রাজা বট্টগামিনীর পৃষ্ঠপোষকতায় অঠকথাসমূহ কীভাবে সংরক্ষণ করা হয়?
ষষ্ঠ অধ্যায়
অট্ঠকথা
ত্রিপিটকের বিষয়বস্তুর সহজ-সরল ব্যাখ্যা স্বরূপ পালি ভাষায় এক শ্রেণির সাহিত্যকর্ম রচিত হয় যা পালি সাহিত্যের ইতিহাসে অট্ঠকথা নামে পরিচিত। ত্রিপিটকের বিষয়বস্তুর ভিত্তিতে রচিত হলেও অট্ঠকথা পালি ত্রিপিটকের অন্তর্গত নয়, একটি স্বতন্ত্র ধারার সাহিত্যকর্ম হিসেবে স্বীকৃত। অঠকথা সাহিত্যে বুদ্ধের ধর্ম-দর্শন ব্যাখ্যার পাশাপাশি প্রসঙ্গক্রমে প্রাচীন ভারত এবং শ্রীলঙ্কার ধর্ম-দর্শন, সমাজ, সাহিত্য, সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতি, ভূগোল প্রভৃতি নানাবিধ বিষয়ও আলোচিত হয়। এজন্য অঠকথা সাহিত্যকে প্রাচীন ভারত ও শ্রীলঙ্কার ইতিহাসের অনন্য উৎস হিসেবে গণ্য করা হয় । এই অধ্যায়ে আমরা অট্ঠকথা সম্পর্কে অধ্যয়ন করব।
এ অধ্যায় শেষে আমরা-
* অট্ঠকথা এর ধারণা ও রচনার পটভূমি বর্ণনা করতে পারব;
* অট্ঠকথার বিষয়বস্তু ব্যাখ্যা করতে পারব;
* অট্ঠকথা রচয়িতাদের জীবন ও কর্ম সম্পর্কে ধারণা দিতে পারব; * অট্ঠকথার গুরুত্ব ও শিক্ষা বর্ণনা করতে পারব।
পাঠ : ১
অট্ঠকথা'র ধারণা ও রচনার পটভূমি
পালি ‘অট্ঠকথা' শব্দটি ‘অট্ঠ’ এবং ‘কথা’ দুটি শব্দের সমন্বয়ে গঠিত। ‘অট্ঠ' শব্দের দ্বারা ‘অর্থ’, 'কথা' শব্দের দ্বারা কথা, বর্ণনা, ব্যাখ্যা প্রভৃতি নির্দেশ করে। অকথাকে সংস্কৃতে ‘অর্থকথা' বা ‘ভাষ্য’ ইংরেজিতে ‘commentary' বলা হয়। অতএব অট্ঠকথা বলতে অর্থকথা, ভাষ্য, অর্থ বর্ণনা, অর্থবাদ, ব্যাখ্যা ইত্যাদি বোঝায়। সাধারণত যে গ্রন্থ শব্দের অর্থবর্ণনা বা ব্যাখ্যা করে তাকে অকথা বলে । ‘সার দীপনী' নামক গ্রন্থে অট্ঠকথা প্রসঙ্গে এরূপ বলা হয়েছে : অথো কথিযতি এতাযতি অট্ঠকথা অর্থাৎ অর্থ বর্ণনা করে বলেই অট্ঠকথা ।
ত্রিপিটকে অনেক জটিল, দুর্বোধ্য, দ্ব্যর্থক ও ঊহ্য পদ বা বিষয় রয়েছে যা সকল শ্রেণির পাঠকের নিকট সহজে বোধগম্য নয়। সেসব পদ বা বিষয়সমূহ সমার্থক বা প্রতিশব্দ, উদাহরণ, উপমা, গল্প, ব্যাখ্যা প্রভৃতির সাহায্যে সহজ-সরলভাবে অট্ঠকথায় উপস্থাপন করা হয়। এভাবে বুদ্ধের ধর্ম-দর্শনের ব্যাখ্যামূলক পালি ভাষায় যে-সাহিত্যকর্ম রচিত হয় তাকে অকথা বলে ।
দুঃখমুক্তির অমিয় বাণীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে সেদিন ভারতবর্ষের নানাজাতি, নানা কুল এবং নানা শ্রেণির অসংখ্য মানুষ আশ্রয় নিয়েছিলেন বুদ্ধের সঙ্ঘে। বৌদ্ধসঙ্ঘে জ্ঞানী ভিক্ষু-ভিক্ষুণী যেমন ছিলেন, তেমনি ছিলেন স্বল্পজ্ঞানীও। ফলে বুদ্ধের ধর্মোপদেশ সবার পক্ষে যথাযথভাবে হৃদয়ঙ্গম করা সম্ভব হতো না। ফলস্বরূপ বুদ্ধের জীবিতকালেই তাঁর ধর্মোপদেশের বিভিন্ন বিষয় অর্থসহকারে ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন
হতো। সঙ্ঘের মধ্যে বিভিন্ন কারণে বিভিন্ন বিষয়ে ব্যাখ্যা ও নির্দেশনার প্রয়োজন দেখা দিত। যেমন : কেউ বুদ্ধ, তাঁর ধর্ম ও সঙ্ঘের নিন্দা করলে, সঙ্ঘের বিধিবিধান ভঙ্গ করলে, বুদ্ধবাণীর ভুল ব্যাখ্যা করলে, সঙ্ঘে অসুন্দর আচরণ করলে, ক্রোধোন্মত্ত আলোচনা হলে, ধর্ম-দর্শনসংক্রান্ত কোনো বিষয়ে সন্দেহ ও বিতর্ক দেখা দিলে, বুদ্ধবাণীর কোনো বিষয় দুর্বোধ্য হলে ভিক্ষুসঙ্ঘ সমবেত হয়ে বিষয়সমূহ প্রতিকার বা সমাধানের চেষ্টা করতেন। এক্ষেত্রে কখনো বুদ্ধ, কখনো বা তাঁর নেতৃস্থানীয় শিষ্যগণ যথাযথ ব্যাখ্যা প্রদানের মাধ্যমে এসব সমস্যার সমাধান করতেন। ত্রিপিটকে এ সম্পর্কে বহু উদাহরণ পাওয়া যায়। যেমন একদা পরিব্রাজক সুপ্রিয় এবং এক তরুণ বুদ্ধ শিষ্যের মধ্যে বুদ্ধ, ধর্ম ও সঙ্ঘ বিষয়ে কথোপকথন হচ্ছিল। একদিকে পরিব্রাজক সুপ্রিয় বুদ্ধ, ধর্ম ও সঙ্ঘের নিন্দা করছিলেন। অপরদিকে তরুণ শিষ্য বুদ্ধের উচ্চ প্রসংশা করছিলেন। এতে ভিক্ষুগণ ইতস্তত বোধ করলে বুদ্ধ এ সম্পর্কে করণীয় ও অকরণীয় বিষয় ব্যাখ্যা প্রদান করেন, যা দীর্ঘনিকায়ের সীলক্খন্ধবগ্গে উল্লেখ পাওয়া যায়। অনুরূপভাবে দেখা যায়, একদা পরিব্রাজক পোতলিপুত্র নবীন ভিক্ষু সমিদ্ধিকে বুদ্ধবাণী ভুলভাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন : “বন্ধু সমিদ্ধি ! সাক্ষাৎ শ্রমণ গৌতমকে আমি এরূপ বলতে শুনেছি : কায় কর্ম মিথ্যা (নিষ্ফল), বাককর্ম মিথ্যা, একমাত্র মনোকর্মই সত্য। আর সেই সমাপত্তি আছে যা লাভ করে ধ্যানী কিছুই অনুভব করেন না।” তখন ভিক্ষু সমিদ্ধি পরিব্রাজক পোতলিপুত্রকে বলেন, “বন্ধু পোতলিপুত্র ! ঐরূপ বলবেন না, ভগবানের অপবাদ ভালো নয়, ভগবান কখনো ঐরূপ বলবেন না।” এরূপ বলার পর পরিব্রাজক পোতলিপুত্র চলে গেলে ভিক্ষু সমিদ্ধি বিষয়টি আনন্দ থেরকে জ্ঞাত করেন। আনন্দ থের তা বুদ্ধকে পরিজ্ঞাত করেন। বুদ্ধ বিষয়টি সুস্পষ্ট করার নিমিত্তে উদাহরণ ও অর্থসহকারে কর্মের সূক্ষ্মাতিসুক্ষ্ম ব্যাখ্যা প্রদান করেন, যা মহাকৰ্ম্মবিভঙ্গ সূত্রে উল্লেখ পাওয়া যায় ।
বৌদ্ধসঙ্ঘ গঠনের প্রথমদিকে এভাবে ব্যাখ্যা ও সিদ্ধান্ত প্রদানের মাধ্যমে সমস্যাসমূহ বুদ্ধ নিজেই সমাধান করতেন। কিন্তু সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে বৌদ্ধসঙ্ঘ বিস্তৃতিলাভ করলে তাঁর পক্ষে সকল সমস্যা সমাধান করা সম্ভব হতো না। ইতিহাসপাঠে জানা যায়, বুদ্ধের ধর্মপ্রচার আরম্ভের কয়েক বছরের মধ্যেই প্রাচীন ভারতের গুরুত্বপূর্ণ জনপদ বা শহর, যেমন : সারনাথ, রাজগৃহ, বৈশালী, নালন্দা, পাবা, উজ্জয়নী, চম্পা, মথুরা, শ্রাবস্তী প্রভৃতি অঞ্চলে বৌদ্ধসঙ্ঘ গড়ে ওঠে এবং উক্ত স্থানগুলো বৌদ্ধ ধর্ম ও দর্শনচর্চার অন্যতম কেন্দ্রে পরিণত হয়। এসব স্থানে সবসময় বুদ্ধের পক্ষে বসবাস করা সম্ভব ছিল না বিধায় কেন্দ্ৰসমূহ বুদ্ধের নেতৃস্থানীয় এক-একজন শিষ্যের নেতৃত্বে পরিচালিত হতে থাকে। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন : আনন্দ, মহাকশ্যপ, মহাকচ্চায়ন, মহাকোট্ঠিত, সারিপুত্র এবং মৌদ্গল্যায়ান। বুদ্ধের অবর্তমানে তাঁরা বুদ্ধের ধর্ম-দর্শনের ব্যাখ্যসহ সঙ্ঘ বিষয়ক বিভিন্ন কর্মকাণ্ড ও সমস্যার সমাধান দিতেন । নেতৃস্থানীয় শিষ্যগণ বুদ্ধের দেশনাসমূহ ভিক্ষুদের অর্থসহকারে ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দিতেন। নেতৃস্থানীয় শিষ্যদের মধ্যে বুদ্ধ অনেককে তাঁর ধর্মোপদেশ তথা ধর্মদর্শন যথাযথভাবে ব্যাখ্যা করতে সক্ষম মনে করতেন । এক্ষেত্রে মহাকচ্চায়ন, সারিপুত্র এবং মহাকোট্ঠিত থের ছিলেন অগ্রগণ্য। মহাকচ্চায়ন বুদ্ধের সংক্ষিপ্ত দেশনাসমূহ প্রাঞ্জল এবং সহজ সরলভাবে শ্রোতাদের নিকট উপস্থাপন করতে পারদর্শী ছিলেন । ধর্ম-দর্শন ব্যাখ্যায় তিনি প্রভূত খ্যাতি অর্জন করেন এবং বুদ্ধ মহাকচ্চায়নকে ধর্ম-দর্শন ব্যাখ্যায় সর্বাগ্রে স্থান দেন। তা ছাড়া, কেন্দ্রসমূহে ভিক্ষুদের মধ্যে ধর্ম-দর্শনসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হতো। নেতৃস্থানীয় শিষ্যগণ এসব আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে যেসব নির্দেশনা ও ব্যাখ্যাদান করতেন তা বুদ্ধকে যথাসময়ে
পরিজ্ঞাত করা হতো। বুদ্ধ নেতৃস্থানীয় শিষ্যদের যেসব ব্যাখ্যা ও নির্দেশনা সঠিক মনে করতেন তা অনুমোদন দান করতেন এবং ভিক্ষুদের গ্রহণ, ধারণ ও পালন করতে নির্দেশ দিতেন। প্রথম সঙ্গীতিতে বুদ্ধবাণী সংকলনের সময় এসব ব্যাখ্যাও অনুমোদন লাভ করে সংকলিত হয়েছিল, যা ত্রিপিটকের বিভিন্ন গ্রন্থে পাওয়া যায়। বুদ্ধ এবং বুদ্ধশিষ্যদের এসব ব্যাখ্যাকে অটঠকথার সূচনা হিসেবে চিহ্নিত করা যায়, যা পরবর্তীকালে সমৃদ্ধি লাভপূর্বক অট্ঠকথা রচনার পটভূমি তৈরি করে।
বুদ্ধবাণীর যুগোপযোগী এবং সহজ-সরল অর্থযুক্ত ব্যাখ্যা হিসেবে যে- সাহিত্যকর্ম রচিত হয়েছিল তাই অট্ঠকথা নামে পরিচিতি লাভ করে। সাধারণত অট্ঠকথা বা ভাষ্য বলতে বোঝায় একজনের প্রজ্ঞা ও দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে প্রাচীন পাঠের নতুন এবং যুগোপযোগী বোধগম্য অর্থ ও ব্যাখ্যা প্রদান করা, যা মূল পাঠের যথোপযুক্ত অর্থ ও ভাব যথাযথভাবে ধারণ করে রাখে।
খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম শতকে সিংহলরাজ রাজ বট্টগামিণীর পৃষ্ঠপোষকতায় অট্ঠকথাসমূহ সিংহলি ভাষায় তালপত্রে লিখে সংরক্ষণ করা হয়। এ কারণে বলা যায়, খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম শতকের আগেই অট্ঠকথা সাহিত্য পরিপূর্ণতা লাভ করেছিল। সিংহলের অনুরাধাপুরার মহাবিহারে তালপত্রে লিখিত অট্ঠকথাসমূহ সংরক্ষিত ছিল। কালক্রমে তা সীহলঠকথা (সিংহলি অট্ঠকথা) নামে পরিচিতি লাভ করে। সীলঠকথাসমূহ মহা-অট্ঠকথা, মহাপচ্চরি অট্ঠকথা, কুরুন্দি অট্ঠকথা, অন্ধক অট্ঠকথা, সংক্ষেপ অট্ঠকথা ইত্যাদি নামে পরিচিত ছিল। অকথা রচনার সূচনা ভারতবর্ষে হলেও তা ভারতবর্ষে পাওয়া যেত না। ফলে ভারতীয় এবং অন্যান্য দেশের লোকেরা সহজে বুদ্ধবাণী বুঝতে পারত না। সে-কারণে খ্রিষ্টীয় পঞ্চম শতাব্দীর দিকে বুদ্ধঘোষ, বুদ্ধদত্ত, ধর্মপাল, মহানাম এবং উপসেন প্রমুখ পণ্ডিতগণ সিংহলে সিংহলি ভাষায় সংরক্ষিত সীহলঠকথা হতে পালি ভাষায় বর্তমান কালের অট্ঠকথাসমূহ রচনা করেন। এভাবে বিবর্তনের বিভিন্ন স্তর অতিক্রম করে অট্ঠকথাসমূহ বর্তমান কালের রূপ পরিগ্রহ করেছে।
প্রথম দিকে অট্ঠকথাসমূহ ত্রিপিটকের বিষয়বস্তু তথা বুদ্ধের ধর্ম-দর্শন নিয়ে রচিত হলেও পরবর্তীকালে প্রাচীন ভারত ও শ্রীলঙ্কার ধর্ম-দর্শন, কাব্য, ব্যাকরণ, ভৌগোলিক, রাজনৈতিক প্রভৃতি নানা বিষয় নিয়েও নানা শ্রেণির অট্ঠকথা রচিত হয়। ফলে অট্ঠকথা বিশাল ও বৈচিত্র্যময় সাহিত্যভাণ্ডারের রূপ লাভ করে ।
অনুশীলনমূলক কাজ
অট্ঠকথা বলতে কী বোঝ ? বুদ্ধের নেতৃস্থানীয় শিষ্যদের নামের একটি তালিকা তৈরি কর ধর্ম-দর্শন ব্যাখ্যায় পারদর্শী কয়েকজন বুদ্ধশিষ্যের নাম বল
সীহলঠকথাসমূহ কী কী নামে পরিচিত ছিল? বর্তমানকালের পালি অট্ঠকথাসমূহ কিসের ভিত্তিতে কারা রচনা করেছিলেন?
অট্ঠকথার বিষয়বস্তু ও পরিচিতি
বুদ্ধের মূলবাণীর বিস্তারিত অর্থ ও ব্যাখ্যামূলক টীকা বৌদ্ধ সাহিত্যের ইতিহাসে অট্ঠকথা বা অর্থকথা নামে পরিচিত । এটাকে ভাষ্যগ্রন্থ বলা যায় । বুদ্ধের জীবিতকালেই বুদ্ধের ধর্মবাণী, বিধি বিধান এবং সমকালীন বিভিন্ন জটিল বিষয়ের সমস্যা বুদ্ধ ও তাঁর নেতৃস্থানীয় শিষ্য-শিষ্যগণ ব্যাখ্যা প্রদানপূর্বক সমাধান করতেন । বুদ্ধ ও তাঁর শিষ্যগণের সেসব ব্যাখ্যাকে অটঠকথা সাহিত্যের সূচনা ও পটভূমি হিসেবে গণ্য করা যায়। অট্ঠকথা রচিয়তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন আচার্য বুদ্ধঘোষ, আচার্য বুদ্ধদত্ত, আচার্য ধর্মপাল, আচার্য উপসেন, আচার্য মহানাম প্রমুখ । নিম্নে বিভিন্ন পিটকের অট্ঠকথার সংক্ষিপ্ত পরিচিতি তুলে ধরা হলো :
সুত্ত পিটকের অট্ঠকথা পরিচিতি
সুত্ত পিটক পাঁচভাগে বিভক্ত । যথা: দীঘনিকায়, মধ্যম নিকায়, সংযুক্ত নিকায়, অঙ্গুত্তর নিকায় এবং খুদ্দক নিকায় । প্রতিটি নিকায়ের স্বতন্ত্র অঠকথা রচিত হয়েছে । খুদ্দক নিকায়ে ষোলটি গ্রন্থ আছে । প্রথম চারটি নিকায়ের অট্ঠকথাসমূহ ভিন্ন ভিন্ন নামে পরিচিতি হলেও খুদ্দক নিকায়ের অনেকগুলো গ্রন্থের অট্ঠকথা একই নামে অভিহিত । যেমন, উদান, ইতিবুত্তক, বিমানবন্ধু, পেতবন্ধু, থেরগাথা, থেরীগাথা এবং চরিয়াপিটক - এই সাতটি গ্রন্থের অট্ঠকথা পরমাদীপনী নামে পরিচিত। অপরদিকে, মহানিদ্দেস ও চূলনিদ্দেস গ্রন্থের অট্ঠকথা সদ্ধম্মপজ্জোতিকা নামে অভিহিত । আচার্য উপসেন মহানিদ্দেস ও চূলনিদ্দেস গ্রন্থদ্বয়ের অকথা হিসেবে সদ্ধম্মপজ্জোতিকা রচনা করেন । তাই প্রথম চারটি নিকায়ের অকথার নাম ও পরিচিতি আলাদাভাবে তুলে ধরা হলো ।
বিনয় পিটকের অট্ঠকথা পরিচিতি
বিনয় পিটক প্রধানত তিন ভাগে বিভক্ত । যথা : সুত্তবিভঙ্গ, খন্ধক এবং পরিবার বা পরিবার পাঠ বিনয়পিটকের বিষয়বস্তুকে ভিত্তি করে দু'টি অট্ঠকথা রচিত হয়েছে । যথা : সমন্তপাসাদিকা এবং কঙ্খাবিতরণী । সমস্তপাসাদিকা সমগ্র বিনয়পিটকের অট্ঠকথা হিসেবে পরিচিত। সুত্তবিভঙ্গ গ্রন্থে বর্ণিত ভিক্ষু ও ভিক্ষুণীদের বিনয় বিধানসমূহ পাতিমোক্খ নামে পরিচিত । পাতিমোখের আলোকে রচিত অঠকথাকে কঙ্খাবিতরণী বলে ।
অভিধর্ম পিটকের অট্ঠকথা পরিচিতি
