আমরা এর আগের শ্রেণিগুলোতেও যোগাসন করেছি। চলো, আমরা একটা মজার খেলার মাধ্যমে যোগাসন প্রদর্শন করি।
ছক ২.১: যোগ-পরিক্রমা
যোগাসনের নাম | উপকারিতা |
|
|
চলো, আমরা প্রত্যেকে 'উপস্থাপনা যাচাই' তালিকায় টিক চিহ্ন (√) দিয়ে অন্য দল/ জোড়ার উপস্থাপনা মূল্যায়ন করি।
এ মহাবিশ্বের প্রতিটি বস্তু একে অন্যের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে নীরবে যে যার কর্মকান্ড পরিচালনা করে চলছে। সূর্যকে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছে পৃথিবী, পৃথিবীকে ঘিরে আবর্তন করছে চন্দ্র। দূর আকাশের চাঁদের টানে পৃথিবীর নদীতে জোয়ার-ভাটা আসে। চন্দ্র-সূর্যের অবস্থান বদলের কারণে চন্দ্রগ্রহণ ও সূর্যগ্রহণ হয়। আমরাও এই বিশ্বব্রহ্মান্ডের অবিচ্ছিন্ন অংশ, একে অপরের সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত আছি। এই সম্পর্ককে অনুভব করার জন্য প্রয়োজন আত্মমগ্ন হওয়া। আত্মমগ্নতায় পরমব্রহ্মের উপলব্ধি আসে। এই আত্মমগ্নতা উপলব্ধি করার একটি মাধ্যম হলো যোগাসন।
স্বামী পরমানন্দ বলেছেন, "বাইরে খুঁজলে ঈশ্বরকে পাওয়া যাবে না, তিনি মানুষের অন্তরে আত্মারুপে বিরাজমান, নিজের ভেতরে তাঁকে প্রকাশ করার নামই সাধনা।"
বৈদিক নিয়মে বিভিন্ন যোগাসনের মাধ্যমে আত্মমগ্ন হওয়া যায়। যোগাসন আমাদের শরীর ও মনকে সুস্থ রাখে। এই যোগাসনের ধারণা বহু প্রাচীন। আমাদের
ধর্মগ্রন্থগুলোতে এ সম্পর্কে বিশদভাবে লেখা হয়েছে। যোগাসন বিষয়টি বুঝতে হলে আমাদের অষ্টাঙ্গযোগ সম্পর্কে জানতে হবে। অষ্টাঙ্গযোগের একটি ধাপ হলো যোগাসন।
দৈনন্দিন জীবনে আমরা উপরের ছবির মতো বিন্দুর দিকে তাকিয়ে এবং একইভাবে আগুনের দিকে তাকিয়ে থেকে মনঃসংযোগ করতে পারি। এ কাজকে বিন্দু ত্রাটক ও অগ্নি ত্রাটক বলে। এতে মনে স্থিরতা আসে। সহজে আত্মমগ্ন হওয়া যায়।
চলো, আমরা শিক্ষকের সহায়তায় ধ্যান/ মেডিটেশন চর্চা করি
মহর্ষি পতঞ্জলি ১৫০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে যোগের তত্ত্ব ও অনুশীলনের ওপর কিছু সূত্র দেন। একে যোগসূত্র বলে। যোগসূত্রে অষ্টাঙ্গযোগের কথা বলা হয়েছে। অষ্টাঙ্গযোগে আটটি ধাপ রয়েছে। নিচে ধাপগুলোর বর্ণনা দেয়া হলো।
১। যম: যম অর্থ সংযম। ইন্দ্রিয় এবং মনকে হিংসা, অশুভ ভাব থেকে সরিয়ে আত্মকেন্দ্রিক করা। অর্থাৎ লক্ষ্য অর্জনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী বস্তু ত্যাগ করা। যম পাঁচ ধরনের-
(ক) অহিংসা- সবসময় নিজের ভেতরে বিদ্বেষহীন চিন্তা ও চেতনা ধারণ করা। এককথায় মনকে ভালোবাসায় পূর্ণ রাখা। শুধু জীবের প্রতি ভালোবাসা নয়, নিখিল বিশ্বের তথা প্রতিটি বস্তুর প্রতি ভালোবাসা।
(খ) সত্য- যেমন দেখছি, যেমন শুনছি এবং যেমন জানছি, ঠিক তেমনটাই মনে, কথায় ও কাজে প্রকাশ করাকে সত্য বলে। মানুষ যদি সত্য চিন্তা করে, যদি সত্য কথা বলে এবং সমগ্রজীবন যদি সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত হয় তাহলে ঈশ্বরের সঙ্গে মিলনের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়।
( গ) অস্তেয়- অস্তেয় অর্থ চুরি না করা। অপরের জিনিস না বলে অধিকার করাকে/নেওয়াকে স্তেয় (চুরি) বলে।
(ঘ) ব্রহ্মচর্য- ব্রহ্মচর্য শব্দের অর্থ ধর্মীয় গ্রন্থ পাঠ ও পবিত্র সংযত জীবনযাপন করা। জীবনে ব্রহ্মচর্যকে প্রতিষ্ঠা করলে দেহে শক্তি মেলে। মনে সাহস ও বুদ্ধি বিকশিত হয়।
(ঙ) অপরিগ্রহ- অপরিগ্রহ অর্থ হচ্ছে অগ্রহণ বা মুক্ত থাকা। অর্থাৎ প্রয়োজনের অতিরিক্ত কিছু সংগ্রহ করা ও মজুত করা বা ভোগের লিঙ্গা থেকে নিজেকে মুক্ত রাখা।
২। নিয়ম: যার মাধ্যমে ব্যক্তি তার অন্তর্গত শৃঙ্খলা ও দায়িত্ববোধের চর্চা করে আত্মশুদ্ধ হয় তা-ই নিয়ম। মহর্ষি পতঞ্জলি শৌচ, সন্তোষ, তপঃ, স্বাধ্যায় এবং ঈশ্বর-প্রণিধান এই পাঁচটি নিয়মের উল্লেখ করেছেন।
(ক) শৌচ- শুদ্ধতা তথা পবিত্রতাকে শৌচ বলে। শৌচ দুই রকমের বাইরের এবং ভেতরের। সাধকের প্রতিদিন জল দ্বারা শরীরের শুদ্ধি, সত্যাচরণ দ্বারা মনের শুদ্ধি, বিদ্যা আর তপস্যা দ্বারা আত্মার শুদ্ধি এবং জ্ঞান দ্বারা বুদ্ধির শুদ্ধি প্রয়োজন।
(খ) সন্তোষ - সন্তোষ মানে সম্যক পরিতৃপ্তি। যখন যে অবস্থায় থাকা যায় সে অবস্থাকে সুখকর মনে করে আনন্দময় জীবনযাপন করা।
(গ) তপঃ - তপঃ মানে তপস্যা অর্থাৎ আত্ম-সংযম। এর মাধ্যমে দেহ, মন ও বাক্যে পরিপূর্ণ শৃঙ্খলা প্রদর্শন করা হয়।
(ঘ) স্বাধ্যায়- স্বাধ্যায় হচ্ছে আত্মোন্নয়নে সহায়তাকারী ও অনুপ্রেরণাদায়ী প্রাসঙ্গিক গ্রন্থাদি থেকে পাঠ গ্রহণ করা। কেননা শিক্ষা ও অধ্যয়নই পারে ব্যক্তির দৃষ্টিভঙ্গিকে পরিশুদ্ধ ও স্বচ্ছ করে গড়ে তুলতে।
(ঙ) ঈশ্বর-প্রণিধান- প্রণিধান অর্থ অর্পণ। সমস্ত কর্ম ও ইচ্ছা ঈশ্বরে অর্পণ করার নাম ঈশ্বর-প্রণিধান।
৩। আসন- আসন অর্থ স্থির হয়ে সুখে অধিষ্ঠিত থাকা। দেহ মনকে সুস্থ ও স্থির রাখার উদ্দেশ্যে যে বিভিন্ন দেহভঙ্গি তাই আসন।
৪। প্রাণায়াম- প্রাণায়াম অর্থ প্রাণের আয়াম। প্রাণ হলো শ্বাসরূপে গৃহীত বায়ু আর আয়াম হলো বিস্তার। সুতরাং প্রাণায়াম বলতে বোঝায় শ্বাস-প্রশ্বাসের বিস্তার। অর্থাৎ শ্বাস-প্রশ্বাসের স্বাভাবিক গতিকে নিয়ন্ত্রণ এবং নিজ আয়ত্তে আনাই প্রাণায়াম। রেচক, পূরক ও কুম্ভক এই তিন প্রক্রিয়ার দ্বারা প্রাণায়াম সম্পন্ন হয়। শাসগ্রহণকে বলে পূরক, শ্বাসত্যাগকে বলে রেচক এবং শ্বাসধারণকে বলে কুম্ভক।
৫। প্রত্যাহার- প্রত্যাহার অর্থ ফিরিয়ে নেওয়া। বাহ্যিক বিষয়বস্তু থেকে ইন্দ্রিয়সমূহকে ভিতরের দিকে ফিরিয়ে নেওয়াই প্রত্যাহার।
৬। ধারণা- মনকে বিশেষ কোনো বিষয়ে স্থির করা বা আবদ্ধ রাখার নাম ধারণা। ধারণা অর্থ একাগ্রতা। নিজ দেহের অঙ্গবিশেষেও যেমন- নাভি, নাকের অগ্রভাগ বা ভূ-যুগলের মধ্যস্থানে অথবা কোনো দেবমূর্তি বা যে- কোনো বস্তুতে মনকে নিবিষ্ট করা যেতে পারে।
