জীবের পরিবেশ

নবম শ্রেণি (মাধ্যমিক ২০২৪) - বিজ্ঞান (অনুসন্ধানী পাঠ) - Science (Investigative Study) - | NCTB BOOK
16
16

১২.১ বিভিন্ন জীবের নিবিড় সহাবস্থান

আমাদের পরিচিত মহাবিশ্বের গ্রহ- নক্ষত্রের মাঝে শুধু পৃথিবীতে প্রাণের উন্মেষ হয়েছে। কোটি কোটি বছরে পরিবর্তনশীল। এই পৃথিবীর পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা করে এই প্রাণ পৃথিবীতে বিকশিত হয়েছে, বিবর্তিত এবং অভিযোজিত হয়েছে। আমাদের চারপাশে যে জীবজগৎ রয়েছে তার মাঝে রয়েছে একটি অভূতপূর্ব বৈচিত্র্য। জীবদের মধ্যে বৈচিত্র্য থাকার কারণেই জীবজগৎকে লক্ষ লক্ষ প্রজাতিতে বিভক্ত করা হয়েছে। প্রতিটি প্রজাতির রয়েছে তার নিজের বৈশিষ্ট্য, এবং তার সেই স্বকীয় বৈশিষ্ট্য দিয়ে যে কোনো একটি প্রজাতি অন্যসব প্রজাতি থেকে ভিন্ন, কিন্তু একটু মনোযোগ দিয়ে লক্ষ করলেই কিন্তু আমরা আবিষ্কার করব যে প্রকৃতির এই উদ্ভিদ, প্রাণী, অণুজীব কেউই স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়, সকল জীব ঐ অঞ্চলে অবস্থিত উদ্ভিদ, প্রাণী, অণুজীব ও প্রাকৃতিক পরিবেশের মধ্যে আন্তঃসম্পর্কিত। পারস্পরিক নির্ভরশীলতার কারণে বিভিন্ন জীবের মাঝে যে নিবিড় সহাবস্থান গড়ে উঠেছে এবং সে কারণে জীবজগতে যে এক ধরনের ভারসাম্যতা বজায় রয়েছে আমরা নিচে তার উপর আলোকপাত করব।

উদাহরণ দেওয়ার জন্য বলা যায়, আপাতদৃষ্টিতে সবুজ উদ্ভিদকে আমাদের স্বনির্ভর মনে হয়, কারণ তারা স্বভোজী-সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে নিজের খাবার নিজেরা তৈরি করে নেয়। কিন্তু পরিবেশের দিক থেকে চিন্তা করলে দেখা যাবে যে, সবুজ গাছপালা পুরোপুরি স্বনির্ভর নয়। যেমন- সবুজ উদ্ভিদকে সালোকসংশ্লেষণের জন্য যে কার্বন ডাইঅক্সাইডের উপর নির্ভর করতে হয়, সেটি জীবেরা তাদের শ্বসনক্রিয়ার মাধ্যমে ত্যাগ করে। পর-পরাগায়নের জন্য একটি সপুষ্পক উদ্ভিদ কীটপতঙ্গের উপর নির্ভর করে। আবার বীজ বিতরণের জন্যও উদ্ভিদ পশুপাখির উপর নির্ভর করে। এভাবে গাছপালা, পশুপাখি, কীটপতঙ্গ ও অন্যান্য সকল জীবজন্তু একে অপরের দ্বারা প্রভাবিত এবং কমবেশি নির্ভরশীল। যেমন- সবুজ উদ্ভিদ সালোকসংশ্লেষণ করে যে অক্সিজেন ত্যাগ করে শ্বসনের জন্য জীবজগৎ সেটি ব্যবহার করে। তাছাড়া ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক এবং বিভিন্ন প্রকার জীবাণু দিয়ে গাছপালা, পশুপাখি, কীটপতঙ্গ বিভিন্নভাবে প্রভাবিত হয়। আমাদের শরীরে যত সংখ্যক দেহকোষ রয়েছে তার থেকে বেশি সংখ্যক অণুজীব বসবাস করে, সেগুলো আমাদের জৈবিক ক্রিয়াকর্মে সহযোগিতা করে যাচ্ছে। এক কথায় বলা যায় যে, পারস্পরিক সংযোগ ও নির্ভরশীলতাই হচ্ছে জীবনক্রিয়া পরিচালনার চাবিকাঠি। জীবজগতে বিভিন্ন প্রকার গাছপালা এবং প্রাণীদের মধ্যে বিদ্যমান জৈবিক সম্পর্কগুলোকে সহ-অবস্থান বা সিম্বিওসিস (Symbiosis) বলা হয়। এই সহ-অবস্থানকারী জীবগুলোর মধ্যে যে ক্রিয়া-বিক্রিয়া বা মিথস্ক্রিয়া ঘটে তার উপর ভিত্তি করে সিম্বিওসিস প্রক্রিয়াকে মিউচুয়ালিজম, কমেনসেলিজম এবং প্যারাসিটিজম এই তিনভাগে ভাগ করা যায়।

মিউচুয়ালিজম (Mutualism):

চিত্র ১২.১: মিউচুয়ালিজম (বামে) মৌমাছির পরাগায়ন (ডানে) পিঁপড়া ও এফিড

যে আন্তঃসম্পর্কে দুটি জীব একটি অন্যটিকে সহায়তা করে এবং উভয়ই একে অন্যের দ্বারা উপকৃত হয় তাকে মিউচুয়ালিজম বলে। যেমন- মৌমাছি খাবার হিসেবে ফুলের মধু এবং পরাগ আহরণের জন্য ফুলে ফুলে উড়ে বেড়ায়, তার বিনিময়ে ফুলের পরাগায়ন ঘটে এবং উদ্ভিদের জন্ম হয়। অনেক পাখি এবং বাদুড় ফল খেয়ে বাঁচে এবং মলত্যাগের সঙ্গে ফলের বীজও ত্যাগ করে। এভাবে বীজের স্থানান্তর হয় এবং এ বীজ নতুন গাছ সৃষ্টিতে সাহায্য করে। কিছু পিঁপড়া আছে যারা এফিড নামে এক ধরনের কীট পালন করে, তাদেরকে অন্য কীটভুক প্রাণী থেকে রক্ষা করে, বিনিময়ে এফিড তার শরীর থাকে নির্গত হানিডিউ নামে মিষ্টি এক ধরনের তরল পিঁপড়াদের পান করতে দেয় (চিত্র ১২.১)। পিঁপড়া আর এফিডের এই মিউচুয়ালিজমে দুই পক্ষেরই উপকার হয়।

 কমেনসেনিজম (Commensalism):

কমেনসেলিজমের ক্ষেত্রে দুই সহযোগীর মধ্যে একজনমাত্র উপকৃত হয়, অন্য সহযোগী সদস্য উপকৃত না হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। যেমন- রোহিণী উদ্ভিদ মূলের সাহায্যে নিজেকে মাটিতে আবদ্ধ করে এবং অন্য বড়ো উদ্ভিদকে আরওহণ করে উপরে উঠে। এরূপে অন্য বৃক্ষের উপর প্রসারিত হয়ে বেশি পরিমাণে আলো গ্রহণ করে কিন্তু বৃক্ষটির কোনো ক্ষতি করে না। পরাশ্রয়ী উদ্ভিদ (epiphyte) অন্য বৃক্ষে ঝুলে থেকে বায়ু থেকে খাদ্য সংগ্রহ করে, কিন্তু আশ্রয়দাতার কোনো ক্ষতি করে না। রেমোরা নামে এক ধরনের ক্ষুদ্র মাছ তাদের বিশেষ চুষনী ব্যবহার করে হাঙর মাছের মতো অতিকায় সামুদ্রিক প্রাণীর গায়ে আটকে থাকে (চিত্র ১২.২)। এটি নিজের কোনো পরিশ্রম না করেই হাঙ্গর মাছের সাহায্য নিয়ে সমুদ্রের নিচে ঘুরে বেড়ায় এবং তার পরিত্যক্ত খাবার খেয়ে বেঁচে থাকে। এই কমেনসেলিজমে দুই সহযোগীর মাঝে হাঙ্গরের কোনো ক্ষতি হয় না কিন্তু রেমোরা মাছের অনেক বড়ো লাভ হয়।

চিত্র ১২.২: কমেনসেলিজম (বামে) পরাশ্রয়ী উদ্ভিদ (ডানে) হাঙর ও রেমোরা মাছ

প্যারাসিটিজম (Parasitism):

এক্ষেত্রে একটি জীব অন্য জীবকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে তার অধিকার থেকে বঞ্চিত করে নিজের অধিকার ভোগ করে। যেমন- স্বর্ণলতা উদ্ভিদ, এটি তার আশ্রয়দাতা উদ্ভিদ থেকে তার খাদ্য সংগ্রহ করে  । কোকিল কখনো পরিশ্রম করে বাসা তৈরি করে না। কাকের বাসায় সে ডিম পাড়ে এবং কাকের দ্বারাই তার ডিম ফোটায়। ম্যালেরিয়া রোগ একটি মশাবাহিত রোগ, এই রোগের জীবাণু মশার কামড়ের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করে এবং রক্তের লোহিত কণা থেকে পুষ্টি গ্রহণ করে তার  বংশ বৃদ্ধি করে। এখানে ম্যালেরিয়ার জীবাণু নিজের জীবন চক্র পূরণ করার জন্য মানুষের দেহকে ব্যবহার করে। ম্যালেরিয়ার সংক্রমণে মানুষের নানা ধরনের বিপজ্জনক উপসর্গ সৃষ্টি হয়। এই প্যারাসিটিজমে দুই সহযোগীর মাঝে মানুষের অনেক ক্ষতি করে ম্যালেরিয়ার জীবাণু তার জীবন চক্র পূর্ণ করে।

