বর্তমান সময় হলো ডাটা নির্ভর, তথ্য প্রযুক্তির সময়। একটি প্রতিষ্ঠানের নানা ধরনের লেনদেনের হিসাবরক্ষণ হাতে কলমে লিখে রাখা অত্যন্ত সময়সাপেক্ষ এবং এতে ভুলের সম্ভাবনাও বাড়ে। খুব বেশি পরিমাণ উপাত্ত (Data) প্রক্রিয়াকরণও (Processing) সম্ভব নয়। তদুপরি এরকম Manual system এর ধারণক্ষমতা (Capacity), দক্ষতা (Efficiency), কার্যকারিতা (Effectiveness) এবং নমনীয়তা (Flexibility) কম। এজন্য হিসাবরক্ষণ সহজতর করার জন্য বিভিন্ন রকমের বৈচিত্র্যময় তথ্য উপস্থাপন, বিশ্লেষণ ও ব্যবসায়িক কাজে লাগবে। এরকম নানাবিধ ব্যবস্থাপনা রিপোর্ট প্রস্তুতকরণে কম্পিউটারাইজড অ্যাকাউন্টিং সিস্টেমের ব্যবহার অত্যাবশ্যক। এক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানকে একটি গঠনমূলক এবং উপযুক্ত কোডিং সিস্টেম রাখতে হয়। মনে করো, একটি উৎপাদনকারী অথবা সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানে যদি যথাযথ কোডিং কাঠামো থাকে তাহলে ব্রুয়, বিক্রয়, আয়, ব্যয়, সম্পদ, দায় ইত্যাদি আর্থিক হিসাব সহজে রক্ষণাবেক্ষণ করা সম্ভব এবং যেকোনো তথ্য খুব সহজে শুধু কোড ইনপুট দিয়ে খুঁজে বের করা সম্ভব।
ইতোমধ্যে আমরা একটি প্রতিষ্ঠানের কোডিং সিস্টেম স্থাপন, এর প্রয়োজনীয়তা ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে
উদাহরণসহ বিস্তারিত ধারণা লাভ করেছি। একটা প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন মেঘতে তাদের কোডিং কাঠামো
(Coding structure) সাজাতে পারে। এ সম্পর্কে নিচে আলোচনা করা হলো- সিকোয়েনশিয়াল কোড (Sequential code): এটি খুবই সহজ একটি কোডিং মেঘন। এই পদ্ধতিতে একটি আইটেম ও তার কোডের মধ্যে কোন নির্দিষ্ট সম্পর্ক থাকে না। একটি করে আইটেম সংযুক্ত হলে কোডের সংখ্যাও ক্রমানুসারে বাড়তে থাকে। অর্থাৎ কোড থেকে আইটেম সম্পর্কে কোন নির্দিষ্ট ধারণা লাভ করা যায় না। মনে করি, একটি খুচরা স্টেশনারি পণ্য বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান তাদের পণ্যের জন্য একটি
সহজবোধ্য সিকোয়েনশিয়াল কোডিং পদ্ধতি ব্যবহার করে। যেমন-
00010 A4 সাইজের কাগজ 00011 বল পয়েন্ট কলম
00012
পেন্সিল
কম্পিউটারাইজড অ্যাকাউন্টিং সিস্টেম-২
ব্লক কোড (Block code): ব্লক কোডিং পদ্ধতি কিছুটা সংঘবদ্ধ। এখানে প্রতিটি আইটেমকে একটি করে ব্লক
বা গ্রুপে শ্রেণিবদ্ধ করে এবং কোডের প্রথম অঙ্কটি (Digit) উক্ত গ্রুপে নির্দেশ করে। পরবর্তীতে অঙ্কগুলো
ক্রমানুসারে বসানো হয়। এই পদ্ধতিতে কোডের প্রথম অঙ্ক দেখে কোডটি কোন গ্রুপে অন্তর্ভুক্ত সে সম্পর্কে
ধারণা লাভ করা যায়। একটি উদাহরণ চিন্তা করা যাক, যেখানে একটি প্রতিষ্ঠান তাদের উৎপাদিত পণ্য শ্রেণিবদ্ধকরণের জন্য ব্লক
কোড ব্যবহার করে
ফেসেটেড কোড (Faceted code) ব্লক কোড-এর উন্নত রূপে ফেসেটেড কোড ব্যবহারকরণ হয়, যেখানে কোডের প্রতিটি অঙ্ক একটি করে নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য নির্দেশ করে। যেমন: পূর্ববর্তী উদাহরণের আলোকে যদি আমরা বিশ্লেষণ করি প্রতিটি আইটেম বিশ্লেষণে তিন অঙ্কের কোড ব্যবহার করা হয়। যেখানে প্রথম অঙ্ক (First digit) কোন আইটেম তা নির্দেশ করে। দ্বিতীয় অঙ্ক আইটেমটির কিসের তৈরি তা নির্দেশ করে এবং তৃতীয় অঙ্ক আইটেমের আকার নির্দেশ করে।
