বাংলা অঞ্চল ও বাংলাদেশ: রাজনৈতিক ইতিহাসের বৈচিত্র্যময় গতিপথ
প্রাচীনকাল থেকে শুরু করে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত বাংলা অঞ্চলের রাজনীতি এবং রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে ওঠার ইতিহাস অনুসন্ধান করব আজ আমরা। দীর্ঘ এই আলাপের মধ্য দিয়ে অনুধাবন করার চেষ্টা করব কীভাবে রাষ্ট্র নামের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানটির জন্ম হয়েছে, কী ধরনের বিবর্তনের মধ্য দিয়ে তাকে যেতে হয়েছে। আমরা আরও অনুধাবন করব, রাষ্ট্র ও শাসক শ্রেণির সঙ্গে ইতিহাসের বিভিন্ন কালপর্বে মানুষের সম্পর্ক কেমন ছিল এবং কী ধরনের প্রতিকূলতা মানুষ জয় করেছে।
সাধারণ মানুষের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে সেই সব বিপ্লব আর বিদ্রোহে জনমানুষের অনেক নেতাই নেতৃত্ব দিয়েছেন। হাজার বছরে গড়ে ওঠা রাজনীতি আর রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে তাঁদের হাত ধরেই এসেছে পরিবর্তন। মানুষের সামগ্রিক কল্যাণে নিজেদের জীবন পর্যন্ত তাঁরা বিলিয়ে নানান উত্থান-পতন আর ভাঙা- গড়ার অভিজ্ঞতাকে সঙ্গে নিয়ে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটেছে। বাংলা অঞ্চলের কয়েক হাজার বছরের ইতিহাসের সবচাইতে তাৎপর্যপূর্ণ এবং দৃষ্টান্তমূলক এই ঘটনার যিনি রূপকার তিনি হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন একমাত্র নেতা যিনি বাংলা অঞ্চলের কাদা- মাটি, নদী-নালা, বিল, হাওর-বাঁওড়, বৃষ্টি আর সবুজের ভেতর দিয়ে ওঠে এসে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তাঁর আগে বাংলার ইতিহাসে এই ভূখণ্ড থেকে ওঠে আসা আর কোনো নেতা সাধারণ মানুষের মুক্তির জন্য, সকল ধর্মের সকল মানুষের মধ্যে ভালোবাসা ও সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্য জীবন বাজি রেখে কাজ করেন নি। গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার এক অতি সাধারণ পরিবারের সন্তান শেখ মুজিবই সর্বপ্রথম ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের জন্য
বাংলা অঞ্চলে প্রাচীন জনপদ: রাজনীতির সূচনা
ভারতীয় উপমহাদেশের পূর্বাংশ তথা বাংলা অঞ্চলে আজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে ছোটো ছোটো অনেক ঐতিহাসিক ও ভৌগোলিক পরিচয় গড়ে উঠতে শুরু করে। একক ও ঐক্যবদ্ধ কোনো রাজ্য বাংলা অঞ্চলে ছিল না। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নাম-পরিচয়গুলোকে বলা হয় জনপদ বা ঐতিহাসিক ও ভৌগোলিক একক। জনপদগুলো গড়ে উঠেছিল বাংলায় আর্য ভাষাগোষ্ঠীর মানুষের আগমনের বহু আগেই। প্রাচীনকালে লিখিত বৌদ্ধ ও সংস্কৃত গ্রন্থগুলো থেকে আমরা যে কটি জনপদের নাম জানতে পারি, তার মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য কয়েকটির পরিচয় সংক্ষেপে জেনে নেওয়া যাক।
বঙ্গ
বঙ্গ নামক কোনো একটি কৌম বা জনগোষ্ঠীর হাত ধরে বঙ্গ জনপদের জন্ম হয়েছিল বলে জানা যায়। এই শব্দের অর্থ 'জলাভূমি' বা 'কার্পাস তুলা'। তবে বাংলার মতো জল-কাদা ও জঙ্গলের ভূখণ্ডে মানুষের টিকে থাকার লড়াইয়ে এই জনগোষ্ঠী বিশেষ যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছিল। মহাকবি কালিদাসের লেখা থেকে জানা যায়, নৌযুদ্ধে বঙ্গীয়রা ছিল খুবই দক্ষ। বাংলার জলভিত্তিক সক্রিয় ব-দ্বীপ এলাকা তথা, বর্তমান বাংলাদেশের ঢাকা-ফরিদপুরের বৃহত্তর এলাকায় প্রাচীন বঙ্গ জনপদ গড়ে উঠেছিল। এর সীমানা কখনো কখনো পশ্চিম দিকেও সম্প্রসারিত হয়েছে। বর্তমান ভারতের পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশের প্রধান অংশটি অতীতের বিভিন্ন কালপর্বে বঙ্গের আওতাভুক্ত ছিল।
