SATT ACADEMY

New to Satt Academy? Create an account


or
Log in with Google Account

নবম-দশম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - চারু ও কারুকলা - NCTB BOOK

পাঠ : ১

শিল্পকলা

শিল্পকলা সম্পর্কে ইতঃপূর্বে অষ্টম শ্রেণিতে তোমরা ধারণা পেয়েছ। শিল্পকলা বিষয়ে কিছু জানতে হলে প্রথমে এর উৎপত্তি বিষয়ে জানতে হবে। অর্থাৎ যখন থেকে গুহাবাসী মানুষ দলবদ্ধভাবে বসবাস শুরু করে বিভিন্ন পদ্ধতিতে একে অপরের সাথে যোগাযোগের মাধ্যম গড়ে তোলে তখন থেকেই শিল্পকলার যাত্রা শুরু। প্রকৃতির বৈচিত্র্য ও বিশালতা মানুষের মনে এক রহস্যময় অনুভূতির জন্ম দেয়। আদিম শিকারি মানুষ সে সব রহস্যের কূলকিনারা করতে না পেরে বিভিন্ন জাদু বিশ্বাসে নির্ভরতা খুঁজেছে। সহজে পশু শিকার করার আশায় সেই জাদু বিশ্বাস থেকেই গুহার দেয়ালে ধারালো পাথর বা পশুর হাড় দিয়ে খোদাই করে এঁকেছে পশু শিকারের বা পশুর নানারকম ছবি। এ ছবিগুলোই পৃথিবীর প্রথম শিল্পকলা।

এরপর সময়ের সাথে সাথে সভ্যতার অগ্রগতি হয়েছে। অর্থাৎ মানুষ প্রকৃতি ও পরিবেশকে তার আয়ত্তে এনে নিজের জীবনযাপনকে অনেক সহজ, সুন্দর ও সমৃদ্ধশালী করেছে। এভাবে যখন মানুষের জীবনের মৌলিক চাহিদাগুলো পুরণ করা অনেক সহজ হলো তখন তার মনের কিছু কিছু অনুভূতি ও কল্পনা শক্তি একত্রিত হয়ে শিল্পিত রূপ নিল। যেমন ভাষা আবিষ্কারের সাথে সাথে কবিতা, গল্প এসেছে। পরে উদ্ভব হয়েছে সংগীতের। এই যে মানুষের মনের কল্পনা ও সৃজনশীলতার মিশ্রণে যা তৈরি হলো ছবি, কবিতা, গান এ সবকে আমরা নাম দিয়েছি শিল্পকলা।

এক কথায় বলা যায়, মানুষের মনের সৃজনশীল কর্মকাণ্ডের সামগ্রিক রূপ হচ্ছে শিল্পকলা।

পাঠ : ২

শিল্পকলার শ্রেণিবিভাগ

সামগ্রিক শিল্পকলা আসলে অনেক শাখা প্রশাখায় বিভক্ত। বহু তার মাধ্যম। আমাদের কাছে বিষয়ের ব্যাপার এই যে, শিল্পকলার প্রায় সকল মাধ্যমেরই শুরু করেছিল আদিম শিকারি মানুষেরা। বিষয়কর দক্ষতার সাথে প্রাচীন যুগের 'হোমো সাপিয়েন্স' মানুষ এঁকেছে বিভিন্ন বন্যপশুর ছবি। তারা অত্যন্ত পর্যবেক্ষণশীল ছিল। জীবজন্তু সম্পর্কে চমৎকার জ্ঞান তাদের ছিল এবং পাথর কিংবা হাড়ের উপর নির্ভুল সুষ্ঠু রেখা অঙ্কন করে তা ফুটিয়ে তুলতে পারত। তাদের আঁকা ছবি দেখে প্রতিটি কতুকে সহজেই চিহ্নিত করা যায়। এমন চিত্র আছে যেখানে জীবজন্তুর আকারে অঙ্কনরত মানুষের ছবিও আছে। মাথার উপর শিং এবং পিছনে লেজ পরিহিত মানুষের ছবি আছে। হরিণের সাজে সজ্জিত মানুষটি হরিণের অঙ্গভঙ্গি নকল করে দুপা উপরে তুলে লাফ দিচ্ছে। তাদের আঁকা ছবি থেকেই জানা যায় যে, আদিম মানুষ শিকার করা পশুকে সামনে রেখে তার চারপাশ ঘিরে বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গি ও চিৎকার করে লাফাতে লাফাতে আনন্দ প্রকাশ করত। সেখান থেকেই মানুষের নৃত্য-গীতির শুরু। শিকার করা বন্যপশুর লোমশ চামড়া, শিং, ইত্যাদি পরিধান করে তারা ঐ পশুর অনুকরণ করে হাঁটা, লাফানো, দৌড়ানো ইত্যাদির অভিনয় করত। ধারণা করা হয় পশুর পালকে ধোঁকা দিয়েভানের সাথে মিশে থেকে সহজে শিকার করার কৌশল হিসেবে তারা এসব করত। সেখান থেকেই মানুষের অভিনয় শিল্পের শুরু। যদিও জাসিম মানুষ এ সবই করেছে তাদের বাঁচার তাগিদে, খাদ্য সংগ্রহের প্রয়োজনে।


