তথ্যমূলক লেখার বৈশিষ্ট্য

অষ্টম শ্রেণি (মাধ্যমিক ২০২৪) - বাংলা - Bangla - লেখা পড়ি লেখা বুঝি | | NCTB BOOK

যেসব বৈশিষ্ট্য থাকলে কোনো লেখাকে তথ্যমূলক লেখা বলা যায়, সেসব বৈশিষ্ট্যের মধ্য থেকে তিনটি বৈশিষ্ট্য নিচে লেখো। লেখার পরে সহপাঠীর সঙ্গে আলোচনা করো এবং প্রয়োজনে সংশোধন করো।

 

                                                                                                                                                                                                                                                                                                                           

                                                                                                                                                                                                                                                                                                                           

                                                                                                                                                                                                                                                                                                                           

 

 

 

নিচে মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র লেখা একটি তথ্যমূলক রচনা দেওয়া হলো।

 

মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ (১৮৮৫-১৯৬৯) বিখ্যাত ভাষাবিদ। তিনি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বে এমএ ডিগ্রি এবং প্যারিসের সোরবোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিলিট ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের 'সংস্কৃত ও বাংলা' বিভাগে তিনি শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। তাঁর লেখা বইয়ের মধ্যে আছে 'বাংলা ভাষার ইতিবৃত্ত', 'বাংলা ভাষার ব্যাকরণ', 'বাংলা সাহিত্যের কথা' ইত্যাদি। 'আঞ্চলিক ভাষার অভিধান' তাঁর সম্পাদিত একটি গুরুত্বপূর্ণ অভিধান।

 

 

ইবনে বতুতার ভ্রমণ

মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্

 

ইবনে বতুতা মরক্কোর তানজাহ শহরে ১৩০৪ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। ১৩২৬ খ্রিষ্টাব্দে ২২ বছর বয়সে হজের উদ্দেশ্যে তিনি জন্মভূমি থেকে রওনা হন। ভূমধ্যসাগরের তীরস্থ আফ্রিকার প্রধান প্রধান শহরগুলি ভ্রমণ করে শেষে তিনি মিসরে উপস্থিত হন। সেখান থেকে আলেকজান্দ্রিয়া বন্দরে পৌঁছে মক্কা শরিফে যাওয়ার উদ্যোগ নেন। সেই দেশের রাজা তখন মোগলদের সঙ্গে যুদ্ধ করছিলেন। ইবনে বতুতা সেজন্য সেখানে কোনো জাহাজ না পেয়ে পুনরায় মিসরে ফিরে আসেন। সেখান থেকে তিনি সিরিয়া যান। দামেস্কে গিয়ে হাদিসের বিদ্যায় দক্ষতা লাভ করেন। তাঁর শিক্ষকগণের মধ্যে দুজন বিদুষী রমণীও ছিলেন। তারপর তিনি সেখান থেকে গত বছরের হজের সংকল্প পূরণের জন্য প্রথমত মদিনা শরিফে উপস্থিত হন। পরে মক্কা শরিফে গিয়ে হজ সম্পন্ন করেন।

 

হজ শেষ করে তিনি ইরানি কাফেলার সাথে ইরাকে পৌঁছান। নাজাফ আশরাফ দেখার জন্য বাগদাদে যান। সেখান থেকে ওয়াসেত, ওয়াসেত থেকে রওয়াকে সৈয়দ আহমদ রেফায়ির কবর জিয়ারত করেন। সেখান থেকে বশরা এবং বশরা থেকে তিনি ইরানের সারহাদে পৌঁছেন। কিছুদিন শুশতারে অবস্থান করে ইস্পাহান হয়ে শিরাজ নগরে উপস্থিত হন। সেখানে সুফি শেখ আবু আবদুল্লাহ খফিফ এবং বিখ্যাত নীতিকার শেখ সাদির কবর দর্শন করেন। সেখান থেকে গায়রুন বন্দর হয়ে পুনরায় ইরাকে উপস্থিত হয়ে কুফায় পৌঁছান। সেখান থেকে দ্বিতীয়বার বাগদাদে আসেন। ধ্বংস হয়ে গেলেও তখন বাগদাদ বড়ো শহর ছিল। বাগদাদ থেকে মসুল এবং মারভিন হয়ে ইবনে বতুতা দ্বিতীয় হজের জন্য ১৩২৯ খ্রিষ্টাব্দে মক্কা শরিফে উপস্থিত হন। সেখানে তিনি দুই বছর থাকেন। পরে চতুর্থ বার হজ করে জেদ্দায় যান।

