অরগানমিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা ও অরগানমিক স্বাস্থ্যবিধি

এইচএসসি (বিএমটি) ভোকেশনাল - ডিজিটাল টেকনোলজি ইন বিজনেস-১ - ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহারে অস্বাস্থ্যকর কর্মপরিবেশ ও ঝুঁকিসমূহ | NCTB BOOK

প্রত্যহ দীর্ঘদিন কম্পিউটারের সামনে বসে কাজ করলে আমাদের শরীরে কিছু অঙ্গের উপর অত্যধিক চাপ এবং কম্পিউটার থেকে নিঃসৃত ইলেকট্রোম্যাগনেটিক রশ্মি আমাদের বিভিন্ন ক্ষতি করতে পারে। দীর্ঘদিন ধরে কম্পিউটার ব্যবহারের ফলে চোখ এবং শরীরের বিভিন্ন অংশে যে ধরনের যন্ত্রণা এবং অসুবিধা সৃষ্টি হয়,দীর্ঘদিনের গবেষণার পর বিজ্ঞানীরা তা প্রতিরোধ ও নিরাময়ের পথ খুঁজে বের করেছেন। বিজ্ঞানের যে শাখায় এসব শারীরিক অসুবিধা নিয়ে আলোচনা করা হয় তাকে বলা হয় অরগানমিকস (Ergonomics)। বিভিন্ন পেশার পেশাজীবীদের কর্মজীবনকে আরও স্বাচ্ছন্দ্যময় করার জন্যই বিজ্ঞানের এ শাখার উদ্ভব।

দ্রুত গতিতে টাইপ এবং মাউসে ঘন ঘন ক্লিক করে কম্পিউটারে কাজ করতে হয়। কম্পিউটারে কাজ করতে গিয়ে শরীরের পেশী এবং অস্থিসন্ধিকে একই পদ্ধতিতে বারবার চালনা করতে হয়। বারবার একই অঙ্গ প্রত্যঙ্গ চালনার বেশ কিছু কুফল বা শারীরিক সমস্যা আছে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের পরিভাষায় এই কুফল বা সমস্যাকে “রিপিটেটিভ স্ট্রেন ইনজুরি” বলা হয়। সমাজে কম্পিউটার প্রফেশনালরা এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে। কম্পিউটার ব্যবহারজনিত কারণে যে সব সমস্যা হতে পারে তা নিম্নে দেওয়া হলো।

১. মাথা ব্যথা।

২. চোখ ব্যথা ।

৩. ঘাড় এবং কাঁধ ব্যথা ।

৪. হাত, কনুই এবং কব্জি ব্যথা ।

৫. পিঠ, কোমর এবং পা ব্যথা ।

৬. হাঁটু, গোড়ালি এবং পায়ের পাতা ব্যথা।

উপরোক্ত সমস্যা সমূহ কী কী কারণে সৃষ্টি হয় তা নিম্নে দেওয়া হলো—

১. মাথা (Head) ব্যথা

• মনিটরের আকৃতি খুব ছোট হওয়া।

• মনিটরের কন্ট্রাস্ট নিম্নমানের বা রিফ্রেশ রেট কম হওয়া।

• মনিটর ব্যবহারকারীর খুব কাছাকাছি স্থাপন করা । 

• মনিটরে আলো বা অন্য কোন কিছুর প্রতিফলন হওয়া ।

• কক্ষের আলো খুব কম বা বেশি হওয়া।

• ফন্ট সাইজ খুব ছোট হওয়া।

২. চোখ (eye) ব্যথা

• মনিটরের খুব কাছে ব্যবহারকারীর আসন স্থাপন করা।

• দীর্ঘক্ষণ ধরে কাজ করা।

• মনিটর blinking করা।

• চশমা বা কন্টাক্ট লেন্স ব্যবহারকারী চিকিৎসকের পরামর্শ ব্যতিরেকেই কম্পিউটার ব্যবহার করা।

• কক্ষের আলো খুব কম বা বেশি হওয়া।

• মনিটরের কন্ট্রাস্ট নিম্নমানের (poor contrast) বা রিফ্রেশ রেট (refresh rate) কম হওয়া ।

