উৎস দলিলাদি ও কোডিং শনাক্তকরণ এবং ম্যানেজমেন্ট রিপোর্টিং
Source Documents, Coding Identification and
Management Reporting
একটি পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের ব্যয় সংক্রান্ত অভ্যন্তরীণ পরিকল্পনা প্রণয়ন (Planning), সিদ্ধান্ত গ্রহণ (Decisions making) এবং নিয়ন্ত্রণ (Control) করার জন্য উৎপাদন ব্যয় হিসাববিজ্ঞান (Cost accounting) সম্পর্কে জানা আবশ্যক। বিভিন্ন রকমের ব্যয় পরিমাণ ও উৎস দলিলাদি (Source documents) সংরক্ষণ ও প্রতিষ্ঠানে একটি উপযুক্ত কোডিং সিস্টেম (Coding system) প্রণয়নও গুরুত্বপূর্ণ। হিসাবরক্ষকদের দলিলসমূহে যথার্থ কোড ব্যবহার করা, সঠিক অ্যাকাউন্টে লিপিবদ্ধ করা এবং এই সিস্টেম থেকে বিভিন্ন তথ্যের ভিত্তিতে নানা ধরনের ম্যানেজমেন্ট রিপোর্ট প্রস্তুত করাতে হয়য়। এ অধ্যায় শেষে আমার যা জানতে পারব— উৎস দলিলাদি, কোডিং সিস্টেম, কোডিং শনাক্তকরণ এবং ম্যানেজমেন্ট রিপোর্টিং।
একটি প্রতিষ্ঠানে প্রতিনিয়ত অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক বিভিন্ন রকমের কার্যক্রম সংঘটিত হয় যা উৎপাদন ব্যয় হিসাববিজ্ঞানের (Cost accounting) আলোচ্য বিষয়। যেমন- একটি প্রতিষ্ঠান নানা ধরনের কাঁচামাল (Materials) ব্রুয় করে। অনেক কর্মচারী ও কর্মকর্তা মজুরি ও বেতনের ভিত্তিতে কর্মরত থেকে উৎপাদন কার্যে প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে নিয়োজিত আছে। এছাড়া প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন রকমের স্থির ব্যয় (Fixed cost) হয়। এসব ব্যয় উপাদান (Cost element) তাদের উৎস থেকেই সঠিকভাবে দলিলপত্রের ভিত্তিতে (Documentation) লিপিবদ্ধ করা গুরুত্বপূর্ণ।
ম্যাটেরিয়াল কন্ট্রোল সাইকেল (Material Control Cycle)
মনে করো, জুবায়ের অ্যান্ড ব্রাদার্স একটি পোশাক উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান। এখানে পোশাক তৈরির জন্য বিভিন্ন রকম কাঁচামালের (Raw material) প্রয়োজন হয়। এসব কাঁচামাল সরবরাহকারীর কাছ থেকে ক্রয়/গ্রহণ করে স্টোরে মজুদকরণ, উৎপাদনে ইস্যুকরণ এবং ব্যয় সংক্রান্ত সকল হিসাব যথাযথভাবে লিপিবদ্ধকরণ গুরুত্বপূর্ণ। এ সংশ্লিষ্ট ধাপগুলো চক্রাকারে এবং ক্রমান্বয়ে আবর্তিত হয় যা ম্যাটেরিয়াল কন্ট্রোল সাইকেল হিসেবে পরিচিত।
ম্যাটেরিয়াল কন্ট্রোল সাইকেল-এর ধাপগুলো নিচে সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো—
মালের চাহিদা (Material requisition): উৎপাদনকারী বিভাগের যখন গুদাম থেকে কাঁচামালের প্রয়োজন হয় তখন মালের চাহিদা দেওয়া হয়। উৎপাদনকারী বিভাগের একজন কর্মকর্তা মান চাহিদাপত্রে স্বাক্ষর করে অনুমোদন দিলে গুদাম থেকে চাহিদাকৃত মাল উৎপাদনকারী বিভাগে সরবরাহ করা হয় ।
ক্রয় চাহিদা (Purchase requisition): উৎপাদনকারী বিভাগে যাতে মজুদের ঘাটতি না পরে সেজন্য প্রতিষ্ঠান কর্তৃক সরবরাহকারীর নিকট থেকে যে পরিমাণ কাঁচামাল ক্রয়ের প্রয়োজন হয় তাকে ক্রয় চাহিদা বলে। ক্রয় চাহিদাতে একটি আনুমানিক পরিমাণ পণ্য ক্রয় করা হবে বলে আন্দাজ করা হয় ।
ক্রয় ফরমায়েশ (Purchase order): ব্রুয় চাহিদা নির্ণয় করার পর একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ কাঁচামালের উল্লেখ করে সরবরাহকারীকে যখন পণ্য ক্রয়ের বিষয়ে জানানো হয় তখন তাকে ক্রয় ফরমায়েশ বলে।
গ্রহণ (Receiving) : ক্রয় ফরমায়েশ অনুযায়ী সরবরাহকারী কর্তৃক পাঠানো পণ্য সঠিকভাবে বুঝে নেওয়াকেই গ্রহণ বলে।
গুদামজাতকরণ (Storing): উৎপাদনকারী বিভাগ হতে মালের চাহিদা না আসা পর্যন্ত কাঁচামাল সংরক্ষণ করাকে গুদামজাতকরণ বলে। প্রেরণ (Issuing) উৎপাদনকারী বিভাগ থেকে প্রাপ্ত মালের চাহিদা অনুযায়ী গুদামঘর থেকে উৎপাদনকারী বিভাগে কাঁচামাল পাঠানোকে প্রেরণ বলে।
ফ্রি-ইনভেন্টরি (Free-inventory) : ইনভেন্টরি ব্যবস্থাপনায় স্টোর বিভাগকে কী পরিমাণ মাল (Material) মুক্ত অবস্থায় আছে তা হিসাব রাখতে হয়। অর্থাৎ যে মালের জন্য উৎপাদন বিভাগ থেকে কোনো চাহিদাপত্র নেই এবং যেকোনো বিভাগকে ইস্যু করা যাবে তাকে ফ্রি-ইনভেন্টরি বলে। আমরা নিম্নলিখিত সূত্রের সাহায্যে ফ্রি-ইনভেন্টরির হিসাব করতে পারব।
