দৈনন্দিন জীবনে রসায়নের ব্যবহার

অষ্টম শ্রেণি (মাধ্যমিক ২০২৪) - বিজ্ঞান (অনুসন্ধানী পাঠ) - Science (Investigative Study) - | NCTB BOOK
42
42

তোমরা আগের কয়েকটি অধ্যায়ে বিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা রসায়নের প্রাথমিক একটি ধারণা পেয়েছ। তোমরা যখন রসায়ন সম্পর্কে আর জানবে তখন আমাদের দৈনন্দিন জীবনে এর গুরুত্ব দেখে বিস্মিত হবে। উদাহরণ দেওয়ার জন্য বলা যায়, আমরা খাবারকে ঠিক রাখার জন্য ফুড প্রিজারভেটিভ ব্যবহার করি। অন্যদিকে, বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক সামগ্রী অনেক সময় খাবারকে অনিরাপদ করে তোলে। এছাড়া নিরাপদ পানীয়, বিভিন্ন পরিষ্কারক প্রসাধন সামগ্রীসহ আরও অনেক কিছুতে রসায়নের অনেক প্রয়োগ রয়েছে। তোমরা জানো যে, মাটির উর্বরতা বাড়ানোর জন্য আমরা বিভিন্ন ধরনের সার ব্যবহার করে থাকি। এই সারও নানা ধরনের রাসায়নিক পদার্থ দ্বারা তৈরি। আবার শিল্প কারখানা থেকে যে সকল বর্জ্য তৈরি হয়, তা অনেক সময় পরিবেশকে দূষিত করে। এই শিল্প বর্জ্যও রাসায়নিক পদার্থ। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থের ভূমিকা রয়েছে। এই সকল রাসায়নিক পদার্থ কীভাবে প্রস্তুত করা হয়, তাদের বৈশিষ্ট্য ও ব্যবহার কী এবং সেগুলো আমাদের জীবনে কী ধরনের প্রভাব ফেলে এই অধ্যায়ে সেই বিষয়গুলো সংক্ষেপে আলোচনা করা হবে।

14.1 গৃহস্থালির রসায়ন

রসায়ন তোমার দৈনন্দিন জীবনের একটি বড়ো অংশ। যেমন-খাবার, বাতাস, পানি, জীবন রক্ষাকারী ঔষধ, পরিষ্কার করার রাসায়নিক এবং যা কিছু আমরা দেখতে বা স্পর্শ করতে পারি, এমন প্রতিটি বস্তুতে রসায়ন বা রসায়নের ব্যবহার খুঁজে পাওয়া যাবে। আমরা যদি খাবারের কথা বলি তাহলে দেখবে সেখানেও রসায়নের অনেক বড়ো ভূমিকা রয়েছে। উদাহরণ হিসেবে এই অধ্যায়ে খাবার লবণ, বেকিং সোডা ও ভিনেগার এই তিনটি খাদ্য সামগ্রীর রসায়ন নিয়ে আলোচিনা করা হবে।

14.1.1 খাদ্য সামগ্রীর রসায়ন (Food Chemistry)

(ক) খাবার লবণ বা সোডিয়াম ক্লোরাইড (NaCl)

আমরা জানি যে সমুদ্রের পানিতে প্রচুর পরিমাণে খাবার লবণ (NaCl) থাকে, সঙ্গে খুবই সামান্য পরিমাণে ক্যালসিয়াম ক্লোরাইড (CaCl₂), ম্যাগনেসিয়াম ক্লোরাইড (MgCl₂) সহ অন্যান্য কিছু লবণ থাকে। আমাদের দেশে আমরা সমুদ্রের পানি থেকে খাবার লবণ সংগ্রহ করে থাকি। কক্সবাজার জেলার বিভিন্ন উপজেলায় সমুদ্র উপকূলের লবণচাষিরা বিভিন্ন আকৃতির জমির চারপাশে বাঁধ তৈরি করে একপাশ খানিকটা খুলে রাখে। সমুদ্রের জোয়ারের সময় যখন পানি ঐ জায়গায় প্রবেশ করে, তখন পানি প্রবেশের মুখ বন্ধ করে জোয়ারের পানি আটকে রাখা হয়। সূর্যের তাপে ঐ জায়গার পানি বাষ্পীভূত হয়ে গেলে লবণ দেখতে পাওয়া যায়। লবণ চাষের মাধ্যমে পাওয়া লবণকে শিল্প কারখানায় পরিশোধিত করে খাওয়ার উপযোগী লবণে পরিণত করা হয়।