উপরের আলোচনা থেকে তোমরা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ যে পৃথিবীর বিভিন্ন জীবের মধ্যে প্রতিনিয়ত ক্রিয়া- বিক্রিয়া বা মিথস্ক্রিয়া হচ্ছে এবং প্রতিটি জীব পরস্পরের সঙ্গে আন্তঃসম্পর্কযুক্ত। এই সম্পর্ক দিয়ে কেউ লাভবান হচ্ছে আবার কেউ ক্ষতিগ্রস্তও হচ্ছে, আর এভাবেই তারা একটা ভারসাম্য বজায় রেখে চলেছে।

১২.২ বাস্তুসংস্থান ও বাস্তুতন্ত্র (Ecology and Ecosystem)

বাস্তুসংস্থান বা ইকোলজি (Ecology) বলতে বোঝানো হয় জীবজগৎ ও তার পারিপার্শিক পরিবেশে মাঝে যে সম্পর্ক রয়েছে সে সম্পর্কে জ্ঞান। অন্যদিকে বাস্তুতন্ত্র বা ইকোসিস্টেম (Ecosystem) হচ্ছে একটি অঞ্চল, যেখানে সেই অঞ্চলের বসবাসকারী উদ্ভিদ এবং প্রাণীর সঙ্গে সেই অঞ্চলের জড় উপাদান-যেমন- মাটি, জল, বায়ু, সূর্যালোকের সঙ্গে এক ধরনের মিথস্ক্রিয়া ঘটছে। জড়জগৎ ও জীবজগৎ উভয়ই হলো বাস্তুতন্ত্রের মূল ভিত্তি।

১২.২.১ বাস্তুতন্ত্র (Ecosystem)

পৃথিবীর সব জীব, জড় ও ভৌত অবস্থা সবকিছু মিলেই আমাদের পরিবেশ। জীব সক্রিয়ভাবে জড়জগৎ থেকে তাদের প্রয়োজনীয় উপাদান সংগ্রহ করে তার জীবন অতিবাহিত করে, মৃত্যুর পর তার দেহ পরিবেশে মিশে গিয়ে সেসব গৃহীত উপাদান আবার জড় পরিবেশেই ফিরিয়ে দেয়। সবুজ উদ্ভিদ বায়ু থেকে কার্বন ডাইঅক্সাইড এবং মাটি থেকে পানি সংগ্রহ করে সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় তাদের প্রধান খাদ্য কার্বোহাইড্রেট তৈরির সময় অক্সিজেন ত্যাগ করে। উদ্ভিদ এবং প্রাণী মিলিয়ে পুরো জীবজগতের শ্বসনের জন্য যতটুকু অক্সিজেন প্রয়োজন তার একটি বড়ো অংশ আসে এই সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়া থেকে। সবুজ-অসবুজ এই দুই ধরনের উদ্ভিদই মাটি বা পানি থেকে কিছু খনিজ লবণ খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে। তৃণভোজী প্রাণীরা নানাভাবে উদ্ভিদের বিভিন্ন অংশ খেয়ে বেঁচে থাকে। বিভিন্ন স্তরের মাংসাশী প্রাণীরা আবার তৃণভোজী বা অন্যান্য ক্ষুদ্রতর মাংসাশী প্রাণীদের খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে। সকল প্রাণীর বর্জ্য পদার্থ পরিবেশেই মিশে যায়। তাছাড়া মৃত্যুর পর উদ্ভিদ আর প্রাণীর দেহ পচনক্রিয়ার মাধ্যমে আবার পরিবেশেই ফিরে যায়। এই পচনের কাজটি করে ব্যাকটেরিয়াসহ কিছু অণুজীব। এভাবে প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য প্রাকৃতিক নিয়মেই বজায় থাকে।

তোমরা ইতোমধ্যে জেনে গেছ প্রাকৃতিক পরিবেশে উদ্ভিদ এবং প্রাণী এই দুই ধরনের জীবের সঙ্গে জড়পদার্থের মধ্যে যে শক্তি আর বস্তুর আদান প্রদান হয় তাকে বলা হয় মিথস্ক্রিয়া, আর এ ধরনের মিথস্ক্রিয়ায় আন্তঃসম্পর্ক ঘটে, পৃথিবীর এরকম যে কোনো অঞ্চলই হচ্ছে বাস্তুতন্ত্র (Ecosystem)। সুতরাং বাস্তুতন্ত্র বলতে ভূপৃষ্ঠের এমন কোনো অঞ্চলকে বোঝায় যেখানে জড়, খাদ্য উৎপাদনকারী সবুজ উদ্ভিদ, খাদ্যের জন্য উদ্ভিদের উপর নির্ভরশীল কিছু প্রাণী এবং মৃত্যুর পর সেই জীবদেহকে পরিবেশে মিশিয়ে দেওয়ার জন্য অণুজীব রয়েছে এবং এসব উপাদানের মধ্যে যথাযথ আন্তঃসম্পর্ক চলমান রয়েছে।

বাস্তুতন্ত্রের উপাদানসমূহ:

জীব সম্প্রদায়, পরিবেশের জড়পদার্থ এবং ভৌত পরিবেশ মিলেই কোনো স্থানের বাস্তুতন্ত্র গড়ে ওঠে। এই তিনটি প্রধান উপাদানের প্রত্যেকটিতে আবার রয়েছে অনেক ধরনের ছোটো ছোটো উপাদান  । বিভিন্ন উপাদানের মাঝে জীব উপাদানগুলোই সব সময় সবচেয়ে বৈচিত্র্যময়।

জড় উপাদান (Nonliving matters):

পরিবেশের জড় পদার্থগুলো জীব উপাদানের জন্য বাসস্থান নির্মাণ করে, শ্বসনের জন্য অক্সিজেন জোগায় এবং বেশ কিছু পুষ্টি উপাদানও সরবরাহ করে। বাস্তুতন্ত্রের সকল জড় উপাদানকে আবার অজৈব এবং জৈব এই দুভাগে ভাগ করা যায়।

চিত্র ১২.৪: বাস্তুতন্ত্রের উপাদানগুলো

(ক) অজৈব বস্তু (Inorganic matters): পানি, বায়ু, এবং মাটিতে অবস্থিত খনিজ পদার্থ অর্থাৎ যেসব পদার্থ কোনো জীবদেহ থেকে আসেনি, বরং জীবের উদ্ভবের আগেই পরিবেশে ছিল সেগুলো বাস্তুতন্ত্রের অজৈব উপাদান। যেমন- ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম, লৌহ, নাইট্রোজেন, অক্সিজেন, কার্বন ডাইঅক্সাইড ইত্যাদি।

(খ) জৈব বস্তু (Organic matters): উদ্ভিদ এবং প্রাণীর বর্জ্য পদার্থ বা এসব জীবের মৃতদেহ থেকে যেসব জড়বস্তু বাস্তুতন্ত্রে যোগ হয় তাদের বলা হয় জৈব উপাদান। এগুলো সচরাচর হিউমাস নামে পরিচিত। হিউমাসের উপাদানের মধ্যে আছে ইউরিয়া, উদ্ভিদ এবং প্রাণীর বিভিন্ন কোষ, টিস্যু, অঙ্গ ইত্যাদি। জৈববস্তু উদ্ভিদের জন্য বেশি পুষ্টিকর। তাই উদ্ভিদ চাষে বেশি করে জৈব সার দিতে হয়। বহু প্রাণীও হিউমাসসমৃদ্ধ মাটি বেশি পছন্দ করে।

চিত্র ১২.৫: বাস্তুতন্ত্রের জীবজ উপাদান

ভৌত উপাদান (Physical components)

পরিবেশে সূর্যালোকের পরিমাণ, তাপমাত্রা, বায়ুতে জলীয়বাষ্পের পরিমাণ, বায়ুর চাপ এবং বায়ুপ্রবাহ, ভূপৃষ্ঠ বা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে গভীরতা (মাটির নিচে বা পানির নিচে) এবং উচ্চতা ইত্যাদি বহু উপাদান বাস্তুতন্ত্রকে নানাভাবে প্রভাবিত করে। এসব উপাদান মিলে গড়ে ওঠে কোনো অঞ্চলের আবহাওয়া ও জলবায়ু। এইসবই হচ্ছে কোনো বাস্তুতন্ত্রের ভৌত উপাদান।

জীবজ উপাদান (Living components):

জীবকুল বাস্তুতন্ত্রের সক্রিয় উপাদান। এরাই তাদের কাজের মাধ্যমে পরিবেশে বিভিন্ন পরিবর্তন আনে। পরিবেশের জীবজ উপাদানগুলো প্রধানত তিন প্রকার- উৎপাদক, খাদক এবং বিয়োজক (চিত্র ১২.৫)।

