১৯০০ সালের দিকে এ ধারণা প্রায় স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে, এই মহাবিশ্বের সকল কিছু পরমাণু দিয়ে গড়া। এটাও প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছিল যে, সকল পরমাণুতেই রয়েছে ইলেকট্রন। এর প্রমাণ অবশ্য পাওয়া গিয়েছিল ক্যাথোড রশ্মি ও ফটোইলেকট্রিক ক্রিয়া নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করার সময়। ইলেকট্রন ঋণাত্মক আধানযুক্ত কণিকা। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে পরমাণু সর্বসমেতভাবে একটি নিরপেক্ষ কণিকা। সুতরাং এটা ধারণা করা স্বাভাবিক ছিল যে, পরমাণুতে অবশ্যই ঋণাত্মক আধানের সমপরিমাণ ধনাত্মক আধান রয়েছে। এছাড়া, ইলেক্ট্রনের মোট ভর পরমাণুর ভরের তুলনায় খুবই নগণ্য। সুতরাং ধারণা করা হয়েছিল যে, পরমাণুতে অধিক ভরবিশিষ্ট ধনাত্মক আধানযুক্ত কণিকা রয়েছে। এ ধারণার প্রেক্ষিতে বিজ্ঞানী থমসন পরমাণুর গড়নের একটি মডেল প্রস্তাব করেন। এই মডেলটি প্লাম পুডিং মডেল নামে অভিহিত। একে বাংলায় কিশমিশ পুডিং মডেল বলা যেতে পারে ।
থমসনের কিশমিশ পুডিং মডেল বিজ্ঞানীদের মধ্যে তেমন গ্রহণযোগ্যতা না পাওয়ায় বিজ্ঞানীরা নতুন নতুন মডেলের সন্ধানে গবেষণা চালিয়ে যেতে থাকেন। রাদারফোর্ড আলফা কণা পরীক্ষার মাধ্যম সৌর মডেল প্রদান করেন। পরবর্তীতে নীলস্ বোর রাদারফোর্ডের পরীক্ষালব্ধ ফলাফল ও প্ল্যাঙ্কের কোয়ান্টাম তত্ত্ব সমন্বয় করে পরমাণুর কোয়ান্টাম মডেল প্রদান করেন।
১৮৯৮ সালে বিজ্ঞানী জে. জে. থমসন যে কিশমিশ পুডিং মডেল তাতে তিনি বলেন যে, পুডিংয়ের ভেতর কিশমিশ যেমন বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে পরমাণুতে ঠিক তেমনি নিরবচ্ছিন্নভাবে বণ্টিত ধনাত্মক আধানের মধ্যে ইলেকট্রন ছড়িয়ে আছে। দেশজভাবে এ মডেলকে তরমুজ মডেল বলা যেতে বে বঞ্চিত rner.cবস্তার করেন পারে। তরমুজের রসালো অংশকে যদি ধনাত্মক আধান বিবেচনা করা হয় এবং তরমুজের বীচিকে যদি ঋণাত্মক আধানযুক্ত ইলেকট্রন মনে করা হয় তাহলে তরমুজের রসালো অংশের মধ্যে এর বীচিগুলো বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে থাকাকে থমসন পরমাণু মডেলের সাথে তুলনা করা যেতে পারে (চিত্র ৯.১)।
থমসন বলেছিলেন যে, ইলেকট্রনগুলোর মধ্যে তড়িৎ মিথস্ক্রিয়ার দরুন এরা এক অ্যাঙ্গউম (10-10m) পর্যায়ের ব্যাসার্ধের কল্পিত গোলাকৃতি পরমাণুর ভেতর সুবিন্যস্ত থাকে।
রাদারফোর্ডের পরীক্ষাআর্নেস্ট রাদারফোর্ড ১৯০৯ সালে তাঁর বিখ্যাত আলফা কণা বিক্ষেপণ পরীক্ষা সম্পাদন করেন। আলফা কণা হলো তেজস্ক্রিয় বিকিরণে নির্গত ধনাত্মক আধানযুক্ত কণিকা। রাদারফোর্ডের নির্দেশে তার দুজন সহকর্মী গাইগার ও মার্সডেন এ পরীক্ষাটি করেছিলেন। একটি তেজস্ক্রিয় উৎস থেকে নির্গত আলফা কণা দিয়ে ভারী ধাতুর (যেমন স্বর্ণ) অত্যন্ত পাতলা | পাতকে আঘাত করা হয়েছিল। পরীক্ষায় যে স্বর্ণের পাত ব্যবহার করা হয়েছিল তার পুরুত্ব ছিল 6 x 10-7m। স্বর্ণপাতের অপরদিকে রাখা হয়েছিল একটি চলনশীল জিঙ্ক সালফাইড পর্দা (চিত্র ৯.২)। আলফা কণা যখন এ পর্দায় এসে পড়ত তখন আলোকপ্রভা দেখা যেত। পরীক্ষায় দেখা যায় যে, প্রায় 99% আলফা কণাই স্বর্ণপাত ভেদ করে সোজাসুজি চলে যায় এবং ZnS পর্দাকে আলোকিত করে। থাকে বেঁকে যায়। মাত্র কয়েকটি আলফা কণা তাদের পথ থেকে বেঁকে যায়। কমসংখ্যক আলফা কণা (প্রায় 20,000 এর মধ্যে 1 টি) সোজা বিপরীত দিকে ফিরে আসে। |
---|
পরমাণুর অধিকাংশ স্থানই ফাঁকা। যেহেতু আলফা কণার তুলনায় ইলেকট্রনের ভর অতি নগণ্য, সেহেতু এই ফাঁকা স্থানে ইলেকট্রন থাকতে পারে। তবে এরা আলফা কণার গতিপথের কোনো পরিবর্তন ঘটাতে পারে না ।
যেহেতু খুব কম সংখ্যক আলফা কণা বিপরীত দিকে ফিরে আসে, তাই বলা যায়, আলফা কণা সোজাসুজি তার চেয়ে ভারী কোনো কিছুর সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয় বা তা দ্বারা বিকর্ষিত হয়। অর্থাৎ পরমাণুর কেন্দ্রে পরমাণুর সমস্ত ভর অতি ক্ষুদ্র স্থান দখল করে থাকে।