৩. ঘাড় এবং কাঁধ (Neck & Shoulders) ব্যথা

• সঠিক উচ্চতায় মনিটর স্থাপন না করা।

• ব্যবহারকারীর আসন কম্পিউটার থেকে দূরে হওয়া। • কী-বোর্ডের তুলনায় মাউস অধিক উচ্চতায় রাখা ।

• সামনের দিকে ঝুঁকে (Leaning forward) কাজ করা ।

• মাথা কাত করে বা পিছনে হেলান দিয়ে (Tilting back) কাজ করা।

• সঠিক অঙ্গস্থিতি (posture) অর্থাৎ ব্যবহারকারীর স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ আসন বিন্যাস ।

ঘাড়ে এবং কানের কাছে টেলিফোন ধরা অবস্থায় কম্পিউটারে কাজ করা। কী-বোর্ডের অবস্থান অধিক দূরে হওয়া কিংবা অধিক নিচে বা উচ্চতায় স্থাপন করা।

টেলিফোন সেট বা ব্যবহার্য অন্যান্য যন্ত্রপাতি হাতের নাগালের বাহিরে স্থাপন করা। দূরদৃষ্টি ও ক্ষীণদৃষ্টি উভয়ের জন্য ব্যবহৃত চশমা (bifocal) ব্যবহার করে কাজ করা।

• ডকুমেন্ট নিচে রেখে টাইপ করা। অর্থাৎ, টাইপ করার সময় বারবার নিচের দিকে তাকানো।

৪. হাত কনুই এবং কব্জি (Hand, Elbows & Wrists) ব্যথা

কী-বোর্ড অধিক দূরে কিংবা অধিক নিচে বা উচ্চতায় স্থাপন করা। কী-বোর্ড সরাসরি ব্যবহারকারীর সামনে না রেখে একপাশে রাখা বা এক পাশ থেকে কাজ করা।

কী-বোর্ডের তুলনায় মাউস অধিক উচ্চতায় রাখা।

কনুইতে ভার (leaning on elbows) দিকে কাজ করা। মাউস, কী-বোর্ড, ক্যালকুলেটর ইত্যাদি বেশি ব্যবহার করা।

• কজি সঠিক অবস্থানে না থাকা অর্থাৎ উপরে, নিচে কিংবা একপাশে থাকা।

• মাউস সেট-আপ ঠিক না থাকা। অর্থাৎ বামহাতি ব্যবহারকারী ডানহাতের মাউস (right-hand mouse) ব্যবহার করা।

• শরীর থেকে হাতের কনুই অধিক দূরত্বে রাখা ।

• শক্ত বাটনবিশিষ্ট কী-বোর্ড, পয়েন্টিং ডিভাইস বা লাইট পেন ব্যবহার করা কিংবা বিরতিহীনভাবে কম্পিউটারে টাইপ করা।

• হাতের তালুর গোড়ার অংশে চাপ দিয়ে কিংবা টেবিলের প্রান্তে বা কোণায় হাত রেখে কাজ করা।

• হিসাব-নিকাশ কাজের জন্য নিউমেরিক প্যাড কী অথবা সংখ্যাবিশিষ্ট পৃথক কী-বোর্ড (Detachable 10-key) ব্যবহার না করা। 

৫. পিঠ, কোমর এবং পা (Back, Hip & Legs) ব্যথা

• কম্পিউটারের কাজের উপযোগী চেয়ার ব্যবহার না করা।

• অধিক উচ্চতাসম্পন্ন কিংবা পিছনে সাপোর্ট নেই, এমন চেয়ার ব্যবহার করা।

• বিরতিহীনভাবে দীর্ঘক্ষণ বসে কাজ করা।

• কী-বোর্ডের অবস্থান অধিক দূরে হওয়া কিংবা অধিক নিচে বা উচ্চতায় স্থাপন করা।

• ছোট হেলানোবিশিষ্ট চেয়ার (low backrest chair) কিংবা পিছনের দিকে বেশি হেলানো চেয়ার ব্যবহার করা।

