বিজ্ঞান বলতেই হয়তো তোমাদের চোখে বিজ্ঞানের নানা যন্ত্রপাতি, আবিষ্কার, গবেষণা, ল্যাবরেটরি- এসবের দৃশ্য ফুটে ওঠে, বিজ্ঞানের আসল বিষয় কিন্তু যন্ত্রপাতি, গবেষণা বা ল্যাবরেটরি নয়, বিজ্ঞানের আসল বিষয় হচ্ছে তার দৃষ্টিভঙ্গি। এই সভ্যতার সবচেয়ে বড় অবদান রেখেছে বিজ্ঞান আর সেটি এসেছে পৃথিবীর মানুষের বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। বিজ্ঞানের রহস্য অনুসন্ধানের জন্য কখনো সেটি যুক্তিতর্ক দিয়ে বিশ্লেষণ করা হয়, কখনো ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়, আবার কখনো প্রকৃতিতে এই প্রক্রিয়াটিকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করা হয়। সেই প্রাচীনকাল থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত অসংখ্য বিজ্ঞানী মিলে বিজ্ঞানকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। এই অধ্যায়ে পদার্থবিজ্ঞানের এই ক্রমবিকাশের একটি ধারাবাহিক বর্ণনা দেওয়া হয়েছে।
পদার্থবিজ্ঞানের ইতিহাস পড়লেই আমরা দেখব এটি তাত্ত্বিক এবং ব্যবহারিক বিজ্ঞানীদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় গড়ে উঠেছে। ল্যাবরেটরিতে গবেষণা করতে হলেই নানা রাশিকে সুক্ষ্মভাবে পরিমাপ করতে হয়। পরিমাপ করার জন্য কীভাবে এককগুলো গড়ে উঠেছে, সেগুলো কীভাবে পরিমাপ করতে হয় এবং পরিমাপের জন্য কী ধরনের যন্ত্রপাতি ব্যবহার করতে হয় সেগুলোও এই অধ্যায়ে আলোচনা করা হবে।
পদার্থবিজ্ঞান বিজ্ঞানের একটা শাখা এবং বলা যেতে পারে এটা হচ্ছে প্রাচীনতম শাখা। তার কারণ অন্য বিজ্ঞানগুলো দানা বাঁধার অনেক আগেই বিজ্ঞানীরা পদার্থবিজ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ শাখা জ্যোতির্বিদ্যা চর্চা করতে শুরু করেছিলেন। পদার্থবিজ্ঞানকে একদিকে যেমন প্রাচীনতম শাখা, ঠিক সেভাবে বলা যেতে পারে এটা সবচেয়ে মৌলিক (fundamental) শাখা। এর ওপর ভিত্তি করে রসায়ন দাঁড়িয়েছে, রসায়নের ওপর ভিত্তি করে জীববিজ্ঞান দাঁড়িয়েছে, আবার জীববিজ্ঞানের ওপর ভিত্তি করে অন্য অনেক বিষয় দাঁড়িয়ে আছে।
সাধারণভাবে আমরা বলতে পারি বিজ্ঞানের যে শাখা পদার্থ আর শক্তি এবং এ দুইয়ের মাঝে যে অন্তঃক্রিয়া (interaction) তাকে বোঝার চেষ্টা করে সেটা হচ্ছে পদার্থবিজ্ঞান। তোমরা নিশ্চয়ই অনুমান করতে পেরেছ এখানে পদার্থ বলতে শুধু আমাদের চারপাশের দৃশ্যমান পদার্থ নয়, পদার্থ যা দিয়ে গঠিত হয়েছে, অর্থাৎ অণু-পরমাণু থেকে শুরু করে ইলেকট্রন, প্রোটন, নিউট্রন, কোয়ার্ক বা স্ট্রিং পর্যন্ত হতে পারে। আবার শক্তি বলতে আমাদের পরিচিত স্থিতিশক্তি, গতিশক্তি, মাধ্যাকর্ষণ বা বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় শক্তি ছাড়াও সবল কিংবা দুর্বল নিউক্লিয়ার শক্তিও হতে পারে!
পদার্থবিজ্ঞান যেহেতু বিজ্ঞানের প্রাচীনতম শাখা এবং সবচেয়ে মৌলিক শাখা, শুধু তাই নয় বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখা কোনো না কোনোভাবে এই শাখাকে ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে তাই খুব স্বাভাবিকভাবেই পদার্থবিজ্ঞানের পরিসর অনেক বড়। শুধু তাই নয়, পদার্থবিজ্ঞানের নানা সূত্রকে ব্যবহার করে নানা ধরনের প্রযুক্তি গড়ে উঠেছে, সেগুলো আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার করি (শেষ অধ্যায়ে চিকিৎসাবিজ্ঞানে ব্যবহার করা হয় সেরকম বেশ কয়েকটি যন্ত্রের উদাহরণ দেওয়া হয়েছে)। বর্তমান সভ্যতার পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান হচ্ছে ইলেকট্রনিকসের এবং এই প্রযুক্তিটি গড়ে ওঠার পেছনেও সবচেয়ে বড় অবদান পদার্থবিজ্ঞানের। দৈনন্দিন জীবনযাত্রা ছাড়াও যুদ্ধের তাণ্ডবলীলা থেকে শুরু করে মহাকাশ অভিযান—এরকম প্রতিটি ক্ষেত্রেই পদার্থবিজ্ঞানের ব্যবহার রয়েছে। শুধু তাই নয়,বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখা এবং পদার্থবিজ্ঞানকে একত্র করে নিয়মিতভাবে নতুন নতুন শাখা গড়ে উঠেছে যেমন: Astronomy ও পদার্থবিজ্ঞান মিলে Astrophysics তৈরি হয়েছে, জৈব প্রক্রিয়া ব্যাখ্যা করার জন্য জীববিজ্ঞান এবং পদার্থবিজ্ঞান ব্যবহার করে গড়ে উঠেছে Biophysics, রসায়ন শাখার সাথে পদার্থবিজ্ঞান শাখার সম্মিলনে জন্ম নিয়েছে Chemical Physics, ভূ-তত্ত্বে ব্যবহার করার জন্য
পদার্থবিজ্ঞান ব্যবহার করে তৈরি হয়েছে Geophysics এবং চিকিৎসাবিজ্ঞানে পদার্থবিজ্ঞান ব্যবহার করে গড়ে উঠেছে Medical Physics ইত্যাদি। কাজেই পদার্থবিজ্ঞানের পরিসর সুবিশাল এবং অনেক গভীর। পঠন-পাঠনের সুবিধার জন্য আমরা পদার্থবিজ্ঞানকে দুটি মূল অংশে ভাগ করতে পারি। সেগুলো হচ্ছে:
ক্লাসিক্যাল পদার্থবিজ্ঞান: এর মাঝে রয়েছে বলবিজ্ঞান, শব্দবিজ্ঞান, তাপ এবং তাপগতি বিজ্ঞান, বিদ্যুৎ ও চৌম্বক বিজ্ঞান এবং আলোক বিজ্ঞান।
আধুনিক পদার্থবিজ্ঞান: কোরান্টাম বলবিজ্ঞান এবং আপেক্ষিক তত্ত্ব ব্যবহার করে যে আধুনিক পদার্থবিজ্ঞান গড়ে উঠেছে, সেগুলো হচ্ছে আণবিক ও পারমাণবিক পদার্থবিজ্ঞান, নিউক্লির পদার্থবিজ্ঞান, কঠিন অবস্থার পদার্থবিজ্ঞান এবং পার্টিকেল ফিজিকস ।