পুণ্ড্র
পুণ্ড্র বাংলার আরেকটি প্রাচীনতম জনপদ। পুন্ডু নামের একটি জনগোষ্ঠীর থেকেই এই জনপদের উৎপত্তি। এই জনপদের কেন্দ্র ছিল পুণ্ড্রনগর। এই পুণ্ড্রনগরের ধ্বংসাবশেষ বর্তমানে খুঁজে পাওয়া যাবে বাংলাদেশের ভূখণ্ডে প্রাপ্ত প্রত্নস্থল বগুড়া জেলার মহাস্থানগড়ে। পুণ্ড্র জনপদেরই একটি অংশের নাম প্রাচীনকালে বরেন্দ্র বা বরেন্দ্রী হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছিল। তোমরা জেনে আনন্দ পাবে যে, প্রাচীনকালে এই পুণ্ড্র শব্দটির অর্থ ছিল ইক্ষু বা আখ।
রাঢ়
বাংলা অঞ্চলের পশ্চিমে বর্তমান ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ভাগীরথী নদীর উভয় তীরের এক বিস্তৃত জনপদ হিসেবে ছিল এর অবস্থান। দক্ষিণে সমুদ্র পর্যন্ত এই জনপদ বিস্তৃত ছিল। এই রাঢ়েই আজ থেকে প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছর পূর্বে তাম্র-প্রস্তর যুগের সূচনা ঘটেছিল। অজয় নদের তীরে পাণ্ডু রাজার ঢিবি নামে পরিচিত স্থানে বাংলার আদি মানুষের সমাজ ও সংস্কৃতি রচনার সর্বপ্রথম নিদর্শন পাওয়া গেছে। আবার রাঢ় এলাকাতেই আজ থেকে প্রায় দুই হাজার বছর আগে তাম্রলিপ্তি নামে একটি নৌ এবং সমুদ্রবন্দর গড়ে উঠেছিল। বাংলার সবচেয়ে পুরোনো এই বন্দর ধরে বাংলার শস্য, বস্ত্র, সুগন্ধি মসলা গ্রিসসহ বর্তমান ইউরোপের নানান স্থানে রপ্তানি হতো।
সমতট
সমতট ছিল বাংলার দক্ষিণ-পূর্বাংশের জনপদ। মেঘনা নদীর পূর্ব তীর থেকে শুরু করে বর্তমান কুমিল্লা- নোয়াখালী-চট্টগ্রাম এবং ভারতের ত্রিপুরার প্রধান অংশ নিয়ে এই জনপদ গড়ে উঠেছিল। আজ থেকে প্রায় দেড় হাজার বছর আগে সুয়ান জাং (হিউয়েন সাং) নামে একজন চৈনিক পর্যটক বাংলায় এসেছিলেন। তাঁর লেখা ভ্রমণ বৃত্তান্ত থেকে আমরা জানতে পারি, প্রাচীন সমতট ছিল বৌদ্ধ ধর্মের শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রধান একটি কেন্দ্র। এখানে তিনি অনেক স্থাপনা দেখেছিলেন। এই স্থাপনাগুলোকে বলা হতো বিহার। বিহারগুলোতে বৌদ্ধধর্মের ভিক্ষুরা বসবাস করতেন, ধর্ম এবং জ্ঞান চর্চা করতেন।
বাংলার প্রাচীন এই জনপদগুলোর কথা আমরা জানতে পারি প্রধানত বৈদিক সাহিত্য থেকে। বৈদিক সাহিত্য রচিত হয়েছিল আর্য ভাষার মানুষের হাতে। এসব গ্রন্থে বাংলার প্রাচীন জনপদের কথা এলেও খুব সম্মানজনকভাবে আসেনি। অধিকাংশ কেন এই রকম বলা হয়েছে জানো? পণ্ডিতগণ বলে থাকেন, প্রায় আড়াই হাজার বছর পূর্বে যখন আর্য ভাষাগোষ্ঠীর মানুষেরা বাংলা অঞ্চলে প্রবেশ করছিলেন তখন এই অঞ্চলে অনেক আগে থেকে যাঁরা বসবাস করছিলেন তাঁদের বাধার মুখে তাঁরা পড়েছিলেন। আধিপত্য বিস্তারে এই দ্বন্দ্বের কারণেই সেই সময়ের সংস্কৃত সাহিত্যে বাংলা অঞ্চলের মানুষদের তুচ্ছ করে দেখানো হয়েছে।
যাহোক, আর্যদের মধ্য থেকেই একসময় মৌর্য, গুপ্ত প্রভৃতি শক্তিশালী রাজবংশের উত্থান ঘটে। এইসব রাজশক্তির হাত ধরে বাংলায় আর্য ভাষাগোষ্ঠীর সংস্কৃতি বা বৈদিক সংস্কৃতি প্রবেশ করে। ধীরে ধীরে এইসব জনপদের নগরকেন্দ্রিক মানুষের ওপরও আর্য ধর্ম ও ভাষা-সংস্কৃতি প্রভাব বিস্তার করতে থাকে।
বাংলা অঞ্চলে মৌর্য ও গুপ্তদের রাজনীতি ও ক্ষমতা সম্প্রসারণ
