ইসলামি যাকাত ব্যবস্থা সমাজে প্রচলিত থাকলে, সমাজের দরিদ্র ও অভাবী মানুষের নানাবিধ সমস্যার সমাধান হবে। আবার ধনীরাও তাদের দায়মুক্ত হওয়ার বিশেষ সুযোগ পাবে । কাজেই ইসলামে যাকাতের অনেক গুরুত্ব রয়েছে । নিম্নে যাকাতের কতিপয় গুরুত্ব সম্পর্কে বর্ণনা করা হলো :
১. যাকাতের অর্থনৈতিক গুরুত্ব
যাকাতের অন্যতম গুরুত্ব হলো অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা করা। সমাজের কেউ সম্পদের পাহাড় গড়বে, সুউচ্চ ইমারতে বসবাস করবে, বিলাসবহুল জীবনযাপন করবে, আর কেউ অনাহারে, অর্ধাহারে দিন কাটাবে এমন বিধান ইসলামে নেই । কেউ শিক্ষা, খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান ইত্যাদি মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে পারবে না, আর বাড়ি বাড়ি ঘুরবে, শান্তি ও সাম্যের ধর্ম ইসলাম তা কিছুতেই সমর্থন করে না । কাজেই সকল শ্রেণির নাগরিকের মধ্যে অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষার জন্য ইসলাম ধনীদের উপর যাকাত ফরজ করেছে। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, “আল্লাহ তায়ালা লোকের উপর সাদাকা (যাকাত) ফরজ করেছেন । তা নেওয়া হবে ধনীদের থেকে এবং বিলিয়ে দেওয়া হবে দুস্থদের মধ্যে।” (বুখারি ও মুসলিম) সাধারণত মানুষের অর্থের প্রতি লিপ্সা থাকে । যে কৃপণ স্বভাবের হয়, সে নিজের কষ্টে উপার্জিত অর্থ নিঃস্বার্থভাবে কাউকে দিতে চায় না । তাই দয়াময় আল্লাহ তায়ালা সম্পদশালী ব্যক্তিদের মনকে সম্পদের লিপ্সা, লোভ, কৃপণতা, স্বার্থপরতা প্রভৃতি দোষ থেকে মুক্ত ও পবিত্র রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি মানুষের মনকে দয়া-মায়া, স্নেহ, মমতা ও ভালোবাসা ইত্যাদি মানবিক গুণসম্পন্ন করে তোলার জন্য তাদের উপর যাকাত ফরজ করে দিয়েছেন । সম্পদের প্রকৃত মালিক আল্লাহ তায়ালা । মানুষের নিকট তা আমানতস্বরূপ । মানুষ শ্রম ও মেধার দ্বারা সম্পদ অর্জন করবে এবং প্রয়োজন মোতাবেক সম্পদ খরচ করবে। কিন্তু সম্পদ জমা করে রাখা বা কেবল নিজের ভোগবিলাসের জন্য খরচ করা ইসলাম অনুমোদন করে না। কারণ ধনীদের সম্পদে দরিদ্রের অধিকার আছে, তা অবশ্যই আদায় করতে হবে। গরিবের অধিকার আদায় করলে মালিক দায়মুক্ত হবে, সম্পদ পবিত্র হবে; অন্যথায় সম্পদ হালাল হবে না। ইসলামি অর্থনীতিতে পুঁজিবাদ সমর্থন করা হয় না। যাকাত প্রথার মাধ্যমে অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা করা হয়।
