাং ১০ কেজি মাছ ঠান্ডা হতে ২৫০+৮০= ৩.১২ কেজি বরফ প্রয়োজন হবে।

বরফের প্রকারভেদ

ক) ব্লক আইস (Block ice): এটি মৎস্য শিল্পে ব্যবহৃত বরফের মধ্যে অন্যতম এবং বহুল পরিচিত। আমাদের দেশে এটি বেশি ব্যবহৃত হয়। প্রয়োজন অনুসারে একখন্ড বরফের ওজন ১২-১৫০ কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে। তবে বাজারের ওপর নির্ভর করে এর আকৃতি দেয়া হয়। চিংড়ি শীতলীকরণের জন্য ব্লক আইসকে গুঁড়ো করে ব্যবহার করা হয়।

খ) ফ্লেক আইস (Flake ice): এটি তুলার ন্যায় নরম। এটি খুব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বরফের গুঁড়ো, যা দেখতে পাউডারের ন্যায়।

গ) টিউব আইস (Tube ice): এ ধরনের বরফ একটা উলম্ব নলের ভিতরের পাত্রে তৈরি করা হয়, যা ফাঁপা সিলিন্ডার আকৃতির হয়ে থাকে। এর গুরুত্ব প্রায় ১০-১২ মিটার ও আকার ৫০×৫০ বর্গ মিমি. । নল থেকে বরফ বের করার পর একে বরফ কাটা নলের সাহায্যে সুবিধামত খন্ডে (সাধারণত ৫০ মিমি) কাটা হয়।

ঘ) প্লেট আইস (Plate ice): এটি দেখতে প্লেটের ন্যায়। একটি উলম্ব প্লেটের এক মুখে এ ধরনের বরফ তৈরি হয় এবং অপর মুখে পানি প্রবাহিত করে একে প্লেট থেকে বের করে আনা হয়। এই বরফের সর্বানুকূল পুরুত্ব হলো ১০-১৫ মিমি। তবে বরফ খন্ডের আকার পরিবর্তনশীল।

২. শীতল পানিতে চিংড়ি নিমজ্জনের মাধ্যমে এটি করা হয় মূলত দু'ভাবে- 

ক) রেফ্রিজারেটেড সামুদ্রিক পানি ও 

খ) শীতল সামুদ্রিক পানি ব্যবহার করে।

ক. রেফ্রিজারেটেড সামুদ্রিক পানি (Refrigerated Sea Water - RSW) এক্ষেত্রে সমুদ্রের পানিকে ঠান্ডা করে ব্যবহার করা হয়। সমুদ্রের পানিতে শতকরা ৩.৫ ভাগ লবণ থাকে। যদি সমুদ্রের পানিকে রেফ্রিজারেটেড করা হয় তাহলে সহজে তাপমাত্রা কমানো সম্ভব। এক্ষেত্রে তাপমাত্রা মাইনাস ২ ডিগ্রি সে. থেকে মাইনাস ১০ ডিগ্রি সে. পর্যন্ত সীমাবন্ধ থাকবে।

রেফ্রিজারেটেড সামুদ্রিক পানির সুবিধা-

১) খুব দ্রুত ঠান্ডা হয় কারণ এর ক্ষেত্রফল বেশি হয়।

২) চিংড়ির একটির উপর অন্যটিকে রেখে জড়তা কমিয়ে দেয়।

৩) নিম্ন তাপমাত্রায় জমাট বাধা সম্ভব।

৪) অল্প সময়ে, কম শ্রমে অধিক পরিমাণে চিংড়িকে দ্রুত পরিচর্যা করা যায়।

রেফ্রিজারেটেড সামুদ্রিক পানির অসুবিধা-

১) চিংড়ির দেহের মধ্যে অধিক পরিমাণে লবণ প্রবেশ করে, কারণ সমুদ্রের পানিতে অতিরিক্ত থাকে। ফলে প্রক্রিয়াজাত ও বাজারজাতকরণে অসুবিধা হয়।

২) চিংড়ির ওজন বেড়ে যায়, কারণ পানি ও লবণ দেহে প্রবেশ করে।

৩) প্রোটিনের পরিমাণ কমে যায় ।

৪) অল্প সময়েই অ্যানারোবিক হ্যালোফিলিক ব্যাক্টেরিয়া চিংড়ি পচাতে শুরু করে 

 

খ. শীতল সামুদ্রিক পানি (Chilled Sea Water CSW)

সমুদ্রের পানির সাথে কিছু পরিমাণ বরফ মিশিয়ে এটা তৈরি করা হয়। এক্ষেত্রে কিছু ঠান্ডা আসে রেফ্রিজারেটর থেকে এবং কিছু আসে বরফ থেকে। এ ক্ষেত্রে ব্যবহৃত চিংড়ি ও বরফের অনুপাত সাধারণত ৩:১ অথবা ৪:১ হয়ে থাকে। শীতল সামুদ্রিক পানি পদ্ধতিতে পর্যাপ্ত ঠান্ডা করার জন্য কী পরিমাণ বরফ প্রয়োজন তা সহজে নির্ণয় করা যায়। নিচে এ সম্পর্কিত হিসাব-নিকাশ দেওয়া হল।

ধরা যাক, ৮ টন বা ৮ হাজার কেজি চিংড়িকে ২৪ ডিগ্রি সে. থেকে মাইনাস ১ ডিগ্রি সে. তাপমাত্রায় ঠান্ডা করতে হবে এবং চিংড়ি ও বরফের অনুপাত হবে ৪:১। চিংড়ি ও পানির মিশ্রণের ফলে তাদের একত্রে ওজন হবে ১০ টন (১০ হাজার কেজি) এবং কি পরিমাণ তাপ বর্জন করবে তা নিচের সূত্রের সাহায্যে নির্ণয় করা যায়।

আমরা জানি, বরফ গলনের সুপ্ততাপ ৮০ কিলোক্যালরি।
এতএব প্রয়োজনীয় বরফের ওজন = ২৫০০০০+৮০= ৩১২৫ কেজি। অতএব মাইনাস ১.০ ডিগ্রি সে তাপমাত্রায় নিয়ে আসার জন্য ৩ টনের কিছু বেশি বরফ দরকার হবে।

৩. শীতলীকরণ কক্ষে চিংড়ির উপর দিয়ে ঠান্ডা বাতাস প্রবাহের মাধ্যমে-

ক) সমুদ্রে বরফ দিয়ে চিংড়ি শীতলীকরণ (Chilling of Fish with Ice at Sea),

খ) স্তুপাকারে শীতলীকরণ (Bulk Chilling) যেখানে চিংড়ি ধরা হয় এবং যে জলযানের মাধ্যমে চিংড়ি ধরা হয় তার উপর যে শীতলীকরণ করা হয় তাকে স্তুপাকারে শীতলীকরণ বলে। একটি উপযুক্ত ফিসরুম বিশিষ্ট ফিসিং ভেসেলে নিম্নরুপে চিংড়িকে মজুত করা হয়।

