আয়শা বেগম ৭০ বছর বয়সী একজন গৃহিনী। তিনি দুই ছেলে, পাঁচ মেয়ে এবং নাতি-নাতনি নিয়ে খুব ভালোভাবে সংসার চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু তার চালচলনে আভিজাত্যের ছোঁয়া। নাতি-নাতনিদের সাথে গল্প আড্ডায় তার সময় পার হয়। নাতি-নাতনিরা তার আভিজাত্যপূর্ণ চালচলনের ইতিহাস জানতে চান। তিনি তাদের জানান সঞ্চয় প্রবণতাই তাকে ভালোভাবে চলার সুযোগ দিয়েছে। তিনি সংসার জীবনের প্রথম থেকে মাটির ব্যাংকে সামান্য টাকা প্রতি সপ্তাহে জমা করতেন। এই ধারণাটি তিনি তার মা ও দাদীর নিকট থেকে পেয়েছেন। প্রাচীনকালে মানুষ চোর ডাকাতের ভয়ে নিজেদের সঞ্চিত অর্থ পিতলের কলসিতে ভরে মাটির নিচে পুঁতে রাখত। আবার প্রাচীন ইহুদি ব্যবসায়ীগণ লম্বা টুল বা বেঞ্চে বসে অর্থের ব্যবসায় করতো। যেখানে মানুষের প্রয়োজনে অর্থ ধার দেওয়া হতো ও মানুষের সঞ্চিত অর্থ গ্রহণ করা হতো। এই টাকা পুনরায় সুদ সহ ফেরত নেওয়ার ও ফেরত দেওয়ার জন্য তারা লোক নিয়োগ করতো। মূলত এখান থেকে ব্যাংকের উৎপত্তি হয়। বর্তমানে ব্যাংকসমূহ জনগণের সঞ্চিত আমানত বিভিন্ন হিসাবের মাধ্যমে সংরক্ষণ করে মানুষকে সঞ্চয়ে আগ্রহী করে।
এ উপ-অধ্যায়ে আমরা ব্যাংকের ধারণা, ব্যাংকের শ্রেণিবিভাগ, ব্যাংকের কার্যাবলি ইত্যাদি সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করতে পারব।
আমরা যা আয় করি তা থেকে প্রতি মাসে সংসার খরচের পর কিছু অর্থ উদ্বৃত্ত থাকে। এ উদ্বৃত্ত অর্থ বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানে সঞ্চিত রাখা যায়। আবার প্রয়োজনে তা থেকে খরচও করা যায়। অন্যদিকে, একজন ব্যবসায়ীর ব্যবসায় কাজ পরিচালনার জন্য বড় অঙ্কের টাকা প্রয়োজন হলে তিনি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের দ্বারস্থ হন । প্রতিষ্ঠানটি তাকে কিছু শর্তসাপেক্ষে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ঋণ দেয়। এভাবে যে ধরনের আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে নিজস্ব অর্থের নিরাপত্তাসহ সুবিধাজনক লেনদেন করা যায় এবং ঋণ সহযোগিতা পাওয়া যায়, সেটি হলো ব্যাংক।
মানুষ বেঁচে থাকার জন্য বিভিন্নভাবে অর্থ উপার্জন করে। উপার্জিত অর্থের কিছু অংশ উদ্বৃত্ত থাকতে পারে। আর এ উদ্বৃত্ত অর্থের নিরাপদ সংরক্ষণের উদ্দেশ্যেই ব্যাংক ব্যবস্থার উদ্ভব হয়েছে। এর প্রধান কাজ হলো জনগণের উদ্বৃত্ত অর্থ সংগ্রহ করে তহবিল গঠন করা। উক্ত তহবিল থেকে বিভিন্ন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনে ঋণ দেওয়া। অর্থাৎ ব্যাংক হলো ধার করা অর্থের ধারক। ঋণ গ্রহণকারীর কাছ থেকে প্রাপ্ত সুদের একটি অংশ অর্থ জমাদানকারীদেরকে দেওয়া হয়। এ দুই সুদের পার্থক্যই হলো ব্যাংকের মুনাফা। যে প্রতিষ্ঠান অর্থ ও ঋণের ব্যবসায়ে জড়িত তাকে ব্যাংক বলে। বর্তমানে ব্যাংক মুদ্রাবাজার নিয়ন্ত্রণ ও মুদ্রার উপযোগিতাও সৃষ্টি করে। ব্যাংকের উল্লিখিত সংজ্ঞা থেকে আমরা ব্যাংকের নিম্নোক্ত বৈশিষ্ট্যগুলো সম্পর্কে জানতে পারি—
• ব্যাংক হলো অর্থ জমা ও ঋণের সাথে যুক্ত একটি আর্থিক মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠান;
• জনগণের অর্থ আমানত হিসেবে জমা রাখে;
• জনগণকে সুদের বিনিময়ে বিভিন্ন (স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘ) মেয়াদি ঋণ দেয়;
• চাহিবামাত্র গ্রাহকের জমাকৃত অর্থ পরিশোধে বাধ্য থাকে; গ্রাহক সেবার লক্ষ্যে এটি কাজ করে;
