পুস্তকের শ্রেণিবদ্ধ সংগ্রহকে লাইব্রেরি বা গ্রন্থাগার বলা হয় । সকল প্রকার জ্ঞানকে একত্র করে স্থায়িত্বদানের অভিপ্রায় থেকে লাইব্রেরির সৃষ্টি । এক ব্যক্তির পক্ষে সর্ববিদ্যাবিশারদ হওয়া অসম্ভব । বিভিন্ন ব্যক্তি বিভিন্ন বিদ্যায় পারদর্শিতা লাভ করে । আবার যে ব্যক্তি যে বিদ্যায় পারদর্শিতা লাভ করে, তার সবটুকু জ্ঞান মস্তিষ্কে ধারণ করাও তার পক্ষে সম্ভব হয় না । তাই প্রয়োজন এমন কোনো উপায় উদ্ভাবনের, যার দৌলতে দরকার অনুযায়ী সমস্ত বিষয়ে একটা মোটামুটি জ্ঞান লাভ করা যায় । ফলে লাইব্রেরির সৃষ্টি ।
লাইব্রেরি তিন প্রকার - ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সাধারণ । ব্যক্তিগত লাইব্রেরি ব্যক্তিমনের খেয়ালমতো গড়ে ওঠে তা হয়ে থাকে ব্যক্তির মনের প্রতিবিম্ব । ব্যক্তি যে ধরনের রচনা ভালোবাসে তার প্রাচুর্য, আর যে ধরনের রচনা পছন্দ করে না তার অনুপস্থিতি হয়ে থাকে ব্যক্তিগত লাইব্রেরির বৈশিষ্ট্য । এখানে ব্যক্তি স্বেচ্ছাচারী সম্রাট, খেয়ালমতো গড়ে তোলে তার কল্পনার তাজমহল । কাব্যপ্রেমিক হলে কাব্যগ্রন্থ দিয়ে, কথাসাহিত্যপ্রেমিক হলে কথাসাহিত্য দিয়ে, ইতিহাসপ্রিয় হলে ঐতিহাসিক গ্রন্থ দিয়ে সে সাজিয়ে তোলে তার টেবিল, আলমারির শেলফ - সবকিছু । কারো বাধা দেওয়ার অধিকার নেই, আপত্তি করবার দাবি নেই, উপদেশ দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা নেই । এখানে সে স্বাধীন, স্বতন্ত্ৰ ৷
ব্যক্তিগত লাইব্রেরি যেমন ব্যক্তির ইচ্ছার প্রতিবিম্ব, পারিবারিক লাইব্রেরি তেমনি পরিবারের অন্তর্গত ব্যক্তিসমূহের সমষ্টিগত ইচ্ছার প্রতিচ্ছায়া । এখানে যেমন একের রুচির ওপর বহুর অত্যাচার অশোভন, তেমনি বহুর রুচির ওপর একের জবরদস্তি অন্যায় । দশ জনের রুচির দিকে নজর রেখেই পারিবারিক লাইব্রেরি সাজাতে হয় ।
ব্যক্তিগত ও পারিবারিক লাইব্রেরি ব্যক্তি বা পরিবারের মর্জিমাফিক গড়ে ওঠে। সাধারণের হুকুম চালাবার মতো সেখানে কিছুই নেই । লাইব্রেরিসম্পন্ন ব্যক্তির চালচলনে এমন একটা শ্রী ফুটে উঠতে বাধ্য, যা অন্য প্রত্যক্ষ করা দুষ্কর । সত্যিকার বৈদগ্ধ্য বা চিৎপ্রকর্ষের অধিকারী হতে হলে লাইব্রেরির সঙ্গে অন্তরঙ্গতা সৃষ্টি করা অবশ্য প্রয়োজনীয় । তাছাড়া, লাইব্রেরি বা শ্রেণিবদ্ধ পুস্তক সংগ্রহ গৃহসজ্জার কাজেও লাগে । আর এই ধরনের গৃহসজ্জায় লাভ এই যে, বাইরের পারিপাট্যের সঙ্গে তা মানসিক