৭। ধ্যান বা মেডিটেশন- ধ্যান অর্থ নিরবচ্ছিন্ন গভীর চিন্তা। নিরবচ্ছিন্নভাবে ঈশ্বরের চিন্তা করলে মন একসময় ঈশ্বরময় হয়ে ওঠে। ধ্যানে যোগীর দেহ শ্বাস-প্রশ্বাস ইন্দ্রিয় মন বিচারশক্তি অহংকার সবকিছু ঈশ্বরে লীন হয়ে যায়। তিনি এমন এক সচেতন অতীন্দ্রিয় অবস্থায় চলে যান যা ব্যাখ্যা করা যায় না। তখন পরম আনন্দ ছাড়া তাঁর আর কোনো অনুভূতি হয় না। তিনি তাঁর আপন অন্তরের আলো দেখতে পান।
৮। সমাধি- সমাধি অর্থ সম্পূর্ণরূপে ঈশ্বরে চিত্ত তথা হৃদয় সমর্পণ। এই সমপর্ণের মাধ্যমে মনঃশূন্য, বুদ্ধিশূন্য, অহংশূন্য নিরাময় অবস্থা প্রাপ্ত হন। তখন পরমাত্মার সঙ্গে তাঁর মিলন ঘটে। তখন তাঁর 'আমি' বা 'আমার' জ্ঞান থাকে না। কারণ তখন তাঁর দেহ, মন ও বুদ্ধি স্তব্দ থাকে। সাধক তখন প্রকৃত যোগ লাভ করেন।
জীবাত্মার সাথে পরমাত্মার পরম আনন্দময় মিলনই সমাধি অবস্থা। সমাধি দুই প্রকার- সবিকল্প এবং নির্বিকল্প। সাধকের ধ্যানের বস্তু ও নিজের মধ্যে পার্থক্যের অনুভূতি থাকলে, তা হলো সবিকল্প সমাধি। আর সাধক যখন ধ্যানের বস্তুর সঙ্গে একাত্ম হয়ে যান সে অবস্থাই হলো নির্বিকল্প সমাধি। এই সমাধি লাভ যোগসাধনার সর্বোচ্চ স্তর, যোগীর পরম প্রাপ্তি। চলো, আমরা অষ্টাঙ্গযোগ যেভাবে আমাদের জন্য কল্যাণকর তা 'প্রাণবায়ু' বেলুনে পাঁচটি পয়েন্টে লিখি।
একটি বিশেষ ভঙ্গিতে মনঃসংযোগ করে কিছু সময়ের জন্য স্থির ভাবে অবস্থান করাকে যোগাসন বলা হয়। আমাদের শরীর ও মনকে সুস্থ রাখতে যোগাসনের গুরুত্ব অপরিসীম। বর্তমানে যোগাসনকে মূলত দুটিভাগে ভাগ করা হয়। ধ্যানাসন ও স্বাস্থ্যাসন। যোগশাস্ত্রে প্রতিটি আসনেরই নাম রয়েছে। এই নামের সঙ্গে আসন যুক্ত করে উচ্চারণ করা হয়। যেমন- 'শব' নামের আসনটিকে উল্লেখ করা হয়েছে শবাসন (শব+আসন) নামে। এখন আমরা অতি পরিচিত কয়েকটি যোগাসন সম্পর্কে জানব।
সুখ শব্দের সাধারণ অর্থ হলো- হর্ষ, আনন্দ, প্রীতি, স্বাচ্ছন্দ্য, স্বস্তি, তৃপ্তি ইত্যাদি। সুখ পাওয়া যায় এমন ভাবগত অর্থ থেকে এই আসনের নামকরণ করা হয়েছে সুখাসন (সুখ+ আসন)।
পদ্ধতি
১. কোনো সমতল স্থানে, মেরুদণ্ড সোজা করে, দুই পা ছড়িয়ে বসতে হবে।
২. এবার ডান পা ভাঁজ করে বাম উরুর দিকে নিয়ে আসতে হবে।
৩. বাম পা ভাঁজ করে ভাঁজ করা ডান পায়ের নিচ থেকে বাম উরুর কাছে আনতে হবে।
৪. এবার ডান হাত ডান হাঁটুর উপর এবং বাম হাত বাম হাঁটুর উপরে রাখতে হবে।
৫. হাতের তালু থাকবে হাঁটুর দিকে ফেরানো এবং আঙুলগুলো হাঁটুর উপর ছড়ানো থাকবে।
৬. শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক রেখে এক মিনিট অবস্থান করতে হবে।
৭. তারপর পা বদল করে একই প্রক্রিয়ায় আসনটি করতে হবে।
৮. সর্বশেষে আসন ত্যাগ করে শবাসনে এক মিনিট বিশ্রাম নিতে হবে।
পুরো আসনটি মোট তিন বার করতে হবে।
১। মনের একাগ্রতা, মনঃসংযোগ ও মনের স্থিরতা বৃদ্ধি পায়।
২। ধ্যান ও প্রাণায়ামে এ আসন খুবই উপযোগী। মনের চাপ নিয়ন্ত্রণ করে মনকে নিবিড়ভাবে এই আসন প্রশান্ত করে তোলে।
৩। মানসিক উদ্বেগ, অনিদ্রা, ক্ষুধা ও বিষণ্ণতা দূর করে।
৪। পিঠের ব্যথা উপশম ও মেরুদণ্ড সবল হয়।
৫। পেটের পেশী সবল, পরিপাকতন্ত্রের উন্নতি ও দেহের রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি করে।
৬। হাঁটুর নমনীয়তা বাড়ে। ফলে হাঁটু মুড়ে যাঁরা বসতে কষ্ট পান, তাঁদের অসুবিধা দূর হয়। এছাড়া হাঁটুর ব্যথা দূর হয়।
৭। পায়ের পাতা প্রসারিত হয়, পেশী শিথিল হয় এবং শারীরিক উত্তেজনা প্রশমিত হয়। মন শুদ্ধচিন্তা করার সহায়ক হয়।
৮। পায়ের পাতা, হাঁটু ও গোড়ালির নমনীয়তা বৃদ্ধি পাওয়ায় গাঁটের বাতজনিত ব্যথা দূর হয়, দীর্ঘক্ষণ হাঁটা- চলার ক্ষেত্রে পা সক্রিয় থাকে।
শরীরের ভঙ্গিমা পেছনের দিকে অর্থাৎ নিচু হয়ে পিছনের দিকে নুইয়ে করতে হয় বলে, এই আসনটি পশ্চিমোত্তাসন নামে পরিচিত। একে অনেকে উগ্রাসনও বলে। উগ্র শব্দের অর্থ হচ্ছে শিব। শিব সংহারকর্তা বলে শিবের বৈশিষ্ট্যময় এই আসনটি দ্রুত আয়ত্ব করা বেশ কঠিন, তবে ধীরে ধীরে তা রপ্ত হলে খুব অনায়াসে করা যায়।
১। প্রথমে দুটি পা সামনের দিকে সোজা করে বসতে হবে।
২। দুই পা সোজা হলে দুহাতের আঙুলের সাহায্যে দুপায়ের দুটি বুড়ো আঙুল ধরতে হবে।
৩। পায়ের আঙুল ধরার সময়, কোমর থেকে দেহের উপরের অংশ সামনের দিকে ঝুঁকিয়ে নিতে হবে।
৪। শ্বাস-প্রস্বাস ধীরে ধীরে ত্যাগ করতে হবে।
৫। এরপর আস্তে আস্তে দেহকে সামনের দিকে নুইয়ে আনতে হবে, যাতে মাথা দুহাঁটুর মাঝখানে স্পর্শ করে।
৬। প্রথম অবস্থায় পুরোপুরি স্পর্শ না হলে অভ্যাসের মাধ্যমে ধাপে ধাপে তা আয়ত্তে আনা যায়।
৭। পেটকে আসনরত অবস্থায় ভেতর দিকে সঙ্কুচিত করতে হবে, ফলে খুব সহজেই সামনের দিকে নুইয়ে পড়তে কষ্ট হবে না।
৮। মাথা হাঁটু স্পর্শ করলে, মাথা দুটি হাতের মাঝখানে থাকবে।
৯। প্রথম দিকে এই আসন শুধুমাত্র ৫ সেকেন্ড করাই উত্তম। তারপর আবার সোজা হয়ে বসতে হবে। এভাবে বারবার অভ্যাস করতে হবে।
১০। প্রথমদিকে প্রতিদিন চার বার এবং ৩০ সেকেন্ড পর্যন্ত অভ্যাস করাই বিধেয়। এই আসন ভালোভাবে রপ্ত হলে ধীরে ধীরে সময় বাড়িয়ে দিতে হবে।
১। দেহের গ্রন্থিগুলি নমনীয, সবল ও সতেজ হয়। কোমরের ব্যথাবেদনার উপশম হয়।
২। মূত্রাশয়, উদর, পিত্তাশয় প্রভৃতি বেশ সক্রিয় ও সবল হয়ে ওঠে।
৩। দেহ শক্তিশালী, সুঠাম ও লাবণ্যময় হয়ে ওঠে।
৪। অন্ত্রের সঙ্কোচন ও প্রসারণের গতি বাড়ে। ফলে খাদ্যবস্তু দ্রুত শরীরের একস্থান থেকে অন্য স্থানে স্থানান্তর ঘটে।
৫। পেটে অনাকাঙ্ক্ষি চর্বি কমে আসে।
৬। শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি ঠিক থাকে ও পরিপাকক্রিয়া সঠিকভাবে চলে।
৭। মন ও চিন্তা-চেতনা উর্ধ্বমুখী হয়।
৮। হেচকী তথা উর্ধশ্বাসজনিত কোনো রোগ থাকলে তা সহজেই নিরাময় হয়।
৯। যাঁদের বেশিক্ষণ হাঁটতে পায়ে কষ্ট হয়, এ আসনের ফলে পায়ের পেশী ও স্নায়ুগুলো খুব সবল ও সতেজ হয়ে ওঠে। দীর্ঘক্ষণ হাঁটলেও ক্লান্তি আসে না। পায়ের বাত নিরাময় হয়।
১০। এ আসনে খুব সহজেই শারীরিক ও মানসিক প্রশান্তি আসে। মানসিক রোগীদের ক্ষেত্রে এ আসন নিয়মিত অভ্যাসে ভালো সুফল দেয়।
১১। মেরুদণ্ড, পেট, হৃদপিন্ডের যথাযথ ব্যায়াম হয়। ফলে পেটে বাড়তি মেদ জমতে পারে না। মেরুদণ্ড সংকোচন-প্রসারণে নমনীয় হয় ও হৃৎপিন্ডের কর্মক্ষমতা বেড়ে যায়।
