মানবদেহের অঙ্গ ও তন্ত্র (Organ and Organ system )

অষ্টম শ্রেণি (মাধ্যমিক ২০২৪) - বিজ্ঞান (অনুসন্ধানী পাঠ) - Science (Investigative Study) - | NCTB BOOK
40
40

এক বা একাধিক টিস্যু দিয়ে তৈরি এবং নির্দিষ্ট কাজ করতে সক্ষম প্রাণিদেহের অংশবিশেষকে অঙ্গ বলে। দেহের অঙ্গসমূহ নিয়ে জীববিজ্ঞানের যে শাখায় আলোচনা করা হয়, তাকে অঙ্গসংস্থানবিদ্যা বলে। অবস্থানভেদে মানবদেহে দুধরনের অঙ্গ আছে। চোখ, কান, নাক, হাত, পা, মাথা, এগুলো হচ্ছে বাহ্যিক অঙ্গ। পাকস্থলী, ডিওডেনাম, ইলিয়াম, মলাশয়, হৃৎপিণ্ড, অগ্ন্যাশয়, প্লীহা, ফুসফুস, বৃক্ক, শুক্রাশয়, ডিম্বাশয় এগুলো হচ্ছে মানবদেহের অভ্যন্তরীণ অঙ্গ। শরীরের বাইরের অঙ্গগুলো নিয়ে জীববিজ্ঞানের যে শাখায় আলোচনা করা হয়, তাকে বহিঃ অঙ্গসংস্থান আর ভিতরের অঙ্গগুলো নিয়ে যে শাখায় আলোচনা করা হয় তাকে অন্তঃ অঙ্গসংস্থান বলে।

তোমরা জানো পরিপাক, শ্বসন, রেচন, প্রজনন ইত্যাদি শারীরবৃত্তীয় কাজ করার জন্য প্রাণিদেহে কতগুলো অঙ্গের সমন্বয়ে বিভিন্ন তন্ত্র গঠিত হয়। ষষ্ঠ শ্রেণিতে তোমাদের মানবদেহের এরকম দশটি তন্ত্রের কথা বলা হয়েছিল। ইতোমধ্যে আগের শ্রেণিতে তোমাদের বেশ কয়েকটি তন্ত্রের কথা বলা হয়েছে। এখানে তোমাদের ত্বকতন্ত্র, শ্বসনতন্ত্র এবং রেচনতন্ত্রের কথা বলা হবে।

13.1 ত্বকতন্ত্র (Integumentary system)

আমাদের শরীরের একেবারে বাইরের আবরণটি হচ্ছে ত্বক। এই ত্বক আমাদের শরীরকে রোদ-তাপ, জীবাণুর আক্রমণ কিংবা আঘাত ইত্যাদি থেকে রক্ষা করে। এটি শরীরের ভেতরকার জলীয় বাষ্পকে শরীরের ভেতরে সংরক্ষণ করে এবং আমাদের শরীরের তাপমাত্রাকে নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে। ত্বক আমাদের স্পর্শের অনুভূতি দেয় এবং আমরা উষ্ণ কিংবা শীতল তাপমাত্রার অনুভূতিও এই ত্বকের মাধ্যমে পেয়ে থাকি।

আমাদের শরীরের বাইরের আবরণ রয়েছে ত্বক, নখ, চুল, গ্রন্থি, ত্বকের ভেতরকার স্নায়ু এবং রক্তনালি; এবং এইসব মিলিয়ে গঠিত হয়েছে আমাদের ত্বকতন্ত্র। মানবদেহের সবচেয়ে বড়ো তন্ত্র হচ্ছে এই ত্বকতন্ত্র এবং নিচে এই তন্ত্রের বিভিন্ন অঙ্গাণুর সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেয়া হলো।

13.1.1 ত্বক (skin)

একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের দেহ-ত্বকের ওজন প্রায় তিন কেজির কাছাকাছি। এটি প্রায় 2 মিলিমিটার পুরু; প্রয়োজনে কোথাও কম পুরু (যেমন চোখের পাতা) এবং কোথাও বেশ পুরু (যেমন-পায়ের তলা)।

মানুষের ত্বক বা চামড়া তিন স্তরে বিভক্ত: 