যেহেতু আলফা কণাসমূহ ধনাত্মক আধানযুক্ত এবং এক্ষেত্রে বিকর্ষিত হয় সেহেতু পরমাণুর কেন্দ্রও ধনাত্মক আধানযুক্ত হবে । তিনি ভারী ও ধনাত্মক আধানযুক্ত পরমাণুর এ কেন্দ্রকে নিউক্লিয়াস নামে অভিহিত করেন।
নিউক্লিয়াসের আয়তন সমগ্র পরমাণুর আয়তনের তুলনায় খুবই কম। হাইড্রোজেন পরমাণুর ব্যাস যেখানে 10-10m, সেখানে নিউক্লিয়াসের ব্যাস 10-15 m থেকে 10-14m, অর্থাৎ পরমাণু নিউক্লিয়াসের তুলনায় দশ হাজার থেকে এক লাখ গুণ বড়।
আলফা কণিকা বিক্ষেপণ পরীক্ষার পর্যবেক্ষণের ওপর ভিত্তি করে ১৯১১ সালে রাদারফোর্ড পরমাণুর গঠন সম্পর্কে একটি মডেল প্রদান করেন।
পরমাণুর কেন্দ্রস্থলে একটি ধনাত্মক আধানযুক্ত ভারী বস্তু আছে। এই ভারী বস্তুকে নিউক্লিয়াস বলা হয়। পরমাণুর মোট আয়তনের তুলনায় নিউক্লিয়াসের আয়তন অতিশয় নগণ্য। নিউক্লিয়াসে পরমাণুর সমস্ত ধনাত্মক আধান এবং প্রায় সমস্ত ভর কেন্দ্রীভূত।
পরমাণু তড়িৎ নিরপেক্ষ। অতএব নিউক্লিয়াসের ধনাত্মক আধানের সমান সংখ্যক ঋণাত্মক আধানযুক্ত ইলেকট্রন পরমাণুর নিউক্লিয়াসকে ঘিরে থাকে।
সৌরজগতে সূর্যের চারদিকে ঘূর্ণায়মান গ্রহসমূহের মতো পরমাণুর ইলেকট্রনগুলো এর কেন্দ্রে থাকা নিউক্লিয়াসের চারদিকে অবিরত ঘুরছে (চিত্র ৯.৩)। নিউক্লিয়াস ও ইলেকট্রনের মধ্যে বিদ্যমান স্থিরতড়িৎ আকর্ষণ বল এক্ষেত্রে কেন্দ্রমুখী বল হিসেবে কাজ করছে।
রাদারফোর্ডের পরমাণু মডেল আলফা কণা বিক্ষেপণ পরীক্ষার ফলাফলের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হলেও তাত্ত্বিক দিক দিয়ে মডেলটি যথেষ্ট বিরোধিতার সম্মুখীন হয়। এ মডেলের বিরোধীরা বলেন,
সৌরমণ্ডলের গ্রহসমূহ সামগ্রিকভাবে আধানবিহীন অথচ ইলেকট্রনগুলো ঋণাত্মক আধানযুক্ত এবং পরস্পরকে কুলম্ব বল দ্বারা বিকর্ষণ করে। অপরদিকে গ্রহগুলো মহাকর্ষ বল দ্বারা পরস্পরকে আকর্ষণ করে। সুতরাং গ্রহের সাথে ইলেকট্রনের তুলনা সঠিক হয় না।
ম্যাক্সওয়েলের তত্ত্বানুসারে কোনো আধানযুক্ত বস্তু বা কণা বৃত্তাকার পথে ঘুরলে তা ক্রমাগত শক্তি বিকিরণ করবে এবং তার গতিপথের ব্যাসার্ধ ধীরে ধীরে কমতে থাকবে এবং ঋণাত্মক আধানযুক্ত ইলেকট্রনসমূহ ক্রমাগত শক্তি হারিয়ে নিউক্লিয়াসে পতিত হবে (চিত্র ৯.৪)। ফলে পরমাণুর অস্তিত্ব থাকবে না। কিন্তু বাস্তবে পরমাণু হতে ক্রমাগত শক্তি বিকিরণ বা ইলেকট্রনের নিউক্লিয়াসে পতন কখনোই ঘটে না। আবর্তনশীল ইলেকট্রনের কক্ষপথের আকার সম্পর্কে কোনো ধারণা রাদারফোর্ডের মডেলে দেওয়া হয়নি।
রাদারফোর্ডের মডেলের সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করার জন্য রাদারফোর্ডের পরীক্ষালব্ধ ফলাফলের সাথে প্ল্যাঙ্কের কোয়ান্টাম তত্ত্ব সমন্বয় করে ১৯১৩ সালে ডেনমার্কের পদার্থবিজ্ঞানী নীলস্ বোর পরমাণুর গঠন সম্পর্কে একটা নতুন মডেল উপস্থাপন করেন।
কোয়ান্টাম তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে বোরের মডেলের উল্লেখযোগ্য প্রস্তাব বা স্বীকার্য হলো :
অর্থাৎ,
সুতরাং আবর্তনশীল ইলেকট্রনের কক্ষপথ ছিন্নায়িত ও অনুমোদিত।
এ কক্ষগুলো শক্তি স্তর নামে পরিচিত। নিউক্লিয়াস থেকে ক্রমাগত দূরবর্তী শক্তিরসমূহকে ১ম, ২য়, আ ইত্যাদি শক্তি স্তর বলা হয়। প্রত্যেক শক্তিস্তরে ইলেকট্রনের শক্তি নির্দিষ্ট।
কোনো ইলেকট্রন যদি উচ্চশক্তি স্তর Eu থেকে একটি নিম্নশক্তি স্তর El -এ গমন করে তাহলে নিঃসৃত ফোটনের
শক্তি হবে, hf = Eu - El….(9.2)
এখানে h হলো প্ল্যাঙ্কের ধ্রুবক এবং f হলো ফোটনের কম্পাঙ্ক।
রাদারফোর্ডের মডেলের সীমাবদ্ধতা অভিক্রমণ বোরের মডেলের সাহায্যে রাদারফোর্ড মডেলের সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করা সম্ভব হয়।
পরমাণুর স্থায়িত্ব এক অতি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। রাদারফোর্ডের মডেল পরমাণুর স্থায়িত্ব ব্যাখ্যা করতে ব্যর্থ হয়। কোয়ান্টাম মডেল উপস্থাপন করে বোর এ সীমবদ্ধতা অতিক্রম করতে সক্ষম হন। এই মডেলের সাহায্যে হাইড্রোজেন পরমাণুর বর্ণালি রেখার উৎপত্তির ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব হয় এবং কক্ষপথের ব্যাসার্ধ ও কক্ষপথে ইলেকট্রনের শক্তি পরিমাপ করাও এই মডেলের সাহায্যে সম্ভব হয়।