মৌর্যদের পর উত্তর ভারতে শক্তিশালী সাম্রাজ্য স্থাপন করেন গুপ্ত বংশের সম্রাটগণ। এই বংশের সম্রাটদের মধ্যে প্রথম চন্দ্রগুপ্ত, সমুদ্রগুপ্ত, দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত প্রমুখ নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মৌর্যদের মতো গুপ্তরাও রাজ্য সম্প্রসারণবাদী নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। চতুর্থ শতকের মাঝমাঝি সময়ে সমুদ্রগুপ্ত বাংলা অঞ্চলে সৈন্য অভিযান পরিচালনা করে বঙ্গ, পুণ্ড্র প্রভৃতি জনপদ নিয়ন্ত্রণে নেন। সমুদ্রগুপ্তের পুত্র দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের সময় মেঘনা নদীর পূর্ব তীরে সমতট পর্যন্ত গুপ্তদের আধিপত্য বিস্তৃত হয়েছিল বলে গুপ্তদের বিভিন্ন উৎস হতে জানা যায়।
শাসনকাজ পরিচালনার জন্য সাম্রাজ্যের কেন্দ্র থেকে সম্রাট বড়ো বড়ো যোদ্ধা এবং সেনাপতিদের পাঠাতেন। উচ্চপদস্থ এই প্রশাসকেরা বাইরে থেকে এসে বাংলা অঞ্চলে স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করেন। তাঁদের পাশাপাশি আসতেন নতুন ধর্ম-সংস্কৃতি আর অনেক বিদ্বান, পুরোহিত, ব্যবসায়ী মানুষজন। রাজ্য বিস্তারের পাশাপাশি নতুন ধর্ম-সংস্কৃতি বিস্তারেও তারা কাজ করতেন। এভাবে দীর্ঘকাল চলতে থাকে। কোনো এক সময় কেন্দ্রীয় সাম্রাজ্যে গোলযোগ দেখা দিলে কিংবা সম্রাট দুর্বল হয়ে পড়লে বাংলা অঞ্চলের উচ্চপদস্থ সামরিক ব্যক্তিদের অনেকেই নিজেদের স্বাধীন ঘোষণা দিয়ে কেন্দ্রের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে ফেলতেন। বাংলা অঞ্চলে যেসব রাজার নাম তোমরা পাবে তাদের অধিকাংশই দেখবে বাংলা ভূখণ্ডের সীমানার বাইরে বহুদূর থেকে এই অঞ্চলে প্রবেশ করেছেন। তার মানে কী জানো? তার মানে হচ্ছে, বাংলায় আদি যে অধিবাসীরা ছিলেন রাজক্ষমতা তাঁদের হাতে ছিল না। তাঁরা ছিলেন সাধারণ। প্রতিকূল প্রকৃতি আর নিজেদের বাঁচিয়ে জীবন-ধারণ করাই ছিল তাঁদের জন্য সবচাইতে বড়ো চ্যালেঞ্জ। বাংলা অঞ্চলে তাই যখনই কোনো রাজ্য প্রতিষ্ঠা হয়েছে, তার নেতৃত্ব দিয়েছেন বাইরের অঞ্চল থেকে আসা কোনো কোনো যোদ্ধা।
বাংলা অঞ্চল: গুপ্ত পরবর্তীকালীন রাজনৈতিক অবস্থা
ষষ্ঠ শতকের শেষ দিকে উত্তর ভারতকেন্দ্রিক গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতন হয়। কেন্দ্রীয় সাম্রাজ্যের দুর্বলতার সুযোগে কেন্দ্র থেকে দূরের রাজ্যগুলো তখন আবারও স্বাধীন হতে শুরু করে। এই সময় ভারতবর্ষের অন্যান্য অংশের মতো পূর্বাংশ তথা বাংলা অঞ্চলেও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যসত্তা গড়ে ওঠার খবর পাওয়া যায়। বঙ্গ তেমনই একটি রাজ্যসত্তা হিসেবে বিকশিত হয়েছিল। বঙ্গ রাজ্যের উত্থান হয়েছিল গোপচন্দ্র নামে একজন শাসকের হাত ধরে ষষ্ঠ শতকের দ্বিতীয় দশকে। রাজ্যটির কেন্দ্রস্থল ছিল বর্তমান বাংলাদেশের গোপালগঞ্জ জেলার কোটালীপাড়ায়। আর খুব সম্ভবত বিস্তৃত ছিল গঙ্গা নদীর দুই স্রোতোধারা অর্থাৎ পদ্মা ও ভাগীরথী নদীর অন্তর্বর্তী ভূভাগের প্রধান অংশে। এই হিসেবে বঙ্গ রাজ্যের সীমানা বর্তমান বাংলাদেশের ঢাকা, ফরিদপুর, যশোরের বৃহত্তর এলাকা এবং বর্তমান ভারতের পশ্চিম বাংলার দক্ষিণাংশব্যাপী বিস্তৃত হয়েছিল বলে ইতিহাসবিদ বিএন মুখার্জী গবেষণা করে জানিয়েছেন। গোপচন্দ্র ছাড়াও ধর্মাদিত্য, সমাচারদেব, দ্বাদশাদিত্য, সুধন্যাদিত্য ছিলেন বঙ্গ রাজ্যের পাঁচ জন রাজা। তাঁদের জারি করা তাম্রশাসন ও মুদ্রা পাওয়া গেছে। আনুমানিক ৫২৫ থেকে ৬০০ সালের মধ্যে এই সকল রাজা বঙ্গের শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন।