ক) এপিডার্মিস এটি একেবারে উপরের স্তর। ত্বকের এই স্তরটিকে আমরা দেখতে পাই এবং স্পর্শ করতে পারি। এটি আমাদের গায়ের রং নির্ধারণ করে এবং শরীরের পানি প্রতিরোধক একটি আবরণ হিসেবে কাজ করে। 

খ) ডার্নিস: এটি এপিডার্মিসের পরবর্তী স্তর। এই স্তরটি সবচেয়ে পুরু এবং এর মাঝে লোমের গোড়া, ঘাম ও তেলগ্রন্থি অবস্থিত। 

গ) হাইপোডার্মিস: এটি হচ্ছে ত্বকের সবচেয়ে নিচের স্তর। এটি মূলত চর্বি দিয়ে গঠিত এবং এই স্তর আমাদের তাপমাত্রার তারতম্য থেকে রক্ষা করে।

13.1.2 নখ 

নখ আমাদের হাত ও পায়ের আঙুলকে সুরক্ষা দেয়। এটি পাঁচ ভাগে বিভক্ত: 

ক) নেল প্লেট: নখের শক্ত অংশটুকু যেটা আমরা দেখতে পাই তাকে নেল প্লেট বলে। 

খ) নেল বেড: নখের নিচে চামড়ার আবরণটি হচ্ছে নেল বেড। 

গ) কিউটিকল: নখের গোড়ার পাতলা চামড়াটিকে কিউটিকল বলা হয়। 

ঘ) ম্যাট্রিক্স: নখের গোড়া যেটি নখের বৃদ্ধি ঘটায় সেটি হচ্ছে ম্যাট্রিক্স। 

ঙ) লুনুলা: নখের সাদা অগ্রভাগকে লুনুলা বলা হয়।

13.1.3 চুল 

চুল আমাদের মাথার তাপমাত্রা সংরক্ষণে সহায়তা করে। চোখের ভুরু এবং পাতা চোখকে ধুলাবালি। থেকে রক্ষা করে। চুল কেরাটিন নামক প্রোটিন দিয়ে তৈরি। এটি তিন ভাগে বিভক্ত:

ক) হেয়ার শ্যাফট: চুলের এই অংশটুকু আমরা দেখতে পাই। 

খ) হেয়ার ফলিকন: এটি হচ্ছে ত্বকে ক্ষুদ্র টিউবের মতো একটি গঠন, যেখানে চুলটি থাকে। 

গ) হেয়ার বাল্ব: চামড়ার নিচে চুলের যে অংশ চুলকে বৃদ্ধি পেতে সাহায্য করে তাকে হেয়ার বাল্ব বলে।

13.1.4 গ্রন্থি

ত্বকের সর্বত্র নানারকম গ্রন্থি রয়েছে যেগুলো থেকে জলীয়, তৈলাক্ত কিংবা লবণাক্ত দ্রব্য চামড়ার ভেতর থেকে চামড়ার ওপর নির্গত হয়। ত্বকতন্ত্র নিচের গ্রন্থিগুলো দিয়ে গঠিত:

ক) সুডোরিফেরাস গ্রন্থি: এগুলো আমাদের শরীর থেকে ঘাম নির্গত করে। 

খ) সেরাকিউস গ্রন্থি: এগুলো শরীর থেকে তৈলাক্ত পদার্থ নির্গত করে। 

গ) সেরামিউনাস গ্রন্থি: এগুলো আমাদের কানে ইয়ার ওয়াক্স নির্গত করে। 

ঘ) ম্যামারি গ্রন্থি: এগুলো মানুষের বুকে থাকে এবং মায়ের বুকের দুধ এই গ্রন্থি থেকে নির্গত হয়।

13.1.5 ত্বকতন্ত্রের কাজ

ত্বক আমাদের শরীরের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি তন্ত্র। ত্বককে অনেক সময় বাইরের বৈরী পরিবেশের বিরুদ্ধে শরীরের প্রথম প্রতিরোধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ত্বকতন্ত্র আমাদের জীবাণুর আক্রমণ থেকে রক্ষা করে, আঘাত কিংবা ক্ষতস্থানের সংক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সৃষ্টি করে এবং আঘাত নিরাময় করে। এটি সূর্যের ক্ষতিকর অতিবেগুনি রশ্মি থেকেও শরীরকে রক্ষা করে।