পরমাণুর ইলেকট্রনগুলোর শক্তির কতগুলো সুনির্দিষ্ট মান থাকতে পারে, এই মানগুলোকে পরমাণুর শক্তিস্তর বলা হয়। কোনো নির্দিষ্ট মৌলের সকল পরমাণুর শক্তিস্তরের একই রকম সেট থাকে। এটিই ঐ মৌলের বৈশিষ্ট্য। এর অর্থ হলো, অন্যান্য মৌলের জন্য শক্তিস্তরের এই সেট পৃথক। কোনো পরমাণুর বিভিন্ন শক্তিস্তরের শক্তি তরঙ্গ বলবিদ্যা ব্যবহার করে বের করা যায়। হাইড্রোজেন পরমাণুর বেলায় বোর মডেল ব্যবহার করে এই শক্তি স্তরের শক্তি বের করা যায়।
পরমাণুর শক্তি স্তরকে চিত্রে অনুভূমিক রেখায় অনুক্রম দ্বারা নির্দেশ করা হয়। চিত্র ১৯-৫-এ হাইড্রোজেন পরমাণুর শক্তিস্তরের চিত্র দেখানো হয়েছে। হাইড্রোজেনের শুধু একটি ইলেকট্রন থাকে যা সাধারণত সর্বনিম্ন শক্তিস্তর দখল করে থাকে। এই স্তরের শক্তির মান হলো - 13.6 eV। ইলেট্রনটি যখন এই শক্তি স্তরে থাকে তখন পরমাণু ভূমি অবস্থায় রয়েছে বলা হয়। কোনো পরমাণু যদি কোনো না কোনোভাবে শক্তি শোষণ করে অন্য কোনো পরমাণুর সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে অথবা তড়িতচৌম্বক বিকিরণ শোষণ করে যদি উত্তপ্ত হয় তাহলে ইলেকট্রনটি একটি উচ্চ শক্তিস্তরে উঠে যেতে পারে। এতে পরমাণুটি অস্থিতিশীল হয়। এ অবস্থাকে বলা হয় উত্তেজিত অবস্থা, কিছুক্ষণ পরে অক্রম সময় ব্যবধানে ইলেকট্রন শক্তির নিম্নতম স্তরে নেমে আসে অর্থাৎ পরমাণুটি ভূমি অবস্থায় ফিরে আসে । ইলেট্রন যে শক্তি শোষণ করছিল তা তড়িতচৌম্বক বিকিরণরূপে নির্গত হয়ে যায় ।
প্রতিটি শক্তিস্তরকে কোয়ান্টাম সংখ্যা দ্বারা বৈশিষ্ট্যায়িত করা হয়। সর্বনিম্ন শক্তিস্তরের জন্য n = 1, পরবর্তী স্তরের জন্য n = 2 ইত্যাদি, n = (অসীম) স্তরের জন্য শক্তির মান শূন্য। কোনো ইলেকট্রন উত্তেজিত হয়ে এই স্তরে উঠলে এটি আর পরমাণুতে আবদ্ধ থাকে না, পরমাণু থেকে মুক্ত হয়ে যায়। কোনো পরমাণু একটি ইলেকট্রন হারালে তা আয়নিত হয়ে যায়, ভূমি অবস্থা থেকে কোনো হাইড্রোজেন পরমাণুকে আয়নিত করতে 13.6ev শক্তির প্রয়োজন হয়।
রাদারফোর্ডের আলফা কণা বিক্ষেপণ পরীক্ষা থেকে জানা যায় যে, পরমাণুর প্রায় সমস্ত ভর (99.97%) এর কেন্দ্রে একটি বিন্দুতে কেন্দ্রীভূত থাকে এবং এখানেই থাকে পরমাণুর সকল ধনাত্মক আধান। রাদারফোর্ড পরমাণুর এই কেন্দ্রবিন্দুর নামকরণ করেন নিউক্লিয়াস। নিউক্লিয়াসের মধ্যে থাকে ধনাত্মক আধান যুক্ত প্রোটন এবং আধান নিরপেক্ষ নিউট্রন। সবচেয়ে সরল পরমাণু হাইড্রোজেনের নিউক্লিয়াসে কোনো নিউট্রন থাকে না-শুধুমাত্র একটি প্রোটন থাকে। আধান নিরপেক্ষ পরমাণুর নিউক্লিয়াসে অবস্থিত ধনাত্মক আধানযুক্ত প্রোটন সংখ্যার সমসংখ্যক ঋণাত্মক আধানযুক্ত ইলেকট্রন নিউক্লিয়াসকে কেন্দ্র করে আবর্তনশীল থেকে পুরো পরমাণুর আধান নিরপেক্ষতা বজায় রাখে।
নিউক্লিয়াসের গঠন অতি জটিল। আলফা কণা ও গামা রশ্মি বর্ণালি থেকে জানা যায় যে, নিউক্লিয়াস থেকে আলফা কণা ও গামা রশ্মি নির্গত হয়। গামা রশ্মির বর্ণালি থেকে জানা যায় যে, নিউক্লিয়াসে আরো একটি কণার অস্তিত্ব রয়েছে। এই কণাকে নিউট্রিনো বলা হয়। এর কোনো ভর নেই। মহাজাগতিক বা কসমিক রশ্মির গবেষণা থেকে জানা যায় যে, নিউক্লিয়াসের ভিতরে আরো এক ধরনের কণার অস্তিত্ব আছে। এদেরকে বলা হয় মেসন।
নিউক্লিয়াসে অবস্থিত ধনাত্মক আধানযুক্ত প্রোটনের সংখ্যাকে বলা হয় পারমাণবিক সংখ্যা। একে Z দ্বারা নির্দেশ করা হয় । নিউক্লিয়াসে অবস্থিত প্রোটন ও নিউট্রনের মোট সংখ্যাকে ভরসংখ্যা বলে। একে A দ্বারা প্রকাশ করা হয় । A থেকে Z বাদ দিলে নিউট্রন সংখ্যা N পাওয়া যায়। সাধারণত কোনো মৌলিক পদার্থের নিউক্লিয়াসকে রূপে লেখা হয়। এখানে X হচ্ছে মৌলিক পদার্থের রাসায়নিক সংকেত, Z হলো পারমাণবিক সংখ্যা এবং A হলো ভর সংখ্যা।
নিউক্লিয়াসের ব্যাসার্ধ R কে প্রকাশ করা হয় R = সম্পর্ক দ্বারা। এখানে ro একটি ধ্রুবক যার মান ro = 1.414 ×10-15 m এবং A হচ্ছে নিউক্লিয়াসের প্রোটন ও নিউট্রনের মিলিত সংখ্যা তথা ভর সংখ্যা। নিউক্লিয়াসের ব্যাসার্ধ প্রায় 10-15m। একে ফেমটোমিটার বা ফার্মিও বলা হয় ।