আমাদের শরীরের বিভিন্ন কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের জন্য বিভিন্ন আয়ন, যেমন-সোডিয়াম আয়ন (Na+), পটাসিয়াম আয়ন (K+), ইত্যাদির প্রয়োজন হয়। শরীরে কোনো কারণে সোডিয়াম আয়নের ঘাটতি হলে তখন এই খাবার লবণ তার ঘাটতি পূরণে ভূমিকা রাখে।

 সোডিয়াম ক্লোরাইডের (NaCl) ব্যবহার: সোডিয়াম ক্লোরাইড বা খাদ্য লবণের খাদ্য সংক্রান্ত ব্যবহার ছাড়াও অন্যান্য ক্ষেত্রেও নানবিধ ব্যবহার রয়েছে। নিচে লবণের কিছু ব্যবহারের কথা বলা হলো :

1) লবণ দীর্ঘদিন ধরে খাবারের স্বাদ বের করে আনার জন্য ব্যবহার করা হয়। 

2) খাবার সংরক্ষণের কাজে লবণ অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, যেমন-নোনা ইলিশ। 

3) রান্না করার সময় পানির তাপমাত্রা বাড়ানোর জন্য লবণ ব্যবহার করা হয়। 

4) ডায়রিয়া হলে মানুষের শরীরে পানিশূন্যতা তৈরি হয়। এই পানিশূন্যতা দূর করার জন্য খাবার স্যালাইন খাওয়ানো হয়। আর খাবার স্যালাইন বানানোর অন্যতম উপাদান হচ্ছে লবণ। 

5) শীতপ্রধান দেশে রাস্তায় জমে থাকা বরফ গলিয়ে ফেলার জন্য লবণ ছিটিয়ে দেওয়া হয়। 

6) ট্যানারি শিল্পে সংগৃহীত পশুর চামড়া প্রাথমিকভাবে রক্ষা করার জন্য লবণ ব্যবহার করা হয়। 

7) লবণ ব্লিচিং, মৃৎপাত্র, সাবান এবং ক্লোরিন উৎপাদনেও ব্যবহৃত হয়। রাসায়নিক শিল্পে সোডিয়াম হাইড্রোক্সাইড (NaOH) যৌগ প্রস্তুত করার জন্য লবণ ব্যবহার করা হয়। এছাড়া, অন্যান্য শিল্প কারখানায়ও এর ব্যাপক ব্যবহার রয়েছে।

(খ) বেকিং সোডা

বেকিং সোডা হচ্ছে সোডিয়াম বাইকার্বোনেট (NaHCO₃) যা অনেক সময় খাবার সোডা নামে পরিচিত। বেকিং পাউডার বেকিং সোডা থেকে একটু ভিন্ন কারণ তাতে বেকিং সোডার সঙ্গে অল্প পরিমাণ টারটারিক অ্যাসিডের পাউডার মেশানো থাকে।

বেকিং সোডার ব্যবহার: বেকিং সোডার নানাবিধ ব্যবহার রয়েছে। নিচে কিছু ব্যবহার উল্লেখ্য করা হলো

1) সাধারণত কেক এবং বিস্কিট প্রস্তুত করার সময় বেকিং পাউডার ব্যবহার করা হয়। বেকিং পাউডারকে যখন পানি এবং ময়দার সাথে মিশানো হয় তখন CO₂ উৎপন্ন হয়, এই CO₂ বুদবুদ তৈরি করে, যার ফলে কেকের মিশ্রণটি ফুলে উঠে বা প্রসারিত হয়। বেকিং পাউডারে থাকা বেকিং সোডা (NaHCO₃) টারটারিক অ্যাসিডের (C₂H₂O) সঙ্গে বিক্রিয়া করে CO₂, এবং H₂O উৎপন্ন করে। বিক্রিয়াটি নিচে দেখানো হলো:

<math xmlns="http://www.w3.org/1998/Math/MathML"><mi>J</mi><mi>a</mi><mi>H</mi><mi>C</mi><msub><mi>O</mi><mn>3</mn></msub><mo>+</mo><msub><mi>C</mi><mn>4</mn></msub><msub><mi>H</mi><mn>6</mn></msub><msub><mi>O</mi><mn>6</mn></msub><mo> </mo><mo>→</mo><mo> </mo><msub><mi>C</mi><mn>4</mn></msub><msub><mi>H</mi><mn>4</mn></msub><mi>N</mi><msub><mi>a</mi><mn>2</mn></msub><msub><mi>O</mi><mn>6</mn></msub><mo>+</mo><mn>2</mn><mi>C</mi><msub><mi>O</mi><mn>2</mn></msub><mo>+</mo><mn>2</mn><msub><mi>H</mi><mn>2</mn></msub><mi>O</mi><mo> </mo></math>