আমরা ত্বকের মাধ্যমে চাপ তাপ ইত্যাদি অনুভূতি অনুভব করি এবং বিপজ্জনক পরিস্থিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়ে শরীরকে নিরাপদ রাখতে পারি। ত্বক ঘামের ভেতর দিয়ে শরীরের বর্জ্য নিষ্কাশন করে এবং একই সঙ্গে শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে শরীরকে শীতল রাখে। আমাদের ত্বক চর্বি, পানি, গ্লুকোজ ইত্যাদি সংরক্ষণ করে এবং ভিটামিন ডি প্রস্তুত করে যা আমাদের শরীরের হাড়ের গঠনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

আমাদের শরীর প্রকৃতপক্ষে একটি অত্যন্ত জটিল সিস্টেম এবং এখানে সবকটি তন্ত্র একে অন্যকে সাহায্য করে মানব দেহকে সচল রাখে।

13.2 শ্বসনতন্ত্র (Respiratory system)

বেঁচে থাকার জন্য সকল প্রাণী অক্সিজেন গ্রহণ করে থাকে। শ্বসন প্রক্রিয়ায় বাতাসের সঙ্গে আমাদের ফুসফুসে অক্সিজেন প্রবেশ করে এবং তা রক্তের মাধ্যমে বাহিত হয়ে দেহের সব অঙ্গের সব কোষে পৌঁছায়। শ্বসনতন্ত্রের মাধ্যমে গ্রহণ করা এই অক্সিজেনের সাহায্যে মানুষের দেহকোষে সঞ্চিত খাদ্য জারণ প্রক্রিয়ায় শক্তি উৎপাদন করে, যে শক্তি আমাদের শরীরের দৈনন্দিন কাজে সহায়তা করে থাকে। 

মানুষের শ্বসনতন্ত্রকে তিনটি অঞ্চলে ভাগ করে বর্ণনা করা যায়।

মানুষের শ্বসনতন্ত্র

13.2.1 বায়ু গ্রহণ ও ত্যাগ অঞ্চল (Air intake and discharge zone)

সম্মুখ নাসারন্ধ্র (Anterior nastrils): নাকের সামনে অবস্থিত পাশাপাশি দুটি ছিদ্রকে সম্মুখ নাসারন্ধ্র বলে। এই নাসারন্ধ্র দুটি সবসময় খোলা থাকে এবং এই পথেই দেহের অভ্যন্তরে বায়ু প্রবেশ করে থাকে।

ডেস্টিবিউন (Vestibule): নাসারন্ধ্রের পরে নাকের ভিতরের অংশটির নাম ভেস্টিবিউল। ভেস্টিবিউল দুইটির প্রাচীরে অনেক লোম থাকে। এই অংশ আর্দ্র ও লোমগুলো ছাঁকনির মতো হওয়ায় গৃহীত বাতাসের ধূলাবালি ও রোগজীবাণুও আটকে যায়।

নাসাগহ্বর (Nasal cavity): ভেস্টিবিউলের পরের গুরুত্বপূর্ণ অংশটি হচ্ছে নাসাগহ্বর। নাসাগহ্বরের প্রাচীরে সূক্ষ্ম ছোট ছোট লোমের মত সিলিয়াযুক্ত, মিউকাস ক্ষরণকারী এবং ঘ্রাণ উদ্দীপক অলফ্যাক্টরী (Olfactory) কোষ থাকে। এটি প্রশ্বাসের সাথে আগত বায়ুকে কিছুটা সিক্ত করে দেয়। সিলিয়াযুক্ত ও মিউকাস কোষগুলো ধুলাবালি এবং রোগজীবাণুও আটকে দেয় এবং অলফ্যাক্টরি কোষ ঘ্রাণ অনুভব করার প্রয়োজনীয় উদ্দীপনা মস্তিষ্কে প্রেরণ করে।