গৌড় নামে আরেকটি রাজ্যসত্তার উত্থান ঘটেছিল সপ্তম শতকের শুরুর দিকে রাজা শশাঙ্কের হাত ধরে। গৌড় রাজ্যের রাজধানী ছিল কর্ণসুবর্ণ যা এখন বর্তমান ভারতের পশ্চিম বাংলা প্রদেশের মুর্শিদাবাদ জেলায় খুঁজে পাওয়া যাবে। এই গৌড় রাজ্যসত্তার অন্তর্ভুক্ত ছিল বাংলা অঞ্চলের উত্তরাংশ এবং পশ্চিমাংশের বিস্তৃত এক এলাকা; যার মধ্যে ছিল বর্তমান বাংলাদেশের বৃহত্তর রাজশাহী, বগুড়া, দিনাজপুরের এলাকাসমূহ এবং বর্তমান ভারতের পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাংশ এবং বিহারের অংশবিশেষ। তবে হ্যাঁ, বঙ্গ এবং গৌড়ের সীমানা যে সব সময়
একই ছিল তা কিছুতেই বলা যাবে না। রাজাদের শক্তি ও ক্ষমতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সীমানাও বদল হয়ে যেত। কখনো এসব রাজ্যের রাজারা অভিযান চালিয়ে নতুন এলাকা নিয়ন্ত্রণে নিয়েছেন, আবার কখনো অন্য এলাকার রাজাদের আক্রমণের ফলে নিজ রাজ্যের সীমানা সংকুচিত হয়েছে।
শশাঙ্কের রাজত্বের আনুমানিক বিস্তার
এই কৃতিত্বের পাশাপাশি শশাঙ্ক নিজের শক্তি প্রদর্শনের জন্য তৎকালীন গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতা-কেন্দ্র মগধ, উৎকল এবং কঙ্গোদের দিকেও সৈন্য পরিচালনা করেছিলেন বলে তাম্রশাসন, মুদ্রা এবং অন্যান্য সাহিত্যিক উৎস থেকে জানা যায়। শশাঙ্ককে বাংলা অঞ্চলের প্রথম সাম্রাজ্যবাদী শাসক বলা যেতে পারে। নিজের রাজ্যের বাইরে উত্তর ভারতের দিকে সৈন্য পরিচালনার মাধ্যমে তিনি সাম্রাজ্যবাদের সূচনা করেছিলেন। শশাঙ্কের পর বাংলার পাল বংশের শাসক ধর্মপাল এবং দেবপালও একইভাবে সাম্রাজ্যবাদী কার্যক্রমে যুক্ত হয়েছিলেন। মগধ এবং কনৌজে আধিপত্য বিস্তার করে নিজেদের আধিপত্য বৃদ্ধিতে এবং গৌরব প্রচারে তৎপর হয়েছিলেন।
মাৎস্যন্যায় ও পাল রাজাদের রাজনীতি ও ক্ষমতাবলয়
শশাঙ্কের মৃত্যুর পর দীর্ঘকাল বাংলা অঞ্চলে শক্তিশালী কোনো শাসক ছিলেন না। এর ফলে বাংলায় বহিঃশক্তির আক্রমণ শুরু হয়। বাংলার অভ্যন্তরেও সামন্তরাজারা একে অন্যকে হত্যা করে ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের লড়াইয়ে ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। এর ফলে এক অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। প্রায় একশ বছর ধরে চলমান এই অরাজকতা ইতিহাসে 'মাৎস্যন্যায়' নামে পরিচিত। পুকুরে বড়ো মাছ ছোটো মাছকে ধরে গিলে ফেলার মতো বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিকে বলে মাৎস্যন্যায়। শব্দটি প্রথম কৌটিল্য তাঁর 'অর্থশাস্ত্র' গ্রন্থে ব্যবহার করেছিলেন। যাহোক, এই অরাজকতার অবসান হয় অষ্টম শতকের মধ্যভাগে গোপাল নামে একজন শাসকের হাত ধরে বাংলায় পাল বংশের উত্থানের মধ্য দিয়ে। এই বংশের রাজারা সাধারণভাবে বৌদ্ধধর্মের অনুসারী হিসেবে পরিচিত।'