আমরা আগেই বলেছি, পদার্থবিজ্ঞান কিংবা বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখাকে ব্যবহার করে পৃথিবীতে নানা ধরনের প্রযুক্তি গড়ে উঠেছে। এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে আমরা আমাদের জীবনকে সহজ এবং অর্থপূর্ণ করে ভুলেছি, আবার কখনো কখনো ভয়ংকর কিছু প্রযুক্তি বের করে শুধু নিজের জীবন নয়, পৃথিবীর অস্তিত্বও বিপন্ন করে তুলেছি। অনেক সময় অকারণে অপ্রয়োজনীয় প্রযুক্তি গড়ে তুলে পৃথিবীর সম্পদ নষ্ট করার সাথে সাথে আমাদের পরিবেশকে দূষিত করে ফেলছি। কাজেই মনে রেখো প্রযুক্তি মানেই কিন্তু ভালো নয়, পৃথিবীতে ভালো প্রযুক্তি যেরকম আছে ঠিক সেরকম খারাপ প্রযুক্তিও আছে। কোনটি ভালো এবং কোনটি খারাপ প্রযুক্তি সেটা কিন্তু তোমাদের নিজেদের বিচারবুদ্ধি ব্যবহার করে বুঝতে হবে।
পদার্থবিজ্ঞান এক দিনে গড়ে ওঠেনি, শত শত বছরে গড়ে উঠেছে। পদার্থবিজ্ঞানীরা তাঁদের চারপাশের রহস্যময় জগৎকে দেখে প্রথমে কোনো একটা সূত্র দিয়ে সেটা ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন। পরীক্ষা- নিরীক্ষা করে সেই সূত্রকে কখনো গ্রহণ করা হয়েছে, কখনো পরিবর্তন করা হয়েছে, আবার কখনো পরিত্যাগ করা হয়েছে। এভাবে আমরা পদার্থের ক্ষুদ্রতম কণা থেকে শুরু করে মহাবিশ্বের বৃহত্তম আকার পর্যন্ত ব্যাখ্যা করতে শিখেছি। এই শেখাটা হয়তো এখনো পূর্ণাঙ্গ নয়—বিজ্ঞানীরা সেটাকে পূর্ণাঙ্গ করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন, যেন কোনো একদিন অভ্যন্ত অল্প কিছু সূত্র দিয়ে আপাতদৃষ্টিতে ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ের সবকিছু ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয়ে যাবে।
আধুনিক সভ্যতা হচ্ছে বিজ্ঞানের অবদান। বিজ্ঞানের এই অগ্রগতি এক দিনে হয়নি, শত শত বছর থেকে অসংখ্য বিজ্ঞানী এবং গবেষকের অক্লান্ত পরিশ্রমে একটু একটু করে আধুনিক বিজ্ঞান বর্তমান অবস্থায় পৌঁছেছে। মনে রাখতে হবে প্রাচীনকালে তথ্যের আদান-প্রদান এত সহজ ছিল না, বিজ্ঞানের গবেষণার ফলাফল একে অন্যকে জানাতে যথেষ্ট বেগ পেতে হতো, হাতে লিখে বই প্রস্তুত করতে হতো এবং সেই বইয়ের সংখ্যাও ছিল খুব কম। প্রচলিত বিশ্বাসের বিরুদ্ধে কথা বলতে সাহসের প্রয়োজন ছিল। বিজ্ঞানীদের বন্দী করে রাখা বা পুড়িয়ে মারার উদাহরণও রয়েছে। তারপরেও জ্ঞানের অন্বেষণ থেমে থাকেনি এবং বিজ্ঞানীরা প্রকৃতির রহস্য উন্মোচন করে আমাদের এই আধুনিক বিজ্ঞান উপহার দিয়েছেন।
পদার্থবিজ্ঞানের ইতিহাসকে আমরা কয়েকটি পর্বে ভাগ করে বর্ণনা করতে পারি।
বর্তমানে পদার্থবিজ্ঞান বলতে আমরা যে বিষয়টিকে বোঝাই প্রাচীনকালে সেটি শুরু হয়েছিল জ্যোতির্বিদ্যা, আলোকবিজ্ঞান, গতিবিদ্যা এবং গণিতের গুরুত্বপূর্ণ শাখা জ্যামিতির সমন্বয়ে। গ্রিক বিজ্ঞানী থেলিসের (BC 624-586) নাম আলাদাভাবে উল্লেখ করা যেতে পারে, কারণ তিনিই প্রথম কার্যকারণ এবং যুক্তি ছাড়া শুধু ধর্ম, অতীন্দ্রিয় এবং পৌরাণিক কাহিনিভিত্তিক ব্যাখ্যা গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছিলেন। খেলিস সূর্যগ্রহণের ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন এবং লোডস্টোনের চৌম্বক ধর্ম সম্পর্কে জানতেন। সেই সময়ের গণিতবিদ ও বিজ্ঞানীদের মাঝে পিথাগোরাস (S27 BC) একটি স্মরণীয় নাম। জ্যামিতি ছাড়াও কম্পমান তারের ওপর তার মৌলিক কাজ ছিল। গ্রিক দার্শনিক ডেমোক্রিটাস ( 460 BC) প্রথম ধারণা দেন যে পদার্থের অবিভাজ্য একক আছে, যার নাম দেওয়া হয়েছিল এটম (এই নামটি আধুনিক পদার্থবিজ্ঞান ব্যবহার করে থাকে)। তবে বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায় তার ধারণাটি প্রমাণের কোনো সুযোগ ছিল না বলে সেটি সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল না। সেই সময়কার সবচেয়ে বড় দার্শনিক এবং বিজ্ঞানী এরিস্টটলের মাটি, পানি, বাতাস ও আগুন দিয়ে সবকিছু তৈরি হওয়ার মতবাদটিই অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য ছিল। আরিস্তারাস (310 BC) প্রথমে সূর্যকেন্দ্রিক সৌরজগতের ধারণা দিয়েছিলেন এবংতার অনুসারী সেলেউকাস যুক্তিতর্ক দিয়ে সেটি প্রমাণ করেছিলেন, যদিও সেই যুক্তিগুলো এখন কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে। গ্রিক বিজ্ঞান এবং গণিত তার সর্বোচ্চ শিখরে উঠেছিল সর্বকালের একজন শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী আর্কিমিডিসের (287 BC) সময় (চিত্র 1.01)। তরল পদার্থে ঊর্ধ্বমুখী বলের বিষয়টি এখনো বিজ্ঞান বইয়ের পঠনসূচিতে থাকে। গোলীয় আয়নায় সূর্যরশ্মিকে কেন্দ্রীভূত করে দূর থেকে শত্রুর যুদ্ধজাহাজে আগুন ধরিয়ে তিনি যুদ্ধে সহায়তা করেছিলেন। গ্রিক আমলের আরেকজন বিজ্ঞানী ছিলেন ইরাতোস্থিনিস (276 BC), যিনি সেই সময়ে সঠিকভাবে পৃথিবীর ব্যাসার্ধ বের করেছিলেন।
এরপর প্রায় দেড় হাজার বছর জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা প্রায় বন্ধ হয়েছিল। শুধু ভারতীয়, মুসলিম এবং চীনা ধারার সভ্যতা গ্রিক ধারার এই জ্ঞানচর্চাকে বাঁচিয়ে রেখেছিল। ভারতবর্ষে আর্যভট (476), ব্রহ্মগুপ্ত এবং ভাস্কর গণিত ও জ্যোতির্বিদ্যার অনেক মূল্যবান কাজ করেছেন। শূন্যকে সত্যিকার অর্থে ব্যবহার করার বিষয়টিও ভারতবর্ষে (আর্যভট) করা হয়েছিল। মুসলিম গণিতবিদ এবং বিজ্ঞানীদের ভেতর আল খোয়ারিজমির (783 ) নাম আলাদাভাবে উল্লেখ করতে হয় । তার লেখা আল জাবির বই থেকে বর্তমান এলজেবরা নামটি এসেছে। ইবনে আল হাইয়াম (965) কে আলোকবিজ্ঞানের স্থপতি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আল মাসুদি (896) প্রকৃতির ইতিহাস নিয়ে 30 খণ্ডে একটি এনসাইক্লোপিডিয়া লিখেছিলেন। ওমর খৈয়ামের নাম সবাই কবি হিসেবে জানে, কিন্তু তিনি ছিলেন উঁচুমাপের পণিতবিদ, জ্যোতির্বিদ এবং দার্শনিক। চীনা গণিতবিদ ও বিজ্ঞানীরাও পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে অনেক কাজ করেছেন। তাদের মাঝে শেন কুয়োর নামটি উল্লেখ করা যায় (1031 ), যিনি চুম্বক নিয়ে কাজ করেছেন এবং ভ্রমণের সমর কম্পাস ব্যবহার করে দিক নির্ধারণ করার বিষয়টি উল্লেখ করেছিলেন।
