মঙ্গলকর আচার-আচরণই হলো পার্বণ। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে এই পার্বণসমূহ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। একে ধর্মাচারও বলা যেতে পারে। আবহমানকাল থেকে আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে উৎসব আনন্দের মধ্য দিয়ে বিভিন্ন পার্বণ পালিত হয়। আমাদের পালিত পার্বণগুলোর মধ্যে নববর্ষ, বিভিন্ন সংক্রান্তি উৎসব, দোলযাত্রা, বসন্তোৎসব, বর্ষা উৎসব প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। পূর্ববর্তী শ্রেণিতে আমরা নববর্ষ ও পৌষসংক্রান্তি সম্পর্কে জেনেছি। এখন আমরা চৈত্রসংক্রান্তি ও দোলযাত্রা সম্পর্কে জানব।
বাংলা মাসের শেষ দিনটিকে বলা হয় সংক্রান্তি। সেই ধারাবাহিকতায় চৈত্র মাসের শেষ দিনটিকে বলা হয় চৈত্রসংক্রান্তি। এ দিনটি বাংলা বছরের শেষ দিনও বটে। এ দিনকে ঘিরে থাকে নানা অনুষ্ঠান-উৎসবের আয়োজন। চৈত্রসংক্রান্তি অনুসরণ করেই আসে পহেলা বৈশাখ বা নববর্ষ। শাস্ত্র, ধর্মীয় বিশ্বাস ও লোকাচার অনুসারে চৈত্র সংক্রান্তির এই দিনে স্নান, দান, ব্রত, উপবাস, নানাবিধ পূজা-পার্বণ প্রভৃতি ক্রিয়াকর্মকে পুণ্যজনক মনে করা হয়। আবহমান বাংলার ঐতিহ্য আর লোকায়ত উৎসবের আমেজ পাওয়া যায় এই দিনটিকে ঘিরে। চৈত্রসংক্রান্তি উদ্যাপন উপলক্ষ্যে অঞ্চলভেদে নানাবিধ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। আমরা এখন কয়েকটি পার্বণ সম্পর্কে জানব।
চৈত্রসংক্রান্তি উদযাপনে শিব বা নীলপূজার আয়োজন করা হয়। এ দিন ভক্তরা নীলকে সুসজ্জিত করে গীতিবাদ্য সহযোগে বাড়ি বাড়ি ঘোরান এবং ভিক্ষা সংগ্রহ করেন। নীলের গানকে বলা হয় অষ্টক গান। সন্ধ্যাবেলায় সকলের কল্যাণার্থে ভক্তরা প্রদীপ জ্বালিয়ে নানা উপচার দিয়ে শিবপূজা করেন। এরপর প্রসাদের মাধ্যমে সারাদিনের উপবাস ভঙ্গ করেন। নীলপূজার সঙ্গে জড়িয়ে আছে নীল নাচ এবং শিবের গাজন। উত্তরবঙ্গে কোনো কোনো অঞ্চলে একে গম্ভীরা পূজা বলে।
লোকউৎসব হিসেবে চড়কপূজা বেশ পরিচিত। চড়কপূজা উপলক্ষ্যে যে আচার-অনুষ্ঠান পালিত হয়ে থাকে তা অনেক এলাকায় গাজন, গম্ভীরাপূজা বা নীলপূজা নামে পরিচিত। চৈত্রের দাবদাহ থেকে রক্ষা পেতে বৃষ্টির জন্য চাষিরা পালা গানের আয়োজন করে থাকে। যারা চড়কপূজা উপভোগ করতে আসে তারা কোনো ধর্মের বাঁধনে আবদ্ধ নয়। সকাল থেকে সন্ধ্যা সময়জুড়েই মেলা চলতে থাকে মহাসমারোহে। চড়কপূজা যদিও নির্দিষ্ট একটি গোষ্ঠীর আচার-অনুষ্ঠান কিন্তু একে কেন্দ্র করে যে মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে তাতে বাঙালির ধর্মনিরপেক্ষ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার সুস্পষ্ট প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায়।
