বাগদা চিংড়ির চাষ ব্যবস্থাপনা

এসএসসি(ভোকেশনাল) - শ্রিম্প কালচার এন্ড ব্রিডিং-১ - প্রথম পত্র (নবম শ্রেণি) | NCTB BOOK

বাগদা চিংড়ি একটি স্পর্শকাতর চাষযোগ্য প্রজাতি হওয়ায় চাষ কার্যক্রমটি অত্যন্ত সতর্কতার সাথে এবং ধারাবাহিক পদ্ধতি অনুসরণের মাধ্যমে সম্পাদন করতে হয়। সমগ্র চাষ কার্যক্রমটিকে কয়েকটি ধাপে সম্পাদন করলে ভাল ফল পাওয়া যায়। খামার ব্যবস্থাপনার ধাপসমুহ নিম্নরূপ-

Content added By

উপযুক্ত স্থান নির্বাচন

বাগদা চিংড়ি চাষের জন্য স্থান নির্বাচন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। চিংড়ি চাষে ঘেরের জন্য এমন স্থান নির্বাচন করতে হবে। যেখানে জোয়ার-ভাটার সময় পানির সরাসরি সংযোগ থাকে। মাটির ধরন হবে দোআঁশ বা এঁটেল দোআঁশ। ঘেরে যোগাযোগের জন্য রাস্তা থাকা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। চিংড়ি চাষের জন্য উপযুক্ত স্থান নির্বাচনের সময় নিচের বিষয় সমূহ বিবেচনা করা একান্ত প্রয়োজন।

ক. দূষণমুক্ত এলাকা: কলকারখানা ও ট্যানারি হতে বিষাক্ত বর্জ্য পদার্থ পরিশোধন ছাড়া সরাসরি নিক্ষেপের ফলে পানির দূষণ মাত্রাতিরিক্তভাবে বৃদ্ধি পেয়ে চিংড়ির মড়ক দেখা যায়। তাছাড়া মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহারের ফলে পানির ভৌত-রাসায়নিক গুণাগুণ পরিবর্তিত হয়ে চিংড়ির জন্য প্রতিকূল পরিবেশের সৃষ্টি করে। সুতারাং এ সমস্ত এলাকায় চিংড়ি খামার স্থাপন না করাই ভালো। বরং দূষণমুক্ত এলাকা চিংড়ি খামারের জন্য নির্বাচন করতে হবে।

খ. অতি বৃষ্টিজনিত বন্যামুক্ত এলাকা: অতি বৃষ্টিজনিত ঢলের পানি খামারের পানির গুণাগুণ, যেমন- লবণাক্ততা, অক্সিজেন, পিএইচ ইত্যাদিও হঠাৎ পরিবর্তন করে দেয়, ফলে চিংড়ি চাষ ব্যাহত হয়। এ সমস্ত স্থানে বাঁধ নির্মাণ ব্যয়বহুল ও ঝুঁকিপূর্ণ। এছাড়া বৃষ্টি ধৌত খোলা পানিতে জৈব ও অজৈব পদার্থের পরিমাণ অনেক বেশি থাকে যা চিংড়ির ফুলকা পচনসহ অনেক রোগের সৃষ্টি করে। কাজেই অতি বৃষ্টিজনিত এলাকা পরিহার করে বন্যামুক্ত এলাকা চিংড়ি খামারের জন্য নির্বাচন করতে হবে।

গ. পানির উৎস: বাগদা চিংড়ি চাষের জন্য লবণাক্ত পানির প্রয়োজন। এছাড়া চিংড়ি চাষের জন্য অন্যান্য যে সব ভৌত-রাসায়নিক গুণাবলী থাকা প্রয়োজন তা সমুদ্রের পানিতে বিদ্যমান। তাই খামারের জন্য এমন স্থান নির্বাচন করতে হবে যেখানে চিংড়ি চাষের উপযোগী লবণাক্ত পানি পাওয়া যায়। তাছাড়া চিংড়ি চাষের জন্য যে সব উৎস বা আধার থেকে পানি সরবরাহ করা হবে তা অবশ্যই দূষণমুক্ত হতে হবে। তাছাড়া চিংড়ি খামার থেকে পানির উৎসের দূরত্বের বিষয়টিও বিবেচনায় রাখতে হবে। দুরুত্ব বেশি হলে সার্বক্ষণিকভাবে পানি পাবার বিষয়টি অনিশ্চিত হওয়ার সাথে সাথে সরবারাহ ব্যয় বৃদ্ধি পাবে।

ঘ. জোয়ার-ভাটার বৈশিষ্ট্য: খামারের পানি পরিবর্তন, পানি নিষ্কাশন ও বাঁধের উচ্চতা নির্ধারণের জন্য খামার নির্মাণের স্থানে ভূমির উচ্চতার সাথে জোয়ার-ভাটার হ্রাস-বৃদ্ধির পরিমাণ জানা দরকার। যেসব স্থানে জোয়ার- ভাটার হ্রাস-বৃদ্ধির পরিমাণ ২-৩ মিটার, সেসব জায়গা খামার স্থাপনের জন্য অধিক উপযোগী। জোয়ার-ভাটার হ্রাস-বৃদ্ধি ৪ মিটারের বেশি বা ১ মিটারের কম হলে বাঁধ নির্মাণ ও পানি সরবরাহ ব্যয় বৃদ্ধি পাবে, ফলে চিংড়ি চাষ লাভজনক না হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

ঙ. মাটির গুণাগুণ: মাটির পানি ধারণক্ষমতা ও ভেদ্যতা, মাটির উর্বরতা প্রভৃতি চিংড়ি চাষ পুকুরের জন্য অত্যাবশ্যকীয় বিষয়। মাটির গুণাগুণ ভালো না হলে খামার স্থাপন ব্যয়বহুল ও ঝুঁকিপূর্ণ হয়। মাটি যত ভেদ্য হবে পানি চোয়ানোর হার তত বেশি হবে। খামার স্থাপনে মাটির যে গুণাগুণ থাকা প্রয়োজন তা নিম্নরূপঃ

১) অভেদ্য মাটি দেখে স্থান নির্বাচন করতে হবে, তা না হলে খামারে পানি ধরে রাখা কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়।

২) মাটির পিএইচ ৫-৬.৫ থাকতে হয়।

৩) মাটিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ ২.৫-৪.৩% থাকতে হয়।

৪) মাটির ধরন হবে দোআঁশ, বেলে-দোআঁশ বা এঁটেল দোআঁশ।

৫) অধিক অম্লযুক্ত মাটি চিংড়ি চাষের জন্য অনুপযোগী।

৬) দূষিত গ্যাসমুক্ত মাটি চিংড়ি চাষের জন্য বেশি উপযোগী। 

৭) অপ্রয়োজনীয়/অতিরিক্ত আগাছামুক্ত হতে হবে।

চ. পানির গুণাগুণ: পানির তাপমাত্রা, দ্রবীভূত অক্সিজেন, পানির লবণাক্ততা, পানির স্বচ্ছতা, পিএইচ, অ্যালকালিনিটি, হার্ডনেস, অ্যামোনিয়া ইত্যাদি চিংড়ি চাষের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। এ সব প্রয়োজনীয় গুণাগুণ সঠিক মাত্রায় না থাকলে চিংড়ির উৎপাদন ব্যাপকভাবে বাধাগ্রস্ত হয় । কাজেই চিংড়ি চাষের জন্য পানির নিম্নোক্ত গুণাগুণসমূহ পার্শ্বে উল্লিখিত মাত্রায় থাকা অপরিহার্য বলে বিভিন্ন গবেষণা তথ্যে পাওয়া যায়।

ছ. ভূ-প্রকৃতি: যেখানে খামার স্থাপন করা হবে সেখানকার ভূ-প্রকৃতি অবশ্যই জানা থাকতে হবে। ভূ-গর্ভস্থ পানির অবস্থানও জানা দরকার। লালচে ও এসিড সালফেটযুক্ত মাটি চাষের জন্য অনুপোযোগী। স্থানটি খামার স্থাপনের উপযোগি কি না শুরুতেই যাচাই করে নিতে হবে বিশেষ করে মাটির গঠন।

জ. অবকাঠামোগত সুবিধা: চিংড়ি খামারের প্রয়োজনীয় উপকরণ সরবরাহ ও স্থানান্তরের জন্য উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রয়োজন। রাস্তা-ঘাট ও যাতায়াত ব্যবস্থা ভালো না হলে চিংড়ি বিক্রির ক্ষেত্রেও সমস্যা দেখা দিতে পারে। সর্বোপরি বন্যামুক্ত এলাকা চিংড়ি চাষের জন্য উপযোগী। এজন্য বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ আছে এবং পানি নিয়ন্ত্রণের জন্য ফ্লুইস গেট আছে এমন এলাকা নির্বাচন করা উচিত।

ঝ. বিদ্যুৎ সরবরাহ: চিংড়ি খামারে বিদ্যুৎ থাকা জরুরি। খামারের স্থান নির্বাচনের সময় বিদ্যুৎ পাওয়ার নিশ্চয়তা থাকা আবশ্যক। বিদ্যুৎ না থাকলে ডিজেল চালিত পাম্পে জ্বালানি খরচ বেশি লাগবে। পানি অপসারণ বা খামারে পানি প্রবেশের ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ সবচেয়ে সুবিধাজনক ও সাশ্রয়ী বিধায় বিদ্যুতের নিশ্চয়তা আবশ্যক।

ঞ. দক্ষ জনশক্তি: চিংড়ি খামার লাভজনক করতে হলে দক্ষ জনশক্তির কোন বিকল্প নেই। খামারে সহনশীল উৎপাদন ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণ ও অধিক উৎপাদনের জন্য খামারের দক্ষ জনশক্তি নিয়োগ করতে হবে। তাই দক্ষ জনশক্তির পর্যাপ্ততা বিবেচনা করে চিংড়ি খামার স্থাপন করা উচিত।

ট. উৎপাদন সামগ্রীর প্রাপ্যতা ও সরবরাহ: এমন জায়গায় চিংড়ি খামার স্থাপন করা উচিত যেখানে খুব কাছাকাছি হাট বাজার আছে, যার ফলে খুব সহজেই খামার স্থাপন ও পরিচালনার জন্য সার, চুন, যন্ত্রপাতি ও মেরামত সামগ্রী সংগ্রহ করা যায়। এছাড়া দূরবর্তী বাজার থেকে সংগ্রহ করতে হলে প্রয়োজনীয় পরিবহণ ব্যবস্থা থাকা উচিত।

ঠ. বিরোধমুক্ত এলাকা: বিরোধপূর্ণ এলাকায় চিংড়ি খামার স্থাপন করা উচিত নয়। এতে সামাজিক ও পরিবেশগত বিপর্যয়ের সম্ভাবনা থাকে। এছাড়া চিংড়ি একটি মূল্যবান ফসল হওয়ায় খামারের সার্বক্ষণিক নিরাপত্তার বিষয়টি অতীব গুরুত্বপূর্ণ। নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় জনবলের ব্যবস্থা করাসহ কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।

Content added || updated By

খামারের অবকাঠামো উন্নয়ন ও সংরক্ষণ

চিংড়ি চাষের সফলতা মূলত সঠিক ব্যবস্থাপনা, পরিবেশ, স্থান, দক্ষতা, পুঁজি, অবকাঠামোগত সুবিধা, উপকরণ সরবরাহ ইত্যাদি অনেকগুলো বিষয়ের সাথে সম্পর্কযুক্ত। সাধারণভাবে আধুনিক চিংড়ি চাষ ব্যবস্থাপনাতে আশানুরূপ ফলন পেতে হলে সঠিকভাবে অবকাঠামো নির্মাণ ও এর যথাযথ সংরক্ষণ একান্ত প্রয়োজন। খামারের সঠিক নকশা প্রণয়নপূর্বক খামারে নিম্নোক্ত অবকাঠামোসমূহ নির্মিত হওয়া আবশ্যক।

ক. বেষ্টনী বাঁধ: উন্নত পদ্ধতির বাগদা চিংড়ি চাষে ঘেরের বাঁধ বা পাড় নির্মাণ করার সময় নিম্নোক্ত বিষয়সমূহ খেয়াল রাখতে হবে।

১) ঘেরের বাঁধ দৃঢ় এবং মজবুত হতে হবে, যাতে করে পানি ঘের থেকে বেরিয়ে না যায় এবং বাইরে থেকে পানি ঢুকতে না পারে।

 ২) বাঁধের উচ্চতা হবে ৮ ফুটের অধিক এবং তলা হবে ১২-১৬ ফুট, উভয় দিকের ঢালের (মাটির ধরন অনুযায়ী) অনুপাত হবে ১ঃ ২ হতে ১ঃ ১.৫।

৩) ঘেরের পাড়ের চূড়া অন্তত ২ ফুট প্রশস্ত হবে, পাড়ের উভর ঢালে ঘাসের ছাপ সংগ্রহ করে লাগানো যেতে পারে। 

খ. পুকুরের বাঁধ বা অভ্যন্তরীণ বাঁধ: খামারের অভ্যন্তরীণ বাঁধ এমনভাবে নির্মাণ করতে হবে যেন চাষ এলাকায় ১-২ মিটার পানি ধরে রাখা যায় অর্থাৎ বাঁধের উচ্চতা কমপেক্ষ ১.৫ মিটার হতে হবে। তবে স্তরে মাটি কমপ্যাক্ট করে বাঁধ খুব মজবুতভাবে নির্মাণ করতে হবে, যাতে চাষ এলাকা বা পুকুরের পানি বের হয়ে না যায় এবং বাইরের পানি পুকুরে প্রবেশ করতে না পারে। পুকুরের পাড় যাতে ধসে না যায় বা অতিবৃষ্টির ফলে বাঁধের মাটি ধুইয়ে ক্ষয় হয়ে না যায় সে জন্য বাঁধের পায়ে দুর্বা জাতীয় ঘাস অথবা পুকুরে ছায়া সৃষ্টি করবে না এ রকম গাছ লাগাতে হবে। একটি বাঁধ নির্মাণ করার সময় বিভিন্ন স্থানের পরিমাপ নিচের চিত্রের সাহায্যে বর্ণনা করা হলো:

চিত্রে ৬ ফুট গভীরতা সম্পন্ন একটি নার্সারি পুকুর, যার ঢাল জমির বাইরের দিক হতে বকচর পর্যন্ত দৈর্ঘ্য ২০ ফুট, যেখানে ২ ফুট পর হতে মাটি ফেলা হয়েছে। বাইরের ঢাল ৬ ফুট, বাঁধের উপরের দৈর্ঘ্য ৬ ফুট বাইরের বাঁধের ভিতরের ঢাল ৬ ফুট ও বকচর ২ ফুটসহ মোট ২০ ফুট। ঘেরের ভেতরের দৈর্ঘ্য ১৫ ফুট যার মধ্যে ২ ফুট বকচর ভেতরের দিকে ঢাল ৪ ফুট, ভিতরের বাঁধের উপরের দৈর্ঘ্য ৫ ফুট ও ভেতরের বাঁধের বাইরের ঢাল ৪ ফুট। বাঁধের উচ্চতা নির্ভর করে উক্ত স্থানের বন্যার পানির উচ্চতা, মাটির গঠন ও পুকুরের ব্যবস্থাপনা সুবিধার উপর।

গ. নার্সারি পুকুর: চিংড়ি পোনার সুষম বৃদ্ধি ও পোনার মৃত্যুহার নুন্যতম পর্যায়ে রাখার জন্য নার্সারি পুকুর ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত জরুরি। নার্সারি পুকুর যথাযথভাবে তৈরি করতে হবে। এর ফলে পোনার মজুদকালীন মৃত্যুহারও কমে যাবে এবং পোনা দ্রুত বাড়বে। এ ক্ষেত্রে পালনীয় কাজগুলো হলো:

১) নার্সারিতে যাতে ৩ থেকে ৪ ফুট পানি থাকে সে অনুপাতে পুকুর খনন করতে হবে।

২) ঘন মশারির নেট দিয়ে নার্সারি নির্মাণ করতে হবে। 

৩) নার্সারির নেট পানির উপরে এক হাত পরিমাণ বাড়তি রাখতে হবে এবং তার মাটিতে কাদার পরিমাণ ৫-৬ ইঞ্চির বেশি হওয়া যাবে না।

৪) পুকুরের পাড় অবশ্যই উঁচু, মজবুত ও বন্যামুক্ত হতে হবে।

৫) ব্যবস্থাপনার সুবিধার জন্য বাড়ির কাছাকাছি হওয়া ভালো।

৬) পুকুরে প্রচুর সূর্যের আলো এবং বাতাস থাকার ব্যবস্থা থাকতে হবে যাতে নার্সারি পুকুরে কমপক্ষে দিনে ৬-৮ ঘন্টা সূর্যের আলো পড়ে।

চিত্র-২.১: একটি আদর্শ নার্সারি পুকুর

ঘ. পালন পুকুর

উন্নত পদ্ধতির চিংড়ি চাষে পালন পুকুর নির্মাণ একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। যথাযথভাবে পালন পুকুরটি নির্মাণ করা হলে রোগ সংক্রমণের ঝুঁকি বহুলাংশে কমে যাবে। পালন পুকুর তৈরিতে নিম্নের যে সকল বিষয়গুলো বিবেচনায় রাখতে হয়-

১) পালন পুকুরের সব জায়গায় ৩ ফুটের অধিক পানি থাকতে হবে।

২) পালন পুকুরের পাড়ে গাছ-গাছালি ও ঝোপ-ঝাড় থাকলে তা পরিষ্কার করে ফেলতে হবে। 

৩) পুরাতন পুকুরের ক্ষেত্রে তলা ভালভাবে শুকাতে হবে প্রয়োজনে কালো মাটি থাকলে সরিয়ে ফেলতে হবে।

৪) পালন পুকুরের তলদেশ সমান হতে হবে।

৫) দোআঁশ মাটি হলে পুকুরের ঢাল ১১.৫ এবং বেলে মাটি হলে পুকুরের ঢাল ১৪২০ হবে।

৬) এই পদ্ধতিতে একটি আদর্শ পালন পুকুরের আয়তন হওয়া উচিত অনধিক এক হেক্টর।

৭) দিনে কমপক্ষে ৬-৮ ঘণ্টা পর্যাপ্ত সূর্যালোকে থাকতে হবে।

৮) পুকুরের পাড় অবশ্যই উঁচু ও মজবুত হতে হবে।

চিত্র-২.২: একটি আদর্শ পালন পুকুর

ঙ. রিজার্ভার নির্মাণঃ জরুরি প্রয়োজনে পরিশোধিত পানি সরবরাহের জন্য মূল/পালন পুকুরের পাশে একটি ৫- ৬ ফুট গভীর রিজার্ভার নির্মাণ করতে হবে। রিজার্ভারের আয়তন পালন পুকুরের চার ভাগের এক ভাগ হতে পারে। সর্বোপরী রিজার্ভারের চারপাশে জালের বেড়া থাকতে হবে।।

চ. ফ্লুইস গেট নির্মাণ: বাগদা চিংড়ি চাষের জন্য ফ্লুইস গেট নির্মাণ অত্যন্ত প্রয়োজন। ব্লুইস গেটের মাধ্যমে পুকুরে পানি সরবরাহ ও পুকুর থেকে পানি নিষ্কাশন করা হয়। এজন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক পরিমিত আকারের ফ্লুইস গেট নির্মাণ করতে হবে। চাষ এলাকায় ঘেরে পানির নিশ্চয়তার জন্য প্রতিটি জোয়ারে ৩০ শতাংশ পানি যাতে সরবরাহ করা যায় এমনভাবে পেট নির্মাণ করতে হবে।

চিত্র-২.৩: চিংড়ি ঘেরে ফ্লুইস গেট

পানি সরবরাহ গেট পুকুরের তলা থেকে কিছুটা উপরে এবং নিষ্কাশন গেট পুকুরের তলা থেকে কিছুটা নিচুতে স্থাপন করা দরকার। এতে পুকুরে সঠিকভাবে পানি সরবরাহ ও নিষ্কাশন করা যায়। ফ্লুইস গেট কাঠের, আরসিসি পাইপ বা পিভিসি পাইপ অথবা সিমেন্ট দ্বারা নির্মাণ করা যায়। ফ্লুইস গেট সাধারণত দু'ধরনের হয়ে থাকে, যথা- প্রধান ফ্লুইস গেট ও গৌণ বা অপ্রধান ফ্লুইস গেট। বেষ্টনী বাঁধের উৎসের নিকট যে গেট নির্মাণ করা হয় তাকে প্রধান ফ্লুইস গেট এবং পুকুরের পাড়ে যে গেট নির্মাণ করা হয় তাকে গৌণ ফ্লুইস গেট বলে। পানি সরবরাহ খালে পানি সরবরাহ করার জন্য সাধারণত প্রধান ফ্লুইস গেট ব্যবহার করা হয় এবং সরবরাহ খাল থেকে পুকুরে পানি সরবরাহ করার জন্য গৌণ ফ্লুইস গেট ব্যবহার করা হয়। একটি কাঠের ফ্লুইস গেট নির্মাণের সময় নিচের বিষয়গুলোর প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে-

১) ফ্লুইস গেটে বা গেটসমূহের আকার বা সংখ্যা এমন হতে হবে যাতে নির্ধারিত সময়ে খামারে পানি প্রবেশ করানো যায় বা সময়মত খামার থেকে পানি বের করা যায়।

২) খামারের এমন স্থানে গেট নির্মাণ করতে হবে যাতে খামারের সমস্ত পানি বের করা সম্ভব হয়। গেটে ছোট ছিদ্রযুক্ত জাল, আহরণ জাল ও ফল বোর্ড বসানোর ব্যবস্থা থাকতে হবে। 

৩) পেট পানি নিরোধক হতে হবে যাতে গেটের পার্শ্বে বা তলা দিয়ে পানি প্রবেশ করতে বা পানি বের হয়ে যেতে না পারে।

৪) গেটের তলদেশ দিয়ে পানি সরবরাহ ও নিষ্কাশনের ব্যবস্থা থাকতে হবে।

৫) গেটের উপরিভাগ দিয়ে নিষ্কাশনের ব্যবস্থা থাকতে হবে।

৬) গেটের ডিজাইন এমন হতে হবে যেন সহজে পরিচালনা করা যায় । 

পুকুরে পানি সরবরাহ ও নিষ্কাশনের কাজ ৪-৬ ঘন্টার মধ্যে সম্পন্ন করার ব্যবস্থা থাকা দরকার। নিষ্কাশন কাজ যাতে সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করা যায় সেজন্য পুকুরের তলদেশ পানি সরবরাহ করানোর গেটের দিক থেকে পানি নিষ্কাশন গেটের দিকে ঢালু হতে হবে। পানি সরবরাহ ফ্লুইস গেটের মুখে সূক্ষ ছিদ্রযুক্ত জাল স্থাপন করে রাক্ষুসে মাছ ও অন্যান্য অবাঞ্ছিত জলজ প্রাণীর খামারে প্রবেশ বন্ধ করা যায়। আর নিষ্কাশন ফ্লুইস গেটের মুখে জাল স্থাপন করে অতি সহজেই চিংড়ি আহরণ করা যায়।