ফ্রি-ইনভেন্টরি = মজুদকৃত ইনভেন্টরি (Inventory on hand) + ফরমায়েশাধীন মাল ( Inventory on order) চাহিদাপত্রের বিপরীতে নির্গমনের জন্য সিডিউল করা মাল (Inventory Scheduled for use)মালের আদেশ, গ্রহণ, মজুদ ও ইস্যু করার জন্য প্রয়োজনীয় দলিলাদি ( Necessary Document for ordering, receiving, storing and issuing materials)
মাল চাহিদাপত্র (Material requisition note) : কোনো উৎপাদনকারী বিভাগে (Production department) উৎপাদন কার্য সম্পন্ন করতে যে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল দরকার তা পূর্বপরিকল্পনার ভিত্তিতে চিহ্নিত করা হয়। আলোচ্য বিভাগ কোন কাঁচামাল কত পরিমাণে প্রয়োজন তা উল্লেখ করে স্টোরের (Store) কাছে একটি মাল চাহিদাপত্র বা Material requisition note প্রেরণ করে। এর একটি কপি প্রেরণকারী বিভাগ নিজের কাছে সংরক্ষণ করে, আরেক কপি স্টোরে সংরক্ষিত হয় যা একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস প্রামাণিক দলিল (Source document) হিসেবে বিবেচিত। কারণ এর উপর ভিত্তি করেই পরবর্তীতে কাঁচামাল স্টোর থেকে উৎপাদনকারী বিভাগে ইস্যু (Issue) করা হবে।
ক্রয় চাহিদাপত্র (Purchase requisition note) : যখন স্টোরস বিভাগ থেকে কোনো কাঁচামালের মজুদ একটি নির্দিষ্ট সীমার কাছাকাছি নেমে আসে, স্টোরকিপার একটি পূর্বমুদ্রিত বিশেষ ধরনের ফরমের মাধ্যমে ক্রয় বিভাগ (Purchasing department)-এর কাছে ক্রয় চাহিদা পেশ করে। এই ফরম ব্রুয় চাহিদাপত্র (Purchase requisition note) হিসেবে পরিচিত। এ চাহিদাপত্রে মালের বিবরণ, বিক্রেতার ক্যাটালগ নাম্বার (যদি সরবরাহকারী নিয়মিত হয়), প্রত্যাশিত ডেলিভারি তারিখ ইত্যাদি ঘর থাকে। চাহিদাপত্রটি অবশ্যই দায়িত্বশীল অফিসার কর্তৃক অনুমোদিত (Approved) হতে হবে যাতে নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা যায়। ক্রয় চাহিদাপত্রের তিনটি কপি তৈরি করা হয় যার মধ্যে মূল কপি ক্রয় বিভাগে প্রেরণ করা হয়। এক কপি সংশ্লিষ্ট চাহিদাদাতা বিভাগে এবং একটি কপি স্টোরের কাছে থাকে।
ক্রয় ফরমায়েশপত্র (Purchase order): ব্রুয় চাহিদাপত্র পাওয়ার পর, ক্রয় বিভাগ মালের উৎস তথা উপযুক্ত সরবরাহকারীর অনুসন্ধান করে। নিয়মিত ক্রয়ের ক্ষেত্রে সরবরাহকারী নির্ধারিত থাকে। নতুন কোনো সরবরাহকারী (Supplier) বাছাইয়ের ক্ষেত্রে Letter of inquiry আহ্বান করে সম্ভাব্য সরবরাহকারীদেরথেকে Quotation গ্রহণ করে। এরপর ক্রয় বিভাগ তুলনামূলক দর, বাট্টার হার, ডেলিভারির সময়, ঋণকাল (Credit period) ইত্যাদি তুলনা করে সরবরাহকারী চূড়ান্ত করে। অতঃপর ক্রয় বিভাগ পূর্বমুদ্রিত ক্রয় ফরমায়েশপত্র ( Purchase order) পূরণ করে মূল কপিটি সরবরাহকারীর নিকট পেশ করেন। এছাড়া একটি করে কপি হিসাব বিভাগ, মাল গ্রহণ বিভাগ (Goods received section), চাহিদাদাতা বিভাগে প্রেরণ করে।ক্রয় ফরমায়েশ পত্র পাওয়ার পর সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান মাল সরবরাহ করে এবং পণ্য প্রদানের সাথে একটি। Delivery note ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের মাল গ্রহণ বিভাগকে প্রদান করে যেখানে মালের বিবরণ ও পরিমাণ উল্লেখ করা থাকে।
মালামাল গ্রহণ পত্র (Goods received note) : প্রেরিত মালের চালান পাওয়ার পর সঠিক delivery note এবং মাল গ্রহণ বিভাগে থাকা ক্রয় ফরমায়েশ পত্র (Purchase order) এর কপির সাথে যাচাই বাছাই করে গ্রহণকারী কেরানি (Store clerk) মালের চালান গ্রহণ করে এবং সেই মর্মে মালামাল গ্রহণ পত্র (Goods received note) তৈরি করেন। তিনি এক কপি করে হিসাব বিভাগ ও চাহিদাদাতা বিভাগে প্রেরণ করেন।মাল ফেরত নোট (Material return note) মাল গ্রহণ করার পর স্টোর থেকে সংশ্লিষ্ট চাহিদাদাতা বিভাগে পূর্বে প্রেরণকৃত মাল চাহিদাপত্রের ভিত্তিতে নির্দিষ্ট পরিমাণে মাল (Material) পণ্য (Goods) উৎপাদনের উদ্দেশ্যে ইস্যু করা হয়। অনেক সময় উৎপাদন শেষে কিছু মাল উদ্বৃত্ত বা অবশিষ্ট থাকতে পারে। সেগুলো স্টোরে ফেরত পাঠানো হয়। কোন কোন মাল কী পরিমাণে স্টোরে ফেরত পাঠানো হয় তা চিহ্নিত করে উৎপাদন বিভাগ Material return note তৈরি করে এবং একটি কপি স্টোরে পাঠায়।ম্যাটেরিয়াল কন্ট্রোল সাইকেলের প্রয়োজনীয় দলিলাদি সম্পর্কে আমরা সম্যক ধারণা পেলাম। এবার স্টোর বিভাগের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে চিন্তা করো স্টোরে বিভিন্ন Material এর মজুদের হিসাবরক্ষণে প্রয়োজনীয় রেকর্ড হালনাগাদ (Update) করতে কী কী দলিলের প্রয়োজন হবে তা দেখব।