পাঠ: ৩

শুধু ছবি আঁকা নয়, প্রস্তর যুগের মানুষ মূর্তিও তৈরি করত। যাকে বলা হয় ভাস্কর্য। সে সব ভাস্কর্যের বেশিরভাগই ছিল মানুষের মূর্তি এবং প্রায় সবই নারীমূর্তি। জালিম সমাজ ছিল মাতৃতান্ত্রিক। মেয়েরাই ছিল সলের প্রধান। মাকে মনে করা হতো পদের আদি সত্ত্বা। অর্থাৎ তার থেকেই সনের উদ্ভব হয়ে। তাই মাতৃসত্ত্বার প্রতীক হিসেবে তারা এসব নারীমূর্তি তৈরি করেছিল। কখনো পাহাড়ের গায়ে আঁচড় কেটে আবার কখনো আলাম পাথর কেটে তারা এগুলো তৈরি করত। এছাড়া বাইসনের শিং, পশুর হাড় কিরো পাথর প্রভৃতি দিয়ে পশু- পাখির মূর্তিও তারা তৈরি করত। নানারকম মৃৎপাত্র অর্থাৎ মাটির তৈরি পাত্র ভারা তৈরি করত এবং বিভিন্ন রকম হাজিরার তৈরি করে তাতে নানারকম কারুকার্য করত। এমনকি মাছের মেরুদণ্ডের হাড়, ঝিনুক ও হরিণের পীত দিয়ে পয়না বানিয়ে তা ব্যবহার করত আনিম মানুষ। অর্থাৎ কারুশিল্পের সূচনাও তারা করেছিল। পশুর হাড়, চামড়া, কাঠ, খাগড়া, পাথর কিংবা কাদামাটি দিয়ে শুরু হয় ঘরবাড়ি তৈরির প্রথম প্রচেষ্টা। সেখান থেকেই স্থাপত্যকলার শুরু। এভাবে মানুষের অর্জিত ও চর্চিত শিল্পকলার প্রায় সকল শাখার সুত্রপাত আদিম মানুষের হাতেই ঘটেছিল, যেমন- চিত্রকলা, কারুশিল্প, ভাষ্কর্য, মুখশিয়, স্থাপত্যশিল্প নৃত্য, সঙ্গীত, অভিনয় এ রকম অনেক শিল্প মাধ্যম।


পাঠ : ৪

অষ্টম শ্রেণিতে আমরা জেনেছি যে, সমগ্র শিল্পকলা মূলত প্রধান দুটি ধারায় বিভক্ত। একটি হচ্ছে চারুশিল্প বা Fine Arta এবং অন্যটি হচ্ছে কারুশিল্প বা Crafts, চারুশিল্প কাতে আমরা সে সব শিল্পকেই বুঝি যা মানুষের সৃজনশীল মনের শতঃস্ফূর্ণ বহিঃপ্রকাশ। অর্থাৎ সৃষ্টির আনন্দে মনের তাগিদেই তার উৎপত্তি। আমাদের দৃষ্টি ও মনকে আনন্দ দেয়াই তার উদ্দেশ্য। মানুষের মনের নানা অনুভূতি, সুখ, দুঃখ, আনন্দ, বেদনা এবং আরও নানামুখী অনুভব থেকে চারুশিল্পর সৃষ্টি।