নাসাগনবিন (Nasopharynx): নাসা গহ্বরদুটি পশ্চাৎ নাসারন্ধ্র নামে দুটি ছিদ্রের মাধ্যমে নাসাগলবিলে উন্মুক্ত হয় যেখানে বাতাস বাহিত হয়ে থাকে। নাসা গলবিলের পরে রয়েছে মুখ গলবিল (Oropharynx) যেখানে বাতাস এবং খাদ্য দুটিই বাহিত হয়। ল্যারিঞ্জোফেরিঙ্কস নামে গলবিলের শেষ অংশে খাদ্যনালি ও শ্বাসনালিতে প্রবেশ করার জন্য খাদ্য এবং বাতাস বিভক্ত হয়ে যায়।

স্বরযন্ত্র (Larynx): এটি গলবিলের একেবারে নিচের অংশের ঠিক সামনের দিকের অংশ। স্বরযন্ত্র কয়েকটি তরুণাস্থি টুকরা দিয়ে গঠিত। এগুলোর মধ্যে থাইরয়েড তরুণাস্থি সবচেয়ে বড়ো এবং এটি পুরুষের গলার সামনে উঁচু হয়ে থাকে, হাত দিলে এর অবস্থান বোঝা যায় এবং বাইরে থেকেও দেখা যায়, যেটি Adam's Apple নামে পরিচিত। স্বরযন্ত্রে অনেক পেশি যুক্ত থাকে। এর অভ্যন্তরভাগে থাকে মিউকাস আবরণী ও স্বররজ্জু (vocal cord)। টানটান অবস্থায় বাতাসের সাহায্যে স্বররজ্জু কম্পিত হয়ে শব্দ সৃষ্টি করে।

স্বরযন্ত্রের উপরে থাকে এপিগ্লটিস (epiglottis) নামে ঢাকনার আকৃতির একটি ছোটো তরুণাস্থি। এপিগ্লটিস খাদ্য গলাধঃকরণের সময় স্বরযন্ত্রের মুখটি বন্ধ করে দেয় যেন খাদ্য স্বরযন্ত্রে প্রবেশ করতে না পারে, যখন এর বিচ্যুতি ঘটে আমরা তখন বিষম খাই। অন্যসময় এটি শ্বসনের জন্য উন্মুক্ত থাকে

13.2.2 বায়ু পরিবহণ অঙ্কন (Air transport zone)

শ্বাসনানি (Windpipe/Trachea): স্বরযন্ত্রের পর প্রায় 12 সেমি, দীর্ঘ ও ৫ সেমি, ব্যাসবিশিষ্ট ফাঁপা নলাকার অংশকে শ্বাসনালি বা ট্রাকিয়া বলে। ট্রাকিয়া চুপসে যায় না বলে সহজে এর মধ্য দিয়ে বায়ু চলাচল করতে পারে। এর আন্তঃপ্রাচীরের অতি ক্ষুদ্র সূক্ষ্ম লোমের মতো সিলিয়া অবাঞ্ছিত বস্তুকে প্রবেশ করতে বাধা দেয়।

ব্রহ্মাস (Bronchus): বক্ষগহ্বরে ট্রাকিয়ার শেষ প্রান্ত দুটি (ডান ও বাম) শাখায় বিভক্ত হয়, এদের নাম ব্রঙ্কাস (বহুবচন ব্রঙ্কাই, bronchi)। ডান ব্রঙ্কাসটি অপেক্ষাকৃত ছোট কিন্তু প্রশস্ত এবং তিনভাগে ভাগ হয়ে ডান ফুসফুসের তিনটি খণ্ডে প্রবেশ করে। বাম ব্রঙ্কাসটি দুভাগে ভাগ হয়ে বাম ফুসফুসের দুটি খন্ডে প্রবেশ করে। ফুসফুসের অভ্যন্তরে প্রতিটি ব্রঙ্কাস পুনঃপুন বিভক্ত হয়ে অসংখ্য ক্ষুদ্রাকার ব্রঙ্কিওল (bronchiole) নামে অসংখ্য সূক্ষ্ম নালি গঠন করে।

13.2.3 শ্বসন অঙ্কন (Respiratory zone):

ফুসফুস (Lungs):

