আমাদের প্রিয়নবি হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন সর্বশেষ নবি ও রাসুল। তাঁকে আমাদের জন্য পৃথিবীতে রহমতস্বরূপ প্রেরণ করা হয়েছে। এ বিষয়ে মহান আল্লাহ বলেন-
وَمَا أَرْسَلْنَكَ إِلَّا رَحْمَةً لِلْعَلَمِينَ
আমি তো আপনাকে জগৎসমূহের রহমতস্বরূপ প্রেরণ করেছি।' (সূরা আল-আম্বিয়া, আয়াত: ১০৭)
আরবের সমকালীন পরিবেশ
মহানবি (সা.)-এর আবির্ভাব সময়কালকে আইয়্যামে জাহেলিয়া বলা হতো। আইয়্যামে জাহেলিয়া অর্থ অজ্ঞতা ও বর্বরতার যুগ। এ সময় আরবের সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় অবস্থা খুবই ভয়াবহ ছিল। সমগ্র আরববাসী শিরক ও পাপাচারে নিমজ্জিত ছিল। তারা মদ, জুয়া, নারী ও যুদ্ধ-বিগ্রহ নিয়ে নিমগ্ন থাকতো। তাদের মধ্যে ভালো-মন্দের কোনো পার্থক্য ছিল না। ঝগড়া-বিবাদ, চুরি-ডাকাতি, হত্যা, লুণ্ঠন, দুর্নীতি ও যুদ্ধ-বিগ্রহ-ই ছিল তাদের জীবন। তারা এক আল্লাহর পরিবর্তে বিভিন্ন দেব-দেবীর মূর্তি পূজা করত। পবিত্র কাবা গৃহে তখন ৩৬০টি দেবদেবীর মূর্তি ছিল।
এ সময় আরবের নারীদের অবস্থা ছিল খুবই শোচনীয়। তাদের কোনো সামাজিক অধিকার বা মর্যাদা ছিল। না। তাদেরকে ভোগের সামগ্রী মনে করা হতো। তারা কন্যা সন্তানের জন্মকে দুর্ভাগ্য ও লজ্জার কারণ মনে করত। এমনকি কোনো কোনো গোত্র তাদের কন্যা সন্তানকে জীবন্ত কবর দিতেও দ্বিধা করত না। পণ্যদ্রব্যের ন্যায় দাস-দাসী বাজারে বিক্রয় করা হতো এবং তাদের সাথে অমানবিক আচরণ করা হতো। এরকম ভয়াবহ নৈতিক অধঃপতনের পরেও তারা সাহসিকতা, প্রখর স্মৃতিশক্তি, কাব্যচর্চা, বাগ্মিতা, গোত্রপ্রীতি ও আতিথেয়তা প্রভৃতি গুণে গুণান্বিত ছিলো। তাদের মধ্যে কিছু লোক ছিল যারা এক আল্লাহতে বিশ্বাস করত। তারা কুসংস্কার ও পৌত্তলিকতা থেকে দূরে থাকত, তাদেরকে ‘হানীফ' বলা হতো।
এরকম ঘৃণ্য পাপাচার, কুসংস্কার ও বর্বরতায় নিমজ্জিত আরববাসীদের মধ্যে প্রিয়নবি হযরত মুহাম্মাদ (সা.) কে প্রেরণ করা হয় বিশ্ববাসীর রহমতস্বরূপ। তিনি সকল নবি-রাসুলগণের মধ্যে সর্বশেষ নবি ও রাসুল। তিনি নবিগণের নবি, আমাদের প্রিয়নবি হযরত মুহাম্মাদ মোস্তফা (সা.)।
হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর জন্ম ও পরিচয়
আমাদের প্রিয়নবি হযরত মুহাম্মাদ (সা.) ১২ রবিউল আউয়াল সোমবার সুবহে সাদেকের সময় মক্কার বিখ্যাত কুরাইশ বংশে জন্মগ্রহণ করেন। প্রসিদ্ধ মত অনুসারে হস্তিবাহিনীর ঘটনার ৫০ দিন পরে ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে তাঁর জন্ম হয়। তাঁর পিতার নাম আবদুল্লাহ এবং মাতার নাম আমিনা। তিনি মাতৃগর্ভে থাকা অবস্থায় তাঁর পিতা মৃত্যুবরণ করেন। দাদা আব্দুল মুত্তালিব তাঁর নাম রাখেন মুহাম্মাদ এবং স্নেহময়ী মা আমেনা তাঁর নাম রাখেন আহমাদ।
ধাত্রী হালিমার গৃহে শিশু মুহাম্মাদ (সা.)