পাল বংশের শাসকদের মধ্যে ধর্মপাল, দেবপাল, প্রথম মহীপাল এবং রামপালের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। গোপালের মৃত্যুর পর ৭৮১ সালে তাঁর পুত্র ধর্মপাল ক্ষমতায় আরোহণ করেন। পাল বংশের অন্যতম ক্ষমতাধর রাজা বলা হয় তাঁকে। ধর্মপালের রাজত্বকালে পাল বংশ এতই ক্ষমতাবান হয়ে ওঠে যে, উত্তর ভারতে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি দাক্ষিণাত্যের রাষ্ট্রকূট বংশ এবং রাজপুতনার গুর্জরপ্রতিহার বংশের সঙ্গে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হন। ক্ষমতা প্রদর্শন ও আধিপত্য বিস্তারের এই লড়াই ইতিহাসে 'ত্রিশক্তির সংঘর্ষ' নামে পরিচিত। এই সংঘর্ষের প্রথম পর্যায়ে ধর্মপাল প্রতিপক্ষের উভয়ের কাছেই পরাজিত হলেও পরে কিছুকালের জন্য বারাণসী এবং প্রয়াগ দখল করে গঙ্গা-যমুনার মধ্যবর্তী এলাকা পর্যন্ত বাংলার রাজ্য সীমানা বিস্তৃত করেন। ধর্মপালের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র দেবপাল ক্ষমতায় বসেন। দেবপালের সময়েই পাল বংশের রাজ্যসীমা সবচেয়ে বেশি পরিমাণে বিস্তৃতি লাভ করেছিল।
কৈবর্ত বিদ্রোহ'
দেবপালের মৃত্যুর পর পাল বংশের আধিপত্য ক্রমে কমে আসতে থাকে এবং তাঁদের রাজ্যসীমাও হ্রাস পেতে শুরু করে। এমনই এক দুর্বল শাসকের সময়ে বাংলার উত্তরাংশে বরেন্দ্র এলাকায় কৈবর্তদের একটি বিদ্রোহ সংগঠিত হয়। কৈবর্ত শব্দের মানে হচ্ছে মৎস্যজীবী সম্প্রদায়। মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের নেতা দিব্যোক ছিলেন একজন সামন্ত জমিদার। দিব্যোকের নেতৃত্বে পাল বংশীয় রাজা দ্বিতীয় মহীপালকে হত্যা করে বরেন্দ্র এলাকায় কৈবর্ত শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলার ইতিহাসে এই কৈবর্ত বিদ্রোহ অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা বলে বিবেচিত হয়। এই সময়েই প্রথম রাজশক্তির বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষকে অস্ত্র ধারণ করতে দেখা যায়। অন্যান্য সামন্ত শক্তির সমর্থন থাকলেও দিব্যোক মূলত মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের সাধারণ মানুষকে সঙ্গে নিয়েই বরেন্দ্র দখল করেছিলেন।
বরেন্দ্র থেকে ক্ষমতা হারালেও পাল শাসনের অবসান হয়নি। বরেন্দ্র এলাকায় যখন কৈবর্ত শাসন বিদ্যমান তখন রামপাল নামে একজন পালবংশীয় রাজা ক্ষমতায় বসেন। রামপাল তাঁর পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রকূট, মগধ, রাঢ় সহ চৌদ্দটি রাজ্যের রাজাদের কাছ থেকে সৈন্য ও অস্ত্রসহায়তা নিয়ে বরেন্দ্র আক্রমণ করেন। বরেন্দ্রের শাসনক্ষমতায় তখন দিব্যোকের ভ্রাতুস্পুত্র ভীম। ভীম এবং রামপালের সৈন্যদের মধ্যে যুদ্ধ সংঘটিত হয়। যুদ্ধে ভীম পরাজিত ও নিহত হন। বরেন্দ্র আবারও পাল সাম্রাজের অধীনে চলে আসে। তবে এই রামপালই ছিলেন পাল বংশের সর্বশেষ শক্তিশালী রাজা। এরপর মদনপালের সময় পালবংশের পতন ঘটে।
দেব ও চন্দ্র রাজাদের রাজনীতি ও ক্ষমতাবলয়
পাল রাজবংশের উত্থান হয়েছিল বাংলা অঞ্চলের উত্তর-পশ্চিম অংশে বরেন্দ্র এলাকায়। তাঁদের ক্ষমতার কেন্দ্রও ছিল উত্তর-পশ্চিম অংশে এবং মগধের অংশবিশেষে। আঞ্চলিক বাংলার উত্তর-পশ্চিম দিকে যখন পাল রাজাদের শাসন চলছে, দক্ষিণ-পূর্ব দিকে তখন অনেকগুলো পৃথক ও স্বাধীন রাজবংশের শাসন চলছিল। এঁদের মধ্যে ভদ্র বংশ, খড়গ বংশ, দেব বংশ এবং চন্দ্র বংশের শাসকেরা নদী দিয়ে বিভাজিত বাংলার খানিকটা অংশে বেশ প্রভাব-প্রতিপত্তি নিয়ে রাজত্ব করেন। রাজবংশগুলোর রাজধানী ছিল যথাক্রমে কর্মান্ত-বসাক, দেবপর্বত এবং বিক্রমপুর। দেব বংশের রাজাদের রাজধানীর নাম ছিল দেবপর্বত। ক্ষীরোদা নামের একটি নদীকে আশ্রয় করে প্রাচীন দেবপর্বত নগরী গড়ে উঠেছিল। কুমিল্লার লালমাই পাহাড়ের কোনো একটি স্থানে ছিল দেবপর্বতের অবস্থান। শান্তিদেব, বীরদেব, আনন্দদেব, ভবদেব ছিলেন দেব বংশের উল্লেখযোগ্য রাজা। এদের ক্ষমতা কেন্দ্রভূমি ছিল প্রধানত প্রাচীন সমতট এলাকা। বাংলা অঞ্চলের দক্ষিণ-পূর্ব দিকের সবচেয়ে শক্তিশালী রাজবংশ ধরা হয় চন্দ্র বংশকে।