 

 

জেদ্দা থেকে জাহাজে উঠে লোহিত সাগরের অপর তীরে আফ্রিকা ভ্রমণ করে ইয়েমেন আসেন। পরে এডেন থেকে জাহাজে চড়ে আফ্রিকার পূর্ব তীরে পৌঁছান। সেখান থেকে জাঞ্জিবার ও উল্লুজা ভ্রমণ করে জাহাজ যোগে আরবের দক্ষিণ ভাগে হাজরামাউতের জাফর শহরে আসেন। সেখানে থেকে ওমান হয়ে হরমুজ শহরে উপস্থিত হন। সেখানে বিখ্যাত দাতা বাদশাহ তহন্তনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সেখান থেকে তিনি আনাতোলিয়ায় চলে যান। তখন আনাতোলিয়ায় অরাজক ছিল। বুরসা থেকে জাহাজে চড়ে কৃষ্ণসাগরের তীরে তীরে শহর দেখতে দেখতে কাজাখ মরুভূমিতে উপস্থিত হন। পরে ছয় মাসের রাস্তা অতিক্রম করে ক্রিমিয়ায় পৌঁছান। তখন ক্রিমিয়া সুলতান উজবুকের রাজত্বাধীন ছিল। এই রাজা চেঙ্গিস খাঁর বংশসম্ভূত ছিলেন। রাশিয়ার অধিকাংশ তাঁর পদানত ছিল। ভলগা নদীর তীরস্থ সরায় তাঁর রাজধানী ছিল।

 

সেখান থেকে ইবনে বতুতা বুলগার দেশে যান। রাশিয়ার উত্তরাংশকে এই নামে অভিহিত করা হতো। তখন রমজান মাস ছিল এবং দিন বাড়ার ঋতু ছিল। রোজা খুলে মাগরিব ও এশার নামাজ তাড়াতাড়ি পড়তে না পড়তে সকাল হতো। সেখান থেকে উত্তর মহাসাগর পর্যন্ত তাঁর যাবার ইচ্ছা ছিল। ঈদের দিন পর্যন্ত তিনি বাদশাহ শিবিরে রইলেন। যখন তিনি বাদশার সঙ্গে হাজী তুরখান শহরে ছিলেন, তখন বাদশার এক বেগম যিনি কুসতুনতিনিয়ার খ্রিষ্টান রাজার কন্যা ছিলেন, কুসতুনতিনিয়া যাবার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। ইবনে বতুতা তাঁর সাথে কুসতুনতিনিয়ায় গিয়ে পুনরায় সরায় শহরে ফিরে এলেন।

সেখান থেকে বোখারায় পৌঁছালেন। সেখানে চেঙ্গিস খাঁর বংশীয় সুলতান আলাউদ্দিন তরমশিয়ারিনের দরবারে কিছুদিন থেকে সমরখন্দে চলে যান। সেখান থেকে বাল্ব, বাল্ব থেকে হিরাত, সেখান থেকে জাম, মশহদ ও নয়শাবুর ভ্রমণ করে কুন্দুস দিয়ে আন্দরাব ও পাঞ্জশির রাস্তা দিয়ে পাশাই ও পারোয়ান হয়ে গজনি ও চরখে পৌঁছালেন। সেখান থেকে কাবুলে গেলেন। কাবুল থেকে কির্মাশ হয়ে সম্ভবত কুরাম পাস দিয়ে সিন্ধু নদীর পশ্চিম তীরে ডেরা ইসমাইল খাঁ, ডেরা গাজি খাঁ এবং কাশ্মীর এলাকা দিয়ে মরুভূমির পথে সিন্ধুর তীরবর্তী ভক্করের নিকট কোনো স্থানে ১৩৩৩ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বর মাসে ইবনে বতুতা উপস্থিত হলেন।

 

পরে ভক্কর হয়ে সিন্ধুর মোহনাস্থিত বন্দর লাহিরীতে উপস্থিত হলেন। সেখান থেকে মুলতানে এলেন। মুলতান থেকে যাত্রা করে অযোধ্যা অর্থাৎ পাকপট্রনের ঘাট পার হয়ে শতদ্রু অতিক্রম করলেন। সেখানে থেকে পুরাতন দিল্লিতে উপস্থিত হলেন। বাদশাহ সুলতান মুহম্মদ তুঘলক তাঁকে বিশেষ সম্মান করে শহরের কাজি নিযুক্ত করলেন। ইবনে বতুতা নয় বছর পর্যন্ত দিল্লিতে থাকেন।

