প্রাচীন বাংলার আচার-অনুষ্ঠান, উৎসব ও রীতিনীতি

নবম-দশম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - বাংলাদেশের ইতিহাস ও বিশ্বসভ্যতা - প্রাচীন বাংলার সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস | | NCTB BOOK

প্রাচীন বাংলায় পূজা-পার্বণ ও আমোদ-প্রমোদের প্রচুর ব্যবস্থা ছিল। উমা অর্থাৎ দুর্গার অর্চনা উপলক্ষে বরেন্দ্রে বিপুল উৎসব হতো । বিজয়া দশমীর দিন ‘শাবোরৎসব’ নামে একপ্রকার নৃত্যগীতের অনুষ্ঠান হতো । হোলাকা বা বর্তমানকালের 'হোলি' ছিল তখন অন্যতম প্রধান উৎসব। স্ত্রী-পুরুষ সকলে এতে যোগদান করতো । ভ্রাতৃদ্বিতীয়া, আকাশপ্রদীপ, জন্মাষ্টমী, অক্ষয় তৃতীয়া, দশহরা, গঙ্গাস্নান, মহাঅষ্টমীতে ব্রহ্মপুত্র স্নান ইত্যাদি বর্তমানের সুপরিচিত অনুষ্ঠান সেকালেও প্রচলিত ছিল । এসব পূজা-পার্বণ আমোদ-উৎসব ব্যতীত হিন্দুধর্মের অনেক লৌকিক অনুষ্ঠানও প্রাচীনকালের সামাজিক জীবনে বিশিষ্ট স্থান অধিকার করেছিল । শিশুর জন্মের পূর্বে তার মঙ্গলের জন্য গর্ভাধান, পুংসবন, সীমন্তোন্নয়ন ও শোষ্যন্তীহোম অনুষ্ঠিত হতো । জন্মের পর জাতকর্ম, নিষ্ক্রমণ, নামকরণ, পৌষ্টিককর্ম, অন্নপ্রাশনসহ অনেক উপাচার পালন করা হতো ।

বাংলার হিন্দুদের দৈনন্দিন জীবনে ধর্মশাস্ত্রের ব্যাপক প্রভাব ছিল । কোন তিথিতে কী কী খাদ্য ও কর্ম নিষিদ্ধ, কোন তিথিতে উপবাস করতে হবে এবং বিবাহ, অধ্যয়ন, বিদেশ যাত্রা, তীর্থ গমন প্রভৃতির জন্য কোন কোন কাল শুভ বা অশুভ সে বিষয়ে শাস্ত্রের অনুশাসন কঠোরভাবে পালিত হতো । তখনকার দিনে বাঙালি পুরুষদের কোনো সুনাম ছিল না, বরং তারা বিবাদপ্রিয় ও উদ্ধত বলে পরিচিত ছিল । কিন্তু বাঙালি মেয়েদের সুখ্যাতি ছিল । মেয়েরা লেখাপড়া শিখতো। শিক্ষিত সমাজে মাতা ও পত্নীর সম্মান ও মর্যাদা বেশ উচ্চ ছিল । সে যুগে অবরোধ বা পর্দাপ্রথা ছিল না। একজন স্ত্রী গ্রহণই ছিল সাধারণ নিয়ম । তবে পুরুষের মধ্যে বহুবিবাহ প্রথা প্রচলিত ছিল । বিধবা নারী জীবনের চরম অভিশাপ বলে বিবেচিত হতো। মুছে যেত কপালের সিঁদুর এবং সেই সঙ্গে তার সমস্ত প্রসাধন ও অলঙ্কার । বিধবাকে নিরামিষ আহার করে সব ধরনের বিলাস বর্জন ও কৃচ্ছ্র সাধন করতে হতো । সহমরণ প্রথা সেকালেও প্রচলিত ছিল । প্রাচীন বাংলায় ধন-সম্পত্তিতে নারীদের কোনো অধিকার ছিল না। তবে স্বামীর অবর্তমানে অপুত্রক বিধবা স্ত্রী স্বামীর সমস্ত সম্পত্তির অধিকার দাবি করতে পারতো ।

বাংলার প্রাচীন ধর্মশাস্ত্রে নৈতিক জীবনের খুব উচ্চ আদর্শের পরিচয় পাওয়া যায় । একদিকে সত্য, শৌচ, দয়া, দান প্রভৃতি সর্ববিধ গুণের মহিমা কীর্তন করা হয়েছে। অপরদিকে, ব্রহ্মহত্যা, সুরা পান, চুরি করা, পরদার গমন (পরস্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক) ইত্যাদিকে মহাপাতকের কাজ বলে গণ্য করে তার জন্য কঠোর শাস্তি ও গুরুতর প্রায়শ্চিত্তের ব্যবস্থা করা হয়েছিল ।

Content added By
Promotion