অভিধর্ম পিটক সাত ভাগে বিভক্ত । যথা : ধম্মসঙ্গণি, বিভঙ্গ, ধাতুকথা, পুগ্গল পঞ্ঞত্তি, কথাবন্ধু, যমক এবং পঠান । অভিধর্ম পিটকের প্রতিটি গ্রন্থের অকথা রচিত হয়েছে। ধম্মসঙ্গণি এবং বিভঙ্গের অঠকথা ছাড়া অভিধর্মপিটকের অন্যান্য পাঁচটি গ্রন্থের অকথা পঞ্চপকরণঠকথা নামে পরিচিত । অভিধর্ম বৌদ্ধ দর্শন হিসেবে খ্যাত ।
অভিধর্ম পিটকের অট্ঠকথায় বৌদ্ধধর্মের গভীর দার্শনিক বিষয়সমূহ সহজ ও প্রাঞ্জল ভাষায় উপস্থাপন করা
পাঠ : ৩
অট্ঠকথাচার্য বুদ্ধদত্ত
অট্ঠকথা রচনাকারীদের মধ্যে কালজয়ী অট্ঠকথা রচয়িতা হচ্ছেন বুদ্ধদত্ত। কিন্তু এই কালজয়ী লেখক তাঁর অমর সাহিত্যকর্মে নিজেকে প্রকাশ করেননি। তা ছাড়া, বুদ্ধঘোষের জীবনী পাওয়া গেলেও বুদ্ধদত্তের জীবনী পাওয়া যায় না। ফলে এই মহান লেখকের জন্ম, বাল্যকাল, দীক্ষা, শিক্ষা ও জীবনচর্যা প্রভৃতি কুয়াশাচ্ছন্ন। এই অনুচ্ছেদে প্রখ্যাত অট্ঠকথা রচয়িতা বুদ্ধদত্ত সম্পর্কে পাঠ করব।
জন্মস্থান ও সময়কাল :
গন্ধবংস গ্রন্থে বুদ্ধদত্তকে ভারতের আচার্য হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। বিনয়বিনিচ্ছয় ও উত্তরবিনিচ্ছয় গ্রন্থে তাঁকে উরগপুর নিবাসী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। বিনয়বিনিচ্ছয় গ্রন্থটি তিনি চোল রাজ্যের ভূতমঙ্গল গ্রামে বিষ্ণুদাসের আরামে রাজা অচ্যুত বিক্রমের সময়কালে রচনা করেন বলে উল্লেখ পাওয়া যায়। অভিধম্মাবতার গ্রন্থ মতে, উরগপুর কাবেরী নদীর তীরে অবস্থিত ছিল। পণ্ডিতগণ একমত যে, উরগপুর ছিল বর্তমান কালের দক্ষিণ ভারতের ত্রিচিনপোলির নিকটবর্তী উরায়ুর স্থানটির প্রাচীন নাম । তিনি খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতকের শেষ ভাগ হতে খ্রিষ্টীয় পঞ্চম শতকের প্রথম ভাগে জন্মগ্রহণ করেন।
বুদ্ধঘোসুপ্পত্তি এবং বিনয়বিনিচ্ছয় টীকা গ্রন্থ মতে, বুদ্ধঘোষ এবং বুদ্ধদত্ত সমসাময়িক ছিলেন। বুদ্ধঘোসুপ্পত্তি গ্রন্থ হতে জানা যায় যে, বুদ্ধদত্ত যেদিন সিংহল থেকে জম্বুদ্বীপে ফিরে আসার জন্য রওনা দিয়েছিলেন সেদিন বুদ্ধঘোষও অট্ঠকথা রচনা করার জন্য সিংহলে যাত্রা করেন। উভয়ের জাহাজ মাঝপথে ধাক্কা লেগে থেমে যায়। তখন বুদ্ধদত্ত বুদ্ধঘোষকে ‘আবুসো' সম্বোধন করে কোথায় এবং কী উদ্দেশ্যে যাচ্ছেন তা জিজ্ঞাসা করেন। উত্তরে বুদ্ধঘোষ বলেন, আমি বুদ্ধবচন সিংহলি হতে মাগধী ভাষায় অনুবাদ করার জন্য যাচ্ছি। বুদ্ধদত্ত বলেন, আমিও বুদ্ধবাণী মাগধী ভাষায় লেখার জন্য সিংহলে গিয়েছিলাম। আমি কেবল জিনালংকার, দন্তবংস, ধাতুবংস এবং বোধিবংস রচনা সম্পন্ন করেছি। অটঠকথা ও টীকা রচনা করতে পারিনি। যদি বুদ্ধবচন সিংহলি হতে মাগধী ভাষায় অনুবাদ করতে ইচ্ছুক হন তাহলে প্রথমে অট্ঠকথা ও টীকা রচনা করবেন। এরূপ বলে তিনি বুদ্ধঘোষকে উৎসাহিত করেন। বুদ্ধঘোষকে 'আবুসো' বলে সম্বোধন করায় কোনো কোনো পণ্ডিত বুদ্ধদত্তকে বয়োজেষ্ঠ্য মনে করেন। বুদ্ধঘোসুপ্পত্তি এবং বিনয় বিনিচ্ছয় বুদ্ধদত্তের অনেক পরে রচিত। তা ছাড়া, বুদ্ধঘোষ ও বুদ্ধদত্তের গ্রন্থের মধ্যে সাক্ষাতের বিষয়টি পাওয়া যায় না ফলে পণ্ডিতগণ উভয়ের সাক্ষাৎ সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করেন। তবে সময়কাল বিচারে বুদ্ধদত্ত এবং বুদ্ধঘোষ সমসাময়িক ছিলেন বলে ধারণা করা যায়।
বৌদ্ধধর্মে দীক্ষা বা প্রব্রজ্যা লাভ :
বুদ্ধদত্তের দীক্ষা সম্পর্কে বিশদভাবে কিছু জানা যায় না। অভিধম্মাবতার এবং রূপারূপবিভাগ গ্রন্থ হতে জানা যায় যে, তিনি সিংহলের মহাবিহার নিকায়ের অনুসারী ভিক্ষুর নিকট প্রব্রজিত হন। মহাবিহার নিকায়ের নিয়ম অনুযায়ী তিনি ভিক্ষুদের নিকট ধর্ম-বিনয় শিক্ষা লাভ করে পারদর্শিতা অর্জন করেন । তিনি আজীবন নিকায়ের অনুসারী ছিলেন। কিন্তু তিনি কোন গুরুর নিকট এবং কোন বিহারে দীক্ষিত হয়েছিলেন সে-সম্পর্কে কিছুই জানা যায় না ।
কবি ও অন্যান্য কীর্তি :