বেকিং পাউডারের পরিবর্তে বেকিং সোডা ব্যবহার করা হলে কেক ফুলিয়ে তোলার জন্য আলাদাভাবে অ্যাসিড জাতীয় কোনো উপাদান মেশাতে হয়।

2) বেকিং সোডা পেটে অ্যাসিডিটি কমাতে সহায়তা করে। এটি অ্যান্টাসিড হিসেবে কাজ করতে পারে যা পেট খারাপ এবং বদহজমের চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত হয়।

3) পোকার কামড়ের ব্যথা নিরাময়ে বেকিং সোডা ব্যবহার করা যায়। 

4) গৃহস্থালি কাজে পরিষ্কার করার জন্য এবং দুর্গন্ধ দূর করার জন্য বেকিং সোডা ব্যবহার করা হয়। 

5) বেকিং সোডা কীটনাশক হিসেবেও কাজ করতে পারে। 

6) এটি কানের ড্রপ, টুথপেস্ট, মাউথওয়াশ ও শ্যাম্পুতে ব্যবহৃত হয়। 

7) সাবানের ফেনা তৈরি করতে পারে বলে এটি অগ্নি-নির্বাপক কাজে ব্যবহৃত হয়।

(গ) ভিনেগার

ভিনেগার হলো অ্যাসিটিক অ্যাসিড (CH, COOH) এর একটি জলীয় দ্রবণ। ভিনেগারে 5-10% অ্যাসিটিক অ্যাসিড থাকে। বিভিন্ন ফলের রস থেকে ভিনেগার তৈরি করা হয়, তাই বাজারে নানা ধরনের ভিনেগার পাওয়া যায়। খাদ্য সামগ্রী, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং গৃহস্থালি কাজে ভিনেগার ব্যবহার করা হয়।

ভিনেগারের ব্যবহার:

1। খাদ্য সংরক্ষণে ভিনেগারের ভূমিকা রয়েছে। আচার ঠিক রাখতে ভিনেগার ব্যবহার করা হয়। যদি আচার তৈরিতে ভিনেগার ব্যবহার করা হয়, তাহলে তাতে ব্যাকটেরিয়া আক্রমণ করতে পারে না। ভিনেগারের অ্যাসিটিক অ্যাসিড (CH, COOH) যখন আচারে দেওয়া হয়, তখন সেখান থেকে ত্যাগকৃত H' ব্যাকটেরিয়াকে ধংস করে দিতে পারে। ফলে খাবার দীর্ঘদিন ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণ থেকে রক্ষা পায়।'

2। খাবারের স্বাদ এবং ঘ্রাণ বাড়ানোর কাজে ভিনেগার ব্যবহার করা হয়। 

3। আয়না, কাচ কিংবা টেবিল পরিষ্কার করতে, রান্নাঘর কিংবা বাথরুম দুর্গন্ধমুক্ত করতে এবং গৃহস্থালি কাপড়, কার্পেট কিংবা সোফায় দাগ দূর করতে ভিনেগার ব্যবহার করা হয়। 

4) চুল, ত্বক কিংবা পরিশ্রান্ত পায়ের পাতা সতেজ করতে ভিনেগারের দ্রবণ ব্যবহার করা হয়। 

5) বাগানের আগাছা দূর করার জন্যও ভিনেগার ব্যবহার করা যায়।

14.1.2 পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার রসায়ন

আমাদের সুস্থ থাকতে হলে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার বিকল্প নেই। আমাদের শরীর এবং চারপাশের সবকিছু পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকলে মনও ভালো থাকে। এই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য আমরা বিভিন্ন ধরনের পরিষ্কারক ব্যবহার করে থাকি। আমাদের শরীর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য প্রসাধনী সাবান ব্যবহার করি। কাপড়-চোপড় পরিষ্কার করার জন্য কাপড় কাচা সাবান বা সোডা ব্যবহার করি। জীবাণুনাশক হিসেবে ব্লিচিং পাউডারের ব্যবহার রয়েছে। এছাড়া 80-95% ইথানল বা আইসো প্রোপাইল অ্যালকোহল করোনাভাইরাসের মতো অতি সংক্রামক জীবাণু ধংস করার জন্য ব্যবহার করা হয়। ঘরের জানালার কাচ বা অন্যান্য কাচদ্রব্য পরিষ্কারের কাজে গ্লাস ক্লিনার ব্যবহার করা হয়। টয়লেট পরিষ্কার করার জন্য টয়লেট ক্লিনার ব্যবহার করা হয়। এগুলো সবই রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় তৈরি করা হয়, অর্থাৎ পরিষ্কার- পরিচ্ছন্নতার জন্য রসায়নের ভূমিকা অনেক গুরুত্বপূর্ণ।

পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত কয়েকটি সামগ্রী সম্পর্কে নিচে আলোচনা করা হলো।

(ক) কাপড় কাচা সোডা

সোডিয়াম কার্বনেট (Na,CO,) হচ্ছে সোডা অ্যাস, এই সোডা অ্যাসের একটি অণুর সঙ্গে দশ অণু পানি (HO) রাসায়নিকভাবে যুক্ত হলে তাকে কাপড় কাচা সোডা বা ওয়াশিং সোডা বলা হয়। সেজন্য কাপড় কাচা সোডার রাসায়নিক নাম হচ্ছে সোডিয়াম কার্বনেট ডেকা হাইড্রেট (Na,CO, 10H,O)। কাপড় কাচা সোডা কাপড় থেকে দুর্গন্ধ দূর করতে, দাগ সরাতে এবং পরিষ্কার করতে ব্যবহার করা হয়।

(খ) টয়লেট ক্লিনার

টয়লেট ক্লিনারের মূল উপাদান হচ্ছে সোডিয়াম হাইড্রোক্সাইড (NaOH)। এর সঙ্গে কিছু পরিমাণ সোডিয়াম হাইপোক্লোরাইট (NaOCl) মিশ্রিত থাকে। টয়লেট, বেসিন এবং কমোডে চর্বি ও প্রোটিন জাতীয় পদার্থ, বিভিন্ন রঙ জাতীয় জৈব ও অজৈব পদার্থ এবং বিভিন্ন ধরনের জীবাণু থাকে। বেসিন, কমোড ইত্যাদি পরিষ্কার করার জন্য এই টয়লেট ক্লিনার ব্যবহার করা হয়।'

টয়নেট ক্লিনার দ্বারা পরিষ্কার করার কৌশন: টয়লেট ক্লিনারে বিদ্যমান সোডিয়াম হাইপোক্লোরাইট (NaOCl) পানির সাথে বিক্রিয়া করে সোডিয়াম হাইপোক্লোরাস অ্যাসিড (HOCI) এবং সোডিয়াম হাইড্রোক্সাইড (NaOH) উৎপন্ন করে।

NaOCI + H₂O + NaOH + HOCI

সোডিয়াম হাইড্রোক্সাইড ক্ষারধর্মী হওয়ার কারণে চর্বি ও প্রোটিন জাতীয় পদার্থকে পরিষ্কার করতে সাহায্য করে। অন্যদিকে, হাইপোক্লোরাস অ্যাসিড (HOCI) ভেঙে হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড (HCI) ও জায়মান অক্সিজেন [0] উৎপন্ন করে। (তৃতীয় বন্ধনীর মধ্যে লিখে [0] জায়মান অক্সিজেনকে বোঝানো হয়)

HOCI + H₂O HCl + [0]

এই জায়মান অক্সিজেন রঙিন পদার্থকে বর্ণহীন করে এবং জীবাণুকেও ধ্বংস করে। এভাবে টয়লেট ক্লিনার রঙিন জাতীয় পদার্থকে বর্ণহীন করে ও জীবাণু ধংস করে টয়লেট পরিষ্কারে কাজ করে থাকে।

গ) সাবান

সোডিয়াম স্টিয়ারেট বা পটাসিয়াম স্টিয়ারেট হচ্ছে সাবানের রাসায়নিক নাম। সোডিয়াম স্টিয়ারেটের সংকেত CH, COONa এবং পটাসিয়াম স্টিয়ারেটের সংকেত C₁₂H₃, COOK। তেল বা চর্বির সঙ্গে 35 35 NaOH বা KOH বিক্রিয়া করে সাবান তৈরি করা হয়। সাবান তৈরির এই প্রক্রিয়াকে সাবানায়ন (saponification) বলে।'ব্যবহারের উপর ভিত্তি করে সাবানকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়-প্রসাধনী সাবান ও লন্ড্রি সাবান। গোসল করা, হাত-মুখ ধোয়া বা ত্বক পরিষ্কার করার জন্য প্রসাধনী সাবান ব্যবহার করা হয়। অন্যদিকে কাপড় কাচা বা পরিষ্কার করার জন্য আমরা যে সাবান ব্যবহার করি তাদেরকে কাপড় কাচা সাবান বা লন্ড্রি সাবান বলে।'