(ক) উৎপাদক (producer): সবুজ উদ্ভিদ সূর্যালোকের উপস্থিতিতে বাতাস থেকে কার্বন ডাইঅক্সাইড এবং মাটি থেকে পানি সংগ্রহ করে সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় তাদের প্রধান খাদ্য কার্বোহাইড্রেট (শর্করা) তৈরি করে। এ সময় উপজাত হিসেবে উদ্ভিদ অক্সিজেন ত্যাগ করে। তাই সালোকসংশ্লেষণ হচ্ছে বাস্তুতন্ত্রের উৎপাদন প্রক্রিয়া, উৎপাদক হলো সবুজ উদ্ভিদকুল। এই উৎপাদক উদ্ভিদগুলোকে বলা হয় স্বভোজী (Autotroph) কারণ তারা নিজের খাবার নিজেরাই তৈরি করতে পারে, অন্য কোনো জীবের উপর নির্ভর করতে হয় না।

(খ) খাদক (Consumer): কোনো প্রাণীই পরিবেশের জড়পদার্থ থেকে খাদ্য তৈরি করতে পারে না। তারা খাদ্যের জন্য প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সবুজ উদ্ভিদের উপর নির্ভরশীল। তাই এদের বলা হয় পরভোজী জীব। যেসব প্রাণী সরাসরি উদ্ভিদ থেকে খাদ্য গ্রহণ করে তাদেরকে বলা হয় তৃণভোজী প্রাণী (herbivorous)। এদের অপর নাম প্রথম শ্রেণির খাদক। ঘাস ফড়িং, মুরগি, গরু, ছাগল, হরিণ ইত্যাদি প্রথম শ্রেণির খাদক।

যেসব প্রাণী তৃণভোজী প্রাণীদের খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে তাদের বলা হয় গৌণ খাদক বা দ্বিতীয় শ্রেণির খাদক। এরা এক ধরনের মাংসাশী প্রাণী। ব্যাঙ, শিয়াল, বাঘ ইত্যাদি দ্বিতীয় শ্রেণির খাদক।

যেসব প্রাণী গৌণ খাদকদের খেয়ে বাঁচে তারাও মাংসাশী প্রাণী (carnivorous)। এদের বলা যায় তৃতীয় শ্রেণির বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ খাদক। সাপ, ময়ূর, বাঘ ইত্যাদি এই শ্রেণির খাদক।

একটি বিশেষ শ্রেণির খাদক জীবন্ত প্রাণীর চেয়ে মৃত প্রাণীর মাংস বা আবর্জনা খেতে বেশি পছন্দ করে। যেমন- কাক, শকুন, শিয়াল, হায়েনা ইত্যাদি। এদের নাম দেওয়া হয়েছে আবর্জনাভুক বা ধাঙড় (scavenger)। কারণ এরা মৃতদেহ বা আবর্জনা খেয়ে পরিবেশ পরিষ্কার রাখে। উল্লেখ্য যে, কখনো কখনো বাস্তুতন্ত্রে এমন প্রাণী দেখা যায়, যারা একাই বিভিন্ন স্তরের খাদক হিসেবে ভূমিকা রাখে। যেমন-: মানুষ একই সঙ্গে তৃণভোজী এবং মাংশাসী (omnivorous)।

(গ) বিয়োজক (Decomposer): ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক ইত্যাদি অতিক্ষুদ্র জীব বা অণুজীব উদ্ভিদ এবং প্রাণীর বর্জ্য পদার্থ এবং মৃতদেহ থেকে তাদের খাদ্য গ্রহণ করে এবং পরিণামে এসব বর্জ্য বিয়োজিত হয়ে মাটি বা পানির সঙ্গে মিশে যায়। এই মিশে যাওয়া উপাদান তখন উদ্ভিদের পক্ষে আবার খাদ্য উপাদান হিসেবে গ্রহণ করা সম্ভব হয়। তাই এই অণুজীবগুলোকে বলা হয় বিয়োজক বা পরিবর্তক।

১২.৩ পপুলেশান ইকোলজি

পপুলেশান শব্দটির অর্থ হচ্ছে একটি অঞ্চলের একটি নির্দিষ্ট ধরনের প্রজাতির সংখ্যা এবং পপুলেশান ইকোলজি বলতে বোঝানো হয় সেই অঞ্চলের পরিবেশের সঙ্গে এই সংখ্যার সম্পর্ক। সময়ের সঙ্গে পপুলেশান কীভাবে বৃদ্ধি পায়, হ্রাস পায় কিংবা দীর্ঘ সময়ব্যাপি স্থিতিশীল থাকে পপুলেশান ইকোলজি তার পেছনের কারণ অনুসন্ধান করে এবং ব্যাখ্যা করে। একই সঙ্গে একটি জীবের পপুলেশান কীভাবে সেই এলাকার বাস্তুতন্ত্রকে প্রভাবিত করে পপুলেশান ইকোলজি সেই বিষয়েও আলোকপাত করে।

পপুলেশন ইকোলজির চারটি মূল উপাদান- হচ্ছে আকার, ঘনত্ব, জীব সংখ্যা, ডিস্পারসান এবং ডেমোগ্রাফি।

(ক) আকার (Size): অঞ্চলটির নির্দিষ্ট জীবের মোট সংখ্যা হচ্ছে পপুলেশনের আকার।

(খ) ঘনত্ব (Density) এই অঞ্চলের নির্দিষ্ট জীবটির মোট সংখ্যাকে তার এলাকার পরিমাণ দিয়ে ভাগ করলে জীব সংখ্যার বা পপুলেশনের ঘনত্ব পাওয়া যায়।

(গ) বিচ্ছুরণ (Dispersion): পুরো এলাকায় জীবকুল কীভাবে ছড়িয়ে আছে সেটি দিয়ে জীবের বিচ্ছুরণ বোঝানো হয়। তিন ধরনের ডিস্পারসান হওয়া সম্ভব (চিত্র ১২.৬), সেগুলো হচ্ছে বিক্ষিপ্ত বা এলোমেলো (Random), সুষম বা নিয়মিত (Uniform) এবং গুচ্ছ (Clumped)।

বিক্ষিপ্ত: কোনো প্রজাতির জীবকে যদি তার এলাকায় এলোমেলোভাবে ছড়িয়ে থাকতে পাওয়া যায় তাহলে তাকে বিক্ষিপ্ত বা এলোমেলোভাবে বণ্টিত বলা যায়। অনেক বুনোফুলের বীজ বাতাসে একটি এলাকাতে ছড়িয়ে পড়ে সেখানকার যে কোনো জায়গায় অঙ্কুরোদগম হতে পারে, তাদেরকে বিক্ষিপ্ত বণ্টন বলা হয়।

সুষম: কোনো প্রজাতির জীবকে যদি তার এলাকায় পরস্পর থেকে মোটামুটি সমদূরত্বে পাওয়া যায় তাহলে সেটিকে সুষম বা নিয়মিত বণ্টন বলা হয়। পেঙ্গুইন পাখি হচ্ছে সুষম বণ্টনের উদাহরণ।

গুচ্ছ: অনেক প্রজাতির জীব দলবদ্ধভাবে থাকে, তাদের বণ্টনকে গুচ্ছ বণ্টন বলা হয়। হাতির পাল এই ধরনের বণ্টনের উদাহরণ।

চিত্র ১২.৬: জীবের বিক্ষিপ্ত, সুষম এবং গুচ্ছ ধরনের বিচ্ছুরণ

(ঘ) ডেমোগ্রাফি: পপুলেশনের প্রতিটি বয়সের আনুপাতিক হারকে ডেমোগ্রাফি বলা হয়।

একটি অঞ্চলের জীবসংখ্যা বৃদ্ধির হার পর্যালোচনা হচ্ছে পপুলেশান ইকোলজির একটি মূল বিষয়। পপুলেশন বৃদ্ধির হার চারটি ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ের উপর নির্ভর করে, সেগুলো হচ্ছে- জন্মহার, মৃত্যুহার, আগমনের হার (Immigretion) এবং নির্গমনের হার (Emigration)। আমরা যদি কোনো অঞ্চলের চড়ুই পাখির কথা 

চিত্র ১২.৭: জীবের পপুলেশান জন্ম, মৃত্যু, আগমনের হার এবং নির্গমনের হারের উপর নির্ভর করে।

চিন্তা করি, তাহলে দেখব প্রতি বছরে সেখানে বেশ কিছু চড়ুই পাখির জন্ম হয় আবার নানা কারণে বেশ কিছু চড়ুই পাখির মৃত্যুও হয়। যদি জন্মের হার মৃত্যুর হার থেকে বেশি হয় তাহলে অবশ্যই সেখানে চড়ুই পাখির সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। জন্ম-মৃত্যুর হার ছাড়া আগমন এবং নির্গমনের হার পপুলেশন বৃদ্ধিকে প্রভাবিত করে। ভালো আবাসস্থলের খোঁজে কিছু চড়ুই পাখী এই এলাকা ছেড়ে চলে গিয়ে পপুলেশনের সংখ্যা কমিয়ে দিতে পারে, আবার অন্য এলাকা থেকে কিছু চড়ুই পাখি চলে এসে পপুলেশনের সংখ্যা বাড়িয়ে দিতে পারে। যদি নির্গমন থেকে আগমনের সংখ্যা বেশি হয় তাহলে সেই এলাকার পাখির সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে (চিত্র ১২.৭)।