ফুসফুস সংখ্যায় দুটি এবং এগুলো হালকা গোলাপি রঙের স্পঞ্জের মতো নরম অঙ্গ। বাম ফুসফুসটি আকারে ছোটো, এটি দুই লোববিশিষ্ট এবং ডান ফুসফুস আকারে বড়ো, এটি তিন লোববিশিষ্ট। নিঃশ্বাস- প্রশ্বাসের সঙ্গে সঙ্গে ফুসফুসের লোব দুটি সংকুচিত এবং প্রসারিত হয়। এর ভিতরের অংশ পিচ্ছিল। বিভাজিত ব্রঙ্কিওল নালিগুলো ফুসফুসের কার্যকরী একক ক্ষুদ্রকায় লোবিওল (lobule) এর সঙ্গে সংযুক্ত থাকে। লোবিওলগুলোর আকৃতি একগুচ্ছ অতিক্ষুদ্র বেলুনের মত যেখানে প্রশ্বাসের মাধ্যমে গ্রহণ করা অক্সিজেন এবং শরীরে সৃষ্ট হওয়া কার্বন ডাইঅক্সাইডের বিনিময় ঘটে থাকে। অক্সিজেন রক্তে প্রবেশ করে এবং বর্জ্য হিসেবে কার্বন ডাইঅক্সাইড রক্ত থেকে বের হয়ে নিঃশ্বাসের মাধ্যমে শরীর থেকে নির্গত হয়ে যায়।

তোমরা দেখতে পাচ্ছ শ্বসনতন্ত্রের বিভিন্ন অঙ্গগুলো সমন্বিতভাবে কাজ করে আমাদের শরীরে শক্তি সৃষ্টি করার জন্য অক্সিজেন সরবরাহ নিশ্চিত করা থাকে। মানুষের পৃথিবীতে বেঁচে থাকার জন্য শ্বসনতন্ত্রের উপর নির্ভরশীল। কাজেই শ্বসনতন্ত্রকে সুস্থ রাখার জন্য আমাদের সবারই সচেষ্ট থাকা দরকার। ধূমপান না করা, বায়ুদূষণ থেকে দূরে থাকা এবং খেলাধুলা ও নিয়মিত ব্যায়াম করে ফুসফুসকে সতেজ রেখে আমরা আমাদের শ্বসনতন্ত্রকে সুস্থ রাখতে পারি।

13.3 রেচনতন্ত্র (Excretory system)

বেচনতন্ত্র

তোমরা এই অধ্যায়ে ত্বকতন্ত্র ও শ্বসনতন্ত্র সম্পর্কে যখন জেনেছ তখন নিশ্চয় বুঝেছ যে তাদের কাজের মধ্যে দিয়ে আমাদের শরীর থেকে বর্জ্য অপসারিত হয়। ত্বকের গ্রন্থি ঘামের মাধ্যমে বর্জ অপসারণে ভূমিকা রাখে। আর ফুসফুসের অন্যতম কাজ হচ্ছে বায়বীয় বর্জ্য হিসেবে কার্বন ডাইঅক্সাইড নিষ্কাশন করা। তার মানে এই অঙ্গগুলো রেচনতন্ত্রের অংশ। আমার এই অধ্যায়ে দেখব যে কিডনিও শরীরের এক ধরনের বর্জ অপসারণে কাজ করে, তবে এই ভিন্ন ভিন্ন তন্ত্রের অঙ্গগুলো একসঙ্গে কাজ করে না, প্রতিটি অঙ্গ অন্য অঙ্গ থেকে কম-বেশি স্বাধীনভাবে নিজেদের কাজ করে। আমাদের শরীর থেকে সম্পূর্ণ এবং সফল ভাবে সব ধরণের বর্জ্য সরানোর জন্য সবারই প্রয়োজন।

আমাদের শরীরের সকল অংশের বিভিন্ন ধরনের কোষে অনেক কাজ হয়, এইসব কাজ করতে গিয়ে কোষের ভেতরে নানা ধরনের নাইট্রোজেন ঘটিত বর্জ্য পদার্থ তৈরি হয়। এসব বর্জ্য পদার্থ রক্তে পরিবাহিত হয়, এবং সাধারণত শরীরের জন্য ক্ষতিকর তাই শরীর থেকে বের করে দেয়ার প্রয়োজন হয়। শরীর থেকে এসব অপ্রয়োজনীয় বর্জ্য পদার্থ বের করে দেয়ার জন্য কিডনি দিয়ে যে রেচনতন্ত্র গঠিত সেখানে রয়েছে এক জোড়া বৃক্ক বা কিডনি, এক জোড়া রেচন নালি, একটি মূত্রথলি ও একটি মূত্রনালি।