সৌন্দর্যেরও পরিচয় দেয়। লাইব্রেরি সৃজনে তৎপর হয়ে ধনী ব্যক্তিরা পুস্তক কেনার নেশা সৃষ্টি করলে দেশের পক্ষে লাভ হবে এই যে অনবরত বাঁধানো পুস্তকগুলো হাতড়াতে হাতড়াতে তাদের চামড়ার তলে যে একটি মন সুপ্ত রয়েছে, সে সম্বন্ধে তাঁরা সচেতন হয়ে উঠবেন । লাইব্রেরি সৃজনের দরুন তাঁরা নিজেরা ততটা লাভবান না হলেও তাঁদের পুত্রকন্যাদের যথেষ্ট উপকৃত হওয়ার সম্ভাবনা। হয়তো এই লাইব্রেরি থাকার দরুণই পরিণত বয়সে তাঁরা সুসাহিত্যিক বা সাহিত্য-সমঝদার হয়ে উঠবেন । এ আশা শুধু ভিত্তিহীন কল্পনা নয়, বড় বড় সাহিত্যিক বা কবিদের জীবনী আলোচনা করলে দেখা যায়, বাল্যে তাঁরা পিতার অথবা পারিবারিক লাইব্রেরি থেকে সাহিত্যসাধনার প্রেরণা লাভ করেছেন ।সাধারণ পাঠাগার আধুনিক জিনিস । কারণ, ঐতিহাসিকরা কী বলবেন জানি নে, যে জ্ঞানার্জনস্পৃহা থেকে পাঠাগারের জন্ম, ব্যাপকভাবে তার জাগরণস্পৃহা সহজে মেটানো সম্ভব নয় । জ্ঞানের বাহন পুস্তক, আর পুস্তক কিনে পড়া যে দুঃসাধ্য ব্যাপার, তা ধারণা করা সহজ । পুস্তকের ব্যাপারেও সমবায়নীতির প্রবর্তন আবশ্যক । অর্থাৎ এক্ষেত্রেও দশে মিলে কাজ না করলে সার্থকতা লাভ করা অসম্ভব। এ ব্যাপারে দশের মিলিত ফলস্বরূপ যা পাওয়া যায়, তাকেই সাধারণ লাইব্রেরি বলা হয় । অবশ্য সাধারণ লাইব্রেরি ব্যক্তির দানও হতে পারে । তবে ব্যক্তিগত প্রভাবের চাইতে সাধারণের প্রভাবই সেখানে বলবত্তর হতে বাধ্য । যদি না হয়, তবে সাধারণ পাঠাগার না বলে ব্যক্তিগত পাঠাগার বলাই ভালো ।
সাধারণ লাইব্রেরির পুস্তক শ্রেণিবদ্ধ করতে যথেষ্ট সতর্কতার পরিচয় দিতে হলেও পুস্তক নির্বাচনে বিশেষ সাবধানতার পরিচয় দিতে হয় বলে মনে হয় না ।
সাধারণ লাইব্রেরির পুস্তকসংগ্রহ বিষয়ে আরেকটি কথা বলা দরকার । পুস্তক নির্বাচনকালে জাতীয় বৈশিষ্ট্য বা জাতীয় সংকীর্ণতার পরিচয় যত কম দেওয়া হয়, ততই ভালো । কারণ, যতদূর মনে হয়, পাঠাগার জাতীয় বৈশিষ্ট্যের রক্ষক নয়, ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্যের বিকাশক। আর ভালো পুস্তকলেখক যখন কোনো বিশেষ সম্প্রদায়ের লোক নন, সমস্ত সম্প্রদায়ের আত্মীয়, তখন পুস্তক নির্বাচনকালে সংকীর্ণ মনোভাবসম্পন্ন না হওয়াই ভালো ।
