তাপ গতিবিদ্যার প্রথম সূত্র প্রকৃতপক্ষে শক্তির নিত্যতা সূত্রেরই একটি বিবৃতি। বিজ্ঞানী ক্লসিয়াস এই সূত্রকে সাধারণ রূপে বর্ণনা করেন। তাঁর মতে, কোনো সিস্টেমে তাপ শক্তি অন্য কোনো শক্তিতে রূপান্তরিত হলে অথবা অন্য কোনো শক্তি তাপে রূপান্তরিত হলে সিস্টেমের মোট শক্তির পরিমাণ একই থাকে ।
পরিমাণ তাপশক্তি সরবরাহ করার ফলে যদি কোনো সিস্টেমের অভ্যন্তরীণ শক্তির পরিবর্তন এবং সিস্টেম
কর্তৃক পরিবেশের ওপর বাহ্যিক কৃতকাজের পরিমাণ হয়, তাহলে
= + ... (1.9)
ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পরিবর্তনের সময় এই সমীকরণকে লেখা যায়,
dQ = dU +dW….. (1.10)
এখানে বা dQ ধনাত্মক ধরা হবে যদি সিস্টেমে তাপ সরবরাহ করা হয়। পক্ষান্তরে তাপশক্তি যদি সিস্টেম থেকে পরিবেশে যায় তাহলে বা dQ ঋণাত্মক হবে। সিস্টেম কর্তৃক পরিবেশের ওপর কাজ সম্পাদিত হলে বা dW ধনাত্মক হবে এবং পরিবেশ সিস্টেমের ওপর কাজ সম্পাদন করলে বা dW ঋণাত্মক হবে। সিস্টেমের অভ্যন্তরীণ শক্তি বৃদ্ধি পেলে বা dU ধনাত্মক হবে আর সিস্টেমের অভ্যন্তরীণ শক্তি হ্রাস পেলে বা dU ঋণাত্মক হবে । তাপগতিবিদ্যার প্রথম সূত্র ব্যবহারে চিহ্ন সম্পর্কে সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন।
(1.10) সমীকরণ থেকে দেখা যায় যে,
dU =dQ - dW
অর্থাৎ কোনো সিস্টেমের অভ্যন্তরীণ শক্তির পরিবর্তন হচ্ছে সিস্টেমে যে পরিমাণ শক্তি তাপ হিসেবে প্রবাহিত হচ্ছে এবং যে পরিমাণ শক্তি কাজ হিসেবে সিস্টেম থেকে পরিবেশে যাচ্ছে তার পার্থক্যের সমান।
ধরা যাক, ঘর্ষণহীন পিস্টন সংযুক্ত কোনো সিলিন্ডারের মধ্যে কিছু গ্যাস আবদ্ধ আছে (চিত্র ১-১)। পিস্টনের প্রস্থচ্ছেদের ক্ষেত্রফল A গ্যাসের চাপ p হলে পিস্টনের ওপর গ্যাসের চাপজনিত মোট বলের পরিমাণ হবে pA। এখন এই বলের সমান একটি বাহ্যিক বল F পিস্টনের ওপর ক্রিয়াশীল হলে পিস্টনটি সাম্যাবস্থায় থাকবে।
এখন ধরা যাক, গ্যাস প্রসারিত হয়ে পিস্টনটিকে বাইরের দিকে খুব ক্ষুদ্র দূরত্ব dx পরিমাণ সরিয়ে নিল। dx খুব ক্ষুদ্র হওয়ায় গ্যাসের চাপ অপরিবর্তনশীল বিবেচনা করা যায়। F বলের বিরুদ্ধে বাহ্যিক কাজের পরিমাণ dw হলে,
dW = Fdx = p A dx
:- dw = p dv
এখানে dV = A dx = গ্যাসের আয়তনের ক্ষুদ্র প্রসারণ।
স্থির চাপে গ্যাসের আয়তন V1 থেকে V2-তে পরিবর্তিত হলে গ্যাস কর্তৃক মোট কৃত কাজ,
অর্থাৎ কৃত কাজ = চাপ x আয়তনের পরিবর্তন
(1.10) সমীকরণে কাজের মান বসিয়ে তাপগতিবিদ্যার প্রথম সূত্রকে লেখা যায়,
dQ = dU + p dv