প্রথমে ফিসরুমের তলদেশ বরফ দিয়ে ১৯০ থেকে ১৯৫ সেন্টিমিটার পর্যন্ত গভীরভাবে আবৃত করে দিতে হয়। তবে বরফের গভীরতা বা পুরুত্ব নির্ভর করে ফিসরুমে ব্যবহৃত নিরোধক, জাহাজের দৈর্ঘ্য এবং সমুদ্রের পানির তাপমাত্রার উপর যদি ফিসরুম ধাতব পদার্থের তৈরি হয়। যদি মেঝে অন্তরিত (insulated) না হয়, তবে তলায় বরফের স্তরের পুরুত্ব বৃদ্ধি করা হয়। তখন এই বরফের স্তরের উপর চিংড়ি রাখতে হবে। তারপর আবার চিংড়ির উপর বরফের গুঁড়ো ছিটিয়ে দিতে হবে। এক্ষেত্রে চিংড়ির মধ্যে বরফের গুঁড়ো থাকবে। প্রতিটি চিংড়ি একে অপরের সাথে লেগে থাকলে ঠান্ডা হতে যত সময় লাগবে তার চেয়ে কম সময় লাগবে যখন প্রতিটি চিংড়ি বরফের গুঁড়ো দিয়ে পৃথক থাকে। এরপর বরফের দ্বিতীয় স্তর দেওয়া হয়, যতক্ষণ পর্যন্ত আগেরগুলো ভর্তি না হয় ততক্ষণ পর্যন্ত গুঁড়ো বরফ ছিটিয়ে দিতে হবে। এক্ষেত্রে বরফের সর্বশেষ যে স্তরটি হয় তার পুরুত্ব ৫ সেন্টিমিটার হতে হবে। প্রতি আধা মিটার পর পর বরফের সাপোর্ট দিতে হবে। চিংড়ির বাক্সে বা ফিসরুমে চিংড়ির স্তর বেশি হওয়া উচিত নয়। কারণ এতে অতিরিক্ত চিংড়ির চাপে তলার চিংড়ি ফেটে যেতে পারে এবং চিংড়ির দেহের তরল পদার্থ বের হয়ে আসতে পারে। ফলে চিংড়ি ওজনে কমে যেতে পারে।

বাক্স শীতলীকরণ (Box Chilling) : সমুদ্রের তীরে আসার পর বাক্সে চিলিং করা চিংড়ি স্তুপ করা চিংড়ির চেয়ে ভালো থাকে এবং ভূমিতে বা তীরে আসার পরও চিংড়ি সুরক্ষিত অবস্থায় থাকবে। এক্ষেত্রে বাক্সের ডিজাইন বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। বাক্সটি এমন আকৃতির হতে হবে, যাতে পর্যাপ্ত পরিমাণ বরফসহ চিংড়ি ধারণ করতে পারে। এই অবস্থায় বরফ চিংড়িকে ভূমিতে আসা পর্যন্ত ঠান্ডা রাখে। আবার একইভাবে বাক্স প্রশস্ত হবে না যাতে একে নড়াচড়া করতে অসুবিধা হয়। বাক্সে এমনভাবে ড্রেনের ব্যবস্থা থাকতে হবে যাতে করে গলিত পানি গড়িয়ে বাক্সের একপাশে বা শেষ প্রান্তে এসে জমা হয়। বাক্সে চিংড়ি বোঝাই করার সময় বাক্সের তলায় প্রায় ৬ সেন্টিমিটার গভীর বরফের স্তর থাকে এবং শেষ স্তরের পুরুত্বও প্রায় ৫ সেন্টিমিটার হয়ে থাকে। বাক্সটি বেশি বোঝাই করা উচিত নয়, যাতে করে এটি ফেটে যেতে পারে। 

সতর্কতা:

১. চিংড়ির স্তরের পুরুত্ব যেন বেশি না হয়। পুরুত্ব বেশি হলে ভিতরের চিংড়িগুলো ঠান্ডা হতে সময় বেশি লাগবে।

২. স্তূপাকার শীতলীকরণের সাহায্যে অতিরিক্ত স্তর দিতে হবে।

৩. বাক্স শীতলীকরণের দৈর্ঘ্য ২৫ সেন্টিমিটারের বেশি হওয়া উচিৎ নয়। এর চেয়ে বড় হলে পরিবহণে অসুবিধা হবে।

৪. শীতল পানিতে চিংড়ি নিমজ্জনের মাধ্যমে চিংড়িকে শীতল করা যায়।

 

শীতলীকরণের সময় চিংড়ির পরিবর্তন

ক) প্রোটিন ও ওজনে কম হওয়া: বরফ দিয়ে চিংড়ি শীতল করতে থাকলে চিংড়ির ওজন ক্রমান্বয়ে কমতে থাকে। ব্যাপকভাবে মুক্ত তরল ও ড্রিপ গঠনের (drip formation) কারণে হিমায়িত ফিলেট ও স্টেক (fillets and steaks) ওজনে কমে যায়। কারণ ড্রিপ গঠনের ফলে কিছু দ্রবণীয় প্রোটিন, লবণ ও অন্যান্য পুষ্টিকারক দ্রব্য দেহ থেকে বেরিয়ে আসে।

খ) বিবর্ণতা (Discoloration): চিলিংয়ের সময় চিংড়ির উপর বরফের অতিরিক্ত চাপের কারণে চিংড়ির ক্ষতি হয়। দেহ থেতলে যায়, গায়ে ক্ষতের সৃষ্টি হয় এবং বিবর্ণ হয়ে থাকে।

গ) পচনশীলতা (Rancidity): বরফ দিয়ে দীর্ঘদিন শীতলীকরণের জন্য পচা গন্ধ চিংড়ির গুণাগুণ নষ্ট করে দেয়। 

ঘ) কুঞ্চিত হওয়া (Shrinkage): কুঁচকে যাওয়া একটি সাধারণ ঘটনা যা চিংড়ির বরফ দিয়ে প্যাকেট করার সময় ঘটে থাকে। বিশেষ করে উপরের স্তরে এটা ঘটে।

খ. হিমায়িতকরণ প্রক্রিয়ায় চিংড়ি সংরক্ষ

হিমায়িতকরণ হলো চিংড়ি সংরক্ষণের এমন একটি পদ্ধতি যাতে চিংড়ি দেহের প্রাথমিক তাপমাত্রাকে কমিয়ে মাইনাস ৪০ ডিগ্রি সে. এর নিচে আনা হয়, ফলে চিংড়ির কলার বেশিরভাগ পানি জমে বরফে পরিণত হয়। এ ক্ষেত্রে প্রায় ৮৫ শতাংশ পানি বরফে রূপান্তরিত হয়। যদিও মাইনাস ৮ ডিগ্রি সে. তাপমাত্রায় চিংড়িকে হিমায়িতকরণ করা হয় তথাপিও এনজাইমেটিক কর্মতৎপরতা মাইনাস ২০ ডিগ্রি সে. তাপমাত্রা পর্যন্ত চলতে থাকে। ফলে চিংড়ির গুণাগুণ নষ্ট হয়ে যাওয়ায় সম্ভাবনা থাকে। তাই চিংড়ির গুণগতমান ভাল রাখার জন্য মাইনাস ৩৫ ডিগ্রি সে. থেকে মাইনাস ৪০ ডিগ্রি সে. তাপমাত্রায় চিংড়িকে ফ্রোজেন করা হয়। হিমায়িতকরণের আধুনিক পদ্ধতিতে দ্রুত দেহের তাপমাত্রা নিচে নেমে আসে এবং চিংড়ির দেহকলার অভ্যন্তরস্থ সর্বশেষ তাপমাত্রা হয় মাইনাস ৪০ ডিগ্রি সে.।

হিমায়িতকরণের উদ্দেশ্য: হিমায়িতকরণের মাধ্যমে কোন একটি দ্রব্যের গুণগত মান অপরিবর্তিত রাখা হয়। নিম্নলিখিত কারণে চিংড়ির ফ্রিজিং বা হিমায়িত করা হয়ে থাকে। যথা-