ছ. গার্ড শেড, বাসস্থান ও ভান্ডার নির্মাণ: গার্ড শেড, বাসস্থান ও ভান্ডার খামার অবকাঠামোর অন্যতম উপাদান। খামারের প্রয়োজনীয় উপকরণাদি যেমন- চুন, সার, খাদ্য, যন্ত্রপাতি, সরঞ্জাম ইত্যাদি রাখার জন্য উপযুক্ত ভান্ডার থাকা দরকার। খামারের ভান্ডারটি শুষ্ক স্থানে হওয়া উচিত। এছাড়া খামারের শ্রমিকসহ খামার পরিচালনায় নিয়োজিত অন্যান্য জনবলের জন্য স্বাস্থ্যসম্মত বাসস্থান থাকা একান্ত অপরিহার্য। কর্মরত জনবলের জন্য পর্যাপ্ত স্যানিটেশন ব্যবস্থাও অত্যন্ত জরুরি। তাছাড়া খামারের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সংখ্যক গার্ড শেড নির্মাণ করতে হবে।

Content added By

বাগদা চিংড়ির খামার/ঘের প্রস্তুতকরণ

চিংড়ি চাষের ক্ষেত্রে খামার/ঘের/পুকুরের ভৌত অবস্থার উন্নয়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেননা সুষ্ঠু পুকুর প্রস্তুতির মাধ্যমে চিংড়ি চাষ ব্যবস্থাপনা সহজেই নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। এছাড়াও চিংড়ি সহজেই পুকুরের পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারে। চিংড়ি চাষ পুকুর প্রস্তুতিতে অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাসমূহ নিচে উল্লেখ করা হলো। 

ক) পুকুরের তলদেশে জৈব্য বর্জ্য পদার্থ মুক্ত হওয়ার কারণে অক্সিজেন গ্রহণকারী বিষাক্ত পদার্থের পরিমাণ হ্রাস পায়।

খ) পুকুরের তলদেশ জীবাণুমুক্ত হয়।

গ) পুকুরে পানিতে খনিজ পদার্থ সহজে মুক্ত হতে পারে।

ঘ) পুকুরের তলদেশের মাটিতে সহজে সূর্যালোক প্রবেশ করতে পারে। ফলে পুকুরের তলদেশের মাটিতে অনুজীবের ক্রিয়া বৃদ্ধি পায় ও জৈব্য পদার্থ সহজেই পচন ক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করতে পারে।

ঙ) চিংড়ি উৎপাদনে অবাঞ্চিত ক্ষতিকর শৈবালের ব্যাপকতা হ্রাস পায়।

চ) চিংড়ির জন্য ক্ষতিকর মাছের ডিম, কাঁকড়ার লার্ভা ও গুরুত্বপূর্ণ ক্ষতিকর প্রাণীর উপস্থিতি বা উপদ্রব হ্রাস পায়।

চিংড়ি চাষের ক্ষেত্রে সুষ্ঠুভাবে পুকুর প্রস্তুতির মাধ্যমে চিংড়ির খাদ্য ও পুষ্টিকর পদার্থের পরিমাণ বাড়ানো যেতে পারে যা পরোক্ষভাবে চিংড়ি চাষে সম্পূরক খাদ্য সরবরাহের সাথে সম্পর্কযুক্ত।

Content added By

চিংড়ি চাষে পুকুর প্রস্তুতির ধাপ

চিংড়ি উৎপাদনের ক্ষেত্রে পুকুরের তলদেশের গভীর কাদার স্তর চিংড়ি উৎপাদনের ক্ষেত্রে বাধাস্বরূপ। চিংড়ি চাষ পদ্ধতি অধিক সম্পূরক খাদ্য নির্ভর হওয়ার কারণে পুকুরের তলদেশে গভীর কাদার সৃষ্টি হয়। এ কারণে চিংড়ি চাষের ক্ষেত্রে প্রতি বছর ফসল আহরণের পরপরই বা পুনরায় চিংড়ির পোনা মজুদের পূর্বেই পুকুর প্রস্তুত করে নিতে হয়। চিংড়ি চাষের ক্ষেত্রে অধিক সার, খাদ্যে বর্জ্য পদার্থ ও প্ল্যাংকটন উৎপাদন সমৃদ্ধ পুকুর ব্যবস্থাপনাগত দিক থেকে ভাল নয়। কেননা এ ধরনের পুকুরের তলদেশে বর্জ্য পদার্থ অধঃক্ষেপনের মাধ্যমে অবায়বীয় গভীর পাঁকের সৃষ্টি হয়। অধিক অবায়বীয় জৈব্য পদার্থ সমৃদ্ধ পুকুর চিংড়ির স্বাভাবিক বৃদ্ধির ও উৎপাদনের উপর প্রতিকূল প্রভাব ফেলে। কখনও কখনও এধরনের অধঃক্ষেপনকৃত পদার্থের কারণে চিংড়ি ও অন্যান্য জীবভরের মৃত্যু ও বিলুপ্তি হতে পারে বা রোগের প্রাদুর্ভাব হতে পারে। এ কারণেই চিংড়ি চাষের ক্ষেত্রে প্রথমেই পুকুরের মাটির প্রকৃতি, পূর্ববর্তী বছরের উৎপাদনে পরিবেশগত বাধাসমূহ নির্ণয় করে পুকুর প্রস্তুতির কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হয়। নিচে পুকুর প্রস্তুতির ধাপসমূহ উল্লেখ করা হলো-

ক. পুকুরের পানি বের করে ফেলা: চিংড়ি ও মাছ আহরণের পর পুকুরের পানি সম্পূর্ণরূপে বের করে দেয়াই উত্তম। এ সময় পুকুরের তলদেশ, ঢাল ও নালার অবস্থা, ব্লুইস গেট প্রভৃতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করে পুকুর প্রস্তুতির কার্যকর পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হয়, যাতে পুকুরের ভৌত অবস্থার উন্নয়ন করা সম্ভব হয়। পুকুরের তলদেশের কালো মাটি পুকুর প্রস্তুতির ক্ষেত্রে প্রধান বাধাস্বরূপ। চিংড়ি আহরণের পরপরই প্রেসার পাইপের মাধ্যমে তীব্র স্রোতে বা বেগে পানি বার বার প্রবেশ ও বের করার মাধ্যমে কালো মাটি অপসারণ করা যেতে পারে। এ কাজটি পুকুরের পানি বের করে দেয়ার সাথে সাথে করতে হবে। যাতে পুকুরের মাটি সূর্যালোকে শক্ত হয়ে যেতে না পারে। বছরের নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে কাজটি করলে বছরের শুরুতে অর্থাৎ জানুয়ারি মাসে পিএল মজুদ করা সম্ভবপর হয় এবং এপ্রিল-মে মাসে ভাইরাসের সংক্রমণের পূর্বেই ফসল আহরণ করা সম্ভবপর হবে।

চিত্র-২.৪: চিংড়ি খামারের পানি অপসারণ

খ. পুকুর শুকানোঃ পুকুরে জলস্রোত দিয়ে বা প্রম নির্ভর পদ্ধতিতে পুকুরের তলদেশের বর্জ্য পদার্থ সরিয়ে ফেলার পর ১০-১৫ দিন সূর্যালোকে পুকুর এমনভাবে শুকাতে হয়, যাতে পুকুরের তলদেশের মাটিতে ২৫-৩০ সেমি গভীর ফাটলের সৃষ্টি হয়। পুকুরের তলদেশের গভীর অঞ্চল শুকানোর ক্ষেত্রে পানি নিষ্কাশন পাম্প ব্যবহার করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে নিম্নলিখিত বিষয়সমূহ বিবেচনায় নিতে হবে-

  • পুকুরের তলার মাটি এমনভাবে শুকাতে হবে যেন মাটিতে ফাটল ধরে এবং কোথাও ভেজা ভেজা বা জলীয় উপাদান না থাকে।
  • শুকানোর পর দৃশ্যমান আবর্জনা দূর করতে হবে, ফলে তলার মাটি পরিষ্কার হবে জীবাণু মারা যাবে।
  •  মাটি শুকানোর পর অতিরিক্ত কাঁদা, স্তূপীকৃত জৈব পদার্থ, দুপ যুক্ত কালো মাটি ঘের থেকে সরিয়ে ফেলা উচিত।
  •  পুকুর/ঘের এর তলা ভালো ভাবে সমতল করে নিতে হয় এবং পানি নিগর্মণ পথের দিকে কিছুটা ঢালু রাখতে হবে।
  •  অধিক উৎপাদন পেতে হলে পুকুর/ষের খামার ভালোভাবে শুকাতেই হবে।

চিত্র-২.৫: চিংড়ি নামারের তলদেশ শুকানো ও সমতলকরণ

তাছাড়া পুকুরের ভিতরের অংশ থেকে মাটি কেটে পুকুরের চারপার্শ্বে শক্ত মজবুত, প্রশস্থ ও দৃঢ়ভাবে পাড় তৈরি করতে হবে। চারিপার্শ্বের পানির সর্বোচ্চ উচ্চতার চেয়ে প্রধান বাঁধের উচ্চতা কমপক্ষে ৩ ফুট বেশি করতে হবে।

গ. ভনদেশের মাটি চাষ পুকুরের মাটি শুকানোর পর ১০-১৫ সেমি গভীর তলদেশের মাটি লম্বালম্বি ও আড়াআড়িভাবে ৩-৫ বার চাষ করতে হয়। এক্ষেত্রে অধিক পরিমাণ বর্জ্য পদার্থ সমৃদ্ধ স্থানসমূহ অধিক গভীর করে চাষ দেয়ার প্রয়োজন হয়। সাধরণত চাষের গভীরতা পুকুরের তলদেশের চাষের ক্ষেত্রে ট্রাক্টর, দেশীয় প্রচলিত পদ্ধতি অবলম্বন করা যেতে পারে।

ঘ. পাড় মেরামত ও বেড়া দেয়া: মের প্রস্তুত করার পূর্বেই পাড় মেরামত করা প্রয়োজন। পাড়ে কোন গর্ভ থাকলে তা বন্ধ করে ফেলতে হবে। পাড় ভালা থাকলে তা মাটি দিয়ে ভালভাবে মেরামত করে নিতে হবে। সম্ভব হলে পাড়ে ঘাস লাগানো যেতে পারে। পাড়ের গর্ভ বিভিন্ন ক্ষতিকর প্রাণীর আশ্রয়স্থল হিসেবে কাজ করে। তাছাড়া পুকুরের চারদিকে বেড়া দিতে হবে, যাতে কাঁকড়া, সাপ, ব্যাঙ, কুঁচে, শামুক এবং জীবাণুবাহক অন্যান্য ক্ষতিকর প্রাণী পুকুরে প্রবেশ করতে না পারে। এর ফলে খামারের জৈব নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে।

পুকুরের পাড় মেরামত                                     পুকুরের চারপাশে বেড়া দেয়া

চিত্র-২.৬: পুকুরের পাড় মেরামত ও বেড়া দেয়া 

Content added By

রাক্ষুসে ও অবাঞ্ছিত মাছ

চিংড়ি চাষ একটি অত্যন্ত লাভজনক কার্যক্রম হলেও বিভিন্ন ভুল সিদ্ধান্তের কারণে অনেক সময় চিংড়ি চাষে সফলতা নাও আসতে পারে। ব্যর্থতার মাঝে যে সমস্ত কারণগুলো রয়েছে তার মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য কারণ হলো- পোনা মজুদের পূর্বে সঠিক নিয়মে পুকুর হতে রাক্ষুসে ও অবাঞ্ছিত মাছ দূর না করা। রাক্ষুসে ও অবাঞ্ছিত মাছ চাষকৃত পুকুরে কী ক্ষতি করতে পারে এ ব্যাপারে অনেকের সুস্পষ্ট ধারনা নেই। নিচে রাক্ষুসে ও অবাঞ্ছিত মাছ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।

রাক্ষুসে মাছ: যে সমস্ত মাছ সরাসরি অন্য মাছ বা চিংড়ি ধরে খায় তাদেরকে রাক্ষুসে মাছ বলে, যেমন- ফলি, বোয়াল, ভেটকি, ৰেলে, শোল, গজার প্রভৃতি। এরা চাষকৃত চিংড়ি বা চিংড়ির পিএল সরাসরি খেয়ে ফেলে, ফলে চিংড়ির উৎপাদন কমে যায়। নিচে কতিপয় রাক্ষুসে মাছের ছবিসহ নাম উল্লেখ করা হলো :

চিত্র-২.৭: প্রধান প্রধান রাক্ষুসে মাছ 

অবাঞ্ছিত মাছ: যে সমস্ত মাছ সরাসরি অন্য মাছকে যায় না কিছু চাষকৃত মাছের সাথে অক্সিজেন, খাদ্য ও বাসস্থান নিয়ে তাঁর প্রতিযোগীতা করে তাদের অবাঞ্ছিত মাছ বলে, যেমন- পারলে, ভাগনী, চা তেলাপিয়া, কাকিলা প্রভৃতি অন্যতম। পুকুরে এ ধরনের মাছ থাকলে খাদ্যের অপচয় হয় এবং উৎপাদন অনেক কমে যায়। নিচে কিছু উল্লেখযোগ্য অবাঞ্ছিত মাছের নাম উল্লেখ করা হলো :

চিত্র-২-৮: প্রধান প্রধান অবাঞ্ছিত মাছ

নিম্নলিখিত কারণে রাক্ষুসে ও অবাঞ্ছিত মাছ চিংড়ি চাষের ঘের/পুকুর থেকে দূর করা প্রয়োজন-

ক) রাক্ষুসে মাছ চাষকৃত মাছের পোনা খেয়ে ফেলে ফলে উৎপাদন আশানুরূপ হয় না।
খ) পুকুরে মজুতকৃত চিংড়ির সঠিক রেকর্ড সংরক্ষণে অসুবিধার সৃষ্টি হয়।
গ) অবাঞ্ছিত মাছ চাষকৃত চিংড়ির খাদ্যে ভাগ বসায়। তাছাড়া চাষকৃত চিংড়ির সঙ্গে বাসস্থান ও অক্সিজেনসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ উপাদান নিয়েও প্রতিযোগিতা করে।
ঘ) উভয় প্রকার মাছই পুকুরে রোগ-জীবাণুর বাহক এবং আশ্রয়স্থল হিসেবে কাজ করে, কারণ বিভিন্ন প্রকার মাছের রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা এক নয়।
ঙ) উভয় প্রকার মাছের উপস্থিতিতেই চিংড়ির উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়, উৎপাদন কম হয় এবং লাভের অংশ কমে যায়।

চ) দেখা গেছে ১ কেজি রাক্ষুসে মাছ প্রায় ১০ কেজি চাষকৃত চিংড়ি খেয়ে ফেলে, আবার ১ কেজি রাক্ষুসে মাছ ১০ কেজি চাষযোগ্য মাছের খাদ্য খেয়ে ফেলে।

Content added By

রাক্ষুসে ও অবাঞ্ছিত মাছ দূরীকরণ

চিংড়ি চাষ লাভজনকভাবে পরিচালনা করতে হলে চিংড়ি পোনা মজুদের পূর্বে সঠিক নিয়মে পুকুর হতে রাক্ষুসে ও অবাঞ্ছিত মাছ দূর করতে হবে। নিচে রাক্ষুসে ও অবাঞ্ছিত মাছ কিভাবে ঘের বা পুকুর হতে দূর করা যায় সে বিষয়ে আলোচনা করা হলো।

ক) পানি শুকিয়ে: পুকুর হতে রাক্ষুসে ও অবাঞ্ছিত মাছ দূরীকরণের সবচেয়ে ভাল পদ্ধতি হলো স্যালো মেশিন দ্বারা পানি সেচে পুকুর শুকিয়ে ফেলা। পুকুর শুকানোর পূর্বে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে যে মৌসুমে পুকুর শুকানো হচ্ছে সে মৌসুম পুকুর শুকানোর জন্য উপযোগী কিনা। কারণ পুকুর শুকানোর পরে কমপক্ষে ১৫ দিন রোদে রাখলে তার তলদেশ রোদে ফেটে যাবে, ফলে বিভিন্ন প্রকার বাজে গ্যাস দূর হয়ে যাবে। তলদেশে কাদার মধ্যে সে সমস্ত রাক্ষুসে মাছ লুকিয়ে থাকার সম্ভাবনাও অনেকটা কমে যায়। এ কাজটি ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে করলে খরচও অনেকটা কম হবে।

খ) ঘন ফাঁসের জাল টেনেঃ পুকুর শুকানো সম্ভব না হলে এবং পুকুরের তলদেশ সমতল হলে সে সমস্ত পুকুরে যতদূর সম্ভব পানি কমিয়ে দিয়ে বার বার ঘন ফাঁসের জাল টেনে রাক্ষুসে ও অবাঞ্ছিত মাছ বহুলাংশে দুর করা যেতে পারে। তবে যত ভালোভাবেই জাল টেনে রাক্ষুসে মাছ দূর করা হোক না কেন অধিকাংশ ক্ষেত্রে কিছু না। কিছু মাছ থেকে যেতেই পারে। তাই জাল টেনে রাক্ষুসে মাছ দমন করে যদি পুকুরে পোনা মজুদ করতে হয় তাহলে অবশ্যই বড় সাইজের পোনা মজুদ করতে হবে। তবে এক্ষেত্রে চিংড়ির পোনা মজুদ করা অনুচিত।

গ) জীবন্ত টোপ ব্যবহার করে: অনেক সময় জীবন্ত মাছকে বড়শিতে টোপ হিসেবে ব্যবহার করে রাক্ষুসে মাছ যেমন- শোল, গজার, বোয়াল প্রভৃতি মাছ দূর করা হয়। যেহেতু এ জাতীয় মাছ রাক্ষুসে স্বভাবের তাই ছোট মাছ, যেমন- পুঁটি, খলিসা, টেংরা প্রভৃতি মাছকে বড়শিতে টোপ হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে।

ঘ) খাবার দেওয়ার পর ঝাঁকি জাল ব্যবহার করে: এই পদ্ধতিতেও অনেক সময় রাক্ষুসে ও অবাঞ্ছিত মাছ দূর করা যেতে পারে। পুকুরের কয়েকটি নির্দিষ্ট অংশে খাদ্য প্রয়োগ করলে মাছ যখন খাদ্য গ্রহণের জন্য খাদ্য প্রয়োগকৃত অঞ্চলে যাবে তখন ঝাঁকি জালের মাধ্যমে খুব সহজেই ধরা যেতে পারে। তবে এই পদ্ধতির ব্যবহার খুবই সীমিত এবং এই পদ্ধতিতে সম্পূর্ণভাবে রাক্ষুসে ও অবাঞ্ছিত মাছ দূর করা যায় না।

ঙ) মাছ মারার ঔষধ (বিষ) প্রয়োগ করেঃ রাক্ষুসে ও অবাঞ্ছিত মাছ দূর করার ক্ষেত্রে পুকুর শুকানো সম্ভব না হলে এর পরে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য পদ্ধতি হলো মাছ মারার ঔষধ (বিষ) প্রয়োগ করে তা দূর করা। ঔষধ প্রয়োগের ক্ষেত্রে অবশ্যই বিষের ধরন ও বিষক্রিয়ার মেয়াদকালের বিষয়টি বিশেষভাবে বিবেচনা করতে হবে। কারণ বাজারে এমন কিছু নিষিদ্ধ ও অননুমোদিত বিষ পাওয়া যায় যা ব্যবহারে আপাত দৃষ্টিতে অর্থ সাশ্রয় মনে হলেও পরিবেশ ও মানব দেহের জন্য অনেক বেশি ক্ষতিকর। নিচে বিভিন্ন প্রকার ঔষধের নাম, প্রয়োগ মাত্রা ও প্রয়োগ পদ্ধতি দেয়া হলো:

১. রোটেনন; রোটেনন হচ্ছে ডেরিস নামক গুল্ম জাতীয় এক প্রকার গাছের মূল (শিকড়) থেকে তৈরি এক ধরনের পাউডার জাতীয় পদার্থ যা দেখতে বাদামি বর্ণের। যদিও রোটেনন তরল ও পাউডার এ দুই অবস্থায় পাওয়া যায়, তবে আমাদের দেশে মুলত পাউডার জাতীয় রোটেনন পাওয়া যায়। রোটেননের শক্তিমাত্রা এর মধ্যে বিদ্যমান মূল কার্যকর উপাদানের উপর নির্ভরশীল। বাজারে দু'ধরনের শক্তি সম্পন্ন রোটেনন পাওয়া যায়, যেমন- ৭% এবং ৯.১% শক্তি সম্পন্ন। তবে ৯.১% শক্তি সম্পন্ন রোটেননই সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়। তাপমাত্রা বেড়ে গেলে রোটেনন-এর মাত্রা কম প্রয়োজন হয়। তাই শীতকালে রোটেনন প্রয়োগের ক্ষেত্রে গরমকালের চেয়ে বেশি পরিমাণে রোটেনন প্রয়োজন পড়ে। রোটেনন প্রয়োগের ক্ষেত্রে এর প্রয়োগ মাত্রা প্রজাতি, তাপমাত্রা ও শক্তিমাত্রার ওপর নির্ভর করে। রোটেননের প্রয়োগমাত্রা নিচে উল্লেখ করা হলো:

রোটেননের শক্তি মাত্রা

গ্রাম/শতক/ফুট পানি

৭%

১৬.১৮

৯.১%

১৮.২৫

 প্রয়োগ পদ্ধতি: পরিমাণমত রোটেনন পাউডার একটি পাত্রে নিয়ে অল্প অল্প করে পানি যোগ করে পেস্টের মত করে কাই তৈরি করতে হবে। অতঃপর উক্ত কাইকে সমান তিন ভাগে ভাগ করে দুই ভাগ গুলে তরল করে এবং এক ভাগ ছোট ছোট বল তৈরি করে সমস্ত পুকুরে সমানভাবে ছিটিয়ে দিতে হবে। এরপর জাল টেনে পানি উলট-পালট করে দিলে ভালো হয়। ১৫-২০ মিনিট পর মাছ ভাসতে শুরু করলে খুব দ্রুত জাল টেনে মাছ ধরে ফেলতে হবে। কারণ বেশি দেরি হলে মৃত মাছ পুকুরের তলায় ডুবে যাবে ও মাছ জালে উঠবে না। ভোর বেলায় রোটেনন প্রয়োগ করা ভালো, কারণ তখন পানিতে অক্সিজেন কম থাকে। এর ফলে রোটেনন এর বিষক্রিয়া বেশি কার্যকর হয়।