পাঠ : ৫

অষ্টম শ্রেণিতে আমরা জেনেছি যে, সমগ্র শিল্পকলা মূলত প্রধান দুটি ধারায় বিভক্ত। একটি হচ্ছে চারুশিল্প বা Fine Arts এবং অন্যটি হচ্ছে কারুশিল্প বা Crafts, চারুশিল্প বলতে আমরা সে সব শিল্পকেই বুঝি যা মানুষের সৃজনশীল মনের মতঃসম্পূর্ণ বহিঃপ্রকাশ। অর্থাৎ সৃষ্টির আনন্দে মনের তাগিদেই তার উৎপত্তি। আামাদের দৃষ্টি ও মনকে আনন্দ দেয়াই তার উদ্দেশ্য। মানুষের মনের নানা অনুবৃত্তি, সুখ, দুঃখ, আনন্দ, বেননা এবং আরও নানামুখী অনুভব থেকে চারুশিল্প সৃষ্টি হয় ।
অন্যদিকে কারুশিল্প তৈরি হয়, মানুষের ব্যবহারিক প্রয়োজন মাথায় রেখে। অর্থাৎ কারুশিল্প যদিও শিল্প তথাপি তা কেবল মানুষকে আনন্দ দেবার জন্য বা দৃষ্টিকে আনন্দ দেবার জন্য তৈরি হয় না, এ শিল্প মানুষের ব্যবহারিক কাজে প্রয়োজন হয়। দৈনন্দিন জীবনে বিভিন্নভাবে বিভিন্ন প্রয়োজনে আমরা কারুশিল্পের ব্যবহার করি। তবে মানুষের সৃষ্ট সকল প্রকার শ্রেষ্ঠ শিল্পই চারুশিল্পের অন্তর্গত।

পাঠ : ৫

 শিল্পকলাকে প্রধানত দুটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে।

(১) চারুশিল্প

(২) কারুশিল্প।

চারুশিল্পকে আবার লগিতকলা, মানবিক কলা, নাটক, কাব্যসাহিত্য ও পদ্যসাহিত্যে ভাগ করা হয়েছে। এর মধ্যে ললিতকলা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভাগ। এই ভাগের কয়েকটি শাখা আছে। যেমন— চিত্রকলা, ভাস্কর্য, খোদাইশিল্প, সংগীত, নৃত্য ও নৃত্যনাট্য।
অন্যদিকে শিল্পকলার অপর ধারা কারুশিল্পের শাখাগুলো হচ্ছে- মৃৎশিল্প, বুনন, তাঁতশিল্প, বাঁশ, বেত ও কাঠের তৈরি শিল্প, চর্ম বা চামড়ার তৈরি বিভিন্ন পণ্য, গহনা, বিভিন্ন ধাতুর তৈরি শৈল্পিক তৈজসপত্র, গৃহস্থালি সামগ্রী, হাতিয়ার ইত্যাদি। এ ছাড়াও কারুশিল্পের ধারায় তৈরি আরও কিছু শিল্প আছে, যেগুলোকে আমরা লোকশিল্পরূপে চিহ্নিত করে থাকি। যেমন— পটচিত্র, মাটির ও কাঠের তৈরি বিভিন্ন খেলনা হাতি, ঘোড়া, মানুষ, পাখি। পোড়ামাটির ফলকচিত্র, নকশিকাঁথা, নকশি পাতিল বা শখের হাঁড়ি ইত্যাদি। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, শিল্পকলার প্রধান দুই ধারার বিভিন্ন শাখা প্রশাখা মিলিয়ে এর জগৎ অনেক বড় ও বিস্তৃত।