বুদ্ধদত্তের মূল পরিচয় তিনি একজন বৌদ্ধভিক্ষু এবং অট্ঠকথা রচয়িতা বা ভাষ্যকার। আচার্য হিসেবে তাঁর খ্যাতি সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিল। সমকালীন পণ্ডিতদের নিকট তিনি বিশেষ শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন। পণ্ডিতগণ তাঁর রচিত গ্রন্থ হতে প্রচুর উদ্ধৃতি গ্রহণ করতেন। তিনি সমর্থ এবং বিদর্শন ভাবনায়ও পরদর্শী ছিলেন। বৌদ্ধধর্ম ও দর্শনচর্চায় পারদর্শী এ মহাপুরুষ কবি হিসেবেও পরিচিত ছিলেন।
বুদ্ধদত্তের অধিকাংশ গ্রন্থ পদ্যে রচিত। যেমন, বিনয়বিনিচ্ছয় গ্রন্থটি ৩১৮৩টি গাথায়, উত্তরবিনিচ্ছয় গ্রন্থটি ৯৬৯টি গাথায় এবং অভিধম্মাবতার গ্রন্থটি ১৪১৫টি গাথায় রচিত। অসীম কবিত্বশক্তির অধিকারী না হলে সহজ-সরলভাবে পদ্যে বা গাথায় বুদ্ধের ধর্ম-দর্শন ব্যাখ্যা করতে সক্ষম হতেন না। তিনি মহাভাষ্যকার নামেও অভিহিত হতেন ।
সাহিত্যকর্ম :
প্রাচীনকালের লেখকগণ গ্রন্থের মধ্যে নাম ও নিজের সম্পর্কে কিছুই লিখতেন না। বুদ্ধদত্তও তাই করেছেন। তাই বুদ্ধদত্তের সাহিত্যকর্ম নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে বিতর্ক রয়েছে। ঐতিহ্য অনুসারে নিম্নলিখিত গ্রন্থসমূহ বুদ্ধদত্ত রচনা করেন :
১. মধুরখবিলাসিনী (বুদ্ধবংসঠকথা)
২. বিনয়বিনিচ্ছয়
৩. উত্তরবিনিচ্ছয়
৪. অভিধম্মাবতার
৫. রূপারূপবিভাগ
৬. জিনলংকার
৭. দন্তবংস বা দাঠাবংস
৮. ধাতুবংস
৯. বোধিবংস
উপরের বর্ণিত গ্রন্থসমূহের মধ্যে বিনয়বিনিচ্ছয়, উত্তরবিনিচ্ছয়, অভিধম্মাবতার, রূপারূপবিভাগ এবং মধুরখবিলাসিনী- এই পাঁচটি গ্রন্থ পণ্ডিতগণ বুদ্ধদত্তের প্রকৃত রচনা হিসেবে স্বীকার করেন। বাকি গ্রন্থগুলো নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে সংশয় রয়েছে। তিনি বিনয়বিনিচ্ছয়, মধুর বিলাসিনী এবং অভিধম্মাবতার গ্রন্থটি দক্ষিণ ভারতের চোল রাজ্যে রচনা করেছিলেন বলে জানা যায় ।
মৃত্যু :
বুদ্ধদত্তের মৃত্যু সম্পর্কে তেমন কিছুই জানা যায় না। বুদ্ধঘোসুপ্পত্তি গ্রন্থে উল্লেখ আছে যে, তিনি সিংহল থেকে প্রত্যাবর্তনের অল্পকাল পরেই মৃত্যু বরণ করেন। কিন্তু মৃত্যুর কারণ ও স্থান সম্পর্কে কিছুই জানা যায় না। তিনি যেহেতু দক্ষিণ ভারতের অধিবাসী ছিলেন এবং দক্ষিণ ভারতেই তাঁর গ্রন্থসমূহ রচনা করেছিলেন, সেহেতু ধারণা করা হয় দক্ষিণ ভারতেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন ।
অনুশীলনমূলক কাজ বুদ্ধদত্তের জন্মস্থান কোথায়? কবি হিসেবে বুদ্ধদত্তের মূল্যায়ন কর ঐতিহ্য অনুসারে বুদ্ধদত্ত রচিত গ্রন্থের তালিকা তৈরি করে তাঁর প্রকৃত রচনাসমূহ চিহ্নিত কর |
পাঠ : 8
অট্ঠকথাচার্য ধর্মপাল
ধর্মপাল সুপ্রসিদ্ধ অট্ঠকথাচার্য ছিলেন। বুদ্ধঘোষের পরেই ছিল তাঁর স্থান। অকথা, টীকা এবং অনুটীকা লিখে তিনি পালিসাহিত্য ভাণ্ডারকে নানা আঙ্গিকে সমৃদ্ধ করেছেন। অমর সাহিত্যকর্ম রচনা করার জন্য বৌদ্ধগণ এখনও তাঁকে শ্রদ্ধাচিত্তে স্মরণ করে। কিন্তু অসীম প্রতিভার অধিকারী এই মহান লেখকের জীবন সম্পর্কে খুব সামান্যই জানা যায় ।
জন্মস্থান ও সময়কাল :
গন্ধবংস গ্রন্থে ধর্মপালকে জম্বুদ্বীপ তথা ভারতের আচার্য হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এ-গ্রন্থে সুনির্দিষ্টভাবে তাঁর জন্মস্থানের উল্লেখ নেই । সাসনবংস গ্রন্থ মতে, তিনি সিংহলের নিকটবর্তী দমিল রাজ্যের পদরতিত্থের অধিবাসী ছিলেন। নেত্তিপকরণ গ্রন্থের অকথা মতে, তিনি বদরিখ বিহারের নিবাসী ছিলেন। পণ্ডিতগণ ‘পদরতিখ' এবং 'বদরিখ' অভিন্ন স্থান বলে মনে করেন। হিউয়েন সাং-এর মতে, ধর্মপাল কাঞ্চিপুরায় জন্মগ্রহণ করেন। এ-স্থানটি দক্ষিণ ভারতের মাদ্রাজ শহর হতে ৪৩ মাইল দক্ষিণে অবস্থিত বর্তমানকালের কণ্ড্রেবরণ শহর হিসেবে চিহ্নিত করেন। অপরদিকে পণ্ডিতগণ, ‘পদরতিখ’ বা ‘বদরিখ’ স্থানটি দক্ষিণ ভারতের নাগপট্টনে অবস্থিত বলে অভিমত পোষণ করেন। নাগপট্টন দক্ষিণ ভারতের তেনজোর জেলায় অবস্থিত এবং জন্মসূত্রে তিনি তামিল ছিলেন। বিভিন্ন স্থানের নামোল্লেখ পাওয়া গেলেও তিনি ‘পদরতিখ' বা 'বদরিখ' স্থানে জন্মগ্রহণ করেন । কারণ তাঁর রচিত গ্রন্থ এ-বিষয়টি সমর্থন করে। তাঁর জন্মস্থান হিসেবে যেসব স্থানের নামোল্লেখ পাওয়া যায়া সেসব স্থান দক্ষিণ ভারতেই অবস্থিত ছিল। সম্ভবত, স্থানটি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন নামে পরিচিত ছিল। তাই তাঁর জন্মস্থান হিসেবে বিভিন্ন স্থানের নামোল্লেখ পাওয়া যায়। পণ্ডিতগণ একমত যে, দক্ষিণ ভারতই ছিল ধর্মপালের জন্মস্থান । তিনি খ্রিষ্টীয় ষষ্ঠ শতকের শেষভাগে জন্মগ্রহণ করেন ।