হায়ারারকিক্যাল/অনুক্রমিক কোড (Hierarchical code): এটি এক ধরনের ফেনেটেড কোড যেখানে প্রতিটি অঙ্কে (Digit) একটি করে শ্রেণিকে নির্দেশ করে এবং ডানপাশের অঙ্কটি তার পূর্ববর্তী অঙ্কটি দ্বারা নির্দেশিত শ্রেণির একটি সাবসেট। এভাবে একটি কোডের বাম থেকে ডানদিকে একটি অনুক্রমে অগ্রসর হতে থাকে। যেমন— কোনো কোডের প্রথম অঙ্ক দিয়ে আইটেমের ধরন নির্দেশিত হলে এর পরবর্তী অঙ্ক অর্থাৎ দ্বিতীয় অঙ্ক আইটেমের সাধারণ বর্ণনা দিবে। তৃতীয় অঙ্ক সাধারণ বৈশিষ্ট্যকে আরো নির্দিষ্টভাবে ব্যাখ্যা করবে। অর্থাৎ যত বাম থেকে ডানদিকে অগ্রসর হবে আমরা একটি অনুক্রম (Hierarchy) দেখতে পাব। যেমন— একটি ফার্নিচার প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান তাদের তৈরিকৃত ফার্নিচারের জন্য কোডিং করবে, তা যদি Hierarchical code ব্যবহার করে তার একটি উদাহরণ চিন্তা করি।
এখন কাঠের ফার্নিচারের জন্য-
৩য় ডিজিট 1. সেগুন কাঠ 2. মেহগনি কাঠ
ধাতব ফার্নিচারের জন্য- আ ডিজিট
1. লোহা 2. অ্যালুমিনিয়াম 3.
এখন, মেহগনি কাঠের চেয়ারের কোড 112। এখানে আমরা কোডটি যতই বাম থেকে ডান দিকে যাই
একটি অনুক্রম দেখা যায়। নেমনিক কোড (Mnemonic code): নেমনিক কোড মূলত মনে রাখা সহজ এবং দ্রুত মনে করা যায়
এমন বিষয়কে বোঝায়। কোন শব্দ / আইটেম (Item) এর নামের সংক্ষিপ্তরূপ কোড হিসেবে ব্যবহার করা হয়। আমরা ক্রিকেট ম্যাচে যেমন দেখি স্কোরকার্ডে দুই দলের নামের সংক্ষিপ্তরূপ দেখা যায়। যেমন— বাংলাদেশের ক্ষেত্রে BAN, অস্ট্রেলিয়ার জন্য AUS, ইন্ডিয়া IND, পাকিস্তানের PAK ইত্যাদি। একটি প্রতিষ্ঠান যাদের দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কার্যক্রম বিস্তৃত তারা তাদের আঞ্চলিক বিক্রয় বিশ্লেষণের জ নেমনিক কোড ব্যবহার করতে পারে। যেমন-
Dhaka এর জন্য কোড Dhk
Sylhet এর জন্য কোড Syl
Chittagong এর জন্য কোড Ctg
এভাবে বিক্রেতা অথবা ক্রেতার জন্য কোডিং করলে তাদের নামের সংক্ষিপ্তরূপ ও ব্যবহার করা যায়।
আমরা ইতিমধ্যে হিসাবরক্ষণে কোডিং সিস্টেমের উপযোগিতা এবং বিভিন্ন ধরনের কোডিং মেথড সম্পর্কে জেনেছি। লেনদেন প্রক্রিয়াকরণ অথবা আয় ব্যয়ের কোনো আইটেমে যথাযথ কোড আরোপ করার ক্ষেত্রে ত্রুটি হতে পারে। এসব ভুলের জন্যও লেনদেন হিসাবরক্ষণে ভুল আসে। স্বভাবতই আমাদের একটি | প্রতিষ্ঠানের কোডিং কাঠামো প্রধান আয়ের উৎস, বায়ের ধরন প্রতিষ্ঠানের প্রধান কার্যক্রম সম্পর্কে বিস্তারিত ধারনা রাখতে হবে। এর মাধ্যমে কোডিং এর ত্রুটিসমূহ শনাক্তকরণ এবং পরবর্তীতে সংশোধন করা সম্ভব। কোডিংয়ে বিভিন্ন ধরনের ত্রুটি ঘটতে পারে। যেমন: একটি লেনদেন থেকে প্রাপ্ত উপাত্ত প্রক্রিয়াকরণে ভুল হিসাবের কোড আরোপন হতে পারে। নিচে তিনটি উদাহরণের সাহায্যে ব্যাখ্যা করা হলো।
উদাহরণ-১: মনে করি, একটি প্রতিষ্ঠানের বিক্রয় হিসাব সাধারণভাবে 027 কোডের মাধ্যমে রেকর্ড করা হয়। অন্যান্য আয়ের ক্ষেত্রে 028 কোড ব্যবহৃত হয়। এখন, ভুলক্রমে স্বল্পমেয়াদি বিনিয়োগ থেকে প্রাপ্ত সুদের আয় (Interest income from short term investment), বাড়ি ভাড়া থেকে প্রাপ্ত আয় (Rental income from investment property) ইত্যাদি আয় লিপিবদ্ধকরণে 028 কোড ব্যবহার না করে ভুলক্রমে 027 কোড ব্যবহার করা হলো। ফলে অন্যান্য আয় কম রেকর্ড হবে এবং বিক্রয় সংক্রান্ত আয় ভুলক্রমে বেশি আসবে।