ষোড়শ এবং সপ্তদশ শতাব্দীতে ইউরোপে পদার্থবিজ্ঞানের জগতে একটি বিস্ময়কর বিপ্লবের শুরু হয়, সময়টা ছিল ইউরোপীয় রেঁনেসার যুগ। 1543 সালে কোপার্নিকাস তার একটি বইয়ে সূর্যকেন্দ্রিক একটি সৌরজগতের ব্যাখ্যা দেন (বইয়ের প্রকাশক ধর্মযাজকদের ভয়ে লিখেছিলেন যে এটি সত্যিকারের ব্যাখ্যা নয়, শুধু একটি গাণিতিক সমাধান মাত্রা)। কোপার্নিকাসের তত্ত্বটি দীর্ঘদিন লোকচক্ষুর আড়ালে পড়ে ছিল, গ্যালিলিও ( 1564-1642) সেটিকে সবার সামনে নিয়ে আসেন। তিনি গাণিতিক সূত্র দেওয়ার পর পরীক্ষা করে সেই সূত্রটি প্রমাণ করার বৈজ্ঞানিক ধারার সূচনা করেন। গ্যালিলিওকে অনেক সময় আধুনিক বিজ্ঞানের জনক বলা হয়। তবে সূর্যকেন্দ্রিক সৌরজগতের প্রবন্ধা হওয়ার কারণে তিনি চার্চের কোপানলে পড়েছিলেন এবং শেষ জীবনে তাঁকে গৃহবন্দী হয়ে কাটাতে হয়। 1687 খ্রিস্টাব্দে বিজ্ঞানী নিউটন বলবিদ্যার তিনটি এবং মহাকর্ষ বলের সূত্র প্রকাশ করেন, যেটি বল এবং গতিবিদ্যার ভিত্তি তৈরি করে দেয়। আলোকবিজ্ঞান এবং অন্য আরো কাজের সাথে সাথে বিজ্ঞানী নিউটন লিবনিজের সাথে গণিতের নতুন একটি শাখা ক্যালকুলাস আবিষ্কার করেছিলেন।
অষ্টাদশ শতাব্দীর আগে তাপকে ভরহীন এক ধরনের তরল হিসেবে বিবেচনা করা হতো। 1798 সালে কাউন্ট রামফোর্ড দেখান, তাপ এক ধরনের শক্তি এবং যান্ত্রিক শক্তিকে তাপশক্তিতে রূপান্তর করা যায়। আরও অনেক বিজ্ঞানীর গবেষণার ওপর ভিত্তি করে লর্ড কেলভিন 1850 সালে তাপ গতিবিজ্ঞানের (থার্মোডাইনামিক্সের) দুটি পুরুত্বপূর্ণ সূত্র দিয়েছিলেন।বিদ্যুৎ ও চুম্বকের ওপরেও এই সময় ব্যাপক গবেষণা শুরু হয়। 1778 সালে কুলম্ব বৈদ্যুতিক চার্জের ভেতরকার বলের জন্য সূত্র আবিষ্কার করেন। 1800 সালে ভোল্টা বৈদ্যুতিক ব্যাটারি আবিষ্কার করার পর বিদ্যুৎ নিয়ে নানা ধরনের গবেষণা শুরু হয়। 1820 সালে অরস্টেড দেখান বিদ্যুৎ প্রবাহ দিয়ে চুম্বক তৈরি করা যায়। 1831 সালে ফ্যারাডে এবং হেনরি ঠিক তার বিপরীত প্রক্রিয়াটি আবিষ্কার করেন।তারা দেখান চৌম্বক ক্ষেত্রের পরিবর্তন করে বিদ্যুৎ তৈরি করা যায়। 1864 সালে ম্যাক্সওয়েল তার বিখ্যাত ম্যাক্সওয়েল সমীকরণ দিয়ে পরিবর্তনশীল বিদ্যুৎ ও চৌম্বক ক্ষেত্রকে একই সূত্রের মাঝে নিয়ে এসে দেখান যে আলো আসলে একটি বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় তরঙ্গ। বিদ্যুৎ ও চুম্বক আলাদা কিছু নয়, আসলে এ দুটি একই শক্তির দুটি ভিন্ন রূপ। এটি সময়োপযোগী একটি আবিষ্কার ছিল, কারণ 1801 সালে ইয়ং পরীক্ষার মাধ্যমে আলোর তরঙ্গ ধর্মের প্রমাণ করে রেখেছিলেন।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই বিজ্ঞানীরা দেখতে লাগলেন প্রচলিত পদার্থবিজ্ঞান দিয়ে অনেক কিছু ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না। 1803 সালে ডাল্টন পারমাণবিক তত্ত্ব দিয়েছেন, 1897 সালে থমসন সেই পরমাণুর ভেতর ইলেকট্রন আবিষ্কার করেছেন, 1911 সালে রাদারফোর্ড দেখিয়েছেন, পরমাণুর কেন্দ্রে খুবই ক্ষুদ্র নিউক্লিয়াসে পজিটিভ চার্জগুলো থাকে।
কিন্তু দেখা পেল নিউক্লিয়াসকে ঘিরে ঘুর ইলেকট্রনের মডেলটি কোনোভাবে ব্যাখ্যা করা যায় না, কারণ বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় সূত্র অনুযায়ী এই অবস্থায় ইলেকট্রন তার শক্তি বিকীরণ করে নিউক্লিয়াসের ভেতর পড়ে যাবে কিন্তু বাস্তবে তা কখনো ঘটে না। 1900 সালে ম্যাক্স প্লাঙ্ক কোয়ান্টাম তত্ত্ব আবিষ্কার করেন, এই তত্ত্ব ব্যবহার করে পরবর্তীতে পরমাণুর স্থিতিশীলতা ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয়েছিল। বিকিরণ সংক্রান্ত কোয়ান্টাম সংখ্যায়ন তত্ত্বের সঠিক পাণিতিক ব্যাখ্যা দিয়ে প্রফেসর সত্যেন্দ্রনাথ বসু পদার্থবিজ্ঞানের জগতে যে অবদান রেখেছিলেন, তার স্বীকৃতিস্বরূপ একশ্রেণির মৌলিক কণাকে বোজন নাম দেওয়া হয়। 1900 থেকে 1930 সালের এই সময়টিতে অনেক বড় বড় বিজ্ঞানী মিলে কোয়ান্টাম তত্ত্বটিকে প্রতিষ্ঠিত করেন।
বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় তরঙ্গের বাহক হিসেবে ইথার নামে একটি বিষয় কল্পনা করে নেওয়া হয়েছিল এবং 1887 সালে মাইকেলসন ও মোরলি তার অস্তিত্ব আবিষ্কার করার চেষ্টা করে দেখান যে প্রকৃতপক্ষে ইথার বলে কিছু নেই এবং আলোর বেগ স্থির কিংবা গতিশীল সব মাধ্যমে সমানা 1905 সালে আইনস্টাইনের থিওরি অব রিলেটিভিটি থেকে এই বিষয়টির ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। থিওরি অব রিলেটিভিটি থেকেই সর্বকালের সবচেয়ে চমকপ্রদ সূত্র E=বের হয়ে আসে, যেখানে দেখানো হর বস্তুর ভরকে শক্তিতে রূপান্তর করা সম্ভব।
কোয়ান্টাম তত্ত্বের সাথে থিওরি অব রিলেটিভিটি ব্যবহার করে ডিরাক 1931 সালে প্রতি পদার্থের (Anti Particle) অস্তিত্ব ঘোষণা করেন, যেটি পরের বছরেই আবিষ্কৃত হয়ে যায়।
1895 সালে রন্টজেন এক্স-রে আবিষ্কার করেন। 1896 সালে বেকেরেল দেখান যে পরমাণুর কেন্দ্র থেকে তেজস্ক্রিয় বিকিরণ হচ্ছে। 1899 সালে পিয়ারে ও মেরি কুরি রেডিয়াম আবিষ্কার করেন এবং বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারেন পরমাণুগুলো আসলে অবিনশ্বর নয়, সেগুলো ভেঙে ভেজস্ক্রিয় বিকিরণ হতে পারে।