১) অণুজীব দ্বারা খাদ্য বস্তুর পচনকে রোধ করে বা বাধা

২) এনজাইমের কার্যাবলীকে রোধ করে বা বাধা দেয়।

৩) রাসায়নিক বিক্রিয়া রোধ করে বা বাধা দেয়।

আংশিক হিমায়িতকরণ (Partial freezing): আংশিক হিমায়িতকরণ হলো চিলিং এবং হিমায়িতকরণ তাপমাত্রার মধ্যবর্তী একটি তাপমাত্রা অর্থাৎ যখন চিংড়ির দেহের তাপমাত্রাকে কমিয়ে মাইনাস ৩ ডিগ্রি সে. বা মাইনাস ৪ ডিগ্রি সে. এ আনা হয়, তখন তাকে আংশিক হিমায়িতকরণ বলে।

ফ্রোজেন (Frozen ): ফ্রোজেন হলো তাপমাত্রাকে কমিয়ে কমপক্ষে মাইনাস ৮ ডিগ্রি সে. থেকে মাইনাস ১০ ডিগ্রি সে. এ নিয়ে আসা।

ফ্রোজেন পণ্য (Frozen product): যখন কোন বস্তুর তাপমাত্রা কমিয়ে মাইনাস ৮ ডিগ্রি সে. থেকে মাইনাস ১০ ডিগ্রি সে. এর মধ্যে নিয়ে আসা হয়, তখন সেই বস্তুকে ফ্রোজেন পণ্য বলে ।

চিলিং স্টোরেজ (Chilling storage): চিংড়িকে হিমায়িতকরণ তাপমাত্রার উপরে রেখে গুদামজাত করাকে চিংড়ির চিলিং স্টোরেজ বলে। চিলিং স্টোরেজের ব্যাপক ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়। কারণ এটি স্বল্পমেয়াদী সংরক্ষণ পদ্ধতি হিসেবে খুবই ফলপ্রসু। 

সারণি: চিলিং ও ফ্রিজিং এর মধ্যে পার্থক্য

ক্রম

চিলিং

ফ্রিজিং

০১তাপমাত্রা কমিয়ে ফ্রিজিং পয়েন্টের নিকট নিয়ে আসাতাপমাত্রা কমিয়ে মাইনাস ৮ ডিগ্রি সে. থেকে মাইনাস ৩০ ডিগ্রি সে. বা মাইনাস ৪০ ডিগ্রি
সে, এ নিয়ে আসা
০২দেহস্থ পানির অণুগুলো বরফে পরিণত হয় নাদেহস্থ পানির অণুগুলো বরফে পরিণত হয়
০৩এটি স্বল্পকালীন সংরক্ষণ পদ্ধতিএটি দীর্ঘকালীন সংরক্ষণ পদ্ধতি
০৪মাছ ধরার যান্ত্রিক যানে এর সুযোগ- সুবিধা থাকেট্রলারে ও মাদারশীপে সাধারণত এ সুযোগ সুবিধা থাকে
০৫চিলিং সাধারণত বরফের মাধ্যমে করা হয় ফ্রিজিং সরাসরি ফ্রিজারের মাধ্যমে করা হয়

 

হিমায়িতকরণের শ্রেণিবিন্যাস হিমায়িতকরণ মূলত দু' প্রকার যথা-

ক) ধীরগতি হিমায়িতকরণ (slow freezing), এবং 

খ) দ্রুত হিমায়িতকরণ (quick freezing)

ক) ধীরগতি হিমায়িতকরণ (slow freezing)

এ পদ্ধতিতে ধীরে ধারে চিংড়ির দেহ থেকে তাপমাত্রা কমিয়ে হিমায়িতকরণ তাপমাত্রায় নিয়ে আসা হয়। সাধারণত তাপমাত্রা কমিয়ে মাইনাস ২৫ ডিগ্রি সে. বা তার নিচে রাখা হয়। তাই এই তাপমাত্রা মাইনাস ১৫ ডিগ্রি সে. থেকে মাইনাস ৩০ ডিগ্রি সে. বা নিচে রাখা হয়। হিমায়িতকরণ হতে সময় লাগে ৩ ঘন্টা থেকে ৭২ ঘন্টা।

ধীরগতি হিমায়িতকরণের সুবিধা

  • মাইনাস ১ ডিগ্রি সে. থেকে মাইনাস ৮ ডিগ্রি সে. পর্যন্ত তাপমাত্রা ব্যাক্টেরিয়ার আক্রমণের জন্য খুবই অসুবিধাজনক।
  • তাপমাত্রা খুব ধীরে ধীরে কমে বিধায় চিংড়ির দেহের অধিকাংশ ব্যাক্টেরিয়া মারা যায়।

ধীরগতি হিমায়িতকরণের অসুবিধা

  • যেহেতু এটি ধীর প্রক্রিয়া তাই চিংড়ির দেহে সংঘটিত রাসায়নিক বিক্রিয়া ও ব্যাক্টেরিয়ার কর্মতৎপরতা চলতে থাকে, ফলে কিছুটা হলেও চিংড়ির গুণাগুণ নষ্ট হয়।
  • ধীর হিমায়নের ফলে বরফের বড় কেলাস (crystal) উৎপন্ন হয় যা পেশীকে নষ্ট করে ফেলে তাই চিংড়ির বাজার দর কমে যায়। 
  • বেশি লবণ বেরিয়ে আসে ফলে প্রোটিন ডিনেচারেশন (denaturation) হয়।

খ) দ্রুত হিমায়িতকরণ (Quick freezing ) 

এই পদ্ধতিতে দ্রুত চিংড়ির দেহের তাপমাত্রা কমিয়ে আনা হয়। এ ক্ষেত্রে হিমায়িতকরণের তাপমাত্রা সাধারণত মাইনাস ৪০ ডিগ্রি সে. এবং হিমায়িতকরণ হতে ৩০ মিনিট বা তার চেয়ে কম সময় লাগে।

দ্রুত হিমায়িতকরণের সুবিধা

  •  চিংড়ির শরীরের অভ্যন্তরে গঠিত বরফের কণিকাগুলো ছোট বলে দেহ কলার যান্ত্রিক ক্ষতি হয় না, আর হলেও কম হয়।
  • যেহেতু এই প্রক্রিয়ায় কম সময়ের মধ্যে চিংড়ির দেহ মধ্যস্থিত তরল পদার্থ বরফে পরিণত হয় ফলে কম পরিমাণে পুষ্টি পানিতে দ্রবীভূত হয় এবং বরফের মধ্যে আটকা পড়ে।
  • খুব তাড়াতাড়ি অণুবীক্ষণিক জীবের বৃদ্ধি বাধাগ্রস্থ হয়। 
  • থইং (thawing) এর ফলে পূর্বের কোষগুলো পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসতে পারে।
রেফ্রিজারেশন (Refrigeration)
একটি বন্ধ ঘরে ঠান্ডা বাতাস প্রবাহিত করে চিংড়ি বা অন্য কোন খাদ্য দ্রব্যের তাপমাত্রা কমিয়ে তাদেরকে সংরক্ষণ করার পদ্ধতিকে রেফ্রিজারেশন বলে।

হিমায়ক যন্ত্রের প্রকারভেদ (Types of freezer )

মাছ বা চিংড়ি হিমায়িতকরণের জন্য বিভিন্ন ধরনের হিমায়ক যন্ত্র বা ফ্রিজার ব্যবহার করা হয়ে থাকে। নিচে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত কয়েকটি হিমায়ক যন্ত্রের বিবরণ দেয়া হলোঃ

