টেলিফোন হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় এবং সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত একটি যোগাযোগ মাধ্যম। আমরা এখন এই টেলিফোন ব্যবহার করে পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে একজন মানুষের সাথে যোগাযোগ করতে পারি। ল্যান্ডফোন
1875 সালে আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল টেলিফোন আবিষ্কার করেছিলেন, নানা ধরনের বিবর্তনের মধ্য দিয়ে সেটি আধুনিক টেলিফোনে রূপ নিয়েছে, কিন্তু তার মূল কাজ করার প্রক্রিয়াটি এখনো আগের মতোই আছে।
তোমরা সবাই টেলিফোন দেখেছ এবং ব্যবহার করেছ। টেলিফোনে পাঁচটি উপাংশ থাকে। (a) সুইচ: যেটি মূল টেলিফোন নেটওয়ার্কের সাথে সংযুক্ত অথবা বিচ্ছিন্ন করে (b) রিংগার: যেটি শব্দ করে জানিয়ে দেয় যে কেউ একজন যোগাযোগ করেছে (c) কি প্যাড: যেটি ব্যবহার করে একজন অন্য একজনকে ডায়াল করতে পারে (d) মাইক্রোফোন: যেটি আমাদের কণ্ঠস্বরকে বৈদ্যুতিক সিগন্যালে পরিবর্তন করে (e) স্পিকার: যেটি বৈদ্যুতিক সিগন্যালকে শব্দে রূপান্তর করে শোনার ব্যবস্থা করে দেয়।
প্রত্যেকটি টেলিফোনই তামার তার দিয়ে আঞ্চলিক অফিসের সাথে যুক্ত থাকে। আমরা যখন কথা বলার জন্য কোনো নম্বরে ডায়াল করি তখন আঞ্চলিক অফিসে সেই তথ্যটি পৌঁছে যায়। সেখানে একটি সুইচ বোর্ড থাকে, যেটি নির্দিষ্ট গ্রাহকের টেলিফোনের সাথে যুক্ত করে দেয়। যদি আমরা অনেক দূরে কিংবা ভিন্ন কোনো দেশে একজনের সাথে কথা বলতে চাই তাহলে সুইচবোর্ড সেভাবে আমাদের নির্দিষ্ট নেটওয়ার্কের সাথে যুক্ত করে দেয়।
প্রযুক্তির উন্নতি হওয়ার আগে যখন পৃথিবীর দুই প্রান্তের দুজন মানুষ টেলিফোনে কথা বলত তখন কথাবার্তা পাঠানোর জন্য তাদের টেলিফোনকে তামার তার দিয়ে সংযুক্ত করে দিতে হতো, সে কারণে পুরো প্রক্রিয়াটা ছিল অনেক খরচসাপেক্ষ। আধুনিক যোগাযোগব্যবস্থার পুরোটা অনেক সহজ হয়ে গেছে, এখন একটি অপটিক্যাল ফাইবারে একই সাথে আক্ষরিক অর্থে লক্ষ লক্ষ মানুষের কথাবার্তা পাঠানো সম্ভব। তাই টেলিফোনে কথাবার্তা বলার বিষয়টি অনেক সহজ হয়ে গিয়েছে।
ল্যান্ডফোন যেহেতু তামার তার দিয়ে যুক্ত, তাই এটাকে একটা নির্দিষ্ট জায়গায় রাখতে হয় এবং টেলিফোন করার জন্য কিংবা টেলিফোন ধরার জন্য সেই জায়গাটিতে আসতে হয়। মোবাইল টেলিফোন আমাদের সেই বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্তি দিয়েছে এবং এই টেলিফোনটি আমরা আমাদের সাথে রেখে যেকোনো জায়গায় যেতে পারি এবং যতক্ষণ আমরা নেটওয়ার্কের ভেতরে আছি, যেকোনো নম্বরে ফোন করতে পারি, কথা বলতে কিংবা এসএমএস বিনিময় করতে পারি। সে কারণে মোবাইল ফোন এখন সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত এবং সবচেয়ে জনপ্রিয় যোগাযোগ মাধ্যম।
তোমরা সবাই দেখেছ মোবাইল টেলিফোন কোনো তার দিয়ে যুক্ত নয়, যার অর্থ এটি ওয়ারল্যাস বা রেডিও তরঙ্গ দিয়ে যোগাযোগ করে থাকে। কাজেই প্রত্যেকটি মোবাইল টেলিফোন আসলে একই সাথে একটি রেডিও ট্রান্সমিটার এবং একটি রেডিও রিসিভার।