বিন কার্ড (Bin card) : স্টোরে বিভিন্ন মালের গ্রহণ (Receipt), নির্গমন (Issue) এবং অবশিষ্ট পরিমাণ (Physical quantity) বিন কার্ডে (Bin card) লিপিবদ্ধ করা হয়।
বিন কার্ড নিত্য মজুদ তালিকা (Perpetual inventory system) এর একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। বিন কার্ডে নতুন কোনো মাল সরবরাহকারীর থেকে গ্রহণ করলে Good received note-এর রেফারেন্স দিয়ে প্রাপ্তি কলামে রেকর্ড করা হয়। ঠিক তেমনি কোনো মাল উৎপাদন থেকে ফেরত আসলে Material return note-এর রেফারেন্স দিয়ে প্রাপ্তি কলামেলিপিবদ্ধ করা হয়। পক্ষান্তরে উৎপাদনের উদ্দেশ্যে ইস্যুকৃত মাল Material requisition note-এর রেফারেন্স দিয়ে Bin card-এর নির্গমন কলামে লিপিবদ্ধ করা হয়।
আমরা পূর্ববর্তী আলোচনায় ম্যাটেরিয়াল কন্ট্রোল সাইকেলে প্রয়োজনীয় দলিলাদি সম্পর্কে জেনেছি। এবার উৎপাদন ব্যয় হিসাববিজ্ঞান (Cost accounting)-এর প্রেক্ষাপটে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ উপাদান/কাঁচামাল বায় (Direct and indirect material cost ) নির্ধারণ, বিশ্লেষণ, অনুমোদন ও রেকর্ডিং সম্পর্কে আলোচনা করব।
বায় প্রকৃতি (Cost nature) এর ভিত্তিতে ব্যয়কে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ব্যয়ে ভাগ করা যায়। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ উপাদান/কাঁচামাল ব্যয়ের ধারণা পেতে একটি উদাহরণ চিন্তা করি। মনে করো বংশাল মটরস একটি মটরবাইক প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান। এখানে একটি মটরবাইককে যদি ব্যয় ইউনিট (Cost unit) বিবেচনা করি তাহলে মটরবাইক তৈরিতে প্রয়োজনীয় প্রত্যক্ষ উপাদান/কাঁচামাল হবে মেটাল বডি পার্টস, টায়ার ইত্যাদি। অর্থাৎ যে সব উপাদান সরাসরি চিহ্নিত (Identify / trace) করা যায় তাই প্রত্যক্ষ উপাদান/কাঁচামাল । পক্ষান্তরে, উৎপাদন প্লান্টে ফ্লু. টেপ, প্রস্তুতকারী মেশিনের লুব্রিকেট, শ্রমিকদের সুরক্ষার জন্য গ্লাভস ইত্যাদিও প্রয়োজন হয়। একটি বাইক তৈরিতে এসব উপাদান কতটুকু প্রয়োজন তা সরাসরিভাবে চিহ্নিত করা সম্ভব হয় না। তাই বংশাল মটরস-এর জন্য এসব উপাদান পরোক্ষ উপাদান / কাঁচামাল ( Indirect
material) হিসেবে বিবেচিত হবে। তাই বলা যায়, উৎপাদনে ব্যবহৃত যে উপাদান উৎপাদিত পণ্যের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত না বা চিহ্নিত করা যায় না সেসব ব্যয়কে পরোক্ষ উপাদান/কাঁচামাল ব্যয় বলা হয় ( Indirect material cost)। কাঁচামাল / উপাদানের প্রকৃতি অনুযায়ী প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কাঁচামাল/উপাদানের শ্রেণিবিভাগ করা হয়। স্টোরে সংরক্ষণের
জন্য আলাদা ক্যাটালগ থাকে যাতে কাঁচামাল / উপাদানগুলোর গ্রহণ ও ইস্যু করা সহজ হয়।
প্রত্যক্ষ উপাদান ব্যয় বিশ্লেষণ (Direct material cost analysis) : পূর্ববর্তী আলোচনায় আমরা দেখেছি কোন কাঁচামাল উপাদান কী পরিমাণে প্রয়োজন তা উল্লেখ করে চাহিদাকারী উৎপাদন বিভাগ মাল চাহিদাপত্র (Material requisition note) স্টোরে পাঠায়। প্রত্যক্ষ কাঁচামাল উপাদানের চাহিদাপত্রে এই কাঁচামাল উপাদানের ব্যয় লক্ষ্যবস্তু (Cost object) যেমন— জব নাম্বার, ব্যাচ নাম্বার উল্লেখ করা থাকে যাতে এই প্রত্যক্ষ কাঁচামাল উপাদান ব্যয় সংশ্লিষ্ট বিভাগের উপযুক্ত ব্যয় লক্ষ্যবস্তুতে আরোপ করা যায়। এই চাহিদাপত্রের ভিত্তিতে স্টোরের বিন কার্ড ও স্টোর খতিয়ান আপডেট করা হয়। তদুপরি ব্যয় লক্ষ্যবস্তুতে প্রত্যক্ষ উপাদান বায় আরোপিত হয়।