ইলেকট্রনিকস এবং আধুনিক প্রযুক্তির আবিষ্কারের কারণে শক্তিশালী এক্সেলেরেটর তৈরি করা সম্ভব হয় এবং অনেক বেশি শক্তিতে এক্সেলেরেট করে নতুন নতুন কণা আবিষ্কৃত হতে থাকে। তাত্ত্বিক Standard Model ব্যবহার করে এই কণাগুলোকে চমৎকারভাবে সুবিন্যস্ত করা সম্ভব হয়। আপাতদৃষ্টিতে অসংখ্য নতুন নতুন কথা মনে হলেও অল্প কয়েকটি মৌলিক কণা (এবং তাদের প্রতি পদার্থ) দিয়ে সকল কলার গঠন ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয়। Standard Model ব্যবহার করে এই কণাগুলোর ভর ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয় বলে ভরের জন্য হিগস বোজন নামে একটি নতুন কণার অস্তিত্ব ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়। 2013 সালে পরীক্ষাগারে হিগজ বোজনকে শনাক্ত করাটি তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের বিরাট সাফল্য হিসেবে ধরা হয়।
1924 সালে হাবল দেখিয়েছিলেন বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সবগুলো গ্যালাক্সি একে অন্য থেকে দূরে সরে যাচ্ছে, যেটি প্রদর্শন করে যে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ধীরে ধীরে প্রসারিত হচ্ছে। যার অর্থ অতীতে একসময় পুরো বিশ্বব্রহ্মাণ্ড এক জায়গায় ছিল। বিজ্ঞানীরা দেখান প্ৰায় চৌদ্দ বিলিয়ন বছর আগে ‘বিগ ব্যাং' নামে একটি প্রচণ্ড বিস্ফোরণে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড তৈরি হওয়ার পর সেটি প্রসারিত হতে থাকে। অতি সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন, এই প্রসারণ কখনোই থেমে যাবে না এবং বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সবকিছুই একটি অন্যটি থেকে দূরে সরে যাবে। পদার্থবিজ্ঞানীরা আরো দেখিয়েছেন, তারা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের দৃশ্যমান গ্রহ নক্ষত্র গ্যালাক্সির মাত্র 4 শতাংশ ব্যাখ্যা করতে পারেন, বাকি ব্যাখ্যা করতে হলে রহস্যময় ডার্ক ম্যাটার ও ডার্ক এনার্জির ধারণা মেনে নিতে হয়। যার গঠন নিয়ে বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে যাচ্ছেন।কঠিন পদার্থের বিজ্ঞান (Solid State) নিয়ে গবেষণা অর্ধপরিবাহী পদার্থের জন্ম দেয়, যেগুলো ব্যবহার করে বর্তমান ইলেকট্রনিকস গড়ে উঠেছে, যেটি বর্তমান সভ্যতার ভিত্তিমূল।
তোমরা এর মাঝে জেনে গেছ যে পদার্থবিজ্ঞান হচ্ছে বিজ্ঞানের সেই শাখা যেটি শক্তি এবং বলের উপস্থিতিতে সময়ের সাথে বস্তুর অবস্থান পরিবর্তন ব্যাখ্যা করে। যে কোনো জ্ঞানের মতোই পদার্থবিজ্ঞানের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে জানা, পদার্থবিজ্ঞানের জানার পরিসরটি অনেক বড়, ক্ষুদ্র পরমাণু থেকে বিশাল বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের রহস্য উদ্ঘাটন করাই হচ্ছে পদার্থবিজ্ঞানের উদ্দেশ্য। বোঝার সুবিধার জন্য আমরা পদার্থবিজ্ঞানের উদ্দেশ্যকে তিনটি মূল ভাগে ভাগ করতে পারি:
প্রাচীনকালে চীন দেশে এক টুকরো লোড স্টোনকে অন্য এক টুকরোকে অদৃশ্য একটা শক্তি দিয়ে আকর্ষণ করতে দেখা গিয়েছিল। বিশেষ ধরনের এই পদার্থের বিশেষ এই ধর্মটির নাম দেওয়া হয়েছিল চৌম্বকত্ব (Magnetism)। একইভাবে প্রাচীন গ্রিসে আম্বর নামের পদার্থকে পশম দিয়ে ঘষা হলে সেটি এই দুটি পদার্থকে একটি অদৃশ্য শক্তি দিয়ে আকর্ষণ করত। এই বিশেষ ধর্মের নাম দেওয়া হলো ইলেকট্রিসিটি বা বৈদ্যুতিক শক্তি (Electricity)। অষ্টাদশ শতাব্দীতে এটি নিয়ে ব্যাপক গবেষণা হয় এবং বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেন এটি একই বলের দুটি ভিন্ন রূপ এবং এই বলটির নাম দেওয়া হয় বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় বল (Electromagnetism)। পরবর্তীতে তেজস্ক্রিয়তা আবিষ্কৃত হওয়ার পর বিটা রশ্মি নামে একটা বিশেষ বিকিরণ ব্যাখ্যা করার সময় দুর্বল নিউক্লিয় বল নামে নতুন এক ধরনের বল আবিষ্কৃত হয়। পদার্থবিজ্ঞানীরা পরে দেখালেন বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় বল এবং দুর্বল নিউক্লিয় বল একই বলের ভিন্ন ভিন্ন রূপ। তাদেরকে একত্র করে সেই বলের নাম দেওয়া হলো ইলেকট্রো উইক ফোর্স। পদার্থবিজ্ঞানীরা ধারণা করেন, প্রকৃতিতে মহাকর্ষ বল এবং নিউক্লিয়ার বল নামে আরো যে দুটি বল রয়েছে ভবিষ্যতে সেগুলোও একই সূত্রের আওতায় আনা যাবে।
পদার্থবিজ্ঞান এভাবেই একের পর এক প্রকৃতির রহস্য উন্মোচন করে যাচ্ছে। একইভাবে বলা যায় একটি বস্তু তৈরি হয়েছে অণু দিয়ে, পরবর্তীতে দেখা গেছে অণুগুলো মৌলগুলোর পরমাণু দিয়ে তৈরি। পরমাণুগুলো চার্জ নিরপেক্ষ হলেও তার কেন্দ্রে রয়েছে পজিটিভ চার্জের নিউক্লিয়াস এবং তাকে কেন্দ্ৰ করে ইলেকট্রনগুলো ঘুরছে। ইলেকট্রন একটি মৌলিক কণা হলেও দেখা গেল নিউক্লিয়াস প্রোটন এবং নিউট্রন দিয়ে তৈরি। পরবর্তীতে দেখা যায় নিউট্রন এবং প্রোটনও কোয়ার্ক নামে অন্য এক ধরনের মৌলিক কণা দিয়ে তৈরি। ইলেকট্রন এবং কোয়ার্ক স্ট্রিং দিয়ে তৈরি কিনা সেটি বর্তমান সময়ের গবেষণার বিষয়।
