১৯২৫ সালে চিত্তরঞ্জন দাসের মৃত্যু এবং ১৯২৬ সালে কোলকাতার দাঙ্গা হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিরূপ পরিস্থিতি সৃষ্টি করে । এ পরিস্থিতিতে মওলানা আকরম খাঁ, তমিজউদ্দিন খান প্রমুখ মুসলিম নেতা কংগ্রেস ত্যাগ করেন । ১৯২৯ সালে প্রাদেশিক আইন পরিষদের নির্বাচনের পর 'নিখিল বঙ্গ প্রজা সমিতি' নামে একটি দল গঠনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় । এ সমিতির প্রধান উদ্দেশ্য ছিল বাংলার কৃষকের অবস্থার উন্নতি সাধন করা । ফলে কৃষক আন্দোলন ও রাজনীতিতে নতুন ধারা প্রবর্তিত হয়। ১৯৩৫ সালে ময়মনসিংহে অনুষ্ঠিত প্রজা সমিতির সম্মেলনে এ কে ফজলুল হক নিখিল বঙ্গ প্রজা সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হন । পরবর্তী বছর এর নতুন নামকরণ হয় ‘কৃষক-প্রজা পার্টি' । কৃষক প্রজা পার্টি ছিল সম্পূর্ণভাবে পৃথক এবং প্রদেশ পর্যায়ে গঠিত বাংলার রাজনৈতিক সংগঠন । ১৯৩৭ সালের মার্চে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় কৃষক-প্রজা পার্টি ও মুসলিম লীগের মধ্যে । তবে কোনো দল এককভাবে সরকার গঠন করার যোগ্যতা অর্জনে ব্যর্থ হয় । ফলে মুসলিম লীগ ফজলুল হকের নেতৃত্বে সরকার গঠনের প্রস্তাব গ্রহণ করে। ফজলুল হক মুখ্যমন্ত্রী নিযুক্ত হন এবং শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এ সম্মিলিত মন্ত্রিসভা ছিল দুর্বল। ফলে কৃষক-প্রজা পার্টি দুর্বল হয়ে পড়ে ।
জিন্নাহর সাথে ফজলুল হকের মতবিরোধের কারণে ১৯৪১ সালে ফজলুল হক মুসলিম লীগ থেকে পদত্যাগ করেন। ফজলুল হকের প্রতি সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের সমর্থন থাকায় ঐ সালের ডিসেম্বর মাসেই তিনি দ্বিতীয় মন্ত্রিসভা গঠন করেন। এ নতুন মন্ত্রিসভা ছিল বহুদলের সমাবেশ । এরূপ একটি মন্ত্রিসভা গঠনের মাধ্যমে ফজলুল হক বাংলার রাজনীতিতে এক নতুন ধারার সূচনা করেন । এই নতুন ধারা ছিল বাংলার হিন্দু- মুসলমানের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা করে রাজনৈতিক সমস্যা সমাধান করা। ফজলুল হকের দ্বিতীয় মন্ত্রিসভা ১৯৪১ থেকে ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত ক্ষমতাসীন ছিল। ১৯৪৩ সালের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধের জন্য প্রয়োজনীয় সমর্থন না পেয়ে ফজলুল হক পদত্যাগ করতে বাধ্য হন । ১৯৪৩ সালের ১৩ই এপ্রিল দেশব্যাপী দুর্ভিক্ষের পটভূমিতে খাজা নাজিমুদ্দীন মন্ত্রিসভা গঠন করেন । সর্বনাশা এ দুর্ভিক্ষে বাংলার ৩০ লক্ষাধিক লোক মৃত্যুবরণ করে বলে ধারণা করা হয়। ১৯৪৫ সালে নাজিমুদ্দীন মন্ত্রিসভার পতন ঘটে ।
১৯৪৬ সালের প্রাদেশিক নির্বাচন ও নেতৃত্বকে কেন্দ্র করে বাংলার মুসলিম লীগ দুইটি উপদলে বিভক্ত হয়। শেষ পর্যন্ত সোহরাওয়ার্দী বাংলার মুসলিম লীগের নেতা নির্বাচিত হন। নির্বাচনে মুসলিম লীগ ১১৪ আসনে জয়লাভ করে। প্রকারান্তরে এতে পাকিস্তান দাবির প্রতি বাংলার মুসলমানদের সুস্পষ্ট সমর্থনের প্রতিফলন ঘটে। বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসে এ নির্বাচন ও নির্বাচনের ফল ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। ১৯৪৬ সালের ২৪শে এপ্রিল সোহরাওয়ার্দী একটি মন্ত্রিসভা গঠন করেন। প্রকৃতপক্ষে সোহরাওয়ার্দী মন্ত্রিসভার সময় ছিল বাংলা ও ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসের ক্রান্তিলগ্ন। ব্রিটিশ শাসনের অবসান ও দেশ বিভাগের রাজনৈতিক পরিবেশে কোলকাতার দাঙ্গা ও স্বাধীন অখণ্ড বাংলা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা ও ভারত বিভাগ ছিল এ সময়ের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ।
অখণ্ড বাংলার উদ্যোগ:
১৯৪৭ সালে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক এক রক্তক্ষয়ী দাঙ্গায় রূপ নেয়। এরকম চরম জটিল পরিস্থিতি মোকাবেলায় ব্যর্থ ব্রিটিশ সরকার ভারতীয়দের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের ইচ্ছা ঘোষণা করে । ঠিক এই রকম পরিস্থিতিতে বাংলার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী যুক্ত বাংলার প্রস্তাব উত্থাপন করেন । এ প্রস্তাবের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নেন শরৎচন্দ্র বসু। প্রস্তাবটি উপমহাদেশের ইতিহাস 'বসু-সোহরাওয়ার্দী' প্রস্তাব নামে খ্যাত। ১৯৪৭ সালের ২৭শে এপ্রিল দিল্লিতে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে শহীদ সোহরাওয়ার্দী তাঁর বক্তব্যে স্বাধীন-সার্বভৌম অখণ্ড বাংলা রাষ্ট্র গঠনের বিষয়টি উত্থাপন করেন এবং এর পক্ষে জোরালো যুক্তি উপস্থাপন করেন । মুসলিম লীগ নেতা আবুল হাশিম বৃহত্তর বাংলা রাষ্ট্রের একটি রূপরেখা প্রণয়ন করেন। পরবর্তীকালে শরত্চন্দ্র বসু তাঁর এক প্রস্তাবে অখণ্ড বাংলাকে একটি 'সোস্যালিস্ট রিপাবলিক' হিসেবে গড়ে তোলার আহ্বান জানান ।
বসু- সোহরাওয়ার্দী চুক্তি:
১৯৪৭ সালের ২০শে মে কোলকাতায় কংগ্রেস নেতা শরৎচন্দ্র বসুর বাসগৃহে অখণ্ড বাংলার পক্ষে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় আলোচনার মাধ্যমে স্বাধীন-সার্বভৌম অখণ্ড বাংলা রাষ্ট্রের পক্ষে এক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। বৃহত্তর বাংলা রাষ্ট্রের পক্ষে বসু-সোহরাওয়ার্দী চুক্তিটি স্বাক্ষর করেন মুসলিম লীগের পক্ষে আবুল হাশিম এবং কংগ্রেসের পক্ষে শরৎচন্দ্র বসু। সভায় উপস্থিত ছিলেন মুসলিম লীগের হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাশিম, ফজলুর রহমান, মোহাম্মদ আলী, এ. এম. মালেক প্রমুখ নেতা। অপরদিকে কংগ্রেস নেতাদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন শরত্চন্দ্র বসু, কিরণ শংকর রায় ও সত্যরঞ্জন বখসী। সভায় স্বাক্ষরিত চুক্তিটি সংক্ষিপ্ত আকারে নিচে উল্লেখ করা হলো-
অখণ্ড বাংলা প্রস্তাবের ব্যর্থতা:
অখণ্ড বাংলা প্রস্তাব নিয়ে কংগ্রেস-মুসলিম লীগ উভয় দলের নেতাদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। প্রথম দিকে মুসলিম লীগের গোঁড়াপন্থী রক্ষণশীল নেতারা বৃহত্তর স্বাধীন বাংলা রাষ্ট্রের পক্ষে ছিলেন । প্রাথমিক পর্যায়ে মহাত্মা গান্ধী ও মোহাম্মদ আলী জিন্নাহরও এই প্রস্তাবের প্রতি মৌন সমর্থন ছিল। কিন্তু প্রস্তাবটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের প্রথম সারির নেতাদের