পুকুরে যখন রোটেনন প্রয়োগ করা হয় তখন ঐ রাক্ষুসে ও অবাঞ্ছিত মাছ পানি হতে দ্রবীভূত অক্সিজেন গ্রহণ করার সক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। কারণ মাছ যখন পানি হতে অক্সিজেন গ্রহণ করার নিমিত্তনিঃশ্বাস নিতে থাকে, তখন পানিতে দ্রবীভূত রোটেনন এর বিষক্রিয়া দ্বারা মাছের ফুলকার ল্যামেলি আক্রান্ত হয়। ফুলকায় যে গিল ল্যামেলি আছে সেই গিল ল্যামেলিগুলো ফেটে যায়। ফলে পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেন হিমোগ্লোবিনের সাথে যুক্ত হয়ে অক্সিহিমোগ্লোবিন রূপে দেহে পরিবাহিত হতে পারে না। অক্সিজেন পরিবহণের সেই কার্যকারিতা বন্ধ হয়ে যায়, ফলে মাছ অক্সিজেন গ্রহণ করতে না পেরে আস্তে আস্তে মারা যায়।

O2+Hb=HbO2
অক্সিজেন+ হিমোগ্লোবিন = অক্সিহিমোগ্লোবিন

এছাড়াও বিষযুক্ত পানি যখন নিঃশ্বাস এর মাধ্যমে সরাসরি মাছের পাকস্থলীতে প্রবেশ করে তখন অনুরুপ প্রতিক্রিয়ায় মাছের অভ্যন্তরীণ অংশ, যেমন- পরিপাকতন্ত্র, হৃদযন্ত্র, যকৃত, ফুসফুস প্রভৃতির সঙ্গে সংযুক্ত রক্তনালির দ্রুত ক্ষতিসাধন হয়। ফলে রক্ত সঞ্চালন প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায় ও পরিশেষে মাছ মারা যায়।

চিত্র-২-৯: রাক্ষুসে ও অবাঞ্ছিত মাছ দুরীকরণে ব্যবহৃত রোটেনন পাউডার ও ফসটক্সিন ট্যাবলেট

২. ফসটক্সিন/কুইকফস/সেলফস: এগুলো এক ধরনের কীটনাশক। বাজারে ও গ্রাম ওজনের ট্যাবলেট আকারে এগুলো পাওয়া যায়। পুকুরে রাক্ষুসে ও অবাঞ্ছিত মাছ দূরীকরণে এগুলো খুবই কার্যকর। তবে মানুষের জন্য অত্যন্ত বিষাক্ত বিধায় সতর্কতার সাথে এগুলো ব্যবহার করতে হয়। প্রতি ফুট গভীরতার জন্য শতকে ১টি ট্যাবলেট ব্যবহার করতে হবে।

প্রয়োগ পদ্ধতি: ট্যাবলেটগুলো সমানভাবে সমস্ত পুকুরে ছিটিয়ে দেয়ার পর জাল টেনে পানি উলট-পালট করে দিতে হবে। ট্যাবলেট প্রয়োগের ১-২ ঘন্টা পর মাছ মরে ভাসতে শুরু করলে জাল টেনে মাছ ধরার ব্যবস্থা করতে হবে। এ ট্যাবলেটের বিষক্রিয়ার মেয়াদকাল প্রায় ৭ দিন।

৩. ব্লিচিং পাউডার: যদিও এটা পানি বিশোধনে ব্যবহৃত হয়, তবুও এদ্বারা রাক্ষুসে ও অবাঞ্ছিত মাছ দূর করা যায়। পুকুরে ব্লিচিং পাউডার ব্যবহার করা হলে আর চুন প্রয়োগের প্রয়োজন হয় না। প্রতি ফুট গভীরতার জন্য শতকে ১ কেজি ব্লিচিং পাউডার ব্যবহার করতে হবে।

প্রয়োগ পদ্ধতি: পরিমাণমত ব্লিচিং পাউডার সুবিধাজনক কোনো পাত্রে পানি দিয়ে গুলে নিয়ে সমস্ত পুকুরে ছিটিয়ে দিতে হবে। এ পাউডার সকালে প্রয়োগ করলে ভালো ফল পাওয়া যায়। পাউডার প্ররোগের ২০-৩০ মিনিট পরেই মাছ মরতে শুরু করনে জাল টেনে মাছ ধরতে হবে। মনে রাখতে হবে এর বিষক্রিয়ার মেয়াদকাল প্রায় ৭ मिন।

৪. চা বীজের খৈলঃ চা বীজের গুঁড়া হতে এটা তৈরি করা হয়। চা বীজের খৈল প্রথমে বিষ এবং পরে সার হিসেবে কাজ করে। এ পাউডারের মধ্যে স্যাপোনিন নামক এক প্রকার বিষাক্ত পদার্থ থাকে, যা পানিতে দ্রবীভূত হয়ে মাছের রক্তের লোহিত কণিকাগুলোকে নষ্ট করে ফেলে, ফলে মাছ মারা যায়। পানির তাপমাত্রা বেশি থাকলে এ বিষক্রিয়া তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যায়। তাপমাত্রা কম হলে এটা ধীরে ধীরে কাজ করে ফলে অনেক সময় ধরে এর কার্যকারিতা থাকে। তাই চা বীজের খৈল তাপমাত্রা বাড়ার আগে সকালের দিকে প্রয়োগ করা ভালো। বিষ প্রয়োগের ৩-৫ ঘন্টার মধ্যেই মাছগুলো ভারসাম্য হারিয়ে ভাসতে শুরু করে এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই মারা যায়। এটা প্রয়োগে মাছ ছাড়াও চিংড়ি চাষের জন্য ক্ষতিকর ব্যাঙাচি, ছোট শামুক, জোঁক এবং কিছু কিছু পোকামাকড় মারা যায়। তবে চা বীজের খৈল চিংড়ির জন্য ক্ষতিকারক নয়, যেহেতু চিংড়ির রক্তে লোহিত কণিকা অনুপস্থিত। প্রতি ফুট গভীরতার জন্য শতকে ১ কেজি চা বীজের খৈল ব্যবহার করতে হবে।

প্রয়োগ পদ্ধতি: পরিমাণমত চা বীজের খৈল প্রথনে অল্প পানিতে গুলে নিয়ে তার সাথে আরও পানি মিশিয়ে পাতলা প্রবণ তৈরি করে সূর্যালোকিত দিনে সমস্ত পুকুরে সমানভাবে ছিটিয়ে দিতে হবে। পাউডার প্রয়োগের ২০-৩০ মিনিট পরেই মাছ মরতে শুরু করলে জাল টেনে না ধরতে হবে। এর বিষক্রিয়ার মেয়াদকাল প্রায় ৩- ৪ দিন।

চিত্র-২-১০: রাক্ষুসে ও অবাঞ্ছিত মাছ দুরীকরণে ব্যবহৃত চা বীজের খৈল ও মহুয়া বীজের খৈল

৫. মহুয়া বীজের খৈল: মহুয়া বীজ হতে তেল নিষ্কাশনের পর যে থৈল অবশিষ্ট থাকে তা বিষ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এতে স্যাপোনিন (৪-৬%) নামক এক প্রকার বিষাক্ত পদার্থ বিদ্যমান থাকে। আমাদের দেশের উত্তরাঞ্চলে এই গাছ সামান্য পরিমাণে জন্মে। এটাও চা বীজের খৈলের ন্যায় প্রথনে বিষ ও পরে সার হিসেবে কাজ করে। এটা প্রয়োগ করার ২ ঘন্টার মধ্যেই বিষক্রিয়া শুরু হয়ে যায় এবং মাছ মরে ভারসাম্যহীনভাবে ভাসতে শুরু করে। প্রতি ফুট গভীরতার জন্য শতকে ৩ কেজি চা বীজের খৈল ব্যবহার করতে হবে।

প্রয়োগ পদ্ধতি: পরিমাণমত মহুয়া বীজের খৈল প্রথমে অল্প পানিতে গুলে নিয়ে তার সাথে আরও পানি মিশিয়ে পাতলা দ্রবণ তৈরি করে সূর্যালোকিত দিনে সমস্ত পুকুরে সমানভাবে ছিটিয়ে দিতে হবে। পাউডার প্রয়োগের ২০-৩০ মিনিট পরেই মাছ মরতে থাকে। এর বিষক্রিয়ার মেয়াদকাল প্রায় ৩-৪ দিন।

ঔষধ প্রয়োগে সতর্কতা

  • ঔষধ প্রয়োগের সময় নাকে মুখে কাপড় এবং হাতে পলিথিন বেঁধে নিতে হবে।
  • ঔষধ বাতাসের অনুকূলে ছিটাতে হবে। 
  • ঔষধ বাচ্চাদের নাগালের বাইরে রাখুন।
  • ঔষধ প্রয়োগের পর পাত্রটি ভালভাবে পরিষ্কার করুন।


পানির বিষাক্ততা পরীক্ষা পদ্ধতি
বিষাক্ততা পরীক্ষার সময়: পুকুরে চিংড়ির রেল/পিএল মজুদ করার ১-২ দিন পূর্বে পানির বিষাক্ততা পরীক্ষা করে নেয়া উচিত। পানির বিষাক্ততা পরীক্ষা করার পদ্ধতি সমুহ হলো:

ছাপার সাহায্যে বিষাক্ততা পরীক্ষা: পানির বিষাক্ততা পরীক্ষার জন্য পুকুরে একটি হাপা টাঙিয়ে তার মধ্যে অল্প পরিমাণে যে কোনো রে/চিংড়ির পিএল ছেড়ে ১২ ঘন্টা পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করতে হবে। যদি এ সময়ের মধ্যে অধিকাংশ রেগু/পিএল (৭০% বেঁচে থাকে) মারা না যায়, তবে বুঝতে হবে পানিতে বিষাক্ততা নেই। এ অবস্থায় পুকুরে রেপু/পিএল মজুদ করা যাবে। যদি এ সময়ের মধ্যে পুকুরে বেশি পরিমাণে রেল/পিএল মারা যায় তবে বুঝতে হবে পানিতে বিষাক্ততা আছে। 

        পুকুরে স্থাপিত হাপা                           পানি ভর্তি বালতি

চিত্র-২.১১: পানির বিষাক্ততা পরীক্ষা

বালতিতে পানির বিষাক্ততা পরীক্ষা: যে পুকুরে রেণ/পিএল মজুদ করা হবে তার পানি একটি বালতিতে ১০- ১৫ লিটার) নিয়ে পানির বিষাক্ততা পরীক্ষা করা যেতে পারে। দু'টি বালতির একটিতে রেণু ছাড়া পুকুরের এবং অন্যটিকে টিউবওয়েল বা অন্য একটি ভালো পুকুরের ১০-১৫ লটার পানি দিতে হবে। পুকুর থেকে পানি নেয়ার সময় উপর, মধ্য ও নিচের পানি ভালভাবে মিশ্রিত করে নিতে হবে। বালতি দু'টিতে অল্প কিছু রেণু ছেড়ে ৩-৪ ঘন্টা পর্যবেক্ষণ করতে হবে। দু'টি বালতিতে একই সময়ে সমান সংখ্যক পোনা মারা গেলে বুঝতে হবে বিষাক্ততা নেই। যদি রেণু ছাড়ার পুকুরের পানিযুক্ত বালতিতে অধিকাংশ পোনা/পিএল বেঁচে থাকে তা হলেও বুঝতে হবে পানিতে বিষাক্ততা নেই। পুকুরের পানিতে বিষাক্ততা থাকলে কোনো অবস্থাতেই পুকুরে রেগু/পিএল মজুদ করা উচিত নয়। এক্ষেত্রে যতদিন পর্যন্ত পানির বিষাক্ততা শেষ না হয় ততদিন অপেক্ষা করা উচিত। 

Content added By

চুন প্রয়োগ ও পিএইচ ব্যবস্থাপনা

চুন হলো ক্যালসিয়ামযুক্ত অজৈব যৌগ যা অম্লত্ব হ্রাস বা প্রশমনে, প্রাণীর দৈহিক কাঠামো গঠন ও রোগজীবাণু ধ্বংস করতে সহায়তা করে। চুনের মধ্যে ক্যালসিয়াম ম্যাগনেসিয়ামের ঋনাত্বক আরন থাকে বা পানির অম্লত্বকে নিরপেক্ষ করতে সহায়তা করে।

চুন প্রয়োগের উপকারিতা: পুকুরে চুন প্রয়োগ করলে একসঙ্গে অনেকগুলো উপকার পাওয়া যায়। এর প্রধান প্রধান গুণাবলি নিচে উল্লেখ করা হলো:

ক) চুন চিংড়ি চাষের পরিবেশ অর্থাৎ মাটি ও পানির অম্লত্ব ও ক্ষারত্বকে নিরপেক্ষ করে। পানির পিএইচ চিংড়ি চাষের অনুকূলে রাখতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। পানির পিএইচ ৭.৫-৮.৫ এর মধ্যে থাকলে সেই পুকুরের চিংড়ির বৃদ্ধি ও ফলন ভালো হয়। 

খ) চুন প্রয়োগের ফলে পুকুরের মাটি থেকে বিভিন্ন ধরনের পুষ্টিকারক উপাদানসমূহ তথা খনিজ পদার্থ (যা পানির উর্বরতা বৃদ্ধিতে সহায়ক) অতি সহজেই মুক্ত হয়ে পানিতে মিশে। ফলে পুকুরের স্বাভাবিক উৎপাদন ক্ষমতা বেড়ে যায়, যা চিংড়ির প্রাকৃতিক খাবার তৈরিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।

গ) চিংড়ির জন্য ক্ষতিকর, এমন ধরনের রোগ বিস্তারের উৎস, রোগজীবাণু ও রোগজীবাণু পরিবাহক পরজীবীসমূহকে চুন ধ্বংস করে তথা জীবাণুনাশক হিসেবে কাজ করে।

ঘ) চুন পানিতে বিদ্যমান অতিরিক্ত জৈবকণা ও কাদাকে অধঃক্ষেপ না করে পানিকে পরিষ্কার রাখতে তথা দূর করতে সহায়তা করে। পুকুরে পর্যাপ্ত আলোর অনুপ্রবেশ নিশ্চিত হয়, ফলে সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ বেড়ে যায়।

ঙ) চুন পুকুরের তলদেশে সঞ্চিত দূষিত গ্যাসসমূহ দূর করে।

চ) চুনের ক্যালসিয়াম চিংড়ির দৈহিক বৃদ্ধিতে বিশেষ করে প্রজননকালে ভ্রুণের বর্ধনে ও খোলস গঠনে সহায়তা করে।

ছ) চুন পানিতে প্রয়োগকৃত সারের কার্যকারিতা বৃদ্ধি করে। পানির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে তথা পানিতে প্রাকৃতিক খাদ্য ফাইটোপ্লাংকটন ও জুপ্লাংকটন তৈরি করে পানির বর্ণ সবুজ করতে সহায়তা করে।

জ) চুন প্রয়োগের ফলে জৈব পদার্থসমূহ ভেঙে গিয়ে মাটি ও পানির উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধি করে।

ঝ) প্রয়োজনীয় উপকারী জীবাণুর বংশ বৃদ্ধিতে জৈব পদার্থসমূহের সুষ্ঠু পচনের জন্য চুন সহায়তা করে।

ঞ) সালোকসংশ্লেষণের জন্য পর্যাপ্ত কার্বন-ডাই-অক্সাইড তৈরির মাধ্যমে চুন পানিতে অক্সিজেন স্বল্পতার মাত্রা কমিয়ে আনে। সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়াকে বৃদ্ধির মাধ্যমে চুন পানিতে অক্সিজেনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়।

ট) চুন প্রয়োগের ফলে জৈব পদার্থের পচন ক্রিয়া দ্রুত হয় এবং পুকুরের তলদেশ থেকে ক্ষতিকর কার্বন-ডাই অক্সাইড গ্যাস বের করে দেয়। ফলশ্রুতিতে পুকুরের তলার মাটি নিরপেক্ষ হয়।

ঠ) চুন পুকুরের পানিতে বিদ্যমান অতিরিক্ত ম্যাগনেসিয়াম, সোডিয়াম ও পটাশিয়াম আয়নের ক্ষতিকর প্রক্রিয়াকে বাধা দেয় এবং এদের বিষক্রিয়া নষ্ট করে দেয়। এর ফলে পুকুরের স্বাভাবিক উৎপাদন ক্ষমতা অনেক বেড়ে যায়। 

ড) চুন প্লাংকটনের বৃদ্ধির জন্য কাদায় আবদ্ধ ফসফরাসকে মুক্ত করে দেয়।

ঢ) চুন মাটি ও পানির মধ্যে সালফিউরিক অ্যাসিডের মত অত্যন্ত ক্ষতিকারক পদার্থের স্থায়ী বন্ধ হওয়াকে প্রতিরোধ করে। 

ণ) চুন বাফার (কার্বন-ডাই-অক্সাইড এর সংরক্ষণাগার) হিসেবে কাজ করে অর্থাৎ চুন এর বাফারিং প্রক্রিয়ায় পুকুরের পানির কার্বন-ডাই-অক্সাইড এর সাথে মিশে ক্যালসিয়াম বাইকার্বোনেট তৈরি করে এবং এই ক্যালসিয়াম বাইকার্বোনেট বাফার হিসেবে কাজ করে। এছাড়াও বাইকার্বোনেট পুকুরের পিএইচকে স্থির অবস্থায় রাখতে সহায়তা করে। 

চুনের প্রকারভেদ: বাজারে বিভিন্ন ধরনের চুন পাওয়া যায়, যেমন- পাথুরে চুন, পোড়া চুন, কলিচুন ইত্যাদি। এছাড়াও শামুক ও ঝিনুকের খোলস পুড়িয়ে এক ধরনের চুন পাওয়া যায়। তবে এগুলো চিংড়ি চাষের পুকুরে ব্যবহার করে ভালো ফল পাওয়া যায় না। নিচের সারণিতে চুনের প্রকারভেদ ও উৎস উল্লেখ করা হলো: 

সারণি: চুনের প্রকারভেদ ও উৎস 

ক্রম 

চুনের নাম

উৎস

০১পাথুরে চুন খনিতে প্রাপ্ত, বাজারে পাওয়া যায় না
০২পোড়া চুনখনিতে প্রাপ্ত, পোড়ানোর পর বাজার পাওয়া যায়
০৩কলি চুনপোড়া চুন আর্দ্রতাযুক্ত হয়ে বা পানিতে গোলানোর পর প্রাপ্ত চুন
০৪ডলোমাইট প্রক্রিয়াজাতকৃত যৌগ চুন
০৫ জিপসামপ্রক্রিয়াজাতকৃত যৌগ চুন

প্রয়োগ মাত্রা: পুকুরের তলদেশের মাটির প্রকারভেদ, পুকুরের বয়স, পানির পিএইচ ইত্যাদি বৈশিষ্ট্যের ওপর চুন প্রয়োগের মাত্রা নির্ভর করে। কাদা মাটি, এঁটেল মাটি ও লাল মাটির পুকুরে স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে একটু বেশি চুন প্রয়োজন হয়। পুকুর দীর্ঘদিন আগাছা ও পচা আবর্জনায় পূর্ণ থাকলে স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে চুন বেশি দরকার হয়। সাধারণত শতাংশ প্রতি এক কেজি হারে চুন প্রয়োগ করতে হয়। পোড়া চুনের ক্ষমতা পাথুরে চুনের দ্বিগুণ এবং কলিচুনের ক্ষমতা পাথুরে চুনের দেড় গুণ। নিচে পিএইচ এর ওপর ভিত্তি করে চুন প্রয়োগের মাত্রা দেয়া হলো

পিএইচ মান

৩-৫ এর মধ্যে

৫-৬ এর মধ্যে

৬-৭ এর মধ্যে

পোড়া চুনের পরিমাণ

৬ কেজি/শতাংশ

৪ কেজি/শতাংশ

১-২ কেজি/শতাংশ

প্রয়োগ পদ্ধতি: পুকুর তৈরির সময় প্রয়োজনীয় চুন একটি মাটির চাড়ি বা গামলার মধ্যে কমপক্ষে ১২-২৪ ঘন্টা আগে গুলে নিতে হবে। তারপর প্রয়োজনীয় চুন পাড়সহ সমস্ত পুকুরে সমানভাবে ছিটিয়ে দিতে হবে। চুন ব্যবহারের সময়কাল হলো চাষ দেয়ার ২-৩ দিন পর অথবা বিষ প্রয়োগের ৭-৮ দিন পর 

   শুকনো ঘেরে চুন প্রয়োগ                            পানি ভর্তি ঘেরে চুন প্রয়োগ

চিত্র-২.১২: পুকুরে চুন প্রয়োগ

 

সতর্কতা 

  • পোড়া চুন এবং কলি চুন অত্যন্ত ক্ষারীর তাই এটি ব্যবহারে পিএইচ দ্রুত বেড়ে যায়, এজন্য পুকুর শুকানো অবস্থায় তা ব্যবহার করা নিরাপদ।
  • চুন ব্যবহারের সময় নাক ও মুখ গামছা দিয়ে বেধে নিতে হবে।
  • বাতাসের অনুকূলে চুন ছিটাতে হবে।
  • চুল গুলানোর সময় তাপ সৃষ্টি হয় সেজন্য প্লাস্টিকের বালতিতে চুল গুলানো যাবে না।
  • চুন শিশুদের নাগালের বাইরে রাখতে হবে।
  • ব্যবহারের পর পাত্র ভালোভাবে পরিষ্কার করে রাখতে হবে।


 

পিএইচ (pH) 

