চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া

নবম-দশম শ্রেণি (দাখিল) - বাংলা সাহিত্য - কবিতা | NCTB BOOK

স্পর্শ কাতরতাময় এই নাম

উচ্চারণমাত্র যেন ভেঙে যাবে,

অন্তর্হিত হবে তার প্রকৃত মহিমা,

চুনিয়া একটি গ্রাম, ছোট্ট – কিন্তু ভেতরে-ভেতরে

খুব শক্তিশালী

মারণাস্ত্রময় সভ্যতার বিরুদ্ধে দাঁড়াবে ।

মধ্যরাতে চুনিয়া নীরব ।

চুনিয়া তো ভালোবাসে শান্তস্নিগ্ধ পূর্ণিমার চাঁদ,

চুনিয়া প্রকৃত বৌদ্ধ-স্বভাবের নিরিবিলি সবুজ প্রকৃতি;

চুনিয়া যোজনব্যাপী মনোরম আদিবাসী ভূমি ।

চুনিয়া কখনো কোনো হিংস্রতা দ্যাখেনি ।

চুনিয়া গুলির শব্দে আঁতকে ওঠে কি?

প্রতিটি গাছের পাতা মনুষ্যপশুর হিংস্রতা দেখে না না করে ওঠে?

- চুনিয়া মানুষ ভালোবাসে ।

বৃক্ষদের সাহচর্যে চুনিয়াবাসীরা প্রকৃত প্রস্তাবে খুব

সুখে আছে ।

চুনিয়া এখনো আছে এই সভ্যসমাজের

                            কারো কারো মনে,

কেউ-কেউ এখনো তো পোষে

বুকের নিভৃতে এক নিবিড় চুনিয়া ।

চুনিয়া শুশ্রূষা জানে,

চুনিয়া ব্যান্ডেজ বাঁধে, চুনিয়া সান্ত্বনা শুধু -

চুনিয়া কখনো জানি কারুকেই আঘাত করে না;

চুনিয়া সবুজ খুব, শান্তিপ্রিয় – শান্তি ভালোবাসে,

কাঠুরের প্রতি তাই স্পষ্টতই তীব্র ঘৃণা হানে ।

চুনিয়া চিৎকার খুব অপছন্দ করে,

চুনিয়া গুলির শব্দ পছন্দ করে না ।

রক্তপাত, সিংহাসন প্রভৃতি বিষয়ে

চুনিয়া ভীষণ অজ্ঞ;

চুনিয়া তো সর্বদাই মানুষের আবিষ্কৃত

মারণাস্ত্রগুলো

ভূমধ্যসাগরে ফেলে দিতে বলে ।

চুনিয়া তো চায় মানুষেরা তিনভাগ জলে

রক্তমাখা হাত ধুয়ে তার দীক্ষা নিক ।

চুনিয়া সর্বদা বলে পৃথিবীর কুরুক্ষেত্রগুলি

সুগন্ধি ফুলের চাষে ভরে তোলা হোক ।

চুনিয়ারও অভিমান আছে,

শিশু ও নারীর প্রতি চুনিয়ার পক্ষপাত আছে;

শিশুহত্যা, নারীহত্যা দেখে দেখে সে-ও

মানবিক সভ্যতার প্রতি খুব বিরূপ হয়েছে।

চুনিয়া নৈরাশ্যবাদী নয়, চুনিয়া তো মনেপ্রাণে

নিশিদিন আশার পিদিম জ্বেলে রাখে

চুনিয়া বিশ্বাস করে;

শেষাবধি মানুষেরা হিংসা-দ্বেষ ভুলে

পরস্পর সৎপ্রতিবেশী হবে।
                                                              (সংক্ষেপিত)
 

Content added || updated By

 রফিক আজাদ ১৪ই ফেব্রুয়ারি ১৯৪১ সালে টাঙ্গাইল জেলার জাহিদগঞ্জের গুণীগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা সালিম উদ্দিন খান এবং মাতা রাবেয়া খান। তিনি ১৯৫৯ সালে টাঙ্গাইলের ব্রাহ্মণশাসন উচ্চ বিদ্যালয় থেকে প্রবেশিকা এবং ১৯৬২ সালে নেত্রকোনা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৬ ও ১৯৬৭ সালে তিনি বাংলা সাহিত্যে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। কর্মজীবনে তিনি সাংবাদিকতা, অধ্যাপনা ও সরকারি চাকরিতে নিয়োজিত ছিলেন। প্রেম, দ্রোহ ও প্রকৃতিনির্ভর কবিতার এক তাৎপর্যপূর্ণ জগৎ তিনি সৃষ্টি করেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্য: অসম্ভবের পায়ে, চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া, সশস্ত্র সুন্দর, হাতুড়ির নিচে জীবন, পরিকীর্ণ পানশালায় আমার স্বদেশ, অপর অরণ্যে, বিরিশিরি পর্ব ইত্যাদি। সাহিত্যে অসামান্য অবদানের জন্য তিনি আলাওল পুরস্কার এবং বাংলা একাডেমি পুরস্কারসহ অনেক পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হন। ১২ই মার্চ ২০১৬ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। 
 