পাঠ :৭

শিল্পকলা চর্চার আদিম যুগের সেই কন্য, লোম দাড়িওয়ালা গুহাবাসী মানুষদের আঁকা ছবিই পৃথিবীর সবচেয়ে পুরোনো শিল্পকলা এ কথা আমরা আগেই জেনেছি। যারা এ ছবিগুলো এঁকেছে, হাজার হাজার বছর লাগে তারা পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে। কিন্তু তাদের আঁকা ছবিগুলো এখনো টিকে আছে। আর শুধু টিকে আছে বললে ভুল হবে। নেই সব ছবিগুলো, আলিম মানুষদের তৈরি বিভিন্ন মূর্তি, পাত্র ও হাতিয়ার আমাদের সামনে মেলে ধরে আছে ইতিহাসের এক অজানা অধ্যায়। ভেবে দেখ তখন ভাষা পর্যন্ত আবিষ্কার হয়নি, পি আবিষ্কার তো সূরের কথা। সুতরাং তখনকার কোনো লিখিত ইতিহাস তো পার পাওয়া যাবে না। কিন্তু আমি গুহাবাসী সে সব মানুষদের জীবনযাপন, আচার ব্যবহার, পোশাক-পরিচ্ছদ জানলে তো মানব জাতির ইতিহাস অসম্পূর্ণ থেকে বেস্ত। শিখিত ইতিহাস আমরা পাইনি বটে, কিন্তু তাদের করা ঐসব শিল্পকর্মগুলোই আজ ইতিহাসের সাক্ষী। শিল্পকর্মগুলো দেখে, ছবি দেখে আমরা আদিম মানুষের জীবন সংগ্রাম, পোশাক-পরিচ্ছন, তাদের চিন্তা, বিশ্বাস সবই জানতে পেরেছি। এভাবে নাদিম যুগের পরে পুরোনো গ্রুফর যুগ বা পুরোনো পাথর যুগ নতুন পাথরের যুগ, কৃষিযুগ প্রভৃতি সভ্যতার সবগুলো পর্যারকেই আমরা জেনেছি মানুষের কচ্ছপত সংস্কৃতির নিদর্শন থেকে। অর্থাৎ ঐ সভ্যতার মানুষ যে সকল হাতিয়ার, বাসনপত্র, পোশাক-পরিচ্ছদ, গয়নাগাটি ইত্যাদি ব্যবহার করত তা থেকে। মানুষের ব্যবহৃত ঐসব সামগ্রীকেই এখন আমরা কারুশিল্প বলে থাকি। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, মানব সভ্যতা ও শিল্প হাত ধরাধরি করে এগিয়েছে, তাই বলা হয় শিল্পের বয়স মানবসভ্যতার সমান। ঐ সমস্ত শিল্পকলার মাধ্যমে আমরা মানুষের সত্যতার ইতিহাসকে জানতে পেরেছি। এ থেকেই আমরা শিল্পকলা চর্চার গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারি। কোনো সমাজ, দেশ বা জাতির পরিচয়কে আমাদের সামনে তুলে ধরে তাদের শিল্প ও সংস্কৃতি। শিল্প একটি বিশেষ সময়কেও ধরে রাখে। যার থেকে আমরা সময়ে অনেক উপাদানকে পেরে যাই। যেমন মিশরীয় চিত্রকলা। মিশরীয়রা ছবি আঁকত মন্দিরে অথবা পিরামিডের ভিতরে। পিরামিড হচ্ছে রাজা, বাদশা বা বড়লোকদেৱ ৰুকা ঘর। ত্রিভুজ আকৃতির বিশাল বিশাল পাথরের তৈরি বিরাট বিরাট সমাধি। এর ভিতরেদেয়ালে, মৃতের কফিনে, মন্দিরে মিশরীয়রা হাজার হাজার ছবি আঁকত। সবটুকু জায়গা ছবি দিয়ে ভরে দিত। একটুও ফাঁকা রাখত না। এসব ছবিতে কিছু কিছু গৃহপালিত জীবজন্তুর ছবি থাকলেও বেশিরভাগই থাকত নারী, পুরুষ, রাজা, রানি ও দেব-দেবী। তাদের অধিকাংশ ছবিই গল্প বলা ছবি। অর্থাৎ ছবিগুলো দেখলেই এর ঘটনা বোঝা যায়। কখনো কখনো ছবির সাথে তাদের ভাষায় এর ব্যাখ্যাও থাকত। এসব ছবিগুলো দেখেই আজকে আমরা মিশরীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির কথা জানতে পারি। ঐ সময়ে তাদের পোশাক-পরিচ্ছদ, রাজা-রানি, জনগণ ও তাদের জীবনযাত্রা, নিয়ম- কানুন, আচার-বিশ্বাস সবই বলে দেয় ঐ ছবিগুলো আর তাদের ব্যবহৃত বিভিন্ন কারুশিল্পসামগ্রী। পিরামিডগুলোও মিশরীয় স্থাপত্যের বিস্ময়কর নিদর্শন। মূলত মিশরীয় শিল্পকলাই আমাদের সামনে তার অতীত ঐতিহ্য ও ইতিহাসকে হাজির করেছে।