১২। পেটে অসুখ হলে তা দ্রুত সারিয়ে তুলতে এ আসন অতি উত্তম।
১৩। বহুমূত্র রোগ নিরাময় করে।
১৪। মনোবল বৃদ্ধি করে ও শরীরের স্নায়ুবিক দুর্বলতা কমায়।
ভুজঙ্গ অর্থ সাপ। এই আসনের দেহভঙ্গিমা সাপের মতো দেখায় বলে এর নামকরণ করা হয়েছে ভুজঙ্গাসন (ভুজঙ্গ+আসন)।
১. সমতল স্থানে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়তে হবে। পায়ের দুই পাতা ও গোড়ালি জোড়া থাকবে।
২. দুই হাত কনুই থেকে ভাঁজ করে বুকের দুই পাশে স্থাপন করতে হবে।
৩. হাতের তালু মাটির দিকে ফেরানো থাকবে।
৪. দুই হাতে ভর দিয়ে মাথাসহ শরীরের উর্ধ্বাংশ ধীরে ধীরে উপরে তুলতে হবে।
৫. এবার হাত ও পেটের উপর ভর দিয়ে শরীরকে উর্ধ্বমুখী করে ত্রিশ সেকেন্ড অবস্থান করতে হবে। এই সময় শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক থাকবে।
৬. ত্রিশ সেকেন্ড পর আসন ত্যাগ করে, শবাসনে বিশ্রাম নিতে হবে।
আসনটি মোট তিন বার করতে হবে।
১. মেরুদণ্ডের নমনীয়তা বৃদ্ধি পায়। মেরুদণ্ডের বাত দূর হয়।
২. কোমরের বাত ও ব্যথার উপশম হয়।
৩. পিঠ ও কোমরের পেশি মজবুত হয়।
৪. মেয়েদের ঋতুস্রাবের ব্যথা ও অনিয়ম দূর হয়।
৫. যকৃৎ, প্লীহার কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।
৬. অজীর্ণ, কোষ্ঠকাঠিন্যের উপশম হয়।
৭. উচ্চ-রক্তচাপের রোগীদের জন্য এই আসন অত্যন্ত সুফল প্রদান করে থাকে।
জাতি-ধর্ম-বর্ণ-অঞ্চল নির্বিশেষে সারা বিশ্বেই মানুষ এখন শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার জন্য যোগ ব্যায়াম বা ইয়োগা করছে। তৈরি হয়েছে বিভিন্ন ইয়োগা সেন্টার, ইয়োগা ক্লাব ইত্যাদি। ইয়োগা ক্যাম্পেরও আয়োজন করা হয়। এমনকি ২১ জুনকে ঘোষণা করা হয়েছে আন্তর্জাতিক ইয়োগা ডে বা যোগ দিবস হিসেবে।
তোমরাও একটি 'ইয়োগা ক্লাব' গঠনের উদ্যোগ নাও। আর সুবিধাজনক একটি দিনে বিদ্যালয়ে 'ইয়োগা ডে' পালন করো। সেদিন ইয়োগা ক্যাম্পেরও আয়োজন করবে। সুস্থতা, স্থিরতা ও মনঃসংযোগের মাধ্যমে 'নিজের মাঝে এক সুন্দর পৃথিবী গড়ি/ সৃষ্টিজগতের কল্যাণ করি' এই স্লোগান নিয়ে কাজ করে যাও।
তালিকা ২.৫: ইয়োগা ক্লাব গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় বিষয়গুলোর তালিকা
|
ছক ২.৬: ইয়োগা ডে কার্যক্রম
|
আমরা অনেকেই হয়তো পাঁচালি পড়েছি বা শুনেছি। পাঁচালি হলো এক ধরনের লোকজ গীতিকথা। আমাদের হিন্দুধর্মে বিভিন্ন দেব-দেবীর নামে পাঁচালি আছে। এই পাঁচালিগুলোতে মূলত সেইসব দেবদেবীর কাহিনি, উপাখ্যান, মহিমা, স্তুতি, প্রার্থনা ইত্যাদি বিভিন্ন ছন্দে বর্ণিত থাকে। যা সাধারণত সংশ্লিষ্ট দেবদেবীর পূজার সময়ে সুর করে পাঠ করা হয়। চলো, মনসার পাঁচালির কিছু অংশ সুর করে পড়ি।
চলো, আমরা মনসার পাঁচালিতে কোন দেবী সম্পর্কে বলা হয়েছে আর তাঁর সম্পর্কে কী কী বলা হয়েছে তা দলে/জোড়ায় আলোচনা করে প্রত্যেকে 'দেবী-কথন' ছকে পয়েন্ট আকারে লিখি।
ছক ২.৬: দেবী-কথন' ছক
|
বাংলার সাহিত্য-নাটক-সিনেমা-গানে আমরা বেহুলা-লখিন্দরের কথা অনেক শুনেছি। প্রায় সাতশ বছর আগে এই কাহিনি নিয়ে লেখা হয়েছিল মনসামঙ্গল বা পদ্মাপুরাণ কাব্য। এই কাহিনিতে আমরা দেখি, দেবী মনসা পৃথিবীতে নিজের পূজা প্রচলনের জন্য চাঁদ সওদাগরকে কতভাবেই না অনুরোধ করেছেন। চাঁদ সওদাগরের সব নৌকা ডুবিয়ে তাকে নিঃস্ব করেছেন। একে একে ছয় ছেলেকে মেরে ফেলেছেন। তবুও চাঁদ সওদাগরের কাছ থেকে পূজা আদায় করতে পারেননি মনসা দেবী। এরপর চাঁদ সওদাগরের ছোট ছেলে লখিন্দরও বিয়ের রাতে মনসার পাঠানো সাপের কামড়ে মারা যায়। কিন্তু স্ত্রী বেহুলা বহু বিঘ্ন-বিপত্তি অতিক্রম করে স্বর্গে গিয়ে লখিন্দরের প্রাণ ফিরিয়ে আনে। এই কাহিনিই মনসার পাঁচালিতে বর্ণনা করা হয়েছে। মনসাপূজায় এই পাঁচালি পাঠ করা হয়।
|
ছক ২.৭: মনসার গল্প
|
যে গল্পটি লেখা হয়েছে তাতে মনসা দেবীর কাহিনি ফুটে উঠেছে। এই যে আমরা বিভিন্ন দেব-দেবীর পাঁচালি পড়ি, পূজা-অর্চনা করি এগুলো আমাদের ধর্মাচারের অংশ। এবারে তাহলে আমরা ধর্মাচার সম্পর্কে জেনে নেই।
ধর্মাচার: ধর্মাচার হলো ধর্মীয় রীতি ও নীতির অন্তর্গত কিছু আচার-অনুষ্ঠান বা ক্রিয়াকর্ম। আবার ধর্মানুষ্ঠানের সময় যেসব রীতিনীতি আচার-অনুষ্ঠান পালন করা হয় তাও ধর্মাচার। ধর্মাচারকে অনেক সময় লোকাচারও বলা হয়। মানুষের বিশ্বাস অনুসারে অঞ্চলভেদে রীতিনীতির পার্থক্যের কারণে ধর্মাচার লোকাচারে পরিণত হয়। হিন্দুধর্মের বিশ্বাস অনুসারে সংক্রান্তি উৎসব, গৃহপ্রবেশ, জামাইষষ্ঠী, রাখিবন্ধন, হাতেখড়ি প্রভৃতি হচ্ছে ধর্মাচার।
দেবদেবী: হিন্দুধর্মে দুভাবে ঈশ্বরের উপাসনা করা হয়। নিরাকার ও সাকার রূপে। পরমেশ্বরের অস্তিত্ব প্রকৃতিতে বিরাজমান। প্রকৃতির গাছপালা জীবজন্তু আকাশ-বাতাস সবকিছুর মধ্যে পরমেশ্বরের অস্তিত্ব রয়েছে। এক্ষেত্রে পরমেশ্বরের রূপ কোনো আকারের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। তাই তিনি নিরাকার। নিরাকার হলেও ভক্তের আহ্বানে পরমেশ্বর বিশেষ উদ্দেশ্য, বিশেষ বৈশিষ্ট্য ও বিশেষ কাজের জন্য সাকার রূপে ভক্তের কাছে আবির্ভূত হন। তখন তিনি সুনির্দিষ্ট রূপ, সুনির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য ও ক্ষমতার অধিকারী হন। পরমেশ্বরের সেই সাকার রূপকে বলা হয় দেবদেবী। যেমন- ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব, দুর্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতী, মনসা, শীতলা, শনি প্রমুখ।
