আমারও মন চৈত্রে পলাতক,
পলাশে আর আমের ডালে ডালে
সবুজ মাঠে মাঝবয়সী লালে
দণ্ড দুই মুক্তি-সুখে জিরায়
মাটির কাছে সব মানুষ খাতক ।
বিভোল মনে অবাক চেয়ে থাকে
সারা দুপুর হেলাফেলার হীরায়,
উদাস মন হাওয়ার পাকে পাকে
ঘুঘুর ডাকে গ্রামের ফাঁকা ক্ষেতে
মিলিয়ে দেয় দুস্থতার পাতক,
বিকাল তাই সন্ধ্যা-রঙে মেতে শেষ,
যে শেষ সারাদিনের পরে
একটি গানে গহন স্বাক্ষরে ৷
জানো কি সেই গানের আমি চাতক?
বিষ্ণু দে ১৯০৯ সালে কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন । কলকাতার সংস্কৃত কলেজিয়েট স্কুলে তাঁর শিক্ষা আরম্ভ হয়। ১৯৩২ সালে সেন্ট পলস কলেজ থেকে ইংরেজি সাহিত্যে বি.এ. সম্মান এবং ১৯৩৪ সালে এম. এ. ডিগ্রি লাভ করেন। কর্মজীবনে তিনি রিপন কলেজ, কৃষ্ণনগর কলেজ, মৌলানা আজাদ কলেজ ও প্রেসিডেন্সি কলেজে ইংরেজির অধ্যাপক ছিলেন। ১৯২৩ সালে প্রকাশিত 'কল্লোল' পত্রিকাকে কেন্দ্র করে যে সাহিত্যিক গোষ্ঠীর উদ্ভব ঘটে, তিনি ছিলেন তাঁর অন্যতম কবি। অসাধারণ পাণ্ডিত্যের অধিকারী বিষ্ণু দে পুরাণ ও ঐতিহ্যের ব্যবহারে তাঁর কবিতাকে ভিন্ন এক মাত্রা দান করেন। বোধের তীক্ষ্ণতা, তীব্রতা ও জটিলতায় তাঁর কবিতা স্বাতন্ত্র্যমণ্ডিত। তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্য: উর্বশী ও আর্টেমিস, চোরাবালি, সাতভাই চম্পা, তুমি শুধু পঁচিশে বৈশাখ, স্মৃতিসত্তা ভবিষ্যৎ, রবিকরোজ্জ্বল নিজদেশে, উত্তরে মৌন থাকো ইত্যাদি। সাহিত্য আকাদেমি ও জ্ঞানপীঠ পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননায় তিনি ভূষিত হন । ৩রা ডিসেম্বর ১৯৮২ সালে বিষ্ণু দে মৃত্যুবরণ করেন।
আমারও মন ... মুক্তি সুখে জিরায় - মানবমনে প্রকৃতির শাশ্বত আবেদন আছে। শহরে নগরে যেখানে সে বসবাস করুক না কেন, তার অবচেতনে লুকিয়ে থাকে প্রকৃতির চিরায়ত আহ্বান । আলোচ্য অংশে কবি হৃদয়ও পালিয়ে আনন্দ পায় চৈত্রের ঠা-ঠা রোদের আম-কাঁঠালের ডালে ডালে, সবুজ মাঠে মাঠে। মাঝবয়সী লাল – গাছ-পালার বয়স্ক পাতার রং বোঝাতে কবি এই চিত্রকল্পটি ব্যবহার করেছেন। বিভোল— অভিভূত, আত্মহারা, মুগ্ধ। দুস্থতার পাতক – শারীরিক ও মানসিক অশান্তি দূর করা অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। চাতক— একপ্রকার পাখি। কবি কল্পনায় চাতক পাখি বৃষ্টির পানি ছাড়া অন্য পানি পান করে না ।
বিষ্ণু দে-র ‘একটি কাফি’ কবিতাটি কবির তুমি শুধু পঁচিশে বৈশাখ কাব্য থেকে সংকলন করা হয়েছে। এটি একটি প্রকৃতিলগ্ন কবিতা। বাংলার নিসর্গ প্রকৃতি, এর মাঠ-ঘাট, মানুষ অতুলনীয় এবং বিশেষ আবেদনময়। যে জন এই নিসর্গ-প্রকৃতি থেকে নগরের আহ্বানে সেখানে স্থায়ী বসতি গড়েন, তাকেও তার এককালের পল্লিপ্রকৃতি বারবার আকর্ষণ করে; ষড়ঋতু তার মনে আবেগের রংধনু তোলে। এর শাশ্বত কারণ হলো, মানুষ স্বভাবত তার নিজভূমের প্রতি ঋণী হয় । কবি নিজেও তৃষ্ণার্ত চাতক পাখির মতো তাঁর নিজভূমের পল্লিপ্রকৃতির জন্য অপেক্ষমাণ। কবিতায় নিসর্গ প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের একাত্মতাই উন্মোচিত হয়েছে।
আরও দেখুন...