তীব্র বিরোধিতার কারণে বিষয়টি জটিল হয়ে যায় । ফলে উভয় নেতা অখণ্ড বাংলা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিষয়ে মত বদলে ফেলেন। মুসলিম লীগের রক্ষণশীল নেতারা প্রথম দিকে এর সমর্থক হলেও পরে তারা অখণ্ড বাংলাকে পাকিস্তানের অংশ করার দাবি জানাতে থাকেন । বিশেষ করে খাজা নাজিমুদ্দীন, আকরম খাঁ প্রমুখ । আকরম খাঁ ১৬ই মে দিল্লিতে জিন্নাহর সঙ্গে এক বৈঠকের পর সাংবাদিকদের জানান যে, অখণ্ড বাংলা মুসলিম লীগ সমর্থন করে না। ফলে বসু-সোহরাওয়ার্দী প্রস্তাব মুসলিম লীগের সমর্থন হারায় ।
বৃহত্তর স্বাধীন বাংলা রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব অর্থাৎ বসু-সোহরাওয়ার্দী প্রস্তাব প্রথম থেকেই কংগ্রেসের উঁচু পর্যায়ের নেতাদের তীব্র বিরোধিতার মুখোমুখি হয় । কংগ্রেস নেতা জওহরলাল নেহরু ও সরদার বল্লভ ভাই প্যাটেলসহ বহু নেতা এর বিরোধী ছিলেন । তাঁরা কোনোমতেই স্বাধীন ভারতবর্ষে কোলকাতাকে হাতছাড়া করার পক্ষপাতী ছিলেন না । তাছাড়া পেট্রোল ও অন্যান্য খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ আসামও তাঁদের প্রয়োজন ছিল। অপরদিকে কংগ্রেস মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ অখণ্ড বাংলায় হিন্দু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিয়েও শঙ্কিত ছিলেন। হিন্দু মহাসভার শ্যামাপ্রসাদ যুক্ত বাংলার চরম বিরোধী ছিলেন । ফলে যুক্ত বাংলা প্রস্তাব কংগ্রেসের সমর্থন হারায় ।
তাছাড়া পত্রপত্রিকা যুক্ত বাংলার বিরুদ্ধে ক্রমাগত প্রচারণা চালাতে থাকে। পশ্চিম বাংলাকেন্দ্রিক বাঙালি অবাঙালি, ব্যবসায়ী, বণিক, পুঁজিপতিশ্রেণি এর বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করে । এমনকি ঢাকার হিন্দু সম্প্রদায়ের বুদ্ধিজীবী শ্রেণিও যুক্ত বাংলার বিপক্ষে সোচ্চার ছিলেন। এ রকম পরিস্থিতিতে কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব স্বাধীন বাংলা পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যান করে । অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে কংগ্রেসের কার্যকরী কমিটিও সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে বাংলা ভাগের পক্ষে প্রস্তাব গ্রহণ করে । অপরদিকে জুন মাসের ৩ তারিখে লর্ড মাউন্টব্যাটেন ভারত বিভক্তির ঘোষণায় বাংলা ও পাঞ্জাব ভাগের পরিকল্পনা করেন । জুন মাসের ২০ তারিখে বিধান সভার সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য বাংলা ভাগের পক্ষে রায় দিলে বাংলা বিভাগ অনিবার্য হয়ে পড়ে। ১৯৪৭ সালের ভারত স্বাধীনতা আইনে পাঞ্জাব ও বাংলা ভাগের কথা বলা হয়। ১৯৪৭-এর আইন অনুসারে ভারত ভাগ হয়। ১৪ই আগস্ট জন্ম হয় পাকিস্তান নামে এক কৃত্রিম মুসলিম রাষ্ট্রের। আর ১৫ই আগস্ট জন্ম হয় আরেকটি রাষ্ট্রের, যার নাম হয় ভারত । পূর্ব বাংলা পাকিস্তানের অংশে পরিণত হয়- পরবর্তীকালে যা পূর্ব পাকিস্তান নামে পরিচিতি লাভ করে । অপরদিকে, পশ্চিম বাংলা যুক্ত হয় ভারতের সঙ্গে । এভাবেই প্রস্তাবিত অখণ্ড স্বাধীন বাংলা রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন ব্যর্থ হয়ে যায় ।