পরোক্ষ উপাদান/কাঁচামাল ব্যয় বিশ্লেষণ (Indirect material cost analysis) : আমরা পূর্ববর্তী উদাহরণের প্রেক্ষিতে চিন্তা করি উৎপাদন কার্য পরিচালনা করার জন্য উৎপাদন বিভাগের ডিম্পোজেবল গ্লাভস, Cleaning materials ইত্যাদির প্রয়োজন পড়বে। কিন্তু এসব উপাদানের ব্যবহার কোনো নির্দিষ্ট ব্যয় লক্ষ্যবস্তুতে চিহ্নিত করা সম্ভব নয়। যেমন- ব্যাচ নম্বর ৫০৫ উৎপাদনে কি পরিমাণ Cleaning materials প্রয়োজন হবে তা সরাসরিভাবে হিসাব করা কষ্টকর। এ ব্যয় সাপেক্ষে তাই চাহিদাকারী বিভাগ যখন পরোক্ষ উপাদানের জন্য চাহিদাপত্র প্রেরণ করে সেখানে কোনো ব্যয় লক্ষ্যবস্তু (Cost object) নম্বর উল্লেখ থাকে না। পরোক্ষ উপাদান ব্যয় সরাসরি ইউনিট ব্যয় হিসাবে হিসাব করা হয় না বরং একে উপরিব্যয় (Overheads) হিসেবে বিবেচনা করা হয় এবং এর হিসাব সংক্রান্ত আলোচনা আমরা পরবর্তী পাঠে শিখব।
উৎপাদন ব্যয় হিসাববিজ্ঞানের আলোচনার শ্রম ব্যয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একটি প্রতিষ্ঠানে উৎপাদন কার্যে অনেক শ্রমিক, কর্মচারী ও কর্মকর্তা প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে কর্মরত থাকে। এদের বেতন ও মজুরি প্রদানে প্রতিষ্ঠানকে ব্যয়ভার বহন করতে হয়। এরূপ শ্রম ব্যয় হিসাবরক্ষণে কত জন কত সময় কাজ করে তা নির্ধারণ করা আবশ্যক। সময় লিপিবদ্ধকরণের জন্য অভ্যন্তরীণ ব্যবহারে প্রয়োজনীয় কিছু উৎস দলিল সংরক্ষণ করা হয় যেমন- Clock card, Time sheet, Job card ইত্যাদি। এসব দলিলে প্রত্যেক মজুরিভিত্তিক শ্রমিক, বেতনভূক্ত কর্মচারী কর্মকর্তা কতসময় কাজ করে তার হিসাব
রাখা হয়। এই তথ্যের ভিত্তিতে মজুরি হার (Wages rate), ওভারটাইম হার (Overtime rate). ন্যূনতম মজুরি (Minimum guaranteed wages) ইত্যাদির সমন্বয়ে প্রত্যেক শ্রমিক, কর্মকর্তা কর্মচারীর মোট মজুরি, বেতন তথা প্রতিষ্ঠানের জন্য শ্রম ব্যয় (Labour cost) হিসাব করা হয়।
শ্রম ব্যয়ের উপাদান (Elements of labour cost ) নির্দিষ্ট সময়ের (সাপ্তাহিক বা মাসিক) প্রেক্ষিতে একটি প্রতিষ্ঠান তার শ্রমিক-কর্মচারীদের জন্য মজুরি, বেতন ও বিভিন্ন ভাতা বাবদ যে ব্যয়ভার বহন করে তার মোট পরিমাণকে শ্রম ব্যয় বলে। শ্রম বায়ের উপাদান বিশ্লেষণ করে নিম্নলিখিত উপাদানসমূহ পাওয়া যায়— মূল মজুরি ও বেতন (Basic wages and salaries) : শ্রমিকদের তাদের স্বাভাবিক (দৈনিক ৮ ঘণ্টা)কাজের ভিত্তিতে পূর্বনির্ধারিত হারে যে মজুরি দেওয়া হয় তাকে মূল মজুরি বলে। বেতনভুক্ত কর্মচারীগণ তাদের দায়িত্ব পালনের জন্য মাসিক মূল বেতন পেয়ে থাকে।
ওভারটাইম মজুরি (Overtime wages) উৎপাদন চাহিদা বেশি থাকলে অনেক সময় শ্রমিকদের স্বাভাবিক সময়ের বেশি কাজ করতে হয়। বাংলাদেশের কারখানা আইন অনুযায়ী দৈনিক আট ঘণ্টা বা সাপ্তাহিক ৪৮ ঘণ্টার বেশি কাজ করলে অতিরিক্ত সময়কে ওভারটাইম বলে। এই অতিরিক্ত সময়ে শ্রমিকদের মূল মজুরির থেকে দ্বিগুণ হারে মজুরি প্রদান করা হয়।
বোনাস মজুরি শ্রমিকরা নির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করলে নির্ধারিত হারে প্রণোদনা হিসেবে কিছু অতিরিক্ত মজুরি পেয়ে থাকে যাকে বোনাস মজুরি বলে। প্রকৃতিগত দিক থেকে উপাদান ব্যয়ের মত শ্রম ব্যয়কেও দুইভাগে ভাগ করা যায়। প্রত্যক্ষ শ্রম ব্যয় (Direct labour cost ) উৎপাদনক্ষেত্রে সরাসরিভাবে যুক্ত শ্রমিকদের মূল মজুরি (Basic wages) যা বায় লক্ষ্যবস্তুতে (যেমন- ব্যাচ, জব) আরোপ করা যায় সেরূপ শ্রম ব্যয়কে প্রত্যক্ষ শ্রম ব্যয় বলা হয়।
পরোক্ষ শ্রম ব্যয় (Indirect labour cost) : যে সকল শ্রমিক/কর্মচারী উৎপাদনের সাথে সরাসরি জড়িত না থেকেও উৎপাদন কাজে পরোক্ষভাবে সহায়তা করে তাদেরকে প্রদত্ত মজুরি ও বেতনকেই পরোক্ষ শ্রম ব্যয় বলে। এসব ব্যয় কোনো নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে সরাসরি আরোপ করা সম্ভব না বা সময়সাপেক্ষ। পরোক্ষ শ্রম ব্যয় মূলত কারখানা উপরিবায় (Production overhead) এর অংশ। মূল বেতনের/মজুরির সাথে প্রদত্ত সাধারণ ওভারটাইম মজুরি (General overtime wages), বিভিন্ন পরিপূরক ও সহায়ক সুবিধাদি যেমন যানবাহন, চিকিৎসা ভাতা, বাড়িভাড়া, উৎসব বোনাস প্রভৃতি পরোক্ষ শ্রম ব্যয়ের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। তোমরা পরবর্তী অধ্যায়ে বিভিন্ন রকমের বায়ের শ্রেণিবিভাগ সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা লাভ করবে। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ শ্রম ব্যয় নির্ধারণ ও বিশ্লেষণের জন্য শ্রমিকদের হাজিরা সময় (Attendance time) নির্ণয় গুরুত্বপূর্ণ। শ্রমিকদের কারখানায় আগমন ও প্রস্থানের সময়কে হাজিরা সময় বলে। ঘড়ি কার্ড (Clock card) এর মাধ্যমে প্রত্যেক শ্রমিকের আগমন ও প্রস্থানের সময় লিপিবদ্ধ করা হয়। প্রত্যেক শ্রমিকের জন্য পৃথক Clock card থাকে এবং Clock number তথা Unique card থাকে। সপ্তাহ শেষে প্রত্যেক শ্রমিকের কর্মরত ঘণ্টা নির্ণয় করে Clock কার্ডে লিখা হয়।