পিএইচ হচ্ছে কোনো দ্রবণের হাইড্রোজেন আয়নের ঘনত্বের ঋণাত্মক লগারিদম। সহজ ভাষায় পিএইচ হচ্ছে কোনো বস্তুর অম্লত্ব বা ক্ষারত্বের পরিমাপক। পানির পিএইচ বলতে পানির অম্লত্ব বা ক্ষারত্বের অবস্থা বুঝায়। পিএইচ ০ থেকে ১৪ পর্যন্ত বিস্তৃত। পানির পিএইচ যদি ০-৭ এর মধ্যে থাকে তবে তা অগ্নীয়। এই অম্লীয় পানিতে হাইড্রোজেন আয়নের পরিমাণ বেশি থাকে। আবার পিএইচ যদি ৭-১৪ এর মধ্যে থাকে তবে ভা ক্ষারীয়। এই ক্ষারীয় পানিতে অক্সাইড জায়নের পরিমাণ বেশি থাকে। কিন্তু বিশুদ্ধ পানিতে উপরোক্ত উভয় আয়নের পরিমাপ সমান সমান থাকার ফলে পানির গুণাগুণ নিরপেক্ষ বা প্রশম হয়। অর্থাৎ পিএইচ যদি থাকে তবে ভাদ্বারা নিরপেক্ষ মান নির্দেশিত হয়।

চিংড়ি চাষে পিএইচ-এর প্রভাব: চিংড়ি চাষ ব্যবস্থাপনার সাথে পিএইচ মান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণত চিংড়ি চাষের জন্য মৃদু ক্ষারীয় পানি অর্থাৎ পানির পিএইচ ৭.৫-৮.৫ এর মাঝে হলে সবচেয়ে ভালো। পানির পিএইচ ৪ এর নিচে নেমে গেলে অর্থাৎ পানি খুব বেশি অম্লীয় হয় তাহলে চিংড়ি বাঁচতে পারে না। কারণ তখন পানিতে বিষাক্ত হাইড্রোজেন সালফাইড গ্যাসের পরিমাণ বেড়ে যায়। আবার পানি যদি খুব বেশি ক্ষারীয় হয় অর্থাৎ পিএইচ মান ৯.৫ এর বেশি হয় তাহলে চিংড়ি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে না। কারণ এই অবস্থায় পানিতে পর্যাপ্ত পরিমাণ মুক্ত কার্বন-ডাই-অক্সাইড থাকে না। শুধু তাই নয় এই অবস্থায় পানিতে বিষাক্ত অ্যামোনিয়া গ্যাসের পরিমাণ বেড়ে যায়। এই দুটো অবস্থাই চিংড়ির জন্য ক্ষতিকর। পিএইচ মান ১১ এর উপরে গেলে চিংড়ি মারা যায়। চিংড়ি চাষে ভালো ফল পেতে হলে মাছ চাষিকে অবশ্যই পুকুরের পানির পিএইচ মান সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। পিএইচ মান কাঙ্ক্ষিত মানের চেয়ে কম বেশি হলে সম্ভাব্য কারণসমূহ জেনে সেই অনুযায়ী পদক্ষেপ নিতে হবে। অম্লীয় ও ক্ষারীয় পানির উৎস ও তার প্রভাব নিচে আলোচনা করা হলো:

অম্লীয় পানির উৎসসমূহ হলো-

ক) মাটিতে ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেসিয়ামের অভাব হলে বা জৈব পদার্থ বেশি হলে পানিতে অম্লীয় অবস্থার সৃষ্টি হয়।

খ) উষ্ণ আর্দ্র অঞ্চলে অধিক পরিমাণ বৃষ্টিপাত হলে বৃষ্টির সাথে চুন মাটির অভ্যন্তরে তলিয়ে যায়, ফলে অম্লীয় অবস্থার সৃষ্টি হয়।
গ) বিভিন্ন কলকারখানার আবর্জনা পানিতে পতিত হয়ে পানির অম্লত্ব বাড়াতে সহায়তা করে।

চিংড়ি চাষে অম্লীয় পানির প্রভাব-

ক) পিএইচ মান ৫ এর নিচে থাকলে অভিস্রবণের মাধ্যমে চিংড়ি দেহের রক্ত থেকে সোডিয়াম ক্লোরাইড আয়নসমূহ বের হয়ে যায়। চিংড়ি পর্যায়ক্রমে সোডিয়াম ও ক্লোরাইড আয়ন হারানোর ফলে রক্তের গঠন ঠিক রাখতে না পেরে দুর্বল হয়ে পরিশেষে মারা যায়। পানিতে ক্যালসিয়াম কম থাকলে এ ক্ষতি আরও মারাত্মক আকার ধারণ করে।

খ) শরীর থেকে প্রচুর বিজল বা মিউকাস বের হয় এবং চিংড়ি ধীরে ধীরে তার কর্মক্ষমতা, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, খাদ্য গ্রহণ ও খাদ্য পরিবর্তন করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। ফলে চিংড়ি মারা যায়।

গ) চিংড়ির রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায় ও অনেক সময় খাবারের রুচি হারিয়ে ফেলে।

ঘ) চিংড়ি আঘাতপ্রাপ্ত হলে সহজে ঘা সারে না।

ঙ) পানিতে অম্লত্বের পরিমাণ বেশি হলে চিংড়ির প্রজনন অঙ্গের বৃদ্ধি অসম পর্যায়ের হয়ে থাকে, যা ডিম পরিস্ফুটন বা পোনা উৎপাদনে বাধার সৃষ্টি করে।

চ) পুকুরের পানিতে সহজে চিংড়ির প্রাকৃতিক খাদ্য তৈরি হতে পারে না।

ছ) পানিতে অক্সিজেন থাকা সত্বেও চিংড়ি তা গ্রহণ করতে পারে না ফলে চিংড়ি পানির উপর ভেসে উঠে ও পরিশেষে মারা যায়।

ক্ষারীয় পানির উৎসসমূহ হলো-

ক) ক্যালসিয়াম ও সিলিকা সমৃদ্ধ মাটি।

খ) পুকুরের পানি ঘন সবুজ হলে অত্যাধিক সালোকসংশ্লেষণের জন্য দিনের বেলায় পানির পিএইচ মান সামান্য বেড়ে যায়। ফলে পানি ক্ষারীয় হতে পারে।

চিংড়ি চাষে ক্ষারীয় পানির প্রভাব-

ক) পানির পিএইচ মান ১১ এর বেশি হলে চিংড়ির মৃত্যু পর্যন্ত ঘটে থাকে।

খ) পিএইচ মান বেড়ে গেলে চিংড়ির চোখের লেন্স এবং কর্ণিয়া নষ্ট হয়ে যায়, পুকুরে প্রাকৃতিক খাদ্য উৎপাদন হ্রাস পায়, অসমোরেগুলেশান ক্ষমতা হ্রাস পায়, ফলে চিংড়ি দুর্বল হয়ে মারা যায়। চিংড়ির রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ও খাবারে রুচি কমে যায়। অনেক সময় চিংড়ি প্রজনন ক্ষমতাও কমে যায়।

পানির পিএইচ মান পরীক্ষাকরণ:  পানি অম্লীয় না ক্ষারীয় তথা পানির পিএইচ মান কত তা পরীক্ষা করার জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি আছে। নিচে কিছু পদ্ধতি আলোচনা করা হলো।

ক) লিটমাস কাগজ: লিটমাস কাগজ পানিতে ডুবানোর পর কাগজের রং যদি লাল হয়ে যায়, তবে তা অম্লীয় পানি এবং যদি নীল হয়ে যায় বা লিটমাস কাগজের রঙের কোনো পরিবর্তন না হয় তবে তা ক্ষারীয় পানি।

(খ) ডিজিটাল পিএইচ মিটার: আধুনিক পদ্ধতিতে ডিজিটাল পিএইচ মিটারের সাহায্যে অত্যন্ত নির্ভুলভাবে পানির পিএইচ পরিমাণ নির্ণয় করা যায়।

গ) পিএইচ পেপার: পিএইচ পেপার একটি গোলাকার চাকতির ভিতর পেচানো থাকে। পেচানো অংশ থেকে এক টুকরো (১ ইঞ্চি পরিমাণ) কাগজ নিয়ে ৩০ সেকেন্ড পানিতে ডুবিয়ে রাখার পর পানি থেকে উঠালে কাগজের রং পরিবর্তিত হবে। রং বদলানো কাগজটিকে চাকতির গায়ে আঁকা বিভিন্ন রংয়ের সাথে মিলিয়ে দেখলেই ঐ পানির পিএইচ বুঝা যাবে অর্থাৎ পানিতে ডুবানোর পর ঐ কাগজের পরিবর্তনকৃত রং চাকতির গায়ে আঁকা যে রঙের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ মনে হবে সেখানে লিপিবন্ধ পিএইচ মানই হবে ঐ পানির পিএইচ মান। পানির পিএইচ মান দেখে পুকুরের জন্য কোন ধরনের চুন লাগবে তা নির্ধারণ করা যায়।

মাটির পিএইচ পরীক্ষা পদ্ধতি

কোন পুকুরের তলা থেকে এক মুঠ (প্রায় ২০ গ্রাম) মাটি নিয়ে খুব ভালোভাবে শুকিয়ে গুঁড়া করে পাউডার বানাতে হবে। এই পাউডারের দ্বিগুণ পরিমাণ পরিষ্কার ফোটানো ঠাণ্ডা পানিতে মিশিয়ে খুব ভালোভাবে নেয়ে কমপক্ষে ২৪ ঘণ্টা রেখে দিতে হবে। পরদিন সকালে পিএইচ কাগজ দিয়ে থিতানো পানির পিএইচ পরীক্ষা করতে হবে। প্রাপ্ত পিএইচ হবে পরীক্ষিত পুকুরের মাটির পিএইচ।

পিএইচ কমে গেলে বা পানি অগ্নীয় হলে করণীয় :
যে কোন কারণে পুকুরের পানির পিএইচ কমে যেতে পারে। যদি কোনো কারণে পিএইচ মান কমে যায় তাহলে জাতীয় পানিতে শতাংশ প্রতি ১ কেজি পোড়া ফুল প্রয়োগ করতে হবে। চুলের পরিমাণ নগ্নতা বা পানির পিএইচ এর উপর নির্ভরশীল।

পিএইচ বেড়ে গেলে বা পানি ক্ষারীয় হলে করণীয় : অপ্রত্যাশিতভাবে পানির পিএইচ বেড়ে গেলে পিএইচ কমানোর নির্মিত কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে, যেমন প্রাথমিকভাবে তেঁতুল গোলানো পানি বা তেঁতুল/সজনের পাতা ভেজানো পানি দিতে হবে। তবে শতাংশ প্রতি ১৫০ গ্রাম ইউরিয়া প্রয়োগ করে এ সমস্যার সমাধান করা যায়।

ক্ষারত্ব ও খরতা

ক্ষারত্ব ও খরতা হলো পানিতে অবস্থিত বিভিন্ন ধরনের আয়নের পরিমাপক।

ক্ষারত্ব: সাধারণত ক্ষারত্ব হলো কার্বোনেট, বাইকার্বোনেট ও হাইড্রোক্সিল আয়নের পরিমাপক। পুকুরে এর মাত্রা ২০ মিগ্রা/ লিটার এর নিচে থাকা বাঞ্ছনীয়।

খরতা: সাধারণত খরতা হলো ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেসিয়াম আয়নের পরিমাপক। যা প্রকাশ করা হয় ক্যালসিয়াম কার্বোনেট দিয়ে। মোট খরতার পরিমাণ মোট ক্ষারত্বের সাথে সম্পর্কিত। পানির খরতা ২০ মিগ্রা/লিটার এর কম হলে পানির বাফার ক্রিয়া নষ্ট হয়ে যায় এবং চিংড়ির জন্য তা বিশেষভাবে ক্ষতিকর। সাধারণভাবে বলা যায় যে, ভালো জলাশয়ের খরতা ৪০-২০০ মিগ্রা/লিটার এর মধ্যে হওয়া উচিত।

চিংড়ি চাষের ক্ষেত্রে ক্ষারত্ব ও খরতার প্রভাব: চিংড়ি চাষের জন্য হালকা খর পানি সবচেয়ে ভালো। ক্ষারত্ব ও খরতার মান ২০ মিগ্রা/লিটার এর কম ও ৩০০ মিগ্রা/লিটার এর বেশি হলে পানির বাফারিং ক্ষমতা কমে যায়। ফলে পানির পিএইচ দ্রুত উঠানামা করে। পুকুরে সার দিলে তা কার্যকর হয় না। ক্ষারত্ব ৩০০ মিগ্রা/লিটার এর বেশি হলে পুকুরের প্রাথমিক উৎপাদনশীলতা (ফাইটোপ্লাংকটন) হ্রাস পায়। কারণ তখন সালোকসংশ্লেষণের জন্য প্রয়োজনীয় পরিমাণ মুক্ত কার্বন-ডাই-অক্সাইড থাকে না। চিংড়ি সহজেই অম্লতা ও অন্যান্য ধাতুর বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়।

হার্ডনেস: হার্ডনেস-এর দ্বারা পানিতে দ্রবীভূত ম্যাগনেসিয়াম ও ক্যালসিয়াম লবণসমূহের মাত্রা বুঝায়। হার্ডনেস মাছ/চিংড়ি চাষের ক্ষেত্রে ব্যাপক ভূমিকা পালন করে থাকে।

Content added By

পুকুরে সার প্রয়োগ

পুকুরে প্রাকৃতিক খাবার জন্মানোর জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে নাইট্রোজেন, ফসফরাস ও পটাসিয়ামের দরকার হয়। তাছাড়াও ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, সালফার, কপার, জিংক প্রভৃতি যৌগের দরকার হয়। পুকুরে যে চুন দেয়া হয় তা ক্যালসিয়ামের উৎস হিসেবে কাজ করে। আমাদের দেশের পুকুরের মাটিতে নাইট্রোজেন ও ফসফরাস ব্যতীত বাকি মৌলগুলো চিংড়ির প্রাকৃতিক খাবার জন্মানোর জন্য মোটামুটি যথেষ্ট পরিমাণে থাকে। তাই পুকুরে মাছের প্রাকৃতিক খাবার পর্যাপ্ত পরিমাণে তৈরির জন্য বাইরে থেকে কেবল নাইট্রোজেন ও ফসফরাস সরবরাহ করলেই চলে।

বাগদা চিংড়ির খামারে কাঁটা শেওলা উৎপাদনের মাধ্যমে চিংড়ি চাষ করা হলে সার প্রয়োগের প্রয়োজন হয় না। খামারে একবারে পানির গভীরতা অধিক বৃদ্ধি করা ঠিক নয়, কারণ সূর্যালোকের অনুপস্থিতির কারণে শেওলা উৎপাদন কার্যক্রম বাধাগ্রস্থ হয়। এক্ষেত্রে প্রথম পর্যায়ে ১ ফুট পানি প্রবেশ করিয়ে ১০-১৫ দিন কোন কার্যক্রম ছাড়াই ফেলে রাখতে হবে, অতঃপর প্রয়োজনীয় পরিমাণ পানি প্রবেশ করাতে হবে। কাঁটা শেওলার উপর নির্ভর না করে খাদ্য এবং সার প্রয়োগের মাধ্যমে উন্নততর পদ্ধতি অনুসরণ করা হলে নিম্নলিখিত হারে রোটেনন প্রয়োগের ৩-৫ দিন পর পুকুর/খামারে সার প্রয়োগ করতে হবে:

  •  ইউরিয়া : ২০-২৫ কেজি/হেক্টর (প্রতি শতাংশে ৮০-১০০ গ্রাম)
  • টিএসপি : ২০-২৫ কেজি/হেক্টর (প্রতি শতাংশে ৮০-১০০ গ্রাম)
  • খৈল : ৩০-৪৫ কেজি/হেক্টর (প্রতি শতাংশে ১৫০-২০০ গ্রাম)

সার প্রয়োগে বিবেচ্য বিষয়সমূহ হলো

ক) কী পরিমাণ সার পুকুরে প্রয়োগ করতে হবে তা নির্ভর করে মাটির গুণাগুণ ও উর্বরতা শক্তির ওপর।

 খ) সাধারণত বেলে মাটিতে যেখানে পুষ্টি উপাদানের পরিমাণ কম থাকে সেখানে সারের পরিমাণ একটু বেশি দিতে হয়। আবার পলি মাটিতে যেখানে পুষ্টি উপাদানের পরিমাণ বেশি থাকে সেখানে পরিমাণ একটু কম দিতে হবে।

গ) জৈব সারের ব্যবহার পরিহার করতে হবে। 

ঘ) অজৈব সার শুষ্ক পুকুরে দেয়া যাবে না।

ঙ) অজৈব সার চিংড়ি ছাড়ার ৪/৫ দিন পূর্বে পরিমিত পরিমাণে দিতে হবে। 

চ) সার বৃষ্টির দিনে না দিয়ে রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে দিলে ভালো ফল পাওয়া যায়।

Content added By

পোনা মজুদ ব্যবস্থাপনা

পোনা মজুদ ব্যবস্থাপনার ত্রুটির কারণে খামারে পোনা ছাড়ার পর পরই ব্যাপকভাবে পোনা মারা যায়। সাধারণত পোনা মজুদ ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে সম্যক জ্ঞানের অভাবেই এ ধরনের সমস্যার সৃষ্টি হয়। আমাদের দেশে প্রাকৃতিক উৎস থেকে চিংড়ির পোনা সংগ্রহ করা হয় এবং দুর-দুরান্ত থেকে এসব পোনা পরিবহণ করে এনে খামারে মজুদ করা হয়। ফলে পরিবেশের পরিবর্তন ক্লেশ, পোনার ক্লেশ ও খামারে পানিতে খাপ খাওয়ানো বা অভ্যস্তকরণ ঠিকমত না হওয়ার ফলে পোনা মারা যায়। তাই পোনা মজুদ ব্যবস্থাপনার মূল বিষয়গুলোর প্রতি যথাযথ গুরুত্ব দিলে মজুদকালে পোনার মৃত্যুহার যথেষ্ট পরিমাণে কমানো সম্ভব। মজুদ ব্যবস্থাপনার মুল বিষয়গুলো হলো-

ক. পোনা শনাক্তকরণ

বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চল, সাগর এলাকা, নদ-নদী ও খাল বিলে বিভিন্ন প্রকার চিংড়ি পোনার উৎসস্থল। চাষের জন্য বিশেষ করে লোনাপানির বাগদা চিংড়ির পোনা এবং মিঠাপানির গলদা চিংড়ির পোনা প্রাকৃতিক উৎস নির্ভর। প্রাকৃতিক উৎস থেকেই মুলত এসব চিংড়ির পোনা সংগ্রহ করা হয়। প্রাকৃতিক উৎস থেকে এসব পোনা সংগ্রহের সময় অন্যান্য বিভিন্ন প্রজাতির পোনা ধরা পড়ে। বিভিন্ন প্রজাতির চিংড়ির পোনা থেকে বাগদা ও গলদা চিংড়ির পোনা শনাক্ত করে আলাদাভাবে সংগ্রহ করা হয়। এজন্য বিভিন্ন প্রজাতির চিংড়ি পোনার শনাক্তকরণ বৈশিষ্ট্যের ওপর সম্যক জ্ঞান থাকা দরকার। নিম্নে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ চিংড়ি পোনার শনাক্তকরণ বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করা হলো:

১. বাগদা চিংড়ি: বাগদা চিংড়ির পোষ্ট লাভা বা পিএল অন্যান্য চিংড়ির পোস্ট লার্ভার চেয়ে আকারে বড় হয়। দেহের গঠন সরু ও লম্বাটে হয়ে থাকে। চক্ষু তুলনামুলকভাবে বড়। পিএল এর দেহের দৈর্ঘ্য বরাবর লেজ পর্যন্ত বাদামি রঙের দাগ দেখা যায়। জুভেনাইল অবস্থায় এই দাগ সবুজ বর্ণ ধারণ করে এবং পেটের দিকে তখন এটি একটি কাঠির মত দেখায়। খড়গ বা শুড় সোজা এবং ডগাটি সামান্য উপর দিকে বাঁকানো থাকে। খড়গের উপর তলে ৫টি দাঁত দেখা যায়। ১ম তিন জোড়া পায়ের শেষ প্রান্তে ছোট চিমটা আছে। ২য় পা ১ম পায়ের চেয়ে সামান্য লম্বা এবং ৩য় পায়ের চাইতে ছোট বা সমান ।

২. ঢাকা চিংড়ি: এই চিংড়ির পোনা বাগদা চিংড়ির পোনার চেয়ে আকারে অনেক ছোট। এদের দেহের রং স্বচ্ছ সাদা এবং রোস্টামের অগ্রভাগ গোলাপী রঙের হয়ে থাকে। পুচ্ছ পাখনা ও টেলসনে অস্পষ্ট লালচে বাদামি দাগ দেখা যায়। চক্ষু দন্ড হালকা হলুদ বর্ণের এবং পঞ্চম ও ষষ্ঠ উদর খন্ডে মধ্যবর্তী পৃষ্ঠ কাঁটা থাকে। রোষ্ট্রামের উপরিভাগে ১টি মাত্র দাঁত দেখা যায় এবং এই রোস্টাম চক্ষু ছাড়িয়ে সম্মুখের দিকে প্রসারিত। এরা পাত্রের গা ঘেসে দ্রুত সাঁতার কাটে এবং নড়াচড়া অনুভব করলে লাফাতে চেষ্টা করে, সাধারণত এরা সাঁতারের সময়ে ধড়ের মাঝামাঝি সামান্য উঁচু করে সাঁতার কাটে।

৩. বাগতারা চিংড়ি: এই পোনা দেখতে অনেকটা বাগদা চিংড়ির পোনার মত, তবে তুলনামূলকভাবে বাগদা পোনার চেয়ে আকারে ছোট। রোস্ট্রামের উপরিভাগে ৪-৫টি দাঁত আছে। পোনার উদরের তলদেশে ৪-৫টি লালচে বাদামি রঙের ফোঁটা ফোঁটা দাগ থাকে। ষষ্ঠ উদর খন্ডকের পিঠের দিকে একটি কাঁটা থাকে। এদের তলপেটে পিছন দিকে ইংরেজি 'এম' অক্ষরের মত নীলাভ কালো দাগ দেখা যায়।

৪. হন্নি চিংড়ি: এরা দেখতে অনেকটা হরিণা চিংড়ির মত এবং দেহের রং অনেকটা বাদামি বা খয়েরি রঙের। শুঙ্গের বৃত্তে লালছে ধরনের রঞ্জন কণা থাকে। এদের রোস্ট্রাম ক্রিকোণাকৃতির এবং এর উপরিভাগে ৪-৭টি দাঁত থাকে। চক্ষু বৃত্তের মাঝামাঝি পর্যন্ত বিস্তৃত। উদর খন্ডকের পাশের নিচের দিকে লাল ইটের মত ডোরা এবং ইউরোপড ও লেজে দাগ থাকে।