সৃষ্টির আদিকাল থেকে আমরা জানি যে উপর থেকে কিছু ছেড়ে দিলে সেটি নিচে পড়বে এবং সেটি দেখে আমরা অনুমান করতে পারি যে পৃথিবীর সবকিছুই তার নিজের দিকে আকর্ষণ করছে। পদার্থবিজ্ঞান যদি শুধু মাধ্যাকর্ষণ বলের অস্তিত্বের কথা ঘোষণা করে থেমে যায় তাহলে সেটি মোটেও যথেষ্ট নয়। একটি নির্দিষ্ট ভরের বস্তুকে অন্য নির্দিষ্ট ভর কতটুকু বল দিয়ে আকর্ষণ করে এবং দূরত্বের সাথে সেটি কীভাবে পরিবর্তিত হয় সেটি নিখুঁতভাবে না জানা পর্যন্ত এই জ্ঞানটুকু পূর্ণ হয় না। নিউটন মহাকর্ষ বলের সূত্র দিয়ে অত্যন্ত সঠিকভাবে প্রকৃতির এই নিয়মটি ব্যাখ্যা করেছেন। প্রকৃতির নিয়মটি সঠিকভাবে জানা হলে সেটি অন্য অনেক জায়গায় প্রয়োগ করে ব্যবহার করা যায়। কাজেই মহাকর্ষ বলের সূত্র দিয়ে যেরকম একটি পড়ন্ত বস্তুর গতি ব্যাখ্যা করা যায়, ঠিক সেরকম সূর্যকে ঘিরে পৃথিবীর প্রদক্ষিণকেও ব্যাখ্যা করা যায়। প্রকৃতির এই নিয়মগুলো সঠিকভাবে জানার জন্য বিজ্ঞানীরা সেটি যেরকম যুক্তিতর্ক দিয়ে বিশ্লেষণ করেছেন, ঠিক সেরকম ল্যাবরেটরিতে নানা ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষাও করে যাচ্ছেন। পদার্থবিজ্ঞানের বিস্ময়কর সাফল্যের পেছনে যেরকম তাত্ত্বিক গবেষণা হয়েছে ঠিক সেরকম রয়েছে পরীক্ষা-নিরীক্ষা। এই দুটি ভিন্ন ধারায় গবেষণা করে প্রকৃতির নিয়মগুলো খুঁজে বের করা পদার্থবিজ্ঞানের মূল উদ্দেশ্য।
আইনস্টাইন তার থিওরি অব রিলেটিভিটি থেকে সূত্রটি বের করে দেখিয়েছিলেন, ভরকে শক্তিতে রূপান্তর করা যায়। 1938 সালে অটোহান এবং স্ট্রেসম্যান একটি নিউক্লিয়াসকে ভেঙে দেখান যে নিউক্লিয়াসের ভর যেটুকু কমে গিয়েছে সেটা শক্তি হিসেবে বের হয়েছে। এই সূত্রটি ব্যবহার করে নিউক্লিয়ার বোমা তৈরি করে সেটি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ হিরোশিমা এবং নাগাসাকিতে ফেলে মুহূর্তের মাঝে লক্ষ লক্ষ মানুষ মেরে ফেলা সম্ভব হয়েছিল। শুধু যে মারণাস্ত্র তৈরি করা সম্ভব তা নয়, এই শক্তি মানুষের কাজেও লাগানো সম্ভব। এই সূত্র ব্যবহার করে নিউক্লিয়ার বৈদ্যুতিক কেন্দ্র (Nuclear Power Plant ) তৈরি করা হয় এবং আমাদের রূপপুরেও সেরকম একটি নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি হতে যাচ্ছে।
পদার্থবিজ্ঞানের একটি শাখা হচ্ছে কঠিন অবস্থার পদার্থবিজ্ঞান এবং সেখানে অর্ধপরিবাহী নিয়ে কাজ করা হয়। এই অর্ধপরিবাহীর সাথে বিশেষ মৌল মিশিয়ে তাদের যুক্ত করে ট্রানজিস্টার তৈরি করা হয়। এই প্রযুক্তি দিয়ে ইলেকট্রনিকসের একটি অভাবনীয় উন্নতি হয়েছে এবং বর্তমান সভ্যতায় এই ইলেকট্রনিকসের একটি অনেক বড় অবদান রয়েছে।
আমরা এভাবে দেখাতে পারব প্রযুক্তির প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই পদার্থবিজ্ঞানের ছোট কিংবা বড় অবদান রয়েছে। শুধু চিকিৎসার ক্ষেত্রে পদার্থবিজ্ঞানের কী কী অবদান রয়েছে সেটি এই বইয়ের শেষ অধ্যায়ে দেখানো হয়েছে।
পানি ঠাণ্ডা হলে সেটা বরফ হয়ে যায়, গরম করলে সেটা বাষ্প হয়ে যায়—এটা আমরা সবাই জানি। মানুষ প্রাচীনকাল থেকেই এটা দেখে আসছে। এই জ্ঞানটুকু কিন্তু পুরোপুরি বিজ্ঞান হতে পারবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না আমরা বলতে পারব কোন অবস্থায় ঠিক কত তাপমাত্রায় পানি জমে বরফ হয় কিংবা সেটা বাড়িয়ে কোন অবস্থায় কত তাপমাত্রায় নিয়ে গেলে সেটা ফুটতে থাকে, বাষ্পে পরিণত হতে শুরু করে। তার অর্থ প্রকৃত বিজ্ঞান করতে হলে সবকিছুর পরিমাপ করতে হয়। বিজ্ঞানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে এই পরিমাপ করে সব কিছুকে নিখুঁতভাবে ব্যাখ্যা করা।
টেবিল ০১ঃSI ইউনিটে সাতটি ভিন্ন ভিন্ন ভৌত রাশি
রাশি | Unit | একক | Symbol |
দৈর্ঘ্য | meter | মিটার | m |
ভর | kilogram | কিলোগ্রাম | kg |
সময় | second | সেকেন্ড | s |
বৈদ্যুতিক প্রবাহ | ampere | অ্যাম্পিয়ার | A |
তাপমাত্রা | kelvin | কেল্ভিন | K |
পদার্থের পরিমান | mole | মোল | mol |
দীপন তীব্রতা | candela | ক্যান্ডেলা | cd |
এই জগতে যা কিছু আমরা পরিমাপ করতে পারি তাকে আমরা রাশি বলি। এই ভৌতজগতে অসংখ্য বিষয় রয়েছে, যা পরিমাপ করা সম্ভব। উদাহরণ দেওয়ার জন্য বলা যেতে পারে, কোনো কিছুর দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, উচ্চতা, আয়তন, ওজন, তাপমাত্রা, রং, কাঠিন্য, তার অবস্থান, বেগ, তার ভেতরকার উপাদান, বিদ্যুৎ পরিবাহিতা, অপরিবাহিতা, স্থিতিস্থাপকতা, তাপ পরিবাহিতা, অপরিবাহিতা, ঘনত্ব, আপেক্ষিক তাপ, চাপ গলনাঙ্ক, স্ফুটনাঙ্ক ইত্যাদি— অর্থাৎ আমরা বলে শেষ করতে পারব না। এক কথায় ভৌতজগতে রাশিমালার কোনো শেষ নেই। তোমাদের তাই মনে হতে পারে এই অসংখ্য রাশিমালা পরিমাপ করার জন্য আমাদের বুঝি অসংখ্য রাশির সংজ্ঞা আর অসংখ্য একক তৈরি করে রাখতে হবে! আসলে সেটি সত্যি নয়, তোমরা শুনে খুবই অবাক হবে (এবং নিশ্চয়ই খুশি হবে) যে মাত্র সাতটি রাশির সাতটি একক ঠিক করে নিলে সেই সাতটি একক ব্যবহার করে আমরা সবকিছু বের করে ফেলতে পারব। এই সাতটি রাশিকে বলে মৌলিক রাশি এবং এই মৌলিক রাশি ব্যবহার করে যখন অন্য কোনো রাশি প্রকাশ করি সেটি হচ্ছে লব্ধ রাশি। মৌলিক রাশিগুলো হচ্ছে দৈর্ঘ্য, ভর, সময়, বৈদ্যুতিক প্রবাহ, তাপমাত্রা, পদার্থের পরিমাণ এবং দীপন তীব্রতা। এই সাতটি মৌলিক রাশির আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সাতটি একককে বলে SI একক, (SI এসেছে ফরাসি ভাষার Systeme International d'Unites কথাটি থেকে) এবং সেগুলো টেবিলে দেখানো হয়েছে। পরের টেবিলে অনেক বড় থেকে অনেক ছোট কিছু দুরত্ব, ভর এবং সময় দেখানো হয়েছে।