হযরত মুহাম্মদ (স.) ও খুলাফায়ে রাশিদিনের যুগে সরকারি ব্যবস্থাপনায় যাকাত আদায় করা হতো। আদায়কৃত মালের বিতরণও সরকারি ব্যবস্থাপনায় হতো। নিসাবের নির্ধারিত পরিমাণ সম্পদের মালিকরা যাকাত দিতে বাধ্য থাকত। অন্যদিকে যারা যাকাত পাওয়ার হকদার (দাবিদার ) তারা সবাই যাকাতের অর্থ পেয়ে উপকৃত হতো। কুরআন ও হাদিসের নির্দেশ মোতাবেক যাকাত আদায় ও বিতরণ করা মুসলমানদের একটি পবিত্র দায়িত্ব । এ ব্যবস্থাপনার উপর মুসলমানদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক কল্যাণ অনেকাংশে নির্ভরশীল। মুসলিম সম্প্রদায় ইসলামি ব্যবস্থাপনায় যাকাত আদায় করলে সমাজে ধনী-দরিদ্রের পার্থক্য কমে আসবে; কেউ বেকার থাকবে না । বরং মুসলিম সমাজের অর্থনৈতিক অবস্থার দ্রুত উন্নতি হবে। অসহায় গরিব মানুষকে অর্থ দিয়ে সাহায্য করা একটি মানবিক দায়িত্ব । যাকাত প্রদানের মাধ্যমে এ মানবিক গুণের বিকাশ ঘটবে।
কাজ : শিক্ষার্থীরা দলে বিভক্ত হয়ে ‘যাকাতের অর্থনৈতিক' গুরুত্বের উপর আলোচনা করবে। |
২. যাকাতের সামাজিক গুরুত্ব
যাকাতের মাধ্যমে সমাজে ধনী-দরিদ্রের মধ্যকার বিরাজমান বৈষম্য দূর হয়। তাদের মধ্যে অর্থনৈতিক সমতার ক্ষেত্র প্রস্তুত হয় । আল্লাহর নির্দেশমতো যথাযথভাবে যাকাত প্রদান করলে সমাজের কোনো লোক অন্নহীন, বস্ত্রহীন, গৃহহীন থাকবে না । কেউ না খেয়ে থাকবে না । কেউ বিনা চিকিৎসায় কষ্ট পাবে না ।
সম্পদশালী ব্যক্তিদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় যাকাত ও সাদাকার (দানের) অর্থে অভাবীদের প্রয়োজন মিটিয়েও অনেক জনহিতকর এবং কল্যাণমূলক কাজ করা যায় । বহু দরিদ্র ব্যক্তিকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করে তোলা যায়। স্বাস্থ্যবান দরিদ্র শ্রমিককে তার শ্রমের উপযোগী উপকরণ দেওয়া সম্ভব হয় । দরিদ্রের জন্য সেবামূলক অনেক প্রতিষ্ঠান যেমন ইয়াতিমখানা, দাতব্য চিকিৎসালয় প্রভৃতি স্থাপন করা যায় । এমনিভাবে সম্মিলিত প্রচেষ্টা চালালে এমন এক সময় আসবে যখন যাকাত গ্রহণ করার লোক খুঁজে পাওয়া যাবে না। ইসলামের প্রথম যুগে এমন পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে অপূর্ব সাফল্য অর্জিত হয়েছিল। দৃষ্টান্তস্বরূপ খলিফা হযরত উমর ইবনে আব্দুল আজিজ (র.)-এর যুগের কথা উল্লেখ করা যায়। ইসলামি যাকাত ব্যবস্থা প্রচলনের ফলে, তাঁর যুগে যাকাত নেওয়ার মতো লোক খুঁজে পাওয়া কষ্টকর ছিল । ইসলামি যাকাত ব্যবস্থা গোটা সমাজকে কৃপণতা, সংকীর্ণতা, স্বার্থপরতা, হিংসা, বিদ্বেষ প্রভৃতি বদভ্যাস থেকে পবিত্র রাখে এবং পরস্পরের মধ্যে ভালোবাসা, ত্যাগ, মমত্ববোধ ইত্যাদি গুণ আরও সুদৃঢ় করে।
কাজ : শিক্ষার্থীরা দলে বিভক্ত হয়ে ‘যাকাতের সামাজিক গুরুত্বের' উপর আলোচনা করবে। |
আরও দেখুন...