পপুলেশন ইকোলজির আরও গভীরে প্রবেশের পূর্বে আমাদের জীবের বংশধর উৎপাদনের দুটি ধারার সঙ্গে পরিচিত হওয়া প্রয়োজন, সেটি হচ্ছে আর এবং কে সিলেকশন (r and K Selection)। যেসব জীব অধিক সংখ্যক বংশধর উৎপাদন করে কিন্তু শৈশবে তাদের লালনের ব্যাপারে যত্নবান হয় না তাদেরকে 'আর- সিলেক্টেড' (r-Selected) জীব বলা হয়। পোকামাকড় বা মাছ হচ্ছে তাদের উদাহরণ। আবার যেসব জীব বংশধর উৎপাদনের বেলায় সংখ্যার চেয়ে মানের উপর বেশি গুরুত্ব দেয়, অর্থাৎ কমসংখ্যক বংশধর জন্ম দিয়ে অধিক পরিমাণ যত্ন দিয়ে বড়ো করে তোলে, তাদেরকে বলা হয় 'কে-সিলেক্টেড' (K-Selected) জীব। মানুষ এবং অন্য বড়ো স্তন্যপায়ী প্রাণী হচ্ছে কে-সিলেক্টেড জীবের উদাহরণ। পরিবেশ যখন অনুকূল এবং স্থিতিশীল থাকে সেখানে কে-সিলেক্টেড জীব ভালোভাবে বেঁচে থাকে।

'কে-সিলেক্টেড' জীব এবং আর-সিলেক্টেড' জীবকে আমরা তার জীবদ্দশার পুরো সময়টিতে বেঁচে থাকার সম্ভাবনা দিয়েও ব্যাখ্যা করতে পারি। যেমন- মানুষ কিংবা হাতির মতো বিশাল স্তন্যপায়ী প্রাণীদের সন্তানের সংখ্যা খুব কম এবং তারা তাদের সন্তানদের শৈশবে বাঁচিয়ে রাখার জন্য অনেক সময় এবং শক্তি ব্যয় করে। কাজেই এই প্রাণীগুলোর শিশু মৃত্যর হার কম এবং তাদের একটি বড়ো অংশ পূর্ণ বয়সে পৌঁছাতে পারে (চিত্র ১২.৮)। অন্যদিকে আর-সিলেক্টেড' জীব প্রচুর সন্তানের জন্ম দেয় কিন্তু তাদের বাঁচিয়ে রাখার জন্য চিত্র ১২.৮: 'কে-সিলেক্টেড' এবং আর-সিলেক্টেড' জীবের জীবদ্দশায় বেঁচে থাকার সম্ভাবনা 

চিত্র ১২.৮: 'কে-সিলেক্টেড' এবং আর-সিলেক্টেড' জীবের জীবদ্দশায় বেঁচে থাকার সম্ভাবনা

কোনো সময় কিংবা শক্তি ব্যয় করে না। এই জীবগুলো তাদের জীবদ্দশার শুরুতে অনেক বেশি সংখ্যায় মৃত্যুবরণ করে, তবে একটু বয়স হয়ে যাবার পার সেগুলো টিকে থাকতে শুরু করে। বিভিন্ন কীটপতঙ্গ বা মাছ এই দলের ভেতর পড়ে। জীবদ্দশায় টিকে থাকার সম্ভাবনার বিচার থেকে কে-সিলেক্টেড' জীবকে টাইপ । এবং আর-সিলেক্টেড' জীবকে টাইপ III বলা হয়। এই দুটি জীবনধারার মাঝামাঝি টাইপ ।। আরেকটি জীবন ধারা রয়েছে যেগুলোর মৃত্যুর আশঙ্কা পুরো জীবনে সমানভাবে বিস্তৃত। কিছু পাখি বা ইঁদুরকে এই দলভুক্ত করা যায়।

একটি এলাকায় একটি নির্দিষ্ট প্রজাতির জীব কী পরিমাণে বৃদ্ধি পেতে পারে সেটি কয়েকটি বিষয়ের উপর নির্ভর করে। সেগুলো হচ্ছে- (১) জীবটি কত তাড়াতাড়ি সন্তান জন্ম দেওয়ার উপযোগী বয়ঃপ্রাপ্ত হতে পারে, (২) কত দ্রুত জীবটি পরবর্তী বংশধর জন্ম দিতে পারে, (৩) কত বেশি সংখ্যকবার বংশধর জন্ম দিতে পারে এবং (৪) প্রতিবার কত বেশি সংখ্যক বংশধর জন্ম দিতে পারে।

যদি পরিবেশ থেকে কোনো বাধা বা চাপের সম্মুখীন না হয় তাহলে পপুলেশন বৃদ্ধির হার জ্যামিতিক হারে বেড়ে যেতে পারে। কিন্তু সব সময়েই পপুলেশন বৃদ্ধি পাওয়ার পর পরিবেশে থেকে আলো, বাতাস, স্থান ও পুষ্টির অভাবের কারণে বৃদ্ধির হার একটি নির্দিষ্ট সংখ্যায় পৌঁছানোর পর থেমে যায়। জন্ম ও মৃত্যুর হারে একটি সমতা আসার পর পপুলেশান একটি স্থিতিশীল পর্যায়ে আসে, একটি অঞ্চলের জন্য এই স্থিতিশীল সংখ্যাটিই হচ্ছে নির্দিষ্ট সেই জীবটির ক্যারিং ক্যাপাসিটি (caring capacity)। একটি অঞ্চলে কোনো একটি জীব যতগুলো জীবকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে তাকে সেই জীবের ক্যারিং ক্যাপাসিটি বলে (চিত্র ১২.৯)।

তোমরা নিশ্চয়ই অনুমান করতে পারছ, একটি জীবের জন্য ক্যারিং ক্যাপাসিটি কত হবে সেটি অনেকগুলো বিষয়ের উপর নির্ভর করে, তবে সাধারণভাবে সেগুলোকে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়, পপুলেশন ঘনত্বের উপর নির্ভরশীল এবং নির্ভরশীল নয় এরকম দুটি বিষয়। খাদ্য, পানি বা আবাসভূমির সংকট ইত্যাদি পপুলেশন ঘনত্বের উপর নির্ভরশীল বিষয়। আবার প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ঘূর্ণিঝড়, জলবায়ুর প্রভাব ইত্যাদি পপুলেশন ঘনত্বের উপর নির্ভরশীল নয় সেরকম কয়েকটি বিষয়।

 

১২.৪.১ খাদ্যশিকন (Food chain):

যে কোনো বাস্তুতন্ত্রের জীব উপাদানগুলোর মধ্যে উৎপাদক হিসেবে সবুজ উদ্ভিদ সবার প্রথম কাজে নামে। তারা খাদ্য তৈরি না করলে তৃণভোজী প্রাণীরা খাদ্য সংকটে পড়ে মারা যেত এবং তৃণভোজী প্রাণী না থাকলে মাংসাশী প্রাণীরা তাদের খেতে না পেয়ে মারা যেতো। যখন খাদ্য শক্তি উৎপাদক থেকে শুরু করে বিভিন্ন স্তরের খাদকদের মধ্যে প্রবাহিত হয়, তখন সেই প্রবাহকে একসঙ্গে খাদ্যশিকল বা ফুড চেইন বলা হয় (চিত্র ১২.১০)। 

চিত্র ১২.১০: খাদ্য শিকল

উদাহরণ হিসেবে বলা যায় মাঠের সবুজ ঘাস হচ্ছে উৎপাদক। ঘাসফড়িং সে ঘাসের অংশবিশেষ খেয়ে বাঁচে।

ইঁদুর ঐ ঘাস ফড়িংকে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে, আর সাপ সেই ইঁদুরকে খেয়ে ফেলে। সাপটি আকারে খুব বড়ো না হলে একটি বাজপাখি আবার সেই সাপটিকে খেয়ে ফেলবে। সেক্ষেত্রে খাদ্যশিকলটিকে নিচের মতো করে লেখা যাবে:

এখানে উল্লেখ্য যে, বাজপাখির মৃত্যুর পর ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক ইত্যাদি অতিক্ষুদ্র জীব বা অণুজীব বাজপাখির মৃতদেহ থেকে তাদের খাদ্য গ্রহণ করে এবং পরিণামে দেহটি বিয়োজিত হয়ে মাটি বা পানির সঙ্গে মিশে যায়। যেটি আবার ঘাস বা অন্য উদ্ভিদ তাদের খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে চক্রটি পূর্ণ করে।

বিভিন্ন ধরনের বাস্তুতন্ত্রে বিভিন্ন ধরনের খাদ্যশিকল হতে পারে। যেমন- শিকারজীবী খাদ্যশিকল, পরজীবী খাদ্যশিকল এবং মৃতজীবী খাদ্যশিকল।

(a) শিকারজীবী খাদ্যশিকল (Predator food chain): যে খাদ্যশিকলে প্রথম স্তরের খাদক আকারে সবচেয়ে ছোটো থাকে এবং পর্যায়ক্রমে উপরের খাদকেরা নিচের স্তরের খাদকগুলো শিকার করে খায় সেরূপ শিকলকে বলা হয় শিকারজীবী খাদ্যশিকল। উপরে বর্ণিত খাদ্যশিকলটি একটি শিকারজীবী খাদ্যশিকল।

(b) পরজীবী খাদ্যশিকন (Parasitic food chain): পরজীবী উদ্ভিদ ও প্রাণী অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিজেদের চেয়ে বড়ো আকারের পোষকদেহ থেকে খাদ্য গ্রহণ করে। এক্ষেত্রে খাদ্যশিকলের প্রথম ধাপে সব সময় সবুজ উদ্ভিদ নাও থাকতে পারে।