টেবিল : অনেক বড় থেকে অনেক ছোট দূরত্ব, ভর এবং সময়
দূরত্ব | m | ভর | kg | সময় | s |
নিকটতম গ্যালাক্সি | আমাদের গ্যালাক্সি | বিগ ব্যাংয়ের সময় | |||
নিকটতম নক্ষত্র | সূর্য | ডাইনোসরের ধ্বংস | |||
সৌরজগতের ব্যাসার্ধ | পৃথিবী | মানুষের জন্ম | |||
পৃথিবীর ব্যাসার্ধ | জাহাজ | এক দিন | |||
এভারেস্টের উচ্চতা | হাতি | মানুষের হৃৎস্পন্দন | 1 | ||
ভাইরাসের দৈর্ঘ্য | মানুষ | মিউওনের আয়ু | |||
হাইড্রোজেন পরমাণুর ব্যাসার্ধ | ধূলিকণা | স্পন্দনকাল: সবুজ আলো | |||
প্রোটনের ব্যাসার্ধ | ইলেকট্রন | স্পন্দনকাল: এক MeV গামা রে |
পরিমাপের একক (Units of Measurements)
এই এককগুলোর ভেতর সেকেন্ড, মিটার এবং ক্যান্ডেলার পরিমাপ আগেই কয়েকটি ধ্রুব দিয়ে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছিল। 2019 সালের মে মাস থেকে কিলোগ্রাম, কেলভিন, মোল এবং অ্যাম্পিয়ারকেও পদার্থবিজ্ঞানের মৌলিক কিছু ধ্রুব ব্যবহার করে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। কাজেই এখন পৃথিবীর যে কোনো ল্যাবরেটরিতে এই ধ্রুবগুলো পরিমাপ করে সেখান থেকে সবগুলো এককের পরিমাপ অনেক সূক্ষ্মভাবে পরিমাপ করা সম্ভব হবে। সাতটি একক পরিমাপ করার জন্য যে মৌলিক ধ্রুবগুলোর মান চিরদিনের জন্য নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে সেগুলো 1.03 টেবিলে দেখানো হয়েছে।
টেবিল 1.03: সাতটি ধ্রুবের নির্দিষ্ট করে দেওয়া মান
ধ্রুব | মান |
আলোর বেগ (c) | 299,792,458 meter / second |
প্লাঙ্কের ধ্রুব (h) | joule.second
|
ইলেকট্রনের চার্জ (e) | coulomb |
পরমাণুর স্পন্দন (Δ) | 9,192,631,770 hertz |
বোল্টজম্যান ধ্রুব () | joule/kelvin |
এভোগাড্রোর ধ্রুব () | particles/mole |
বিকিরণ তীব্রতা () | 683 lumens / watt |
সেকেন্ড (s): সিজিয়াম 133 (Cs-133) পরমাণুর 9,192, 631,770 টি স্পন্দন সম্পন্ন করতে যে পরিমাণ সময় নেয় সেটি হচ্ছে এক সেকেন্ড।
মিটার (m): শূন্য মাধ্যমে এক সেকেন্ডের 299,792,458 ভাগের এক ভাগ সময়ে আলো যে দূরত্ব অতিক্রম করে সেটি হচ্ছে এক মিটার।
কিলোগ্রাম (kg): প্লাঙ্কের ধ্রুবকে দিয়ে ভাগ দিলে যে ভর পাওয়া যায় সেটি হচ্ছে এক কিলোগ্রাম।
অ্যাম্পিয়ার (A): প্রতি সেকেন্ডে সংখ্যক ইলেকট্রনের সমপরিমাণ চার্জ প্রবাহিত হলে সেটি হচ্ছে এক অ্যাম্পিয়ার।
মোল(Mol): যে পরিমাণ বস্তুতে এভোগাড্রোর ধ্রুব সংখ্যক কণা থাকে সেটি হচ্ছে এক মোল ।
কেলভিন (K): যে পরিমাণ তাপমাত্রার পরিবর্তনে তাপশক্তির joule পরিবর্তন হয় সেটি হচ্ছে কেলভিন।
ক্যান্ডেলা (candela): সেকেন্ডে বার কম্পনরত আলোর উৎস থেকে যদি এক স্টেরেডিয়ান (Sterndian ) ঘনকোণে এক ওয়াটের 683 ভাগের এক ভাগ বিকিরণ তীব্রতা পৌঁছায় তাহলে সেই আলোর তীব্রতা হচ্ছে এক ক্যান্ডেলা।
এক মিটার বলতে কতটুকু দূরত্ব বোঝায় বা এক কেজি ঠিক কতখানি ভর, কিংবা এক সেকেণ্ড কতটুকু সময়, এক ডিগ্রি কেলভিন তাপমাত্রা কতটুকু উত্তাপ কিংবা এক অ্যাম্পিয়ার কতখানি কারেন্ট অথবা এক মোল পদার্থ বলতে কী বোঝায় বা এক ক্যান্ডেলা কতখানি আলো সেটা সম্পর্কে তোমাদের সবারই একটা বাস্তব ধারণা থাকাউচিত! এই বেলা তোমাদের সেই বাস্তব ধারণাটা দেওয়ার চেষ্টা করে দেখা যাক। তোমাদের শুধু জানলে হবে না, খানিকটা কিন্তু অনুভবও করতে হবে। সাধারণভাবে বলা যায়:
• স্বাভাবিক উচ্চতার একজন মানুষের মাটি থেকে পেট পর্যন্ত দূরত্বটা মোটামুটি এক মিটার ।
এক লিটার পানির বোতলে কিংবা চার গ্লাসে যেটুকু পানি থাকে তার ভর হচ্ছে এক কেজির কাছাকাছি।
‘এক হাজার এক’ এই তিনটি শব্দ বলতে যেটুকু সময় লাগে সেটা মোটামুটি এক সেকেন্ড!
বলা যেতে পারে তিনটা মোবাইল ফোন একসাথে চার্জ করা হলে এক অ্যাম্পিয়ার বিদ্যুৎ ব্যবহার করা হয়। (মোবাইল ফোন 5 ভোল্টের কাছাকাছিতে চার্জ করা হয়। তাই এখানে খরচ হবে 5 ওয়াট। যদি বাসার লাইট, ফ্যান, ফ্রিজে 220 ভোল্টের কিছুতে এক অ্যাম্পিয়ার বিদ্যুৎ ব্যবহার হয় তখন কিন্তু খরচ হবে 220 ওয়াট!)
হাত দিয়ে আমরা যদি কারো জ্বর অনুভব করতে পারি, বলা যেতে পারে তার তাপমাত্রা এক কেলভিন বেড়েছে।
মোলটা অনুভব করা একটু কঠিন, বলা যেতে পারে একটা বড় চামচের এক চামচ পানিতে মোটামুটি এক মোল পানির অণু থাকে। এক কাপ পানিতে দশ মোল পানি থাকে।
একটা মোমবাতির আলোকে মোটামুটিভাবে এক ক্যান্ডেলা বলা যায়।
দেখতেই পাচ্ছ এর কোনোটাই নিখুঁত পরিমাপ নয় কিন্তু অনুভব করার জন্য সহজ। যদি এই পরিমাপ নিয়ে অভ্যস্ত হয়ে যাও, তাহলে ভবিষ্যতে যখন কোনো একটা হিসাব করবে, তখন সেটা নিয়ে তোমাদের একটা মাত্রাজ্ঞান থাকবে।
বিজ্ঞান বা পদার্থবিজ্ঞান চর্চা করার জন্য আমাদের নানা কিছু পরিমাপ করতে হয়। কখনো আমাদের হয়তো গ্যালাক্সির দৈর্ঘ্য মাপতে হয় () আবার কখনো একটা নিউক্লিয়াসের ব্যাসার্ধ মাপতে হয়(); দূরত্বের মাঝে এই বিশাল পার্থক্য মাপার জন্য সব সময়েই একই ধরনের সংখ্যা ব্যবহার করা বুদ্ধিমানের কাজ নয়, তাই আন্তর্জাতিকভাবে কিছু SI উপসর্গ বা গুণিতক (prefix) তৈরি করে নেওয়া হয়েছে। এই গুণিতক থাকার কারণে একটা ছোট উপসর্গ লিখে অনেক বড় কিংবা অনেক ছোট সংখ্যা বোঝাতে পারব। উপসর্গগুলো টেবিল 1.05 এ দেখানো হয়েছে। আমরা দৈনন্দিন জীবনে কিন্তু এগুলো সব সময় ব্যবহার করি। দূরত্ব বোঝানোর জন্য এক হাজার মিটার না বলে এক কিলোমিটার বলি। ক্যামেরার ছবির সাইজ বোঝানোর জন্য দশ লক্ষ বাইট না বলে এক মেগাবাইট বলি!