বাল্যকাল ও দীক্ষা :
ধর্মপালের বাল্যকাল ও দীক্ষা সম্পর্কে কিছুই জানা যায় না। হিউয়েন সাং-এর ভ্রমণ-বৃত্তান্তে তাঁর বাল্যকাল সম্পর্কে এরূপ বর্ণনা পাওয়া যায় :
‘ধর্মপাল কাঞ্চিপুরায় জন্মগ্রহণ করেন। বালক বয়সেই তিনি সুন্দর ও সৎ স্বভাবের অধিকারী ছিলেন, যা তাঁর সমৃদ্ধ ও উন্নত জীবন গঠনে সহায়ক ভূমিকা রেখেছিল। বয়োঃপ্রাপ্ত হলে সে-রাজ্যের রাজকন্যার সঙ্গে তাঁর বিবাহের কথা পাকা হয়। বিবাহের পূর্বরাত্রে তাঁর মনে দুঃখময় ভাবাবেগ উদয় হয়। তিনি বুদ্ধমূর্তির সামনে মুক্তির জন্য প্রার্থনা করলে তাঁর প্রার্থনা মঞ্জুর হয়। এক দেবতা এসে তাঁকে সেখান থেকে অনেক দূরের এক পর্বতের বিহারে নিয়ে যান। সেই বিহারের ভিক্ষুগণ তাঁকে দীক্ষা দান করেন। ধর্মপালের গ্রন্থে বা অন্য কোনো গ্রন্থে এ-বিষয়টির উল্লেখ পাওয়া যায় না। ফলে বিষয়টি কতটুকু সত্য তা নিয়ে সংশয় দেখা দেয়। তাঁর রচিত নেত্তিপকরণ গ্রন্থ হতে জানা যায় যে, তিনি দক্ষিণ ভারতের ‘পদরতিখ’ বা ‘বদরিখ’ বিহারে বসবাস করতেন। ফলে ধারণা করা হয় যে, তিনি দক্ষিণ ভারতে দীক্ষা বা প্রব্রজ্যা লাভ করেছিলেন। তবে তাঁর দীক্ষাগুরুর নাম জানা যায় না। তিনি মহাবিহার নিকায়ের তথ্যের আলোকে তাঁর গ্রন্থসমূহ রচনা করেছিলেন। ফলে তিনি মহাবিহার নিকায়ের অনুসারী বা থেরবাদী ছিলেন বলে ধারণা করা যায়।
আচার্য বুদ্ধঘোষ এবং আচার্য ধর্মপাল :
বুদ্ধঘোষ এবং ধর্মপাল দুজনেরই রচনারীতি অভিন্ন। শব্দ ও উপমাপ্রয়োগ, বিষয়বস্তুর পরিকল্পনা ও উপস্থাপনা এবং ভাষাশৈলীতে উভয়ে একই রীতি অনুসরণ করেছেন। বুদ্ধের ধর্ম-দর্শন সম্পর্কে উভয়ের ব্যাখ্যা প্রায় একই । ফলে ধারণা করা হয় যে, তাঁরা একই বিদ্যানিকেতনে অধ্যয়ন করেছেন। বুদ্ধঘোষ
সুত্ত পিটকের প্রথম চারটি নিকায়ের উপর অকথা রচনা করেছেন। অপরদিকে ধর্মপাল পঞ্চম নিকায় বা খুদ্দক নিকায়ের উপর অকথা রচনা করেন। সুত্তপিটকের প্রথম চারি নিকায়ের অকথাসমূহ তার আগে রচিত হওয়ায় তিনি শেষ নিকায়ের অকথা রচনা করেন। এ-কারণে ধারণা করা হয় যে, বুদ্ধঘোষ ধর্মপালের পূর্ববর্তী ছিলেন।
ধর্মপালের সাহিত্যকর্ম :
১৪টি গ্রন্থ ধর্মপালের রচনা হিসেবে ‘গন্ধবংস' গ্রন্থে উল্লেখ পাওয়া গেলেও পণ্ডিতগণ এ-বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করেন। অকথাসমূহের মধ্যে ইতিবুত্তকঠকথা, উদানঠকথা, চরিয়পিটকঠকথা, থেরগাথাট্ঠকথা, থেরীগাথাঠকথা, বিমলবিলাসিনী (বিমান বন্ধুর অকথ) এবং বিমলবিলাসিনী পেতবন্ধুর অট্ঠকথা অর্থাৎ পরমখদীপনী নামে পরিচিত এ-সাতটি গ্রন্থের ভূমিকায় উল্লেখ আছে যে, গ্রন্থসমূহ ধর্মপাল রচনা করেন। ফলে এ-সাতটি গ্রন্থ পণ্ডিতগণ ধর্মপালের রচনা হিসেবে স্বীকার করেন। কিন্তু সাসনবংসে অট্ঠকথাসমূহ ধর্মপালের রচনা হিসেবে স্বীকার করা হলেও টীকাগ্রন্থগুলো ধর্মপালের রচনা হিসেবে স্বীকার করা হয়নি।
ধর্মপালের মৃত্যু
ধর্মপালের মৃত্যু সম্পর্কে কিছুই জানা যায় না। তিনি যেহেতুে দক্ষিণ ভারতের অধিবাসী ছিলেন সেহেতু দক্ষিণ ভারতেই তাঁর মৃত্যু হওয়া স্বাভাবিক। তাই তিনি দক্ষিণ ভারতে মৃত্যুবরণ করেছিলেন বলে ধারণা করা যায় ।
অনুশীলনমূলক কাজ অট্ঠকথাচার্য ধর্মপাল কখন কোথায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন? অট্ঠকথাচার্য ধর্মপাল রচিত গ্রন্থের একটি তালিকা তৈরি কর । |
পাঠ : ৫
অট্ঠকথার গুরুত্ব