• প্রতিষ্ঠানটি সততা ও বিশ্বস্ততার প্রতীক হিসেবে গণ্য হয়;
• প্রতিষ্ঠানটির ব্যবসায়ের প্রধান উদ্দেশ্য মুনাফা অর্জন ।
জেনে রাখো বিশেষজ্ঞদের লেখা কয়েকটি সংজ্ঞা নিচে দেওয়া হলো- অধ্যাপক কেয়ারক্রস (Prof. Cairncross) বলেছেন, 'A bank is a financial intermediary, a dealer in loans and debts', অর্থাৎ ‘ব্যাংক হলো একটি আর্থিক মধ্যস্থ কারবারি; ধার ও ঋণের ব্যবসায়ী।’ অধ্যাপক সেয়ার্স (Prof. Sayers) বলেছেন, 'Banks are the institutions whose debts are commonly accepted in settlement of the other peoples debt. অর্থাৎ 'ব্যাংক হলো এমন একটি প্রতিষ্ঠান যার ঋণ অন্য সকলের পারস্পরিক ঋণ নিষ্পত্তির জন্য ব্যবহৃত হয়। অধ্যাপক আর. পি. ক্যান্ট (Prof. R. P. Kent) বলেছেন, 'A bank is an institution whose principal function is to collect the unutilized money from the people and to lend it to others.' অর্থাৎ 'ব্যাংক হচ্ছে এমন একটি প্রতিষ্ঠান যার মৌলিক উদ্দেশ্য হচ্ছে অব্যবহৃত উদ্বৃত্ত অর্থ সংগ্রহ করা এবং অপরকে তা ঋণ হিসেবে প্রদান করা। |
---|
তাই বলা যায়, ব্যাংক এমন একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান যা বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবের (Bank Account) মাধ্যমে কম সুদে আমানত সংগ্ৰহ করে। তারপর ঐ অর্থ বেশি সুদে অন্যপক্ষকে ঋণ দিয়ে মুনাফা অর্জন করে।
▪️জেনে রাখো ব্যাংকিং: সাধারণভাবে, ব্যাংকের অর্থসংক্রান্ত যাবতীয় কার্যাবলিকে ব্যাংকিং বলে। প্রশ্ন হলো, ব্যাংকের কাজ কী? চলতি, সঞ্চয়ী ও মেয়াদি হিসাবে অর্থ গ্রহণ করা, গ্রাহকদের চেক গ্রহণ করা, দাবি পরিশোধ করা, ঋণ দেওয়া, বিলবাট্টা করা, গ্রাহকদের অর্থ একস্থান থেকে অন্যস্থানে পাঠাতে সাহায্য করা ইত্যাদি ব্যাংকের কাজ। এসব কাজই সমষ্টিগতভাবে ব্যাংকিং নামে পরিচিত। এ বিষয়ে ব্যাংকিং আইনের সংজ্ঞাটি জেনে নিই। ১৯৪৯ সালের ভারতীয় ব্যাংকিং আইনের ৫(১) ধারা অনুযায়ী, ঋণ মঞ্জুর বা অর্থ বিনিয়োগ করা, জনগণের অর্থ আমানত হিসেবে সংগ্রহ করা এবং চাহিবামাত্র বা অন্য কোনো অবস্থায় তা উত্তোলনের সুযোগ প্রদান করাই হলো ব্যাংকিং (Banking means the accepting for the purpose of lending or investment of deposits or money from the public, re-payable on demand or otherwise, and withdrawable by cheque, draft, order or otherwise) | সুতরাং, আমানত গ্রহণ, ঋণ দেওয়া, চেক পরিশোধ করা, বিল বাট্টা করা, অর্থ স্থানান্তর করা, ঋণ ও বিনিময়ের মাধ্যম সৃষ্টি করা, মক্কেলের মূল্যবান দ্রব্য ও দলিল সংরক্ষণ করা, মক্কেলের বিলের স্বীকৃতি দেওয়া, আমানত হিসেবে প্রাপ্ত অর্থ বিনিয়োগ করাসহ ব্যাংকের যাবতীয় কাজকে একসাথে ব্যাংকিং বলা হয় । |
---|
নিচে ছকের সাহায্যে ব্যাংক এবং ব্যাংকিং-এর সম্পর্ক বোঝানো হলো-
সুতরাং, ব্যাংক হলো একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং এ প্রতিষ্ঠানের কাজগুলোই হলো ব্যাংকিং। ব্যাংক যখন অন্য কোনো ব্যক্তির কাজ করে, তখন ব্যাংক সে ব্যক্তির ব্যাংকার হিসেবে অভিহিত হয়। ধরো, তুমি সোনালী ব্যাংক-এর মাধ্যমে যাবতীয় লেনদেন করো। তাহলে সোনালী ব্যাংক হলো তোমার ব্যাংকার। বাংলাদেশ ব্যাংক যেহেতু সরকারের কাজ করে, এজন্য বাংলাদেশ ব্যাংক হলো সরকারের ব্যাংকার ।
আরও দেখুন...