১. এয়ার ব্লাস্ট ফ্রিজার (Air Blast Freezer ABF )

২. কন্টাক্ট প্লেট ফ্রিজার (Contact Plate Freezer CPF)

৩. ইমারসন ফ্রিজার (Immersion Freezer IF )

৪. সাপ ফ্রিজার (Sharp Freezer SF)

৫. অন্যান্য ফ্রিজার (Other Freezer )

১. এয়ার ব্লাস্ট ফ্রিজার (Air blast freezer )

যে হিমায়ক যন্ত্রের ভিতর দিয়ে ঠান্ডা বাতাসের বাষ্প প্রবাহিত করে চিংড়ি বা অন্যান্য খাদ্যদ্রব্যকে হিমায়িতকরণ করা হয় তাকে এয়ার ব্লাস্ট ফ্রিজার বলে। এটি দু' প্রকার-

ক) সার্বক্ষণিক ফ্রিজার (Continuous freezer): এতে হিমায়িতকরণের সময় উৎপাদ (product) ঘুরতে থাকে। যেমন- হিমাগারের ভিতর এক পাশ দিয়ে চিংড়ি ঢোকানো হয় এবং অন্য পাশ দিয়ে বের করা হয়।

খ) ব্যাচ ফ্রিজার (Batch freezer): এর ভিতর উৎপাদ স্থির থাকে। যেমন- হিমাগারের ভিতর এক ব্যাচ চিংড়ি ঢুকিয়ে নির্দিষ্ট সময়ে ধরে রেখে দেয়া হয়।

বাণিজ্যকভাবে ব্যবহৃত এয়ার ব্লাস্ট ফ্রিজারের হিমায়িতকরণ পদ্ধতি: এয়ার ব্লাস্ট ফ্রিজারে সাধারণত সুড়ঙ্গ পথযুক্ত একটি পৃথককৃত ঘর, যার মধ্যে ইভাপোরেটরের উপর দিয়ে এক বা একাধিক ফ্যানের মাধ্যমে উৎপন্ন বায়ু যাকে অ্যামোনিয়া (NH3), ঠান্ডা লবণ পানি অথবা রেফ্রিজারেন্ট (refrigerant) ১২ বা ২২ ঘন্টা দিয়ে ঠান্ডা করা হয়। যে দ্রব্যকে হিমায়িতকরণ করা হবে তার চারপাশে দিয়ে বায়ু প্রবাহিত করা হয়। এই ফ্রিজারের পৃথককৃত ঘরের মধ্যে সাধারণত একবারেই সম্পূর্ণরূপে সেলফের র‍্যাকে চিংড়ি ভর্তি করা হয়। প্রয়োজন অনুসারে র্যাককে ঘূর্ণায়মান অবস্থায় অথবা স্থির রাখা হয়। সাম্প্রতিককালে উন্নত ফ্রিজারে চিংড়ি উৎপাদকে সর্বক্ষণ নাড়াচাড়া করানোর জন্য কনভেয়ার ব্যবহার করা হয়। এই ধরনের অধিকাংশ ফ্রিজারে তাপমাত্রা মাইনাস ৩৫ ডিগ্রি সে. থেকে মাইনাস ৪০ ডিগ্রি সে. এর মধ্যে রাখা হয়। অধিকাংশ অর্থনৈতিক সুবিধাজনক হিমায়িতকরণ করানোর জন্য উৎপাদের উপর দিয়ে এই ঠান্ডা বাতাস প্রবাহের গতি সাধারণত ৫০০-১০০০ এফপিএম (ফুট পার মিনিট) এর মধ্যে রাখা হয়। এরুপ ফ্রিজারের হিমায়িতকরণ করতে সময় লাগে ৬ থেকে ৮ ঘন্টা।

২. কন্টাক্ট প্লেট ফ্রিজার (Contact Plate Freezer CPF)

এই হিমায়ক যন্ত্রে চিংড়িকে প্লেটের উপর রেখে ধীরে ধীরে হিমায়িতকরণ করা হয়। এরুপ ফ্রিজারে চিংড়িকে ফাঁপা ধাতুর প্লেটের মধ্যে রাখা হয়, যার ভিতরে যে কোন একটি রেফ্রিজারেন্ট প্রবাহিত করানো হয়। এটি দু' প্রকার-

ক) আনুভূমিক কন্টাক্ট প্লেট ফ্রিজার এতে ট্রের মধ্যে বসানো চিংড়ির চ্যাপ্টা প্যাক ব্যবহার করা হয়। 

খ) উলম্ব কন্টাক্ট প্লেট ফ্রিজার প্রধানত বড় ধরনের ব্লক তৈরি করার জন্য ব্যবহার করা হয়।

বাণিজ্যিক পদ্ধতি: কন্টাক্ট প্লেট ফ্রিজারের একটি কেবিনে বা ঘরের চলাচলক্ষম আনুভুমিক প্লেটগুলোর উলম্ভভাবে গাদা দেওয়া থাকে। প্লেটগুলোকে সংযুক্ত পথের মাধ্যমে ঠান্ডা লবণ পানি, NH3 বা রেফ্রিজারেন্ট ১২ বা ২২ ঘন্টা দিয়ে ঠান্ডা করার ব্যবস্থা থাকে। এই ধরনের ফ্রিজার গাটবন্দী (packaged) মৎস্য উৎপাদের জন্য উপযুক্ত। প্রতিটি ব্লক চিংড়িসহ ৫০-৬০ মিলিমিটার পর্যন্ত পুরু হয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে ব্লকের তাপমাত্রা মাইনাস ৩৫ ডিগ্রি সে. হয়ে থাকে। মৎস্য উৎপাদকে তাড়াতাড়ি ফ্রিজিং করার জন্য এটি ব্যবহার করা হয়।

৩. ইমারসন ফ্রিজার (Immersion Freezer IF )

এ ক্ষেত্রে নিম্ন তাপমাত্রার তরল পদার্থ উৎপাদকে ডুবানো বা নিমজ্জন করা হয়। এ ধরনের ঠান্ডা তরল পদার্থের মধ্যে চিংড়িকে রেখে সরাসরি তার দেহের তাপমাত্রা কমানোর পদ্ধতি এয়ার ব্লাস্ট ফ্রিজারের ঠান্ডা বাতাস থেকে উৎকৃষ্ট। পানি থেকে এই ধরনের তরল পদার্থের ফ্রিজিং পয়েন্ট বেশি হয়ে থাকে।

৪. সার্প ফ্রিজার (Sharp Freezer SF)

সার্প ফ্রিজার একটি পৃথককৃত ঘর এবং সেখানকার তাপমাত্রা মাইনাস ২৫ ডিগ্রি সে রাখা হয়। এখানে একাধিক পাইপের কয়েল দিয়ে তৈরি সেলফ রাখা হয়। যার ভিতর দিয়ে ঠান্ডা লবণ পানি, NH, অথবা অন্যান্য রেফ্রিজারেন্টকে প্রবাহিত করা হয়। এই পদ্ধতিতে চিংড়িকে হিমায়িতকরণের সময় সরাসরি সেলফে রক্ষিত প্লেটের উপর রাখা হয়। এই পদ্ধতিতে উৎপাদের সব অংশ পাইপের সংস্পর্শে থাকতে পারে না। এই পদ্ধতি অনেক পুরাতন বলে বর্তমানে এর ব্যবহার অত্যন্ত সীমিত।