(ঘ) ডিটারজেন্ট

প্রাকৃতিক উপাদান দিয়ে সাবান তৈরি করা হয়, অন্যদিকে রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় কৃত্রিম উপায়ে ডিটাজেন্ট তৈরি করা হয়। সোডিয়াম লরাইল সালফেট (C₁₂H₂SO₄ Na) হচ্ছে ডিটারজেন্টের অন্যতম প্রধান রাসায়নিক উপাদান। ডিটারজেন্ট সাবানের মতোই পরিষ্কারক রাসায়নিক দ্রব্য, এটি তরল ও পাউডার দুভাবেই বাজারে পাওয়া যায়। ডিটারজেন্টকে ব্যবহারউপযোগী করার জন্য এতে বিভিন্ন পদার্থ যোগ করা হয়, কাজেই ডিটারজেন্ট পরিষ্কারক হিসেবে অনেক কার্যকর হলেও পরিবেশের প্রতি সাবানের মতো নমনীয় নয়।

সাবান দিয়ে ময়লা পরিষ্কার করার কৌশন (Cleansing mechanism of soap): কাপড়ে কিংবা আমাদের ত্বকে যে সমস্ত ময়লা লেগে থাকে অনেক সময়েই তা জৈব জাতীয় পদার্থ এবং পানিতে অদ্রবণীয়। কাজেই শুধু পানি দিয়ে ধুয়ে এই ময়লা পরিষ্কার করা যায় না। সাবান (C, H, COONa) একটি দীর্ঘ কার্বন শিকল বিশিষ্ট অণু। পানিতে দ্রবীভূত অবস্থায় এরা ঋণাত্মক চার্জবিশিষ্ট C,H, COO আয়ন এবং ধনাত্মক চার্জযুক্ত Na' এ ভাগ হয়ে যায়। ঋণাত্মক চার্জযুক্ত প্রান্ত পানিকে আকর্ষণ করে বলে এই প্রান্তকে হাইড্রোফিলিক বা পানিআকর্ষী বলে। ধনাত্মক চার্জযুক্ত অন্য প্রান্ত তেল বা গ্রিজে দ্রবীভূত হয় এবং এই প্রান্তকে হাইড্রোফোবিক বা পানিবিকর্ষী বলা হয়। পানির উপস্থিতিতে সাবান যখন তেল বা গ্রিজ জাতীয় ময়লাযুক্ত কাপড়ের সংস্পর্শে আসে, তখন হাইড্রোফোবিক প্রান্ত তেল বা গ্রিজ জাতীয় পদার্থের দিকে আকর্ষিত হয়ে এতে দ্রবীভূত হয়। অন্যদিকে, হাইড্রোফিলিক প্রান্ত পানির দিকে আকর্ষিত হয় এবং তেলজাতীয় ময়লার কণা সাবান বা ডিটারজেন্টের চার্জযুক্ত আয়ন দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে ময়লার কণার চারপাশে একটি বলয় তৈরি করে। এই অবস্থায় কাপড়কে ধোয়ার উদ্দেশ্যে ঘষা দিলে বা মোচড়ানো হলে ময়লার কণাটি মুক্ত হয়ে সরে আসে। এভাবেই সাবান কিংবা ডিটারজেন্ট কাপড় কিংবা ত্বকের ময়লা অথবা জীবাণু পরিষ্কার করে থাকে।

অতিরিক্ত সাবান বা ডিটারজেন্ট ব্যবহারে সতর্কতা: সাবান প্রস্তুতের সময় সাবানের মধ্যে কিছু পরিমাণ ক্ষার থেকে যায়। ফলে অতিরিক্ত সাবান ব্যবহার করলে হাতের ত্বকের ক্ষতি হতে পারে। আবার অনেক সময় পুকুর, জলাশয় বা নদীর তীরে সাবান বা ডিটারজেন্ট ব্যবহার করলে সাবান ও ডিটারজেন্ট থেকে নির্গত ফেনা পুকুর, জলাশয় বা নদীর পানিতে মিশে যায়; এই ফেনা পানিতে থাকা দ্রবীভূত অক্সিজেনের সঙ্গে বিক্রিয়া করে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ কমিয়ে দেয়। ফলে পানির মধ্যে থাকা জলজ উদ্ভিদ ও মাছ মারা যায়। এভাবেই অতিরিক্ত সাবান ও ডিটারজেন্ট ব্যবহারে পানি দূষিত হয়।