সাধারণভাবে যে কোনো তাপগতীয় প্রক্রিয়ায় কৃতকাজের পরিমাণ pV রৈখিক চিত্র-এর সাহায্যে নির্ণয় করা যায়। এই রৈখিক চিত্রকে নির্দেশক চিত্র বলে। X অক্ষে আয়তন V এবং Y অক্ষে চাপ p নিয়ে নির্দেশক চিত্র বা pV রৈখিক চিত্র অঙ্কন করা হয়।
যদি গ্যাসের চাপ এর আয়তনের সাথে পরিবর্তিত হয় তাহলে নির্দেশক চিত্রের রূপ চিত্র ১.২-এর ন্যায় হবে। গ্যাসের এই পরিবর্তনের জন্য কৃতকাজের পরিমাণ নির্দেশক চিত্রের aABb ক্ষেত্রের ক্ষেত্রফলের সমান হবে।
যে প্রক্রিয়ায় কোনো সিস্টেমের তাপমাত্রা স্থির থাকে যাতে করে বয়েলের সূত্র প্রয়োগ করা যায় তাকে সমোষ্ণ প্রক্রিয়া বলে।
ধরা যাক, আমাদের সিস্টেম হচ্ছে একটি গ্যাসভর্তি সিলিন্ডার যার সাথে একটি নড়নক্ষম পিস্টন লাগানো আছে। সিলিন্ডারের দেয়ালের মধ্য দিয়ে সিস্টেমে তাপ প্রবেশ করতে কিংবা সিস্টেম থেকে বেরিয়ে যেতে পারে।
যদি সিস্টেমে খুব ধীরে ধীরে তাপ সরবরাহ করা যায় তাহলে গ্যাসের চাপ ও আয়তনের পরিবর্তন হবে যদিও এর তাপমাত্রার কোনো পরিবর্তন হবে না। এরূপ পরিবর্তনকে সমোষ্ণ পরিবর্তন বলা হয়। এর ফলে গ্যাসের যে প্রসারণ হয় তাকে সমোষ্ণ প্রসারণ বলে।
সমোষ্ণ প্রক্রিয়ার pV রৈখিক চিত্র ১.৩ চিত্রে দেখানো হয়েছে। এই রৈখিক চিত্রকে সমোষ্ণরেখ বলে।
সমোষ্ণ প্রক্রিয়ায় উষ্ণতা স্থির থাকে বলে সিস্টেমের অভ্যন্তরীণ শক্তির কোনো পরিবর্তন হয় না অর্থাৎ dU = 0।
সুতরাং তাপগতিবিদ্যার প্রথম সূত্র থেকে আমরা পাই,
dQ=0+dW
:- dW= dQ.. .. (1.14)
অর্থাৎ সমোষ্ণ প্রক্রিয়ায় কোনো সিস্টেম কর্তৃক কৃতকাজ সিস্টেমে সরবরাহকৃত তাপশক্তির সমান। সমোষ্ণ প্রক্রিয়ায়
P1V1 = P2V2 হবে ।
সিস্টেমটিকে পরিবেশ থেকে তাপীয়ভাবে অন্তরিত করে অথবা গ্যাসকে দ্রুত প্রসারিত অথবা সঙ্কুচিত করলে রুদ্ধতাপীয় প্রক্রিয়া পাওয়া যায়। এই প্রক্রিয়ায় সিস্টেমের যে পরিবর্তন হয় তাকে রুদ্ধতাপীয় পরিবর্তন বলে। এর ফলে গ্যাসের যে প্রসারণ হয় তাকে রুদ্ধতাপীয় প্রসারণ, আর গ্যাস সঙ্কুচিত হলে তাকে রুদ্ধতাপীয় সঙ্কোচন বলে। যেহেতু রুদ্ধতাপীয় প্রক্রিয়ায় সিস্টেমে কোনো তাপ প্রবেশ করতে পারে না বা সিস্টেম থেকে কোনো তাপ বেরিয়ে যেতে পারে না সুতরাং dQ = 0 । অতএব, তাপগতিবিদ্যার প্রথম সূত্র থেকে আমরা পাই,
0 = dU+dW
:. dw=-dU ... (1.15)
রুদ্ধতাপীয় প্রসারণের সময় সিস্টেম কর্তৃক সম্পাদিত কাজ সিস্টেমের অভ্যন্তরীণ শক্তি দ্বারা সম্পাদিত হয় বলে সিস্টেমের অভ্যন্তরীণ শক্তি তথা তাপমাত্রা হ্রাস পায় অর্থাৎ সিস্টেম শীতল হয়। পক্ষান্তরে রুদ্ধতাপীয় সঙ্কোচনের সময় বাইরে থেকে শক্তি সরবরাহ করে সিস্টেমের ওপর কাজ সম্পাদিত হয় বলে সিস্টেমের অভ্যন্তরীণ শক্তি বৃদ্ধি পায় ফলে সিস্টেমের তাপমাত্রাও বৃদ্ধি পায়।