পূজা-অর্চনা: ধর্মীয় রীতিনীতিকে অনুসরণ করে যেসব অনুষ্ঠানাদি করা তাই ধর্মানুষ্ঠান। পূজা হলো একটি ধর্মানুষ্ঠান। পূজা শব্দের অর্থ ভক্তি নিবেদন করা; শ্রদ্ধাজ্ঞাপন বা সম্মান জানানো। পূজা হিন্দুধর্মের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য। হিন্দুধর্মে ঈশ্বরের নিরাকার ও সাকার উভয় রূপের উপাসনার বিধান আছে। দেবদেবীর মূর্তি বা প্রতিমা হলো ঈশ্বরের বিভিন্ন গুণের রূপকল্প বা প্রতীক। স্থান ও কালভেদে বিভিন্ন প্রকার পূজানুষ্ঠান প্রচলিত আছে। যেমন: গৃহে বা মন্দিরে নিত্যপূজা, আবার বিভিন্ন উৎসব উপলক্ষে বিশেষ পূজা করা হয়, যেমন: দুর্গাপূজা। কোনো শুভ কাজের শুরুতে বা সফলতা লাভের উদ্দেশ্যেও আরাধ্য দেবদেবীর পূজা করা হয়ে থাকে। শাস্ত্রীয় বিধিবিধান মেনে আরাধ্য দেবদেবীর পূজা করা হয়। শাস্ত্রমতে আসনশুদ্ধি, সংকল্প, বিঘ্ন অপসারণ, প্রাণপ্রতিষ্ঠা, মন্ত্রপাঠ, যজ্ঞ, আরতি, অঞ্জলি, বিসর্জন প্রভৃতি পূজার অঙ্গ। আবার গন্ধ, পুষ্প, ধূপ, দীপ, পাদ্য, অর্ঘ্য ইত্যাদি বাহ্য-উপচারে দেবদেবীর পূজা করা হয়। মনের ভাব, ভক্তি, শ্রদ্ধা, নিষ্ঠা, ব্যাকুলতা, একাগ্রতা ইত্যাদি অন্তঃ-উপচারের সাথে পূজা করলে কাঙ্ক্ষিত ফল লাভ হয়। পূজা সম্পর্কে শ্রীমদ্ভগবদ্দীতায় বলা হয়েছে-
পত্রং পুষ্পং ফলং তোয়ং যো মে ভক্ত্যা প্রযচ্ছতি।
তদহং ভক্ত্যুপহৃতমন্নামি প্রযতাত্মনঃ।।
(গীতা, ৯/২৬)
সরলার্থ: যে ভক্ত পত্র, পুষ্প, ফল, জল ভক্তিসহকারে আমাকে উৎসর্গ করে, শুদ্ধচিত্ত সেই ভক্তের ভক্তিপূর্ণ উপহার আমি সানন্দে গ্রহণ করি।
নিচে মনসাপূজা ও শনিপূজার বিবরণ দেওয়া হলো:
মনসা সাপের দেবী। বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন স্থানে মনসাপূজা হয়। মনসাপূজার সঙ্গে মানুষের জীবন -জীবিকার সম্পর্ক রয়েছে। একসময়ে বাংলাদেশ ও ভারতের অনেক স্থানের মানুষ জলাশয়ের ধারে, নদীর পাড়ে, জঙ্গলের মধ্যে বসবাস করত। এসব স্থানে প্রচুর সাপের বাস ছিল। এ কারণে মানুষ সাপের দংশন থেকে রক্ষা পেতে মনসা দেবীর পূজা করত।
মনসা মূলত লৌকিক দেবী। হিন্দুদের মধ্যে অনেকে তাঁর পূজা করে। মানুষের মাধ্যমে লৌকিক সমাজে মনসাপূজার প্রসার ঘটেছে। পরবর্তীকালে সৃষ্ট কিছু পুরাণে মনসা দেবীর উদ্ভব ও প্রসারের কথা বলা হয়েছে। এভাবে লৌকিক থেকে তিনি পৌরাণিক দেবীতে পরিণত হয়েছেন।
মনসা দেবীকে বিষহরী, মহাজ্ঞানযুক্তা ও সিদ্ধিদাত্রী বলা হয়। সাধারণ বৈষয়িক জ্ঞান থেকে উচ্চতর জ্ঞান হলো মহাজ্ঞান। মহাজ্ঞান জাগরিত হলে মনের হিংসা, বিদ্বেষ, নিন্দা, পরশ্রীকাতরতা ইত্যাদি নষ্ট হয়। হিংসা-বিদ্বেষ মনকে বিষময় করে। সাপের বিষের যন্ত্রণা থেকেও যা তীব্রতর। মহাজ্ঞান সেই বিষকে বিনষ্ট করে। মনসাপূজার মাধ্যমে মানুষের মনে মহাজ্ঞান জাগরিত হয়। মানুষের মনের বিদ্বেষ-বিষ নষ্ট হয়। মন আনন্দে ভরে ওঠে। সে কারণে তিনি বিষহরী। আবার মহাজ্ঞানী ধাপে ধাপে সিদ্ধির পথে অগ্রসর হন। দেবী মনসাকে পূজার মাধ্যমে সেই সিদ্ধি লাভ হয়, তাই তিনি সিদ্ধিদাত্রী।
মনসা দেবীর চার হাত। নিচের বাম হাতে সাপ। নিচের ডান হাতে অভয়মুদ্রা। প্রতিটি হাতে রয়েছে অতি বিষধর সাপের কঙ্কণ। দেবীর মাথায় সাতটি সাপের একটি মুকুট। প্রতিটি সাপের মাথায় রয়েছে মণি। সাদা চাঁপা ফুলের মতো তাঁর গায়ের রং। তাঁর পরনে উদীয়মান সূর্যের মতো লাল রঙের কাপড়। মনসাকে ঘিরে আছে আটটি সাপ- অনন্ত, বাসুকি, পদ্ম, মহাপদ্ম, তক্ষক, কুলীর, কর্কট ও শঙ্খ। তাঁর বাহন হাঁস। চন্দ্রবদনা দেবী হাঁসের উপর বসে থাকেন। তাঁর পায়ের নিচে রয়েছে পদ্মের আসন।
মনসাপূজা করা হয় দুভাবে- ঘট অথবা প্রতিমা স্থাপন করে। এই পূজার জন্য বিশেষ ঘট তৈরি করা হয়। ঘটে সর্পমূর্তি থাকে। বিধি মেনে সেখানে মনসার পূজা করা হয়। এ কারণে অঞ্চলভেদে মনসাপূজার অপর নাম ঘটপূজা। পূজার আঙ্গিনায় সিজ গাছ লাগানো হয়। সিজ গাছ হলো মনসা পূজার জন্য বিশেষ গাছ, যা ফণীমনসা গাছ নামেও পরিচিত। আষাঢ় মাসের কৃষ্ণপক্ষের পঞ্চমী তিথিতে মনসা দেবীর পূজা হয়। এই তিথিকে বলা হয় নাগপঞ্চমী। আবার শ্রাবণ মাসের কৃষ্ণপক্ষের পঞ্চমী তিথিতেও এই পূজার বিধান রয়েছে। পূজা শেষে মনসা দেবীর পাঁচালি পাঠ করা হয়।
পারিবারিক আঙ্গিনা, একক মন্দির বা সর্বজনীন মন্দিরে মনসাপূজা করার নিয়ম প্রচলিত।
মনসা দেবীর প্রণামমন্ত্র
আস্তিকস্য মুনের্মাতা ভগিনী বাসুকেস্তথা।
জরৎকারুমুনেঃ পত্নী মনসা দেবী নমোহস্তু তে।।
সরলার্থ: আস্তিক মুনির মাতা, বাসুকি নাগের ভগিনী, জরৎকারু মুনির পত্নী মনসা দেবী, তোমাকে নমস্কার।
মনসাকে সাপের দেবী হিসেবে পূজা করা হয়। এতে মানুষের মনে সাপের ভীতি দূর হয়। জল-জঙ্গলপূর্ণ ভূখন্ডে জীবন-জীবিকার জন্য রাতবিরাতে মানুষকে নানা কাজে বের হতে হয়। সেসময়ে মনসার পূজারীর মনে সাপের ভীতির পরিবর্তে সাহস বা আস্থা বিরাজ করে। ফলে সাপ দেখে ভক্ত ভয় পায় না।
সাপ একটি প্রাকৃতিক প্রাণী। তার ওপর দেবত্ব আরোপ করে পূজা করলে প্রকৃতির প্রতি মানুষের আন্তরিক ভালোবাসা প্রকাশ পায়। মানুষ সাপকে হত্যা না করে তাকে রক্ষা করে। সাপরক্ষার মাধ্যমে প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা পায়। প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট হলে মানুষের বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে পড়ে। তাই সাপের ভীতি দূর করা, সাপকে বাঁচানো, প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা করার পাশাপাশি প্রকৃত জ্ঞান লাভ ও মনের হিংসা-বিদ্বেষ দূর করাই মনসাপূজার উদ্দেশ্য। মনসাপূজার কয়েকটি প্রধান উদ্দেশ্য আমরা প্রত্যেকে 'মনসা-স্তুতি রহস্য' ছকে লিখি।
ছক ২.৮: মনসা-স্তুতি রহস্য
|
শনিদেবের পরিচয়
হিন্দুধর্মে একজন দেবতা শনি। নবগ্রহের মধ্যে অন্যতম গ্রহ শনির নাম অনুসারে তাঁর নামকরণ। ব্যক্তিগত জীবনের নানা বাধাবিপত্তি দূর করা এবং পৃথিবীর কল্যাণের জন্য শনিপূজা করা হয়।
সূর্য ও বিশ্বকর্মার কন্যা ছায়ার পুত্র শনি। তিনি পৌরাণিক দেবতা। তাঁর চার হাত। হাতে ধীর-ধনুক ও দন্ড। অসদাচারীকে শাস্তিপ্রদানের প্রতীক এই দণ্ড। তাঁর গায়ের রং নীল। পরিধেয় বস্ত্র কালো। কালো রঙের মেঘ
পুঞ্জীভূত হয়ে অঞ্জনের (কাজলের) মতো দেখায়। এ কারণে তাঁকে 'নীল-অঞ্জন-চয়-প্রখ্য' বলা হয়। তাঁর গতি অত্যন্ত ধীর, শনিগ্রহের মতো। সূর্যের চারিদিকে পৃথিবীর ঘুরে আসতে সময় লাগে এক বছর। সেখানে শনিগ্রহের সময় লাগে ঊনত্রিশ বছর। ধীরগতির জন্য তাই শনিদেবকে 'শনৈশ্চর' বলা হয়। 'শনৈঃ' শব্দের অর্থ ধীরে ধীরে।
প্রতি শনিবার গৃহের আঙ্গিনায় শনিদেবের পূজার বিধান রয়েছে। সর্বজনীন শনিমন্দিরেও শনিপূজা করা যায়।
