সভ্যতার বিবর্তনে ব্যাংক ব্যবস্থার উন্নতি ঘটেছে। বর্তমানে ব্যাংক ব্যবসায় একটি লাভজনক ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। সে কারণে এর মালিকানা, প্রকৃতি ইত্যাদির মধ্যে নানা পরিবর্তন এসেছে। সময়ের পরিবর্তনে অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের ব্যাংকিং ব্যবস্থার আত্মপ্রকাশ লক্ষণীয়। ব্যাংকগুলোর মালিকানা, কাজের ধরন, সাংগঠনিক কাঠামো ও তালিকাভুক্তি আলাদা । নিচে চিত্রের মাধ্যমে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাংকের শ্রেণিবিভাগ দেখানো হলো-
ক. মালিকানার ভিত্তিতে শ্রেণিবিভাগ (Classification on the basis of ownership)
অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সাথে মিল রেখে প্রতিটি দেশে বিভিন্ন মালিকানায় ব্যাংক গঠিত হতে দেখা যায়। নিচে মালিকানার ভিত্তিতে ব্যাংকের শ্রেণিবিভাগ দেখানো হলো—
১. সরকারি ব্যাংক (State owned bank) : যে ব্যাংকের নিয়ন্ত্রক, সংগঠক, পরিচালক ও মালিক সরকার তাকে সরকারি ব্যাংক বলে। এ ধরনের ব্যাংক সরকারি উদ্যোগে গঠিত হতে পারে। আবার পরবর্তী সময়ে জাতীয়করণের মাধ্যমেও সরকারি মালিকানায় আনা হতে পারে। যেমন: অগ্রণী ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, সোনালী ব্যাংক, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক ইত্যাদি ।
২. বেসরকারি ব্যাংক (Private ownership bank) : ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত, পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত ব্যাংককে বেসরকারি ব্যাংক বলে। সব বেসরকারি ব্যাংককে বাংলাদেশ ব্যাংক-এর তালিকাভুক্তির মাধ্যমে পরোক্ষভাবে সরকারের UCB নিয়ন্ত্রণে থাকতে হয়। যেমন: ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লি., ঢাকা ব্যাংক লি., প্রাইম ব্যাংক লি. ইত্যাদি।
৩. সরকারি ও বেসরকারি যৌথ মালিকানাধীন ব্যাংক (Government and private join ownership bank) : যে ব্যাংক সরকারি ও বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে গঠিত, পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয় তাকে সরকারি ও বেসরকারি যৌথ মালিকানাধীন ব্যাংক বলে। যেমন : বাংলাদেশের আইএফআইসি (IFIC) ব্যাংক।
৪. স্বায়ত্তশাসিত ব্যাংক ( Autonomus bank) : যে ব্যাংক সরকারের কোনো বিশেষ আইনবলে বা সংবিধানের বিশেষ অধ্যাদেশের মাধ্যমে গঠিত হয় এবং যা স্বনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় স্বাধীনভাবে নিয়ন্ত্রিত হয় তাকে স্বায়ত্তশাসিত ব্যাংক বলে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বাংলাদেশ উন্নয়ন ব্যাংক, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক ইত্যাদি।
খ. কার্যভিত্তিক শ্রেণিবিভাগ (Classification on the basis of function)
১. কেন্দ্রীয় ব্যাংক (Central bank) : যে ব্যাংক সরকারি মালিকানায় ও নিয়ন্ত্রণে থেকে সরকার ও অন্যান্য ব্যাংকের ব্যাংকার, দেশের মুদ্রাবাজারের পরিচালক ও নিয়ন্ত্রক এবং সর্বোপরি সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে দেশের আর্থিক নীতি বাস্তবায়নের দায়িত্ব পালন করে তাকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলে। প্রতিটি স্বাধীন দেশে একটি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থাকে। বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক হচ্ছে 'বাংলাদেশ ব্যাংক'।