দশম শতাব্দীর শুরু থেকে একাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত চন্দ্র বংশের রাজারা ক্ষমতায় ছিলেন। এই বংশের উল্লেখযোগ্য দুজন রাজা হলেন ত্রৈলোক্যচন্দ্র এবং শ্রীচন্দ্র। কুমিল্লার লালমাই পাহাড়ের রোহিতগিরি ছিল চন্দ্র বংশের রাজাদের উত্থানের কেন্দ্র। এখান থেকেই তাঁরা বঙ্গ ও সমতট এলাকায় ক্ষমতা বিস্তার করেন। ত্রৈলোক্যচন্দ্রের পর তাঁর পুত্র শ্রীচন্দ্র ক্ষমতায় বসেন। শ্রীচন্দ্রের সময় চন্দ্র বংশের উত্তর-পূর্ব দিকে কামরূপ এবং উত্তরে গৌড় পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। শ্রীচন্দ্র কামরূপে দখল অভিযান পরিচালনা করেছিলেন এবং সাফল্য লাভ করেছিলেন। প্রাচীন শ্রীহট্ট (বর্তমান সিলেট) ছিল চন্দ্র বংশের রাজ্যভুক্ত। পাল এবং চন্দ্র বংশের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় ছিল বলে জানা যায়। শ্রীচন্দ্রের সময়ে চন্দ্র বংশের রাজধানী ছিল বর্তমান মুন্সিগঞ্জ জেলার বিক্রমপুর।
সেন রাজাদের রাজনীতি ও ক্ষমতাবলয়
একাদশ শতকের দ্বিতীয় ভাগে আঞ্চলিক বাংলার একটি অংশে (রাঢ় এবং গৌড়) সেন রাজবংশের উত্থান ঘটে। সেন রাজাদের আদি নিবাস ছিল দাক্ষিণাত্যের কর্ণাট। বরেন্দ্র পুনরুদ্ধারে যারা সৈন্য ও অস্ত্র দিয়ে রামপালকে সহায়তা করেছিলেন তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন বিজয় সেন। রামপালের মৃত্যুর পর পাল রাজাদের দুর্বলতার সুযোগে বিজয় সেন বাংলার কিছু অংশ দখল করে নেন। বিজয় সেন একদিকে পাল বংশের রাজা মদনপালকে পরাজিত করে বাংলার উত্তর-পশ্চিম অংশ এবং অন্যদিকে বর্ম রাজাকে পরাজিত করে দক্ষিণ-পূর্ব অংশ দখল করে নেন। এছাড়াও কামরূপ, কলিঙ্গ, মিথিলা আক্রমণসহ নানান স্থানে তিনি যুদ্ধে লিপ্ত হন এবং ক্রমেই আঞ্চলিক বাংলার প্রায় সবটুকু অংশের উপর নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন। বাংলার দক্ষিণ-পূর্ব অংশ জয় করার পর বিজয় সেন বিক্রমপুরে (বর্তমান মুন্সিগঞ্জ জেলা) সেন রাজবংশের রাজধানী প্রতিষ্ঠা করেন।
বিজয় সেনের পর তাঁর পুত্র বল্লাল সেন এবং লক্ষণ সেন বংশানুক্রমে সিংহাসন অধিকার করেন। ত্রয়োদশ শতকের শুরু এবং লক্ষণ সেনের শাসনকালের শেষদিকে তুর্কি-আফগান যোদ্ধা বখতিয়ার খলজি ভারতবর্ষের পূর্বদিকে আক্রমণ পরিচালনা করে সেন সাম্রাজ্যে ভাঙনের সূচনা ঘটান। সেনদের ক্ষমতা বর্তমান বাংলাদেশের বিক্রমপুরে সীমিত হয়ে পড়ে আর বাংলা অঞ্চলের উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের কিছু অংশ (বর্তমান পশ্চিমবঙ্গ ও বিহারের অংশবিশেষ) তুর্কি খলজিদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়।
তুর্কি-আফগান খলজিদের রাজনীতি ও ক্ষমতাবলয়