৫. কেরাণী চিংড়ি: এদের রোস্টাম ছোট, অগ্রভাগ তীক্ষ্ণ ও ক্রিকোণাকৃতির। রোহামের উপরিভাগে ৩-৪টি দাঁত থাকে তবে নিচের দিকে কোনো দাঁত থাকে না। ক্যারোপেসে ২-৩টি এপিগ্যাস্ট্রিক কাঁটা থাকে। ইউরোপডের ডানায় একটি বাদামি ফোঁটা দাগ থাকে। এদের শরীরে এ্যান্টিনাল ও হেপাটিক কাঁটা দেখা যায়। এন্টিনিউলার পেডাংকেলের অগ্রভাগ রঙিন এবং এদের লেজে ছোপ ছোপ দাগ থাকে।

৬. গলদা চিংড়ি: গলদা চিংড়ির পিএল দেখতে স্বচ্ছ এবং পিএল এর মাথার খোলস এর উপর ২-৫টি লম্বালম্বি কাল বর্ণের বন্ধন থাকে। ক্রমান্বয়ে গলদা বড় হতে থাকলে উক্ত বন্ধন বিলুপ্ত হয়ে পেটের প্রতিটি খন্ডের সংযোগস্থলে বলয় দেখা যায়। পিএল পর্যায়ের বয়স ৩০-৩৫ দিন এবং দৈর্ঘ্য ১-১.৫ সেমি হয়। গলদা চিংড়ির রোস্ট্রাম বাঁকানো এবং উপরে নিচে খাঁজ কাটা থাকে। পাগুলো বেশ লম্বা হয় এবং ১ম ও ২য় জোড়া পা চিমটাযুক্ত।

৭. ছটকা চিংড়ি: এদের শিরোবক্ষ অংশে লম্বালম্বি অস্পষ্ট দাগ থাকে। উদর অঞ্চলের পার্শ্বীয় অংশে ক্ষুদ্র বিন্দুর সমন্বয়ে গঠিত দাগ পরিলক্ষিত হয়। এই দাগগুলো সারিবদ্ধ ও নিয়মিতভাবে বিন্যস্ত। এই চিংড়ির পোনার রোস্ট্রামটির দৈর্ঘ্য অপেক্ষকৃত ছোট।

খ. পোনার উৎস ও সংগ্রহ পদ্ধতি

দু'টি উৎস থেকে বাগদা চিংড়ির পোনা সংগ্রহ করা যেতে পারে। উৎস দু'টি হচ্ছে- প্রাকৃতিক উৎস ও হ্যাচারি বা কৃত্রিম প্রজনন কেন্দ্র।

প্রাকৃতিক উৎস: সাধারণত 'জো' বা 'গোণ' কালীন বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে প্রচুর পরিমাণে বাগদা চিংড়ির পোনা পাওয়া যায়। ডিসেম্বর-এপ্রিল মাসের মধ্যে অমাবশ্যা ও পূর্ণিমার ২য় থেকে ৫ম দিনের জোয়ার-ভাটার সময় পানির ওঠা-নামা সবচেয়ে বেশি হয়ে থাকে। এই জোয়ার-ভাটায় পানির সর্বোচ্চ ওঠা- নামাকে খুলনা অঞ্চলে গোণ এবং কক্সবাজার অঞ্চলে জো (tidal fluctuation) বলা হয়। এই জোয়ার আরম্ভ হওয়ার পর ৩য়, ৪র্থ ও ৫ম ঘন্টাই পোনা আহরণের সবচেয়ে বেশি উপযুক্ত সময়। বাংলাদেশের কক্সবাজার, খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, পটুয়াখালী ও ভোলা জেলার বিভিন্ন এলাকায় প্রচুর পরিমাণে বাগদার পোনা পাওয়া যায়। বাংলাদেশের কিছু কিছু এলাকায় সারা বছরই বাগদার পোনা পাওয়া যায়। তবে ফেব্রুয়ারি থেকে মধ্য এপ্রিল পর্যন্ত সময়ে সবচেয়ে বেশি পোনা ধরা পড়ে। তবে প্রাকৃতিক উৎস থেকে পোনা সংগ্রহ করে চাষের ক্ষেত্রে উদ্ভূত অসুবিধাসমূহ হলো :

১) প্রাকৃতিক উৎসের পোনার সাথে অন্যান্য চিংড়ির পোনা ও রাক্ষুসে মাছের পোনা থাকে।

২) একই বয়সের ও একই আকারের পানা পাওয়া যায় না।

৩) সময়মত পর্যাপ্ত পরিমাণে পোনা পাওয়া যায় না।

৪) আহরণ ও পরিবহণজনিত পীড়নের ফলে অনেক সময় পোনা মারা যায়।

৫) পোনা শনাক্তকরণ, গণনা ও পরিবহণের সময় অসতর্কতার ফলে অনেক পোনার অঙ্গহানি হয়ে থাকে এবং এর ফলে এসব অসুস্থ পোনা থেকে কাঙ্ক্ষিত উৎপাদন পাওয়া যায় না।

৬) অত্যন্ত দুর্গম এলাকায় এই পোনা আহরণ করা হয়ে থাকে, ফলে এসব পোনা সংগ্রহ করা বেশ কষ্টসাধ্য ও ঝুঁকিপূর্ণ।

৭) নির্বিচারে চিংড়ি পোনা আহরণের ফলে উপকূলীয় নদীসমূহের জীববৈচিত্র্য ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

প্রাকৃতিক উৎস থেকে পোনা আহরণ ও গণনা: প্রাকৃতিক উৎস থেকে বিভিন্ন পদ্ধতিতে চিংড়ি পোনা আহরণ করা হয় এবং আহরণ পদ্ধতিতে বিভিন্ন ধরনের জাল ব্যবহার করা হয়। সাধারণত উপকুলীয় এলাকায় বেহুন্দী জাল, ছাঁকনি জাল, ঠেলা জাল ও টানা জাল দ্বারা চিংড়ির পোনা ধরা হয়। বাগদা চিংড়ির পোনা আহরণের সময় পোনার মৃত্যুহার ও পোনার পীড়ন যাতে কম হয় এবং অন্যান্য চিংড়ি ও মাছের পোনার মৃত্যুহার কমানো তথা উপকূলীয় নদীসমূহের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার জন্য কতকগুলো বিষয়ের ওপর লক্ষ্য রাখা দরকার। পোনা ধরার সময় লক্ষ্যণীয় বিষয়সমূহ হলো-

ক) পোনা ধরার জাল থেকে নির্দিষ্ট সময় পরপর পোনা সরিয়ে ফেলতে হবে।

খ) পোনা শনাক্তকরণ ও বাছাই এর কমপক্ষে ১ ঘন্টা পর পোনা গণনা করা উচিত যাতে পোনা পাত্রের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারে।

গ) পোনা মজুদের পাত্র ঠান্ডা ও ছায়াযুক্ত স্থানে সযত্নে রাখতে হবে এবং পাত্রের মুখ ঢাকনা দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে কারণ অন্ধকারময় পরিবেশ পোনার জন্য কম পীড়াদায়ক।

ঘ) পোনা মজুদ পাত্রের পানি ঘন ঘন বদলানো এবং বেশি ঘনত্বে পোনা রাখা ঠিক নয়।

ঙ) আহরিত পোনা থেকে বাগদা পোনা আলাদা করে অন্যান্য মাছ ও চিংড়ির পোনা যত্ন সহকারে পানিতে ছেড়ে দিতে হবে।

 সাধারণত প্রাকৃতিক উৎসের পোনা ঝিনুক দিয়ে একটি একটি করে গণনা করা হয়। এতে পোনা গণনা করতে বেশি সময় লাগে এবং অধিক পীড়ন পড়ে। ফলে পোনা পরিবহণকালে নানা ধরনের সমস্যার সৃষ্টি হয় এবং মৃত্যুহার বেশি হয়। অল্প সময়ে বেশি পোনা গণনার জন্য নিম্নোক্ত পদ্ধতি অবলম্বন করা যায়:

ক) ৩০০ অথবা ৫০০ লিটারের গোলাকার ট্যাংকে নির্দিষ্ট পরিমাণ পানি দ্বারা পূর্ণ করে তাতে গণনার জন্য প্রয়োজনীয় পোনা ছাড়তে হবে।

খ) তারপর ট্যাংকের পানি প্যাডেল দ্বারা ওপর নিচে ঘুরাতে হবে।

গ) দ্রুত ১ লিটার পানি নিয়ে তাতে কতটা পোনা আছে তা ভালোভাবে গণনা করতে হবে। এভাবে কয়েকবার এক লিটার করে পানি দিয়ে পোনা গণনা করতে হবে এবং গড়ে এক লিটার পানিতে কি পরিমাণ পোনা আছে তা হিসাব করে বের করে নিতে হবে।

এছাড়া আমাদের দেশে বিশেষ করে কক্সবাজার এলাকায় বেশ কিছু সংখ্যক বাগদার পোনার নার্সারি গড়ে উঠেছে। এসব নার্সারিতে প্রাকৃতিক উৎস থেকে আহরিত পোনা সংগ্রহ করে মজুদ করা হয় এবং ৩-৪ দিন নার্সারিতে বিশেষ যত্নে বা ব্যবস্থাধীনে রাখা হয়। তারপর এসব পোনা বিক্রি করে দেওয়া হয়।

সারণি: প্রাকৃতিক উৎস থেকে সংগৃহীত বাগদা চিংড়ির ভালো ও খারাপ পিএল-এর বৈশিষ্ট্য

ক্রম 

পর্যবেক্ষণ বিষয়

ভালো পিএল

খারাপ পিএল

০১দেহের রংহালকা বাদামি বা স্বচ্ছ লালচে বা নীল
০২খোলসপরিষ্কারনোংরা
০৩আচরণ (সমপরিমাণ লবণাক্ত ও মিঠাপানির মিশ্রণে) ৩০-৪৫ মিনিট বেঁচে থাকেমারা যাবে
০৪আচরণ (গোলাকার পাত্রে স্রোত সৃষ্টি করলে) স্রোতের বিপরীতে সাঁতার কাটেপাত্রের মাঝখানে জমা হয়

হ্যাচারি বা কৃত্রিম প্রজনন কেন্দ্র: আধুনিক পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষের পূর্বশর্ত হচ্ছে সময়মত পর্যাপ্ত পরিমাণে নির্ভেজাল পোনার প্রাপ্তি। সময়মত উন্নতমানের পোনা কেবল কৃত্রিম প্রজনন কেন্দ্র থেকেই পাওয়া সম্ভব। কিন্তু আমাদের দেশে হ্যাচারিতে বাপদার পোনা উৎপাদনের পরিমাণ বৃদ্ধি পেলেও চাষি পর্যায়ে গুণগত মানসম্পন্ন পোনার পর্যাপ্ততা এখনও চাহিদার তুলনায় একেবারেই নগণ্য। হ্যাচারিতে উৎপাদিত পোনা চাষের ক্ষেত্রে সুবিধাসমূহ নিম্নরূপ-

ক) সময়মত ও চাহিদামত পর্যাপ্ত পরিমাণে পোনা পাওয়া যায়।

খ) একই আকারের ও বয়সের পোনা পাওয়া যায়।

গ) সুস্থ-সবল পোনা পাওয়া যায়।

ঘ) নির্ভেজাল বাগদার পোনা পাওয়া যায়।

ঙ) এতে অন্য কোনো চিংড়ি বা রাক্ষুসে মাছের পোনা থাকে না।

চ) হ্যাচারি থেকে সহজেই পোনা অন্যত্র পরিবহণ করা যায়।

ছ) বাগদার পোনা শনাক্তকরণে কোনো সমস্যা হয় না।

উন্নত মানের পিএল শনাক্তকরণঃ হ্যাচারিতে উৎপাদিত পিএল প্রাপ্তির উৎস প্রধানত দু'টি-

১. প্রাকৃতিক উৎসের মাদার চিংড়ি থেকে হ্যাচারিতে উৎপাদিত পিএল; এবং

২. নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে প্রতিপালিত মাদার চিংড়ি থেকে হ্যাচারিতে উৎপাদিত পিএল।

তবে উন্নতমানের পিএল নির্বাচনের জন্য নিম্নোক্ত বিষয়সমূহ বিবেচনায় রাখতে হবে-

১. পিএল-এর বয়স: পিএল-এর বয়স কমপক্ষে ১৪/১৫ দিন না হলে এদেরকে খামারের উন্মুক্ত পরিবেশে খাতস্থ হওয়ার জন্য উপযুক্ত বলে বিবেচনা করা হয়না। পিএল-এর বয়স ১৪/১৫ দিন হলে এর ন্যূনতম দৈর্ঘ্য ১৩/১৪ মিলিমিটার এবং রোম্মামের উর্ধাংশে ৫-৭ টি দাঁতের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়।

চিত্র-২.১৪: বাগদা চিংড়ির ভালো ও খারাপ পিএল

২. পিএল-এর বর্ণ: বাদামী, খয়েরি, সবুজাভ বা কালচে সবুজাভ বর্ণের ঈবনহু শরীরের পিএল উৎকৃষ্ট মানের বলে বিবেচনা করা হয়। তবে লাল, নীল বা কালো বর্ণের পিএল অসুস্থ পরিবেশে প্রতিপালিত হওয়ার ইঙ্গিত বহন করে।

চিত্র-২.১৫ : ৰাগদা চিংড়ির পিএল-এর বর্ণ

৩. আলোর প্রতি আকর্ষণ: আলোর প্রতি সহজাত আকর্ষণ প্রবণতা (photo-taxis) পর্যবেক্ষণ করতে হবে। পিএল-এর প্রতিটি পর্যায়ে আলোর প্রতি আকর্ষণের সহজাত প্রবণতা দেখা যায়। এ প্রবণতা নগ্নি পর্যায়ে সর্বাধিক, জুইয়া ও মাইসিস পর্যায়ে কিছুটা কম এবং পিএল পর্যায়ে আরো কম থাকে।

৪. পিএল-এর নড়াচড়া: পোনার স্বাভাবিক নড়াচড়া, সাঁতার কাটা, চঞ্চলতা, ছটফটে ভাব ও চলাফেরা করার প্রবণতা (movement) পর্যবেক্ষণ করতে হবে।

৫. পিএল-এর আকৃতি: খামারে ছাড়ার উপযোগী পিএল ১৪ বা ১৫-এর আকৃতি কমপক্ষে ১৩-১৪ মিলিমিটার হওয়া উচিৎ। এর চেয়ে ছোট আকারের পোনা খামারে ছাড়ার জন্য বাছাই করা ঠিক নয়।

৬. পিএল-এর আকৃতির সমতা: একই মজুদে বিভিন্ন আকৃতির পোনা থাকলে এদের মধ্যে স্বজাতি ভক্ষণের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। ভালো ফলনের জন্য খামারে সম-আকৃতির পোনা মজুদের কোন বিকল্প নেই। হ্যাচারিতে একই ট্যাংকের পোনা সর্বদা সম-আকৃতি সম্পন্ন হওয়া সমীচীন।

৭. পিএল-এর বিভিন্ন শারিরিক বৈশিষ্ট্য:

  • সুস্থ-সবল পিএল-এর শরীরে বা উপাঙ্গসমূহে কোন প্রকার দাগ, ক্ষতচিহ্ন বা আঘাতের চিহ্ন থাকে না এবং কোন উপাঙ্গ অসম্পূর্ণ বা ছেঁড়া থাকেনা। সুস্থ-সবল পিএল-এর এন্টিনিউল সোজা সম্মুখদিকে বিস্তৃত থাকে এবং পুচ্ছ পাখনা সুন্দরভাবে ছড়ানো থাকে। সুস্থ সবল পিএল-এর শরীর স্বচ্ছ, মসৃণ ও পরিষ্কার থাকে।
  •  অসুস্থ দুর্বল পিএল-এর শরীরে বা উপাঙ্গসমূহে বিভিন্ন ধরনের দাগ থাকতে পারে, ক্ষতচিহ্ন বা আঘাতের চিহ্ন থাকতে পারে এবং কোন কোন উপাঙ্গ অসম্পূর্ণ বা ছেঁড়া থাকতে পারে।

গ. পোনা বা পিএল পরিবহণ পদ্ধতি
আমাদের দেশে বর্তমানে আধুনিক পদ্ধতিতে পলিথিন ব্যাগে চিংড়ির পিএল এবং ড্রাম বা অ্যালুমিনিয়ামের হাড়িতে চিংড়ির জুভেনাইল পরিবহণ করা হয়ে থাকে। কখনও কখনও স্বল্প দূরত্বে হাড়িতে করে রেণু বা পিএল আবার পলিথিন ব্যাগে জুভেনাইল ও ধানী বা চারা পোনা পরিবহণ করতে দেখা যায়। তবে সব সময়ই আধুনিক পদ্ধতিতে পিএল ও জুভেনাইল পরিবহণ অধিক নিরাপদ। পোনা পরিবহণের প্রচলিত নিয়মসমূহ নিচে বর্ণনা করা হলো:

সনাতন পদ্ধতি

ক) সাধারণভাবে হাড়ি বা ব্যারেলের ৩ ভাগের ২ ভাগ টিউবওয়েলের পানি নিয়ে তাতে পুকুরের কিছু পরিষ্কার পানি মেশাতে হবে।

খ) নদী বা খাল পথে পোনা পরিবহণের সুযোগ থাকলে নৌকায় পোনা পরিবহণ করা যায়।

গ) পোনা বা জুভেনাইল ভর্তি করে পাত্রের মুখ যন ফ্রঁসের জাল দিয়ে ঢেকে দিতে হবে।

 ঘ) পরিবহণকালে প্রতি ২-৩ ঘন্টা অন্তর পাত্রের ২/৩ ভাগ পানি পরিবর্তন করলে ভালো হয়।
ঙ) পরিবহণের সময় হাত দিয়ে ব্যারেলের পানি ঝাঁকাতে হবে। 

চ) হাড়িতে পোনা পরিবহণের সময় মাঝে মধ্যে হাত নিয়ে পানি বাঁকাতে/ আন্দোলিত করতে হবে।

আধুনিক পদ্ধতি

ক) পরিবহণের কমপক্ষে ২ ঘন্টা পূর্বে খাদ্য প্রয়োগ বন্ধ করতে হবে। তবে অনেক দুরে পিএল পরিবহণের ক্ষেত্রে জীবিত খাদ্য হিসেবে আর্টিমিয়া বা প্রতি ৫০০ পিএল-এর জন্য একটি সিদ্ধ ডিমের কুসুমের ১/৮ অংশ খেতে দিতে হবে।
খ) পলিদিন ব্যাগে ছিদ্র আছে কিনা তা ভালোভাবে পরীক্ষা করতে হবে। একটি ব্যাগের ভেতর আরেকটি ব্যাগ ঢুকিয়ে কোণাগুলো শক্তভাবে বাঁধতে হবে, যেন সব স্থানে কোনো ক্রমেই রেণু বা পিএল আটকে না যায়। অতঃপর ব্যাগের ১/৩ অংশ পানি দিয়ে পূর্ণ করতে হবে।

গ) শুধুমাত্র পিএল পরিবহণের ক্ষেত্রে প্যাকিংয়ের পূর্বে আশ্রয়স্থল হিসেবে কিছু জলজ আগাছা ব্যাগের ভিতর দিতে হবে। এবার পিএল বা পোনা ব্যাগের ভিতর দিয়ে ২/৩ অংশ অক্সিজেন দিয়ে পূর্ণ করতে হবে এবং পলিখিন ব্যাগের মুখ শক্ত করে বাঁধন দিতে হবে। এক সাথে অনেক ব্যাপ পরিবহণ করা হলে ব্যাগগুলো তাপ অপরিবাহী কার্টুনে নিয়ে পরিবহণ করা অধিক নিরাপদ।

চিত্র ২.১৬: পিএল পরিবহণ

গোনা টেকসইকরণ ও পরিবহণ
তাপমাত্রা, লবণাক্ততা, পিএইচ প্রভৃতির স্বল্পতা বা আধিক্য চিংড়ির মধ্যে পীড়ন সৃষ্টি করে যা রোপ সংক্রমণের কারণ/মৃত্যুর কারণ হতে পারে। হ্যাচারি বা নার্সারির নিয়ন্ত্রিত একটি পরিবেশ থেকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পোনাগুলো নতুন পরিবেশে ছাড়া হয় যা সহনীয় হওয়া অতীব জরুরি। নতুন পরিবেশে খুবই প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হয় বিধার পোনাকে নতুন পরিবেশে খাপ খাওয়ানোর জন্য যথেষ্ট সময় দিতে হবে। যাতে পারিপার্শ্বিক প্রতিকূলতাকে ধীরে ধীরে অতিক্রম করে চাপমুক্তভাবে অভ্যস্থ হতে পারে। যথেষ্ট সতর্কতার সাথে এই কাজটি সম্পাদন করা পেলে- মজুদের সময় পোনা শারীরিকভাবে চাপের সম্মুখীন হবে না। ফলে বেশিরভাগ পোনা সুস্থ থাকবে এবং মজুদকালীন মৃত্যুর হার কম হবে। অপরদিকে পোনা জীবিতের হার বৃদ্ধি পাবে যা বছর শেষে উৎপাদনেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

পরিবহণের সময় পোনার মলমূত্র ত্যাগের ফলে পরিবহণ পাত্রে যাতে কোনো গ্যাস (অ্যামোনিয়া) সৃষ্টি না হয় সেজন্য পোনাকে একটি নির্দিষ্ট সময় ধরে না খাইয়ে রেখে পেট খালি করা হয় এবং পোনা যাতে প্রতিকূল অবস্থার সাথে সহনশীল হতে পারে সে জন্য কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় এটাই পোনা টেকসইকরণ। এক কথায় প্রতিকূল অবস্থার সাথে সহনশীল করে পোনাকে টেকসই করে নেয়াটাই হলো টেকসইকরণ। টেকসই করে পোনা পরিবহণ করলে অধিক দূরত্বে পরিবহণ করা যায় এবং গোনার মৃত্যুহার অনেকাংশে কমে যায়।

চিত্র-২.১৭: পোনা টেকসইকরণ

টেকসইকরণ পদ্ধতিসমূহ

ক) পুকুরে হাপার মধ্যে বেড় জাল দিয়ে পোনা ধরার পর জালের মধ্যে রেখে ১০-১৫ মিনিট পোনাকে ঝাপটা দিয়ে পুনরায় পুকুরে ছেড়ে দিতে হবে। পোনা পরিবহণের অন্তত ৫-৭ দিন পূর্ব থেকে ২-৩ দিন অন্তর দিনে একবার এই কাজটি কতে হবে। পরিবহণের কমপক্ষে ৮ ঘন্টা পূর্বে পোনা ধরে হাপার মধ্যে রাখতে হবে। এই সময় কোনো ধরনের খাবার হাপায় দেয়া যাবে না।