পাঠ : ৮

শিল্পকলা ও স্থাপত্যের চমৎকার নিদর্শন আমরা গ্রিসে এবং ভারতবর্ষেও পাই। মধ্যযুগের গ্রিস ও ভারতবর্ষের সাহিত্যকর্ম সারা বিশ্বের অহংকার। ইলোরা ও অজন্তার গুহাচিত্র প্রাচীন ভারতীয় শিল্পকলাকে আমাদের সামনে তুলে ধরে। পালযুগের পুঁথিচিত্র বা মোঘল চিত্রকলা আমাদের সামনে ভারতের সামাজিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসের অনেক কিছুকেই প্রকাশ করেছে। পাশাপাশি ঐ সময়ের বিভিন্ন ভাস্কর্য ও বিভিন্ন স্থাপনা অর্থাৎ স্থাপত্যশিল্প ভারতবর্ষের অহংকার। অজন্তা গুহার দেয়ালে রিলিফ ভাস্কর্য আগ্রার তাজমহল পৃথিবীর বিষয়। তাই শিল্পকলা চর্চার গুরুত্ব অপরিসীম। মানব সভ্যতা এগিয়েছে মূলত মানুষের সৌন্দর্যবোধকে কেন্দ্র করেই। গুহাবাসী মানুষ যখন গাছ, পাতা, পশুর হাড়, চামড়া, ডালপালা দিয়ে ঘর বানানো শিখল তখন থেকে স্থাপত্যকলা আজকের অবস্থানে এসেছে শুধু মানুষের নিত্যনতুন সৌন্দর্যবোধের কারণে। মানুষ চেয়েছে তার তৈরি ভবনকে শিল্পিতরূপে দেখতে। তাকে আরো সুন্দর করতে। পোশাকের ব্যাপারেও একই কথা প্রযোজ্য। শুধু লজ্জা নিবারণের জন্য আদিম মানুষের গাছের ছাল, পাতা বা পশুর চর্মইতো যথেষ্ট ছিল। কিন্তু আজকে নিত্যনতুন ফ্যাশনের পোশাক আমরা পরিধান করছি। বাজারে গিয়ে আরও নতুন নতুন ডিজাইন খুঁজছি। এসবই শিল্পের প্রতি, সৌন্দর্যের প্রতি আমাদের আকর্ষণের কারণে। নিজের দেশ ও সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করার জন্য, মানুষের রুচি, সৌন্দর্যবোধ ও জাতীয় ঐতিহ্যের বিকাশে শিল্পকলার চর্চা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ছবি আঁকা ও শিল্পকর্ম যেমন- সংগীত, চলচ্চিত্র বা সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে মানুষের সৃজনশীল প্রতিভার বিকাশ ঘটে, মানুষের মানবিক গুণাবলি বিকশিত হয়। সমাজকে সুন্দর করার জন্য, সুন্দরভাবে বাঁচার জন্য, আনন্দে থাকার জন্য এবং নিজেকে ও নিজের অনুভূতিকে প্রকাশ করার জন্য ছবি আঁকা, শিল্পকর্মের চর্চা করা একটি প্রয়োজনীয় কাজ। এ কথাটা শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন এবং তাঁর সাথীরা এ দেশের মানুষকে বোঝাতে পেরেছিলেন বলেই আজ শিল্পকলার চর্চা আমাদের দেশে এত গুরুত্ব পাচ্ছে।

পাঠ : ৯

ছবি আঁকা বা অন্যান্য শিল্পকর্ম মানুষের জীবনকে সুন্দরভাবে গড়ে তুলতে সাহায্য করে। তাই খুব ছোটবেলা থেকে কোনো শিশুকে যদি ছবি আঁকার প্রতি আগ্রহী করে তোলা যায়, তাহলে শিশু লেখাপড়ার উন্নতির সাথে সাথে তার রুচিবোধের জ্ঞান উন্নত করতে পারবে। সুন্দর কী ও অসুন্দর কী তা সহজে বিচার করে তার কাজে সুরুচির পরিচয় দিতে পারবে। ছবি আঁকা ও অন্যান্য শিল্পকলা চর্চার মাধ্যমে একজন মানুষের মধ্যে অনেকগুলো গুণের বিকাশ ঘটানো সম্ভব ।