পূজার জন্য লৌহ-আসন, লৌহ-পাত্র, লৌহ-ঘট দরকার হয়। বিকল্পে কালো কাপড়ে মোড়া আসন, কালো রঙের পাত্র এবং কালো রঙের ঘট ব্যবহার করার বিধান রয়েছে। এছাড়া কালো তিল, কালো বা নীল রঙের ফুল, কালো শাড়ি বা কালো পাড়যুক্ত শাড়ি মুখ্য উপচার। এছাড়া ঋতুভিত্তিক পাঁচ প্রকারের ফল, পাঁচ প্রকারের শস্য, ধূপ-দীপ, পান-সুপারি, আটা, গুড়, বাতাসা ইত্যাদির প্রয়োজন হয়। পাড়া-প্রতিবেশীদের নিমন্ত্রণ করা হয়। পূজা শেষে শনিদেবতার পাঁচালি পাঠ করা হয়। পাঁচালি পাঠ শেষে প্রসাদ বিতরণ করা হয়।
আমরা প্রত্যেকে শনিদেবের পূজার উপচার-সংশ্লিষ্ট নিচের 'চেনা উপচার' ছকটি পূরণ করি।
ছক ২.৯: চেনা উপচার
শনিদেবের পূজায় যেসব উপচার তুমি দেখেছ | শনিদেবের পূজায় যেসব উপচার তুমি সহজে সংগ্রহ করতে পারো |
|
|
নীলাঞ্জন-চয়-প্রখ্যং রবিসূত-মহাগ্রহম্।
ছায়ায়া গর্ভসম্ভূতং তং নমামি শনৈশ্চরম্।।
সরলার্থ: নীল অঞ্জনের ন্যায় রং, ছায়ার গর্ভজাত সূর্যদেবের পুত্র শনিদেবতাকে নমস্কার।
শনিদেবের পাঁচালি পাঠ করার আগে গণেশ, ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব, লক্ষ্মী, সরস্বতী প্রমুখ দেবতাদের স্মরণ করতে হয়। এরপর শনিদেবতাকে স্মরণ করে পাঁচালি পাঠ শুরু করতে হয়।
ব্রাহ্মণের উপাখ্যান
শ্রীহরি নামেতে এক ছিল দ্বিজবর।
করিতে ব্রাহ্মণ সেবা ছিল মন তাঁর ।।
নিত্য ভিক্ষা করি করে উদর পূরণ।
তাহাতে দ্বিজ সেবা হয় অনুক্ষণ ।।
বিনা চিন্তামণি চিন্তা অন্য চিন্তা নাই।
কেমনে সে চিন্তামণি চিনিবারে পাই।।
(সংক্ষেপিত)
মানুষের মনের আশা-আকাঙ্ক্ষার শেষ নেই। আশা-আকাঙ্ক্ষার পূরণ না হলে মনে এক ধরনের অতৃপ্তি ও অসন্তোষ সৃষ্টি হয়। এ অবস্থায় অনেক সময় মানুষ বিপথগামী হয়। অন্যায় কাজে যুক্ত হয়। শনিদেবতা সেই অন্যায়কারীকে শাস্তি দেন। শনিদেবতার শাস্তির ভয়ে মানুষ পাপকর্ম থেকে বিরত থাকে। এভাবে ব্যক্তি-মানুষ ও সমাজ সুন্দর হয়।
পৃথিবীর ওপর সৌরমণ্ডলের গ্রহগুলোর প্রভাব রয়েছে। গ্রহ-নক্ষত্রের প্রভাবে গাছে ফুল ফোটে, ফল ধরে, বর্ণে গন্ধে স্বাদে পরিপূর্ণ হয়। শনিগ্রহের প্রভাবও তার ব্যতিক্রম নয়। শনিগ্রহের কুপ্রভাবে পৃথিবীতে এক ধরনের বিরূপ পরিবেশের সৃষ্টি হয়। আবার সুপ্রভাবে পৃথিবী ফল-ফসলে পরিপূর্ণ হয়। প্রাকৃতিক গ্রহের দেবমূর্তিই শনিদেবতা। শনিদেবতার শুভ প্রভাবে ব্যক্তিগত এবং সার্বিক অমঙ্গল দূর হয়। এ কারণে ব্যক্তি ও সমাজের পাশাপাশি সমগ্র পৃথিবীর মঙ্গল সাধনের জন্য আমরা শনিদেবতার পূজা করে থাকি।
ছক ২.১০: শনিদেবের প্রভাব
শনিদেবের পূজা করলে জগতের যে সকল কল্যাণ হয়' তা নিজের জীবনের আলোকে লিখি - |
১.
২.
৩.
|
ছক ২.১১: কল্যাণ-ঘট
যে পূজার ঘট বানিয়েছি | সেই পূজার কল্যাণকর দিক |
|
|
আমরা অনেকেই বিভিন্ন তীর্থক্ষেত্রের নাম শুনেছি যেমন- গয়া, কাশি, বৃন্দাবন, ইত্যাদি। আমাদের মধ্যে অনেকে আবার এসব তীর্থক্ষেত্র ভ্রমণও করেছে। তবে মজার ব্যাপার হলো, এসকল স্থান কীভাবে তীর্থ- ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে তা আমরা অনেকেই জানিনা। তীর্থক্ষেত্রগুলো সর্ম্পকে অনেক পৌরাণিক কাহিনি প্রচলিত আছে। আজ আমরা এরকমই একটি গল্প পড়ব।
পুরাকালে দক্ষ নামে এক প্রবল পরাক্রমশালী রাজা ছিলেন। ব্রহ্মার বরে তিনি প্রজাপতিদের ওপর আধিপত্য বিস্তার করার ক্ষমতা পান। একবার তিনি দেবী মহামায়াকে তপস্যায় সন্তুষ্ট করে এই বর চান যে, মহামায়া যেন তাঁর ঘরে কন্যারূপে জন্মগ্রহণ করেন। দক্ষের এই প্রার্থনা পূরণ করতে মহামায়া সম্মত হন। কিন্তু তিনি একটি শর্তও জুড়ে দেন- দক্ষ তাঁর প্রতি কোনো অন্যায় আচরণ করলে তিনি প্রাণত্যাগ করবেন। অতঃপর রাজা দক্ষ এবং রানি প্রসূতির ঘরে সতীর জন্ম হয়। তাঁদের ষোলোটি কন্যা ছিল। তাঁদের মধ্যে সতীদেবী ছিলেন দেবী মহামায়ার মনুষ্যরূপ। পরবর্তীতে মহাদেবের সাথে সতীদেবীর বিবাহ হয়। এদিকে জামাতা শিব দক্ষরাজকে মোটেই সম্মান করতেন না।
একবার দেবতারা এক মহাযজ্ঞের আয়োজন করলেন। দক্ষ সেখানে এলে উপস্থিত প্রজাপতিরা দাঁড়িয়ে তাঁকে সম্মান জানান। কিন্তু শিব দাঁড়ালেন না। জামাতা শিবের আচরণে দক্ষ অত্যন্ত অপমানিত বোধ করলেন। ক্ষুব্ধ দক্ষ বাড়ি ফিরে বৃহস্পতি-যজ্ঞের আয়োজন করেন। সেখানে দক্ষের কন্যারা স্বামীসহ নিমন্ত্রিত ছিলেন। কেবল সতী আর শিবকে নিমন্ত্রণ করা হয়নি। পিতার এই বৈষম্যমূলক আচরণে সতী রুষ্ট হয়ে একাই বিনা নিমন্ত্রণে পিতার যজ্ঞস্থলে উপস্থিত হন। দাম্ভিক দক্ষ তখন সতীকে অপমান করেন। সতীর সামনেই শিবের নিন্দা করতে থাকেন। স্বামী-নিন্দা শুনে সতী যজ্ঞস্থলেই প্রাণত্যাগ করেন। জানতে পেরে মহাদেব শিব অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হন। শোকে, ক্ষোভে তিনি নিজের মাথার জটা ছিন্ন করে ভূমিতে ফেলে দেন। ছিন্নজটা থেকে বীরভদ্ররূপে শিবের একটি উগ্ররুপের উদ্ভব হয়। শিবের অনু- চরদের সঙ্গে নিয়ে বীরভদ্র যজ্ঞস্থলে উপস্থিত হয়ে যজ্ঞ লণ্ডভণ্ড করে দেন। বীরভদ্রের অস্ত্রের আঘাতে দক্ষের মাথা কাটা পড়ে। তারপর শিব যজ্ঞস্থলে এসে সতীর মৃতদেহ কাঁধে নিয়ে প্রলয় নৃত্য শুরু করেন। নৃত্যের তাণ্ডবে পৃথিবী রসাতলে যায় যায় অবস্থা! এ অবস্থা থেকে রক্ষা করতে বিষ্ণু তাঁর সুদর্শন চক্র দিয়ে শিবের কাঁধে থাকা সতীর দেহকে খণ্ড-বিখণ্ড করতে থাকেন। সতীর দেহ একান্নটি খণ্ডে বিভক্ত হয়। খণ্ডগুলো ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গায় পতিত হয়। যেসব জায়গায় সতীর দেহখণ্ড পড়েছে সেই জায়গাগুলোকে বলা হয়, শক্তিপীঠ বা মহাপীঠ। |
ছক ২.১২: শক্তিপীঠের অবস্থান
প্রধান প্রধান শক্তিপীঠ | অবস্থান |
|
|
এই যে আমরা প্রধান প্রধান শক্তিপীঠগুলোর তালিকা করলাম, এসব জায়গা হিন্দুধর্মাবলম্বীদের কাছে তীর্থস্থান। কারণ এখানে সতীদেবীর ছিন্ন শরীরের অংশ পড়েছিল। এছাড়া বিভিন্ন মহাপুরুষের জন্মস্থান, মন্দির, আশ্রম, ধর্মগ্রন্থে বর্ণিত ঐতিহাসিক স্থান ইত্যাদি কারণে একটি স্থান তীর্থস্থান হয়ে ওঠে। এই তীর্থস্থানগুলোকে ধর্মস্থানও বলে। ধর্মস্থানগুলো ধর্মীয় দিক থেকে পবিত্রস্থান। ধর্মচর্চার স্থান। হিন্দুধর্মে অনেক মহাপুরুষের আবির্ভাব ঘটেছে।