খ) গোলাকার ট্যাংক বা সিস্টার্ন পোনা বিক্রির আগের দিন জাল দিয়ে পোনা ধরে ট্যাংক বা সিস্টার্নে রেখে পানির ফোয়ারা দিতে হবে কমপক্ষে ৮ ঘন্টা। এই সময় সিস্টার্নে কোনো ধরনের খাবার দেয়া যাবে না ।

গ) পুকুরে পোনা টেকসই পোনা বিক্রির আগে যে পুকুরে পোনা টেকসই করা হয় তাকে পাকাই পুকুর বলে। পাকাই পুকুরের আয়তন ১০-৩০ শতাংশ এবং গভীরতা ৩-৪ ফুট হয়। পাকাই পুকুরে পোনা টেকসই করতে ৩-৪ দিন সময় লাগে ।

পিএল অভ্যস্থকরণের নিয়ামকসমূহ

পানিতে বিদ্যমান প্রায় সব ভৌত-রাসায়নিক গুণাগুণই (যেমন- তাপমাত্রা, লবণাক্ততা, পিএইচ, অ্যালকালিনিটি, দ্রবীভূত অক্সিজেন ইত্যাদি) পোনা মজুদের সময় ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করে। তার মধ্যে মাঠ পর্যায়ে পোনা ছাড়ার সময় যে ফ্যাক্টরগুলো অধিকতর গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয় তাহলো- লবণাক্ততা ও তাপমাত্রা। এছাড়া উপস্থিত ক্ষেত্রে বা জরুরি প্রয়োজনে চাষিরা হাত-মুখ দিয়েও এই দু'টি প্যারামিটারকে অনুভব করতে পারে। প্যারামিটারগুলোকে বাড়ানো বা কমানোর ক্ষেত্রে যথেষ্ট সময় নেয়া উচিৎ। যেমন-তাপমাত্রা বাড়ানো কমানোর মাত্রা প্রতি ঘণ্টায় ১.৫ সে. এর বেশি হওয়া অনুচিত। লবণাক্ততা কমানোর মাত্রা প্রতি ঘন্টায় ৩ পিপিটি এবং বাড়ানোর মাত্রা প্রতি ঘন্টায় ১ পিপিটি এর বেশি হওয়া অনুচিত। এবং পিএইচ পরিবর্তনের মাত্রা প্রতি ঘন্টায় ০.৫ এর বেশি হওয়া অনুচিত।

চিংড়ি ঘেরের অন্যান্য কাজগুলোর মতো পোনা মজুদের কাজটিও একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। সেসাথে অধিকতর স্পর্শকাতর বিধায় কাজটি অসাবধানতা বা হালকাভাবে সম্পাদন করার কোন সুযোগ নেই। আর এক্ষেত্রে ভুল করা হলে অবশ্যই মজুদকালীন পোনা মৃত্যুর হার ব্যাপকহারে বেড়ে যাবে, যা বছর শেষে উৎপাদনকেও ব্যাহত করবে। সুতরাং ঘেরের সকল কাজের পাশাপাশি মজুদ ব্যবস্থাপনার কাজটি যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে সম্পাদন করতে হবে যা চাষির সফল ও লাভজনক উৎপাদনে সহায়ক হবে।

পিএল অভ্যস্থকরণ: পোনা ছাড়ার পূর্বে ঘেরের পানির তাপমাত্রা ও লবণাক্ততা এবং পলিথিনের ভেতরের পানির তাপমাত্রা ও লবণাক্ততা পরীক্ষাপূর্বক পার্থক্য নির্ণয় করা অত্যন্ত জরুরি। তারপর পলিথিন ব্যাগগুলো মুখ আটকানো অবস্থায় পানিতে ভাসিয়ে দিতে হবে এবং উপর থেকে দু'হাত দিয়ে বৃষ্টির মতো করে অন্তত ১০ মিনিট পানি ছিটাতে হবে। লক্ষ্য রাখতে হবে যেন দুই পানির তাপমাত্রার ব্যবধান ১ থেকে ২ ডিগ্রি সে.-এর বেশি না হয়। পলিথিনের মুখ খুলে, ভাঁজ খুলে এবং মুখ খোলা অবস্থায় উপর থেকে পলিথিনগুলোর মুখে দু'হাত দিয়ে বৃষ্টির মতো করে অন্তত ৩০ মিনিট পানি ছিটাতে হবে। ধীরে ধীরে পলির ভেতরের ও বাইরের পানির অবস্থা (লবণাক্ততা, তাপমাত্রা ইত্যাদি) সমপর্যায়ে চলে আসবে এবং পোনাগুলো নতুন পানির সাথে অভ্যস্থ হয়ে যাবে। এই প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর বিধায় খুবই সতর্কতার সাথে এবং একটু বেশি সময় নিয়ে করা উচিৎ।

চিত্র-২.১৮: পিএল অভ্যস্থকরণ

পানি ছিটানোর ফাঁকে ফাঁকে দু'একটি পলিথিন ব্যাগের পোনা ও পানিসহ দু'হাত দিয়ে কিছুটা উপরে উঠিয়ে পোনাগুলোর চলাচল দেখতে হবে। বেশিরভাগ পোনা পলিখিন ব্যাগের মাঝে ও উপরের স্তরে ভেসে বেড়াবে। পলির তলায় অপেক্ষাকৃত দুর্বল এবং মৃত পোনাগুলো জটলা পাকানো অবস্থার থাকবে। উন্মুক্ত পলিখিন কাজ করে তার মধ্যে কৃত্রিম স্রোতধারা দিলে স্রোতের বিপরীত দিকে পোনা বেরিয়ে আসবে। নার্সারি পুকুর আয়তনে বড় অর্থাৎ মোটামুটি ১০ শতাংশের অধিক হলে কয়েকটি স্থানে পোনা ছাড়তে হবে।

পিঞ্জল অবমুক্ত পূর্ব বিবেচ্য বিষয়: পোনার বাক্সগুলো অপেক্ষাকৃত অধিক ছায়াযুক্ত স্থানে রাখতে হয়। সকাল থেকে দুপুরের পূর্ব পর্যন্ত পোনা ছাড়ার উপযুক্ত সময়। প্রখর রোদের মধ্যে দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘেরে শোনা মজুদ না করাই ভাল। কারণ এসময়ে সাধারণত পানির তাপমাত্রা বেশি থাকে। তাছাড়া মেঘলা দিন, নিম্নচাপ বা ভ্যাপসা আবহওয়ায় পোনা ছাড়া উচিত নয়। জরুরি প্রয়োজনে এ সময়েও পোনা ছাড়া যেতে পারে যদি-

  • নার্সারিতে পানির গভীরতা এক হাতের বেশি থাকে,
  • যথেষ্ট বাতাস থাকে এবং তা ঘেরের পানিতে ঢেউ খেলে,
  •  লেনের মধ্যে যথেষ্ঠ পরিমাণে সেল্টার/আশ্রয় তৈরি করা থাকে।
  •  পোনা ভর্তি পলিতে অক্সিজেনের স্বল্পতা দেখা দিলে।

সুস্থ ও সবল পোনা চেনার উপায়
পিসিআর পরীক্ষিত পোনা বা বিশ্বস্থ হ্যাচারি থেকে ভাল পোনা মজুদ করা উচিত। কারণ বাহ্যিক দৃষ্টি দিয়ে পোনার গুণগত মান সম্পূর্ণভাবে যাচাই করা যায় না। মজুদের পূর্বে পোনার কিছু আচরণ/অবস্থা নিরীক্ষণ করুন। এই দেখার কাজে অনেকে আঁতশ কাঁচ বা ম্যাগনিফাইং গ্লাস ব্যবহার করে। নিম্নে সবল ও দুর্বল পোনার কিছু বৈশিষ্ট্য উপস্থাপন করা হলো-

ক্রম সবল পোনাদুর্বল পোনা
খোলসের রং উজ্জ্বল, স্বচ্ছ ও স্বাভাবিকখোলসের রং অনুজ্জল, অস্বচ্ছ ও অস্বাভাবিক ঘোলাটে
উপাংগসমূহ দৃঢ় এবং স্বাভাবিকউপাংগসমূহ অস্বাভাবিক, ভাংগা, অসম্পূর্ণ
খাদ্যনালী পূর্ণখাদ্যনালী অপূর্ণ
স্রোতের বিপরীতে সাতার কাটেস্রোতের পক্ষে সাতার কাটে
বিরক্ত করলে দ্রুত লাফ দিয়ে সরে যায় বিরক্ত করলেও দ্রুত সরে যায় না এবং খুবই দুর্বল চলাচল
পলিথিনের নীচে তলানীর মতো জমে থাকে নাপলিথিনের নীচে তলানীর মতো জমে থাকে

নিম্নলিখিত কারণে পোনা শোধন করার প্রয়োজন হয় তা হলো-

ক) পোনাকে জীবাণুমুক্ত করার জন্য,

খ) পোনার পরিবহণকালীন আঘাতজনিত অবস্থার উন্নতির জন্য, 

গ) মজুদের পর যাতে সহজে রোগবালাইয়ে আক্রান্ত না হয়।

পোনা শোধনের উপায়সমূহ

ক. প্রতি ১০ লিটার পানিতে ১ চা চামচ পটাসিয়াম পারম্যাঙ্গানেট বা পটাশ গুলে নিয়ে তাতে পোনাগুলোকে ৩০ সেকেন্ড ডুবিয়ে গোসল করানোর মাধ্যমে। অথবা 

খ. প্রতি ১০ লিটার পানিতে ২০০ গ্রাম খাবার লবণ গুলে নিয়ে তাতে পোনাগুলোকে ৩০ সেকেন্ড ডুবিয়ে গোসল করানোর মাধ্যমে।

চিংড়ি পোনার পরিবহণ ঘনত্ব মূলত জাত, আকার, ওজন, তাপমাত্রা, শারীরতাত্ত্বিক অবস্থা ইত্যাদির ওপর নির্ভর করে। সাধারণতভাবে ৩৬×২০ ইঞ্চি আকারের পলিথিন ব্যাগ, ২০-৪০ লিটার ধারণক্ষমতার হাড়ি এবং ২০০ লিটার ধারণক্ষমতার ড্রাম চিংড়ি পোনা পরিবহণে ব্যবহৃত হয়। চিংড়ি পিএল-এর (গলদা ও বাগদা) পরিবহণ ঘনত্ব সারণিতে উল্লেখ করা হলো:

সারণি : চিংড়ি পিএল-এর পরিবহণ ঘনত্ব

পরিবহণ পদ্ধতিপরিবহণ দুরত্ববয়সপরিবহণ সময়মন্তব্য
অক্সিজেন ভর্তি পলিথিন ব্যাগ

১০০০-১২০০টি / ব্যাগ 

১৫০০-২০০০টি / ব্যাগ

২৫০০-৩০০০টি/ ব্যাগ

১০-১৫ দিন

১৮-২৪ ঘন্টা

 ১২-১৬ ঘন্টা 

৫-৬ ঘন্টা

ব্যাগের ১/৩ অংশ পানি এবং ২/৩ অংশ অক্সিজেন থাকতে হবে
সনাতন পদ্ধতি ২৫০-৫০০টি / লিটার পানিতে১০-১৫ দিন১-১৫ ঘন্টা 

পরিবহণকালে পোনা মৃত্যুর কারণ: একাধিক কারণে পরিবহণকালে চিংড়ির পিএল মারা যেতে পারে। সাধারণত যেসব কারণে পোনার মৃত্যু ঘটে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি কারণ নিচে বর্ণনা করা হলো :

ক) অক্সিজেন ঘাটতি: যদি অধিক ঘনত্বে পোনা পরিবহণ করা হয় তবে খুব দ্রুত পাত্রে অক্সিজেন ঘাটতি সৃষ্টি হওয়ার ফলে পোনা/পিএল মারা যেতে পারে।

খ) শারীরিক ক্ষত: জাল টানা, ওজন ও গণনা করার সময় অথবা এক পাত্র থেকে অন্য পাত্রে স্থানান্তরের সময় চিংড়ির পিএল-এর শরীরে আঘাত লাগতে পারে, এন্টেনা ও উপাঙ্গসমূহ ভেঙে যেতে পারে। দুর্বল ও শারীরিকভাবে ক্ষত এই সমস্ত পোনা পরিবহণকালে এবং পুকুরে মজুদের পরপরই মারা যেতে পারে।

গ) অ্যামোনিয়া সৃষ্টি: পরিবহণকালে চিংড়ির পিএল বা জুভেনাইলের নিঃসৃত মলমূত্র পচনের ফলে পাত্রে অ্যামোনিয়া উৎপন্ন হয়। যার ফলে পানি বিষাক্ত হয়ে পোনা মারা যেতে পারে।

ঘ) তাপমাত্রা: পানির তাপমাত্রা বাড়ার সাথে সাথে পোনার অক্সিজেন চাহিদা বাড়ে। কিন্তু পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের মাত্রা কমতে থাকে। পরিবহণকালে পাত্রের পানির তাপমাত্রা বেড়ে গেলে পোনা মারা যেতে পারে।

ঙ) পরিবহণ দুরত্ব: পরিবহণ দুরত্ব যত বেশি হবে পোনা বা পিএল-এর উপর তত বেশি চাপ পড়ে। এভাবে পোনা বা পিএল যদি শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে যায়, তবে পরিবহণকালে মৃত্যুহার স্বাভাবিক অবস্থার চেয়ে অনেক বেশি হয়।

চ) টেকসই না করে পোনা পরিবহণ: ধানী বা চারা পোনা টেকসই না করে পরিবহণ করলে এরা নাজুক থাকে। ফলে পরিবহণকালীন ধকল সহ্য করতে পারে না এবং অনেক পোনা মারা যায়।

ছ) রোগাক্রান্ত ও দুর্বল পোনা পরিবহণ: রোগাক্রান্ত ও দুর্বল পোনা পরিবহণ করলে মৃত্যুহার স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি হয়।

পরিবহণকালীন বিবেচ্য বিষয়সমূহ:

ক) পানির তাপমাত্রা বাড়ার সাথে সাথে চিংড়ি পোনার অক্সিজেন চাহিদা বাড়ে। তাই পরিবহণকালে পানির তাপমাত্রা কম রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। পাত্রের পানি ঠান্ডা রাখার জন্য প্রতি ঘন্টা পরিবহণ সময়কালে প্রতি লিটার পানিতে ১০ গ্রাম হারে বরফ মিশানোর ব্যবস্থা করলে ভালো হয়।

খ) পিএল-এর আকার যত বড় হবে পরিবহণ ঘনত্ব তত কম হবে। সেই সাথে অক্সিজেন সরবরাহ বাড়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে।

গ) পেটে খাবার থাকলে চিংড়ি পোনার অক্সিজেন চাহিদা বেড়ে যায়। তাছাড়া পেটে খাবার ভর্তি পোনা পরিবহণ করলে পরিবহণের সময় পোনা মলমূত্র ত্যাগ করে। ফলে বিষাক্ত অ্যামোনিয়া গ্যাসের সৃষ্টি হয়। সে জন্য পরিবহণের আগে টেকসইকরণ পদ্ধতিতে পোনার পেট খালি করে নিতে হবে।

ঘ) পরিবহণকালে পোনার অবস্থা খারাপ হতে পারে তা বিবেচনা করে প্রতিরোধকল্পে প্রতি লিটার পানিতে ৩ গ্রাম হারে খাবার লবণ ব্যবহার করতে হবে।

ঙ) ব্যাগে যাতে কোনো প্রকার চাপ না লাগে সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে।

চ) পরিবাহণ পাত্র ভেজা কাপড় বা চটদ্বারা ঢেকে রাখতে হবে এবং পরিবহণকালে ব্যাগ / পাতিল ছায়াযুক্ত স্থানে রাখতে হবে।

ছ) পানি পরিবর্তনের সময় মিশ্রিত পানি এবং পাত্রের পানির তাপমাত্রা সমতায় নিয়ে আসতে হবে।

জ) একই ব্যাগ বা পাত্রে সমান আকারের পিএল পরিবহণ করতে হবে এবং পাত্রের মধ্যে মাত্রাতিরিক্ত পোনা পরিবহণ করা যাবে না।

ঝ) ব্যাগে যাতে কোনো শক্ত বস্তু যেমন- ধারালো টিনের টুকরা, পেরেক ইত্যাদির আঘাত না লাগে সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে। বিড়ি/ সিগারেটের আগুন থেকেও ব্যাগকে সাবধানে রাখতে হবে।

ঞ) পরিবহণের জন্য সঠিক সময় হিসেবে পরিবহণ করতে হবে যাতে করে মৃত্যুহার কোনোভাবেই বেশি না হয়।

ট) পরিবহণকালে পরিষ্কার পানি সাথে রাখা এবং বারবার পাত্রের কিনারা ধুয়ে দিতে হবে, যাতে পোনা পাত্রের গায়ে লেগে না যায়।

ঘ. পোনার মজুদোত্তর ব্যবস্থাপনা

পোনা মজুদের পর পুকুরের সার্বিক ব্যবস্থাপনা চিংড়ি উৎপাদনের পূর্বশর্ত। পোনা মজুদোত্তর সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ছাড়া চিংড়ির কাঙ্ক্ষিত উৎপাদন সম্ভব নয়। পোনা মজুদের পর উল্লেখযোগ্য ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমগুলো হলো-

১. পোনা/ পিএল-এর বাচাঁর হার পর্যবেক্ষণ

পুকুরে মজুদের পর বিভিন্ন কারণে আংশিক বা সম্পূর্ণ মজুদকৃত পোনা বা পিএল মারা যেতে পারে। সম্ভাব্য কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে- পরিবহণজনিত ত্রুটি, শারীরিক আঘাত, পানির বিষক্রিয়া এবং হঠাৎ করে তাপমাত্রা বৃদ্ধি। এসব কারণে পোনা/ পিএল ছাড়ার পর মজুদকৃত পোনা বা পিএল এর বাঁচার হার পর্যবেক্ষণ করা উচিত।
পোনা বাঁচার হার পর্যবেক্ষণ করার উপায়: মরা পোনা পানির উপর ভেসে উঠে। তাই মরা পোনা পাড়ের কাছাকাছি দেখা যায় কিনা তা খুব ভালভাবে লক্ষ্য করতে হবে। মরা পোনা পানি থেকে উঠিয়ে গণনার পর আবার সমপরিমাণ পোনা ছাড়তে হবে।

২. চিংড়ি চাষে পানি ব্যবস্থাপনা

যে কোনো জলজ উদ্ভিদ কিংবা প্রাণী সার্থকভাবে চাষের জন্য স্বাস্থ্যসম্মত পানির কোনো বিকল্প নেই। অথচ সেই পানি ব্যবস্থাপনার দুর্বলতাই চিংড়ি চাষের প্রধান অন্তরায়। বাংলাদেশে বর্তমানে উন্নত প্রচলিত পদ্ধতিতে বেশিরভাগ ঘেরে চিংড়ি চাষের চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে এই পদ্ধতিতে খুব কম ঘেরেই খাদ্য ব্যবহার করা হয়। বেশিরভাগ ঘেরেই প্রাকৃতিক উৎপাদন/উৎপাদনশীলতার উপরই চিংড়ির উৎপাদন নির্ভর করে। ঘেরের প্রাকৃতিক উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি ও স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে চিংড়ি চাষের জন্য অবশ্যই ঘেরের পানি ব্যবস্থাপনার ওপর অধিকতর গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন।
চিংড়ির চলাফেরার জন্য, চিংড়ির নিঃশ্বাস গ্রহণের জন্য, চিংড়ির প্রাকৃতিক খাবার উৎপাদনের জন্য এবং চিংড়িকে রোগবালাই হতে মুক্ত রাখার জন্য পানি ব্যবস্থাপনার বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন। নিচে বিভিন্ন বিষয়ে পানি ব্যবস্থাপনার প্রয়োজনীয়তাসমূহ হলো-

ক. চলাচলের জন্য পানি ব্যবস্থপনা

বেশিরভাগ উপকূলীয় ঘেরের তলদেশ অসমতল হওয়ায় ঘেরের সর্বত্র সমানভাবে পানি থাকে না। এমনকি কোনো কোনো ঘেরে দুই পাড়ের মাঝামাঝি ঘেরের প্রায় ৩০-৪০ ভাগ এলাকায় কোনো পানিই থাকে না। পানির গভীরতা কম ও স্বচ্ছতা বেশি থাকার ফলে ঘেরের তলদেশ পর্যন্ত সূর্যালাকে পৌছায়। ফলে, নানা ধরনের উচ্চতর জলজ উদ্ভিদ (নাজাজ, কারা ইত্যাদি) জন্মে চিংড়ির চলাচলে বাধার সৃষ্টি করে। এসব বিষয়সমূহ বিবেচনা করলে অনেক সময় দেখা যায় যে, ঘেরের অধিকাংশ এলাকা চাষের আওতার বাইরে থাকে। ফলে, চিংড়ির উৎপাদনের হারও অনেক কম হয়। এতএব ঘেরের সম্পূর্ণ এলাকা চাষযোগ্য করার জন্য নিম্নলিখিত পদক্ষেপসমূহ গ্রহণ করতে হয়-

ক) ঘেরের সর্বত্র যাতে সমান গভীরতায় পানি রাখা যায় সেভাবে ঘের প্রস্তুত করতে হবে।

খ) ঘেরের পানির গভীরতা প্রায় এক মিটার এবং পানির স্বচ্ছতা ২৫-৩৫ সেমি এর মধ্যে রাখতে হবে, যেন ঘেরের তলায় সূর্যালাকে না পৌঁছায়। 

গ) ঘেরে জন্মানো যে কোনো উচ্চতর উদ্ভিদ পরিষ্কার করে ফেলতে হবে।

খ. নিঃশ্বাস গ্রহণের জন্য পানি ব্যবস্থাপনা

চিংড়ির স্বাভাবিক শ্বাস গ্রহণের জন্য পানিতে ৪ পিপিএম এর বেশি দ্রবীভূত অক্সিজেনের প্রয়োজন। অক্সিজেন এক ধরনের গ্যাস। পানিতে অক্সিজেন ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের প্রয়োজনীয় গ্যাস, যথা: কার্বন-ডাই-অক্সাইড, অ্যামোনিয়া, হাইড্রোজেন সালফাইড ইত্যাদি দ্রবীভূত থাকে। অপ্রয়োজনীয় গ্যাসমূহের মাত্রা বৃদ্ধি পেলে মজুদকৃত চিংড়ি মারা যেতে পারে। পানির গ্যাস ধারণের একটি নির্দিষ্ট ক্ষমতা রয়েছে। যদি কোন কারণে অপ্রয়োজনীয় গ্যাসের মাত্রা বৃদ্ধি পায়, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই প্রয়োজনীয় গ্যাসের পরিমাণ কমে যাবে। চিংড়ি চাষের জন্য বিভিন্ন প্রয়োজনীয় গ্যাসের সহনীয় মাত্রা নিচের সারণিতে দেয়া হলো:

সারণি: পানিতে দ্রবীভুত বিভিন্ন প্রয়োজনীয় গ্যাসের সহনীয় মাত্রা

ক্রমিক

গ্যাসের নাম

সহনীয় মাত্রা

মন্তব্য

০১দ্রবীভূত অক্সিজেন৫-১০ পিপিএম৪ পিপিএম-এর কম নয়
০২কার্বন-ডাই-অক্সাইড<৬.০ পিপিএমপিএইচ কম হলে পরিমাণ বেড়ে যায়
০৩হাইড্রোজেন সালফাইড<০.০৩ পিপিএমকম পিএইচ এ অধিক ক্ষতিকর
০৪অ্যামোনিয়া<০.০১ পিপিএম উচ্চ পিএইচ এবং তাপমাত্রা অধিক ক্ষতিকর

পানিতে অপ্রয়োজনীয় গ্যাস-এর মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণসমূহ হলো-

ক) পানিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ বৃদ্ধি পেলে,

খ) পানিতে অক্সিজেন এর উৎপাদন / পরিমাণ কমে গেলে,

গ) চিংড়ির অতিরিক্ত খোসা পাল্টানোর কারণে, এবং

ঘ) ঘেরের তলায় কাদার পরিমাণ বৃদ্ধি পেলে । 

জৈব পদার্থের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ার কারণসমূহ হলো-

ক) অতিরিক্ত জৈব সার ব্যবহারের ফলে,

খ) চিংড়িকে অপরিমিত সম্পুরক খাবার সরবরাহ করলে, এবং 

গ) কোনো কারণে পানির সব প্লাংকটন হঠাৎ মরে গেলে।

পানিতে অপ্রয়োজনীয় গ্যাস ও জৈব পদার্থের পরিমাণ বৃদ্ধি পেলে করণীয়- 

ক) চিংড়ি ঘেরের পানিতে বিশেষ প্রয়োজন ব্যতিরেকে জৈব সার প্রয়োগ না করা;

খ) ঘেরে খাবারের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার প্রতি অধিকতর গুরুত্ব দেয়া। কারণ অপরিমিত সম্পূরক খাবার ব্যবহারে যেমন আর্থিক ক্ষতি হয় তেমনি ঘেরের পানি দূষিত হয়;

গ) ঘেরে প্লাংকটন উৎপাদনের সহনশীল মাত্রা বজায় রাখা; 

ঘ) পানিতে প্যাডেল হুইল অথবা অন্য কোনো মাধ্যমে অক্সিজেন সরবরাহ করা; এবং

ঙ) অমাবশ্যা ও পূর্ণিমায় যথারীতি পানি পরিবর্তন করা।

গ. প্রাকৃতিক উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির জন্য পানি ব্যবস্থাপনা

জলাশয়ের প্রাকৃতিক উৎপাদনশীলতা বলতে পানিতে সাধারণত ফাইটোপ্লাংকটন-এর উৎপাদনের হারকে বুঝায়। ফাইটোপ্লাংকটন শুধু পানিতে প্রাথমিক খাদ্যের যোগান দেয় না, সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে চিংড়ির শ্বাস গ্রহণ ও অন্যান্য প্রয়োজনে পানিতে পর্যাপ্ত অক্সিজেন সরবরাহ করে এবং ক্ষতিকর গ্যাসসমূহের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। পার্যপ্ত ফাইটোপ্লাংকটনের উপস্থিতি মাটির তলায় জন্মানো ক্ষতিকর উদ্ভিদ জন্মাতে বাধা সৃষ্টি করে এবং পানিতে দ্রবীভূত অতিরিক্ত নাইট্রোজেন ও ফসফরাস খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করে পানিকে দূষণমুক্ত রাখে। এক কথায় চিংড়ির সঠিক উৎপাদনের জন্য পানির প্রাকৃতিক উৎপাদনশীলতা সহনশীল পর্যায়ে থাকা বিশেষ প্রয়োজন। প্রাকৃতিক উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির জন্য পানির ভৌত-রাসায়নিক গুণাবলি প্রয়োজনীয় মাত্রায় থাকা প্রয়োজন। এছাড়া পানিতে প্রয়োজনীয় মাত্রায় নাইট্রোজেন, ফসফরাস ও পটাশসহ বিভিন্ন খাদ্যোপাদানের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে। চিংড়ি খামারের পানির ভৌত-রাসায়নিক গুণাবলি ও তার সহনীয় মাত্রা নিচের সারণিতে উল্লেখ করা হলোঃ 

সারণি: পানির ভৌত-রাসায়নিক গুণাবলি ও তার সহনীয় মাত্রা

ক্রমগুণাবলীসহনীয় মাত্ৰা
০১তাপমাত্রা২৮-৩২ ডিগ্রী সে.,
০২লবণাক্ততা১০-৩০ পিপিটি
০৩রং সবুজ, হলদে সবুজ অথবা বাদামি
০৪গভীরতা> ১০০ সে.মি.
০৫স্বচ্ছতা৩০-৪০ সে.মি.
০৬পিএইচ৭.৫-৮.৫
০৭অ্যালকালিনিটি৮০-২০০ পিপিএম
০৮নাইট্রেট৮০-২০০ পিপিএম
০৯ফসফেট০.১০ ০.২০ পিপিএম

তাপমাত্রা ও লবণাক্ততাঃ পানির তাপমাত্রার হঠাৎ হ্রাস-বৃদ্ধির ফলে চিংড়ির বৃদ্ধিতে ব্যাঘাত হতে পারে, এমনকি চিংড়ি মারাও যেতে পারে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ঘেরসমূহে পানির গভীরতা কম থাকার ফলে বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে অতিরিক্ত সূর্যতাপ কিংবা হঠাৎ বৃষ্টিপাতের ফলে পানির তাপমাত্রা অস্বাভাবিক পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়। তাপমাত্রার পরিবর্তনের ন্যায় লবণাক্ততার পরিবর্তনের ফলে চিংড়ির তেমন কোনো ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে না। তবে হঠাৎ অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের ফলে লবণাক্ততা এবং তাপমাত্রা উভয়েরই অস্বাভাবিক হ্রাস চিংড়ির ক্ষতির কারণ হতে পারে। পানির গভীরতা প্রায় ১ মিটার রাখা সম্ভব হলে এ ধরনের পরিবর্তনে চিংড়ির তেমন কোনো ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে না ।

রং ও স্বচ্ছতা: সাধারণত পানিতে ফাইটোপ্লাংকটনের রঙের উপর পানির রং নির্ভর করে। ফাইটোপ্লাংকটনের রং কম লবণাক্ত পানিতে সবুজ অথবা হলদে সবুজ থাকে এবং অধিক লবণাক্ত পানিতে বাদামি হয়। ফাইটোপ্লাংকটনের ঘনত্ব যত বেশি হবে পানির স্বচ্ছতাও সেই হারে কমে যাবে। কাজেই পানির স্বাভাবিক গুণাগুণ ধরে রাখার জন্য পানির রং ও স্বচ্ছতার প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।

পিএইচ ও অ্যালকালিনিটি: পানিতে পিএইচ-এর গুরুত্ব এত বেশি যে এক কথায় পিএইচ কে পানির পালস হিসেবে অভিহিত করা যেতে পারে। আর পানিতে প্রাকৃতিক উৎপাদনশীলতার যে সুপ্ত ক্ষমতা বিদ্যমান তা নির্ভর করে পানির অ্যালকালিনিটির উপর। চিংড়ির ভালো উৎপাদনের জন্য পানির এই দু'টি গুরুত্বপূর্ণ গুণাবলি সঠিক মাত্রায় রাখার জন্য সর্বদা সচেষ্ট দৃষ্টি দিতে হবে। কোনো কারণে পিএইচ ও অ্যালকালিনিটি কমে গেলে চুন ব্যবহারের মাধ্যমে তা বাড়ানো যেতে পারে। ঘেরে চিংড়ি থাকা অবস্থায় কৃষিজ চুন বা ডলো চুন ব্যবহার করা নিরাপদ।

পাথুরে কিংবা কলি চুন ব্যবহারের প্রয়োজন হলে অত্যন্ত সাবধানতার সঙ্গে ব্যবহার করতে হবে। পিএইচ-এর মান যদি ৭.৫ এর নিচে নেমে আসে কিংবা সকাল ও বিকালের পিএইচ-এর তারতম্য ০.৫ এর বেশি হয়, তাহলে অবশ্যই পানিতে চুন প্রয়োগ করা যেতে পারে। এমতাবস্থায় একর প্রতি ৪০- ৫ কেজি (শতকে ০.৪-০.৫ কেজি) ডলো চুন প্রয়োগ করা যেতে পারে। চুন প্রয়োগের ফলে পিএইচ-এর সাথে সাথে অ্যালকালিনিটিও বৃদ্ধি পাবে। যদি কোনো কারণে পিএইচ বেড়ে ৯.০ এর অধিক হয়ে যায় তাহলে পানি পরিবর্তন করে পিএইচ কমাতে হবে। বৃষ্টির পানি অল্প, তাই অস্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের ফলে পানির পিএইচ কমে যেতে পারে। সেজন্য বৃষ্টির পর পরই ঘেরে ডলো চুন প্রয়োগ করতে হবে।

খাদ্যোপাদান: পানির প্রাকৃতিক উৎপাদনশীলতা তথা ফাইটোপ্লাংকটনের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য পানিতে প্রয়োজনীয় মাত্রায় নাইট্রোজেন, ফসফরাস ও পটাশসহ বিভিন্ন খাদ্যোপাদানের উপস্তিতি নিশ্চিত করা একান্ত প্রয়োজন। এসব উপাদান সরবরাহের জন্য পানিতে সার প্রয়োগ অপরিহার্য। চিংড়ি চাষের জন্য ঘের প্রস্তুত করার সময় পানিতে একর প্রতি ২০-২৫ কেজি (শতকে ২০০-২৫০ গ্রাম) ইউরিয়া ও একর প্রতি ৩০-৩৫ কেজি (শতকে ৩০০-৩৫০ গ্রাম) টিএসপি সার প্রয়োগ করা যেতে পারে। চিংড়ি পোনা মুজদ পরবর্তী প্রত্যেক মাসে একর প্রতি ১০-১২ কেজি (শতকে ২০০-৩০০ গ্রাম) পটাশ সার প্রয়োগ করা যেতে পারে। যদি চিংড়িকে সম্পুরক খাবার সরবরাহ করা হয়, তাহলে প্রথম দুই মাস পর সাধারণত সার প্রয়োগের প্রয়োজন হয় না।

ঘ. প্লাংকটন মৃত্যু ও তার প্রতিকার

পানিতে কোনো খাদ্যোপাদান কিংবা কার্বন-ডাই-অক্সাইডের অভাব হলে বেশিরভাগ প্লাংকটন মারা যেতে পারে। প্লাংকটনের এই অস্বাভাবিক মারা যাওয়াকে প্লাংকটন ক্রাসও বলা হয়। এমতাবস্থায় পানি একেবারে স্বচ্ছ হয়ে যায়, পানিতে ফোম হয় এবং দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ দ্রুত কমে গিয়ে চিংড়ির জন্য সংকটময় অবস্থার সৃষ্টি করে। এ অবস্থায় দ্রুত পানি পরিবর্তন এবং পানিতে কৃত্রিম উপায়ে অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা করতে হবে। প্লাংকটন ক্রাস প্রতিরোধকল্পে পানিতে নিয়মানুযায়ী চুন ও সার ব্যবহার অব্যাহত রাখতে হবে।

ঙ. রোগ প্রতিরোধে পানি ব্যবস্থাপনা

যেকোনো পানিতেই চিংড়ির রোগের জীবাণু বিদ্যমান থাকে। উপযুক্ত পরিবেশ এবং চিংড়ির রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গেলেই কেবলমাত্র রোগ জীবাণু চিংড়িকে আক্রমণ করতে সক্ষম হয়। যে পরিবেশ চিংড়ির বসবাসের জন্য অসহনশীল, সেই পরিবেশেই রোগ জীবাণুর বংশ বৃদ্ধি বেশি হয় এবং চিংড়িকে আক্রমণ করতে সহায়ক হয়। চিংড়ির চলাফেরা কোনো কারণে অস্বাভাবিক কিংবা চিংড়িকে রোগাক্রান্ত মনে হলে তাৎক্ষণিকভাবে পানির পিএইচ, দ্রবীভূত অক্সিজেন ও অ্যালকালিনিটি পরীক্ষা করে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। পানি পরিবর্তনের সময় খেয়াল রাখতে হবে যেন প্রবেশকৃত পানির গুণগতমান সহনীয় পর্যায়ে থাকে। উন্নত পদ্ধতির চিংড়ি চাষে জলাধারে পানি পরিশোধনপূর্বক ঘেরে সরবরাহ করা যেতে পারে। পানি পরিশোধনের জন্য ২০-২৫ পিপিএম হারে ব্লিচিং পাউডার ট্রিটমেন্ট করা যেতে পারে। রোগ প্রতিরোধের জন্য পানির ভৌত ও রাসায়নিক গুণাবলি সহনশীল মাত্রায় বজায় রাখতে হবে।

চ. পানির গুণাগুণ সংরক্ষণে পানি ব্যবস্থাপনা

পানির গুণাগুণ সঠিক মাত্রায় বজায় রাখা চিংড়ি চাষের সফলতার ক্ষেত্রে অন্যতম মূল চাবিকাঠি। সাধারণত পানি ব্যবস্থাপনা তথা পানির গুণাগুণ বজায় রাখার প্রধান কারণ হচ্ছে চিংড়ির বেঁচে থাকার হার বাড়ানো এবং স্বাভাবিক দৈহিক বৃদ্ধি। পুকুরের পানির ভালো অবস্থা বলতে সাধারণত পানিতে পরিমিত অক্সিজেন ও অত্যন্ত কম বর্জ্যের উপস্থিতিকে বুঝায়। এই বর্জ্যের উৎস হচ্ছে চিংড়ির মল, অভুক্ত খাদ্য, শেওলা এবং অন্যান্য অনুবীক্ষণিক জীব। চিংড়ি চাষকালে প্রথম তৃতীয় মাস পর্যন্ত খাদ্যের প্রায় ৩০% এবং চতুর্থ মাস বা শেষ পর্যায়ে প্রায় ৫০% বর্জ্য হিসেবে পুকুরের তলায় জমা হয়। এর ফলে ক্ষতিকর শেওলার উৎপাদন ত্বরান্বিত হয় এবং একটা পর্যায়ে এসব ক্ষতিকর শেওলা মারা গিয়ে পানি দূষিত করে। ফলে চিংড়ির স্বাভাবিক জীবনযাপন এবং দৈহিক বৃদ্ধি বাধাপ্রাপ্ত হয়। তাই পানির গুণগতমান বজায় রাখার উত্তম পদ্ধতি হলো নিয়মিতভাবে পুকুরের পানি পরিবর্তন করা। এর ফলে পানির ভৌত-রাসায়নিক গুণাগুণ বজায় থাকে, বিষাক্ত বর্জ্য পদার্থ, অতিরিক্ত শেওলা ইত্যাদি দূরীভূত হয় এবং নতুন পানির সাথে নতুন পুষ্টিকর পদার্থসমূহ পুকুরে সঞ্চালিত হয়। চিংড়ির পোনা মজুদের পর এক সপ্তাহ পর্যন্ত কোনো পানি পরিবর্তন করার প্রয়োজন হয় না। তবে প্রথম মাসে অমাবশ্যা ও পূর্ণিমার সময় একবার বা দুবার পানি পরিবর্তন করা ভাল। চিংড়ি চাষের পুরো সময়ে পোনা মজুদের ঘনত্ব, পানির গুণগতমান, লবণাক্ততা, প্লাংকটনের ঘনত্ব, দ্রবীভূত অক্সিজেন, পিএইচ, রোগের প্রাদুর্ভাব, খাদ্য প্রয়োগের পদ্ধতি ইত্যাদির ওপর ভিত্তি করে পানি পরিবর্তনের মোট পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়। সাধারণত প্রত্যেকবার পানি পরিবর্তনের সময় মোট পানির ২০-৫০% পরিমাণ পরিবর্তন করা হয়। অনেক সময় প্রয়োজনানুসারে প্রতিদিন ১০% পানি পরিবর্তন করা হয় এবং নিবিড় চাষ পদ্ধতিতে সাধারণত প্রতিদিনই ৩০% পানি পরিবর্তন করা হয়। পুকুরে চিংড়ির দেহের ওজন অনুসারে কী পরিমাণ পানি পরিবর্তন করা উচিত তার তালিকা নিচের সারণিতে দেয়া হল-

সারণি: চিংড়ির মোট ওজন অনুসারে পানি পরিবর্তন হার

প্রচলিত চাষ পদ্ধতিতে ভাটার সময় প্রয়োজনে পুকুরের অর্ধেক পানি বের করে দিয়ে জোয়ারের সময় পানি ঢুকানো হয়। সাধারণত জোয়ার-ভাটার ওপর নির্ভর করে মাত্র ৫-৬ দিনে ৫০-১০০% পানি পরিবর্তন করা সম্ভব। আধা-নিবিড় বা নিবিড় চাষ পদ্ধতিতে পানি পরিবর্তনের জন্য বিভিন্ন রকমের পাম্প ব্যবহার করা হয় এবং জোয়ারের পানির ওপর কম নির্ভর করা হয়। আধা নিবিড় চাষ পদ্ধতিতে জোয়ারের সময় স্বাভাবিকভাবে পানি পরিবর্তন করা হয় তবে ভাটার সময় প্রয়োজনে পাম্প ব্যবহার করা হয়। এক্ষেত্রে পানি দুভাবে পরিবর্তন করা যায়। প্রথম পদ্ধতিতে প্রয়োজন মত কিছুটা পানি বের করে দেয়া হয়। এবং পরে সেই পরিমাণ পানি ঢুকানো হয়। দ্বিতীয় পদ্ধতিতে পুকুর/ ঘেরের একদিক দিয়ে পানি প্রবেশ করানো হয় এবং অপরদিক দিয়ে পানি নিষ্কাশন করা হয়। অধিক বৃষ্টিপাতের সময় পানি পরিবর্তন না করে পানি নিষ্কাশন গেটের মুখে ফল বোর্ড স্থাপন করে পুকুরের ওপরের স্তরের পানি বের করে দেয়া উত্তম। এতে লবণাক্ততা হ্রাসের ঝুঁকি কমে যায়। সাধারণত পুকুর/ ঘেরে নিম্নবর্ণিত অবস্থাদি পরিলক্ষিত হলে পানি পরিবর্তন করার বিশেষ প্রয়োজন হয়ে পড়ে।

ক) সকাল (৬-৭টা) ও বিকাল (৩-৪টা) এই দুই সময়ে পর্যবেক্ষণকৃত পিএইচের পার্থক্য ০.৫ থেকে অধিক বা পিএইচের মান ৮.৫ এর বেশি অথবা ৭.৫ এর কম হলে।

খ) পানির স্বচ্ছতা ৮০ সেমি (৩২ ইঞ্চি) এর বেশি অথবা ৩ সেমি এর কম হলে।

গ) পানি অত্যধিক ভারী ও গাঢ় হয়ে গেলে

ঘ) পানিতে অজৈব কণার পরিমাণ অধিক প্রতীয়মান হলে। 

ঙ) পানির উপরিভাগে দীর্ঘক্ষণ স্থায়ী বুদবুদ দেখা গেলে।

চ) পানিতে জ-আয়োনিত অ্যামোনিয়ার পরিমাণ বেড়ে গেলে

 ছ) এ্যারেটর চালানো অবস্থায় দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ কম হলে।

চিত্র-৩.১৯: চিংড়ি ঘেরের পানির উৎস

ছ. পানির গুণাগুন সংরক্ষ

পানির গুণাগুণ রক্ষার জন্য প্রধানত তাপমাত্রা, দ্রবীভূত অক্সিজেন, পানির লবণাক্ততা, অ্যামোনিয়া, নাইট্রাইট, নাইট্রেট, খরতা ও ক্ষারত্ব, পিএইচ, হাইড্রোজেন সালফাইড প্রভৃতির ওপর বিশেষ নজর রাখা হয়। পানিতে এসব প্রয়োজনীয় গুণাগুণ না থাকলে চিংড়ির বৃদ্ধি ও বাঁচার হার কমে যায়।

তাপমাত্রা: সাধারণত তাপমাত্রা সমস্ত প্রাণীর জৈব-বিপাকক্রিয়ায় এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। ১৭ ডিগ্রি সে. তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে চিংড়ির বিপাকীয় কার্যক্রম প্রায় ১০% বৃদ্ধি হয়। একটি নির্দিষ্ট পর্যায় পর্যন্ত পানির তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে জৈব ও রাসায়নিক ক্রিয়া যেমন বাড়ে ঠিক তেমনি তাপমাত্রা কম হলে সমস্ত ক্রিয়া কমে যায়। এই জন্য দেখা যার ২০ ডিগ্রি সে. তাপমাত্রার চেয়ে ৩০ ডিগ্রি সে. তাপমাত্রায় জলজ প্রাণীসমূহের অক্সিজেন চাহিদা, খাদ্যের চাহিদা, দৈহিক বৃদ্ধির হার ইত্যাদি প্রায় দ্বিগুণ দ্রুততার সাথে বেড়ে যায়। বাগদা চিংড়ির উৎপাদনদের জন্য ২৫-৩০ ডিগ্রি সে. তাপমাত্রা উত্তম। ২৫ ডিগ্রি সে. তাপমাত্রার নিচে চিংড়ির বৃদ্ধির হার কমতে থাকে এবং ২০ ডিগ্রি সে. এর নিচে প্রায় থেমে যায়। পানির তাপমাত্রা ১৩ ডিগ্রি সে. এর নিচে এবং ৩৪ ডিগ্রি সে. এর উপরে হলে চিংড়ির ব্যাপক মড়ক দেখা দিতে পারে।