প্রসাধনী ব্যবহারে সতর্কতা: আমরা ত্বক পরিষ্কার রাখতে, ত্বকের সৌন্দর্য রক্ষায়, চুল পরিষ্কার করতে এবং বিভিন্ন কাজে সাবান, শ্যাম্পু, ক্রিম এধরনের প্রসাধন সামগ্রী ব্যবহার করে থাকি। আমাদের ত্বক অম্লীয় প্রকৃতির হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই জীবাণুর আক্রমণ বা সংক্রমণ থেকে ত্বক রক্ষা পেয়ে থাকে। প্রসাধনীতে ক্ষারীয় উপাদান বেশি থাকলে তা ত্বকের স্বাভাবিক অম্লত্ব কমিয়ে দিতে পারে, ফলে জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যাবে।

(ঙ) ব্লিচিং পাউডার

ব্লিচিং পাউডারের রাসায়নিক নাম ক্যালসিয়াম হাইপোক্লোরাইড (Ca(OCl))। কাপড়ে বলপেনের কালি বা অন্য কোনো রং লাগলে যা সাবান বা ডিটারজেন্ট ব্যবহার করলেও পরিষ্কার হয় না, সেক্ষেত্রে ব্লিচিং পাউডার দিয়ে সেগুলো পরিষ্কার করা যায়। এছাড়া, মেঝে, বেসিন ও অন্যান্য জায়গায় জীবাণু ধ্বংস করার কাজেও ব্লিচিং পাউডার ববহার করা হয়। সুইমিং পুলের পানি জীবাণুমুক্ত করার জন্য কিংবা পানীয় জলকে পরিশুদ্ধ করার জন্য ব্লিচিং পাউডার ব্যবহৃত হয়।

14.2 কৃষি ও শিল্পক্ষেত্রে রসায়ন

কৃষি এবং শিল্প ক্ষেত্রে রসায়ন একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। উভয় ক্ষেত্রেই রসায়ন নতুন নতুন উদ্ভাবন করে আমাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করার জন্য সচেষ্ট রয়েছে।

কৃষি ক্ষেত্রে রাসায়নিক সারের ব্যবহার ফসল উৎপাদনে একটি অনেক বড়ো ভূমিকা রেখেছে। এই সার ফসলে প্রয়োজনীয় পুষ্টি সরবরাহ করে এবং তাদের ফলন বহুগুণে বৃদ্ধি করে। সারের পাশাপাশি রাসায়নিক কীটনাশক ফসলকে কীটপতঙ্গ, রোগ এবং আগাছা থেকে রক্ষা করে। রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় মাটিকে বিশ্লেষণ করে কোন মাটিতে কোন ফসল ফলানো সম্ভব এবং তার জন্য কোন ধরনের সার কতটুকু প্রয়োগ করতে হবে সে ব্যাপারে কৃষকদের সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে। রসায়নের সহায়তা নিয়ে বিভিন্ন কৃষিজাত ফসল ও ফলমূল সংরক্ষণ করার জন্য প্রয়োজনীয় নিরাপদ ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয় এবং খাবারের রসায়ন দিয়ে কৃষিজাত খাদ্যের পুষ্টিগুণ নির্ণয় করা হয়।