৫. অন্যান্য ফ্রিজার 

তরল নাইট্রোজেনের হিমায়িতকরণ তাপমাত্রা মাইনাস ১৯৬ ডিগ্রি সে.। তরল নাইট্রোজেন ব্যবহার করেও চিংড়ি/ মাছ হিমায়িত করা হয়। তাজা বা টাটকা চিংড়ি বা মাছ হিমায়িতকরণের সময় সৃষ্ট সমস্যাসমূহ-

ক) জারণের ফলে নষ্ট হওয়া;

খ) পানি বের হয়ে যাওয়া ;

গ) ভঙ্গুরতা বৃদ্ধি পাওয়া;

ঘ) অটোলাইসিসের সমস্যা;

ঙ) প্রোটিন ভেঙ্গে নষ্ট হয়ে যাওয়া; এবং

চ) আণুবীক্ষণিক জীবের সমস্যা ইত্যাদি।

ফ্রিজার বার্ন (Freezer burn): এয়ার ব্লাস্ট ফ্রিজারের ঠান্ডা বাতাসের গতিবেগ ৫০০ এফপিএম এর নিচে হলে চিংড়ির উপর একটি সাংঘাতিক ধরনের প্রভাব পড়ে। এ ধরনের ক্ষতিকর প্রভাবকে ফ্রিজার বার্ন বলে। এই অবস্থায় চিংড়ির পারিপার্শ্বিক বাষ্পের চাপ কমে যায়, ফলে চিংড়ির দেহ থেকে পানি বের হয়ে যেতে থাকে এবং চিংড়ি শক্ত হয়ে ভেঙ্গে যাওয়ার উপক্রম হয়। এ ছাড়া চিংড়ির বর্ণ, গঠন ইত্যাদি নষ্ট হয়ে যায়।

গ্রেজিং (Glazing) : এটি ফ্রিজার বার্ন থেকে চিংড়িকে রক্ষা করার একটি পদ্ধতি। চিংড়ির দেহ থেকে যাতে সহজে পানি বের হয়ে যেতে না পারে, সেজন্য এই প্রক্রিয়ায় চিংড়ির দেহের চারপাশে বরফের একটি আস্তরণ সৃষ্টি করা হয়। এই প্রক্রিয়ায় খুবই অল্প সময়ের জন্য খুব নিম্ন তাপমাত্রায় জলীয় বাষ্প দ্রবণে চিংড়িকে ডোবানো হয়। ফলে চিংড়ির দেহের চারিদিকে বরফের একটি আস্তরণ পড়ে এবং চিংড়ির দেহ থেকে পানি বের হতে বাধা পায়।

থইং (Thawing): থইং হলো হিমায়িতকরণের পরের একটি পরিচর্যা যাতে চিংড়ির দেহে কোথাও কোন বরফ থাকে না। এরুপ অবস্থা তখনই ঘটে যখন চিংড়ির দেহের সর্বত্রই তাপমাত্রা ১ ডিগ্রি সে. এর উপরে থাকে।

চিংড়ি পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণে প্যাকেজিং এর গুরুত্ব

চিংড়ি পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণে প্যাকেজিং-এর গুরুত্ব অপরিসীম। চিংড়ি পণ্যকে বাতাসের আর্দ্রতা, পোকা- মাকড়, ধুলা- বালি ইত্যাদি থেকে রক্ষার জন্য অবশ্যই ভালভাবে প্যাকেজিং করা উচিত। ভাল প্যাকেজিং করে না রাখলে চিংড়ি পণ্যের গুণগতমান অতি দ্রুত নষ্ট হয়ে যাবে। স্বাস্থ্যসম্মত ও উন্নত চিংড়ি পণ্য তৈরি ও বাজারজাতের জন্য উন্নত প্যাকেজিং এর গুরুত্বসমূহ হলো-

ক) প্যাকেজিংয়ের মাধ্যমে কোন দ্রব্যের মানের একটা প্রতিচ্ছবি ক্রেতা/বিক্রেতার নিকট ভেসে উঠে।

খ) প্যাকেজিংয়ের ধরন থেকে অতি সহজেই বুঝে নেয়া যায় পণ্যটি কত ভালভাবে সংরক্ষণ করা আছে বা সংরক্ষিত থাকবে।

গ) ভালভাবে প্যাকেজিং করা থাকলে বিক্রেতা পণ্যটি সুবিধামত স্থানে ও সুবিধামত সময়ে বিক্রয়ের জন্য সংরক্ষণ ও স্থানান্তর করতে পারে।

ঘ) ক্রেতাও সব সময় ভাল প্যাকেজিং করা পণ্য ক্রয় করতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করে।

প্যাকেজিংয়ে লেবেল ব্যবহারের গুরুত্ব:

ক) প্যাকেজিংয়ের লেবেলের মাধ্যমে কোন দ্রব্যের মানের একটা প্রতিচ্ছবি ক্রেতা/ বিক্রেতার নিকট ভেসে উঠে।

খ) প্যাকেজিংয়ের লেবেলের বর্ণনা থেকে অতি সহজে বুঝে নেয়া যায় পণ্যটির গুণগতমান, পুষ্টিগুণ ও এর মেয়াদ সম্পর্কে। 

গ) ভালভাবে প্যাকেজিং ও লেবেলিং করা থাকলে ক্রেতা সব সময় পণ্য ক্রয় করতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করে। 

ঘ) ট্রেসেবিলিটি লেবেল থাকলে পণ্যের পরিপূর্ণ ইতিহাস সহজেই জানা সম্ভব হয়।

 প্যাকেজিং ও লেবেলিং এবং উৎপাদনকারী শনাক্তকরণ

ক) প্যাকেজিং ও লেবেলিং ঠিক থাকলে চিংড়ি পণ্যের গুণগত মানের জন্য উৎপাদনকারীকে দায়ী করা সম্ভব হয়।

খ) প্যাকেজিংয়ের লেবেল থেকে উৎপাদনকারীকে শনাক্ত করা যায়।

গ) উৎপাদনকারীকে শনাক্ত করা গেলে পণ্যের গুণগতমানের দায়ভার উৎপাদনকারীর ওপর বর্তানো সহজ হয়।

ঘ) যেহেতু ট্রেসেবিলিটি (traceability) লেবেল অর্থাৎ পরিপূর্ণ ইতিহাস রাখা আস্তে আস্তে বাধ্যতামূলক হতে যাচ্ছে, সেহেতু উৎপাদনকারীকে বা আরো নিচের দিকে চাষি বা হ্যাচারি মালিককেও শনাক্ত করা সম্ভব হবে।

ট্রেসেবিলিটি লেবেলে সাধারণত যে সকল তথ্য থাকা উচিত সেগুলো হলো-

ক) মা-চিংড়ি সম্পর্কিত তথ্য, যথা- ধরার তারিখ, ধরার প্রকৃতি ও ধরার পরে ব্যবহৃত খাদ্য/ ঔষধের বিবরণ

খ) সকল গৃহীত ব্যবস্থাদির তালিকা।

গ) চিংড়ি পোনা সম্পর্কিত তথ্য, যথা- হ্যাচিং এর তারিখ, ট্যাংকের নম্বর ও খাদ্য / ঔষধসহ গৃহীত ব্যবস্থাদির তালিকা।

ঘ) চিংড়ি চাষ সম্পর্কিত তথ্য, যথা- মজুদের তারিখ, পুকুর নম্বর ও খাদ্য / ঔষধসহ গৃহীত ব্যবস্থাদির তালিকা।

ঙ) চিংড়ি ডিপো/মধ্যবর্তী স্থান সম্পর্কিত তথ্য, যথা- ধরার / সংগ্রহের তারিখ, অবস্থানের মোট সময় ও গৃহীত ব্যবস্থাদির তালিকা।