তাপমাত্রা অত্যধিক হলে খাদ্য ও সার প্রয়োগ প্রয়োজন মত কম বা বেশি অথবা বন্ধ করে দিতে হবে এবং প্রয়োজন অনুসারে পানি পরিবর্তন করে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সনাতন ও হালকা উন্নত পদ্ধতির চিংড়ি চাষের পুকুরে পানির গভীরতা ঠিক রাখা সম্ভব হয় না। ফলে এ সমস্ত খামারে গরমের সময় পানির তাপমাত্রা অত্যধিক বেড়ে যেতে পারে। এ অবস্থায় চিংড়ির আশ্রয়ের জন্য খামারের ভিতরের পার্শ্বে চারদিকে বা কোণাকুণিভাবে নালা থাকা প্রয়োজন। এছাড়া প্রয়োজনমত পানি পরিবর্তন করে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে। নার্সারিতে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের জন্য ৪-৬% এলাকাতে কচুরিপানা দেয়া যেতে পারে।

দ্রবীভূত অক্সিজেন: চিংড়ি চাষের জন্য পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বাগদা চিংড়ির অক্সিজেন চাহিদা তুলনামূলকভাবে বেশি। চিংড়ি চাষের পুকুরে ৫-৭ পিপিএম অক্সিজেন থাকা উত্তম। পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ ২.৫ পিপিএম এর নিচে নামলে চিংড়ি মারা যেতে শুরু করে এবং ১ পিপিএম এর কম হলে কয়েক ঘন্টার মধ্যেই সমস্ত চিংড়ি মারা যাবে। পানিতে অক্সিজেন দ্রবীভূত হওয়ার পরিমাণ নির্ভর করে পানির তাপমাত্রা, লবণাক্ততা ও বায়ুচাপের ওপর। সাধারণত তাপমাত্রা, লবণাক্ততা ও বাতাসের আর্দ্রতা বেড়ে গেলে পানিতে অক্সিজেন ঘাটতি তিন ভাবে হয়ে থাকে, যথা- রাত্রিকালে উদ্ভিদের শ্বাস গ্রহণ, প্রাণিকুলের শ্বাস গ্রহণ এবং পচনশীল জৈব পদার্থের পচন। অক্সিজেন হ্রাসের কারণে চিংড়ির দৈহিক ক্লেশ, ক্ষুদামন্দা, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস এবং দৈহিক বৃদ্ধির ব্যাঘাত ঘটে থাকে। পুকুরে অক্সিজেন হ্রাসের লক্ষণসমূহ হলো:

১) পানির উপর সরের মত বুদবুদ জমা হয়।

২) পুকুরের তলা থেকে বুদবুদের আকারে গ্যাস ভেসে উঠে। 

৩) অধিকাংশ শামুক ও ঝিনুক পুকুরের কিনারায় চলে আসে।

৪) সমস্ত চিংড়ি সাঁতার কাটতে থাকে।

৫) মিশ্রচাষের পুকুর হলে মরা মাছের মুখ হা করা থাকবে ও ফুলকা ফেটে যাবে।

৬) সাধারণত মেঘলা দিনে, খুব গরম পড়লে এবং মধ্যরাত থেকে ভোরবেলা পর্যন্ত পুকুরে অক্সিজেনের স্বল্পতা পরিলক্ষিত হয়।

পানিতে সবুজ উদ্ভিদ কণার (ফাইটোপ্লাংকটন) উপস্থিতিতে সূর্যালোকের প্রভাবে সালোকসংশ্লেষণ ঘটে থাকে। এই সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ার সময় ফাইটোপ্লাংকটন কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে এবং অক্সিজেন ত্যাগ করে থাকে। রাতের বেলায় যখন সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়া বন্ধ থাকে তখন এরা অক্সিজেন গ্রহণ করে ও কার্বন-ডাই-অক্সসাইড ত্যাগ করে থাকে। তাই যেসব পুকুরে ফাইটোপ্লাংকটনের আধিক্য বেশি থাকে সে সব পুকুরে সাধারণত বিকেল বেলায় অক্সিজেনের পরিমাণ বেশি থাকে এবং ভোর বেলায় অক্সিজেনের পরিমাণ কম থাকে। ফাইটোপ্লাংকটন সমৃদ্ধ পকুরের উপরিভাগে অক্সিজেনের পরিমাণ বেশি থাকে এবং তলদেশে কম থাকে। তবে নিম্নোক্ত উপায়ে পুকুরের পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ বৃদ্ধি করা যেতে পারে -

ক) পানিতে ঢেউ এর সৃষ্টি করে, যেমন- সাঁতার কাটা, বাঁশ পেটানো ইত্যাদি।

খ) পুকুরে নতুন পানি সরবরাহ করে অর্থাৎ পানি পরিবর্তন করে।

গ) কৃত্রিমভাবে বায়ু সঞ্চালন করে। যেমন- এ্যারেটর বা প্যাডেল হুইল স্থাপন করে পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ বৃদ্ধি করা যায়। পানিতে স্তর সৃষ্টি রোধে, বর্জ্য পদার্থ বের করা এবং অক্সিজেনের মাত্রা বাড়াতে এ্যারেটর অত্যন্ত কার্যকর ভুমিকা পালন করে থাকে। পুকুরের চারদিকে ৪টি এ্যারেটর ব্যবহার করলে বর্জ্য পদার্থ ঠিকভাবে এক জায়গায় জমা হতে পারে। সবগুলো এ্যারেটর এমনভাবে স্থাপন করতে হবে যাতে সব এ্যারেটর একই দিকে ঘুরে। পুকুর পাড় থেকে এ্যারেটর ৫-১০ মিটার দূরে এবং একটি থেকে অন্যটি ৩০-৩৫ মিটার দূরে স্থাপন করতে হবে।

পানির লবণাক্ততা: বাগদা চিংড়ি প্রায় শূন্য থেকে ৭০ পিপিটি লবণাক্ততায় বেঁচে থাকতে পারে। তবে ১০-২৫ পিপিটি লবণাক্ততায় এদের দৈহিক বৃদ্ধি ভালো হয়। পানির লবণাক্ততা ২৫ পিপিটির বেশি হলে মিঠা পানি সরবরাহ করে পানির লবণাক্ততা কমাতে হবে। রিফ্লাক্টোমিটার বা স্যালাইনোমিটারের সাহায্যে পানির লবণাক্ততা পরিমাপ করা যায়।

অ্যামোনিয়া: সাধারণত পুকুরের তলদেশে পুঞ্জিভূত জৈব পদার্থের পচন ও জলজ প্রাণীর বিপাকীয় ক্রিয়ায় অ্যামোনিয়ার সৃষ্টি হয়ে থাকে। আধা-নিবিড় ও নিবিড় চাষের পুকুরে সাধারণত হঠাৎ করে ব্যাপক হারে ফাইটোপ্লাংকটনের মড়ক ও অন্যান্য ময়লা-আবর্জনা পচনের কারণে অ-আয়নিত অ্যামোনিয়া উৎপাদিত হয়। আয়োনিত (NH4) ও অনায়নিত (NH) অবস্থায় অ্যামোনিয়া পানিতে বিদ্যমান থাকে। অনায়নি অ্যামোনিয়া চিংড়ির জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। পুকুরের পানিতে অনায়নিত অ্যামোনিয়ার মাত্র ০.০২৫ মিগ্রা/ লিটার এর কম থাকতে হবে যা চিংড়ির জন্য সহনীয়। এতে উৎপাদনে কোনো ব্যাঘাত ঘটে না। পানিতে অনায়নিত অ্যামোনিয়ার পরিমাণ ০.১ পিপিএম এর বেশি হলে চিংড়ির দৈহিক বৃদ্ধি বাধাপ্রাপ্ত হয় এবং ০.৪৫ পিপিএম এর বেশি হলে বৃদ্ধির হার অর্ধেকে নেমে আসে।

সাধারণত পানির পিএইচ বৃদ্ধির সাথে সাথে অ্যামোনিয়ার পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। এজন্য পানির পিএইচ ৮.৫ এর বেশি হওয়া উচিত নয়। অ্যামোনিয়ার বৃদ্ধি পিএইচ-এর সাথে সম্পর্কযুক্ত হওয়ার ফলে বিকাল বেলা পানিতে অ্যামোনিয়ার পরিমাণ বেশি থাকে এবং ভোর বেলায় কম থাকে। পানিতে অ্যামোনিয়ার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণের জন্য চিংড়ির মজুদ ঘনত্ব হ্রাস এবং অত্যধিক সার ও খাদ্য প্রয়োগ সাময়িকভাবে বন্ধ করতে হবে।

নাইট্রাইট (NO2): নাইট্রাইট হচ্ছে অ্যামোনিয়া ও নাইট্রেটের মধ্যবর্তী যৌগ। অনেক সময় এই যৌগ চিংড়ির ব্যাপক মড়ক ও দৈহিক হার হ্রাসের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। নাইট্রাইটজনিত কারণে চিংড়ি খাদ্য গ্রহণ বন্ধ করে  দেয়। নাইট্রাইটের মাত্র ০.১ পিপিএম এর নিচে থাকা চিংড়ির জন্য নিরাপদ। তবে সাগরের পানিতে নাইট্রাইট কম বিষাক্ত। চিংড়ির ঘনত্ব হ্রাস ও পানি পরিবর্তন করে জিওলাইট এবং চরম বিপর্যয়ের সময় ৩.৩ কেজি/ শতাংশ/৩০ সেমি পানির গভীরতায় লবণ প্রয়োগ করে নাইট্রাইটের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা যায়।।

নাইট্রেট (NO3): পানিতে নাইট্রেটের মাত্রা ২০ পিপিএম এর নিচে রাখা চিংড়ির জন্য উত্তম। নাইট্রেট চিংড়ির জন্য তেমন একটা বিষাক্ত নয়, বরং শেওলার জন্য একটি পুষ্টিকর উপাদান।
খরতা ও ক্ষারত্ব: পানিতে দ্রবীভূত বাইকার্বনেট ও কার্বনেট এর ঘনত্বই হলো ক্ষারত্ব। বাই-কার্বনেট ও কার্বনেট অন্য কতকগুলো উপাদানের সাথে একত্রে মিলিত আকারে থাকে। উপাদানগুলোর মধ্যে ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেসিয়াম অন্যতম। ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেসিয়াম-এর ঘনত্বকে খরতা বলে। খরতা ও ক্ষারত্বের মান হ্রাস-বৃদ্ধি হলে পানির বাফারিং ক্ষমতা কমে যায় এবং পানির পিএইচ দ্রুত উঠানামা করে। এর হ্রাস বৃদ্ধির ফলে পুকুরে সার দিলে তা কার্যকর হয় না এবং চিংড়ির খোলস বদলানো বাধাপ্রাপ্ত হয়। খরতা ও ক্ষারত্বের মান ৪০-২০০ মিগ্রা/ লিটার হলে চিংড়ির জন্য ভালো। পুকুরের পানি পরিবর্তন করে এবং চুন বা জিপসাম প্রয়োগ করে পানির খরতা ও ক্ষারত্ব নিয়ন্ত্রণ করা যায়।

পিএইচ: চিংড়ির জন্য পানির পিএইচ ৭.৫-৮.৫ হওয়াই উত্তম। পানির পিএইচ মান ৫. পিপিএম এর কম হলে এবং ৯.৫ পিপিএম এর বেশি হলে চিংড়ির জন্য ক্ষতিকর। সাধারণত খামারে পানির পিএইচ-এর উপস্থিতির মাত্রা ফাইটোপ্লাংকটন, অব্যবহৃত খাদ্যের চর্বি ও ময়লা-আবর্জনা দ্বারা প্রভাবিত হয়। দিনের বেলায় ফাইটোপ্লাংকটন আলোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় কার্বন-ডাই-অক্সাইড ত্যাগ করার ফলে ভোর বেলা পিএইচ কমে যায়। পিএইচ এর দ্রুত উঠানামা চিংড়ির জন্য মোটেও ভালো নয়। পানির পিএইচ কমে গেলে চিংড়ির উপর নিম্নোক্ত প্রভাবগুলো পরিলক্ষিত হয়-

ক) চিংড়ির দেহ থেকে সোডিয়াম ও ক্লোরাইড বেরিয়ে যায়, ফলে চিংড়ি দুর্বল হয়ে মারা যায়

খ) চিংড়ির রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায় এবং খাবারে অরুচি ভাব দেখা দেয়। 

গ) পুকুরের প্রাকৃতিক খাদ্য উৎপাদনশীলতা হ্রাস পায়।

পানির পিএইচ বেড়ে গেল চিংড়ির উপর নিম্নোক্ত প্রভাব পরিলক্ষিত হয়- 

ক) চিংড়ির দেহ থেকে সোডিয়াম ও ক্লোরাইড বেরিয়ে যায়, ফলে চিংড়ি দুর্বল হয়ে মারা যায়।

খ) চিংড়ির রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায় এবং খাবারে অরুচি ভাব দেখা দেয়। 

গ) পুকুরের প্রাকৃতিক খাদ্য উৎপাদনশীলতা হ্রাস পায়।

ঘ) চিংড়ির ফুলকা ও চোখ নষ্ট হয়ে যায়।

ঙ) অভিস্রবণ ক্ষমতা হ্রাস পায়।

চ) চিংড়ি খাদ্য গ্রহণ বন্ধ করে দেয়।

চুন ও জিপসাম প্রয়োগ করে পানির পিএইচ বাড়ানো যায় এবং অ্যামোনিয়াম সালফেট (১ কেজি/ শতাংশ) অথবা তুঁতে (৬-১২ গ্রাম/ শতাংশ/ ৩০ সেমি গভীরতা) প্রয়োগ করে পানির পিএইচ কমানো যায়।

হাইড্রোজেন সালফাইড (H2S): সাধারণত পচনশীল জৈব পদার্থের রাসায়নিক বিক্রিয়া ও অক্সিজেনের ঘাটতির ফলে পুকুরের তলদেশের মাটিতে পচা ডিমের গন্ধের অনুরপ গন্ধ পাওয়া যায় এবং মাটির উপরিভাগে কালো আবরণের সৃষ্টি হয়। পানিতে হাইড্রোজেন সালফাইডের মাত্রা ০.১-০.২ পিপিএম হলে চিংড়ি শরীরের ভারসাম্য হারায় ও খাদ্য গ্রহণে অনীহাভাব দেখায়, ফলে চিংড়ির দৈহিক বৃদ্ধির ব্যাঘাত ঘটে। হাইড্রোজেন সালফাইডের মাত্রা ১ পিপিএম-এর বেশি হলে চিংড়ির মড়ক আরম্ভ হয়। পুকুরে অক্সিজেন বৃদ্ধি, সার ও খাদ্য প্রয়োগের মাত্রা হ্রাস ও পিএইচ এর মাত্রা বৃদ্ধি করে হাইড্রোজেন সালফাইডের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। পুকুরের পানি পরিবর্তনের মাধ্যমেও হাইড্রোজেন সালফাইডজনিত সমস্যা সমাধান করা যায়।

জ. সার প্রয়োগ পদ্ধতি

সেক্কি ডিস্ক রিডিং নিয়ে সারের প্রয়োজনীয়তা নির্ণয় করতে হবে। সেক্কি ডিস্ক ১২ ইঞ্চি পানিতে রাখার পর যদি সেক্কি ডিস্ক এর সাদা-কালো অংশ পরিষ্কার দেখা যায়, তবে শতাংশ প্রতি ৮০-১০০ গ্রাম ইউরিয়া এবং ২০-৩০ গ্রাম টিএসপি প্রয়োগ করতে হবে। এ মাত্রায় সার প্রয়োগের ৫-৬ দিনের মধ্যে সেরি ডিস্ক-এর দৃশ্যমানতা না কমলে উপরোক্ত মাত্রার অর্ধেক পরিমাণ সার আবার প্রয়োগ করতে হবে। সাধারণত এই পদ্ধতিতে চাষের ক্ষেত্রে প্রতি ২ সপ্তাহ অন্তর অন্তর অর্থাৎ প্রতি পুর্ণিমা ও অমাবশ্যার সময় পানি পরিবর্তনের পর সার প্রয়োগ করা হয়ে থাকে। অজৈব সার ছিটিয়ে প্রয়োগ করতে হয়। জৈব সার পানিতে গুলিয়ে সমস্ত পুকুরে সমানভাবে ছিটিয়ে দিতে হয়। তাছাড়া জৈব ও অজৈব সার একসাথে মিশিয়ে প্রয়োগ করা যায়।

৫. চিংড়ির নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষা 

চিংড়ির নিয়মিত নমুনায়ন, স্বাস্থ্য পরীক্ষা এবং সর্বোপরি পর্যবেক্ষণ খুব জরুরি। প্রতি ১৫ দিন অন্তর চিংড়ি ধরে নমুনায়ন ও পর্যবেক্ষণ করতে হবে। সে সময় নিম্নলিখিত বিষয়গুলো ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে চিংড়ির স্বাভাবিক বৃদ্ধি অব্যাহত রাখার জন্য কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

সারণি : চিংড়ির নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষা পদ্ধতি এবং করণীয়

ক্রমপর্যবেক্ষণকরণীয়
০১শিরায়/ পেটে খাবার আছে কি না খাবার না থাকলে, কারণ খুঁজে বের করতে হবে এবং প্রয়োজনে খাবার প্রদান বৃদ্ধি করতে হবে।
০২খোলসের উপর সাদা চাকা চাকা দাগ আছে কিনাচিংড়ির ভাইরাস হলো কিনা তা নিশ্চিত হতে হবে এবং প্রয়োজনে চিংড়ি আহরণের উদ্যোগ নিতে হবে।
০৩ফুলকা কালো হয়ে গেছে কিনাচিংড়ি আক্রান্তের সংখ্যা বেশি হলে, ঘেরে হররা / পালা টেনে দিতে হবে এবং স্বল্প মাত্রায় চুন প্রয়োগে করতে হবে।
০৪লেজ ফোলা এবং তাতে পানি জমা হয়েছে কিনাচিংড়ি আক্রান্তের সংখ্যা বেশি হলে, বিঘা প্রতি ১.৫ কেজি  হিসেবে পটাসিয়াম-পার-ম্যাঙ্গানেট পানিতে মিশিয়ে ছিটিয়ে দিতে হবে।
০৫চিংড়ি দুর্বল/ সতেজ কিনাদুর্বল চিংড়ি বেশি হলে কারণ নির্ণয় করতে হবে এবং স্বল্প পরিমাণে চিংড়ি আহরণের উদ্যোগ নিতে হবে। 
০৬খোলস নরম/ শক্ত কিনানরম চিংড়ির সংখ্যা বেশি হলে কারণ নির্ণয় করতে হবে এবং চুন প্রয়োগে করতে হবে।
০৭দেহের মাংশ এবং খোলসের মধ্যে  কোনো ফাঁকা আছে কিনাফাঁকা থাকলে খাবার প্রদানের তালিকা পরীক্ষা করতে হবে এবং প্রয়োজনে পরিমাণ বাড়াতে হবে

ঝ. খামারে চিংড়ির স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা

সাধারণত অস্বাস্থ্যকর জলীয় পরিবেশ, মজুদ ঘনত্ব বেশি, খাদ্যাভাব ইত্যাদি কারণে চিংড়ির শরীরে নানা রকম রোগের প্রাদুর্ভাব পরিলক্ষিত হয়। এজন্য চিংড়ির স্বাস্থ্য রক্ষায় পানির ভৌত-রাসায়নিক গুণাগুণ নিয়ন্ত্রণে রাখার বিষয়ে সতর্ক দৃষ্টি রাখা দরকার। চিংড়ির ঘনত্ব বেশি হলে খাদ্যাভাবও প্রকট হয়। ফলে কিছু কিছু চিংড়ি দ্রুত বড় হয়ে যায় এবং দুর্বল ছোট চিংড়িগুলো খাদ্য প্রতিযোগিতায় হেরে যায়। এর ফলে দুর্বল চিংড়িগুলো ধীরে ধীরে আরও দুর্বল ও রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ে। তাছাড়া অধিক ঘনত্বের কারণে জলীয় পরিবেশও দূষিত হয়ে পড়ে। চিংড়ির স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো নিম্নরূপ:

১) পানি ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন।

২) নির্ধারিত মজুদ ঘনত্ব বজায় রাখা।

৩) খামারের সুষম ও পরিমিত খাদ্য ব্যবহার।

৪) অনাকাঙ্ক্ষিত প্রাণীর অনুপ্রবেশ রোধ।

৫) খামারে ব্যবহৃত সকল যন্ত্রপাতি ও আহরণ সরঞ্জামাদি জীবাণুমুক্ত রাখা।

৬) স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার অংশ হিসেবে পুকুরে রাসায়নিক দ্রব্যের ব্যবহার না করা। তবে একান্তভাবেই যদি রাসায়নিক দ্রব্যের ব্যবহার করতে হয় সে ক্ষেত্রে এর ব্যবহারের মাত্রা সহনশীল পর্যায়ে রাখার জন্য সচেষ্ট হতে হবে। পুকুরে বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্যের ব্যবহারের মাত্রা নিচের সারণিতে দেয়া হলো।

ঞ. অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ

সঠিকভাবে পানি ব্যবস্থাপনা চিংড়ি উৎপাদনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই পানি সরবরাহ ও নির্গমন ব্যবস্থা যাতে ঠিকমত থাকে সেজন্য পানি সরবরাহ ও নিষ্কাশন গেট নিয়মিতভাবে পরীক্ষা করতে হবে। এসব গেটে কোনো প্রকার ত্রুটি দেখা দিলে তা সাথে সাথে অপসারণ করতে হবে। তাছাড়া গেটের পার্শ্বে বা তলা দিয়ে পানি চলাচল করলে তা সাথে সাথে বন্ধ করতে হবে। অবাঞ্ছিত প্রাণী নিয়ন্ত্রণের জন্য নিষ্কাশন গেটে স্থাপিত নেট নিয়মিত পরীক্ষা করতে হবে। এগুলো ত্রুটিপূর্ণ হলে চিংড়ি খামার থেকে বের হয়ে যেতে পারে কিংবা অবাঞ্ছিত প্রাণী খামারে প্রবেশ করার সম্ভাবনা থাকে। বেষ্টনী বাঁধ ও পুকুরের বাঁধ নিয়মিত পরীক্ষা করতে হবে। বাঁধে কোনো প্রকার ত্রুটি থাকলে তা সঙ্গে সঙ্গে মেরামত করতে হবে। খামারে অবকাঠামোসমূহ নিয়মিত ও সুষ্ঠুভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা হলে আকস্মিক প্রাকৃতিক দুর্যোগকালীন সময়েও খামার / চিংড়ির ক্ষয়ক্ষতির সম্ভাবনা কম থাকে।

Content added By
Promotion