২. বাণিজ্যিক ব্যাংক (Commercial bank) : মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে যে ব্যাংক স্বল্প সুদে জনগণের অর্থ আমানত হিসেবে জমা রাখে, অধিক সুদে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেয়, গ্রাহকদের পক্ষে অর্থ আদায়, পরিশোধ, স্থানান্তরসহ বিভিন্ন ব্যাংকিং সেবা সুবিধা প্রদান করে তাকে বাণিজ্যিক ব্যাংক বলে। যেমন : সোনালী ব্যাংক লি., মার্কেন্টাইল ব্যাংক লি., এবি ব্যাংক লি. ইত্যাদি।
৩. বিশেষায়িত ব্যাংক (Specialized bank) : নির্দিষ্ট কোনো উদ্দেশ্য সাধনের জন্য যে ব্যাংকসমূহকে একটি সুপরিকল্পিত নির্দিষ্ট পথে পরিচালিত করা হয়, সেই ব্যাংকসমূহকে বিশেষায়িত ব্যাংক বলে। সাধারণত কোনো নির্দিষ্ট খাতে উন্নয়নের জন্য এরূপ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হয়। যেমন :
i. কৃষি ব্যাংক (Agricultural bank) : দেশের কৃষিখাতের উন্নয়নের লক্ষ্যে কৃষকদের অর্থসংস্থানের জন্য যে ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয় তাকে কৃষি ব্যাংক বলে। এটি একটি বিশেষায়িত আর্থিক প্রতিষ্ঠান। এর কাজ হলো কৃষকদের কৃষি যন্ত্রপাতি, সার, বীজ ইত্যাদি ক্রয়ে প্রয়োজনীয় মূলধনের সংস্থান করা। বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক এ লক্ষ্যে গঠিত ও পরিচালিত হয়।
ii. রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক : দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল তথা রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের কৃষি উন্নয়নের জন্য ১৯৮৭ সালে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়। এর মূল কাজ হচ্ছে উক্ত অঞ্চলের কৃষকদের কৃষি যন্ত্রপাতি, সার, বীজ ইত্যাদি ক্রয়ে কৃষিঋণ সরবরাহ করে প্রয়োজনীয় মূলধনের সংস্থান করা।
iii. কর্মসংস্থান ব্যাংক (Employement bank) : বেকার যুবক ও যুব মহিলাদের আত্মকর্মসংস্থানের মাধ্যমে দারিদ্র বিমোচনের লক্ষ্যে ঋণ সহায়তা প্রদানের জন্য প্রতিষ্ঠিত বিশেষায়িত ব্যাংককে কর্মসংস্থান ব্যাংক বলে। কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি ও বেকার সমস্যা দূর করে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিশ্চিত করা এরূপ ব্যাংকের উদ্দেশ্য। 'কর্মসংস্থান ব্যাংক' বাংলাদেশে এ ধরনের একটি বিশেষায়িত ব্যাংক।
গ. সাংগঠনিক কাঠামোভিত্তিক শ্রেণিবিভাগ (Classification on the basis of organizational structure)
১. একক ব্যাংকিং (Unit banking) : যে ব্যাংক কেবল একটি অফিসের মাধ্যমে তার সব ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করে তাকে একক ব্যাংকিং বলে। এ ধরনের ব্যাংকের কোনো শাখা থাকে না। বাংলাদেশে এ ধরনের ব্যাংকের কোনো অস্তিত্ব নেই। তবে যুক্তরাষ্ট্র সহ পৃথিবীর অনেক দেশে এ ধরনের ব্যাংক দেখা যায়।