রেচনতন্ত্রের অঙ্গসমূহ

রেচনতন্ত্রের গঠন

বৃক্ত (Kidney): বুকের পাঁজরের ঠিক নিচে, পেটের পেছনের দিকের অংশে, মেরুদণ্ডের দুপাশে দুটি বৃক্ক বা কিডনি থাকে। আগের শ্রেণিতে পরিপাকতন্ত্র পড়ার সময় তোমরা যকৃতের কথা জেনেছ। যকৃতের আকার বেশ বড়ো, এটি পেটের ভেতর ডানপাশে থাকে বলে আমাদের ডান বৃক্কটি বাম বৃক্কের তুলনায় সামান্য নিচে অবস্থান করে। বৃক্ক যেহেতু এই রেচনতন্ত্রের মূল অঙ্গ তাই নিচে তার গঠন এবং কার্য পদ্ধতি নিচে আরেকটু বিস্তৃত ভাবে আলোচনা করা হয়েছে।

রেচন নানি বা ইউরেটার (Ureter): যে দুইটি সরু নালি বৃক্ক থেকে মূত্রথলিতে মূত্র পরিবহন করে তাদেরকে রেচন নালি বা ইউরেটার বলে। প্রত্যেকটি রেচন নালি দৈর্ঘ্যে প্রায় 25 সেন্টিমিটার।

মূত্রথলি (Urinary Bladder): মূত্রথলি পাতলা প্রাচীরবিশিষ্ট এবং এক ধরনের অনৈচ্ছিক পেশি দিয়ে তৈরি একটি ত্রিকোণাকৃতির থলি। এটি প্রয়োজনে সংকোচন কিংবা প্রসারণ করতে পারে। সুবিধাজনক সময়ে নিষ্কাশন করার জন্য সাময়িকভাবে মূত্র জমিয়ে রাখা হচ্ছে মূত্রথলির কাজ। মূত্রথলি প্রায় 700750- মিলিলিটার মূত্র জমা রাখতে পারে।

মূত্রনালি বা ইউরেথ্রা (Urethra): মূত্রথলি থেকে মূত্র যে নালির ভেতর দিয়ে লিঙ্গের মধ্য দিয়ে বাহিত হয়ে শেষ পর্যন্ত একটি ছিদ্রের মাধ্যমে বাইরে উন্মুক্ত হয় তাকে মূত্রনালি বলে। প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের দেহে এ নালির দৈর্ঘ্য 1819- সেন্টিমিটার। নারীদের দেহে মূত্রনালির দৈর্ঘ্য মাত্র 34- সেন্টিমিটার।

বৃক্ক বা কিডনির গঠন ও কার্যপদ্ধতি:

বাহ্যিক গঠন: প্রতিটি বৃক্ক বা কিডনি নিরেট, চাপা এবং এর বাইরের দিক উত্তল ও ভিতরের দিক অবতল অর্থাৎ এটি দেখতে অনেকটা শিম বীজের মতো। তবে এটি শিম বীজের মত ক্ষুদ্রাকায় নয়, পরিণত বৃক্ক বা কিডনির দৈর্ঘ্য 1012- সেন্টিমিটার, প্রস্থ 56- সেন্টিমিটার এবং স্থূলত্ব প্রায় 3 সেন্টিমিটার। এটি কালচে লাল রঙের। কিডনির অবতল অংশের ভাঁজকে হাইলাম বলে। হাইলামের মধ্য দিয়ে রেনাল ধমনি কিডনিতে প্রবেশ করে এবং রেনাল শিরা ও ইউরেটার দিয়ে বের হয়। পুরো বৃক্ক বা কিডনিটি ক্যাপসুল নামের তন্ত্রময় যোজক টিস্যু দিয়ে সুদৃঢ় একটি আবরণে ঢাকা থাকে।