তাঁদের এবং তাঁদের ধর্মমতকে কেন্দ্র করে অনেক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। ভক্তরা পুণ্য অর্জনের জন্য, ধর্মচর্চার জন্য সেখানে আসেন। হিন্দুধর্মের নানা উৎসবের পাশাপাশি মহাপুরুষের জীবনকেন্দ্রিক নানা উৎসবও সেখানে পালিত হয়। বিভিন্ন প্রয়োজনে সেখানে গড়ে উঠেছে আবাসনসহ বিভিন্ন অবকাঠামো। সবকিছু মিলে এসব স্থানকে বলা হয় ধর্মস্থান।
আবার হিন্দুধর্মের পৌরাণিক কাহিনির সাথে সংশ্লিষ্ট কোনো পবিত্রস্থান বা তীর্থক্ষেত্রে মন্দিরসহ নানা স্থাপনা গড়ে উঠেছে। সেখানেও ধর্মচর্চা হয়। নানারকমের উৎসব হয়। দর্শনার্থী ও ভক্তদের সমাগম ঘটে। এ সকল স্থানকেও ধর্মস্থান বলা হয়।
ভারতবর্ষে হিন্দুধর্মাবলম্বীদের নানা ধর্মস্থান আছে। বাংলাদেশেও বেশকিছু রয়েছে- পাবনায় সৎসঙ্গ, হরিচাঁদ ঠাকুরের ওড়াকান্দিধাম, সিলেটের চৈতন্যদেবের আদি পিতৃভুমি, সীতাকুন্ডে চন্দ্রনাথধাম, রাজশাহীতে ক্ষেতুড়িধাম, নারায়ণগঞ্জে লাঙ্গলবন্ধ, লোকনাথ ব্রহ্মচারীর বারদীধাম ইত্যাদি। এখানে আমরা জানব, দক্ষযজ্ঞের পৌরাণিক কাহিনি-ভিত্তিক বাংলাদেশের ছয়টি শক্তিপীঠ এবং ভারতবর্ষের সুপ্রসিদ্ধ চারটি ধাম, যা চতুর্ধাম নামে প্রসিদ্ধ।
বাংলাদেশের ছয়টি শক্তিপীঠ।
সতীর দেহখণ্ড পতিত হয়ে তৈরি হয়েছিল একান্নটি শক্তিপীঠ। এর মধ্যে ছয়টির অবস্থান বাংলাদেশে। এই পীঠস্থানগুলোর নাম- সুগন্ধা, ভবানী, জয়ন্তী, মহালক্ষ্মী, অপর্ণা ও যশোরেশ্বরী।
বরিশালের উজিরপুর উপজেলার শিকারপুর গ্রামে সুগন্ধা নদীর পশ্চিম পাড়ে সুগন্ধা শক্তিপীঠের অবস্থান। সতী দেবীর নাসিকা এখানে পড়েছিল। নাসিকা যেহেতু গন্ধ নেওয়ার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত তাই এই পীঠের নাম দেওয়া হয় সুগন্ধা। ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর রচিত অন্নদামঙ্গল কাব্যে বলা হয়েছে-
সুগন্ধায় নাসিকা পড়িল চক্রহতা।
এ্যাম্বক ভৈরব তাহে সুনন্দা দেবতা।।
নদীর অন্য পাড়ে আছে শিবের ভৈরব অবতার 'এ্যম্বক' এর মন্দির।
জনশ্রুতি অনুযায়ী এই মন্দির প্রায় পাঁচ হাজার বছরের পুরোনো। এখানে পুরোনো মন্দিরের জায়গায় নতুন মন্দির তৈরি হয়েছে। পঞ্চচূড়া বিশিষ্ট নতুন মন্দিরের সর্বোচ্চ চূড়ার নিচে মূল গর্ভগৃহে দেবী সুগন্ধা রয়েছেন। স্থানীয়ভাবে দেবী এখানে 'উগ্রতারা' নামে পূজিতা।
এখানে দেবীর নিত্যপূজা হয়। আবার প্রতি অমাবস্যায় বিশেষ পূজা অনুষ্ঠিত হয়। সুগন্ধাপীঠের সবচেয়ে বড় উৎসব শিবচতুর্দশী। তখন মহাধুমধামে শিবপূজা হয়। দূরদূরান্ত থেকে প্রচুর পুণ্যার্থী ও দর্শনার্থী এখানে আসেন।
বরিশাল শহরের নথুল্লাবাদ বাসস্ট্যান্ড থেকে বাসযোগে ইসলাবী যেতে হয়। সেখান থেকে রিকশা-ভ্যানে সহজেই সুগন্ধা শক্তিপীঠে যাওয়া যায়।
চট্টগ্রাম জেলার সীতাকুন্ড উপজেলার চন্দ্রনাথ পাহাড়ের উপর রয়েছে ভবানী শক্তিপীঠ। সীতাকুন্ড বাজার থেকে প্রায় চার কিলোমিটার পূর্বে চন্দ্রনাথ পাহাড়। এর চূড়ায় ভবানী শক্তিপীঠের অবস্থান। স্থানীয়দের কাছে যা চন্দ্রনাথ শক্তিপীঠ নামে পরিচিত। এখানে দক্ষকন্যা সতীর ডান হাত পড়েছিল। ভবানী শক্তিপীঠের পাশে শিবের ভৈরব অবতার 'চন্দ্রশেখর' নামে পূজিত। অন্নদামঙ্গল কাব্যে বলা হয়েছে- চট্টগ্রামে ডানি হস্ত অর্ধ অনুভব। ভবানী দেবতা চন্দ্রশেখর ভৈরব ।।
চন্দ্রনাথ পাহাড়ের সৌন্দর্য অতি মনোরম। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এক হাজার ফুটেরও বেশি উঁচু এই পাহাড়। চারিদিকে পাহাড়ি বন। পাহাড়ের পশ্চিম দিকে বিশাল সমুদ্র। বিশ্রাম নিয়ে ধাপে ধাপে পাহাড়ের সর্বোচ্চ শিখরে উঠতে হয়। ভবানী শক্তিপীঠ ছাড়াও এখানে চন্দ্রনাথ শিবের মন্দির, মহাপুরুষকেন্দ্রিক নানা মন্দির, ধর্মশালা ইত্যাদি রয়েছে।
দেশবিদেশ থেকে বহু সাধু-সন্ন্যাসী ও পুণ্যার্থী এখানে আসেন। পাপমোচন বা মনকে পবিত্র করার জন্য ভক্তদের আগমন ঘটে। এখানে দেবীর নিত্যপূজা হয়। ভবানী শক্তিপীঠের সবচেয়ে বড় উৎসব শিবচতুর্দশী। উৎসব উপলক্ষে এখানে মেলা বসে। চট্টগ্রাম শহরের অলঙ্কার মোড় বা কদমতলীর মোড় থেকে ঢাকা- চট্টগ্রামগামী বাসে সীতাকুন্ড বাসস্টপেজ পৌঁছানো যায়। সেখান থেকে টেম্পু বা অটোরিকশাযোগে চন্দ্রনাথ পাহাড়ের পাদদেশে যাওয়া যায়। দীর্ঘসিঁড়ি বেয়ে পাহাড়ের শীর্ষে পৌঁছোলে দেবীর পীঠস্থানের দর্শন মেলে।
সিলেট জেলার কানাইঘাট থানার কালাজোড় বাউরভাগ গ্রামে জয়ন্তী শক্তিপীঠের অবস্থান। এখানে সতীদেবীর বাম উরু পড়েছিল। জয়ন্তী শক্তিপীঠের পাশেই শিবের অবতার ভৈরব ক্রমদীশ্বর নামে পূজিত। অন্নদামঙ্গল কাব্যে বলা হয়েছে-
জয়ন্তায় বাম জঙ্ঘা ফেলিলা কেশব। জয়ন্তী দেবতা ক্রমদীশ্বর ভৈরব।।
এই পীঠে একটি চারকোণা অগভীর গর্তে একটি পাথরখণ্ড আছে। পাথরখণ্ডটির আকৃতিও চারকোণা। লোকশ্রুতি আছে, এ পাথরখণ্ডটি সতীর বাম উরুর রূপান্তরিত রূপ। ভক্তদের বিশ্বাস, দেবী ও ভৈরব ক্রমদীশ্বর একই কূপে একই সাথে বিরাজ করেন। জনৈক জমিদার এ পাথরের অলৌকিকত্ব জানতে পেরে এখানে মন্দির নির্মাণ করেন। পাশে অন্য একটি অগভীর কূপ আছে। যার জল অতি স্বচ্ছ। সেই জলেই দেবীর পূজা হয়।
পীঠস্থানকে কেন্দ্র করে এখানে নাটমন্দির, শিবমন্দির, সানবাঁধানো দীঘি নির্মিত হয়েছে। প্রতিবছর চৈত্র মাসের প্রথম ও দ্বিতীয় দিনে এখানে মায়ের পূজা হয়। দেশ-বিদেশ থেকে বহু দর্শনার্থী ও পুণ্যার্থী তখন এখানে আসেন।
জয়ন্তীপীঠে যেতে হলে সিলেট থেকে বাসযোগে প্রথমে চতুলবাজার, চতুলবাজার থেকে অটোরিকশাযোগে শলৈঘাট হয়ে কালাজোড় বাউরভাগে যেতে হবে। এখানেই দেবীর দর্শন পাওয়া যায়।
সিলেট জেলার আর একটি শক্তিপীঠের নাম মহালক্ষ্মী। সিলেট শহরের তিন কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে দক্ষিণ সুরমায়, সিলেট- ফেঞ্চুগঞ্জ মহাসড়কের পশ্চিম পাশে জৈনপুর গ্রামে এই পীঠের অবস্থান। এখানে সতী দেবীর গ্রীবা (গলা) পতিত হয়। তাই একে গ্রীবা-মহাপীঠও বলা হয়। দেবীর গ্রীবা পড়েছিল একটি শৈলখণ্ডের উপর। সেই শৈলখণ্ডই দেবীরূপে পূজিত। মহাদেব ভৈরব এখানে সর্বানন্দ নামে পূজিত। অন্নদামঙ্গল কাব্যে বলা হয়েছে-
