যে সকল মনীষী তাঁদের জ্ঞান-গবেষণার জন্য মুসলিম উম্মাহর ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছেন, ইমাম আবু হানিফা (রহ.) তাঁদের মধ্যে অন্যতম। তাঁকে ফিকহ শাস্ত্রের জনক বলে হয়। প্রিয় শিক্ষার্থী, আজ আমরা তাঁর জীবনাদর্শ জানব।
জন্ম ও বংশ পরিচয়
ইমাম আবু হানিফা (রহ.) ৮০ হিজরি সনের ৪ শাবান মোতাবেক ৭০০ খ্রিস্টাব্দে ইরাকের কুফা নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর আসল নাম নুমান, পিতার নাম সাবিত। দাদার নামানুসারে তাঁর নাম রাখা হয় নুমান। তিনিই পরবর্তীতে ইমাম আযম আবু হানিফা নামে জাহিষ্যাত হন।
জ্ঞানার্জন
ইমাম আবু হানিফা (রহ.) ছিলেন তীক্ষ্ণ মেধার অধিকারী। একবার যা পড়তেন বা শুনতেন তা মুখস্থ হয়ে যেতো। তিনি বাল্যকালেই পবিত্র কুরআন হিফয করেছিলেন। ইমাম শা'বীর পরামর্শে তিনি ইলমুল কালাম, পবিত্র কুরআন, হাদিস ও ফিকহ শাস্ত্রের প্রতি আকৃষ্ট হন এবং গভীর পান্ডিত্য অর্জন করেন। তিনি মক্কা, মদিনা, কুফা, বসরা ও সিরিয়ার বিখ্যাত মুহাদ্দিসগণের নিকট হতে হাদিসের জ্ঞান লাভ করেন। পৰিত্ৰ হা উপলক্ষে মক্কা শরীফে এলে বিভিন্ন দেশের মুহাদ্দিস ও ফকীহগণের সাথে আনের আদান-প্রদান করতেন। তিনি কয়েকজন সাহাবির সাক্ষাত পান। তাই তাকে তাবেঈ গণ্য করা হয়।
ফিকহ শাস্ত্রে অবদান
ইমাম আবু হানিফা (রহ.) ফিকহ শাস্ত্রের উদ্ভাবক এবং হানাফি মাযহাবের প্রতিষ্ঠাতা। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের ইবাদাত ও আমলসমূহ আমরা যাতে সঠিকভাবে পালন করতে পারি সেজন্য তিনি কুরআন ও হাদিসে বর্ণিত শরীয়াতের বিধি-বিধানকে অত্যন্ত সহজ করে গ্রন্থিত করেন। এজনাই বিশ্বের অধিকাংশ মুসলমান তাঁর মাযহাবকে অনুসরণ করেন। তাঁর উদ্ভাবিত ফাতওয়া হানাফি মাযহাবের বিখ্যাত গ্রন্থসমূহে লিপিবন্ধ করা হয়েছে। তিনি মুসলিম উম্মাহর জন্য প্রায় ৮৩ হাজার মাসআলার সমাধান করে গেছেন। তাঁর মাযহাবই সারা বিশ্বে সমাদৃত ও সহজ পালনীয়। ইমাম আবু ইউসুফ, ইমাম মুহাম্মাদ, ইমাম যুফারসহ আরো অনেক প্রসিদ্ধ ফকীহ তাঁর শিষ্য ছিলেন। ফিকহ শাস্ত্রে তাঁর অবদানের মূল্যায়ন করতে গিয়ে ইমাম শাফেয়ী (রহ.) বলেন, যদি কোন ব্যক্তি ইলম ফিকহের ব্যাপক জ্ঞানার্জন করতে চায় সে যেন অবশ্যই ইমাম আবু হানিফা ও তাঁর শিষ্যদের সান্নিধ্য গ্রহণ করে। ইমাম আবু হানিফা হাদিস শাস্ত্রে 'হাফেমুল হাদিস' ছিলেন। তার সহিহ হাদিস সংকলন- "মুসনাদ আল-ইমাম আবি হানিফাহ' একটি অমূল্য গ্রন্থ।
চারিত্রিক গুণাবলি
ইমাম আবু হানিফা (রহ.) অনুপম চরিত্রের অধিকারী ছিলেন। তিনি নিয়মিত রাত্রি জাগরণ করে তাহাজ্জুদ সালাত ও আল্লাহর যিকির করতেন। তিনি কখন গিবত বা পরনিন্দা করতেন না। কখনও কারো সম্পর্কে। আলোচনা করলে তার ভালো দিকটাই আলোচনা করতেন। তিনি একজন সফল ব্যবসায়ী ছিলেন। ব্যবসা-বাণিজ্যে সর্বদা সততা বজায় রাখতেন; পণ্যের দোষ-ত্রুটি কখনও গোপন করতেন না। তিনি ওয়াদা ও আমানত রক্ষা করতেন। ঋণী ব্যক্তিকে অবকাশ দিতেন, অধিকাংশ সময় তাদেরকে ক্ষমা করে দিতেন। তিনি খুব সাদাসিধা ও অনাড়ম্বর জীবনযাপন করতেন। তিনি খুব নম্র ও বিনয়ী ছিলেন।
ইমাম আবু হানিফা (রহ.) একজন মুস্তাকী ও পরহিমাগার ছিলেন। হারাম বা নিষিদ্ধ বিষয় থেকে সবসময় নিজেকে পবিত্র রাখতেন। অধিকাংশ সময় চিন্তামগ্ন ও চুপ থাকতেন। তিনি দানশীল ও দয়ালু ছিলেন।
পার্থিব প্রভাব-প্রতিপত্তিকে তিনি অত্যন্ত তুচ্ছ মনে করতেন। তাঁকে খলিফা মানসুর বাগদাদের প্রধান বিচারপতির পদ গ্রহণ করার প্রস্তাব দিলে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। এ জন্য খলিফা তাঁকে জেলে আটক করে রাখেন। কোন কিছুতেই রাজি করাতে না পেরে খলিফা তাঁকে গোপনে বিষ প্রয়োগ করেন। এই বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে তিনি ১৫০ হিজরিতে সিজদাহরত অবস্থায় ইন্তেকাল করেন। আমরা এই মহান মনীষীর জীবনাদর্শ ভালভাবে জানব এবং তাঁর উন্নত নৈতিক আচরণগুলো নিজেদের জীবনে বাস্তবায়নে সচেষ্ট হবো।
দলগত কাজ: ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর চরিত্রের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করো এবং নিজেদের জীবনে অনুশীলন করো। |
---|
আরও দেখুন...