(c) মৃতজীবী খাদ্যশিকল (Saprophytic food chain): এই ধরনের খাদ্যশৃঙ্খলে খাদ্যের পুষ্টি জীবের মৃত বা পচে যাওয়া দেহাবশেষ থেকে বিভিন্ন জীবাণুর দিকে স্থানান্তরিত হয়, কাজেই মূলত মৃতজীবী এবং বিয়োজকের মধ্যে এই ধরনের খাদ্যশিকল আবদ্ধ থাকে। যেমন-

পরজীবী এবং মৃতজীবী খাদ্যশিকলে কোনো উৎপাদক নেই বলে এই খাদ্যশিকলগুলো অসম্পূর্ণ এবং তাদের কার্যকারিতা বজায় রাখার জন্য শিকারজীবী খাদ্যশিকলের প্রথম এক বা একাধিক স্তরের উপর নির্ভরশীল। সুতরাং বাস্তুতন্ত্রের সকল খাদ্যশিকল প্রকৃতপক্ষে উৎপাদক সবুজ উদ্ভিদের সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ার কার্যকারিতার উপর প্রতিষ্ঠিত।

 ১২.৪.২ খাদ্যজান (Food web)

অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায় বাস্তুতন্ত্রের খাদ্যশিকলে একই খাদক বিভিন্ন স্তরে স্থান পেতে পারে। তখন কয়েকটি খাদ্যশিকল একত্রিত হয়ে একটি জালের মতো গঠন তৈরি করে, একে খাদ্যজাল বলে (চিত্র ১২.১১)। স্থলজ ও জলজ উভয় পরিবেশের জন্য এই ঘটনা ঘটে থাকে। পাশের ছবি থেকে এ বিষয়টি আরও স্পষ্ট হবে।

চিত্র ১২.১১: খাদ্যজাল

উপরের চিত্রে দেখা যায় উৎপাদক শৈবাল জুপ্ল্যাংকটন এবং ছোটো মাছকে সরাসরি খাদ্য সরবরাহ করে। জুপ্ল্যাংকটনকে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে ছোটো এবং বড়োমাছ উভয়ই। বড়োমাছ আবার ছোটোমাছকে খায়। বাজপাখি ছোটো মাছ এবং বড়ো মাছটি খুব বেশি বড়ো না হলে সেটিকে সহজেই খেতে পারে। এখানে স্থলজ ও জলজ জীবের পাঁচটি খাদ্য শিকল তৈরি হয়েছে। এভাবে যে খাদ্যজাল তৈরি হয়েছে বিভিন্ন বাস্তুতন্ত্রে এর চেয়েও অনেক বেশি জটিল খাদ্যজাল তৈরি হতে পারে।

উপরের খাদ্যজালের মোট পাঁচটি খাদ্যশিকল এরকম:

বনভূমির বাস্তুতন্ত্রের খাদ্যজাল কেমন হতে পারে সেটি ১২.১২ চিত্রে দেখানো হয়েছে।

১২.৪.৩ বাস্তুতন্ত্রে পুষ্টিদ্রবাহ (Nutrient flow in ecosystem):

খাদ্যশিকল দিয়ে আমরা বিভিন্ন জীবের জীবন ধারণের জন্য খাদ্য গ্রহণের ধাপগুলো সম্পর্কে একটি ধারণা পেয়েছি। কিন্তু এই প্রক্রিয়াটিকে আমরা চাইলে পুষ্টির প্রবাহ হিসেবেও দেখতে পারি। যেমন- উদ্ভিদ অজৈব বস্তু গ্রহণ করে সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় খাদ্য প্রস্তুত করে। উদ্ভিদ যে খাদ্য তৈরি করে তার কিছু অংশ নিজ প্রয়োজনে ব্যবহার করে, অবশিষ্টাংশ উদ্ভিদ দেহেই জমা থাকে। তৃণভোজী প্রাণী এসব উদ্ভিদ খায় এবং পর্যায়ক্রমে মাংসাশী প্রাণী এসব তৃণভোজী খায়। এসব উদ্ভিদ এবং প্রাণীদের মৃত্যুর পর বিয়োজকগুলো এদের খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করে অজৈব বস্তুতে রূপান্তরিত করে পরিবেশে ফিরিয়ে দেয়। সবুজ উদ্ভিদ এসব অজৈব বস্তু গ্রহণ করে এবং পুনরায় খাদ্য প্রস্তুতে ব্যবহার করে থাকে। পুষ্টিদ্রব্যের এরূপ চক্রাকারে প্রবাহিত হওয়ার প্রক্রিয়াটিকে পুষ্টিপ্রবাহ বলে। খাদ্যশিকলের মাধ্যমে এরূপ পুষ্টির প্রবাহ বাস্তুতন্ত্রের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য।

বাস্তুতন্ত্রে শক্তির প্রবাহ (Energy flow in the ecosystem):

যে কোনো বাস্তুতন্ত্রের শক্তির মূল উৎস সূর্য। সূর্য থেকে যে পরিমাণ আলো এবং তাপশক্তি পৃথিবীতে এসে পৌঁছায় তার বড়োজোড় 2% সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় সবুজ উদ্ভিদ ব্যবহার করে। প্রথমে বাস্তুতন্ত্রের প্রথম স্তরের খাদক তৃণভোজী প্রাণীদের সবুজ উদ্ভিদের পাতা, কাণ্ড, ফুল, ফল, বীজ বা মূল খেয়ে জীবন ধারণ করে। এভাবে তৃণভোজী প্রাণীতে পৌঁছায়। মাংসাশী প্রাণী, যারা প্রথম স্তরের খাদকদের (তৃণভোজী প্রাণীদের) খেয়ে বাঁচে তারাই দ্বিতীয় স্তরের খাদক। প্রথম স্তরের খাদক থেকে এভাবে রাসায়নিক শক্তি দ্বিতীয় স্তরের খাদকের দেহে স্থানান্তরিত হয়। একইভাবে দ্বিতীয় স্তরের খাদক থেকে রাসায়নিক শক্তি খাদ্য আকারে তৃতীয় স্তরের খাদকে পৌঁছায়। যদি তৃতীয় স্তরের খাদককে আরও উচ্চতর কোনো খাদক খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে তবে একই প্রক্রিয়ায় শক্তি সর্বোচ্চ স্তরের খাদকে পৌঁছায়। খাদ্যশক্তি বিভিন্ন খাদ্যস্তরে স্থানান্তরিত হওয়াকে খাদ্যশিকল (Food Chain) বলে। একটি খাদ্যচক্রে সাধারণত 4-5টি ধাপ বা পর্যায় থাকে।

খাদ্যচক্রের প্রতিটি ধাপকে খাদ্যস্তর (trophic level) বলে। এক ট্রফিক লেভেল থেকে পরবর্তী ট্রাফিক লেভেল বা খাদ্যস্তরে শক্তি স্থানান্তরের সময় বিপুল পরিমাণ শক্তি তাপশক্তিতে রূপান্তরিত হয়, যা পরবর্তী খাদ্যস্তরে ব্যবহারের উপযোগী থাকে না। তাই খাদ্যচক্র যত ছোটো হয়, তত বেশি পরিমাণ শক্তি এক স্তর থেকে অন্য স্তরে ব্যবহার উপযোগী অবস্থায় স্থানান্তরিত হয়। যে কোনো বাস্তুতন্ত্রের কোনো একটি ট্রফিক লেভেলে যতটুকু শক্তি থাকে তার মাত্র 10% ঠিক উপরের ট্রফিক লেভেলে সঞ্চারিত হতে পারে। বাকি 90% তাপ হিসেবে পরিবেশে বিমুক্ত হয় কিংবা আংশিকভাবে অব্যবহৃত থেকে যায়।

মৃত্যুর পর সব জীবের তার শক্তি গ্রহণ প্রক্রিয়া থেমে যায়। তখন ঐ মৃতদেহে সঞ্চিত রাসায়নিক শক্তি বিয়োজকের কাজের ফলে ভেঙে জড় পদার্থ বা শক্তি আকারে আবার পরিবেশে ফিরে আসে। পরিবেশের বিভিন্ন জড় বস্তুর মধ্যে জমা হওয়া এই শক্তি তখন আবার উদ্ভিদের গ্রহণ উপযোগী হয়। আর এভাবে খাদ্যচক্রের মাধ্যমে বাস্তুতন্ত্রে প্রাকৃতিক শক্তির প্রবাহ চলতে থাকে।

১২.৪.৪ শক্তি পিরামিডের ধারণা :

তোমরা ইতোমধ্যে জেনেছ যে বাস্তুতন্ত্রে একটি খাদ্যস্তর থেকে অপর খাদ্যস্তরে মাত্র 10% শক্তি স্থানান্তরিত হয়, বাকি শক্তি তাপশক্তি হিসেবে পরিবেশ ফিরে যায় কাজেই পরবর্তী খাদ্যস্তরে মোট শক্তির পরিমাণ কমে যায়। এই কারণে নিম্ন খাদ্যস্তর থেকে উচ্চ খাদ্যস্তর পর্যন্ত জীবের স্থানান্তরিত শক্তিকে পরপর সাজালে যে ক্রমহ্রাসমান আকৃতির চিত্র পাওয়া যায় তাকে খাদ্য পিরামিড বা শক্তি পিরামিড বলে (চিত্র ১২.১৩)।