জাতির জীবনধারা গঙ্গা-যমুনার মতো দুই ধারায় প্রবাহিত । এক ধারার নাম আত্মরক্ষা বা স্বার্থ প্রসার, আরেক ধারার নাম আত্মপ্রকাশ বা পরার্থ বৃদ্ধি । একদিকে যুদ্ধবিগ্রহ, মামলাফ্যাসাদ প্রভৃতি কদর্য দিক, অপর দিকে সাহিত্যশিল্প, ধর্ম প্রভৃতি কল্যাণপ্রদ দিক । একদিকে শুধু কাজের জন্য কাজ, অপর দিকে আনন্দের জন্য কাজ । একদিকে সংগ্রহ, আরেক দিকে সৃষ্টি । যে জাতি দ্বিতীয় দিকটির প্রতি উদাসীন থেকে শুধু প্রথম দিকটির সাধনা করে, সে জাতি কখনও উঁচু জীবনের অধিকারী হতে পারে না । কোনো প্রকারে টিকে থাকতে পারলেও নব নব বৈভব সৃষ্টি তার দ্বারা সম্ভব হয় না । মানসিক ও আত্মিক জীবনের সাধনা থেকে চরিত্রে যে শ্রী ফুটে ওঠে, তা থেকে তাকে এক রকম বঞ্চিত থাকতেই হয় । জীবনে শ্রী ফোটাতে হলে দ্বিতীয় দিকটির সাধনা আবশ্যক । আর সেজন্য লাইব্রেরি এক অমূল্য অবদান ।
লাইব্রেরি জাতির সভ্যতা ও উন্নতির মানদণ্ড । কারণ, বুদ্ধির জাগরণ-ভিন্ন জাতীয় আন্দোলন হুজুগপ্রিয়তা ও ভাববিলাসিতার নামান্তর, আর পুস্তক অধ্যয়ন ব্যতীত বুদ্ধির জাগরণ অসম্ভব ।(সংক্ষেপিত)
মোতাহের হোসেন চৌধুরী ১৯০৩ সালে কুমিল্লায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈতৃক নিবাস নোয়াখালী জেলার কাঞ্চনপুর গ্রামে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৪৩ সালে বাংলায় এম.এ. পাস করেনকর্মজীবনে তিনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপক ছিলেন। একজন সংস্কৃতিবান ও মার্জিত রুচিসম্পন্ন ব্যক্তি হিসেবে তিনি খ্যাত ছিলেন। ঢাকা থেকে প্রকাশিত 'শিখা' পত্রিকার সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন । তাঁর লেখায় মননশীলতা ও চিন্তার স্বচ্ছন্দ প্রকাশ ঘটেছে। তাঁর গদ্যে প্রমথ চৌধুরীর প্রভাব লক্ষণীয় । মূলত গদ্যকার হলেও তিনি বেশ কিছু কবিতাও রচনা করেন। তাঁর প্রবন্ধগ্রন্থ সংস্কৃতি কথা বাংলা সাহিত্যের মননশীল প্রবন্ধ-ধারায় একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন। তাঁর মৃত্যুর পর গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। সভ্যতা ও সুখ তাঁর দুটি অনুবাদগ্রন্থ। ১৯৫৬ সালের ১৮ই সেপ্টেম্বর তিনি পরলোকগমন করেন ।
শ্রেণিবদ্ধ -শ্রেণি বা বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী সারি সারি সাজানো ।
অভিপ্ৰায় -ইচ্ছা, উদ্দেশ্য, আকাঙ্ক্ষা ।
সর্ববিদ্যাবিশারদ -সব বিষয়ে পাণ্ডিত্যের অধিকারী ।
পারদর্শিতা -নৈপুণ্য, পটুতা ।
উদ্ভাবন -আবিষ্কার, গবেষণা করে নতুন কিছু বের করা ।
প্রতিবিম্ব -প্রতিচ্ছায়া, প্রতিচ্ছবি, প্রতিফলিত অবিকল রূপ।