উপরের আলোচনায় Clock card এর সাহায্যে কিভাবে শ্রমিকদের আগমন ও নির্গমন সময় লিপিবদ্ধ করা হয় আমরা জেনেছি। এখন আমরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ শ্রম ব্যয় বিশ্লেষণ করার জন্য কারখানায় অবস্থানকালীন সময়ে শ্রমিকগণ কোন কাজে কতটুকু সময় খাটিয়েছে তা সম্পর্কে আলোচনা করব। কারখানার অভ্যন্তরে শ্রমিকদের সময় মূলত দুইভাবে ব্যয়িত হয়- কর্ম সময় (Working time) এবং বেকার সময় (Idle time)। দৈনিক/সাপ্তাহিক টাইম শিটে শ্রমিকদের কর্মরত সময়ের হিসাব থাকে এবং কোন কাজে (জব, ব্যাচে) কত সময় লেগেছে সে সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। টাইম শিটে শ্রমিকের স্বাক্ষর থাকে এবং তা সুপারভাইজার কর্তৃক অনুমোদিত থাকে।
কারখানায় অনেক সময় শ্রমিকরা কাজ করতে ইচ্ছুক হওয়া সত্ত্বেও বিভিন্ন কারণে বেকার (lidle) সময় কাটে। যেমন উপকরণ স্বল্পতা, মেশিন নষ্ট হয়ে যাওয়া, লোডশেডিং ইত্যাদি। কিন্তু এসময় ও শ্রমিকদের মূল মজুরি প্রদান করা হয় যা স্বাভাবিকভাবেই পরোক্ষ শ্রম ব্যয়ের অন্তর্ভুক্ত হয়। কোন শ্রমিক কতটা বেকার সময় কাটালো তা চিহ্নিত করার জন্য ( Idle time card) সংরক্ষণ করা হয়।
কোন দিনের ঘড়ি কার্ডের (Clock card) সাথে টাইম শিট মিলিয়ে যদি সময়ের হেরফের পাওয়া যায় তাহলে এর বেকার সময় কার্ড প্রস্তুত করে, ব্যয়িত সময়ের কারণ ও উল্লেখ করা থাকে। অনেক সময় প্রত্যেক জব সম্পাদনের জন্য আলাদা জব কার্ড তৈরি করা হয় এবং ঐ জব সম্পাদনে কতজন শ্রমিক কত সময় ব্যয় করে তা রেকর্ড করা হয়। মূলত উৎপাদন পরিকল্পনা বিভাগ একটি জব সম্পন্ন করতে Standard time বেঁধে দেয় এবং আসলে কত সময় লেগেছে তার ভিত্তিতে এই জব সম্পাদনের মোট শ্রম ব্যয় (Labour cost) হিসাব করে।
এভাবে জব কার্ড, টাইম শিট থেকে আমরা শ্রমিকের বিভিন্ন কাজের জন্য ব্যয়িত সময় এবং বায় সম্পর্কে ধারণা পাই এবং প্রকৃতিগতভাবে এই তথ্যের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ শ্রমবায় বিভক্ত করে বিশ্লেষণ করি। এসব দলিলপত্র উৎস দলিল হিসেবে ব্যবহৃত হয় যেখানে শ্রমিকদের স্ব-স্ব Clock number/কোড কোন বিভাগের জন্য কাজ করেছে সেই বিভাগের কোড কোন নির্দিষ্ট জব/ব্যাচের জন্য কাজ করলে তার কোড উল্লেখ করা থাকে। এভাবে যথাযথ অনুমোদনের ভিত্তিতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ব্যয় রেকর্ড করা হয়। কোডিং (Coding): ব্যবস্থাপনা পর্ষদ (Management) জানতে ইচ্ছুক থাকে কোন কোন ব্যয় কেন্দ্র (Cost center) থেকে মুনাফা কেন্দ্রের (Profit center) জন্য কত ব্যয় হয়েছে। তাই শ্রমিক কর্মচারীদের বিভিন্ন বিভাগে ব্যয়িত সময়ের ভিত্তিতে শ্রম বায়ের বণ্টন করা হয়। এজন্য কোডিং সিস্টেম প্রয়োজন।
মনে করো, ক্রিস্টোফার পাবলিকেশন-এর বিক্রয় বিভাগ (Sales department ) জাহিদ লাইব্রেরি থেকে ২০০টি বইয়ের বিক্রয় আদেশ (Sales order) গ্রহণ করে। এই বিক্রয় আদেশের একটি কপি স্টোরে পাঠানো হবে যেখানে প্রস্তুতকৃত বই মজুদকৃত অবস্থায় থাকে। স্টোরের Goods delivery section আদেশকৃত বইগুলো প্যাকেজিং করে ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের নিকট প্রেরণ করে। একটি Delivery note পণ্যের সাথে পাঠানো হয় যেখানে প্রেরণকৃত পণ্যের পরিমাণ পণ্য সংক্রান্ত ব্যাখ্যা উল্লেখ থাকে।