চ) চিংড়ি ডিপো/মধ্যবর্তী স্থান সম্পর্কিত তথ্য, যথা- ধরার/সংগ্রহের তারিখ, অবস্থানের মোট সময় ও গৃহীত ব্যবস্থাদির তালিকা।

ছ) চিংড়ি প্রক্রিয়াজাতকরণ সম্পর্কিত তথ্য, যথা- চিংড়ি গ্রহণের তারিখ, প্রক্রিয়াজাতকরণ, প্যাকেজিং ও স্টোরেজসহ গৃহীত ব্যবস্থাদির বিস্তারিত তালিকা।

প্যাকেজিং ও লেবেলিংয়ের সহিত পণ্যের মান বাড়ার সম্পর্ক

ক) প্যাকেজিং ও লেবেলিং ঠিক থাকলে, লেবেলিংয়ে উৎপাদনকারীর পরিচয় থাকে ফলে উৎপাদনকারীর নিজস্ব দায় দায়িত্ব অনেক বেড়ে যায় ও পণ্যের মান বাড়াতে সহায়তা করে।

 খ) উৎপাদনকারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান তাদের উৎপাদিত পণ্যের লেবেলে তাদের নাম ঠিকানা ব্যবহার করলে সেই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সুনাম রক্ষা করা ও ব্যবসায়িক সাফল্য উত্তরোত্তর বৃদ্ধির জন্য তাদের উৎপাদিত পণ্যের মান বাড়াতে সদা সচেষ্ট থাকে।

স্বাস্থ্যসম্মত ও উন্নত চিংড়ি পণ্য তৈরি ও বাজারজাতের জন্য উন্নত প্যাকেজিং সরঞ্জাম হিসেবে পলিথিন জাতীয় সরঞ্জামের ব্যবহার সবচেয়ে বেশি প্রচলিত ও জনপ্রিয়। তাছাড়া বিশ্বব্যাপী প্যাকেজিং সরঞ্জাম হিসেবে পলিথিনের ব্যবহারের সাথে সাথে পলিথিন সিলারের ব্যবহারের ব্যাপকতা বাড়ছে। বিভিন্ন প্রয়োজনে বিভিন্ন প্রকার পলিথিন সিলারও এখন বাজারে পাওয়া যায়। পলিথিন জাতীয় সরঞ্জাম ব্যবহারের বেশ কিছু সুবিধা ও অসুবিধা আছে-

সুবিধাগুলোর মধ্যে রয়েছে-

ক) সহজপ্রাপ্যতা ও মূল্য কম হওয়া

খ) স্বচ্ছ ও অস্বচ্ছ উভয় প্রকার প্রাপ্যতা 

গ) বিভিন্ন আকার ও প্রকৃতির প্রাপ্যতা

ঘ) লেবেল প্রিন্ট করার সুযোগ থাকা

ঙ) আর্দ্রতা প্রতিরোধক হওয়া

চ) টেকসই হওয়া

অসুবিধাগুলোর মধ্যে রয়েছে-

ক) পরিবেশবান্ধব না হওয়া।

খ) কোন সরু দ্রব্য, সূচ ও ধারালো জিনিস যেমন, চাকু, পিন ইত্যাদির সংস্পর্শে আসলে সহজেই ছিদ্র হওয়া বা কেটে যাওয়া।

 গ) মজুদের সময় উপরে অবস্থিত প্যাকেটের পণ্যের চাপ সরাসরি নিচের প্যাকেটের পণ্যের উপর পড়ে।

পুনরায় ব্যবহারযোগ্য সাদা প্লাস্টিক পাত্রের ব্যবহার-

ক) পুনরায় ব্যবহারযোগ্য পাত্র হিসেবে প্রচলিত সাদা প্লাস্টিকের বৈয়মের ব্যবহার করা যেতে পারে।

খ) পরীক্ষামূলকভাবে বেশকিছু সাদা প্লাস্টিকের বৈয়মের ব্যবহার করে শুটকি বাজারজাত করে অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক সাড়া পাওয়া গেছে।

 গ) চিংড়ি পণ্যের ক্ষেত্রে এর ব্যবহার করতে হলে বৈয়মের আকার আকৃতি পরিবর্তন করে চিংড়ি পণ্যের উপযোগী করে তৈরি করতে হবে।

স্বাস্থ্য সম্মত ও উন্নত চিংড়ি পণ্য তৈরি ও বাজারজাতকরণ

স্বাস্থ্যসম্মত ও উন্নত চিংড়ি পণ্যের খবর ক্রেতার নিকট পৌঁছানো অতি জরুরি। চিংড়ি পণ্যের ভোক্তারা সাধারণভাবে চিংড়ি পণ্যের স্বাদের বিচার বিশ্লেষণ করে থাকে। চিংড়ি পণ্যের সকল ক্ষেত্রে হ্যাসাপ মেনে স্বাস্থ্যসম্মতভাবে তৈরি কিনা সে ব্যাপারে সচেতনতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।

চিংড়ি পণ্য বাজারজাতকরণের বিভিন্ন পর্যায়েও গুণগতমান হারাতে পারে। চিংড়ি পণ্য বাজারজাত করার জন্য স্থানান্তরের সময় বা বাজারজাতের পরে বিক্রেতার দোকানে অসাবধানতার কারণে চিংড়ি পণ্যের প্যাকেট ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে ও চিংড়ি পণ্যের গুণগতমান নষ্ট হতে পারে। দোকানে দীর্ঘ দিন অবিক্রিত রয়ে গেলে চিংড়ি পণ্যের গুণাগুণ নষ্ট হতে পারে। কাজেই বাজারজাতকরণের সময়ে ও তৎপরবর্তী বিক্রয়ের সময়ে বিশেষভাবে চিংড়ি পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণ করা অপরিহার্য। তাছাড়া স্বাস্থ্যসম্মত চিংড়ি পণ্যের খবর অতি দ্রুত ক্রেতার নিকট পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতে হবে। এজন্য দেশে ও বিদেশে চিংড়ি পণ্য বিপণনে বিজ্ঞাপন প্রচারসহ মেলা বা প্রদর্শনীর আয়োজন করা যেতে পারে।

হ্যাসাপ (HACCP) ভিত্তিক মৎস্য ও চিংড়ি প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প কারখানার মান নিয়ন্ত্রণে গুরুত্ব : বিগত কয়েক দশকে উন্নত বিশ্বের দেশসমূহে এশিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে চিংড়ি রপ্তানি ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। রপ্তানিকৃত মৎস্যজাত খাদ্যের প্রধান শর্ত হলো গুণগত মানসম্পন্ন হওয়া। ১৯৯০ এর শুরুতে হ্যাসাপ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে চিংড়িজাত খাদ্যের মান উন্নয়নের ওপর গুরুত্ব প্রদান করা হয়। এ পদ্ধতি প্রয়োগ করলে মৎস্যজাত খাদ্যে যে জীবাণুগত সমস্যা এবং নষ্ট হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে তা মান নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে গুণগত মানসম্পন্ন খাদ্যসামগ্রী বিশ্বে বাজারজাত করা সহজ হবে। এই হ্যাসাপ পদ্ধতি বাস্তবায়নের ফলে প্রায় ১০০ ভাগ খাদ্যসামগ্রীকে অণুজীবঘটিত রোগের সংক্রমণ থেকে রোধ করা সম্ভব। বিভিন্ন তথ্য থেকে জানা যায় যে বিশ্বের মোট খাদ্য উৎপাদনের শতকরা ৫ ভাগ খাদ্য ভোক্তাদের কাছে পৌঁছার আগেই নষ্ট হয়ে যায়। এই প্রেক্ষিতে সুদীর্ঘ গবেষণার পর বিজ্ঞানীরা একমত পোষণ করেন যে, খাদ্য উৎপাদনের উৎস্যস্থল থেকে যে সকল কারণে খাদ্য সংক্রমিত হচ্ছে তা নিরীক্ষা এবং নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ভোক্তাদের নিরাপদ স্বাস্থ্য এবং সুন্দর জীবন উপহার দেয়া সম্ভব।