স্বেচ্ছাচারী -যে আপন ইচ্ছানুযায়ী আচরণ করে ।
স্বেচ্ছাচারী সম্রাট -যে রাজা আপন ইচ্ছা অনুযায়ী রাজ্য পরিচালনা করেন । এখানে বাক্যাংশটির বিশেষ অর্থ হচ্ছে - ব্যক্তিগত স্বাধীন রুচি ও পছন্দ অনুযায়ী বই সংগ্রহকারী । যিনি খেয়ালমতো গড়ে তোলেন তাঁর কল্পনার সাম্রাজ্য ।
তাজমহল - সম্রাট শাজাহান যেমন করে তাজমহল তৈরি করে শিল্পীমনের পরিচয় দিয়েছিলেন, তেমনি ব্যক্তিগত লাইব্রেরি হচ্ছে ব্যক্তির নিজস্ব রুচি ও শিল্পীমনের নিদর্শন ।
কাব্যপ্রেমিক - যে কবিতা ভালোবাসে ।
প্ৰতিচ্ছায়া -প্ৰতিচ্ছবি ।
অশোভন -যা শোভন বা সুন্দর নয় ।
জবরদস্তি -জুলুম, পীড়ন, বাড়াবাড়ি ।
মর্জিমাফিক -ইচ্ছা অনুযায়ী, খেয়াল অনুসারে ।
শ্রী -সৌন্দর্য ।
দুষ্কর -দুঃসাধ্য, সহজে করা যায় না এমন ।
বৈদগ্ধ্য -পাণ্ডিত্য ।
চিৎকর্ষ -জ্ঞানচর্চার ফলে মনের উন্নতি ।
পারিপাট্য -শৃঙ্খলা, গোছানো ভাব ।
সৃজন -সৃষ্টি ।
সমবায় নীতি -বহু মানুষ মিলে প্রাতিষ্ঠানিক ও স্বেচ্ছামূলক উদ্যোগে দেশের উন্নয়ন ও জনগণের কল্যাণের নীতি ।
সমঝদার -বোঝে এমন, রসজ্ঞ।
স্পৃহা -ইচ্ছা, আকাঙ্ক্ষা ।
বলবত্তর -অধিকতর শক্তিশালী ।
পরার্থ -পরের উপকার ।
সম্প্রদায় -বিশেষ সমাজ ও গোষ্ঠী ।
বিকাশক -যা বিকাশ ঘটায় ।
ভাব বিলাসিতা -ভাবনার বিলসিতা, কাজের চেয়ে ভাবনায় বেশি মনোযোগ ।
মানবসভ্যতার ক্রম অগ্রগতির ধারায় মানুষের অর্জিত জ্ঞান, মহৎ অনুভব সঞ্চিত হয়ে থাকে গ্রন্থাগারে । এর মাধ্যমে পূর্বপ্রজন্মের জ্ঞান সঞ্চারিত হয় উত্তরপ্রজন্মের কাছে । তাই জ্ঞানচর্চা, জ্ঞান-অন্বেষণ ও গবেষণার ক্ষেত্রে গ্রন্থাগারের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম ।
গ্রন্থাগার হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের বইয়ের শ্রেণিবদ্ধ সংগ্রহশালা । সব ধরনের জ্ঞানের একত্র সমাবেশ ঘটিয়ে জ্ঞানচর্চার প্রসারে ধারাবাহিক ও স্থায়ী ভূমিকা পালনের জন্য লাইব্রেরির সৃষ্টি । বিশ্বের জ্ঞানভাণ্ডার এত বহুমুখী ও বিপুল যে, কোনো এক জনের পক্ষে সব জ্ঞান আহরণ করা সম্ভব নয় । তাই এটি ব্যবহার করে বিভিন্ন ব্যক্তি তাঁর প্রয়োজন ও আগ্রহ অনুযায়ী জ্ঞানচর্চা করতে পারেন । ‘লাইব্রেরি' প্রবন্ধটিতে জ্ঞানলাভ ও পাঠাগারের সম্পর্ক উপস্থাপন করেছেন মোতাহের হোসেন চৌধুরী। প্রবন্ধটি বইপাঠে উদ্বুদ্ধ করার পাশাপাশি পাঠাগার প্রতিষ্ঠায় উৎসাহী করে তোলে।
আরও দেখুন...