শ্রীহট্টে পড়িল গ্রীবা মহালক্ষ্মী দেবী।
সর্বানন্দ ভৈরব বৈভব যাহা সেবি।।
পুরাতন মন্দিরের পরিবর্তে এখানে নতুন মন্দির তৈরি হয়েছে। যা অত্যন্ত কারুকার্য খচিত, প্রশস্ত ও দৃষ্টিনন্দন। এখানে নবরাত্রি উৎসব মহাসমারোহে উদ্যাপিত হয়। তখন দেশ-বিদেশ থেকে বহু ভক্তের সমাগম ঘটে।
সিলেট শহরের কেন্দ্রীয় বাসটার্মিনাল থেকে মোগলাবাজার রোড ধরে রিকশা, ভ্যান বা অটোরিকশায় তিন কিলোমিটার গেলেই মহালক্ষ্মী শক্তিপীঠে পৌঁছোনো যায়।
বগুড়ার শেরপুর উপজেলার ভবানীপুর গ্রামে অপর্ণা শক্তিপীঠের অবস্থান। দেবীর বাম পায়ের গোঁড়ালি বা বাম কান এখানে পড়েছিল। মহাদেবের অবতার ভৈরব এখানে বামন নামে পূজিত। অন্নদামঙ্গলে বলা হয়েছে-
করতোয়া তটে পড়ে বাম কর্ণ তাঁর।
বামেশ ভৈরব দেবী অপর্ণা তাঁহার ।।
এই পীঠস্থানে অনেকগুলো পুকুর রয়েছে। যার মধ্যে বিখ্যাত শাঁখারী-পুকুর। নাটোরের মহারানি ভবানীকে এই পুকুরের মধ্যে শাঁখা-পরিহিতা অবস্থায় দেবী দেখা দিয়েছিলেন, এমন লোকশ্রুতি রয়েছে। ভক্তরা তাই পাপমোচনের জন্য এই পুকুরের জলে স্নান করেন। শিবমন্দির, নাটমন্দির, গোপালমন্দির, ভোজনশালা- সব মিলে পীঠস্থানটি গড়ে উঠেছে। দুর্গাপূজা, শ্যামাপূজা, রামনবমী, মাঘীপূর্ণিমা ইত্যাদি উৎসব সাড়ম্বরে এখানে পালিত হয়। দূরদূরান্ত থেকে পুণ্যার্থী ও দর্শনার্থীরা তখন এখানে আসেন।
বগুড়া থেকে বাসযোগে শেরপুর এবং শেরপুর থেকে রিকশা বা ভ্যানে করে সহজেই অপর্ণা শক্তিপীঠে পৌঁছানো যায়।
সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার ঈশ্বরীপুর গ্রামে যশোরেশ্বরী শক্তিপীঠ অবস্থিত। যশোরেশ্বরী অর্থ যশোরের ঈশ্বরী। অর্থাৎ যশোরের দেবী। এখানে দেবীর হাতের তালু ও পায়ের পাতা পতিত হয়। মহাদেব শিবের অবতার ভৈরব চন্ড নামে এখানে পূজিত। এখানকার পীঠের মূল মন্দির, শিবমন্দির, পুকুর সবই ত্রিকোণাকৃতি। এই পীঠস্থানে নিত্যপূজা হয়। সবচেয়ে বড় উৎসব শ্যামাপূজা। পূজা উপলক্ষে মেলা বসে। দূরদূরান্ত থেকে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীরা উৎসবে যোগ দেন। মন্দিরের পাশে মসজিদ, গীর্জা প্রভৃতির অবস্থান সর্বজনীনতা প্রমাণ করে।
সাতক্ষীরার কেন্দ্রীয় বাসটার্মিনাল থেকে বাসযোগে শ্যামনগর এসে রিকশা-ভ্যানে করে যশোরেশ্বরী শক্তিপীঠে পৌঁছানো যায়।
'ধাম' শব্দের আক্ষরিক অর্থ নিবাস, আশ্রয়স্থল। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণে দেবতার অধিষ্ঠিত নিবাসস্থলই ধাম। অলৌকিক ধর্মীয় কাহিনি বা মহাপুরুষদের জীবন-লীলার সাথে যুক্ত পুণ্যভূমিকেও ধাম বলা হয়। ভক্তরা নিজের পাপমোচন, পুণ্য অর্জন, সর্বোপরি নির্মল প্রশান্তি লাভের জন্য ধামে আসেন। ধামে এসে সংসারে আবদ্ধ জীবের মনের নানা জটিলতা, দ্বিধা-দ্বন্দ্ব কেটে যায়। ধামগুলোকে তাই পুণ্যভূমি, তীর্থক্ষেত্র বা মোক্ষভূমিও বলা হয়। ধামের মূল দেবতাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে মন্দির। আবার, আগত ভক্তদের সুবিধার্থে সেখানে আবাসন, রন্ধনশালা, ভোজনালয়, ধর্মশালা ইত্যাদির ব্যবস্থাও থাকে। এ সব প্রতিষ্ঠানকে একসাথে ধাম বলা হয়।
হিন্দুধর্মে অনেক ধামের উল্লেখ আছে। ধামগুলোর মধ্যে চারটি ধাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য- বদ্রীনাথধাম, রামেশ্বরমধাম, দ্বারকাধাম এবং জগন্নাথধাম। এদেরকে একসাথে চতুর্ধাম বলা হয়। ভারতবর্ষের উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব, পশ্চিম চার প্রান্তসীমায় চারটি ধামের অবস্থান। ভারতের মানচিত্রকে দৈর্ঘ্য-প্রস্থের দিক থেকে সমান দুই ভাগ করে একটি গাণিতিক যোগ-চিহ্ন (+) আঁকা হলে চিহ্নের বাহুগুলোর শীর্ষপ্রান্তে ধামগুলোর অবস্থান। বদ্রী- নাথধাম ভারতের উত্তর সীমানায়, রামেশ্বরমধাম দক্ষিণ সীমানায়, দ্বারকাধাম পশ্চিম সীমানায় এবং জগন্নাথ- ধাম পূর্ব সীমানায় অবস্থিত। পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে বদ্রীনাথধাম সত্যযুগের, রামেশ্বরমধাম ত্রেতাযুগের, দ্বারকাধাম দ্বাপরযুগের এবং জগন্নাথধাম কলি যুগের কাহিনির সাথে যুক্ত। তীর্থক্ষেত্রের পাশাপাশি ধামগুলো দর্শনীয় স্থান হিসেবেও মনোরম।
ভারতের উত্তরাখণ্ড রাজ্যের চামোলি জেলার একটি শহর বদ্রীনাথ। শহরের গাড়োয়াল পার্বত্য এলাকায় অলকানন্দা নদীর ধারে বদ্রীনাথধাম অবস্থিত। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে তিন হাজার মিটার উচ্চতায় এই ধামের অবস্থান। ভগবান বিষ্ণু এখানে বদ্রীনারায়ণ-রূপে পূজিত। স্থানীয়রা এই ধামকে 'দীব্যদেশম' বলেন। তাঁদের বিশ্বাস ভগবান বিষ্ণু এখানে জাগ্রত অবস্থায় রয়েছেন।
দীর্ঘ সিঁড়ি অতিক্রম করে মূল মন্দিরে প্রবেশ করতে হয়। মন্দিরটি তিন ভাগে বিভক্ত- সভাম- গুপ, দর্শনমণ্ডপ ও গর্ভগৃহ। গর্ভগৃহে চাঁদোয়ার নিচে বদ্রীনায়ায়ণের চতুর্ভুজ মূর্তি স্থাপিত। কষ্টিপাথরের এই মূর্তির উচ্চতা এক মিটার। উপরের দুই হাত উত্তোলিত অবস্থায় শঙ্খ ও চক্র ধারণ করা। নিচের দুই হাত যোগমুদ্রায় ও পদ্মাসনে স্থিত।
মন্দিরের একদিকে নরপর্বত এবং বিপরীত দিকে নারায়ণ-পর্বত। মন্দিরে রয়েছে তপ্তকুন্ড নামে একটি উষ্ণ প্রস্রবণ। ভক্তদের বিশ্বাস কুন্ডের জলে স্নান করলে রোগমুক্তি হয়। পাহাড়ি পরিবেশ, বহমান অলকানন্দা নদী- সব মিলে বদ্রীনাথধামের পরিবেশ অতি মনোরম। রাতের আলোকোজ্জ্বল পরিবেশে তা আরও সুন্দর হয়ে ওঠে।
লোকশ্রুতি অনুসারে, শঙ্করাচার্য এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি অলকানন্দা নদী থেকে বদ্রীনাথের মূর্তি উদ্ধার করে মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। তখন থেকে বদ্রীনাথধামে ভক্তদের সমাগম বাড়তে থাকে। পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে, বদ্রীনাথধামের প্রকৃত নাম বদরিকা-ধাম বা বদরিকাশ্রম। সংস্কৃতে 'বদর' শব্দের অর্থ কোলিবৃক্ষ বা কুল গাছ। ভগবান বিষ্ণু হিমালয়ের এই তীব্র শীতাঞ্চলে ধ্যানমগ্ন হন। তাঁকে শীত থেকে রক্ষার জন্য লক্ষ্মীদেবী বদরবৃক্ষ-রূপে ছায়া দিতে থাকেন। সহধর্মিণীর প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে ভগবান নারায়ণ এই স্থানের নাম দেন বদরিকা- শ্রম। পরে তা বদ্রীনাথধামে পরিচিত হয়।