Delivery note-এর নিচে ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি বইগুলো গ্রহণ সাপেক্ষে একটি স্বাক্ষর করে এবং এই স্বাক্ষরকৃত কপিটি ক্রিস্টোফার পাবলিকেশনে ফেরত আসে। এরপর হিসাব বিভাগ (Accounting department) পণ্যের জন্য প্রাপ্ত বিক্রয় আদেশ এবং ক্রেতা কর্তৃক সঠিক পণ্য সকল প্রকার শর্তপূরণ করে গৃহীত হয়েছে তা নিশ্চিতকারী দলিল 'Delivery note'-এর স্বাক্ষরিত কপি পর্যবেক্ষণ করে। Sales order, Delivery note এর তথ্যের ভিত্তিতে ক্রেতার ঠিকানায় বিক্রয় চালান (Sales invoice) পাঠানো হয়। বিক্রয় চালানে বিক্রীত পণ্যের পরিমাণ, ইউনিট মূল্য, মোট মূল্য এবং বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান ক্রিস্টোফার পাবলিকেশন যদি ফ্যাট নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান তাহলে মূল্য সংযোজন কর (মূসক/ Value Added Tax (VAT)] এর পরিমাণ উল্লেখিত থাকে। বিরুনা চালানের সাথে ভ্যাট চালান (মূসক ৬.৩) এর একটি কপিও ক্রেতা প্রতিষ্ঠানকে পাঠানো হয়।
আমরা এই উপ-অধ্যায়ে ম্যাটেরিয়াল কন্ট্রোল সাইকেল বিশ্লেষণের সময় দেখেছিলাম বৃহদাকার প্রতিষ্ঠানে
ব্রুয় বিভাগ (Procurement department) থাকে যা উৎপাদন, পণ্য, অফিস সাপ্লাইজ ইত্যাদি যাবতীয় ক্রয় সংক্রান্ত বিষয়াদি পরিচালনা করে। প্রয়োজন অনুযায়ী বিক্রেতার কাছে ক্রয় আদেশপত্র ( Purchase order) প্রেরণ করে। এই ক্রয় আদেশপত্র-ই বিক্রেতার জন্য বিক্রয় কার্য বিশ্লেষণ, উপাদান পণ্য প্রেরণ ও চালান তৈরি করার ক্ষেত্রে অন্যতম উৎস দলিল। অনেক পাইকারি বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানের বিক্রয় প্রতিনিধিরা (Sales representatives) মাঠ পর্যায়ে পরিদর্শন করে ক্রেতাদের থেকে বিনয় আদেশ (Sales order) নিয়ে আসে। তখন এই দলিলের ভিত্তিতে পণ্য সরবরাহ করা হয়। আমরা ফার্মাসিউটিক্যাল, টয়লেট্রিজ, FMCG, ফুড ও বেভারেজ ইত্যাদি শিল্পে বিক্রয় আদেশ নিয়ে আসতে দেখি।
ডেলিভারি নোটের স্বাক্ষরিত কপি পাওয়ার পর হিসাবরক্ষক বিক্রয় চালান ও ভ্যাট চালান ইস্যু করে ক্রেতার নিকট এক কপি করে প্রেরণ করে। বিক্রয় চালানের তথ্যের ভিত্তিতে বিক্রয় লেনদেন প্রাথমিক বই তথা জাবেদাতৃত্ব করে তারপর খতিয়ানে পোস্টিং করে। এখানে চালানের একটি নির্দিষ্ট নাম্বার/ কোড থাকে যার উপর ভিত্তি করে লেনদেন প্রাথমিকভাবে লিপিবদ্ধ হয়। এরপর ক্রেতার জন্য বরাদ্দ কোডের রেফারেন্স ব্যবহার করে স্ব স্ব ব্যক্তিগত খতিয়ানে (Personal
ledger) হিসাব লেখা হয়।
বিক্রীত পণ্য ফেরত পাঠালে ক্রেতা ডেবিট (Debit note) নোট প্রেরণ করে, যার উপর ভিত্তি করে বিক্রয়
প্রতিষ্ঠান থেকে ক্রেডিট নোট (Credit note) পাঠানো হয়, যেখানে বিক্রম ফেরত হিসাবের সমন্বয় করা হয়। ক্রেডিট নোট বিক্রয়ের সঠিক রেকর্ড নিশ্চিতকরণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ দলিল। এভাবে, সবগুলো দলিলের যথাযথ সংরক্ষণ এবং নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে কম্পিউটারাইজড সিস্টেমে বিক্রম সংক্রান্ত উপাত্ত ইনপুট দেওয়া হয় যেখানে রেফারেন্স হিসেবে বিব্রনা চালান নম্বর (Sales invoice number), ভ্যাট চালান নাম্বার (VAT challan number) ও ক্রেতার জন্য নির্ধারিত কোড নম্বর উল্লেখ থাকে। যার ফলে প্রতিটি বিক্রয় লেনদেন সঠিকভাবে সঠিক অ্যাকাউন্টে রেকর্ড করা হয়। এরপর সিস্টেমে থেকে Sales report পাওয়া যায় যা দিয়ে বিভিন্ন রকমের বিশ্লেষণ করা সম্ভব।
বর্তমান সময় হলো ডাটা নির্ভর, তথ্য প্রযুক্তির সময়। একটি প্রতিষ্ঠানের নানা ধরনের লেনদেনের হিসাবরক্ষণ হাতে কলমে লিখে রাখা অত্যন্ত সময়সাপেক্ষ এবং এতে ভুলের সম্ভাবনাও বাড়ে। খুব বেশি পরিমাণ উপাত্ত (Data) প্রক্রিয়াকরণও (Processing) সম্ভব নয়। তদুপরি এরকম Manual system এর ধারণক্ষমতা (Capacity), দক্ষতা (Efficiency), কার্যকারিতা (Effectiveness) এবং নমনীয়তা (Flexibility) কম। এজন্য হিসাবরক্ষণ সহজতর করার জন্য বিভিন্ন রকমের বৈচিত্র্যময় তথ্য উপস্থাপন, বিশ্লেষণ ও ব্যবসায়িক কাজে লাগবে। এরকম নানাবিধ ব্যবস্থাপনা রিপোর্ট প্রস্তুতকরণে কম্পিউটারাইজড অ্যাকাউন্টিং সিস্টেমের ব্যবহার অত্যাবশ্যক। এক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানকে একটি গঠনমূলক এবং উপযুক্ত কোডিং সিস্টেম রাখতে হয়। মনে করো, একটি উৎপাদনকারী অথবা সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানে যদি যথাযথ কোডিং কাঠামো থাকে তাহলে ব্রুয়, বিক্রয়, আয়, ব্যয়, সম্পদ, দায় ইত্যাদি আর্থিক হিসাব সহজে রক্ষণাবেক্ষণ করা সম্ভব এবং যেকোনো তথ্য খুব সহজে শুধু কোড ইনপুট দিয়ে খুঁজে বের করা সম্ভব।