অন্তর্গঠন: কিডনিকে লম্বচ্ছেদ করা হলে কর্টেক্স, মেডুলা এবং পেলভিস নামে তিনটি অংশ সুস্পষ্টভাবে দেখা যায়। বাইরে অবস্থিত অপেক্ষাকৃত গাঢ় অঞ্চলটি কর্টেক্স। কর্টেক্সের নিচে রয়েছে হালকা লাল রঙের মেডুলা, মেডুলা মূলত ৪1৪-টি পিরামিড আকৃতির অংশ নিয়ে গঠিত, এগুলোকে বলে রেনাল পিরামিড। বৃক্কের ভেতরে ইউরেটারের সাদাটে অংশটি উপর দিকে ফানেলের মতো প্রসারিত হয় যেটাকে রেনাল পেলভিস বলে।

বৃক্ক বা কিডনিতে রক্ত পরিশুদ্ধ করার কার্যকর এককটির নাম নেফ্রন (Nephron), প্রতিটি বৃক্ক বা কিডনিতে প্রায় দশ লক্ষ নেফ্রন রয়েছে। রেনাল ধমনি কিডনিতে প্রবেশ করে বারবার বিভক্ত হয়ে সূক্ষ্ম রক্তনালিকা হিসেবে নেফ্রনের ভেতর প্রবেশ করে। নেফ্রনের ভেতর যে সূক্ষ্ম রক্তজালিকা রক্তকে ছেঁকে তার থেকে বর্জ্য ও তরলকে আলাদা করে সেই অংশটির নাম গ্লমেরুলাস (glomerulus)। রক্ত থেকে পরিদ্রুত এই তরল রেনাল টিউব্যুল নামে একটি বৃক্কনালিকার ভেতর দিয়ে যাওয়ার সময় আর কয়েকবার শোষণ ও নিঃসরণ প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যায়, পরিশেষে পাশাপাশি থাকা রক্ত নালিকার ভেতরে গ্লুকোজ, খনিজ লবণ, পানি ফিরিয়ে দিয়ে শুধু বর্জ্য পদার্থকে মূত্র হিসেবে অপসারণ করে।

কিডনিতে মূত্র তৈরি হবার পর রেনাল পেলভিস অতিক্রম করে ইউরেটার বা মূত্রনালিতে প্রবাহিত হয়। পেলভিস ও ইউরেটারের প্রাচীরে থাকা সংকোচন ও প্রসারণ করতে সক্ষম অনৈচ্ছিক পেশির সংকোচন ও প্রসারণের ফলে মূত্র মূত্রথলির দিকে প্রবাহিত হয়।

কিডনির রক্ত পরিশোধনের ধাপসমূহ

অন্যদিকে পরিশুদ্ধ রক্ত রেনাল শিরা দিয়ে শরীরে ফিরে যায়। প্রতি মিনিটে কিডনি প্রায় অর্ধেক কাপ রক্ত পরিশুদ্ধ করে, সে হিসেবে সারা দিন শরীরের পুরো রক্ত বেশ অনেকবার কিডনির ভেতর দিয়ে গিয়ে পরিশুদ্ধ হয়ে থাকে।

বৃক্ক বা কিডনির কাজ :

তোমরা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ কিডনি আমাদের শরীরের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। আমরা কিডনির কাজগুলোকে সংক্ষেপে এভাবে বর্ণনা করতে পারি।

  • শরীরের বিভিন্ন কোষে প্রোটিন বিপাকের ফলে তৈরি হওয়া নাইট্রোজেনজাত বর্জ্যপদার্থ অপসারণ করে।
  • খাবার ও অন্যান্য মাধ্যমে দেহে প্রবেশ করা বিষাক্ত পদার্থ শরীর থেকে বের করে দেয়।
  • দেহ এবং রক্তে পানির ভারসাম্য, রক্তে অম্ল ও ক্ষারের ভারসাম্য এবং শরীরে বিভিন্ন আয়নের ভারসাম্য রক্ষা করে।
  • শরীরের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হরমোন এবং এনজাইম বা উৎসেচক ক্ষরণ করে।

রক্তে সোডিয়াম, পটাসিয়াম, ক্যালসিয়াম, ফসফেট এবং ক্লোরাইডসহ বিভিন্ন খনিজ উপাদানের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করে এবং রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে।

Content added By
Promotion