চিত্র ১২.১৩: শক্তির পিরামিড

শক্তির এই প্রবাহ সব সময়েই একমুখী। এ শক্তিপ্রবাহকে কখনো বিপরীতমুখী করা যায় না। প্রতিটি ধাপে প্রায় ৭০% ভাগ শক্তি কমে যায় বা ব্যবহারযোগ্যতা হারায়। শক্তির এ ক্রমবর্ধমান ক্ষয় খাদ্যশিকলের আকারকে 4 বা 5টি ধাপের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখে। খাদ্যশিকল যত দীর্ঘ হবে ঊর্ধ্বতম ট্রফিক লেভেলে শক্তির পরিমাণ ততই কমতে থাকবে এবং এক পর্যায়ে এসে আর কোনো শক্তিই অবশিষ্ট থাকবে না।

খাদ্য পিরামিডের বেলায় শুধু স্থানান্তরিত শক্তি নয়, জীবের সংখ্যা কিংবা জীব-ভরকেও পিরামিড আকারে সাজানো যায় এবং সেগুলো বাস্তুতন্ত্রের ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ে আলোকপাত করে।

১২.৫ পানিচক্র

পানি চক্র (চিত্র ১২.১৪) বলতে বায়ুমণ্ডলে, ভূপৃষ্ঠে, এবং ভূপৃষ্ঠের নিচে ভূগর্ভস্থ পানির পারস্পরিক আদানপ্রদান এবং তাদের নিরবচ্ছিন্ন প্রবাহকে বোঝানো হয়। পৃথিবীতে প্রাণের উন্মেষের পিছনে পানির অনেক বড়ো একটা ভূমিকা রয়েছে এবং পৃথিবীর এই পানি-চক্র সেই প্রাণের বিকাশ, বিবর্তন ও অভিযোজনের কাজে সহায়তা করে যাচ্ছে। তোমরা সবাই জান পানি কঠিন, তরল এবং গ্যাস এই তিন অবস্থাতেই থাকতে পারে এবং শক্তির বিনিময়ের মাধ্যমে পানি তার অবস্থার পরিবর্তন করে। শুধু তাই নয় পৃথিবী পৃষ্ঠের প্রায় তিন চতুর্থাংশ পানি হওয়ার কারণে এটি বিপুল পরিমাণ তাপশক্তির আধার হিসেবে কাজ করে। কাজেই পানির সঙ্গে শক্তির আদানপ্রদানের মাধ্যমে চলমান পানির চক্র পৃথিবীর স্থিতিশীলতার পিছনে অনেক বড়ো একটি ভূমিকা রাখে।

তোমরা জানো পানিচক্রে পানি তার কঠিন, তরল ও গ্যাসীয় অবস্থার পরিবর্তন করে, কিন্তু এই পরিবর্তন হচ্ছে ভৌত পরিবর্তন তাই পানির মোট পরিমাণ বা অণুর সংখ্যার কোনো পরিবর্তন হয় না। পানিচক্রে পানিকে তার অবস্থার পরিবর্তনের জন্য বাষ্পীভবন, গলন, ঘনীভবন ঊর্ধ্বপাতন (Sublimation) এবং অবক্ষেপ (Deposition) ইত্যাদি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। পানিচক্রের বিভিন্ন ধাপ কোন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সংঘটিত হয় নিচে তার সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হলো।

বায়ুমণ্ডলে জলীয় বাষ্প

বাষ্পীভবন: সূর্য হচ্ছে পৃথিবীর সকল শক্তির উৎস এবং এই সূর্য পৃথিবীপৃষ্ঠের পানির বাষ্পীভবনের জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি সরবরাহ করে থাকে। পৃথিবীপৃষ্ঠের তরল পানি সূর্যের আলো থেকে তাপ শক্তি গ্রহণ করে বাষ্পে পরিণত হয়ে বায়ুমণ্ডলে মিশে যায়।

ঊর্ধ্বপাতন (Sublimation): বরফ কিংবা তুষার সাধারণত গলে পানিতে রূপান্তরিত হয়, কিন্তু যদি বাতাসের চাপ কম থাকে এবং বাতাস শুষ্ক থাকে তাহলে ঊর্ধ্বপাতন প্রক্রিয়ায় বরফ কিংবা তুষার সরাসরি বাষ্পে পরিণত হতে পারে। শক্তি ব্যয়ের বিবেচনা করলে এটি কম শক্তি খরচ করে ঘটানো সম্ভব তাই পর্বত চূড়ার বরফে, কিংবা মেরু অঞ্চলে বরফ থেকে এই প্রক্রিয়ায় বরফ বাষ্পে রূপান্তরিত হয়ে বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করে থাকে।

প্রস্বেদন: বাষ্পীভবন ও ঊর্ধ্বপাতন এই দুটি প্রক্রিয়া ছাড়াও উদ্ভিদ তার পাতার মাধ্যমে প্রস্বেদন প্রক্রিয়ায় বায়ুমণ্ডলে প্রচুর পরিমাণ জলীয় বাষ্প নির্গমন করে থাকে।

ভূপৃষ্ঠে পানি

ঘনীভবন: বাতাসের জলীয় বাষ্প উপরে উঠে শীতল হয়ে ঘনীভবন প্রক্রিয়ায় ক্ষুদ্র জলকণায় এবং বরফ কণায় পরিণত হয়। এবং শেষ পর্যন্ত একত্রিত হয়ে মেঘে রূপান্তরিত হয়, যেগুলো আকাশে ঘুরে বেড়ায়।

বৃষ্টিপাত: ক্ষুদ্র জলকণা একত্র হয়ে এক সময় বড়ো পানির ফোটায় রূপান্তরিত হয়ে বৃষ্টির পানি হিসেবে আমাদের পৃথিবীপৃষ্ঠে ফিরে আসে। তবে বৃষ্টির ফোঁটা হিসেব তৈরির জন্য সেটিকে কোনো ধরনের ধূলিকণা বা অন্য কোনো কণার উপরে জমা হতে হয়। তাপমাত্রা বেশি কমে গেলে জলকণাগুলো বরফের কণায় রূপান্তরিত হয়ে তুষার কিংবা শিলাবৃষ্টি হিসেবে পৃথিবীতে নেমে আসে।

পানির প্রবাহ: বৃষ্টির পানির যে অংশ মাটি চুঁইয়ে ভূগহ্বরে ঢুকে না যায় সেটি ভূপৃষ্ঠের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে নদীনালা হয়ে শেষ পর্যন্ত সমুদ্রে এসে জমা হয়। কোনো কোনো স্থানে বাতাস কিছু জলীয়বাষ্পকে মেঘ হিসেবে বহন করে পাহাড়ের চূড়ায় নিয়ে যায়। মেঘ ঠান্ডা হয়ে সেখানে তুষারের সৃষ্টি করে। মেরু অঞ্চল বা পর্বতশৃঙ্গে যদি ঊর্ধ্বপাতন প্রক্রিয়ায় পানি বাষ্পীভূত হওয়ার হার থেকে তুষার গঠনের হার বেশি হয় তাহলে বরফের চূড়া গঠিত হয়। গরমকালে সূর্যের তাপে তুষার গলে পানিতে পরিণত হয় এবং সেই পানি পাহাড় থেকে নিচে নেমে আসতে থাকে। এভাবে পাহাড়ের ঢালে ছোটো ছোটো নদীর সৃষ্টি হয়। এসব ছোটো ছোটো নদী আবার সমতলভূমিতে পতিত হয়ে বড়ো নদীর সৃষ্টি করে। সবশেষে সেই পানি গিয়ে সাগরে পতিত হয়।

 ভূগর্ভে পানি

অনুপ্রবেশ (Infiltration): যে প্রক্রিয়ায় বৃষ্টির পানি মাটি চুইয়ে ভূগর্ভে ঢুকে যায় তাকে অনুপ্রবেশ বলে। ভূগর্ভে কতটুকু জমা হবে সেটি নির্ভর করে পানি কত গভীরে প্রবেশ করেছে এবং এবং সেখানে মাটির স্তর কীরকম তার উপর। পাথর কম পানি ধরে রাখতে পারে, সে তুলনায় মাটি বেশি পানি ধরে রাখতে পারে। ভূপৃষ্ঠে অনুপ্রবেশ করা পানি মাটির নিচে গিয়ে একুয়িফায়ার গঠন করতে পারে।

অর্থাৎ তোমরা বুঝতে পারছ ভূপৃষ্ঠের পানি থেকে জলীয় বাষ্প, সেই জলীয় বাষ্প থেকে মেঘ, মেঘ থেকে বৃষ্টি এবং তুষার এবং সেই বৃষ্টি এবং তুষার গলা পানি নদীতে প্রবাহিত হয়ে সর্বশেষ সাগরে পতিত হয়। এভাবে পানি চক্র আবর্তিত হয়। এখানে পানিচক্রের যে ধাপগুলোর কথা বলা হয়েছে সেগুলোর সুনির্দিষ্ট শুরু বা শেষ নেই। এগুলোর জন্য কোনো সময়ও বেধে দেওয়া যায় না কারণ এই পানিচক্র অবিরত ঘটে চলছে।