ইতোমধ্যে আমরা একটি প্রতিষ্ঠানের কোডিং সিস্টেম স্থাপন, এর প্রয়োজনীয়তা ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে
উদাহরণসহ বিস্তারিত ধারণা লাভ করেছি। একটা প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন মেঘতে তাদের কোডিং কাঠামো
(Coding structure) সাজাতে পারে। এ সম্পর্কে নিচে আলোচনা করা হলো- সিকোয়েনশিয়াল কোড (Sequential code): এটি খুবই সহজ একটি কোডিং মেঘন। এই পদ্ধতিতে একটি আইটেম ও তার কোডের মধ্যে কোন নির্দিষ্ট সম্পর্ক থাকে না। একটি করে আইটেম সংযুক্ত হলে কোডের সংখ্যাও ক্রমানুসারে বাড়তে থাকে। অর্থাৎ কোড থেকে আইটেম সম্পর্কে কোন নির্দিষ্ট ধারণা লাভ করা যায় না। মনে করি, একটি খুচরা স্টেশনারি পণ্য বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান তাদের পণ্যের জন্য একটি
সহজবোধ্য সিকোয়েনশিয়াল কোডিং পদ্ধতি ব্যবহার করে। যেমন-
00010 A4 সাইজের কাগজ 00011 বল পয়েন্ট কলম
00012
পেন্সিল
কম্পিউটারাইজড অ্যাকাউন্টিং সিস্টেম-২
ব্লক কোড (Block code): ব্লক কোডিং পদ্ধতি কিছুটা সংঘবদ্ধ। এখানে প্রতিটি আইটেমকে একটি করে ব্লক
বা গ্রুপে শ্রেণিবদ্ধ করে এবং কোডের প্রথম অঙ্কটি (Digit) উক্ত গ্রুপে নির্দেশ করে। পরবর্তীতে অঙ্কগুলো
ক্রমানুসারে বসানো হয়। এই পদ্ধতিতে কোডের প্রথম অঙ্ক দেখে কোডটি কোন গ্রুপে অন্তর্ভুক্ত সে সম্পর্কে
ধারণা লাভ করা যায়। একটি উদাহরণ চিন্তা করা যাক, যেখানে একটি প্রতিষ্ঠান তাদের উৎপাদিত পণ্য শ্রেণিবদ্ধকরণের জন্য ব্লক
কোড ব্যবহার করে
ফেসেটেড কোড (Faceted code) ব্লক কোড-এর উন্নত রূপে ফেসেটেড কোড ব্যবহারকরণ হয়, যেখানে কোডের প্রতিটি অঙ্ক একটি করে নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য নির্দেশ করে। যেমন: পূর্ববর্তী উদাহরণের আলোকে যদি আমরা বিশ্লেষণ করি প্রতিটি আইটেম বিশ্লেষণে তিন অঙ্কের কোড ব্যবহার করা হয়। যেখানে প্রথম অঙ্ক (First digit) কোন আইটেম তা নির্দেশ করে। দ্বিতীয় অঙ্ক আইটেমটির কিসের তৈরি তা নির্দেশ করে এবং তৃতীয় অঙ্ক আইটেমের আকার নির্দেশ করে।
হায়ারারকিক্যাল/অনুক্রমিক কোড (Hierarchical code): এটি এক ধরনের ফেনেটেড কোড যেখানে প্রতিটি অঙ্কে (Digit) একটি করে শ্রেণিকে নির্দেশ করে এবং ডানপাশের অঙ্কটি তার পূর্ববর্তী অঙ্কটি দ্বারা নির্দেশিত শ্রেণির একটি সাবসেট। এভাবে একটি কোডের বাম থেকে ডানদিকে একটি অনুক্রমে অগ্রসর হতে থাকে। যেমন— কোনো কোডের প্রথম অঙ্ক দিয়ে আইটেমের ধরন নির্দেশিত হলে এর পরবর্তী অঙ্ক অর্থাৎ দ্বিতীয় অঙ্ক আইটেমের সাধারণ বর্ণনা দিবে। তৃতীয় অঙ্ক সাধারণ বৈশিষ্ট্যকে আরো নির্দিষ্টভাবে ব্যাখ্যা করবে। অর্থাৎ যত বাম থেকে ডানদিকে অগ্রসর হবে আমরা একটি অনুক্রম (Hierarchy) দেখতে পাব। যেমন— একটি ফার্নিচার প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান তাদের তৈরিকৃত ফার্নিচারের জন্য কোডিং করবে, তা যদি Hierarchical code ব্যবহার করে তার একটি উদাহরণ চিন্তা করি।
এখন কাঠের ফার্নিচারের জন্য-
৩য় ডিজিট 1. সেগুন কাঠ 2. মেহগনি কাঠ
ধাতব ফার্নিচারের জন্য- আ ডিজিট
1. লোহা 2. অ্যালুমিনিয়াম 3.
এখন, মেহগনি কাঠের চেয়ারের কোড 112। এখানে আমরা কোডটি যতই বাম থেকে ডান দিকে যাই
একটি অনুক্রম দেখা যায়। নেমনিক কোড (Mnemonic code): নেমনিক কোড মূলত মনে রাখা সহজ এবং দ্রুত মনে করা যায়
এমন বিষয়কে বোঝায়। কোন শব্দ / আইটেম (Item) এর নামের সংক্ষিপ্তরূপ কোড হিসেবে ব্যবহার করা হয়। আমরা ক্রিকেট ম্যাচে যেমন দেখি স্কোরকার্ডে দুই দলের নামের সংক্ষিপ্তরূপ দেখা যায়। যেমন— বাংলাদেশের ক্ষেত্রে BAN, অস্ট্রেলিয়ার জন্য AUS, ইন্ডিয়া IND, পাকিস্তানের PAK ইত্যাদি। একটি প্রতিষ্ঠান যাদের দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কার্যক্রম বিস্তৃত তারা তাদের আঞ্চলিক বিক্রয় বিশ্লেষণের জ নেমনিক কোড ব্যবহার করতে পারে। যেমন-
Dhaka এর জন্য কোড Dhk
Sylhet এর জন্য কোড Syl
Chittagong এর জন্য কোড Ctg
এভাবে বিক্রেতা অথবা ক্রেতার জন্য কোডিং করলে তাদের নামের সংক্ষিপ্তরূপ ও ব্যবহার করা যায়।