ত্রিপিটকের বিষয়বস্তু অট্ঠকথা সাহিত্যের প্রধান উপজীব্য বিষয় হলেও এতে প্রসঙ্গক্রমে প্রাচীন ভারত এবং শ্রীলঙ্কার ধর্ম-দর্শন, সমাজ, সাহিত্য, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, রাজনীতি, ভূগোল প্রভৃতি বিষয় আলোচিত হয়েছে। তাই অট্ঠকথাকে প্রাচীন ইতিহাস রচনার গুরুত্বপূর্ণ উৎস হিসেবে গণ্য করা হয়। অট্ঠকথাসমূহে সাধারণত ত্রিপিটকের বিষয়বস্তুই ব্যাখ্যা করা হয়েছে। ফলে অট্ঠকথার সাহায্যে সহজে এবং যথাযথভাবে বুদ্ধবাণী বোঝা যায়। তা ছাড়া, কালের বিবর্তনে বা অন্য কোনো কারণবশত ত্রিপিটকের বিষয়বস্তুতে সংযোজন-বিয়োজন বা পরিবর্তন-পরিবর্ধন ঘটেছে কি না তা সহজে নির্ণয় করা যায়। ত্রিপিটক অনুবাদের ক্ষেত্রেও অট্ঠকথা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ত্রিপিটকে বহু দুর্বোধ্য এবং জটিল বিষয় রয়েছে, যা অনুবাদ করার ক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দেয়। কারণ, সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ত্রিপিটকের অনেক শব্দ দুর্বোধ্য রূপ পরিগ্রহ করেছে। কিন্তু অঠকথায় সেসব জটিল ও দুর্বোধ্য শব্দের যথাযথ ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। এ-কারণে অট্ঠকথার সাহায্যে যথাযথভাবে ত্রিপিটক এবং পালি সাহিত্য অনুবাদ করা যায় ।
অট্ঠকথায় ত্রিপিটকের পরে রচিত অনেক গ্রন্থের নাম উল্লেখ পাওয়া যায়। ফলে পালি সাহিত্যভাণ্ডারে গ্রন্থসমূহের রচনাকাল সম্পর্কে যে বিতর্ক লক্ষ করা যায়, তা অট্ঠকথার সাহায্যে সমাধান করা যায়। অট্ঠকথা পাঠ করে বুদ্ধের সময়কাল থেকে খ্রিষ্টীয় পঞ্চম শতক পর্যন্ত প্রাচীন ভারত এবং শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক ইতিহাস সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায়। এর সাহায্যে প্রাচীন রাজন্যবর্গের রাজত্বকাল এবং জীবন-দর্শন নিয়ে প্রচলিত বিতর্ক বা সমস্যা সমাধান করা যায়। অকথার পরবর্তীকালে বুদ্ধের জীবন-চরিত, ধর্ম-দর্শন, বৌদ্ধধর্মের প্রচার-প্রসার এবং বৌদ্ধ সঙ্ঘের ইতিহাস নিয়ে পালি ভাষায় অনেক গ্রন্থ রচিত হয়েছে। অট্ঠকথার সাহায্যে সেসব গ্রন্থে বর্ণিত তথ্যের ঐতিহাসিকত্ব নির্ণয় করা যায়। বাক্যাংশের উদ্ধৃতি দেওয়া আধুনিক অভিধানের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। অকথায় উদ্ধৃতিসহ প্রচুর শব্দার্থ পাওয়া যায়। অট্ঠকথার শব্দার্থের সাহায্যে আধুনিক অভিধান রচনা করা সম্ভব। অকথা সাহিত্য পালি ভাষায় রচিত। পালি এক ধরনের প্রাকৃত, যা মধ্য ভারতীয় আর্য ভাষা হতে উদ্ভূত। ত্রিপিটক রচনার মধ্য দিয়ে পালি ভাষা সাহিত্যিক ভাষা হিসেবে মর্যাদা লাভ করে। পালি ভাষা দু'হাজারেরও অধিক বছরের ইতিহাস ধারণ করে আছে। অট্ঠকথায় সমৃদ্ধ ভাষাশৈলী ব্যবহৃত হয়েছে। অকথা সাহিত্যের ভাষাকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করে ভাষাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে অন্যান্য পালি সাহিত্যের ভাষা ও রচনাশৈলীর প্রকৃতি ও স্বরূপ নির্ধারণ করা যায়। তা ছাড়া পালি ভাষার বিবর্তনের ইতিহাসও জানা সম্ভব। এ-কারণে বলা যায়, ভাষাতাত্ত্বিক গবেষণায় অট্ঠকথার সাহিত্যের গুরুত্ব সমধিক ।
অট্ঠকথা সাহিত্যে বুদ্ধের সময় প্রচলিত বিভিন্ন ধর্মীয় সংঙ্ঘ ও ধর্মমত সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায়, যা বুদ্ধের সময়কালে প্রচলিত ধর্মমতের স্বরূপ সম্পর্কে ধারণা প্রদান করে। অকথা সাহিত্যে প্রাচীন ভারতের নৃতাত্ত্বিক বিষয়েও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায়। বিশেষত লোককাহিনীর সাহায্যে শাক্য, কোলীয়, মল্ল, লিচ্ছবি প্রভৃতি জাতির উৎপত্তি সম্পর্কে যে বিবরণ দেওয়া হয়েছে তা খুবই চিত্তাকর্ষক। অট্ঠকথা সাহিত্যে প্রাচীন ভারত ও শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে প্রচুর তথ্য পাওয়া যায়, যা প্রাচীনকালের রাজনৈতিক ইতিহাস রচনায় খুবই প্রয়োজনীয়। প্রাচীন ভারত ও শ্রীলঙ্কার ধর্ম-দর্শন, সমাজ, সাহিত্য, সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতি, ভূগোল, প্রভৃতির ইতিহাস জানার জন্য পালি অট্ঠকথা সাহিত্যের গুরুত্ব অপরিসীম ।
অনুশীলনমূলক কাজ অট্ঠকথাকে কেন প্রাচীন ইতিহাস রচনার গুরুত্বপূর্ণ উৎস হিসেবে গণ্য করা হয়? অট্ঠকথায় কোন কোন দেশের তথ্য পাওয়া যায়? প্রাচীনকালে গ্রাম ও রাস্তাঘাটের নামকরণ কীভাবে করা হতো?