পানিচক্ষের গুরুত্ব

পানিচক্রের গুরুত্ব অপরিসীম। জলবায়ুর উপরেও পানিচক্রের অনেক বড়ো একটি প্রভাব রয়েছে উদাহরণ দেওয়ার জন্য বলা যায়, পানি বাষ্পীভূত হওয়ার সময় পরিবেশকে শীতল করে না রাখলে গ্রিন হাউস প্রক্রিয়ার কারণে পৃথিবীর তাপমাত্রা অসহনীয় হয়ে উঠত। এছাড়াও পানিচক্র বাতাসকে পরিশুদ্ধ করে। উদাহরণ দেওয়ার জন্য বলা যায় বৃষ্টির ফোঁটা গঠনের জন্য পানির ক্ষুদ্র কণাগুলো ধূলিকণার উপর জমা হয় এবং সেটিকে বায়ুমণ্ডল থেকে সরিয়ে পৃথিবীর মাটির উপর নামিয়ে আনে। শুধু তাই নয় বাতাসে ভাসমান অপদ্রব্যকে, এমনকি ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়াকেও বৃষ্টির পানি অপসারণ করে ফেলে বাতাসকে পরিশুদ্ধ করে।

১২.৬ অক্সিজেন চক্র

আমরা সবাই জানি বাতাসের 78% ভাগ হচ্ছে নাইট্রোজেন এবং 21% হচ্ছে অক্সিজেন। অন্য সব গ্যাস মিলিয়ে হচ্ছে বাকি 1%। পৃথিবীতে সবসময় কিন্তু বাতাসে এই পরিমাণ অক্সিজেন ছিল না। প্রায় 4.6 বিলিয়ন বছর আগে পৃথিবীতে সায়ানোব্যাকটেরিয়া সালোকসংশ্লেষণ করে অক্সিজেন তৈরি করা শুরু করে এবং প্রায় 300 মিলিয়ন বছর আগে পৃথিবীতে অক্সিজেনের পরিমাণ বর্তমান পর্যায়ে এসে পৌঁছায়। পৃথিবীর বেশিরভাগ জীব এই অক্সিজেন শ্বসন করে জীবন ধারণ করে, অর্থাৎ বলা যায় অক্সিজেন পৃথিবীতে প্রাণের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার ব্যাপারে একটি মূল ভূমিকা পালন করে। অক্সিজেন চক্রটি (চিত্র ১২.১৫) একটি জৈব রাসায়নিক চক্র এবং এই চক্রের মাধ্যমে পৃথিবীতে অক্সিজেনের পরিমাণ একটি স্থিতিশীল পর্যায়ে থাকে। এই চক্রটি শুধু বায়ুমণ্ডল নয়, পৃথিবীর জীবমণ্ডল ও পৃথিবী পৃষ্ঠের লিথোস্ফিয়ার পর্যন্ত বিস্তৃত। প্রকৃতপক্ষে  পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে যে পরিমাণ অক্সিজেন রয়েছে তার থেকে অনেক বেশি অক্সিজেন রয়েছে লিথোস্ফিয়ারে।

অক্সিজেন চক্রকে তিনভাগে ভাগ করা যায়। প্রথম ধাপে পৃথিবীর সকল সবুজ উদ্ভিদ সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ার জন্য বায়ুমণ্ডলের কার্বন ডাইঅক্সাইড গ্যাস গ্রহণ করে এবং নিজেদের জন্য খাদ্য তৈরি করে উপজাত দ্রব্য হিসেবে অক্সিজেন ত্যাগ করে। দ্বিতীয় ধাপে সকল শ্বসনকারী জীব তাদের শ্বসনের জন্য অক্সিজেন গ্রহণ করে। তৃতীয় ধাপে সকল জীব নিঃশ্বাসের সঙ্গে কার্বন ডাইঅক্সাইড ত্যাগ করে, যেটি আবার উদ্ভিদের কাছে সালোকসংশ্লেষণের জন্য ফেরত যায়। এভাবে বায়ুমণ্ডলে অক্সিজেনের পরিমাণ স্থিতিশীল থাকে। এখানে উল্লেখ্য, পৃথিবীর স্থলভাগ থেকে যে পরিমাণ অক্সিজেন নির্গত হয় সামুদ্রিক উদ্ভিদ থেকে সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে প্রায় সমপরিমাণ অক্সিজেন বের হয়। এছাড়াও পৃথিবীর লিথোস্ফিয়ার থেকেও কিছু পরিমাণ অক্সিজেন বায়ুমণ্ডলে আদান প্রদান হয়ে থাকে।

অক্সিজেন পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এই গ্যাসটি নিম্নলিখিত কাজে ব্যবহার করা হয়।

অক্সিজেন চক্রের গুরুত্বঃ

১। জীব শ্বসনের মাধ্যমে অক্সিজেন গ্রহণ করে এবং অক্সিজেনের সঙ্গে খাদ্যের দহনের মাধ্যমে নিজের জন্য শক্তি উৎপন্ন করে। 

২। রান্নার কাজে, গাড়িতে, শিল্পকারখানায় এবং আরও অনেক কিছুতেই শক্তি সৃষ্টি করার জন্য জ্বালানি দহন করা হয়, এইসব দহন কাজে অক্সিজেন ব্যবহার করা হয়।

৩। পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেন গ্রহণ করে জলজ প্রাণীরা জীবন ধারণ করে থাকে। 

৪। জৈব বর্জ্য পদার্থের পচন প্রক্রিয়ায় অক্সিজেন ব্যবহৃত হয়।

১২.৭ নাইট্রোজেন চক্র

নাইট্রোজেন চক্র (চিত্র ১২.১৬) পৃথিবীর বাস্তুতন্ত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। নাইট্রোজেন জীবের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি, কিন্তু বায়ুমণ্ডলে এটি বিপুল পরিমাণে থাকলেও কোনো প্রাণী বা উদ্ভিদ এটি সরাসরি ব্যবহার করতে পারে না। নাইট্রোজেন চক্র এমন একটি জৈবভূরাসায়নিক প্রক্রিয়া যেটি প্রায় নিষ্ক্রিয় নাইট্রোজেন গ্যাসকে জীবের ব্যবহারের উপযোগী করে রূপান্তরিত করে তুলে। এই চক্রের মাধ্যমে নাইট্রোজেন গ্যাস বায়ুমণ্ডল থেকে মাটিতে আসে এবং চক্র শেষে আবার বায়ুমণ্ডলে ফিরে যায়। নাইট্রোজেন চক্রের কয়েকটি সক্রিয় প্রক্রিয়া নিচে আলোচনা করা হলো।

নাইট্রোজেন ফিক্সেশান (Fixation): নাইট্রোজেন চক্র শুরু হয় নাইট্রোজেন ফিক্সেশান দিয়ে যেখানে নির্দিষ্ট ব্যাকটেরিয়া দিয়ে বায়ুমণ্ডলের নাইট্রোজেন অ্যামোনিয়াতে রূপান্তরিত হয়। এই ব্যাকটেরিয়াগুলো মাটিতেই থাকে এবং এটি হচ্ছে উদ্ভিদের সঙ্গে এই ব্যাকটেরিয়াগুলোর একধরনের সিম্বিওটিক সম্পর্ক।

নাইট্রিফিকেশন (Nitrification): এই প্রক্রিয়ায় অ্যামোনিয়া প্রথমে নাইট্রাইট পরে নাইট্রেট আয়নে রূপান্তরিত হয়। একবার নাইট্রেটে পরিণত হলে উদ্ভিদ খুব সহজে সেটি পুষ্টির অংশ হিসেবে গ্রহণ করতে পারে।

এসিমিনেশন (Assimilation): এই প্রক্রিয়ায় উদ্ভিদ মাটি থেকে নাইট্রেট গ্রহণ করে সেগুলো ব্যবহার করে নাইট্রোজেন গঠিত অ্যামিনো অ্যাসিড ও অন্যান্য অণু গঠন করে যেগুলো হচ্ছে ডিএনএ এবং প্রোটিন তৈরি করার গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। প্রাণী তাদের প্রয়োজনীয় নাইট্রোজেন উদ্ভিদ থেকে পেয়ে থাকে।

এমোনিফিকেশন (Ammonification): যখন উদ্ভিদ কিংবা প্রাণীর মৃত্যু ঘটে তখন ব্যাকটেরিয়া এবং ফানজাই তাদের দেহাবশেষ পচিয়ে আবার অ্যামোনিয়াতে রূপান্তরিত করে দেয়। নাইট্রোজেন ফিক্সেশানে প্রস্তুত অ্যামোনিয়া যেভাবে নাইট্রেটে পরিণত হয়, ঠিক একইভাবে অ্যামোনোফিকেশানে প্রস্তুত অ্যামোনিয়াও নাইট্রেটে পরিণত হয়।

ডিনাইট্রিফিকেশন (Denitrification): অক্সিজেনের ঘাটতি আছে এরকম এলাকায় এই প্রক্রিয়ায় ডিনাইট্রিফাইং ব্যাকটেরিয়া নাইট্রেটকে ভেঙে আবার নাইট্রোজেনে পরিণত করে বায়ুমণ্ডলে ফিরিয়ে দেয়।

এখানে উল্লেখ্য যে, অতিরিক্ত রাসায়নিক সার ব্যবহার করার কারণে মাটিতে নাইট্রেটের পরিমাণ বেড়ে গিয়ে সেটি একধরনের পরিবেশ দূষণের সৃষ্টি করেছে। কাজেই নাইট্রোজেন চক্রটির সঠিক নিয়ন্ত্রণ মানুষের জন্য একটি জরুরি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