নিউক্লিয়াসকে আলফা কণা দ্বারা আঘাত করে দেখা গেছে যে, তা থেকে সাধারণত প্রোটন এবং নিউট্রন বেরিয়ে আসে। সুতরাং এ সিদ্ধান্তে আসা যায় যে, নিউক্লিয়াস হলো প্রোটন এবং নিউট্রনের সমষ্টি। অন্যান্য পরীক্ষা থেকে জানা গেছে নিউক্লিয়াসের ভিতর অন্যান্য কণা রয়েছে যেমন, নিউট্রিনো।
সুতরাং এর আধান 1.6 x 10-19 C। এর ভর প্রায় 1.00727663 a.mu ৰা, 1.6724 × 10-27 kg এবং নিশ্চল শক্তি প্রায় 938.256 MeV
নিউট্রন (Neutron) : স্বাভাবিক হাইড্রোজেন নিউক্লিয়াস ব্যতীত সকল নিউক্লিয়াস এই প্রাথমিক কণা দিয়ে তৈরি।
এর ভর প্রায় 1.0086654 am u বা 1.6747 x 10-27 kg এবং নিশ্চল শক্তি প্রায় 938.550 Mev
নিউক্লিয়াসের বাইরে 10.6 মিনিট অর্ধায়ুসহ এটা অবক্ষয় প্রাপ্ত হয়ে তৈরি করে একটি প্রোটন, একটি ইলেকট্রন এবং একটি প্রতিনিউট্রিনো। এটি অত্যধিক ভেদন ক্ষমতা সম্পন্ন।
একটি নিউক্লীয় প্রজাতিকে বলা হয় নিউক্লাইড। একটি নিউক্লাইডকে তার রাসায়নিক সংকেত এবং রাসায়নিক সংকেত এর শির সংখ্যা (A = Z + N) দ্বারা শনাক্ত করা হয়।
যেমন- এবং এদের প্রোটন সংখ্যা সমান, কিন্তু ভর সংখ্যা অসমান। কিছু কিছু আইসোটোপ তেজস্ক্রিয় কণা এবং রশ্মি ছুঁড়ে দেয়। এদেরকে বলা হয় তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ বা রেডিও আইসোটোপ। 32P ও 14Cতেজস্ক্রিয় আইসোটোপ-এর উদাহরণ।
যার সংকেত হচ্ছে, u. এই একককে ডেলটন (dalton) ও বলা হয়ে থাকে (Da)। এক একীভূত ভর একক হচ্ছে একটি নিউক্লিয়নের (একটি প্রোটন বা নিউট্রনের) ভরের প্রায় সমান যা ১ গ্রাম/মোল এর সমতুল্য। একটি বন্ধনহীন নিরপেক্ষ কার্বন-১২ পরমাণুর নিউক্লিয় ও ইলেকট্রনিক ভূমি অবস্থার ভরের বারো ভাগের এক ভাগকে একীভূত পারমাণবিক ভর একক বলে।
1u = (12C) = 1.660538921 x 10-27kg
১৯৬১ সালের আগ পর্যন্ত যখন অক্সিজেন-১৬ এর সাথে তুলনা করে আণবিক ও পারমাণবিক স্কেলে ভর প্রকাশ করা হতো, তখন তাকে কেবল পারমাণবিক ভর একক (atomic mass unit) বলা হতো এবং amu দিয়ে প্রকাশ করা হতো। এখনো অনেকে একীভূত পারমাণবিক ভর একককে অর্থাৎ u কে পারমাণবিক ভর একক তথা amu দিয়ে প্রকাশ করে থাকেন ।
E = mc2 = (1.66054 x 10-27kg) (2.9979 x 108 )2 = 14.924 × 10-11J
ফরাসি বিজ্ঞানী হেনরি বেকেরেল ( 1852-1908) তেজস্ক্রিয়তা আবিষ্কার করেন। ১৮৯৬ সালে তিনি দেখতে পান যে, ইউরেনিয়াম যৌগের নিকটে রাখা ফটোগ্রাফিক প্লেট কুয়াশাচ্ছন্ন বা ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। তিনি অনুধাবন করেন যে, ইউরেনিয়াম থেকে নির্গত বিকিরণের দরুন ফটোগ্রাফিক প্লেট ঝাপসা হয়েছে। এ ঘটনাকে বলা হয় তেজস্ক্রিয়তা বা তেজস্ক্রিয় ক্ষয়। তিনি দেখান যে, ইউরেনিয়ামের নিউক্লিয়াস থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অবিরত এই বিকিরণ নির্গত হয়। এই বিকিরণ অতি উচ্চ ভেদন ক্ষমতাসম্পন্ন এবং সাধারণ আলফা কণা বা বিটা কণা। আলফা কণা বা বিটা কণা যে কণাই নির্গত হোক না কেন আদি (parent) মৌলটি (জনক) সম্পূর্ণ নতুন মৌলে (জাতক) রূপান্তরিত হয়। যতক্ষণ পর্যন্ত না একটি স্থায়ী মৌলে রূপান্তরিত হয় ততক্ষণ এই রূপান্তর প্রক্রিয়া চলতে থাকে। তেজস্ক্রিয়তা ঘটনাটি স্বতঃস্ফূর্ত এবং সম্পূর্ণভাবে প্রকৃতি নিয়ন্ত্রিত। এটি তাপ, চাপ, বৈদ্যুতিক বা চৌম্বক ঘটনা দ্বারা প্রভাবিত হয় না।
পরবর্তীকালে রেডিয়াম, পোলোনিয়াম, থোরিয়াম, অ্যাকটেনিয়াম ইত্যাদি ভারী মৌল থেকে তেজস্ক্রিয় রশ্মি বা কণার নির্গমন আবিষ্কৃত হয়। যে সকল মৌল থেকে তেজস্ক্রিয় রশ্মি নির্গত হয় তাদেরকে তেজস্ক্রিয় মৌল বলে।
1 Bq = 1 decay s-1
আগে কুরী (Ci) নামে তেজস্ক্রিয়তার একটি একক ব্যবহৃত হতো।
1Ci = 3.7 x 1010 decay s-1 = 3.7 x 1010 Bq
তেজস্ক্রিয় মৌল থেকে তেজস্ক্রিয় রশ্মি নির্গমনের ফলে আদি মৌলের নিউক্লিয়াস একটি নতুন মৌলের নিউক্লিয়াসে রূপান্তরিত হয়। তেজস্ক্রিয় রশ্মিসমূহ নিউক্লিয়াস থেকেই নির্গত হয়ে মৌলের রূপান্তর ঘটায়, তাই তেজস্ক্রিয়তা একটি নিউক্লিয়ার ঘটনা।