ডেকা | da | |
হেক্টা | h | |
কিলো | k | |
মেগা |
M | |
গিগা | G | |
টেরা | T | |
পেটা | P | |
এক্সা | E |
ডেসি | d | |
সেন্টি | c | |
মিলি | m | |
মাইক্রো | ||
ন্যানো | n | |
পিকো | p | |
ফেমটো | f | |
এটো | a |
আমরা জেনে গেছি যে আমাদের চারপাশে অসংখ্য রাশি থাকলেও মাত্র সাতটি একক দিয়ে এই রাশিগুলোকে পরিমাপ করা যায়। একটা রাশি কোন একক দিয়ে প্রকাশ করা যায়, সেটি আমাদের জানতেই হয়। প্রায় সময়েই রাশিটি কোন কোন মৌলিক রাশি (দৈর্ঘ্য L, সময় T, ভর M ইত্যাদি) দিয়ে কীভাবে তৈরি হয়েছে, সেটাও জানা থাকতে হয়। একটা রাশিতে বিভিন্ন মৌলিক রাশি কোন সূচকে বা কোন পাওয়ারে আছে, সেটাকে তার মাত্রা বলে। যেমন আমরা পরে দেখব বল হচ্ছে ভর এবং ত্বরণের গুণফল। ত্বরণ আবার সময়ের সাথে বেগের পরিবর্তনের হার। বেগ আবার সময়ের সাথে অবস্থানের পরিবর্তনের হার। কাজেই
বেগের মাত্রা ঃ দূরত্ব/সময় ==
ত্বরণের মাত্রা ঃ দূরত্ব/সময় *সময় = =
আমরা এই বইয়ে যখনই নতুন একটি রাশিমালার কথা বলব সাথে সাথেই তার মাত্রাটির কথা বলে দেওয়ার চেষ্টা করব। দেখবে সেটা সব সময় রাশিটিকে বুঝতে অন্যভাবে সাহায্য করবে। এই বইয়ে একটা রাশির মাত্রা বোঝাতে হলে সেটিকে তৃতীয় ব্র্যাকেটের (third bracket) ভেতর রেখে দেখানো হবে। যেরকম বল F হলে
এককের সংকেত লেখার জন্য নিচের পদ্ধতিগুলো অনুসরণ করা হয়ে থাকে:
1. কোনো রাশির মান প্রকাশ করার জন্য একটি সংখ্যা লিখে তারপর একটি ফাঁকা জায়গা (space) রেখে এককের সংকেতটি লিখতে হয়। যেমন কিংবা , শতকরা চিহ্নও (%) এই নিয়ম মেনে চলে। তবে ডিগ্রি (º) মিনিট (') এবং সেকেন্ড ('') লেখার সময় সংখ্যার পর কোনো ফাঁকা জায়গা বা space রাখতে হয় না।
2. গুণ করে পাওয়া লব্ধ লেখার সময় দুটি এককের মাঝখানে একটি ফাঁকা জায়গা বা space দিতে হয়। যেমন: 2.35 N m
3. ভাগ করে পাওয়া লব্ধ এককের বেলায় ঋণাত্মক সূচক বা ‘/’ (যেমন কিংবা ) দিয়েপ্রকাশ করা হয়।
4. প্রতীকগুলো যেহেতু গাণিতিক প্রকাশ, কোনো কিছুর সংক্ষিপ্ত রূপ নয়, তাই তাদের সাথে কোনো যতিচিহ্ন (.) বা full stop ব্যবহার হয় না।
5. এককের সংকেত লেখা হয় সোজা অক্ষরে যেমন মিটারের জন্য m, সেকেন্ডের জন্য s ইত্যাদি। তবে রাশির সংকেত লেখা হয় italic বা বাঁকা অক্ষরে। যেমন ভরের জন্য m, বেগের জন্য v ইত্যাদি ৷
6. এককের সংকেত ছোট হাতের অক্ষরে লেখা হয় যেমন cm, s, mol ইত্যাদি। তবে যেগুলো কোনো বিজ্ঞানীর নাম থেকে নেওয়া হয়েছে সেখানে বড় হাতের অক্ষর (নিউটনের নাম অনুসারে N) হবে। একাধিক অক্ষর হলে শুধু প্রথমটি বড় হাতের অক্ষর হবে (প্যাস্কেলের নামানুসারে গৃহীত একক Pa)
7. এককের উপসর্গ (k, G, M) এককের (m, W, Hz) সাথে কোনো ফাঁক ছাড়া যুক্ত হবে যেমন km, GW, MHz.
৪. কিলো () থেকে সব বড় উপসর্গ বড় হাতে হবে (M, G, T)।
9. এককের সংকেতগুলো কখনো বহুবচন হবে না (25 kgs নয় সব সময় 25 kg)
10. কোনো সংখ্যা বা যৌগিক একক এক লাইনে লেখার চেষ্টা করতে হবে। খুব প্রয়োজন হলে সংখ্যা এবং এককের মাঝখানে line break দেওয়া যেতে পারে।
একসময় পদার্থবিজ্ঞানের বিভিন্ন রাশি সূক্ষ্মভাবে মাপা খুব কষ্টসাধ্য ব্যাপার ছিল। আধুনিক ইলেকট্রনিকস নির্ভর যন্ত্রপাতির কারণে এখন কাজটি খুব সোজা হয়ে গেছে। আমরা এই বইয়ে যে পরিমাণ পদার্থবিজ্ঞান শেখার চেষ্টা করব তার জন্য দূরত্ব, ভর, সময়, তাপমাত্রা, বিদ্যুৎ প্রবাহ এবং ভোল্টেজ মাপলেই মোটামুটি কাজ চালিয়ে নিতে পারব। এগুলো মাপার জন্য আমরা কোন ধরনের যন্ত্রপাতি ব্যবহার করি সেগুলো সংক্ষেপে আলোচনা করা যাক:
ছোটখাটো দৈর্ঘ্য মাপার জন্য মিটার স্কেল ব্যবহার করা হয় এবং তোমরা সবাই নিশ্চয়ই মিটার স্কেল দেখেছ। 100 cm (সেন্টিমিটার) বা 1 m লম্বা বলে এটাকে মিটার স্কেল বলে। যেহেতু এখনো অনেক জায়গায় ইঞ্চি-ফুট প্রচলিত আছে (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি উদাহরণ দেশ!) তাই মিটার স্কেলের অন্যপাশে প্রায় সব সময় ইঞ্চি দাগ কাটা থাকে। এক ইঞ্চি সমান 2.54 cm
একটা স্কেলে সবচেয়ে যে সূক্ষ্ম দাগ থাকে আমরা সে পর্যন্ত মাপতে পারি। মিটার স্কেল সাধারণত মিলিমিটার পর্যন্ত ভাগ করা থাকে, তাই মিটার স্কেল ব্যবহার করে আমরা কোনো কিছুর দৈর্ঘ্য মিলিমিটার পর্যন্ত মাপতে পারি। অর্থাৎ আমরা যদি বলি কোনো কিছুর দৈর্ঘ্য 0.364 m তার অর্থ দৈর্ঘ্যটি হচ্ছে 36 সেন্টিমিটার এবং 4 মিলিমিটার। একটা মিটার স্কেল ব্যবহার করে এর চেয়ে সূক্ষ্মভাবে দৈর্ঘ্য মাপা সম্ভব নয়—অর্থাৎ সাধারণ স্কেলে আমরা কখনোই বলতে পারব না একটা বস্তুর দৈর্ঘ্য 0.3643 m কিন্তু মাঝে মাঝেই কোনো একটা অত্যন্ত সূক্ষ্ম কাজে আমাদের এ রকম সূক্ষ্মভাবে মাপা প্রয়োজন হয়, তখন ভার্নিয়ার (Vernier) স্কেল নামে একটা মজার স্কেল ব্যবহার করে সেটা করা যায়।
ধরা যাক কোনো বস্তুর দৈর্ঘ্য মিলিমিটারের 4 এবং 5 দুটি দাগের মাঝামাঝি কোথাও এসেছে অর্থাৎ বস্তুটির দৈর্ঘ্য 4 মিলিমিটার থেকে বেশি কিন্তু 5 মিলিমিটার থেকে কম। 4 মিলিমিটার থেকে কত ভগ্নাংশ বেশি সেটা বের করতে হলে ভার্নিয়ার স্কেল ব্যবহার করা যায়, এই স্কেলটা মূল স্কেলের পাশে লাগানো থাকে এবং সামনে-পেছনে সরানো যায় (চিত্র 1.05)। ছবির উদাহরণে দেখানো হয়েছে মূল স্কেলের 9 মিলিমিটার দৈর্ঘ্যকে ভার্নিয়ার স্কেলে দশ ভাগ করা হয়েছে। অর্থাৎ ভার্নিয়ার স্কেলের প্রত্যেকটা ভাগ হচ্ছে . আসল মিলিমিটার থেকে মিলিমিটার কম। যদি ভার্নিয়ার স্কেলের শুরুটা কোনো একটা মিলিমিটার দাগের সাথে মিলিয়ে রাখা হয় তাহলে তার পরের দাগটি সত্যিকার মিলিমিটার থেকে মিলিমিটার সরে থাকবে, এর পরেরটি মিলিমিটার সরে থাকবে, পরেরটি মিলিমিটার সরে থাকবে— অর্থাৎ কোনোটাই মূল স্কেলের মিলিমিটার দাগের সাথে মিলবে না, একেবারে দশ নম্বর দাগটি আবার মূল স্কেলের নর নম্বর মিলিমিটার দাগের সাথে মিলব
চিত্র 1.05: মূল এবং ভার্নিয়ার ফেল, যেটি নাড়ানো সম্ভব।
বুঝতেই পারছ ভার্নিয়ার স্কেলটা যদি আমরা এমনভাবে রাখি যে শুরুটা একটা মিলিমিটার দাগ থেকে শুরু না হয়ে একটু সরে (যেমন - mm) শুরু হয়েছে (চিত্র 1.06) তাহলে ঠিক যত সংখ্যক সরে শুরু হয়েছে ভার্নিয়ার স্কেলের তত নম্বর দাগটি মূল স্কেলের মিলিমিটার দাপের সাথে মিলে যাবে কাজেই ভার্নিয়ার স্কেল ব্যবহার করে দৈর্ঘ্য মাপা খুব সহজ। প্রথমে জেনে নিতে হয় ভার্নিয়ার স্কেলের একটি ভাগ এবং মূল স্কেলের একটি ভাগের মাঝে পার্থক্য কতটুকু—এটাকে বলে ভার্নিয়ার ধ্রুবক (Vernier Constant সংক্ষেপে VC)। মূল স্কেলের সবচেয়ে ছোট ভাগের (1 mm) দূরত্বকে ভার্নিয়ার স্কেলের ভাগের (1.05 এবং 1.06 চিত্রে 10) সংখ্যা দিয়ে ভাপ দিলেই এটা বের হয়ে যাবে। আমরা যে উদাহরণ নিয়েছি সেখানে এটার মান:
=0.1 mm =0.0001 m
কোনো দৈর্ঘ্য মাপার সময় মিলিমিটারের সর্বশেষ দাগ পর্যন্ত মেপে ভার্নিয়ার স্কেলের দিকে তাকাতে হয়। ভার্নিয়ার স্কেলের কোন দাগটি মূল স্কেলের মিলিমিটার দাগের সাথে হুবহু মিলে গেছে বা সমপাতন হয়েছে সেটি বের করে দাগ সংখ্যাকে ভার্নিয়ার ধ্রুবক দিয়ে পুণ দিতে হয়। মূল স্কেলে মাপা দৈর্ঘ্যের সাথে সেটি যোগ দিলেই আমরা প্রকৃত দৈর্ঘ্য পেরে যাব। চিত্র 1.06 এর শেষ স্কেলে যে দৈর্ঘ্য দেখানো হয়েছে আমাদের এই নিয়মে সেটি হবে 1.03 cm বা 0.013 m.