|
শূন্যস্থান পূরণ কর
১ . বুদ্ধের ধর্ম-দর্শনের ব্যাখ্যা মূলক পালি ভাষার যে সাহিত্য কর্ম রচিত হয় তাকে.. .. .. .. বলে।
২. আট্ঠকথার সাহায্যে যথাযথ ভাবে.. .. .. .. সাহিত্য অনুবাদ করা যায় ।
৩. সমকালীন.. .. .. .. তিনি শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন।
৪. গন্ধবংস গ্রন্থে বুদ্ধদওকে ভারতের.. .. .. ..হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে।
৫. ধর্মপাল .. .. .. .. জন্মগ্রহণ করেন ।
সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন
১. অট্ঠকথা শব্দের অর্থ বল ।
২. অট্ঠকথা কয় ভাগে বিভক্ত ও কী কী?
৩. পঞ্চনিকায়ের অকথা ও অট্ঠকথা রচয়িতার নাম লেখ ।
৪. অভিধর্ম পিটকের অট্ঠকথাগুলোর নাম লেখ ।
৫. ধর্মপাল কোথায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন?
বর্ণনামূলক প্রশ্ন
১. অট্ঠকথা রচনার পটভূমি ব্যাখ্যা কর।
২. সুত্ত ও অভিধম্ম পিটকের অট্ঠকথা সম্পর্কে একটি সম্যক ধারণা দাও ।
৩. অট্ঠকথাচার্য বুদ্ধদত্তের জীবন ও কর্ম সম্পর্কে তুমি যা জান লেখ ।
৪. অট্ঠকথাচার্য ধর্মপালের জীবন ও কর্ম সম্পর্কে একটি নাতিদীর্ঘ প্রবন্ধ রচনা কর ।
বহুনির্বাচনি প্রশ্ন
১। ‘অট্ঠ' শব্দের বাংলা কী ?
ক. অতীত
খ. অর্থ
গ. অষ্ট
ঘ. অথৈ
২। বৌদ্ধ ভিক্ষুদের মধ্যে জাতিভেদ প্রথা পরিলক্ষিত হয় না, কারণ—
i ধর্মপালন সবার জন্য উন্মুক্ত ছিল
ii তাঁদের সকলের সঙ্ঘে প্রবেশাধিকার ছিল
iii সকল সুযোগ-সুবিধা একই ছিল
বলে।
নিচের কোনটি সঠিক ?
ক. i ও ii
খ. ii ও iii
গ. i ও iii
ঘ.i, ii ও iii
নিচের অনুচ্ছেদটি পড়ে ৩ ও ৪ নং প্রশ্নের উত্তর দাও
রমেশ তালুকদার ত্রিপিটকের একটি গ্রন্থ পড়ে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের পালনীয় শীলের ব্যাখ্যা জানতে পারেন। যাতে ভিক্ষুদের দৈনন্দিন জীবনচর্চা থেকে শুরু করে নৈতিক চরিত্র গঠনের নিয়মসমূহ নিহিত ছিল।
রমেশ তালুকদারের পঠিত বিষয়গুলো কোন গ্রন্থে নিহিত ?
ক. পরিবার পাঠ
গ. সুত্ত বিভঙ্গ
খ. খন্ধক
ঘ. ভিক্ষুণী বিভঙ্গ
81 উক্ত গ্রন্থ পাঠ করে জানা যায় -
i ভিক্ষু-ভিক্ষুণীদের বিধিবিধান
ii বৌদ্ধ ভিক্ষুদের দৈনন্দিন জীবনচর্চা
iii ত্রিপিটকের পরিচিতি
নিচের কোনটি সঠিক ?
ক. i গ. ii ও iii
খ. i ও ii ঘ. i, ii ও iii
সৃজনশীল প্রশ্ন
ক. গুরুত্ব বিচারে অট্ঠকথাকে কয় ভাগে ভাগ করা হয় ?
খ. অট্ঠকথা বলতে কী বোঝায় ? ব্যাখ্যা কর ।
গ.‘?’ চিহ্নিত স্থানে পাঠ্য বইয়ের অকথাচার্য কার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ? ব্যাখ্যা কর ।
ঘ. “উক্ত আচার্য বৌদ্ধ ধর্মের সাহিত্যকর্মে অশেষ অবদান রাখতে সক্ষম হন” – তুমি কি এ বক্তব্যের সাথে একমত ? যুক্তিসহকারে বিশ্লেষণ কর ।
অমল চাকমা একজন গ্রন্থপ্রণেতা। গ্রন্থ রচনার মাধ্যমে ব্যক্তিজীবনে তিনি অনেক সুনাম অর্জন করেন। তাঁর সাহিত্যকর্মের অবদান অনস্বীকার্য। কিন্তু সংসারধর্ম পালনে উদাসীন হওয়ায় তিনি গভীর সাধনা করে প্রব্রজ্যা জীবন গ্রহণ করেন ।
ক. কঙ্খাবিতরণী গ্রন্থটি কে রচনা করেন ?
খ. বৌদ্ধধর্মে অট্ঠকথার গুরুত্ব সংক্ষেপে ব্যাখ্যা কর ।
গ. অমল চাকমার সাহিত্যিক কর্মকাণ্ডের সাথে পাঠ্যবইয়ের কার কর্মকাণ্ডের ইঙ্গিত পাওয়া যায়- ব্যাখ্যা কর।
ঘ. উক্ত আচার্যের প্রব্রজ্যা লাভের কাহিনীটি ধর্মীয় আলোকে মূল্যায়ন কর ।