সুতরাং রুদ্ধতাপীয় প্রসারণে সিস্টেম শীতল হয় আর রুদ্ধতাপীয় সঙ্কোচনে সিস্টেম উষ্ণ হয়।
১.৪ চিত্রে কোনো আদর্শ গ্যাসের ক্ষেত্রে T1এবং T2 তাপমাত্রার জন্য দুটি সমোষ্ণ রেখা দেখানো হয়েছে। গ্যাসের আদি তাপমাত্রা T1 এবং আদি আয়তন V1 ফলে T1 সমোষ্ণ রেখার ওপর এ বিন্দু দ্বারা এর অবস্থা (অর্থাৎ চিত্র : ১.৪ P1, V1, T1) সূচিত হয়েছে। গ্যাসটি রুদ্ধতাপীয়ভাবে প্রসারিত হয়ে V2 আয়তন প্রাপ্ত হলে এর উষ্ণতা হ্রাস পেয়ে T2 হয় এবং T2 সমোষ্ণ রেখার ওপর B বিন্দু দ্বারা এর অবস্থা (অর্থাৎ P2, V2, T2 ) নির্দেশ করা হয়। A ও B বিন্দুর মধ্য দিয়ে অঙ্কিত নিরেট রেখাটি দ্বারা রুদ্ধতাপীয় পরিবর্তনের জন্য গ্যাসটির চাপ ও আয়তনকে সম্পর্কিত করা হয়। এই রেখাকে রুদ্ধতাপ রেখা বলে। ১.৪ চিত্রে দেখা যায় যে, সমোষ্ণ রেখার চেয়ে রুদ্ধতাপীয় রেখা বেশি খাড়া।
কোনো পদার্থের m মোলের তাপমাত্রা কেলভিন বৃদ্ধি করতে যদি জুল তাপশক্তির প্রয়োজন হয় তাহলে ঐ পদার্থের মোলার আপেক্ষিক তাপ,
একক: মোলার আপেক্ষিক তাপের একক : J (mol)-1 K-1
তাপমাত্রার পরিবর্তনের জন্য পদার্থের চাপ এবং আয়তনের পরিবর্তন ঘটে। কঠিন ও তরল পদার্থের জন্য এই পরিবর্তন নগণ্য হওয়ায় তা উপেক্ষা করা যায়। গ্যাসের ক্ষেত্রে তাপমাত্রার পরিবর্তনের জন্য চাপ ও আয়তনের পরিবর্তন অনেক বেশি হওয়ার জন্য গ্যাসের আপেক্ষিক তাপের সংজ্ঞা দেয়ার সময় চাপ ও আয়তনের শর্ত নির্দিষ্ট করে দেয়া প্রয়োজন। দুটি ক্ষেত্রের প্রতি আমরা বিশেষভাবে আগ্রহী : (i) যখন চাপ স্থির থাকে এবং (ii) যখন আয়তন স্থির থাকে ।
স্থির চাপে গ্যাসের মোলার আপেক্ষিক তাপ, Cp : চাপ স্থির রেখে এক মোল গ্যাসের তাপমাত্রা এক কেলভিন বৃদ্ধি করতে প্রয়োজনীয় তাপশক্তিকে স্থির চাপে গ্যাসের মোলার আপেক্ষিক তাপ, Cp, বলে ।
চাপ স্থির রেখে m মোল গ্যাসের তাপমাত্রা T কেলভিন বৃদ্ধি করতে যদি Q জুল তাপশক্তির প্রয়োজন হয় তাহলে স্থির চাপে ঐ গ্যাসের মোলার আপেক্ষিক তাপ,
স্থির আয়তনে গ্যাসের মোলার আপেক্ষিক তাপ, Cv: আয়তন স্থির রেখে কোনো গ্যাসের এক মোলের তাপমাত্রা এক কেলভিন বাড়াতে প্রয়োজনীয় তাপশক্তিকে স্থির আয়তনে গ্যাসের মোলার আপেক্ষিক তাপ, Cv বলে।
আয়তন স্থির রেখে m মোল গ্যাসের তাপমাত্রা T কেলভিন বৃদ্ধি করতে যদি Q জুল তাপশক্তির প্রয়োজন হয় তাহলে স্থির আয়তনে ঐ গ্যাসের মোলার আপেক্ষিক তাপ,