ল্যান্ড টেলিফোনে যে যে যান্ত্রিক উপাংশ থাকা প্রয়োজন মোবাইল টেলিফোনেও সেগুলো কোনো না কোনো ৰূপে থাকতে হয়, তার সাথে আরো কয়েকটি বাড়তি বিষয় যুক্ত হয়। সেগুলো হচ্ছে (a) ব্যাটারি: এই ব্যাটারি দিয়ে মোবাইল ফোনের জন্য বৈদ্যুতিক শক্তি সরবরাহ করা হয় (b) স্ক্রিন: এই স্ক্রিনটিতে মোবাইল ফোনের যোগাযোগের তথ্য দেখানো হয় (c) সিম কার্ড: (SIM: Subscriber Identity Module) যেখানে ব্যবহারকারীর তথ্যগুলো সংরক্ষণ করা হয় (d) রেডিও ট্রান্সমিটার ও রিসিভার: এগুলো দিয়ে মোবাইল ফোন তার নেটওয়ার্কের সাথে যোগাযোগ করে (e) ইলেকট্রনিক সার্কিট: এটি মোবাইল টেলিফোনের জটিল কার্যক্রমকে ঠিকভাবে সম্পাদন করতে সাহায্য করে।
মোবাইল টেলিফোনে যোগাযোগ করার কাজটি সম্পন্ন করার জন্য পুরো এলাকাকে অনেকগুলো সেলে (Cell) ভাগ করে নেয় (চিত্র 13.16)। এজন্য মোবাইল টেলিফোনকে অনেক সময় সেলফোনও বলা হয়। প্রয়োজনের ওপর নির্ভর করে এই সেলগুলোর ব্যাসার্ধ 1 থেকে 20 কিলোমিটার পর্যন্ত হতে পারে। প্রত্যেকটা সেলে একটি করে বেস স্টেশন (BTS: Base Transceiver Station) থাকে। একটি এলাকার অনেকগুলো বেস স্টেশন একটা বেস স্টেশন কন্ট্রোলারের (BSC: Base Station Controller) মাধ্যমের মোবাইল সুইচিং কেন্দ্রের ( MSC: Mobile Service Switching) সাথে যোগাযোগ করে। মোবাইল সুইচিং কেন্দ্রটি মোবাইল নেটওয়ার্কের একটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ, এখানে প্রেরক আর গ্রাহকের মধ্যে যোগাযোগ করিয়ে দেওয়া হয়।
কেউ (প্রেরক) যখন তার মোবাইল ফোনে অন্য কোনো নাম্বারে (গ্রাহকের) ডায়াল করে তখন প্রেরকের মোবাইল ফোনটি সে যে সেলে আছে তার বেস স্টেশনের (BTS) সাথে যুক্ত হয়। সেই বেস স্টেশন থেকে তার কলটি বেস স্টেশন কন্ট্রোলারের (BSC) ভেতর দিয়ে মোবাইল সুইচিং কেন্দ্রে (MSC) পৌঁছায়। মোবাইল সুইচিং কেন্দ্র তার কাছে রাখা তথ্যভাণ্ডার থেকে গ্রাহক সেই মুহূর্তে কোন সেলের ভেতর আছে সেটি খুঁজে বের করে। তারপর প্রেরকের কলটি গ্রাহকের সেই সেলের বেস স্টেশনের সাথে যুক্ত করে দেয় এবং সেই বেস স্টেশন থেকে গ্রাহকের মোবাইল ফোনে রিং দেওয়া হয়।
মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ককে সচল রাখার জন্য অনেক ধরনের প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন করা হয়েছে। আমাদের মোবাইল টেলিফোন থেকে খুবই কম শক্তির সিগন্যাল ব্যবহার করে কাছাকাছি বেস স্টেশনের সাথে যুক্ত করা হয় এবং আমরা যদি একটি সেল থেকে অন্য সেলে চলে যাই এই নেটওয়ার্ক সেটি জানতে পারে এবং এক বেস স্টেশন থেকে অন্য বেস স্টেশনে যোগাযোগটি স্থানান্তর করে দেয়। একটি ঘনবসতিপূর্ণ শহরে যদি অনেক মোবাইল ফোন ব্যবহারকারী থাকে তাহলে ছোট ছোট অনেক সেল দিয়ে তাদের ফোন করার সুযোগ দেওয়া হয়। আবার গ্রামের কম জনবসতি এলাকায় একটি অনেক বড় সেল দিয়ে পুরো এলাকা নেটওয়ার্কের সাথে যুক্ত রাখা হয়।