 

১৩৪২ খ্রিষ্টাব্দের জুলাই মাসে তিনি চীনরাজের নিকট বাদশাহর দূতরূপে উপহার দ্রব্য নিয়ে যেতে নিযুক্ত হন। দিল্লিতে অবস্থানকালে তিনি কনৌজ, আমরোহা ও বিজনোর ভ্রমণ করেছিলেন। এখন দিল্লি থেকে তালপাত, বিয়ানা, কোইল, কনৌজ, গোয়ালিয়র, চন্দেরী ও ধার হয়ে উজ্জয়িনী পৌঁছালেন। সেখান থেকে দৌলতাবাদ এলেন। দৌলতাবাদ থেকে ফিরে সাগরতীরে পৌঁছে সেখান থেকে খাম্বায়েতে উপস্থিত হলেন। বাহারুচের নিকটবর্তী কন্ধার বন্দরে জাহাজে সওয়ার হয়ে ঘোঘা, গোয়া ও হানুর হয়ে মালাবারে পৌঁছালেন।

পরে মালাবারের বন্দর হয়ে কালিকটে উপস্থিত হলেন। সেখানে জাহাজ ভেঙে গেল। জাহাজের সমস্ত লোক ও বাদশাহর উপহার দ্রব্য নষ্ট হয়ে গেল। ভাগ্যক্রমে ইবনে বতুতা তখন জাহাজে ছিলেন না, তাই বেঁচে গেলেন। বাদশাহর ভয়ে ইবনে বতুতা দিল্লি ফিরে না গিয়ে হানুরের সুলতান জামালুদ্দিনের দরবারে উপস্থিত হলেন। হানুর থেকে ফিরে শালিয়াতে এলেন। সেখান থেকে জাহাজে করে ১৩৪৩ খ্রিষ্টাব্দের আগস্ট মাসে মালদ্বীপে উপস্থিত হলেন।

ঠিক এক বছর পরে ইবনে বতুতা মালদ্বীপ হতে রওনা হয়ে সিংহলে পৌঁছালেন। সেখানে রাজার সঙ্গে বাতালাবাত্তা নগরে সাক্ষাৎ করে এবং বাবা আদমের পদচিহ্ন জিয়ারত করে মবরে (কর্ণাটক রাজ্যে) উপস্থিত হলেন। সেখানে তাঁর শ্বশুর সৈয়দ জলালুদ্দিন আহমদ বাদশাহ মুহম্মদ শাহ তুঘলক থেকে বিদ্রোহী হয়ে মাদুরাই রাজত্ব করছিলেন। তিনি ইবনে বতুতার আগমনের পূর্বেই মারা গিয়েছিলেন। ইবনে বতুতা সেখান থেকে কোলাম চলে এলেন। সেখানে তিনি তিন মাস থাকলেন। সেখান থেকে হানুর যাত্রা করার উদ্দেশে তিনি জাহাজে যাচ্ছিলেন, পথে জলদস্যুগণ তাঁর জাহাজ লুট করে নেয়। অন্যান্য সামগ্রীর সঙ্গে তাঁর স্মারকলিপিও অপহৃত হয়। এজন্য ইবনে বতুতার ভ্রমণবৃত্তান্তে মধ্যে মধ্যে কিছু গোলযোগ দেখা যায়। ইবনে বতুতা কালিকটে ফিরে এলেন। সেখান থেকে পুনরায় মালদ্বীপে উপস্থিত হলেন।

সেখান থেকে জাহাজে রওনা হওয়ার ৪৩ দিন পরে বাংলাদেশের সপ্তগ্রাম বন্দরে উপস্থিত হলেন। পরে নদীপথে কামরূপে গিয়ে শেখ জালালুদ্দিন তাবরিজির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সেখান থেকে সোনারগাঁয়ে উপস্থিত হন। ১৩৪৬-৪৭ খ্রিষ্টাব্দে ইবনে বতুতা বাংলায় এসেছিলেন।

সোনারগাঁ থেকে একটা চীনা জাহাজে চড়ে ইবনে বতুতা আরাকান ও পেগুর তীর দিয়ে সুমাত্রায় উপস্থিত হন। তখন সেখানে মালিক জাহির রাজা ছিলেন। সুমাত্রা থেকে মূল জাভা পৌঁছান। মূল জাভা সম্ভবত শ্যাম, কম্বোডিয়া ও কোচিন। সেখান থেকে চীন দেশে গিয়ে কিছু দিন সেখানে পরিভ্রমণ করে পুনরায় সুমাত্রায় উপস্থিত হন।