নাইট্রোজেন চক্রের গুরুত্ব:

১। এই চক্র উদ্ভিদকে তার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জৈব অণু ক্লোরোফিল তৈরি করার ব্যাপারে সহায়তা করে। 

২। এমোনিফিকেশান প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ব্যাক্টেরিয়া এবং ফানজাই মৃত জীবের দেহাবশেষকে পচিয়ে পরোক্ষভাবে পরিবেশ পরিষ্কার করে রাখে। 

৩। নাইট্রাইট এবং নাইট্রেট তৈরি করে ভূমিতে প্রয়োজনীয় পুষ্টি প্রদান করার দায়িত্ব পালন করে। 

৪। নাইট্রোজেন জীবদেহের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, নাইট্রোজেন চক্র জীবদেহের গুরুত্বপূর্ণ জৈব অণুগুলো তৈরি করার বিষয়টি নিশ্চিত করে।

১২.৮ বিভিন্ন পরিবেশে জীবের অভিযোজন

প্রকৃতিতে বেঁচে থাকার জন্য জীবকে তার বাসভূমির পরিবেশে অভ্যন্ত হতে হয়, সে কারণে বৈরী পরিবেশেও আমরা জীবকে টিকে থাকতে দেখি। ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশে ভিন্ন ভিন্ন চ্যালেঞ্জ রয়েছে, যেমন- তাপমাত্রার পার্থক্য, খাদ্যের অপ্রতুলতা, শিকারি প্রাণীর বিচরণ, তারপরেও দীর্ঘ বিবর্তনে সেই পরিবেশেও বেঁচে থাকার মতো বৈশিষ্ট্য নিয়ে প্রাণী অভিযোজিত হয়েছে। প্রকৃতির বিভিন্ন পরিবর্তন ঘটলেও জীবসম্প্রদায়ের সংখ্যার অনুপাতের যে বড়ো পরিবর্তন হয় না তার পিছনে রয়েছে জীবের অভিযোজন ক্ষমতা। পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে বংশানুক্রমে বিবর্তনের মাধ্যমে নির্দিষ্ট পরিবেশে টিকে থাকার উপযোগী প্রজাতিটির মাঝে আমরা সেই পরিবেশের উপযোগী বিভিন্ন ধরনের শারীরিক ও শারীরবৃত্তীয় কার্যকলাপের পরিবর্তন দেখে থাকি। এর ফলে জীবটির অস্তিত্ব বংশানুক্রমিকভাবে সেই পরিবেশে টিকে থাকে। নিচের বিভিন্ন পরিবেশের উদাহরণগুলো থকে তোমরা এই অভিযোজন প্রক্রিয়া সম্পর্কে আরেকটু স্পষ্ট ধারণা পাবে  .

মরুভূমি: মরু অঞ্চলের প্রাণী অভিযোজনের জন্য বিভিন্ন ধরনের শারীরিক পরিবর্তন ঘটায়। যেমন- তাদের দেহে পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা থাকে, দেহ থেকে পানির নির্গমন কমানোর জন্য এদের ত্বক অনেক পুরু হয়, ঘর্মগ্রন্থির সংখ্যাও অনেক কম হয়, শরীরের উপর মোমজাতীয় পানি-অপ্রতিরোধ্য প্রলেপ থাকে। শুধু তাই নয় এই প্রাণীদের আচরণেও ভিন্নতা দেখা যায়, যেমন- দিনের সবচেয়ে উত্তপ্ত সময়ে এগুলো উন্মুক্ত স্থানে আসে না। উট এরকম প্রাণীর একটি উদাহরণ। তারা তাদের কুঁজে অনেক পানি সঞ্চয় করে রাখতে পারে, তাদের নাক এমনভাবে গঠিত যেন নিঃশ্বাসের সঙ্গে পানি হারিয়ে না যায়। শুধু তাই নয় উট অনেক উঁচু তাপমাত্রাও সহ্য করতে পারে।

ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সমুদ্র উপকূলে যেখানে মিঠাপানি এবং লোনাপানি সংযুক্ত হয়, সেখানকার উদ্ভিদগুলোতে লবণাক্ত পানি এবং লবণাক্ত মাটিতে টিকে থাকার বিশেষ বৈশিষ্ট্য রয়েছে। জোয়ার ও ভাটার পানির উচ্চতার তারতম্যে এরা খাপ খইয়ে নেয় এবং পানির নিচে থাকার পরও শ্বসনের জন্য মাটি ফুঁড়ে এখানকার কিছু কিছু উদ্ভিদের শ্বাসমূল বের হয়ে আসে। সুন্দরবনের সুন্দরী গাছ ম্যানগ্রোভ ফরেস্টের পরিবেশে টিকে থাকার জন্য এক ধরনের বিশেষ শ্বাসমূল তৈরি করে। আবার আলোক-উদ্দীপনা গাছগুলোকে আলোর দিকে পরিচালিত করে সালোকসংশ্লেষণের পরিমাণ বাড়ায়।

সামুদ্রিক পরিবেশ: সামুদ্রিক জীবের প্রধান প্রতিবন্ধকতা লবণাক্ততা, পানির চাপ এবং দেহে পানির সাম্যতা বজায় রাখা। সে কারণে তাদের দেহ সাঁতার কাটার উপযোগী হয়ে গড়ে উঠে, এবং পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেন গ্রহণ করার জন্য তাদের বিশেষ শ্বসন ব্যবস্থা থাকতে হয়। ডলফিন এই পরিবেশের উদাহরণ, এদের শরীর সাঁতারের উপযোগীভাবে গঠিত। তাদের সাঁতার দেওয়ার জন্য পাখনা (fin), গতি নিয়ন্ত্রণের জন্য ফ্লিপার থাকে। পানির পৃষ্ঠে শ্বাস নেওয়ার জন্য ডলফিনের ব্রো-হোল রয়েছে।

মেরু অঞ্চল: মেরু অঞ্চলের প্রাণীদের চরম শীতল তাপমাত্রা, খাদ্যের অপ্রতুলতা এবং দীর্ঘ সময় সূর্যালোকের অনুপস্থিতিতে থাকার জন্য অভিযোজন করতে হয়। তাই সাধারণত এই এখানকার প্রাণীদের ঘন লোম, তাপনিরোধক চর্বির স্তর, এবং দীর্ঘ শীতনিদ্রায় অভ্যস্ত হতে হয়। শ্বেতভালুক এদের উদাহরণ। তাদের ঘন লোম এবং পুরু চর্বির স্তর রয়েছে। তাদের ছোটো ছোটো কান এবং ছোটো লেজের কারণে কম তাপ হারিয়ে থাকে।

প্রতজীবী প্রাণী: এই প্রাণীদের অন্ধকার পরিবেশে থাকায় অভ্যস্ত হতে হয়। দৃষ্টি ব্যবহার করতে পারে না বলে এদের স্পর্শানুভূতি এবং গন্ধের অনুভূতি অনেক তীব্র হয়ে থাকে। সূর্যালোকের অভাবে এদের গায়ের রং হাল্কা হয়ে থাকে। দৃষ্টিহীন গুহার মাছ এদের উদাহরণ। অন্ধকারে থাকতে থাকতে এদের চোখের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়েছে কিন্তু অন্ধকারে খাবার অনুসন্ধান করার জন্য গন্ধ ও স্পর্শানুভূতি অনেক বেশি সংবেদনশীল হয়েছে।

পার্বত্য অঞ্চল: উঁচু স্থানের প্রাণীদের কম অক্সিজেনে অভ্যস্ত হতে হয়। তাদের ফুসফুসের আকার সাধারণত বড়ো হয় এবং অক্সিজেন সরবরাহের জন্য শ্বসনতন্ত্র অনেক বেশি দক্ষ। এই প্রাণীদের মেটাবোলিজম ধীরগতির হয়ে থাকে। হিমালয়ের টার (tahr) পাহাড়ি ছাগল-এর উদাহরণ, শীত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য এদের ঘন লোম হয়, এবং এগুলোর পায়ের খুর পাথুড়ে এলাকা আঁকড়ে ধরার উপযোগী হয়ে অভিযোজিত হয়েছে।

মানুষ সৃষ্ট পরিবেশ: মানুষের সৃষ্ট পরিবেশেও পশুপাখি অভিযোজিত হয়। শহুরে এলাকার প্রাণী রাত্রিজীবী হয়ে যায়, সেগুলো দালানকোঠা বা কংক্রিটের স্থাপনায় আস্তানা গড়ে তুলে, শুধু তাই নয় এগুলো মানুষের পরিত্যক্ত খাবারে অভ্যস্ত হয়ে যায়। ইঁদুর-এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। তারা দালানকোঠার ফাঁকফোকরে বসবাস করে এবং মানুষের উচ্ছিষ্ট খাবার খেয়ে বেঁচে থাকে।

পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়ার প্রচেষ্টায় যে প্রাণীগুলো বেশি অভ্যন্ত হবে সেগুলোই সফলভাবে টিকে থাকবে এবং বংশধরদের মাঝে এই অভিযোজিত বৈশিষ্ট্যগুলো দেখা যাবে। এভাবে পরিবেশের সঙ্গে অভিযোজিত হয়ে প্রাণীকুল নিজ প্রজাতির অস্তিত্ব রক্ষা করে এবং এভাবে বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য রক্ষা হয়ে থাকে।

 

Content added By
Promotion