তেজস্ক্রিয় পদার্থ দু ধরনের। যেমন,
কোনো প্রাকৃতিক পদার্থ হতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে তেজস্ক্রিয় রশ্মি নির্গমনের ঘটনা ঘটলে সেসব পদার্থকে প্রাকৃতিক তেজস্ক্রিয় পদার্থ বলে। যেমন- ইউরেনিয়াম (U), রেডিয়াম (Ra), থোরিয়াম (Th) প্রভৃতি মৌল হতে যে তেজস্ক্রিয়তা ঘটে তা প্রাকৃতিক তেজস্ক্রিয়তা। এসব মৌলের পারমাণবিক সংখ্যা 82- এর চেয়ে বেশি।
কোনো মৌলকে কৃত্রিম উপায়ে তেজস্ক্রিয় মৌলে পরিণত করলে সেসব মৌলকে কৃত্রিম তেজস্ক্রিয় মৌল বলে। কোনো মৌলকে নিউক্লিয় বিক্রিয়ার মাধ্যমে বাইরে থেকে অতি উচ্চ বেগ সম্পন্ন কোনো কণা দ্বারা আঘাত করলে সেটি তেজস্ক্রিয় মৌলে পরিণত হয়। এদেরকে কৃত্রিম তেজস্ক্রিয় মৌল বা রেডিও আইসোটোপ বলে। যেমন, , ইত্যাদি।
বিভিন্ন পরীক্ষার মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা তিন রকম তেজস্ক্রিয় রশ্মি আবিষ্কার করেন। ১৮৯৯ সালে রাদারফোর্ড এবং ১৯০০ সালে ভিলার্ডের পরীক্ষা থেকে এসব রশ্মির সন্ধান পাওয়া যায়। তেজস্ক্রিয় রশ্মি তিন প্রকার ।
মাদাম কুরীর পরীক্ষা:নিম্নোক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে মাদাম কুরী তিন প্রকার রশ্মির অস্তিত্ব নিঃসন্দেহে প্রমাণ করেন। তিনি একটি সীসার ব্লকের সরু লম্বা ছিদ্র করে ঐ ছিদ্রে রাখলেন রেডিয়ামঘটিত তেজস্ক্রিয় পদার্থ। ছিদ্র হতে সামান্য দূরে লম্বালম্বিভাবে একটি ফটোগ্রাফিক প্লেট রাখা। হলো যাতে রশ্মি প্লেটের ওপর পড়তে পারে। তারপর সমগ্র ব্যবস্থাকে আবদ্ধ করলেন একটি বায়ুনিরোধী প্রকোষ্ঠে এবং পার্শ্বের সাহায্যে ভিতরের বাতাস বেরা করে নিলেন এবং চৌম্বকক্ষেত্র প্রয়োগ করলেন। ফটোগ্রাফিক প্লেট পরিস্ফুটিত করে পাওয়া গেল তিনটি! পৃথক স্থানে তিনটি দাগ। চুম্বকের প্রভাবে এক জাতের রশ্মি গেল সামান্য বেঁকে, অপরটি গেল উল্টোদিকে অপেক্ষাকৃত অধিক বেঁকে। তৃতীয়টি মোটেই বাঁকেনি (চিত্র ৯.৬)। |
---|
চৌম্বকক্ষেত্রের অভিমুখ, কণাগুলোর গতির প্রারম্ভিক অভিমুখ এবং বিচ্যূতির অভিমুখ থেকে সহজে বোঝা গেল প্ৰথম রশ্মিটি ধনাত্মক আলফা রশ্মি, দ্বিতীয়টি ঋণাত্মক বিটা রশ্মি এবং তৃতীয়টি নিরপেক্ষ গামা রশ্মি। নিঃসরণ থেকে আরো বোঝা গেল আলফা রশ্মি বিটা রশ্মির তুলনায় অধিক ভারী।
(১) যে সকল মৌলের পারমাণবিক সংখ্যা 82-এর বেশি, কেবল সে সকল পরমাণু প্রাকৃতিকভাবে তেজস্ক্রিয় হতে পারে। এর ব্যতিক্রমও আছে যেমন তেজস্ক্রিয় মৌল।
(২) তেজস্ক্রিয় পদার্থ সাধারণত আলফা, বিটা ও গামা —এই তিন প্রকারের তেজস্ক্রিয় রশি নিঃসরণ করে।
(৩) তেজস্ক্রিয়তা একটি সম্পূর্ণ নিউক্লিয়ার ঘটনা এবং এর মাধ্যমে নিউক্লিয়াসের ভাঙনের ফলে একটি মৌল আর একটি নতুন মৌলে রূপান্তরিত হয়।
(৪) তেজস্ক্রিয়া একটি স্বতঃস্ফূর্ত ও উদ্দেশ্যবিহীন ঘটনা এবং এটা চাপ, ভাপ, বিদ্যুৎ বা চৌম্বকক্ষেত্রের ন্যায় বাইরের কোনো প্রক্রিয়া দ্বারা প্রভাবিত হয় না।
১. আলফা রশ্মি ধনাত্মক আধানযুক্ত। এর আধান 3.2 x 10-19 C
২. এ রশ্মি চৌম্বক ও তড়িৎক্ষেত্র দ্বারা বিচ্যুত হয়।
৩. এ রশ্মি তীব্র আয়নায়ন সৃষ্টি করতে পারে।
৪. এর ভর বেশি হওয়ায় ভেদন ক্ষমতা কম ।
৫. সাধারণ চাপ ও তাপমাত্রার কয়েক সেন্টিমিটার বায়ু বা ধাতুর খুব পাতলা পাত দ্বারা এর গতি থামিয়ে দেওয়া যায়।
৬. এ কণা ফটোগ্রাফিক প্লেটে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।
৭. এ রশ্মি জিঙ্কসালফাইড পর্দায় প্রতিপ্রভা সৃষ্টি করতে পারে।
৮. এ কণা প্রচণ্ড বেগে নির্গত হয়
৯. এটি একটি হিলিয়াম নিউক্লিয়াস ।
১০. এ কণার ভর হাইড্রোজেন পরমাণুর চারগুণ।
১. এ রশ্মি ঋণাত্মক আধানযুক্ত। এর আধান 1.6 x 10-19 C
২. এ রশ্মি চৌম্বক ও তড়িৎক্ষেত্র দ্বারা বিক্ষিপ্ত হয়।
৩. এ রশ্মি অত্যন্ত দ্রুত নির্গত হয়। এর দ্রুতি আলোর দ্রুতির শতকরা 98 ভাগ হতে পারে।
৪. এ রশ্মি অতি উচ্চ দ্রুতি সম্পন্ন ইলেকট্রনের প্রবাহ। এর ভর ইলেকট্রনের সমান অর্থাৎ 9.1 x 10-31 kg.