পাঠ : ১০

খাতার একটা ছোট কাগজে একটি শিশু যখন গ্রামের ছবি আঁকে তখন ঐ ছোট কাগজটিতে সে পুরো গ্রামের সবকিছুকে ধরতে চায়, যেমন-গ্রামের ঘরবাড়ি, গাছপালা, নদী- নৌকা, মানুষজন, গরু, ছাগল, ফুল, পাখি সবকিছু। ছোট কাগজটিতে কোথায় ঘরবাড়ি হবে, গাছপালা কোথায় থাকবে, নদীটি কোথা দিয়ে বয়ে যাবে, নৌকা কয়টি থাকবে, কোথায় থাকলে ভালো লাগবে, নদীর পাড়ে ফসলের মাঠ, বাড়ির উঠানে গরু, মেয়েরা নদী থেকে পানি নিয়ে ফিরছে এ রকম অনেক বিষয়েকে সুন্দর করে সাজিয়ে শিশুটি গ্রামের ছবি ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করে। ছোট একটা সাদা কাগজে এতবড় একটি গ্রামকে আঁকতে গিয়ে শিশুটির মধ্যে ছোট জায়গায় সীমিত পরিসরে সবকিছুকে সাজিয়ে রাখার, সুন্দর করে গুছিয়ে নেবার ও শৃঙ্খলাবোধের চর্চা হয়। এরপর রং করার ক্ষেত্রেও কোথায় কী রং দিলে সুন্দর হবে, প্রকৃতিতে কোনটির কী রং এসব নিয়ে শিশুটি ভাবে। এতে তার দেখার ক্ষমতা, চিন্তার শক্তি, সুন্দরের প্রতি আকর্ষণ সবই বৃদ্ধি পায়। ফলে এভাবে ছবি আঁকতে আঁকতে এক সময় তার মধ্যে সৌন্দর্যবোধ, মানবিক গুণাবলি ও মানুষের প্রতি মমত্ববোধ যেমন বৃদ্ধি পায়, তেমনি সুন্দর কাজ, ভালো কাজ করার ব্যাপারে সে উদ্যমী ও সাহসী হয়ে গড়ে ওঠে। পরিণত বয়সে সে কোনো দায়িত্বগ্রহণ করতে ভয় পায়না। ধরা যাক সে কোনো একটি প্রতিষ্ঠানের পরিচালক হলো, যে প্রতিষ্ঠানে শত শত কর্মী কাজ করে। সে কিন্তু সুশৃঙ্খল ও সুন্দরভাবে প্রতিষ্ঠানটি চালাতে পারবে। যার যার কাজ ও দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে বণ্টন করা তার জন্য সহজ হবে। কারণ ছোটবেলায় ছবি আঁকা চর্চার মাধ্যমে এ গুণ সে আয়ত্ত করেছে। ছবি আঁকা খুব সহজে মানুষকে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলে। এজন্য উন্নত বিশ্বে বহু আগে থেকেই লেখাপড়ার অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি ছবি আঁকাকে আবশ্যিক বিষয় হিসাবে গণ্য করা হয়।