চিংড়ির উত্তম ব্যবস্থাপনা

খাদ্য যাতে স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ না হয় এবং খাদ্য নিরাপত্তার লক্ষ্যে প্রক্রিয়াজাতকরণ সংস্থা হ্যাসাপ পদ্ধতি অনুসরণের মাধ্যমে গুণগতমান উন্নয়ন করে থাকে। ভালো প্রক্রিয়াকরণ পদ্ধতি বা GMP (Good Manufacturing Practice) এর মাধ্যমে গুণগত মানসম্পন্ন খাদ্য ভোক্তার কাছে গ্রহণযোগ্যতার জন্য প্রয়োজন হয়। GMP এর অনেকগুলো ধাপ অতিক্রম করে বাস্তবায়ন করতে হয় যা নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির মাধ্যমে স্থায়ীভাবে পণ্য সামগ্রী ভোক্তার কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে থাকে। আবার কার্যকর বা ফলপ্রসূ বলতে আমরা বুঝি পণ্যসামগ্রীটি স্বাস্থ্যসম্মত হওয়া সত্ত্বেও কিছু কিছু অণুজীব কণা খাদ্যে থেকেও যেতে পারে যা সম্পূর্ণভাবে নিশ্চয়তা দেয়া সম্ভব নয়।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে হ্যাসাপ

হ্যাসাপ হলো আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একটি বিধি-বিধান, যা কোন খাদ্য সামগ্রী উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, গুদামজাতকরণ, বিপণন ইত্যাদি প্রতিটি ক্ষেত্রে বাধ্যতামুলকভাবে মেনে চলতে হবে। বাংলাদেশের মূল্য সংযোজিত চিংড়ি পণ্যের প্রধান ক্রেতা হলো যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো। এ সকল দেশের মূল্য সংযোজিত চিংড়ি পণ্য আমদানির প্রধান শর্ত হচ্ছে পণ্য উৎপাদনের সর্বস্তরে হ্যাসাপ-এর বিধিবিধান বাধ্যতামূলকভাবে মেনে চলা। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে রপ্তানির উদ্দেশ্যে রপ্তানিকারক চিংড়ি প্রক্রিয়াজাতকারী কারখানাগুলোতে হ্যাসাপ বিধি-বিধান মানা হচ্ছে।

হ্যাসাপ এর প্রধান দিকগুলো হল মানুষ বা অন্য কোন জীব বা সামগ্রিকভাবে পরিবেশের উপর বিরুপ প্রভাব পড়ে এমন কোন ক্ষতিকারক উপাদান বা কার্যক্রম প্রতিহত করা বা সম্ভব না হলে যতদূর সম্ভব কমানো। যে সকল উপাদান বা কার্যক্রম ক্ষতির কারণ হতে পারে তাদেরকে হ্যাজার্ড বলে। হ্যাজার্ডসমূহকে নিয়ন্ত্রণের জন্যই সকল বিধি-বিধান আরোপ করা হয়েছে। হ্যাজার্ডসমূহকে প্রধানত নিম্নলিখিতভাবে ভাগ করা যায়-

ক. জৈবিক হ্যাজার্ড: ক্ষতিকারক অণুজীব, বিশেষ করে মানুষের রোগ সৃষ্টিকারী ব্যাক্টেরিয়া বা অন্যান্য অণুজীবের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যই মূলত প্রাথমিকভাবেই হ্যাসাপের প্রবর্তন করা হয়েছিল। পরবর্তীতে আরো অন্যান্য দিক সংযোজিত হয়ে হ্যাসাপের কলেবর উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে এখন পর্যন্ত জৈবিক হ্যাজার্ড সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছে। জৈবিক হ্যাজার্ড আবার বিভিন্ন পণ্যের জন্য বিভিন্ন হয়ে থাকে। হিমায়িত পণ্যের জন্য এক রকম, কৌটাজাত পণ্যের জন্য অন্য রকম বা খাবার উপযোগী পণ্যের জন্য সেটা ভিন্ন রকম। চিংড়ি বা মাছের পরজীবী, যথা- নেমাটোডস (গোল কৃমি), সেসটোডস (ফিতা কৃমি), ট্রেমাটোডস (ফ্রুকস) ইত্যাদির উপস্থিতিও এক ধরনের জৈবিক হ্যাজার্ড।

খ. রাসায়নিক হ্যাজার্ড: ক্ষতিকারক রাসায়নিক পদার্থ, যেমন- এন্টিবায়োটিক ও কীটনাশকই বাংলাদেশী মৎস্য পণ্যের জন্য বর্তমানে সবচেয়ে বড় সমস্যা। কিছু কিছু ক্ষতিকারক রাসায়নিক পদার্থ উচ্চ তাপমাত্রায় মাছ বা চিংড়ির দেহ পচনের ফলে তৈরি হয়। ঐ সমস্ত রাসায়নিক পদার্থকে স্কমব্রো টক্সিন বা হিস্টামিন ফরমেশন বলে, ফলে ঐ সমস্ত চিংড়ি বা মাছ খেলে এলার্জি জনিত কারণে বিভিন্ন সমস্যা হতে পারে। এন্টিবায়োটিক সাধারণত প্রক্রিয়াজাতকারীরা ব্যবহার করেন না। এন্টিবায়োটিক সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় হ্যাচারি ও চিংড়ি চাষের খামারে। মাছের ট্রলার থেকে চিংড়ি আহরণ করে প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানায় আনার সময় রাসায়নিক দ্রব্য কিংবা ডিজেলের মিশ্রণের ফলেও চিংড়ির মান ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে।

গ. ফিজিক্যাল হ্যাজার্ড: ক্ষতিকারক কোন বস্তু, যেমন- আলপিন, পেরেক, কাঁচের ভাঙ্গা টুকরা ইত্যাদি হ্যাজার্ডকে ফিজিক্যাল হ্যাজার্ড বলে। প্রক্রিয়াজাতকরণের বিভিন্ন পর্যায়ে এ সমস্ত ক্ষতিকারক বস্তুর সংমিশ্রণের সম্ভাবনা থাকে।

ঘ.পরিবেশগত হ্যাজার্ড: পরিবেশের জানা ক্ষতিকারক বস্তু বা কার্যক্রম, যেমন- ম্যানগ্রোভ ধ্বংস করে চিংড়ি চাষ বা মাছ চাষ, কীটনাশক ব্যবহারের ফলে পানির দূষণ ইত্যাদি হ্যাজার্ডকে পরিবেশগত হ্যাজার্ড বলে।