তৎকালীন আরবের প্রথা অনুসারে শিশু মুহাম্মাদ (সা.)-কে লালন-পালনের জন্য বনু সা'দ গোত্রের বিবি হালিমার নিকট অর্পণ করা হয়। এ সময়ে বিবি হালিমার পরিবার কিছুটা অভাবগ্রস্ত ছিলো। শিশু মুহাম্মাদ (সা.)-এর বরকতে অভাব দূর হয়ে প্রাচুর্যে ভরে ওঠে তার সংসার। পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত বিবি হালিমা তাঁকে নিজ সন্তানের ন্যায় আদর-যত্নে লালন-পালন করেন। এরপর শিশু মুহাম্মাদ (সা.) মা আমেনার গৃহে ফিরে আসেন। মা হালিমার গৃহে অবস্থানকালে শিশু বয়সেই তাঁর মধ্যে ন্যায়বিচারের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত পরিলক্ষিত হয়। তিনি মাতৃদুগ্ধ পান করার সময় বিবি হালিমার বামপাশের দুগ্ধ পান করতেন। অন্য পাশ থেকে কখনই পান করতেন না; তাঁর দুধ ভাইয়ের জন্য রেখে দিতেন। মা হালিমার গৃহে থাকাকালে ৩ বছর বয়সে দুজন ফেরেশতা তাঁর বক্ষ বিদীর্ণ করে মানবীয় সকল দূর্বলতা মুক্ত করে কুদরতি শক্তি ও প্রজ্ঞা বৃদ্ধি করে দেন। ধাত্রী, মা হালিমার প্রতি তাঁর অগাধ শ্রদ্ধা-ভক্তি ও ভালোবাসা ছিলো। তিনি নবুওয়াতের দায়িত্ব লাভের পরেও দুধ মা হালিমা ও তাঁর পরিবারকে অত্যন্ত সম্মান ও সহায়তা করতেন।
মা আমেনার মৃত্যু ও এতিম মুহাম্মাদ (সা.)
মাতৃগৃহে ফিরে আসার পর মায়ের সীমাহীন আদর-ভালোবাসায় বালক মুহাম্মাদ (সা.) বড় হতে লাগলেন। তিনি ৬ বছর বয়সে পিতার কবর যিয়ারতের জন্য মায়ের সাথে মদীনায় যান। সেখান থেকে মক্কায় ফেরার পথে মা আমিনা ইন্তেকাল করেন। ফলে তিনি পিতা-মাতা উভয়কে হারিয়ে একেবারে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন। এসময় দাদা আব্দুল মুত্তালিব এতিম মুহাম্মাদের লালন-পালনের দায়িত্ব নিলেন। দাদা তাঁকে অত্যন্ত স্নেহ- ভালোবাসায় লালন-পালন করতে থাকেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তাঁর আট বছর বয়সে দাদাও ইন্তেকাল করেন। এরপর তিনি চাচা আবু তালেবের তত্ত্বাবধানে বেড়ে উঠতে থাকেন।
আল-আমিন উপাধি লাভ ও বুহাইরা পাদ্রীর ভবিষ্যদ্বাণী
বাল্যকালে মহানবি (সা.)-এর মধ্যে চারিত্রিক উত্তম গুণাবলির বহিঃপ্রকাশ ঘটতে থাকে। তাঁর কোমল স্বভাব ও অমায়িক ব্যবহারে সবাই তাকে আদর-স্নেহ করতেন। তিনি সবাইকে শ্রদ্ধা করতেন ও ভালোবাসতেন। সর্বদা হাসি-খুশি থাকতেন, সকলের কষ্টে ব্যথিত হতেন। সদা সত্য কথা বলতেন, কখনো মিথ্যা বলতেন না। এজন্য শৈশবেই তাঁকে সবাই আল-আমিন বা বিশ্বাসী উপাধিতে ভূষিত করেন।