• টেলিফোন সেট বা ব্যবহার্য অন্যান্য যন্ত্রপাতি দূরবর্তী স্থানে রাখা। 

• সিস্টেম ইউনিট ডেস্কের নিচে রাখার ফলে আরামভাবে পা রাখতে না পারা।

• সিডি-রম, ডিস্ক ড্রাইভ, পেন ড্রাইভ প্রভৃতির সুইচ বা পোর্ট হাতের নাগালে না থাকা ।

৬. হাঁটু, গোড়ালি এবং হাতের পাতা (Knees, Feets & Ankles) ব্যথা 

▪️অধিক উচ্চতাসম্পন্ন কিংবা কম উচ্চতাসম্পন্ন চেয়ার ব্যবহার করা।

▪️বেশি নরম বা বেশি উচ্চতার গদি বা ফোমযুক্ত চেয়ার ব্যবহার করা ।

▪️বিরতিহীনভাবে দীর্ঘক্ষণ বসে কাজ করা। সিস্টেম ইউনিট ডেস্কের নিচে রাখার ফলে আরামভাবে পা রাখতে না পারা।

অরগানমিক স্বাস্থ্য ঝুঁকি পরিহারের একটি পরিকল্পনা নিম্নরুপ-

১. ব্যবহারকারীর চোখের দূরত্ব হতে মনিটরের দূরত্ব 20 ইঞ্চি থেকে 30 ইঞ্চি অর্থাৎ 50 সেন্টিমিটার থেকে 76 সেন্টিমিটার পর্যন্ত হওয়া উচিত। চেয়ারে বসা অবস্থায় হাত সোজাসুজি সামনের দিকে ধরে বৃদ্ধাঙ্গুলি বরাবর দূরত্ব ধরে আনুমানিকভাবে 20 ইঞ্চি পরিমাপ করা যায়।

২. মনিটরের উচ্চতা এমন হওয়া উচিত স্ক্রিনের উপরিভাগ ও ব্যবহারকারীর চোখ একই সমতলে থাকে। স্ক্রিনের মাঝামাঝি অংশে দেখার জন্য চোখ সামান্য নিচের দিকে তাকানো উচিত।

৩. তীব্র বা অসহনীয় আলো পরিহার করার জন্য মনিটরের উজ্জ্বলতা নিয়ন্ত্রণ করা এবং কম্পিউটারের কক্ষের আলো সহনীয় বা কাজের উপযোগী করে ঠিক করে নিতে হবে।

৪. আলোর উজ্জ্বলতা কোনরূপ পরিবর্তন না হলে, মনিটরকে পিছনের দিকে 10° থেকে 20° কাত করা যেতে পারে। এতে মনিটরের উপর থেকে নিচের দিকে দৃষ্টিপাতের সময় মনিটর থেকে ব্যবহারকারীর চোখের দূরত্ব সর্বত্র প্রায় সমান থাকবে। তবে দূরদৃষ্টি ও ক্ষণদৃষ্টি উভয় সুবিধাসম্বলিত চশমা (bifocal) ব্যবহারকারীদের ক্ষেত্রে এই পরিমাপ 33° থেকে 45° হওয়া উচিত।

৫. কী-বোর্ডের মাঝামাঝি অংশ কনুই বরাবর উচ্চতায় থাকা উচিত। এতে ব্যবহারকারী স্বাচ্ছন্দ্যে দীর্ঘক্ষণ কাজ করতে পারবে। ৬. কী-বোর্ড পিছনের দিকে 10° হেলানো উচিত যাতে হাতের কব্জি সমান বরাবর থাকে।

৭. অবিরাম কাজের সময় মাঝে মধ্যে ২০ ফুট অধিক দূরত্বের কোন কিছুর দিকে তাকানো উচিত। এতে চোখের উপর চাপ কম পড়বে এবং চোখ খানিকটা বিশ্রাম পাবে।