৫. ফটোগ্রাফিক প্লেটে এর প্রতিক্রিয়া আছে।
৬. এ রশ্মি প্রতিপ্রভা সৃষ্টি করতে পারে।
৭. এর ভেদন ক্ষমতা আলফা রশ্মির চেয়ে বেশি এবং এটি 1 cm অ্যালুমিনিয়াম পাত ভেদ করতে পারে।
৮. গ্যাসে যথেষ্ট আয়নায়ন সৃষ্টি করতে পারে।
৯. কোনো পদার্থের মধ্য দিয়ে যাবার সময় এই রশ্মি বিক্ষিপ্ত হয়।
১. এ রশ্মি আধান নিরপেক্ষ।
২. এ রশি তড়িৎ ও চৌম্বকক্ষেত্র দ্বারা বিচ্যুত হয় না।
৩. এর বেগ আলোর বেগের সমান অর্থাৎ 3 x 108ms-1
৪. আলফা ও বিটা রশ্মির চেয়ে এ রশ্মির ভেদন ক্ষমতা খুব বেশি। এটি কয়েক সেন্টিমিটার সীসার পাত ভেদ করে যেতে পারে।
৫. স্বল্প আয়নায়ন ক্ষমতা সম্পন্ন।
৬. এ রশ্মি প্রতিপ্রভা সৃষ্টি করতে পারে।
৭. ফটোগ্রাফিক প্লেটে এ রশ্মি প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে।
৮. এর কোনো ভর নেই।
৯. এটি তাড়িতচৌম্বক তরঙ্গ।
১০. এর তরঙ্গদৈর্ঘ্য ক্ষুদ্র, তাই শক্তি খুব বেশি ।
তেজস্ক্রিয়তা আবিষ্কারের তিন বছর পরে এলস্টার (Elster) ও পাইটেল (Geitel) নামক দু'জন বিজ্ঞানী লক্ষ করেন যে, কোনো তেজস্ক্রিয় বন্ধুর তেজস্ক্রিয়তা সময় অতিবাহিত হওয়ার সাথে সাথে কমতে থাকে এবং এই ক্ষয় সূচক নিয়ম (exponential law) মেনে চলে। তেজস্ক্রিয়তা বলতে একটি স্বতন্ত্র পরমাণুর পরিবর্তন বোঝায় এবং সমগ্র বস্তুখণ্ডের পরিবর্তন বোঝায় না। তেজস্ক্রিয়তা একটি স্বতঃস্ফূর্ত আকস্মিক ঘটনা। কোন্ মুহূর্তে কোন্ পরমাণুটি ভেঙে যাবে তা নির্দিষ্ট করে বলা অসম্ভব। এর ক্ষয় পরিসংখ্যানের নিয়ম মেনে চলে। পরীক্ষার সাহায্যে প্রমাণিত হয়েছে, তেজস্ক্রিয় পরমাণুর ভাঙনের বা ক্ষয়ের হার ঐ সময়ে উপস্থিত অক্ষত পরমাণুর সংখ্যার সমানুপাতিক ।
ধরা যাক, সময় গণনার শুরুতে (যখন t = 0) কোনো তেজস্ক্রিয় পদার্থে অক্ষত পরমাণুর সংখ্যা ছিল No । সময় অতিবাহিত হওয়ার সাথে সাথে কিছু পরমাণু ভেঙে যায়। মনে করি । সময়ে অবশিষ্ট অক্ষত পরমাণুর সংখ্যা N । এখন dN যদি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র dr সময়ে dN সংখ্যক পরমাণু ভেঙে যায়, তাহলে পরমাণুর ভাঙনের হার । এখন এ ভাঙনের হার অক্ষত পরমাণুর সংখ্যার সমানুপাতিক, অর্থাৎ
যেহেতু সময় অতিবাহিত হওয়ার সাথে সাথে পদার্থের পরমাণুর সংখ্যা কমে যাচ্ছে তাই ঋণাত্মক চিহ্ন ব্যবহার করা হয়েছে।
:-
(9.16) সমীকরণ থেকে দেখা যায়,
এ সমীকরণ থেকে আমরা পাই, N = 1 হলে
অর্থাৎ ক্ষয় ধ্রুবক একটি পরমাণুর একক সময়ে ভাঙনের সম্ভাব্যতা নির্দেশ করে। ক্ষয় ধ্রুবক যত বড় হবে নির্দিষ্ট সময়ে একটি পরমাণুর ক্ষরের সম্ভাবনা তত বেশি হবে। কোনো তেজস্ক্রিয় পদার্থের একটি পরমাণুর একক সময়ে ভাঙনের তাকে ঐ পদার্থের ক্ষয় ধ্রুবক বলে।
(9.17) সমীকরণ থেকে দেখা যায় যে, এর একক হলো s-1। রেডনের (Rn) ক্ষয় ধ্রুবক 2.11 x 10-6 s-1 বলতে বোঝায় । সেকেন্ডে 1টি রেডন পরমাণুর ভেঙে যাবার সম্ভাবনা 1 এর মধ্যে 2.11 × 10-6
কোনো তেজস্ক্রিয় পদার্থের ক্ষয় ধ্রুবক । এবং সময়ে অক্ষত পরমাণুর সংখ্যা N হলে (9.16) সমীকরণ থেকে আমরা পাই,
মনে করি শুরুতে অর্থাৎ t = 0, তখন পরমাণুর সংখ্যা N = No এবং অন্য কোনো এক সময় t = t তে N = N।
সুতরাং এই সীমার মধ্যে উপরোক্ত সমীকরণকে যোগজীকরণ করে আমরা পাই,
এ সমীকরণটিই তেজস্ক্রিয় রূপান্তর সমীকরণ নামে পরিচিত এবং এ সমীকরণ হতে স্পষ্টত বোঝা যায় যে, তেজস্ক্রিয় রূপান্তর সূচক নিয়ম মেনে চলে। চিত্র ৯.৭-এ তাই প্রদর্শিত হলো।
যে সময়ে কোনো তেজস্ক্রিয় পদার্থের মোট পরমাণুর ঠিক অর্ধেক পরিমাণ ভেঙে যার, তাকে ঐ পদার্থের অর্থ জীবন বা অর্থায়ু বলে।
যে সময় কোনো তেজস্ক্রিয় পদার্থের N সংখ্যক পরমাণু ভেঙে সংখ্যক হয়, সেই সময়ই হচ্ছে অর্থ জীবন। অর্ধ জীবনকে T1/2 দ্বারা প্রকাশ করা হয়।
ইউরেনিয়ামের অর্থ জীবন 450 কোটি বছর বলতে বোঝার নির্দিষ্ট সংখ্যক ইউরেনিয়াম পরমাণু ভেঙে ঠিক অর্ধেক হতে সময় লাগে 450 কোটি বছর। আরো 450 কোটি বছরে ভেঙে হয় এক-চতুর্থাংশ।
(9.18) নং সমীকরণ হতে আমরা জানি,