বাংলা অঞ্চলের উত্তর-পশ্চিমাংশে তুর্কি-আফগান যোদ্ধা ইখতিয়ার উদ্দীন মোহাম্মদ বখতিয়ার খলজির হাত ধরে নতুন এক রাজনীতি আর ক্ষমতা বিস্তারের ইতিহাস গড়ে ওঠে। বখতিয়ার খলজি ছিলেন জাতিতে তুর্কি এবং আফগানিস্তানের গরমসির এলাকার অধিবাসী। অযোধ্যার শাসনকর্তা হুসামউদ্দীনের অধীনে ভারতের উত্তর প্রদেশের মির্জাপুর জেলায় ভিউলী ও ভাগত নামের দুটি পরগনার জায়গির লাভ করেন। ভিউলী এবং ভাগতে বসেই বখতিয়ার কিছু সৈন্য সংগ্রহ করে নিজের শক্তি বৃদ্ধি করেন। এরপর পার্শ্ববর্তী ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্য ও জমিদারি এলাকায় আকস্মিক আক্রমণের মধ্য দিয়ে মগধ পর্যন্ত অগ্রসর হন। আকস্মিক আক্রমণের নীতি অনুসরণ করেই বখতিয়ার একদিন গোপনে প্রস্তুতি ও খোঁজখবর নিয়ে ঝাড়খন্ডের জঙ্গলের মধ্য দিয়ে সেন রাজার প্রাসাদ অভিমুখে সৈন্য পরিচালনা করেন। বলা হয়ে থাকে, ঝাড়খন্ডের জঙ্গলের মধ্য দিয়ে বখতিয়ার এত দ্রুত সৈন্য পরিচালনা করেন যে তাঁর সঙ্গে মাত্র সতেরো-আঠারোজন সৈন্য রাজপ্রাসাদে পৌঁছাতে পেরেছিলেন।
এভাবেই বখতিয়ার খলজি আমাদের বাংলা অঞ্চলের একটি অংশ নিয়ন্ত্রণে নিয়েছিলেন। রাজা লক্ষণ সেনকে বিক্রমপুরের রাজধানীতে ফিরে যেতে বাধ্য করে প্রতিষ্ঠা করেন খলজি বংশের শাসন। লখনৌতিতে স্থাপিত হয় তাঁদের রাজধানী। খলজি রাজাদের ভাষা, ধর্ম এবং সংস্কৃতি ছিল ভারতের পূর্বাংশ তথা বাংলা অঞ্চলের সাধারণ মানুষের ভাষা, ধর্ম এবং সংস্কৃতি থেকে ভিন্ন। ধীরে ধীরে পির, সুফি, দরবেশ ও সুলতানগণ তাঁদের নিজ নিজ এলাকায় প্রচলিত ইসলামি সংস্কৃতি বাংলা অঞ্চলের সাধারণ মানুষের কাছে খুব দ্রুত ছড়িয়ে দেন।
দিল্লির সুলতান এবং মোগল শাসকগণ বাংলার জল-জঙ্গলে নিয়মিত নিষ্কর জমি দান করতেন। তাঁদের ভূমি সম্প্রসারণ নীতি বাংলা অঞ্চলে ইসলাম বিস্তারে ভূমিকা রেখেছিল বলে রিচার্ড ইটন, অসীম রায় এবং মমতাজুর রহমান তরফদার সূত্রে জানা যায়। পরবর্তীকালে আরো নানান রাজনৈতিক ও সামাজিক ঘটনা এক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে। বাংলা অঞ্চলে নানান ধর্ম-বর্ণ-ভাষা-সংস্কৃতি থাকা সত্ত্বেও এই ভূমির সকল মানুষ সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যের এক আশ্চর্য বন্ধনে আবদ্ধ। ধর্মের চেয়ে মানুষ পরিচয় সব সময়ই এখানে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। জীবনানন্দ দাশ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম- সবাই মানবতার জয়গান করেছেন। মধ্যযুগের কবির ভাষায়-
সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই'!
তোমরা পরবর্তীতে বাংলা অঞ্চলের রাজনৈতিক ইতিহাস আরও বিস্তৃত পরিসরে পাঠ করার সুযোগ পাবে, তখন উৎসের গভীরতা অনুসন্ধানের মাধ্যমে অনেক সত্য উদ্ঘাটন করতে পারবে। কিন্তু একটা কথা অবশ্যই মনে রাখতে হবে, কেবল রাজা-বাদশাহদের ইতিহাস পাঠ করে এই ভূমির মানুষকে তুমি মোটেই জানতে ও বুঝতে পারবে না। মানুষকে জানতে হলে মানুষের সংস্কৃতি, রীতিনীতি, প্রথা-পদ্ধতি- সবই জানতে হবে। তোমরা দেখবে, বিভিন্ন শতাব্দীতে বিভিন্ন রাজবংশের উত্থান হচ্ছে। উত্তর ভারতের সাম্রাজ্য সম্প্রসারণ তৎপরতার বিপরীতে চলছে ভারতেরই বিভিন্ন অংশে আঞ্চলিক রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা। ভারতের পূর্বাংশ তথা বাংলা অঞ্চল নিয়ন্ত্রণকারী শাসকদের সঙ্গেও চলেছে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার লড়াই। বাংলার একেকটি অংশে আলাদা রাজবংশ শাসন করেছে। বাইরে থেকে বিশাল যোদ্ধার দল এসে দখল করে নিয়েছে বাংলার ভূভাগ। এভাবেই কালক্রমে বাংলা অঞ্চলের রাজনৈতিক ইতিহাসে নতুন মেরুকরণ ঘটেছে। বাংলা অঞ্চলের সাধারণ মানুষেরা রাজনীতি আর রাজনৈতিক সংস্কৃতির গঠন ও রূপান্তরে ধীরে ধীরে নিজেদের সম্পৃক্ত করেছেন।