এখানে গঙ্গামাতার আবির্ভাব উৎসব সাড়ম্বরে পালিত হয়। হিমালয় থেকে দেবী গঙ্গার পৃথিবীতে আবির্ভাবকে উপলক্ষ করে এই উৎসব।
ভারতের কলকাতার হাওড়া স্টেশন থেকে রেলযোগে উত্তরাখণ্ডের হৃষিকেশে যাওয়া যায়। সেখান থেকে গণ-পরিবহনে বদ্রীনাথধামে পৌঁছে বদ্রীনারায়ণের বিগ্রহ দর্শন করা যায়। প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ দর্শনার্থী বিগ্রহ দর্শনে আসেন। উল্লেখ্য, বদ্রীনাথধাম বছরে ছয় মাস (এপ্রিলের শেষ থেকে অক্টোবরের শেষ পর্যন্ত) দর্শনার্থীদের জন্য খোলা থাকে। তীব্র শীতের বিরূপ আবহাওয়ার জন্য বাকি ছয় মাস বন্ধ থাকে।
ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যের রামনাথপুর জেলার পামবান দ্বীপে রামেশ্বরমধামের অবস্থান। ভারতবর্ষের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে পামবান দ্বীপ সেতুর মাধ্যমে যুক্ত। দক্ষিণ ভারতের এই দ্বীপ থেকে শ্রীলঙ্কা মাত্র চল্লিশ কি- লোমিটার দূরে অবস্থিত। দ্বীপের একদিকে বঙ্গোপসাগর, অন্যদিকে ভারত মহাসাগর। মূল মন্দিরের গর্ভগৃহে শিবলিঙ্গ পূজিত হন, যা জ্যোতির্লিঙ্গ নামে পরিচিত। এখানে রা- মেশ্বরম-এর পাশাপাশি রামেশ্বরী অর্থাৎ দেবী পার্বতী পূজিতা। মন্দিরে রয়েছে বাইশটি কূপ, যাকে কুন্ড বলা হয়। প্রতিটি কুন্ডের জলের তা- পমাত্রাসহ অন্যান্য বৈশিষ্ট্য আলাদা। ভক্তদের বিশ্বাস, কুণ্ডের জলে স্নান করলে আরোগ্য লাভ হয়।
রামেশ্বরম একটি সমস বদ্ধ শব্দ যিনি রাম তিনিই ঈশ্বর রামেশ্বরম। অতএব রামের নামেই এই ধামের নামকরণ। রামায়ণ অনুসারে লঙ্কেশ্বর রাবণ কর্তৃক অপহৃতা স্ত্রী সীতাকে উদ্ধারের আগে রামচন্দ্র বানর সৈন্য- দের সাথে নিয়ে এই দ্বীপে জড়ো হন। সীতাকে উদ্ধার শেষে পুনরায় একই স্থানে একত্রিত হন। সেখানে রাবণকে বধের প্রায়শ্চিত্ত করতে শিবলিঙ্গের পূজা করা হয়। সেই লিঙ্গই প্রসিদ্ধ জ্যোতির্লিঙ্গ। এখানে নিত্যপূজা ছাড়াও নানা উৎসবাদি সাড়ম্বরে উদ্যাপিত হয়।
কলকাতার হাওড়া স্টেশন থেকে সরাসরি রামেশ্বরধামে যাওয়ার ট্রেন পাওয়া যায়।
ভারতের গুজরাট রাজ্যের দ্বারকা জেলায় অবস্থিত দ্বারকাধাম। দ্বারকা ভারতবর্ষের প্রাচীনতম শহরগুলোর মধ্যে একটি। দ্বারকা শব্দটি এসেছে দ্বার থেকে। দ্বার অর্থ দরজা। বহু দ্বারের সমন্বয়ে দ্বারকা নগরী সুরক্ষিত হতো। তাই নগরীর নাম দ্বারকা। গোমতী নদী ও আরব সাগরের সঙ্গমস্থ- লেই দ্বারকামন্দির। এখানে দ্বারকাধীশ নামে ভগবান নারায়ণ পূজিত। শঙ্করাচার্য এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। সমুদ্রের জলে বহুবার নিমজ্জিত হয় দ্বারকামন্দির। পরে তা পুন- নির্মাণ করা হয়। বর্তমানে সংস্কারকৃত সেই মন্দির দৃশ্যমান।
পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে দ্বারকার রাজা ছিলেন শ্রীকৃষ্ণ। রাজা হিসেবে তাঁকে দ্বা- কাধীশ বলা হয়। তিনি সমুদ্র থেকে বারো যোজন (৯৬ বর্গ কি.মি.) জায়গা জলশাসনের মাধ্যমে উদ্ধার করে এই নগরী নির্মাণ করেছিলেন।
কলকাতার হাওড়া স্টেশন থেকে রেলযোগে আহমেদাবাদ গিয়ে, আহমেদাবাদ থেকে রেলপথে দ্বারকা ধামে পৌঁছানো যায়।
ভারতের উড়িষ্যা রাজ্যের পুরী জেলায় জগন্নাথধাম অবস্থিত। বঙ্গোপসাগরের তীরে অত্যন্ত নান্দনিক পরিবেশে এর অবস্থান। জগন্নাথ শব্দের অর্থ জগতের নাথ। ভগবান নারায়ণকেই এখানে জগ- ন্নাথ বলা হয়েছে। জগন্না- থদেবের মন্দিরকে কেন্দ্র করে এখানে জগন্নাথধাম গড়ে উঠেছে।
মন্দিরের প্রাচীরের চারটি দ্বার- সিংহদ্বার, হস্তীদ্বার, অশ্বদ্বার ও ব্যাঘ্রদ্বার। মূল মন্দিরে ওঠার জন্য রয়েছে সুদীর্ঘ সিঁড়ি।
জগন্নাথদেবের বিগ্রহ নির্মাণের একটি পৌরাণিক কাহিনি রয়েছে। কৃষ্ণভক্ত রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন বিষ্ণুর উপাসনা করতে চান। কিন্তু কোন মূর্তিতে ভজনা করবেন সেই সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলেন না। এমন সময় ইন্দ্রদ্যুম্মের সামনে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আবির্ভূত হন। তিনি ইন্দ্রদ্যুমকে পুরীর সমুদ্রতটে ভেসে আসা একখণ্ড কাঠ দিয়ে বিগ্রহ। নির্মাণের আদেশ দেন। এ সময়ে এক বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ ইন্দ্রদ্যুম্নের সামনে উপস্থিত হন। তিনি কাষ্ঠখণ্ড থেকে বিগ্রহ নির্মাণের দায়িত্ব নেন। কিন্তু মূর্তি নির্মাণ শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাঁকে কেউ কাজে বাধা দিতে পারবেন না, এই বলে তিনি নির্মাণ ঘরের দরজা বন্ধ করে দেন। এদিকে নির্মাণ শেষ হওয়ার আগেই রাজা অস্থির হয়ে ঘরের দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে দেখতে পান, মূর্তির হাত-পা তৈরি তখনও বাকি। শিল্পীও অনুপস্থিত। এই শিল্পীই দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা। পরে সেই অসমাপ্ত মূর্তিই জগন্নাথ নামে জগন্নাথধামে পূজিত হয়ে আসছে।
জগন্নাথদেবের পাশাপাশি এখানে কৃষ্ণভ্রাতা বলরাম এবং কৃষ্ণভগ্নী সুভদ্রার বিগ্রহ রয়েছে।
পুরীর জগন্নাথধামে সারা বছরে মোট বারোটি পার্বণ পালিত হয়। পার্বণগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় জগন্নাথদে- বের রথযাত্রা। আষাঢ় মাসের শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়া তিথিতে রথযাত্রা হয়। ঐদিন জগন্নাথদেবের বিগ্রহকে বের করে রথে তোলা হয়। সাথে বলরাম ও সুভদ্রার বিগ্রহকে রথে তোলা হয়। রথকে রশিতে বেঁধে ভক্তরা তা টেনে নিয়ে যান। সাত দিন পর রথকে টেনে মন্দিরে আবার ফিরিয়ে আনা হয়। একে বলে উল্টোরথ। লক্ষ লক্ষ ভক্ত রথযাত্রায় যোগ দেন।
কলকাতার হাওড়া থেকে ট্রেনযোগে বা বাসে করে পুরীর জগন্নাথ ধামে যাওয়া যায়।
ছক ২.১৪: শক্তিপীঠদর্শন
শক্তিপীঠগুলোয় যে কারণে ভ্রমণ করতে যাওয়া প্রয়োজন বলে আমি মনে করি-
|
ছক ২.১৪: তীর্থস্থান ভ্রমণ-পরিকল্পনা
যেখানে যেতে চাই
| যে কারণে যেতে চাই:
|
যেভাবে যাব:
| যা যা করবো:
|