Content added By

অন্তর্হিত - মিলিয়ে যাওয়া, হারিয়ে যাওয়া। মারণাস্ত্রময় ... দাঁড়াবে – স্বাধীনতা যুদ্ধে বাংলাদেশের অন্যান্য সম্প্রদায়ের মতোই মনে প্রাণে ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী সম্প্রদায়ও সার্বিকভাবে অংশগ্রহণ করেছিল। চুনিয়া গ্রামটিও ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী অধ্যুষিত এলাকা। তারা মুক্তিযুদ্ধে যেমন অসীম সাহসিকতার স্বাক্ষর রেখেছেন, তেমনি কবি মনে করছেন পৃথিবীর যেকোনো মারণাস্ত্রের বিরুদ্ধেই তারা রুখে দাঁড়াবে। প্রকৃত বৌদ্ধ-স্বভাবের - মহামানব গৌতমবুদ্ধ মূলত অহিংস নীতিবাদী ছিলেন । এখানে যে সম্প্রদায়ের কথা বলা হয়েছে তারাও বৌদ্ধ- ধর্মাবলম্বী, এরা গৌতম বুদ্ধের মতোই শান্তিপ্রিয় ও অহিংস মনোভাবের মানুষ— এ বোধটিকে বোঝানো হয়েছে। যোজনব্যাপী – যোজন শব্দের অর্থ 'অনেক' বা বহু। এখানে শব্দটি স্থানবাচনার্থেই ব্যবহৃত হয়েছে। যোজনব্যাপী হলো অনেকটা স্থানব্যাপী। আঁতকে – চমকে, হঠাৎ ভয় পেয়ে। সাহচর্য – একসঙ্গে মিলেমিশে।  দীক্ষা – তত্ত্বজ্ঞান লাভ, এক ধরনের শপথ নেয়া। কুরুক্ষেত্র – প্রাচীন ভারতের একটি ঐতিহাসিক স্থান কুরুক্ষেত্র। যেখানে কৌরব এবং পাণ্ডবদের মধ্যে যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। কাহিনীটি মহাভারতে বর্ণিত হয়েছে; নৈরাশ্যবাদী – নিরাশ ব্যক্তি, হতাশ ব্যক্তি, পিদিম – প্রদীপ, বাতি। আর্কেডিয়া- গ্রিসের একটি জায়গা, যা বহুকাল আগে থেকে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং শান্তি প্রিয়তার জন্য বিখ্যাত ৷
 

Content added || updated By

‘চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া' কবিতাটি কবি রফিক আজাদের ‘চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া' কাব্য থেকে সংকলিত হয়েছে। এটি একটি প্রতীকী গদ্য কবিতা। ‘চুনিয়া' নামের একটি গ্রামের প্রতীকের মধ্য দিয়ে কবি মানুষকে সুন্দরভাবে বাঁচার আহ্বান জানাচ্ছেন। কবির কথায়, চুনিয়া একটি ছোট্ট আদিবাসী গ্রাম । শহর থেকে অনেক দূরে এর অবস্থান। মনোরম সবুজ প্রকৃতির পটভূমিতে স্থাপিত বলে চুনিয়া কখনো হিংস্রতা দেখেনি। রক্তপাত দেখেনি। চুনিয়া শুধু জানে মানুষকে ভালোবাসতে । মানবসমাজে আজ যে হিংসা হানাহানি রক্তপাত দেখা যায়, চুনিয়াতে এসব নেই। সবাই এখানে তাই সুখে থাকে। কবি মনে করেন, প্রতিটি মানুষই আসলে এরকম। সভ্যসমাজের অনেকেই এই ধরনের স্নিগ্ধ সুন্দর গ্রামকে অথবা গ্রামের মতো পরিবেশকে বুকের মধ্যে লালন করে থাকেন। চুনিয়া বিশ্বাস করে, মানুষ মারণাস্ত্র ফেলে, হিংসা-দ্বেষ ভুলে পরস্পর সৎ প্রতিবেশী হবে। কেননা মানবতার পক্ষে দাঁড়ানোই হচ্ছে মানবসভ্যতার মূল কথা ।
 

Content added By
Promotion