পাঠ : ১১

শিল্পকলার গুরুত্বপূর্ণ অংশ চিত্রকলা ও কারুকলা

সামগ্রিক শিল্পকলার জগতে চিত্রকলা বা ভাস্কর্য তৈরি এবং কারুকলা একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আমাদের সমাজজীবনেও বিভিন্ন ক্ষেত্রে চিত্রকলা ও কারুকলার অসীম গুরুত্ব রয়েছে। সমাজে বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে চিত্রশিল্পী ও কারুশিল্পীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। যেসব কর্মক্ষেত্রে শিল্পীরা পেশা হিসেবে শিল্পকর্ম করে যাচ্ছে তা হলো গ্রামের পেশাজীবী কারুশিল্পীর কাজ; যেমন- কামার, কুমার, তাঁতি, স্বর্ণকার, সুতার ও বাঁশ-বেতের কারুশিল্পী। মেয়েদের তৈরি নকশিকাঁথা, শীতলপাটি, জায়নামাজ, শতরঞ্জি, পাখা ইত্যাদি ছাড়াও বুনন ও সূচিশিল্পের মাধ্যমে যুগ যুগ ধরে বংশ পরম্পরায় গ্রামের সাধারণ মানুষের মধ্যে এ সব শিল্পকর্মের চর্চা আছে। যাকে আমরা নাম দিয়েছি লোকশিল্প, কারুশিল্প ও কুটিরশিল্প। বর্তমান আধুনিক জীবনযাপনে লোকশিল্প, কারুশিল্প ও কুটিরশিল্পের প্রতি মানুষের আগ্রহ বেড়েছে।আধুনিক জীবনযাপনে ও বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে শিল্পীরা দায়িত্বপূর্ণ কাজ করে যাচ্ছে। বইপুস্তক ও পত্রপত্রিকার জন্য শিল্পী প্রয়োজন। শিক্ষাক্ষেত্রে বিশেষ করে প্রকৌশলবিদ্যা, চিকিৎসাবিদ্যা স্থাপত্যশিক্ষায় নানারকম বিজ্ঞান চর্চা, ইতিহাস, ভূগোল চর্চায় চিত্রশিল্পের অনেক গুরুত্ব রয়েছে। টেলিভিশনের প্রতিটি অনুষ্ঠান নির্মাণের জন্য ডিজাইনার এর প্রয়োজন। নাটক, সিনেমা তৈরিতে সেট ডিজাইনার বা অঙ্কনশিল্পী ছাড়া সম্ভব নয়। বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডিজাইনের জন্য যেমন- বিমান তৈরিতে, জাহাজ নির্মাণে, মোটরগাড়ি, বাস, ট্রেন, টেলিভিশন, রেডিও, তৈজসপত্র, তালা, চাবি, বৈদ্যুতিক বাতি, ফ্যান, বোতল, বৈয়ম, কৌটা থেকে শুরু করে কলম, পেনসিল, ছুরি, কাঁচি বিভিন্ন আসবাবপত্রের সুন্দর চেহারা, রূপ ও গড়ন বা আকার-আকৃতি তৈরির জন্য চিত্রশিল্পীর একান্ত প্রয়োজন। বিভিন্ন জিনিসপত্রের মোড়ক ও বিজ্ঞাপন, পোস্টার প্রভৃতি বিজ্ঞাপনী শিল্পের জন্য চিত্রশিল্পী প্রয়োজন। পোশাক বা ফ্যাশন ডিজাইনের জন্যও চিত্রশিল্পী ছাড়া চলে না। তাই শিল্পকলার চর্চা অত্যন্ত প্রয়োজন এবং চিত্রকলা ও কারুকলার চর্চা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