উপরোক্ত সমীকরণ হতে বোঝা যায় যে, অৰ্থ জীবন T1/2 র ধ্রুবক এর ব্যস্তানুপাতিক অর্থাৎ অর্থ জীবনের মান বেশি হলে ক্ষয় ধ্রুবকের মান কম হবে।
আমরা আগেই বলেছি যে, তেজস্ক্রিয়া একটি স্বতঃস্ফূর্ত ঘটনা। এর প্রকৃতি পরিসংখ্যানের নিয়মাবলি মেনে চলে এবং যে কোনো পরমাণুর জীবন শূন্য (0) থেকে ০০ পর্যন্ত হতে পারে। সুতরাং কোনো তেজস্ক্রির পদার্থের গড় জীবন নির্ণয় করা সম্ভব। প্রত্যেকটি তেজস্ক্রিয় পরমাণুর জীবনের যোগফলকে পরমাণুর প্রারম্ভিক সংখ্যা দ্বারা ভাগ করলে ঐ তেজস্ক্রিয় পদার্থের গড় জীবন পাওয়া যায়। গড় জীবনকে সাধারণত দ্বারা প্রকাশ করা যায়।
দেখা গেছে যে, গড় জীবন ..(1.20)
আমরা জানি,
:- T1/2 =0.693π…(9.21)
সুতরাং অর্ধ জীবন গড় জীবনের সমানুপাতিক ।
min
min
min
min
ধরা যাক, একটা নিউক্লিয়াসের প্রকৃত ভর = M
প্রোটন সংখ্যা = Z
নিউট্রন সংখ্যা = N
একটা প্রোটনের ভর = mp
একটা নিউট্রনের ভর = mn
.. ভরত্রুটি, m = (Zmp + Nmn) - M
হাইড্রোজেন ব্যতীত সকল পরমাণুর নিউক্লিয়াস একাধিক প্রোটন ও নিউট্রন দ্বারা গঠিত। এই প্রোটন এবং নিউট্রনগুলোকে একত্রে নিউক্লিয়ন বলে। নিউক্লিয়নগুলোকে একত্রিত করে একটি স্থায়ী নিউক্লিয়াস গঠন করতে কিছু পরিমাণ শক্তি নির্গত হয়। এই শক্তি ভরত্রুটির সমতুল্য শক্তির সমান। আবার কোনো নিউক্লিয়াসকে ভেঙ্গে এর নিউক্লিয়নগুলোকে পরস্পরের প্রভাব হতে মুক্ত করতে নিউক্লিয়াসকে বাইরে থেকে সমপরিমাণ শক্তি সরবরাহ করতে হয়। এ শক্তিকে বন্ধন শক্তি বলে। সুতরাং বন্ধন শক্তিকে এভাবে বলা যায়,
নিউক্লিয়নগুলোকে একত্রকারী নিউক্লিয়ার বলের ক্রিয়া থেকে নিউক্লিয়ার বন্ধন শক্তির উদ্ভব হয় এবং এই বন্ধন শক্তির কারণেই নিউক্লিয়াসসমূহ স্থায়ী হয়। বন্ধনশক্তি যত বেশি হবে নিউক্লিয়াসের স্থায়িত্বও তত বেশি হবে। কোনো নিউক্লিয়াসের প্রকৃত ভর = M, ভর ত্রুটি = Am এবং আলোর বেগ = c হলে আইনস্টাইনের ভরশক্তি
সম্পর্ক থেকে আমরা পাই,
বন্ধন শক্তি, B. E = , mc2
বা, বন্ধন শক্তি, B. E = [(Zmp + Nmn - M]c2.
এখানে, M = নিউক্লিয়াসের প্রকৃত ভর
Z= প্রোটন সংখ্যা
N = নিউট্রন সংখ্যা
mp = একটা প্রোটনের ভর
mn = একটা নিউট্রনের ভর
…(9.24)
সকল প্রকার নিউক্লিয়ার বিক্রিয়াকে নিচের সাধারণ সমীকরণের সাহায্যে প্রকাশ করা যায় :
X+a=Y+b
এক্ষেত্রে 'a' হচ্ছে আঘাতকারী কণা (42He) বা বুলেট; X হলো আঘাতপ্রাপ্ত লক্ষ্যবস্তু বা টার্গেট নিউক্লিয়াস; 'চ' হলো বিক্রিয়ার ফলে উৎপন্ন বহির্গামী কণা (H) এবং Y হলো পরিবর্তিত নিউক্লিয়াস ।
নিউক্লিয়ার বিক্রিয়া X + a = Y+ b কে সংক্ষেপে লেখা হয় X( a, b ) Y
সুতরাং সমীকরণ (9.24) হবে 2713Al (a, p) Si
এই বিক্রিয়াকে (o, p) বিক্রিয়া বলে। এখানে a হচ্ছে আঘাতকারী কণা আলফা বা ½ He এবং p হচ্ছে বহির্গামী কণা প্রোটন।
রাসায়নিক বিক্রিয়ার ফলে বিক্রিয়ক পদার্থের পরমাণুসমূহের বাইরের কক্ষপথের ইলেকট্রন সজ্জার পরিবর্তন ঘটে।
কোনো নতুন মৌলের উদ্ভব হয় না। কিন্তু নিউক্লিয়ার বিক্রিয়ায় নিউক্লিয়ার আধানের পরিবর্তন হয়ে সম্পূর্ণ নতুন মৌলের উদ্ভব ঘটে। যেমন অ্যালুমিনিয়ামের মধ্যে আলফা কণা পরিচালনা করায় অ্যালুমিনিয়াম পরিবর্তিত হয়ে সিলিকনের নিউক্লিয়াসে পরিণত হয়েছে।
শৃঙ্খল বিক্রিয়া বলতে এমন স্ব-বহ বিক্রিয়া বোঝায় যা একবার শুরু হলে তাকে চালিয়ে রাখার জন্য কোনো অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োজন হয় না। কিশানযোগ্য বিক্রিয়ায় যে নিউট্রন মুক্তি লাভ করে তা শৃঙ্খল বিক্রিয়াকে সম্ভব করে তোলে। আমরা যদি সমীকরণ (9.25)-এর কথা বিবেচনা করি তাহলে দেখতে পাব যে, কিশানের ফলে 23692U থেকে মুক্ত হয়েছে দুটি নিউট্রন । এখন এ দুটি নিউট্রন যদি আরো দুটি 23692U নিউক্লিয়াসের কিশান ঘটায় তাহলে পাওয়া যাবে 4টি নিউট্রন। এরা আরো এটি নিউক্লিয়াসের ফিশান ঘটিয়ে তৈরি করবে 8 (আট) টি নিউটন এবং এ প্রক্রিয়া ফিশানযোগ্য পদার্থ শেষ না হওয়া পর্যন্ত চলতে থাকবে। এ প্রক্রিয়াকেই বলা হয় শৃঙ্খল বিক্রিয়া । ৯.৮ চিত্রে শৃঙ্খল বিক্রিয়ার একটি নক্শা দেওয়া হলো।
