বিশ্লেষণমূলক রচনায় কখনো উপাত্ত বিশ্লেষণ করা হয়, কখনো তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়। কোনো কোনো বিশ্লেষণমূলক রচনায় একইসঙ্গে উপাত্ত ও তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়। নিচে কিছু নমুনা দেওয়া হলো। এর মধ্যে কোনটি উপাত্ত এবং কোনটি তথ্য তা ভান কলামে লেখো। প্রথম দুটি করে দেখানো হলো। লেখার পরে সহপাঠীর সঙ্গে আলোচনা করো এবং প্রয়োজনে সংশোধন করো।
আবদুল হক (১৯১৮-১৯৯৭) বাংলাদেশের একজন সাংবাদিক ও সাহিত্যিক। তাঁর লেখা গ্রন্থের মধ্যে আছে 'বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও অন্যান্য প্রসঙ্গ', 'ভাষা আন্দালন: আদি পর্ব' ইত্যাদি। নিচে ১৯৭৩ সালে রচিত আবদুল হকের একটি প্রবন্ধ দেওয়া হলো। এটি লেখকের 'সাহিত্য ও স্বাধীনতা' বই থেকে নেওয়া হয়েছে।
রচনাটি নীরবে পড়ো এবং এই লেখার মধ্যে লেখকের যে দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত হয়েছে তা খেয়াল করো।
আবদুল হক
বাংলাদেশের সংবিধান কার্যকর হলো যোলোই ডিসেম্বর, বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচাইতে বিখ্যাত এবং উজ্জ্বল দিবসে। কোনো নবজাত রাষ্ট্রের সংবিধান রচনাই বড়ো ঘটনা, কিন্তু বাংলাদেশের সংবিধান রচনার একটা পুরুত্ব এই যে, ইতিহাসে এই প্রথম বাংলা ভাষায় একটি রাষ্ট্রের সংবিধান রচিত হলো। রাজনৈতিক সংগ্রাম ছাড়াও এ সংবিধানের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে। আর এই কারণে শুধু রাজনৈতিক সংগ্রামের নয়, ভাষা আন্দোলনেরও শ্রেষ্ঠতম বিজয়স্তম্ভ বাংলাদেশের সংবিধান। বিজয় দিবস, সংবিধান দিবস এবং ভাষা আন্দোলনের একটি বিশেষ পরিণতি লাভ একসঙ্গে মিশে গেল।
বাংলা ভাষার এবং ব্যাপকতন অর্থে বাংলা সাহিত্যের অগ্রগতির দিক দিয়ে দেখতে গেলে এই সংবিধান রচনার একটা তাৎপর্য হচ্ছে এই, এটি ভাষার বিশেষ এক গুণগত পরিণতি লাভের উদাহরণ। সংবিধানের কাজ রাষ্ট্রীয় আদর্শ ও কাঠামোকে ধরে রাখা, এমন ভাষায় যার মধ্যে ভাবাবেগ, অস্পষ্টতা, স্বার্থতা, বাহুল্য অথবা অন্য কোনো প্রকার ত্রুটি এবং শৈথিল্যের অবকাশ নেই। গনতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সংবিধান যৌথ রাষ্ট্রচিন্তাকে রূপদান করে, যাঁরা সংবিধান রচনায় ব্যাপৃত থাকেন শুধু তাঁদের চিন্তা নয়, সমগ্র জাতির চিন্তাও। সেই সঙ্গে কয়েক শতাব্দীর আন্তর্জাতিক চিন্তা ও অভিজ্ঞতাও এর উপর ছায়াপাত করে। যাঁরা সংবিধানের প্রকৃত রচয়িতা এবং জনসমাজের রাজনৈতিক প্রতিনিধি তাঁরা বাংলা ভাষাবিদগণেরও সহায়তা নিয়েছেন। সম্মিলিতভাবে তাঁদের মনে রাখতে হয়েছে আদালতে এবং ময়দানের সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জের কথা। প্রতিটি বাক্য এবং শব্দকে সোনার মতো সুক্ষ্মভাবে ওজন ও যাচাই করে দেখতে হয়েছে, সেই সঙ্গে দেখতে হয়েছে যেন সংবিধানের ভাষা বাংলা হয়, শুভ বাংলা হয় এবং পাঠযোগ্য বাংলা হয়।
