কেউ ছালটা ছাড়িয়ে নিয়ে সিদ্ধ করছে। পাতাগুলো ছিঁড়ে শিলে পিষছে কেউ! কেউবা ভাজছে গরম তেলে । খোস দাদ হাজা চুলকানিতে লাগাবে । কচি পাতাগুলো খায়ও অনেকে । এমনি কাঁচাই ...
চর্মরোগের অব্যর্থ মহৌষধ ।
কিম্বা ভেজে বেগুন-সহযোগে ।
যকৃতের পক্ষে ভারি উপকার।
কচি ডালগুলো ভেঙে চিবোয় কত লোক দাঁত ভালো থাকে । কবিরাজরা প্রশংসায় পঞ্চমুখ । বাড়ির পাশে গজালে বিজ্ঞরা খুশি হন।
বলে- “নিমের হাওয়া ভালো, থাক্, কেটো না ৷'
কাটে না, কিন্তু যত্নও করে না ।
আবর্জনা জমে এসে চারিদিকে।
শান দিয়ে বাঁধিয়েও দেয় কেউ— সে আর-এক আবর্জনা । হঠাৎ একদিন একটা নতুন ধরনের লোক এলো ।
মুগ্ধদৃষ্টিতে চেয়ে রইল নিমগাছের দিকে। ছাল তুললে না, পাতা ছিঁড়লে না, ডাল ভাঙলে না, মুগ্ধদৃষ্টিতে চেয়ে রইল শুধু ।
বলে উঠল,– ‘বাহ্, কী সুন্দর পাতাগুলি ... কী রূপ ! থোকা থোকা ফুলেরই বা কী বাহার.... একঝাঁক নক্ষত্র নেমে এসেছে যেন নীল আকাশ থেকে সবুজ সায়রে। বাহ্-' খানিকক্ষণ চেয়ে থেকে চলে গেল ।
কবিরাজ নয়, কবি ।
নিমগাছটার ইচ্ছে করতে লাগল লোকটার সঙ্গে চলে যায়। কিন্তু পারলে না। মাটির ভিতরে শিকড় অনেক দূরে চলে গেছে। বাড়ির পিছনে আবর্জনার স্তূপের মধ্যেই দাঁড়িয়ে রইল সে।
ওদের বাড়ির গৃহকর্ম-নিপুণা লক্ষ্মীবউটার ঠিক এক দশা।
প্রকৃত নাম বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়। বিহারের পূর্ণিয়ার অন্তর্গত মণিহার গ্রামে ১৮৯৯ সালের ১৯শে জুলাই তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ডা. সত্যনারায়ণ মুখোপাধ্যায়। বনফুল পূর্ণিয়ার সাহেবগঞ্জ ইংরেজি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯১৮ সালে ম্যাট্রিক, হাজারীবাগের সেন্ট কলম্বাস কলেজ থেকে ১৯২০ সালে আই.এসসি এবং ১৯২৭ সালে পাটনা মেডিক্যাল কলেজ থেকে এম. বি. পাস করেন। মেডিক্যাল অফিসার পদে চাকরির মাধ্যমে বনফুলের কর্মজীবন শুরু। ১৯১৮ সালে শনিবারের চিঠি তে ব্যঙ্গ-কবিতা ও প্যারোডি লিখে তাঁর সাহিত্য অঙ্গনে প্রবেশ। প্রবাসী পত্রিকায় তিনি একপাতা-আধপাতার গল্প লিখতেন । গল্পগুলো আকারে ক্ষুদ্র, অথচ বক্তব্যে তাৎপর্যপূর্ণ। তাঁর উল্লেখযোগ্য গল্পগ্রন্থ : বনফুলের গল্প, বনফুলের আরো গল্প, বাহুল্য, বিন্দুবিসর্গ, অনুগামিনী, তন্বী, ঊর্মিমালা, দূরবীন ইত্যাদি। বাস্তবজীবনে ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিচিত্র উপাদান তাঁর গল্প ও উপন্যাসে নিপুণভাবে প্রকাশিত হয়েছে। বনফুলের উল্লেখযোগ্য উপন্যাস হলো : তৃণখণ্ড, কিছুক্ষণ, দ্বৈরথ, নির্মোক, সে ও আমি, জঙ্গম, অগ্নি ইত্যাদি। এছাড়াও বনফুলের কবিতা, ব্যঙ্গ কবিতা, চতুর্দশপদী, জীবনী নাটক শ্রীমধুসূদন, বিদ্যাসাগর প্রভৃতি তাঁর অনন্যসাধারণ সৃষ্টি। বিভিন্ন পুরস্কারসহ তিনি পদ্মভূষণ উপাধি লাভ করেন । ১৯৭৯ সালের ৯ই ফেব্রুয়ারি বনফুল কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।
ছাল – বাকল, এখানে নিমগাছের বাকল । শিলে পেষা – শিল-পাটায় বাটা। অব্যর্থ – যা বিফল হবে না। পাতাগুলো খায়ও - নিমের কচিপাতা খেলে মানুষের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে। শান দিয়ে বাঁধানো - এখানে ইট ও সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো বোঝাচ্ছে। কবিরাজ – যিনি গাছগাছালি পরিশোধন করে মনুষ্যরোগের চিকিৎসা করেন। কবি – যিনি কবিতা লেখেন । শিকড় অনেক দূর চলে গেছে- প্রতীকাশ্রয়ে বর্ণিত। নিমগাছের শিকড় মাটির গভীরে প্রবেশ করে এবং চারিদিকে বিস্তৃতও হয়। লক্ষ্মী বউটার প্রতীক যেহেতু নিমগাছ সেহেতু নিমগাছের শিকড়ের সঙ্গে বউয়ের সংসারের জালে চারিদিকে আবদ্ধ হওয়াকে বোঝানো হয়েছে।
:বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়ের (বনফুল) অদৃশ্যলোক গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত ‘নিমগাছ গল্প । এই গল্পের সংক্ষিপ্ত অবয়বের মধ্যে লেখক বিপুল বক্তব্য উপস্থাপনের যে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন তা বাংলা সাহিত্যে বিরল। নিমগাছের বর্ণনা, এর পাতা, বাকল, ছায়ার ইত্যাদির বাহ্যিক উপকারিতা কবিতার মতো বর্ণনা করা হয়েছে এই গল্পে। কবিরাজ তার চিকিৎসার কাজে, সাধারণ মানুষ প্রাত্যহিক প্রয়োজনে নিমগাছকে অনবরত ব্যবহার করে থাকে। কিন্তু কেউ এই গাছের সামান্যও যত্ন নেয় না। একজন কবি একদিন নিমগাছের গুণ ও রূপের প্রশংসা করে। নিমগাছের ভালো লাগে ঐ লোককে এবং সে তার সঙ্গে চলে যেতে চায়। কিন্তু মাটির গভীরে তার শিকড়। গাছটি যেতে পারে না । আসলে গাছ তো চলতে পারে না। এটি একটি প্রতীকী গল্প । প্রকৃতপক্ষে, ‘নিমগাছ' গল্পটির নিমগাছ প্রতীকের সূত্রে বনফুল দেখিয়েছেন নারীর অপরিসীম আত্মত্যাগ। নারীর মানবিক মর্যাদা, পারিবারিক ও সামাজিক গুরুত্ব উপলব্ধি করার ইঙ্গিত দেয় গল্পটি।
আরও দেখুন...