এখানে উল্লেখ্য যে, শুরুতে শুধু কথা বলার জন্য টেলিফোন উদ্ভাবন করা হয়েছিল। পরে মোবাইল টেলিফোনে কথার সাথে সাথে এসএমএস পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। এখন স্মার্টফোন নামে নতুন যে ফোনগুলো এসেছে সেগুলো কণ্ঠস্বরের (Voice) সাথে সাথে সব ধরনের তথ্য (Data) আদান প্রদান করতে পারে। কাজেই সেগুলো সরাসরি ইন্টারনেটের সাথে যুক্ত হতে পারে এবং আগে যে কাজগুলো কম্পিউটার বা ল্যাপটপ ছাড়া করা সম্ভব ছিল না সেগুলো এই স্মার্টফোন দিয়ে করা সম্ভব হয়েছে। শুধু তাই নয়, এই স্মার্টফোনগুলোর জন্য নানা ধরনের অ্যাপ (Application) তৈরি হচ্ছে সেগুলো দিয়ে স্মার্টফোন আমাদের আরো নানা ধরনের কাজ করতে সাহায্য করে।
স্মার্টফোন একদিকে আমাদের জীবনযাত্রার একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে। একই সাথে খুব সহজে স্মার্টফোনে ইন্টারনেটে যুক্ত হওয়ার সুযোগের কারণে নতুন প্রজন্ম সামাজিক নেটওয়ার্ক জাতীয় বিষয়গুলোতে অনেক অপ্রয়োজনীয় সময় ব্যয় করছে, সেটি এই মুহূর্তে শুধু আমাদের দেশের নয়, সারা পৃথিবীর একটি বড় সমস্যা।
ফ্যাক্স শব্দটি হচ্ছে ফ্যাক্সিমিন (Facsimile) এর সংক্ষিপ্ত রূপ। ফ্যাক্স করা বলতে আমরা বোঝাই কোনো ডকুমেন্টকে কপি করে টেলিফোন লাইন ব্যবহার করে তাৎক্ষণিকভাবে সরাসরি পাঠিয়ে দেওয়া। বর্তমান যুগে কম্পিউটার, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক, ইন্টারনেট এই ফ্যাক্স প্রযুক্তিকে অনেক পেছনে ফেলে এসেছে, তারপরও প্রায় সব প্রতিষ্ঠানই এখনো এই প্রাচীন কিছু নির্ভরযোগ্য প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে যাচ্ছে। শুনে অবাক লাগতে পারে, ফ্যাক্স পাঠানো হয় টেলিফোন লাইন দিয়ে কিন্তু প্রথম ফ্যাক্সের ধারণাটি পেটেন্ট করা হয় টেলিফোন আবিষ্কারেরও ত্রিশ বছর আগে।
ফ্যাক্স মেশিন একই সাথে একটা ডকুমেন্টের কপি পাঠাতে পারে এবং এই মেশিনে পাঠানো একটি কপিকে প্রিন্ট করে দিতে পারে। ফ্যাক্স মেশিনে যখন একটি ডকুমেন্ট দেওয়া হয় তখন সেখানে উজ্জ্বল আলো ফেলা হয়, ডকুমেন্টের কালো অংশ থেকে কম এবং সাদা অংশ থেকে বেশি আলো প্রতিফলিত হয়, সেই তথ্যগুলো সংরক্ষণ করে ডকুমেন্টটির কপিকে বৈদ্যুতিক সিগন্যালে রূপাস্তর করে টেলিফোন লাইন দিয়ে পাঠানো হয় ।
টেলিফোন লাইনের অন্য প্রান্তে ফ্যাক্স মেশিনটি তার কাছে পাঠানো ডকুমেন্টের কপিটিকে একটি প্রিন্টারে প্রিন্ট করে দেয়। ফ্যাক্স মেশিন এখনো একটি নির্ভরযোগ্য প্রযুক্তি, এটি একটি ডকুমেন্টের কপিকে শুধু সাদা এবং কালো হিসেবে পাঠানো হয় বলে লিখিত ডকুমেন্টের জন্য ঠিক থাকলেও রঙিন কিংবা ফটোগ্রাফের জন্য উপযুক্ত নয়। এছাড়া বেশির ভাগ ফ্যাক্স মেশিনে থার্মাল পেপার ব্যবহার করা হয় বলে ডকুমেন্টটি খুব তাড়াতাড়ি অস্পষ্ট হয়ে যেতে পারে।
আরও দেখুন...