অনিয়ন্ত্রিত শৃঙ্খল বিক্রিয়ায় অতি অল্প সময়ে অধিক পরিমাণ শক্তির উদ্ভব হয়। একটি নিউট্রন দ্বারা শুরু করা একটি অনিয়ন্ত্রিত শৃঙ্খল বিক্রিয়া নজিরবিহীন বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে। কিন্তু শৃঙ্খল বিক্রিয়াকে যথোপযুক্তভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে তা থেকে পাওয়া যাবে অপরিসীম শক্তি। এই শক্তিকে মানব কল্যাণে ব্যবহার করা যেতে পারে। শৃঙ্খল বিক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে নিউক্লিয়ার চুল্লিতে নানান রকম কাজ করা হয়। যেমন, ক্ষমতা বা শক্তি উৎপাদন, নিউট্রন উৎপাদন, তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ ও কিশানযোগ্য পদার্থ উৎপাদন। এ ছাড়া পরমাণু বোমায়ও শৃঙ্খল বিক্রিয়ার প্রয়োগ রয়েছে।
যে বিক্রিয়ায় দুটি হাল্কা নিউক্লিয়াস একত্রিত হয়ে অপেক্ষাকৃত ভারী একটি নিউক্লিয়াস গঠন করে এবং অত্যধিক শক্তি বের হয় সে বিক্রিয়াকে বলা হয় নিউক্লিয়ার ফিউশন। ফিউশন সংঘটিত হয় অত্যধিক উচ্চ তাপমাত্রায়। এ তাপমাত্রায় বিক্রিয়াতে অংশগ্রহণকারী পরমাণুগুলো সম্পূর্ণ আয়নিত অবস্থায় থাকে। এ অবস্থাকে বলা হয় প্লাজমা। নক্ষত্রে যে মৌলিক তাপোৎপাদী বিক্রিয়া সংঘটিত হচ্ছে এবং যা এ মহাবিশ্বের সমস্ত শক্তির উৎস তা হলো হাইড্রোজেন পরমাণু ফিউশনিত হয়ে হিলিয়াম পরমাণু গঠন। এটা দুটি বিক্রিয়ায় ঘটে একটা প্রোটন-প্রোটন চক্র এবং অপরটি কার্বন-কার্বন চক্র। নিউক্লিয়ার ফিউশনকে নিম্নলিখিত সমীকরণ দ্বারা নির্দেশ করা যেতে পারে,
এখানে একটি প্রোটন একটি নিউট্রনকে গ্রাস করে তৈরি করছে একটি ডিউটেরন (H)। গ্রাসের সময় 3.9679 × 10-30 kg ভর হারিয়ে যাচ্ছে এবং 2.23 MeV শক্তি আবির্ভূত হচ্ছে। ডিউটেরনের গতিশক্তি এবং গামা রশি নিঃসরণের ফলে এ শক্তি পাওয়া যায়।
১৯৩৯ সালে নিউক্লিয়ার ফিশান বিক্রিয়া সর্বপ্রথম শনাক্ত করেন বিজ্ঞানী অটোহান এবং এফ উসম্যান। 235U নিউক্লিয়াসের ওপর নিউট্রনের বিক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে তারা লক্ষ করেন যে, ভারী নিউক্লিয়াস (যেমন 235U) আপতিত নিউট্রনটিকে শোষণ করে নেয়, ফলে লক্ষ্য (target) নিউক্লিয়াসটি (235U) দুটি ক্ষুদ্রতর কিন্তু প্রায় সমান ভর সংখ্যাবিশিষ্ট নিউক্লিয়াসে বিভক্ত হয়ে যায়। এই বিক্রিয়াকে বলা হয় কিশান বিক্রিয়া এবং ঘটনাটিকে বলা হয় ফিশান। এ নিউক্লিয়াস দুটিকে বলা হয় ফিশান ভগ্নাংশ (fission fragments)। নিউক্লীয় ফিশানের ফলে উৎপন্ন পদার্থগুলো সাধারণত অত্যধিক তেজস্ক্রিয় হয়। ফিশান ভগ্নাংশ হিসেবে বিভিন্ন নিউক্লিয় প্রজাতি (Nuclear species) আবির্ভূত হতে পারে। আমরা এখানে একটি আদর্শ নিউক্লিয় ফিশানের কথা উল্লেখ করব।
ধীর গতির (কম শক্তিসম্পন্ন) নিউট্রন দ্বারা ইউরেনিয়াম 23592U এর ফিশানকে নিম্নোক্ত সমীকরণ দ্বারা প্রকাশ করা
+ নিউট্রন + শক্তি
এখানে [23592U]* হচ্ছে যৌগিক নিউক্লিয়াস যার স্থায়িত্বকাল মাত্র 10-12s। এটি ফিশান ভগ্নাংশ X এবং Y-এ ভেঙে যাওয়ার আগের অবস্থা নির্দেশ করে। নিউক্লিয় বিক্রিয়ায় ভর-শক্তি এবং আধানের নিত্যতার শর্ত মেনে X এবং Y এর অনেকগুলো সমন্বয় হতে পারে। ইউরেনিয়ামের ফিশানে প্রায় 90 রকমের ভিন্ন ভিন্ন নিউক্লিয়াসের উৎপত্তি হতে পারে। এই প্রক্রিয়ায় কয়েকটি নিউট্রনও সৃষ্টি হয়। প্রতি ফিশানে গড়ে 2.47 নিউট্রন মুক্ত হয়। নিচে একটি নিউক্লিয় ফিশান বিক্রিয়া দেখানো হলো।
শক্তি
এখানে দেখা যাচ্ছে 23592U নিউক্লিয়াস একটি নিউট্রন শোষণ করে 23692U যৌগিক নিউক্লিয়াসে পরিবর্তিত হয়। 92 পরে যৌগিক নিউক্লিয়াসটি দুটি নিউক্লিয়াস জেনন (Xe) এবং ট্রনসিয়াম (Sr)-এ বিভক্ত হয়েছে। এই প্রক্রিয়ায় দুটি নিউট্রন সৃষ্টি হয়েছে এবং প্রায় 200 MeV শক্তি মুক্ত হয়।
ফিশান ভগ্নাংশ 14054Xe এবং 9438Sr উভয়েই বিটা তেজস্ক্রিয়। ভারী নিউক্লিয়াসকে প্রোটন, ডিউটেরন, আলফা কণা এবং গামা রশ্মি দ্বারা আঘাত করলেও নিউক্লিয় ফিশান সংঘটিত হয়।
আরও দেখুন...