চিংড়ি দূষণের উৎস শনাক্তকরণ

নিম্নলিখিত উৎস থেকে চিংড়িতে দূষণ হতে পারে-

ক) সংক্রমণযুক্ত মা চিংড়ির ব্যবহার। 

খ) সংক্রমণযুক্ত লার্ভি/পিএল ব্যবহার।

গ) চাষের জলাশয় বা তার আশপাশের পরিবেশ থেকে সংক্রমণ।

ঘ) চিংড়ি চাষের সময় খাদ্য/ ঔষধ ইত্যাদি থেকে সংক্রমণ।

ঙ) চিংড়ি আহরণের ও বাজারজাতকরণের যে কোন পর্যায়ে সংক্রমণ।

চিংড়ির দূষণের উৎস থেকে মুক্ত হওয়ার উপায়

ক) কোন প্রকার ক্ষতিকারক রাসায়নিক পদার্থ বা অণুজীব দ্বারা সংক্রমিত হলে সেই মা-চিংড়ি কোন অবস্থাতেই চিংড়ির পোনা তৈরির জন্য হ্যাচারিতে ব্যবহার করা চলবে না। 

খ) হ্যাচারিতে ব্যবহারের জন্য এমন মা-চিংড়ি ব্যবহার করতে হবে যাহা নিশ্চিতভাবে কোন ক্ষতিকর রাসায়নিক বা অণুজীব দ্বারা সংক্রমিত নয়। 

গ) চিংড়ি চাষের জন্য ব্যবহৃত লার্ভি/পিএল অবশ্যই সর্বপ্রকার ক্ষতিকর রাসায়নিক বা অণুজীব দ্বারা কোন পর্যায়ে সংক্রমিত নয় তা নিশ্চিত হতে হবে।

ঘ) চিংড়ি চাষের জন্য পিএল নির্বাচনের পূর্বে নিশ্চিতভাবে পিসিআর পরীক্ষার মাধ্যমে জানতে হবে যে চাষের জন্য নির্বাচিত পিএল সর্বপ্রকার ভাইরাসমুক্ত।

ঙ) চিংড়ি চাষ করতে গিয়ে তার আশেপাশের কোন জলাশয় বা পরিবেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করা যাবে না বা আশেপাশের কোন জলাশয় বা পরিবেশ থেকে কোন ক্ষতিকর বস্তুর জলাশয়ে প্রবেশ রোধ করতে হবে।

চ) চিংড়ি চাষের জলাশয় থেকে বা তার আশপাশের পরিবেশ থেকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কোন ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ বা অণুজীব দ্বারা সংক্রমিত নয় সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া বাঞ্ছনীয়।

ছ) চাষের সময়ে চিংড়িকে যে খাদ্য দেয়া হয় বা যে ঔষধ প্রয়োগ করা হয় তা থেকেও চিংড়িতে ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ বা অণুজীব সংক্রমিত হতে পারে। সেজন্য চিংড়ি চাষের সময় খাদ্য/ ঔষধ ইত্যাদি থেকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কোন ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ বা অণুজীব দ্বারা সংক্রমিত নয় সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া বাঞ্ছনীয়।

জ) চিংড়ি চাষের পর আহরণের ও বাজারজাতকরণের সময়েও বিভিন্ন প্রকার ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ বা অণুজীব দ্বারা সংক্রমিত হতে পারে। সেজন্য চিংড়ি আহরণের ও বাজারজাতকরণের কোন পর্যায়ে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কোন ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ বা অণুজীব দ্বারা সংক্রমিত নয় সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া একান্ত প্রয়োজন।

হ্যাচারি ও চিংড়ি চাষে ব্যবহৃত রাসায়নিক পদার্থসমূহ

১. মিথিলিন ব্লু (Metheline blue ) ।

২. ট্রাফলান (Treflan )

৩. প্রোটোজোয়াসাইড (Protozoacide)

৪. ফরমালিন (Formalin )

৫. জুথামনিসাইড (Zoothamnicide)

৬. ব্লিচিং পাউডার (Bleaching powder)

৭. কপার সালফেট (Copper sulfate)

৮. ম্যালাকাইট গ্রীন (Malachite green) ইত্যাদি

হ্যাচারিতে ব্যবহৃত এন্টিবায়োটিকসমূহ

১. সিপরোফ্লোক্সাসিন (Ciprofloxacin)

২. স্ট্রেপটোমাইসিন (Streptomycin) 

৩. কেনামাইসিন (Kanamycin)

৪. ইরাইথ্রোমাইসিন (Erythromycin) 

৫. অক্সিটেট্রাসাইক্লিন (Oxytetracycline)

৬. অক্সোলিনিক এসিড (Oxolinic acid)

৭. অ্যালবাজিন (Albazin)

নিষিদ্ধ এন্টিবায়োটিকসমূহ

১. ক্লোরামফেনিকল (Chloramphenicol

২. নিওমাইসিন (Neomycin)

৩. নাইট্রোফিউরান মেটাবোলাইট (Nitrofuran metabolite )

কার্যকর এন্টিবায়োটিকসমুহ

Erythromycin, Ciprofloxacin etc.

অকার্যকর এন্টিবায়োটিকসমূহ

Chloramphenicol, Nalidixic acid, Amoxicillin, Kanamycin, Neomycin, Ampicillin cte.

নিষিদ্ধ এন্টিবায়োটিকের ব্যবহারে ক্ষতিকর প্রভাবসমূহ

ক. জনস্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব

১) মানবদেহে নানা রকম ক্ষতিকর প্রভাবের কারণে পৃথিবীর অনেক দেশে এন্টিবায়োটিকের ব্যবহার কমে গেছে, অনেক এন্টিবায়োটিক নিষিদ্ধ করা হয়েছে। 

২) কেবলমাত্র প্রয়োজন হলেই চিংড়ির রোগ সৃষ্টিকারী নির্দিষ্ট ব্যাক্টেরিয়া ধ্বংস করতে এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করা উচিত।

৩) প্রায়শই দেখা যায় যে, সমস্যা সৃষ্টিকারী ব্যাক্টেরিয়া শনাক্ত না করেই এবং কোন ধরনের এন্টিবায়োটিক সেনসিটিভিটি (sensitivity) পরীক্ষা ছাড়াই এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হচ্ছে।

৪) এন্টিবায়োটিকের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের কারণে বিভিন্ন ব্যাক্টেরিয়ার এন্টিবায়োটিকের প্রতি রেজিস্ট্যান্স (resistance) সৃষ্টি হচ্ছে। এন্টিবায়োটিকের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার হ্যাচারি কর্মীদের স্বাস্থ্যগত ঝুঁকির কারণ হচ্ছে, মানবদেহেও ড্রাগ রেজিস্ট্যান্স তৈরি হচ্ছে।

জলজ জীবের ওপর প্রভাব

১) হ্যাচারি ও চিংড়ি চাষে ব্যবহৃত রাসায়নিক পদার্থের বর্জ্য জলজ পরিবেশ ও সমুদ্রে যায়, যা পানি দূষণ সৃষ্টি করে থাকে।

২) পানি দূষণের মাধ্যমে জলজ অনেক প্রাণী ও উদ্ভিদের বৃদ্ধি ও প্রজনন মারাত্মকভাবে ব্যহত করে, এমনকি মৃত্যুরও কারণ হতে পারে।

চিংড়ি রপ্তানির ক্ষেত্রে প্রভাব

৩) চিংড়ি উৎপাদনের কোন পর্যায়ে নিষিদ্ধ এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করলে এবং চিংড়ির মাংসপেশীতে এন্টিবায়োটিকের অবশিষ্টাংশ (residue) থাকলে সেই চিংড়ি পণ্য রপ্তানি করা যাবে না।

৪) আমদানীকারক বিভিন্ন দেশ থেকে এ অসাবধানতার কারণে প্রায়ই চিংড়ি কন্টেইনার দেশে ফেরৎ আসে।

Content added || updated By
Promotion