৮. কাজের সময় মাঝে মধ্যে দাঁড়ানো কিংবা পিঠ ও বাহু টান টান করে নেয়া উচত। এতে কোমর, পিঠ ও শরীরের নিম্নাংশে রক্ত চলাচল স্বাভাবিক হবে এবং দীর্ঘক্ষণ কাজ করার ফলে সৃষ্ট পেশীর টান পড়া বা ব্যথা থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে।

৯. কাজ করা অবস্থায় অধিকাংশ সময় দৃষ্টি যেদিকে থাকে (যেমন স্ক্রীন, উৎস ডকুমেন্ট প্রভৃতি) সেদিকে মাথা দিয়ে সোজা হয়ে বসা উচিত। অন্যথায় ঘাড় ব্যথা বা মাথা ব্যথা হতে পারে।

১০. ব্যবহারকারী যাতে স্বাচ্ছন্দ্যে ও আরামে কাজ করতে পারে, এমন চেয়ার ব্যবহার করা উচিত। কী- বোর্ডের বরাবর হাত রাখার জন্য হাতাওয়ালা চেয়ার এবং পিছনে প্রয়োজনীয় সাপোর্টযুক্ত চেয়ার ব্যবহার করতে হবে।

১১. দীর্ঘক্ষণ ধরে একই আসনে কাজ করার ফলে পেশীতে অবসাদ বা ক্লান্তি আসতে পারে। এজন্য আসন বিন্যাস সঠিক থাকলেও মাঝে মধ্যে মনিটর, কী-বোর্ড, চেয়ার প্রভৃতি বিন্যাসে কিছুটা পরিবর্তন করতে হবে।

১২. ল্যাপটপ ব্যবহারকারীরা বিভিন্ন পরিবেশে বিভিন্ন অবস্থায় কাজ করলেও প্রয়োজন অনুযায়ী ও পরিবেশ উপযোগী করে আসন বিন্যাস ঠিক না করে যেনো দীর্ঘ সময় ধরে কাজ না করেন সেদিকটা মাথায় রাখতে হবে।

১৩. আট-দশ ঘণ্টা কাজের মাঝে প্রতি ঘন্টায় ছোট ছোট বিরতি নিতে হবে। সেটা মিনিট দশেকের মতোও হতে পারে।

১৪. কমপক্ষে কয়েক পা হেঁটে শরীরের ভঙ্গি বদল করতে হবে। এ হাঁটার জন্য কম্পিউটারের আশে পাশে যথেষ্ট জায়গা থাকা প্রয়োজন ।

১৫. কাঁধের এবং মেরুদণ্ডের উপরের অংশের পেশিগুলিকে দীর্ঘায়িত এবং শিথিল করতে গুটিকয়েক স্ট্রেচিং এক্সারসাইজ করতে হবে। যেমন- মুষ্টিবদ্ধ দুই হাত মাথার উপর টান টান করা, হাঁটু গেড়ে আধা বসা অবস্থায় জানালার গ্রিল ধরে শরীরটা টানা। ঘাড়টা বার কয়েক ডান, বাম বা উপর নিচ করে নেওয়া।

১৬. হাঁটা চলা না হলেও চেয়ারে বসেই উল্টো হাত করে নিজের দুই কাঁধ জড়িয়ে ধরতে হবে। উঠে দাঁড়িয়ে মাথার পিছনে হাত টান টান করতে হবে। নজর রাখতে হবে বসার ভঙ্গির উপর।

🚻 শ্রেণির কাজ : কম্পিউটার ব্যবহারজনিত কারণে ব্যবহারকারীর বিভিন্ন সমস্যা হতে পারে। নিচে বিভিন্ন শারীরিক সমস্যার তালিকা দেয়া আছে। প্রতিটি সমস্যার বিপরীতে একটি করে কম্পিউটার ব্যবহারজনিত কারণ উল্লেখ করো ।

শারীরিক সমস্যাকম্পিউটার ব্যবহারজনিত কারণ
মাথা ব্যথা 
চোখ ব্যথা 
কোমড় ব্যথা 
কাঁধ ব্যথা 
হাটু ব্যথা 
Content added || updated By

আরও দেখুন...

Promotion