পাঠ : ১২

বিভিন্ন প্রকার কারুশিল্প

ইতঃপূর্বের আলোচনায় আমরা শিল্পকলায় বিস্তৃত ও নানামুখী বিষয় সম্পর্কে জেনেছি। চিত্রকলা, ভাস্কর্য ও কারুশিল্প হাজার বছর ধরে বিশ্বের শিল্প ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছে। যেসব শিল্পকর্ম ও শিল্পীরা তাঁদের কাজের মাধ্যমে এ ক্ষেত্রে অবদান রেখেছে তাঁদের সম্পর্কে সংক্ষেপে আমরা ৬ষ্ঠ, ৭ম ও ৮ম শ্রেণিতে জেনেছি। চীমাবৃয়ে, জত্তো থেকে বতিচেল্লি, পেরুজীনো, রাফায়েল, মাইকেল এঞ্জেলোসহ শুধুমাত্র ইতালিতেই জন্মেছিলেন বহু কালজয়ী শিল্পী, ভ্যাটিকান সিটিতে সিস্তিন গির্জার ছাদের নিচে বাইবেলের ঘটনাবলি নিয়ে মাইকেল এঞ্জেলো যে ছবি এঁকেছেন, তা বিশ্বশিল্পকে দিয়েছে অতুলনীয় সম্পদ। ছাদের নিচে মাচা বেঁধে টানা সাড়ে চার বছর চিত হয়ে শুয়ে শুয়ে এ কাজ তিনি শেষ করেন। মাইকেল এঞ্জেলো মূলত ছিলেন খ্যাতিমান ভাস্কর। গির্জার ছবিটি যখন শেষ হলো তখন গোটা রোমের লোক ফেটে পড়ল তা দেখার জন্য। আজও সারা বিশ্বের হাজার হাজার শিল্পপ্রেমিক রোমের সিস্তিন গির্জায় ঐ ছবি দেখার জন্য ছুটে যায়। আর একজন বিখ্যাত শিল্পী লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি, তিনিও ইতালিতে জন্মান। তাঁর আঁকা মোনালিসা পৃথিবী বিখ্যাত। বর্তমানে ফ্রান্সের প্যারিস শহরের ল্যুভর মিউজিয়ামে সংরক্ষিত আছে ছবিটি। শ্রেষ্ঠ শিল্পীদের আর একজন হচ্ছেন রেমব্রান্ট। তাঁর বিখ্যাত ছবি রাতের পাহারা। বিখ্যাত অন্য একজন শিল্পী পল সেজান। তাঁর প্রাকৃতিক দৃশ্যের ছবি দেখে মনে হবে ছবির মধ্যে ঢুকে আমরা তাঁর মাঠে, ঘাটে, পাহাড়ে বেড়িয়েপড়ি। তোমরা অনেকেই হয়তো ভ্যানগগ এর নাম শুনেছ। তাঁর জন্ম হল্যান্ডে। ফরাসি শিল্পী পল গগ্যা ও ভ্যানগগ একসাথে কিছুদিন ছবি আঁকেন। তাঁরা দুজনেই চিত্রশিল্পের ইতিহাসে বিখ্যাত। আর এক শিল্পী মাতিস। তাঁর একটি বিখ্যাত ছবি-নাচ। বিশ শতকের সেরা শিল্পীদের অন্যতম হচ্ছেন- পাবলো পিকাসো। শিশু ও পায়রা, মা ও শিশু, স্বপ্ন, পায়রা, গুয়ের্নিকা ইত্যাদি তাঁর বিখ্যাত ছবি। অন্যদিকে আধুনিক ভাস্কর্যের জনক অগাস্টিন রদ্যা এবং হেনরি ম্যুরসহ বিভিন্ন ভাস্কররা তাঁদের ভাস্কর্য দিয়ে সমৃদ্ধ করেছেন শিল্পের ভুবনকে। আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশের খ্যাতিমান শিল্পীরাও বিশ্বশিল্পে তাঁদের অবদান রেখেছেন। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নন্দলাল বসু, যামিনী রায়, আব্দুর রহমান চুখতাই, আমাদের দেশের জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসান, এস.এম সুলতান, শফিউদ্দিন আহমেদ প্রমুখ শিল্পীদের কাজেও চারুকলার ভুবন সমৃদ্ধ হয়েছে। অন্যদিকে কারুকলাও সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দেশে নিজ নিজ বৈশিষ্ট্য নিয়ে সমৃদ্ধ করেছে শিল্পকলার ভুবনকে।

বিশ্বশিল্পের এই বিশাল চিত্রকলার ভাণ্ডার এত সমৃদ্ধ, এতবিখ্যাত সব শিল্পী আর শিল্পকর্ম রয়েছে যে সে সব এই স্বপ্ন পরিসরে লিখে শেষ করা যাবে না। তাই অল্প কিছু শিল্পী ও শিল্পকলার নাম উল্লেখ করা হলো। বড় হয়ে, উপরের ক্লাসে উঠে বা ভবিষ্যতে কোনো সময়ে নিজেদের আগ্রহে তোমরা চিত্রকলার এই বিশাল ভাণ্ডার সম্পর্কে বিভিন্ন বইয়ে জানতে পারবে। এই বইয়ের পরবর্তী অধ্যায়ে কয়েকজন বিখ্যাত শিল্পী সম্পর্কে সংক্ষেপে জানতে পারবে।

Content added By

Promotion

Promotion
Content for the offcanvas goes here. You can place just about any Bootstrap component or custom elements here.