বিভিন্ন শিল্প ও কলকারখানায় নানা ধরণের রাসায়নিক দ্রব্যের প্রয়োজন হয়। এই রাসায়নিক দ্রব্য উৎপাদন করার জন্য রাসায়নিক শিল্প রসায়নের উপরেই নির্ভর করে। এই শিল্প অন্য শিল্পের জন্য কাঁচামাল, ফার্মাসিউটিক্যালস, প্লাস্টিক এবং আরও অনেক কিছু উৎপাদন করে থাকে। নতুন পদার্থ উদ্ভাবনে রসায়ন একটি বড়ো ভূমিকা পালন করে, যেটি বিভিন্ন পলিমার, কম্পোজিট কিংবা ন্যানোম্যাটেরিয়ালের মতো উন্নত পদার্থ বের করে যাচ্ছে। বর্তমানে নবায়নযোগ্য শক্তির উপর অনেক গুরুত্ব দেওয়ার জন্য ব্যাটারি, ফুয়েল সেল ইত্যাদির উপর নির্ভরতা অনেক বেড়ে গেছে এবং এই শিল্পগুলো প্রায় এককভাবেই রসায়ন শিল্পের উপর নির্ভর করে। রসায়নের উপর নির্ভরশীল যে শিল্পটির কথা আলাদাভাবে বলা প্রয়োজন সেটি হচ্ছে ফার্মাসিউটিক্যাল বা ওষুধ শিল্প। এই শিল্প মানুষের রোগের চিকিৎসা এবং জনস্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য নতুন ওষুধ ও ভ্যাকসিন আবিষ্কার করে যাচ্ছে।

কাজেই এক কথায় বলা যায়, কৃষি এবং শিল্পের বিকাশে রসায়নের অবদানের কোনো তুলনা নেই।

কৃষিদ্রব্য প্রক্রিয়াকরণ এবং সংরক্ষণে বাসায়নিক দ্রব্য:

যে প্রক্রিয়ায় রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করে কোনো কৃষিজাত দ্রব্য (যেমন-ফলমূল, শাকসবজি, মাছ, ইত্যাদি) দীর্ঘদিন ভালো রাখা যায় বা পচন রোধ করা যায়, সেই প্রক্রিয়াকে কৃষিদ্রব্য প্রক্রিয়াকরণ বলে। কৃষিদ্রব্য যাতে দুর্গন্ধ না হয় এবং এগুলোতে যেন পচন না ধরে সেজন্য বরফ, খাবার লবণ, ভিনেগার, ইত্যাদি দ্বারা সংরক্ষণ করা হয়। উদাহরণ দেয়ার জন্য বলা যায় আমরা মাছ সংরক্ষণের জন্য বরফ ব্যবহার করি, কোল্ড স্টোরেজে আলু সংরক্ষণ করি। ঠিক সেরকম টম্যাটো, কাঁচা আম, ইত্যাদি কোনো পাত্রে দীর্ঘদিন রাখার জন্য ভিনেগার ব্যবহার করা হয়।

এখানে উল্লেখ্য, ফরমালিন দ্বারা খাদ্যদ্রব্য সংরক্ষণ করা উচিত নয়। ফরমালিন মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণীর জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে, এমনকি আমাদের শরীরে ফরমালিন প্রবেশ করে মৃত্যুর কারণও হতে পারে।

ফুড প্রিজারভেটিভ (Food preservative):

খাদ্যদ্রব্যে অনেক সময় কিছু রাসায়নিক পদার্থ মিশানো হয় যাতে খাবারে ব্যাকটেরিয়া জন্মাতে না পারে, খাবার দুর্গন্ধযুক্ত না হয় এবং পচন না ধরে। এই রাসায়নিক দ্রব্যকে ফুড প্রিজারভেটিভ বলে। কিছু ফুড প্রিজারভেটিভ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (World Health Organization) কর্তৃক অনুমোদিত। যে সব ফুড প্রিজারভেটিভ আমাদের শরীরে গেলে শরীরের কোনো ক্ষতি হয় না এবং যেগুলো বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা খাদ্য সংরক্ষক হিসেবে অনুমোদন দিয়েছে, তাদেরকে অনুমোদিত ফুড প্রিজারভেটিভ বলে। যেমন, সোডিয়াম বেনজোয়েট, ভিনেগার, লবণের দ্রবণ, ইত্যাদি অনুমোদিত ফুড প্রিজারভেটিভ। অন্যদিকে যেগুলো আমাদের শরীরে গেলে আমাদের শরীরের জন্য ক্ষতির কারণ হয়, সেগুলোকে অননুমোদিত ফুড প্রিজারভেটিভ বলা হয়। যেমন-ফরমালডিহাইড বা ফরমালিন।

14.3 শিল্প বর্জ্য ও পরিবেশ দূষণ:

শিল্প কলকারখানা থেকে নানা ধরনের বর্জ্য নিষ্কাশিত হয়। যদি এই বর্জ্য সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে প্রক্রিয়া না করেই সরাসরি পরিবেশে উন্মুক্ত করে দেওয়া হয় তাহলে সেটি পরিবেশকে দূষিত করে তুলতে পারে।