জাতীয় সংসদে, নিশ্চিতভাবে ধরা যায়, এখন থেকে বাংলা ভাষাতেই আইন প্রণীত হবে। প্রধানমন্ত্রী বিচারপতিদের অনুরোধ করেছেন বাংলায় মামলার রায় লিখতে। দু-একটি রাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে বাংলা ভাষায়। এসবই বাংলার জন্য নতুন কাজ। একেবারে আনকোরা কাজ বোধ হয় বলা চলে না, তবে এসব ক্ষেত্রে এমন সর্বাত্মক আত্মনিয়োগের দায়িত্ব আর কখনো ভাষার উপর এসে পড়েনি। এসব কাজে আবেগে, বাহুল্যে, শৈথিল্যে, অস্পষ্টতার ভারে তার নুয়ে পড়ার অবকাশ নেই, নিটোলদেহ কর্মীর মতো তাকে ফিটফাট হয়ে উঠতে হবে। কোনো রকম সাহিত্য সৃষ্টি নয়, বাস্তব কর্মনিপুণতাই হবে তার যোগ্যতার মাপকাঠি।
আরো দুটি ক্ষেত্রে বাক্য ও শব্দকে সবসময়ে ঠিক ঐ রকম সোনার মতো ওজন করার দরকার না হলেও যথেষ্ট কর্মনিপুণ হতে হবে। সেই দুটি ক্ষেত্র হচ্ছে প্রশাসন ও উচ্চশিক্ষা। প্রশাসনের ভাষা এবং উচ্চশিক্ষার মাধ্যম, সঠিকভাবে বলতে গেলে প্রধান মাধ্যম হবে বাংলা। সব রকমের জ্ঞান ধরে রাখতে হবে এবং ছাত্রদের কাছে পরিবেশন করতে হবে বাংলা ভাষায়, যে সব দুরূহ বিষয়ে বাংলা ভাষায় কখনো কিছু লেখা হয়নি সেসব বিষয়েও। শিক্ষণীয় সব বিষয়ের মাধ্যম হবে বাংলা, যদিও বিশেষজ্ঞ খ্যাতনামা বিদেশি পণ্ডিতদের লেখা বই চিরদিন ইংরেজি ভাষায় পড়তে হবে শিক্ষার এবং জ্ঞানের পূর্ণতার জন্য। শুধু ইংরেজি ভাষায় কেন, সকল উন্নত ভাষায়। দুরূহ বিষয়কে প্রকাশ করার ক্ষমতা বাংলা ভাষার আছে, এ পরিচয় উনিশ শতক থেকেই কমবেশি পাওয়া যাচ্ছে।
সংবিধান, আইন এবং মামলার রায়, প্রশাসনিক চিঠিপত্র এবং সরকারি আধা-সরকারি সংস্থাসমূহের ব্যবস্থাপনা ও প্রতিবেদন, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষণীয় বিচিত্র প্রকার বিজ্ঞান ও অন্যান্য বিষয় সংক্রান্ত গ্রন্থ, যন্ত্রবিদ্যা এবং অন্যান্য বাস্তব কাজের বিষয় সংক্রান্ত প্রকাশনা সাহিতা নয়, কিন্তু এরা সকলে মিলে ভাষার প্রকাশ ক্ষমতাকে সম্প্রসারিত করে এবং সাহিত্য ও সংস্কৃতির পটভূমি রচনা করে। পশ্চিমবঙ্গ অপেক্ষা বাংলাদেশেই এর সম্ভাবনা অধিক প্রশস্ত; কেননা এদেশে সকল ক্ষেত্রে বাংলা ভাষা অপ্রতিদ্বন্দ্বী। জ্ঞান ও সংস্কৃতি এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের জন্য যতখানি ইংরেজির প্রয়োজন তার অতিরিক্ত সবকিছু ধারণ ও প্রকাশের দায়িত্ব নিতে হবে বাংলা ভাষাকে। পক্ষান্তরে পশ্চিমবঙ্গে অনেকগুলি ক্ষেত্র থেকে শুধু সর্বভারতীয় প্রয়োজনে ইংরেজিকে সরানো ঘাবে না। এবং অনেক ক্ষেত্রে একই প্রয়োজনে হিন্দিকে জায়গা দিতে হবে, জ্ঞান ও সংস্কৃতির নিজস্ব প্রয়োজনে নয়। এই কারণে পশ্চিমবঙ্গ অপেক্ষা বাংলাদেশেই বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ অধিকতর উজ্জ্বল। অধিকন্তু ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তির জন্য সংগ্রাম এবং বিশেষ করে সশস্ত্র সংগ্রামের যে বিপুল অভিজ্ঞতা বাঙালির হয়েছে তাও একটা মহৎ সাহিত্যের রূপ পাওয়ার জন্য প্রতীক্ষা করছে। অপ্রতিরোধ্য প্রয়োজনের চাপেই বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে বাংলাদেশে সমৃদ্ধ হতে হবে, হওয়ার সম্ভাবনা অপরিসীম।
(সংক্ষেপিত)
শব্দের অর্থ
আরও দেখুন...