২. শাখা ব্যাংকিং (Branch banking) : যে ব্যাংকিং ব্যবস্থায় একটি প্রধান অফিসের অধীনে দেশ- বিদেশের বিভিন্ন স্থানে একই নামে অনেকগুলো শাখা প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত হয়ে থাকে তাকে শাখা ব্যাংকিং বলে। বাংলাদেশের ব্যাংক ব্যবস্থা সামগ্রিকভাবে শাখা ব্যাংক ব্যবস্থার আওতাধীন।
৩. চেইন ব্যাংকিং (Chain banking) : যে ব্যাংক ব্যবস্থায় একই শ্রেণিভুক্ত কতিপয় ব্যাংক তাদের নিজস্ব মূলধন, কর্মচারি ও স্বাধীনসত্ত্বা বজায় রেখে সমঝোতা ও সহযোগিতার মাধ্যমে ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করে তাকে চেইন ব্যাংকিং বলে। বাংলাদেশে এ ধরনের ব্যাংক ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি।
৪. গ্রুপ ব্যাংকিং (Group banking) : যে ব্যাংক ব্যবস্থায় কোনো একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান একই ধরনের কতগুলো ছোট ব্যাংক গঠন করে বা একাধিক ব্যাংকের অধিকাংশ শেয়ার ক্রয়ের মাধ্যমে তাদের নিয়ন্ত্রণভার গ্রহণ করে তাকে গ্রুপ ব্যাংকিং বলে। এ ব্যবস্থায় নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানকে হোল্ডিং কোম্পানি এবং যাদের নিয়ন্ত্রণভার গ্রহণ করা হয় তাদের সাবসিডিয়ারি কোম্পানি বলা হয়। হোল্ডিং কোম্পানি ও সাবসিডিয়ারি কোম্পানির সমন্বয়ে গ্রুপ ব্যাংকিং ব্যবস্থা গড়ে ওঠে।
ঘ. তালিকাভুক্তির ভিত্তিতে শ্রেণিবিভাগ (Classification on the basis of scheduling)
১. তালিকাভুক্ত ব্যাংক (Scheduled bank) : দেশের অভ্যন্তরে কর্মরত যেসব ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংরক্ষিত তালিকার অন্তর্ভুক্ত থেকে ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করে তাকে তালিকাভুক্ত ব্যাংক বলে। এরূপ তালিকাভুক্তির জন্য সদস্য ব্যাংকগুলোকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নির্দেশিত শর্তাবলি পূরণ ও তা অনুসরণ করতে হয়। সোনালী ব্যাংক লি., অগ্রণী ব্যাংক লি. ইত্যাদি তালিকাভুক্ত ব্যাংকের উদাহরণ।
২. অতালিকাভুক্ত ব্যাংক (Non scheduled bank) : যে ব্যাংক দেশের ব্যাংকিং আইন অনুযায়ী গঠিত হলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তালিকাভুক্ত না হয়ে ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করে তাকে অতালিকাভুক্ত ব্যাংক বলে। এ ধরনের ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রদত্ত কোনো সুবিধা পায় না। বাংলাদেশ কো- অপারেটিভ ব্যাংক লিমিটেড এ ধরনের ব্যাংকের উদাহরণ।
নিজে করো : ঢাকার মতিঝিলে 'ইছামতি ব্যাংক লিমিটেড'-এর সবচেয়ে বড় এবং গুরুত্বপূর্ণ অফিসটি অবস্থিত। এ অফিস থেকে সারা দেশে তাদের ১০০টি শাখার নিয়ন্ত্রণ করা হয়। মতিঝিলের এই অফিসটির মাধ্যমেই অন্যান্য স্থানের শাখায় পরামর্শ দেওয়া হয়। ব্যাংকটি নানা ক্ষেত্রে গ্রাহকদেরকে বিভিন্ন মেয়াদে ঋণ দেয়। ব্যাংকটির মতিঝিল অফিসের পাশেই 'সাথী ব্যাংক লিমিটেড'-এর আরো একটি ব্যাংকের প্রধান অফিস অবস্থিত। পাশাপাশি অবস্থান থাকলেও এই ব্যাংকটি শুধু কৃষি ও কৃষিজ শিল্পের উন্নয়নের জন্য কৃষকদের পরামর্শ ও ঋণ দেয়। এ ব্যাংকটিরও বিভিন্ন স্থানে শাখা আছে। তবে ইছামতি ব্যাংকের মতো ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে গ্রাহকের ভিন্নতা নেই। উল্লিখিত ঘটনাটির মধ্য দিয়ে ব্যাংকের ধরন চিহ্নিত করো। |
---|
আরও দেখুন...