আমরা ইতিমধ্যে হিসাবরক্ষণে কোডিং সিস্টেমের উপযোগিতা এবং বিভিন্ন ধরনের কোডিং মেথড সম্পর্কে জেনেছি। লেনদেন প্রক্রিয়াকরণ অথবা আয় ব্যয়ের কোনো আইটেমে যথাযথ কোড আরোপ করার ক্ষেত্রে ত্রুটি হতে পারে। এসব ভুলের জন্যও লেনদেন হিসাবরক্ষণে ভুল আসে। স্বভাবতই আমাদের একটি | প্রতিষ্ঠানের কোডিং কাঠামো প্রধান আয়ের উৎস, বায়ের ধরন প্রতিষ্ঠানের প্রধান কার্যক্রম সম্পর্কে বিস্তারিত ধারনা রাখতে হবে। এর মাধ্যমে কোডিং এর ত্রুটিসমূহ শনাক্তকরণ এবং পরবর্তীতে সংশোধন করা সম্ভব। কোডিংয়ে বিভিন্ন ধরনের ত্রুটি ঘটতে পারে। যেমন: একটি লেনদেন থেকে প্রাপ্ত উপাত্ত প্রক্রিয়াকরণে ভুল হিসাবের কোড আরোপন হতে পারে। নিচে তিনটি উদাহরণের সাহায্যে ব্যাখ্যা করা হলো।
উদাহরণ-১: মনে করি, একটি প্রতিষ্ঠানের বিক্রয় হিসাব সাধারণভাবে 027 কোডের মাধ্যমে রেকর্ড করা হয়। অন্যান্য আয়ের ক্ষেত্রে 028 কোড ব্যবহৃত হয়। এখন, ভুলক্রমে স্বল্পমেয়াদি বিনিয়োগ থেকে প্রাপ্ত সুদের আয় (Interest income from short term investment), বাড়ি ভাড়া থেকে প্রাপ্ত আয় (Rental income from investment property) ইত্যাদি আয় লিপিবদ্ধকরণে 028 কোড ব্যবহার না করে ভুলক্রমে 027 কোড ব্যবহার করা হলো। ফলে অন্যান্য আয় কম রেকর্ড হবে এবং বিক্রয় সংক্রান্ত আয় ভুলক্রমে বেশি আসবে।
উদাহরণ-২: তাহিমা ট্রেডার্সের কোডিং সিস্টেমে প্রত্যেক ক্রেতার জন্য একটি করে কোড প্রদান করা হয়। যার সাহায্যে উক্ত ক্রেতার সাথে লেনদেনের প্রক্রিয়াকরণ এবং ক্রেতার জন্য দেনাদার হিসাব (Receivables ledger) আপডেট করা হয়। মনে করি দুইজন ক্রেতা জাহিদুর রহমান ও জাহিদ হাসানের জন্য যথাক্রমে J02 এবং 303 কোড ব্যবহৃত হয়। এখন, জাহিদ হাসানের কাছে বাকিতে ১০,০০০ টাকা বিক্রয় করলে J03 কোড ব্যবহার করা উচিত। কিন্তু J02 কোড ব্যবহার করলে ভুল কোড ব্যবহার করার জন্য হিসাবে ভুল আসবে।
উদাহরণ-৩: বিদিশা বেকারি তাদের প্রতিটি পণ্যের জন্য নির্দিষ্ট মেমনিক কোড ব্যবহার করে যেমন চকলেট তুকির জন্য CHOCO, পাউরুটি রোলের জন্য BRRO, কাপ কেক এর জন্য (CUPCK)। যেমন- একজন ক্রেতা ২০০ পিস কাপকেক অর্ডার দিল এবং পণ্য সরবরাহের পর বিক্রয় চালান পাঠানো হয়। কিন্তু আইটেমের কোড ভুলক্রমে CHOCO দেওয়া হয়। এই ভুলের ফলে কাপ কেকের পরিবর্তে চকলেট কুকির বিক্রয় লিপিবদ্ধ করা হবে।
আমরা এখন ব্যয় লিপিবদ্ধকরণে কোডিং এর ত্রুটি নিয়ে একটি চিন্তা করি। মাশরুর এন্ড কোং-এর ৪টি মোটর গাড়ি রয়েছে। গাড়িগুলোর কোড যথাক্রমে (T505, V787, F406, G369)। গাড়িগুলোর জন্য যাবতীয় খরচ ME67 কোডের হিসাবে রেকর্ড করা হয়। মাশরুর এপ্রিল মাসে আরেকটি নতুন গাড়ি ক্রয় করে যার কোড (X-608)। একমাসে সাধারণত ২০,০০০ টাকার মত খরচ হয়। কিন্তু ২০২২ সালের এপ্রিল মাসে দেখা গেল মোট মোটর গাড়ি সংক্রান্ত ব্যয় ২,২২,০০০ টাকা যা অস্বাভাবিকভাবে বেশি। এবার ME67 কোড ব্যবহার করে এপ্রিল মাসের খরচসমূহের ইনপুট উপাত্তসমূহ বিশ্লেষণ করে পাওয়া গেল :
উপরোক্ত বিশ্লেষণ থেকে ১৭/৪/২০২২ তারিখে গাড়ি ব্রুয়ের ব্যয়কে ভুলক্রমে মোটর গাড়ির খরচের হিসাবে দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ, উক্ত লেনদেন লিপিবদ্ধ করলে সম্পদ হিসাবের কোডের পরিবর্তে খরচ হিসাবে কোড ব্যবহার করে উপাত্ত প্রক্রিয়াকরণ করা হয়েছে। এর ফলে সম্পদের হিসাব কম এবং খরচের হিসাব বেশি এসেছে। আমরা দেখতে পাচ্ছি, ভুল কোড আরোপণের ফলে আয় ও ব্যয়ের হিসাবে গরমিল হয়।
কোডিং-এর ত্রুটিগুলো সংশোধন: আমরা ইতিমধ্যে কোনো লেনদেন যদি ভুল হিসাবে দাখিল করা হয় তাহলে কীভাবে সংশোধন করা হয় তা সম্পর্কে জেনেছি। একইভাবে, ডাটা এন্ট্রির (Data entry) করার সময় আমরা কোনো লেনদেনের জন্য ভুল কোড আরোপ করে জাবেদাভুক্তকরণ করতে পারি, অথবা একটি ব্যয় উপাদানকে ভুল হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করতে পারি। সাধারণ এ জাতীয় কোডিং ত্রুটির ভুল সংশোধন দুই ধাপে হয় । ধাপ-১: প্রথমে দাখিলকৃত ভুল এন্ট্রিকে বাতিল করার জন্য এর বিপরীত দাখিলা (Reversing entry) দেওয়া হয়। ধাপ-২: পরবর্তীতে সঠিক কোড ব্যবহার করে সঠিক আয়, ব্যয় কেন্দ্রে অথবা সঠিক আয়, ব্যয় উপাদান হিসাবে লেনদেনটি রেকর্ড করে ভুল সংশোধন করা হয়।
আরও দেখুন...