সেখানে দুই মাস থেকে জাহাজে রওনা হন এবং ৪০ দিন পরে কোলাম পৌঁছান। সেখানে তিনি রমজান মাস কাটিয়ে ঈদের নামাজ পড়েন। ১৩৪৭ খ্রিষ্টাব্দের এপ্রিল মাসে আরবের জাফর শহরে উপস্থিত হন। পরে মাসকাট, শিরাজ, ইয়াজদ, ইস্পাহান ও শুশতার হয়ে এবং বশরা ও কুফা ভ্রমণ করে ১৩৪৮ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি মাসে বাগদাদে পৌঁছালেন। সেখান থেকে সিরিয়া ঘুরে মিসর, তুনিস, সার্ভনিয়া ও স্পেন হয়ে ১৩৪৯ খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবর মাসে মরক্কোর রাজধানী ফেজ শহরে উপস্থিত হলেন। এভাবে ২৫ বছর বিদেশ ভ্রমণের পরে ইবনে বতুতা স্বদেশে ফিরে আসেন। কিন্তু দেশে ফিরেও তিনি স্থির থাকতে পারেননি। তিনি সুদান ভ্রমণে বের হন। ভ্রমণ শেষ করে ১৩৫৩ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি বাড়ির দিকে রওনা হয়ে ১৩৫৪ খ্রিষ্টাব্দে বাড়ি পৌঁছালেন। তিনি মোট ২৮ বছরে ৯৫ হাজার মাইল পথ পর্যটন করেন। তিনি ১৩৭৮ খ্রিষ্টাব্দে ৭৩ বছর বয়সে মারা যান। ১৩৫৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি তাঁর ভ্রমণ বৃত্তান্ত রচনার কাজ শেষ করেছিলেন।

(সংক্ষেপিত)

 

 

শব্দের অর্থ

 

উদ্যোগ: প্রস্তুতি। 

বিদুষী: বিদ্বান (নারীবাচক)। 

তীরস্থ: তীরবর্তী। 

বৃত্তান্ত: বিবরণ। 

পদানত: পরাজিত। 

সওয়ার: আরোহী। 

বংশোদ্ভূত: বংশে জন্ম নেওয়া। 

স্মারকলিপি: সম্মিলিত আবেদনপত্র।

 

এই রচনায় ব্যবহৃত স্থাননাম

 

আফগানিস্তান: আন্দরাব, কুন্দুস, কুরাম পাস, গজনি, চরখ, পাঞ্জ শির, পারোয়ান, পাশাই, হিরাত। 

আফ্রিকা: আলেকজান্দ্রিয়া, উল্লুজা, ক্রিমিয়া, জাঞ্জিবার, তানজাহ, তুনিস, ফেজ, মরক্কো, মশহদ, মিশর। 

আরব দেশ: ইয়ামেন, এডেন, ওমান, জাফর, জেদ্দা, দামেস্ক, মদিনা, মাসকাট, সিরিয়া, হাজরামাউত। 

ইউরোপ : বুলগার, সরায়, সার্ভনিয়া, স্পেন, হাজী তুরখান। 

ইন্দোনেশিয়া: সুমাত্রা। 

ইরাক: ওয়াসেত, কির্মাশ, কুফা, নাজাফ আশরাফ, বশরা, বাগদাদ, মারভিন, রওয়াক। 

ইরান: ইয়াজদ, ইস্পাহান, গায়রুন, নয়শাবুর, শিরাজ, শুশতার, হরমুজ।

উজবেকিস্তান: বোখারা।

কাজাখাস্তান: কাজাখ। 

তুরস্ক: আনাতোলিয়ায়, বুরসা।

ভারত: অযোধ্যা, আমরোহা, উজ্জয়িনী, কনৌজ, কন্ধার, কামরূপ, কালিকট, কাশ্মীর, কোইল, কোলাম, গোয়া, গোয়ালিয়র, ঘোঘা, চন্দেরী, তালপাত, দৌলতাবাদ, পাকপট্টন, বাহারুচ, বিজনোর, বিয়ানা, মাদুরাই, মালাবার, মুলতান, লাহিরী, শালিয়াত, সপ্তগ্রাম, হানুর।

মায়ানমার: পেগু।

Content added || updated By
Promotion