১২ বছর বয়সে কিশোর মুহাম্মাদ (সা.) চাচা আবু তালেবের সাথে ব্যবসার উদ্দেশ্যে সিরিয়া গমন করেন। পথে বুহাইরা নামক জনৈক খ্রিস্টান পাদ্রীর সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। খ্রিস্টান পাদ্রী তাঁকে শেষ জামানার নবি ও সর্বশ্রেষ্ঠ রাসুল হিসেবে চিনতে পারেন। তিনি আবু তালেবকে পরামর্শ দেন তিনি যেন এই বালককে পৌত্তলিক ইয়াহুদিদের ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করেন; তাকে মক্কায় পাঠিয়ে দেন। তাই চাচা আবু তালেব পাদ্রীর পরামর্শ মোতাবেক মহানবি (সা.)-কে মক্কায় ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করেন।
শান্তি সংঘ প্রতিষ্ঠা ও হাজরে আসওয়াদ (কালো পাথর) স্থাপন
শৈশব থেকেই মহানবি (সা.) আরব জাতির চারিত্রিক অধঃপতন লক্ষ করেছেন। এ সময়ে হরবে ফুজ্জারের ভয়াবহতা দেখে তিনি অত্যন্ত ব্যথিত হন; তাঁর মন বিগলিত হয়। তাই তিনি সমাজের অরাজকতা দূর করে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য আত্মনিয়োগ করেন। এ সময় তিনি কতিপয় খুবককে নিয়ে 'হিলফুল ফুযুল ) নামে একটি খুব শান্তিসংঘ প্রতিষ্ঠা করেন। এ সংঘের মাধ্যমে তিনি মুসাফিরদের নিরাপত্তা, মজলুম ও অসহায়ের সহায়তা এবং অত্যাচারীকে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেন। বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে সম্প্রীতি স্থাপন ও আরবে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার চেষ্টা করেন। তিনি যে ভবিষ্যৎ জীবনে শান্তির অগ্রদূত হবেন, এ সাংগঠনিক তৎপরতা তাই প্রমাণ করে।
ছোটবেলা থেকেই মহানবি মুহাম্মাদ (সা.) অনন্যসাধারণ বুদ্ধিমত্তার অধিকারী ছিলেন। তিনি যখন একজন যুবক, সে সময় মক্কার গোত্রপ্রধানরা মিলে পবিত্র কা'বা ঘর সংস্কারের কাজ শুরু করেন। কা'বা ঘর সংস্কারের কাজ সমাপ্ত হলে পবিত্র হাজরে আসওয়াদ (কালো পাথর) যথাস্থানে স্থাপন করা নিয়ে গোত্রসমূহের মধ্যে। বিবাদ শুরু হয়। অবশেষে গোত্রপ্রধানরা সিদ্ধান্ত নেয় যে, আগামীকাল সকালে সর্বপ্রথম যে ব্যক্তি কা'বা চত্বরে প্রবেশ করবেন, তিনিই এ বিবাদ মীমাংসা করবেন। সকালবেলা হযরত মুহাম্মাদ (সা.) সবার আগে কা'বা চত্তরে প্রবেশ করলেন। এটা দেখে সবাই সন্তুষ্ট হলো। তিনি তাঁর চাদরের মাঝখানে পবিত্র পাথরটি রেখে সকল গোত্রের সরদারকে চাদরের চারপাশ ধরতে বললেন। তারা সকলে মিলে চাদরটি ধরে যথাস্থানে নিয়ে গেল, হযরত মুহাম্মাদ (সা.) নিজ হাতে পাথরখানা কাবার দেয়ালে বসিয়ে দিলেন। ফলে আরব জাতি একটি ভয়াবহ যুদ্ধ থেকে রক্ষা পেল এবং সকলে পাথরটি বসানোর গৌরব লাভ করল।