শিল্প কারখানা থেকে নির্গত বর্জ্যগুলো কঠিন, তরল বা বায়বীয় তিন ধরনেরই হতে পারে। কঠিন বর্জ্যের মাঝে রয়েছে ধাতব কণা, প্লাস্টিক, কাগজ, পরিত্যক্ত ইলেকট্রিক সার্কিট বোর্ড, কার্ডবোর্ড ইত্যাদি। তরল বর্জ্যের মাঝে আছে বিষাক্ত রাসায়নিক দ্রব্য, ধাতব দ্রবণ, অ্যাসিড, ক্ষার ইত্যাদি। বায়বীয় বর্জ্যের মাঝে আছে বিভিন্ন অ্যাসিড গ্যাস, গ্রিন হাউজ গ্যাস, উদ্বায়ী জৈব পদার্থ, ধুয়া, বিষাক্ত গ্যাস ইত্যাদি। এ ছাড়াও সঠিক ব্যবস্থাপনা না থাকলে মেডিক্যাল বর্জ, তেজস্ক্রিয় বর্জ্য কিংবা জৈব বর্জ্য বিপজ্জনক পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে।

শিল্প কলকারখানার বর্জ্য সঠিকভাবে ব্যবস্থাপনা করা না হলে সেটি একটি বিশাল ভৌগোলিক এলাকার মাটি, পানি বা বায়ু দূষণের কারণ হতে পারে। বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ দিয়ে মাটি দূষিত হয়ে গেলে সেটি সেই এলাকার ফসলের উপর প্রভাব ফেলে এবং পর্যায়ক্রমে মানুষের খাবারের ভেতর দিয়ে তাদের দেহে স্থান করে নেয়। পানি দূষণের কারণে জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণী ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং মাছকে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে মানুষ এই দূষণের শিকার হয়। বায়ু দূষণের কারণে সারা পৃথিবীর মানুষ নানারকম বক্ষব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে।

পরিবেশ দূষণ যে শুধু একটি এলাকায় সীমাবদ্ধ থাকে তা নয়, সামগ্রিক ভাবে এটি জলবায়ুর উপরেও বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। কাজেই শিল্প কলকারখানার বর্জ্য অব্যবস্থাপনার উপর রাষ্ট্রীয় বিধিনিষেধ থাকা খুবই প্রয়োজন। এ জন্য জন সচেতেনতা এবং টেকসই সমাধানের জন্য সম্মিলিত উদ্যোগের কোন বিকল্প নেই।

আমাদের দেশে চামড়া শিল্প, রং শিল্প, কীটনাশক শিল্প ইত্যাদি থেকে বর্জ্য হিসেবে, ক্রোমিয়াম (Cr), লেড (Pb), মার্কারি (Hg), ক্যাডমিয়াম (Cd) ইত্যাদি ভারী ধাতু নির্গত হয়। সঠিকভাবে প্রক্রিয়া না করার কারণে অনেক জায়গাতেই এইসব বর্জ্য পদার্থ মাটি এবং পানিতে প্রবেশ করেছে। এইসব মাটিতে চাষাবাদ করলে বা উদ্ভিদের জন্ম হলে সেসব উদ্ভিদেও এইসব ভারী ধাতু প্রবেশ করে। এইসব উদ্ভিদের ফলমূল খেলে আমাদের শরীরেও এইসব ধাতু ঢুকে কিডনি বা লিভারের ক্ষতি করে, এমনকি অবশেষে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।

একইভাবে আমরা অনেক ক্ষেত্রে পলিথিন ও প্লাস্টিক সামগ্রী ফেলে রাখি। এগুলো পুকুর, নদী, বিভিন্ন জলাশয়, এমনকি সমুদ্রের পানিতে মিশে গিয়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণায় পরিণত হয়। এইসব ক্ষুদ্র কণাকে মাইক্রোপ্লাস্টিক (microplastic) বলে। পুকুর, নদী, বিভিন্ন জলাশয় এবং সমুদ্রের পানিতে যে সমস্ত মাছ থাকে তাদের মধ্যেও এই মাইক্রোপ্লাস্টিক প্রবেশ করে। আমরা আবার এই মাছ খাই, ফলে মাইক্রোপ্লাস্টিক আমাদের শরীরেও প্রবেশ করে বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা তৈরি করতে পারে।

কাজেই পরিবেশ দূষণ থেকে আমাদের দেশকে রক্ষা করা এখন আমাদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি দায়িত্ব হয়ে দাঁড়িয়েছে।

Content added By
Promotion