ভার্নিয়ার স্কেলের পরিবর্তে একটা স্কুকে ঘুরিয়ে (চিত্র 1.07) স্কেলকে সামনে-পেছনে নিয়েও স্কুগেজ (Screw Gauge) নামে বিশেষ এক ধরনের স্কেলে দৈর্ঘ্য মাপা হয়। এখানে ক্ষুয়ের ঘাট (thread) অত্যন্ত সুক্ষ্ম রাখা হয় এবং পুরো একবার ঘোরানোর পর স্কেল লাগানো ত্রুটি হয়তো 1mm অগ্রসর হয়। স্ক্রয়েরএই সরণকে স্ক্রয়ের পিচ (pitch) বলে। যে বৃত্তাকার অংশটি ঘুরিয়ে স্কেলটিকে সামনে- পেছনে নেওয়া হয় সেটিকে সমান 100 ভাগে ভাগ করা হলে প্রতি এক ঘর ঘূর্ণনের জন্য স্কেলটি 1 পিচের ভাগের এক ভাগ অগ্রসর হয়। অর্থাৎ এই স্কেলে = 0.01mm পর্যন্ত মাপা সম্ভব হতে পারে ।এটাকে স্কু-গজের ন্যূনাঙ্ক বলে।
আজকাল ভার্নিয়ার স্কেলের পরিবর্তে ডায়াল লাগানো কিংবা ডিজিটাল স্লাইড ক্যালিপার্স বের হয়েছে, যেটা দিয়ে সরাসরি নিখুঁতভাবে দৈর্ঘ্য মাপা যায়!
ভর সরাসরি মাপা যায় না তাই সাধারণত ওজন মেপে সেখান থেকে ভরটি বের করা হয়। আমরা যখন বলি কোনো একটা বস্তুর ওজন 1 gm বা 1 kg তখন আসলে বোঝাই বস্তুটির ভর 1 gm কিংবা 1 kg. এক সময় বস্তুর ভর মাপার জন্য নিক্তি ব্যবহার করা হতো, যেখানে বাটখারার নির্দিষ্ট ভরের সাথে বস্তুর ভরকে তুলনা করা হতো। আজকাল ইলেকট্রনিক ব্যালেন্সের (চিত্র 1.08) ব্যবহার অনেক বেড়ে গেছে। ব্যালেন্সের ওপর নির্দিষ্ট বস্তু রাখা হলেই ব্যালেন্সের সেন্সর সেখান থেকে নিখুঁতভাবে ওজনটি বের করে দিতে পারে।
চিত্র 1.08 : ডিজিটাল ওজন মাপার যন্ত্র।
সময় মাপার জন্য স্টপ ওয়াচ ব্যবহার করা হয় (চিত্র 1.09)। একসময় নিখুঁত স্টপ ওয়াচ অনেক মূল্যবান সামগ্রী হলেও, ইলেকট্রনিকসের অগ্রগতির কারণে খুব অল্প দামের মোবাইল টেলিফোনেও আজকাল অনেক সূক্ষ্ম স্টপ ওয়াচ পাওয়া যায় । স্টপ ওয়াচে যেকোনো একটি মুহূর্ত থেকে সময় মাপা শুরু করা হয় এবং নির্দিষ্ট সময় পার হওয়ার পর সময় মাপা বন্ধ করে কতখানি সময় অতিক্রান্ত হয়েছে সেটি বের করে ফেলা যায়। মজার ব্যাপার হচ্ছে, স্টপ ওয়াচ যত নিখুঁতভাবে সময় মাগতে পারে আমরা হাত দিয়ে কখনোই তত নিখুঁতভাবে এটা শুরু করতে বা থামাতে পারি না ।
চিত্র 1.09: থামা খড়ি বা স্টপ ওয়াচ।
ত্রুটি একটি নেতিবাচক শব্দ এবং “পরিমাপে ত্রুটি” বলা হলে আমাদের মনে হয়, যে মানুষটি পরিমাপ করেছে সে তার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন না করায় একটি ত্রুটি হয়েছে। বিষয়টি তা নয়, যে পরিমাপ করছে তার অবহেলার কারণে কখনো কখনো ত্রুটি হতে পারে কিন্তু আমাদের জানতে হবে যে আমরা যে যন্ত্রপাতি দিয়ে পরিমাপ করি সেগুলো কখনো নির্ভুল নয়। কাজেই কতটুকু নির্ভুলভাবে পরিমাপ করা সম্ভব তার একটি সীমা আছে অর্থাৎ পরিমাপে ত্রুটি থাকা খুবই স্বাভাবিক। তবে পরিমাপ কতটুকু নির্ভুল হয়েছে তারও একটি পরিমাপ থাকতে হয়। কাজেই একটা পরীক্ষা করে পরীক্ষার ফলাফলটি জানানোর সময় সেটি কতটুকু নির্ভুল সেটাও জানিয়ে দিতে পারলে ফলাফলের বিশ্বাসযোগ্যতা অনেক বেড়ে যায়। পরীক্ষার ফলাফলের নির্ভুলতা বের করার জন্য কিছু প্রচলিত নিয়ম জানা থাকলে তোমরাও তোমাদের পরীক্ষার ফলাফলের নির্ভুলতার একটা পরিমাপ দিতে পারবে।
ধরা যাক তুমি একটি স্কেল দিয়ে বস্তুর দৈর্ঘ্য মাগছ। বস্তুটির দৈর্ঘ্য কত নির্ভুলভাবে মাপতে পারবে সেটি নির্ভর করে তোমার স্কেলটিতে কত সুক্ষ্মভাবে দাগ কাটা হয়েছে তার ওপর। যদি প্রতি 1 cm পর পর দাগ কাটা থাকে তাহলে উত্তরটি অবশ্যই তুমি নির্দিষ্ট সংখ্যক cm এ প্রকাশ করবে। কিন্তু বস্তুর প্রকৃত দৈর্ঘ্যটি যে হুবহু সেই সংখ্যক cm ছিল তা কিন্তু নয়, সেটি সম্ভবত এর কাছাকাছি ছিল, কাজেই তোমার মাপা দৈর্ঘ্যটির ভেতর একটু অনিশ্চয়তা থাকা সম্ভব, সে কারণে প্রচলিত নিয়মে আমরা প্রকৃত উত্তরের সাথে সেই অনিশ্চয়তাটুকু যোগ করে দিই। অর্থাৎ আমরা যদি দেখি দৈর্ঘ্যটি 4 এর কাছাকাছি তাহলে আমরা বলব কস্তুটির দৈর্ঘ্য:
।
অর্থাৎ বস্তুটির দৈর্ঘ্য 3.5 cm থেকে 4.5 cm এর ভেতর যেকোনো মান হতে পারে।
আরও দেখুন...