যাহোক, মধ্য এশিয়া থেকে আগত যোদ্ধারা পদাতিক এবং অশ্বারোহী সৈন্য হিসেবে যুদ্ধবিদ্যায় অভ্যস্ত ছিলেন। জল-জঙ্গল বেষ্টিত বাংলার অভ্যন্তরে প্রবেশ করে যুদ্ধ পরিচালনা করার সক্ষমতা তাঁদের ছিল না। বখতিয়ার তাই পূর্ব দিকে (যেখানে বর্তমান বাংলাদেশ গড়ে উঠেছে) সেন শাসিত এলাকায় প্রবেশ না করে তিব্বতের দিকে পরবর্তী অভিযান পরিচালনা করেন এবং মৃত্যুমুখে পতিত হন। এরপর বখতিয়ারের সেনাপতি আলী মর্দান খলজি লখনৌতির সিংহাসন নিয়ন্ত্রণে নেন। আলী মর্দানের সঙ্গে ক্ষমতার ভাগ নিয়ে বখতিয়ারের অপর দুই সেনাপতি শীরান খলজি এবং গিয়াসউদ্দীন ইওজ খলজির বিবাদ শুরু হয়। ত্রিপক্ষীয় এই দ্বন্দ্বে শীরান এবং মর্দান দুজনেই নিহত হন। লখনৌতির ক্ষমতায় বসেন গিয়াসউদ্দীন ইওজ খলজি। বখতিয়ার খলজি লখনৌতিতে রাজ্য প্রতিষ্ঠা করলেও তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা করেননি। দিল্লির শাসনকর্তা কুতুবউদ্দীন আইবাক ও গজনীর সুলতান মোহাম্মদ ঘোরীর প্রতি মৃত্যু অবধি আনুগত্য প্রদর্শন করে গিয়েছেন। লখনৌতিকে প্রথম স্বাধীন রাজ্য হিসেবে ঘোষণা দিয়ে নিজের নামে খুতবা প্রচার ও মুদ্রা জারি করেন আলী মর্দান খলজি। গিয়াসউদ্দীন ইওজ খলজি ক্ষমতায় আরোহণ করার পর মর্দানের পন্থা অনুসরণ করেন। তিনি দিল্লির মুসলমান শাসকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে নিজের নামে খুতবা পাঠ ও মুদ্রা জারি করেন। ১২১২ থেকে ১২২৭ পর্যন্ত প্রায় ১৫ বছর লখনৌতি শাসন করেন সুলতান গিয়াসউদ্দীন ইওজ খলজি। ১২২৭ সালের দিকে ইওজ খলজি যখন বাংলার দক্ষিণ-পূর্ব দিকে রাজ্য বিস্তারের জন্য সেন রাজাদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত ছিলেন, সেই সময় দিল্লির সুলতান ইলতুৎমিশের পুত্র নাসিরউদ্দীন লখনৌতি আক্রমণ করেন। ইওজ খলজি তা প্রতিহত করতে দ্রুত ছুটে যান লখনৌতির দিকে। সেখানে গিয়ে তিনি দিল্লির সৈন্যদের হাতে ধরা পড়েন ও সপরিবার নিহত হন।
ইওজ খলজির মৃত্যুর পর ভারতের তৎকালীন অন্যান্য বহু আঞ্চলিক রাজ্যের মতো লখনৌতি রাজ্য দীর্ঘকালের জন্য দিল্লির শাসকদের অধীনে চলে যায়। লখনৌতির শাসনকর্তা প্রেরিত হয় দিল্লি থেকে। দিল্লির সুলতানের প্রতি আনুগত্য বজায় রেখে শাসনকাজ পরিচালনা করতেন লখনৌতির শাসকেরা। আনুগত্যের বদলে কেউ বিদ্রোহ করলে এবং যথাযথ রাজস্ব প্রদান না করলে কেন্দ্রীয় শাসকেরা সৈন্য প্রেরণ করে স্থানীয় শাসকদের উচ্ছেদ করে নতুন শাসক নিয়োগ দিতেন। এ সময়কালে লখনৌতি রাজ্যে যাঁরা শাসনকর্তা হিসেবে আসেন তাঁদের অধিকাংশই ছিলেন দিল্লির শাসকদের ক্রীতদাস। এজন্য এই সময়কে অনেকে 'দাস শাসন' বা 'মামলুক শাসন' বলেও অভিহিত করে থাকেন।
বাংলা অঞ্চলে ইলিয়াস শাহী ও হোসেন শাহী বংশের রাজনীতি ও ক্ষমতাবলয়
দিল্লি এবং লখনৌতির শাসকদের উভয়েই মুসলমান ছিলেন। কিন্তু তাদের মধ্যে চলেছে ধারাবাহিক দ্বন্দ্ব। এই দ্বন্দ্বের মধ্যেই লখনৌতির বিদ্রোহী শাসকগণ সুযোগ পেলেই লখনৌতির দক্ষিণ ও পূর্বদিকে সমর অভিযান পরিচালনা করে রাজ্য সম্প্রসারণ করতেন। এসব অভিযানের ফলে বাংলা অঞ্চলের বৃহৎ অংশ লখনৌতির শাসকদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। ১৩৩৮ সালের মধ্যে লখনৌতির পাশাপাশি বাংলায় আরও দুটি শক্তিকেন্দ্র তৈরি হয়। একটি হচ্ছে, লখনৌতির দক্ষিণ দিকে সাতগাঁ, অন্যটি দক্ষিণ পূর্ব দিকে সোনারগাঁ। দিল্লির সুলতানগণ লখনৌতির পাশাপাশি বাকি দুটি কেন্দ্রেও শাসনকর্তা নিয়োগ দিতেন।