চৈত্রসংক্রান্তি উদ্যাপন উপলক্ষ্যে অঞ্চলভেদে আরও নানাবিধ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
চৈত্রসংক্রান্তির দিনে গ্রামবাংলায় খাওয়া হয় ছাতু, দই ও পাকা বেল সহযোগে এক বিশেষ শরবত। এদিনে নারীরা একটি নির্দিষ্ট খেজুরগাছের গোড়ায় দুধ এবং ডাবের জল ঢেলে পূজা করেন। পূজা শেষে একজন খেজুরগাছ থেকে খেজুর-ভাঙা ভক্তদের মাঝে বিলাতে থাকেন। সেই খেজুর খেয়ে উপোস ভঙ্গ করেন ভক্তরা। একে খেজুর ভাঙ্গা উৎসব বলে।
চৈত্রসংক্রান্তি বাঙালি ছাড়াও উদ্যাপন করে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীরাও। তাঁদের ভাষায় বৈসাবি পালিত হয় চৈত্রসংক্রান্তি ও নববর্ষের দিনে। বৈসাবি শব্দটির ‘বৈ’ এসেছে ত্রিপুরাদের ‘বৈসু’ থেকে, ‘সা’ এসেছে মারমাদের ‘সাংগ্রাই’ থেকে এবং ‘বি’ শব্দটি চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যাদের ‘বিজু’ থেকে। বিভিন্ন লৌকিক অনুষ্ঠানের পাশাপাশি সকলের মঙ্গলের জন্য বিশেষ প্রার্থনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
ফাল্গুনী পূর্ণিমার দিন বৃন্দাবনে শ্রীকৃষ্ণ আবির নিয়ে শ্রীরাধিকা ও অন্যান্য গোপীর সঙ্গে রং খেলেছিলেন। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস সেখান থেকেই দোল খেলার উৎপত্তি হয়। এই ফাল্গুনী পূর্ণিমার দিন সকালে রাধা ও কৃষ্ণের বিগ্রহে আবির রঙে রাঙিয়ে পূজা করা হয়। একে দোলপূজাও বলা হয়। রাধাকৃষ্ণের বিগ্রহ দোলায় চড়িয়ে কীর্তনগান সহকারে শোভাযাত্রা বের করা হয়। এজন্য উৎসবটিকে দোলযাত্রা বলা হয়। এসময় ভক্তরা আবির খেলে পরস্পরকে রাঙিয়ে দেন। ফাল্গুনী পূর্ণিমার এই দিনে রাধা-কৃষ্ণকে দোলায় দুলিয়ে রং খেলা হয় বলেই এদিনকে দোলপূর্ণিমা বলা হয়। এ পূজার পূর্বরাত শুক্লা চতুর্দশীতে খড়কুটা জ্বালিয়ে অগ্নি- উৎসব করা হয়। একে মেড়া পোড়ানো কিংবা বুড়ির ঘর পোড়ানো বলা হয়। ভক্তদের বিশ্বাস, বুড়ির ঘর আগুনে পুড়িয়ে অমঙ্গলকে তাড়ানো হয়।
দোলযাত্রা উৎসবের একটি ধর্মনিরপেক্ষ সর্বজনীন দিকও রয়েছে। এই দিন সকাল থেকেই নারী-পুরুষ নির্বিশেষে আবির ও বিভিন্ন প্রকার রং নিয়ে খেলায় মেতে ওঠেন। একে বসন্ত উৎসবও বলা হয়। কোথাও কোথাও এটি হোলি উৎসব নামে পরিচিত।
দোল উৎসবের সাংস্কৃতিক ও সামাজিক গুরুত্ব অনেক। উৎসবমুখর এই দিনে সবাই অতীতের সমস্ত দোষত্রুটি, ঝগড়া-বিবাদ ভুলে গিয়ে রং খেলায় মেতে ওঠে। পরমতসহিষ্ণুতার বৃদ্ধি ঘটে। এক অপরকে ক্ষমা করে। সম্প্রীতির পরিবেশ সৃষ্টি হয়। উৎসবস্থলে বিভিন্ন দ্রব্যসামগ্রীর মেলা বসে। গৃহস্থালির অনেক সামগ্ৰী মেলায় পাওয়া যায়। সাধারণের মধ্যে অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা বৃদ্ধি পায়।
আরও দেখুন...