উদাহরণ-২: তাহিমা ট্রেডার্সের কোডিং সিস্টেমে প্রত্যেক ক্রেতার জন্য একটি করে কোড প্রদান করা হয়। যার সাহায্যে উক্ত ক্রেতার সাথে লেনদেনের প্রক্রিয়াকরণ এবং ক্রেতার জন্য দেনাদার হিসাব (Receivables ledger) আপডেট করা হয়। মনে করি দুইজন ক্রেতা জাহিদুর রহমান ও জাহিদ হাসানের জন্য যথাক্রমে J02 এবং 303 কোড ব্যবহৃত হয়। এখন, জাহিদ হাসানের কাছে বাকিতে ১০,০০০ টাকা বিক্রয় করলে J03 কোড ব্যবহার করা উচিত। কিন্তু J02 কোড ব্যবহার করলে ভুল কোড ব্যবহার করার জন্য হিসাবে ভুল আসবে।
উদাহরণ-৩: বিদিশা বেকারি তাদের প্রতিটি পণ্যের জন্য নির্দিষ্ট মেমনিক কোড ব্যবহার করে যেমন চকলেট তুকির জন্য CHOCO, পাউরুটি রোলের জন্য BRRO, কাপ কেক এর জন্য (CUPCK)। যেমন- একজন ক্রেতা ২০০ পিস কাপকেক অর্ডার দিল এবং পণ্য সরবরাহের পর বিক্রয় চালান পাঠানো হয়। কিন্তু আইটেমের কোড ভুলক্রমে CHOCO দেওয়া হয়। এই ভুলের ফলে কাপ কেকের পরিবর্তে চকলেট কুকির বিক্রয় লিপিবদ্ধ করা হবে।
আমরা এখন ব্যয় লিপিবদ্ধকরণে কোডিং এর ত্রুটি নিয়ে একটি চিন্তা করি। মাশরুর এন্ড কোং-এর ৪টি মোটর গাড়ি রয়েছে। গাড়িগুলোর কোড যথাক্রমে (T505, V787, F406, G369)। গাড়িগুলোর জন্য যাবতীয় খরচ ME67 কোডের হিসাবে রেকর্ড করা হয়। মাশরুর এপ্রিল মাসে আরেকটি নতুন গাড়ি ক্রয় করে যার কোড (X-608)। একমাসে সাধারণত ২০,০০০ টাকার মত খরচ হয়। কিন্তু ২০২২ সালের এপ্রিল মাসে দেখা গেল মোট মোটর গাড়ি সংক্রান্ত ব্যয় ২,২২,০০০ টাকা যা অস্বাভাবিকভাবে বেশি। এবার ME67 কোড ব্যবহার করে এপ্রিল মাসের খরচসমূহের ইনপুট উপাত্তসমূহ বিশ্লেষণ করে পাওয়া গেল :
উপরোক্ত বিশ্লেষণ থেকে ১৭/৪/২০২২ তারিখে গাড়ি ব্রুয়ের ব্যয়কে ভুলক্রমে মোটর গাড়ির খরচের হিসাবে দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ, উক্ত লেনদেন লিপিবদ্ধ করলে সম্পদ হিসাবের কোডের পরিবর্তে খরচ হিসাবে কোড ব্যবহার করে উপাত্ত প্রক্রিয়াকরণ করা হয়েছে। এর ফলে সম্পদের হিসাব কম এবং খরচের হিসাব বেশি এসেছে। আমরা দেখতে পাচ্ছি, ভুল কোড আরোপণের ফলে আয় ও ব্যয়ের হিসাবে গরমিল হয়।
কোডিং-এর ত্রুটিগুলো সংশোধন: আমরা ইতিমধ্যে কোনো লেনদেন যদি ভুল হিসাবে দাখিল করা হয় তাহলে কীভাবে সংশোধন করা হয় তা সম্পর্কে জেনেছি। একইভাবে, ডাটা এন্ট্রির (Data entry) করার সময় আমরা কোনো লেনদেনের জন্য ভুল কোড আরোপ করে জাবেদাভুক্তকরণ করতে পারি, অথবা একটি ব্যয় উপাদানকে ভুল হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করতে পারি। সাধারণ এ জাতীয় কোডিং ত্রুটির ভুল সংশোধন দুই ধাপে হয় । ধাপ-১: প্রথমে দাখিলকৃত ভুল এন্ট্রিকে বাতিল করার জন্য এর বিপরীত দাখিলা (Reversing entry) দেওয়া হয়। ধাপ-২: পরবর্তীতে সঠিক কোড ব্যবহার করে সঠিক আয়, ব্যয় কেন্দ্রে অথবা সঠিক আয়, ব্যয় উপাদান হিসাবে লেনদেনটি রেকর্ড করে ভুল সংশোধন করা হয়।
আরও দেখুন...