বিবি খাদিজার সাথে বিবাহ
তৎকালীন আরবে খাদিজা (রা.)-এর সচরিত্রের যথেষ্ঠ সুনাম ছিল। তিনি নিষ্কলুষ চরিত্রের জন্য তাহিরা বা পূণ্যবর্তী নামে পরিচিত ছিলেন। তিনি মহানবি মুহাম্মাদ (সা.)-এর সততা ও আমানতদারিতায় মুগ্ধ হয়ে তাঁকে তার ব্যবসায়-বাণিজ্য পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ করেন। মহানবি মুহাম্মাদ (সা.)-এর নেতৃত্বে ব্যবসায় প্রচুর সাফল্য আসে। তাছাড়া তাঁর অমায়িক ব্যবহার, সততা ও বুদ্ধিমত্তায় তিনি তাঁর প্রতি আরো বেশি মুগ্ধ হয়ে যান। ফলে খাদিজাতুত তাহিরা তাকে বিবাহের প্রস্তাব পাঠান। হযরত মুহাম্মাদ (সা.) চাচা আবু তালেবের পরামর্শে এ প্রস্তাব সানন্দে গ্রহণ করলেন। এ সময় খাদিজা (রা.) বয়স ছিল ৪০ বছর আর হযরত মুহাম্মাদ (সা.) -এর বয়স ছিল ২৫ বছর।
মুহাম্মাদ (সা.)-এর নবুওয়াতের দায়িত্ব লাভ
হযরত মুহাম্মাদ (সা.) শৈশব হতেই সমাজকে পাপাচার ও কুসংস্কার থেকে মুক্ত করে শান্তি প্রতিষ্ঠার কথা ভাবতেন। হযরত খাদিজা (রা.)-এর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার পর তিনি প্রায়শ মক্কার অদূরে হেরা পর্বতের গুহায় গভীর চিন্তায় ধ্যানমগ্ন থাকতেন। অবশেষে ৪০ বছর বয়সে ৬১০ খ্রিস্টাব্দে পবিত্র রমযান মাসের ২৭ তারিখ ওহী প্রাপ্ত হন। হযরত জিব্রাঈল (আ.) তাঁকে সূরা আলাকের প্রথম পাঁচটি আয়াত পাঠ করে শোনান; তিনি নবুওয়াত লাভ করেন। নবুওয়াত লাভের পর তিনি মহান আল্লাহর একত্ববাদের দাওয়াত ও ইসলাম প্রচার শুরু করেন।
মহানবি (সা.)-এর শৈশব-কৈশোর থেকে আমাদের শিক্ষণীয়
মহানবি (সা.) -এর শৈশব-কৈশোরের অনুপম চরিত্রিক মাধুর্যে আমাদের জন্য অনুসরণীয় অসংখ্য দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছে; তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো-
১। আমরা ন্যায়বিচার করব ও অপরের অধিকার আদায়ে সর্বদা সচেষ্ট হবো;
২। ছোট-বড় সকলের সাথে উত্তম ব্যবহার করব, সকলকে সম্মান করব ও ভালোবাসবো; কাউকে অপমান করব না।
৩। সর্বদা কঠোর পরিশ্রম করব; পরিবারের কাজে সহযোগিতা করব;
৪। পরিবার ও সমাজে শান্তি বিনষ্টকারী কোনো আচরণ করব না;
৫। সদা সত্য কথা বলব; কারও আমানত নষ্ট করব না:
৬। বন্ধু ও সহপাঠীরা মিলে ভালো কাজ করার চেষ্টা করব; কোনো অন্যায় করব না;
৭। অসহায় ও অত্যাচারিত মানুষকে সাহায্য করব এবং অত্যাচারীকে প্রতিহত করব:
৮। সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার চেষ্টা করব;
৯। সর্বোপরি ইসলামি আদর্শে নিজেদের জীবন গড়ব।
আরও দেখুন...