গ্যামেট সৃষ্টি (Formation of Gametes) বা গ্যামেটোজেনেসিস (Gametogenesis):
যে প্রক্রিয়ায় জনন অঙ্গের (শুক্রাশয় ও ডিম্বাশয়) প্রাইমর্ডিয়াল জননকোষ (জনন মাতৃকোষ) থেকে গ্যামেট (শুক্রাণু ও ডিম্বাণু) উৎপন্ন হয়ে নিষেকে সক্ষম হয়ে উঠে তাকে গ্যামেটোজেনেসিস (গ্রিক gamos = জননকোষ এবং genesis = উৎপত্তি হওয়া) বলে।
ক. শুক্রাণু সৃষ্টি বা স্পার্মাটোজেনেসিস (spermatogenesis):
পূর্ণাঙ্গ শুক্রাণু সৃষ্টির প্রক্রিয়াকে স্পার্মাটোজেনেসিস (spermatogenesis: গ্রিক sperma = শুক্রাণু + genesis = জনন বা সৃষ্টি) বলে।
নিচে মানুষের স্পার্মাটোজেনেসিস প্রক্রিয়া বর্ণনা করা হলো। ক্রমবর্ধনের উপর ভিত্তি করে সমগ্র প্রক্রিয়াটিকে নিচে বর্ণিত চারটি ধাপে ভাগ করা যায়।
১. সংখ্যাবৃদ্ধি পর্যায় (Multiplication phase): শুক্রাশয়ের সেমিনিফেরাস নালিকার জার্মিনাল এপিথেলিয়াল কোষ (seminal epithelial cell, 2n) বার বার মাইটোসিস প্রক্রিয়ায় বিভাজিত হয়। উৎপন্ন কোষগুলোকে স্পার্মাটোগোনিয়া (spermatogonia, একবচনে-spermatogonium) বলে। স্পার্মাটোগোনিয়ামকে (2n) শুক্রাণু মাতৃকোষ-ও বলা হয়।
২. পরিবর্ধন পর্যায় (Growth phase): প্রত্যেক স্পার্মাটোগোনিয়াম সেমিনিফেরাস নালিকার সারটলি কোষ থেকে পুষ্টি গ্রহণ করে আয়তনে বড় হয়। এ কোষগুলোকে প্রাইমারি স্পার্মাটোসাইট (primary spermatocyte) বলে। এসব কোষের নিউক্লিয়াস আয়তনে বেশ বড় এবং ক্রোমোজোমগুলোতে মিয়োসিসের ইন্টারফেজ দশার লক্ষণ প্রকাশ পায়।
৩. পূর্ণতাপ্রাপ্তি পর্যায় (Maturation phase): এ পর্যায়ের শুরুতে প্রাইমারি স্পার্মাটোসাইটগুলোতে প্রথম মিয়োসিস বিভাজন ঘটে, ফলে সৃষ্ট কোষগুলো হ্যাপ্লয়েড (n) প্রকৃতির হয়। এদের সেকেন্ডারি স্পার্মাটোসাইট (secondar spermatocyte) বলে। এগুলো প্রতিটি দ্বিতীয় মিয়োসিস বিভাজনের মাধ্যমে দুটি করে স্পার্মাটিড (spermatid) সৃষ্টি করে। এভাবে পূর্ণতাপ্রাপ্তি পর্যায়ে একটি ডিপ্লয়েড প্রাইমারি স্পার্মাটোসাইট (2n) থেকে চারটি হ্যাপ্লয়েড স্পার্মাটিড (n) গঠিত হয়।
৪. স্পার্মিওজেনেসিস (Spermiogenesis): যে জটিল প্রক্রিয়ায় চলাচলে অক্ষম, গোলাকার স্পার্মাটিড ধারাবাহিক ও সম্পূর্ণ আঙ্গিক পরিবর্তনের মাধ্যমে, আর কোন বিভাজন ছাড়াই সচল শুক্রাণুতে পরিণত হয় তাকে স্পার্মিওজেনেসিস বলে। প্রথমে স্পার্মাটিডের নিউক্লিয়াসটি পানি, RNA ও নিউক্লিয়াস পরিত্যাগ করে সঙ্কুচিত হয় এবং শুক্রাণুর মাথা গঠন করে। স্পার্মাটিডে গলজি বডি থেকে অ্যাক্রোসোম (acrosome) সৃষ্টি হয়ে শুক্রাণুর মাথায় টুপির মতো অবস্থান করে। স্পার্মাটিডের সেন্ট্রিওল শুক্রাণুর অক্ষীয় সূত্রক ও লেজ গঠন করে। এভাবে স্পার্মাটিড রূপান্তরিত সচল, লম্বাকৃতির ও প্রায় সাইটোপ্লাজমবিহীন শুক্রাণুতে পরিণত হয়। এ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে ৬০-৭০ দিন সময় লাগে।
মানুষের শুক্রাণুর গঠন (Structure of Human sperm)
শুক্রাণুদেহ চারটি প্রধান অংশে বিভক্ত:
• মাথা (Head): মাথা হচ্ছে শুক্রাণুর সামনের অংশ যা দেখতে স্ফীতকায়, কোণাকার বা লেন্সের মত। মাথার সাইটোপ্লাজমের অধিকাংশ জুড়ে থাকে একটি ডিম্বাকার নিউক্লিয়াস। এতে ক্রোমোজোম (n সংখ্যক) থাকায় পিতার বংশগতি সন্তানে সঞ্চারিত হয়। এর সামনের অর্ধেক অংশের উপরে নিউক্লিয়াসকে ঢেকে থাকে অ্যাক্রোসোম। অ্যাক্রোসোমে উপস্থিত টিস্যু গলনকারী এনজাইমগুলো ডিম্বাণুর ঝিল্লি ভেদ করে ভিতরে প্রবেশে সাহায্য করে।
• গ্রীবা (Neck): গ্রীবা হচ্ছে শুক্রাণুর মাথার ঠিক পিছনে মাথা ও মধ্যখন্ডের মাঝখানে অবস্থিত একটি সরু, স্বচ্ছ সংযোগস্থল। এখানে পরস্পরের সাথে সমকোণে দুটি সেন্ট্রিওল থাকে।
• মধ্য খন্ড (Middle piece): সাইটোপ্লাজম, মাইটোকন্ড্রিয়া ও অক্ষীয় সূত্রে গঠিত অংশটি হচ্ছে শুক্রাণুর মধ্য খন্ড।
• লেজ বা ফ্ল্যাজেলাম (Tail or Flagellum): শুক্রাণুর মধ্যখণ্ডের সাইটোপ্লাজম ও মাইটোকন্ড্রিয়ার সমাপ্তির অংশ থেকে শুরু করে পিছনের। সবটুকুই লেজ বা ফ্ল্যাজেলাম। এটি শুক্রাণুর দীর্ঘতম অংশ। ফ্ল্যাজেলাম শুক্রাণুকে গতিশীল করে নিষেকের উদ্দেশে ডিম্বাণুর কাছে পৌছাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
খ. ডিম্বাণু সৃষ্টি বা উওজেনেসিস (Oogenesis):
ডিম্বাশয়ের অভ্যন্তরে ডিম্বাণু সৃষ্টির পদ্ধতিকে উওজেনেসিস (oogonesis; গ্রিক oon = ডিম্বাণু + genesis = সৃষ্টি বা জনন) বলে।
১.সংখ্যাবৃদ্ধি পর্যায় (Multiplication phase): ডিম্বাশয়ের জার্মিনাল এপিথেলিয়াল কোষ (2n) বার বার মাইটোসিস প্রক্রিয়ায় বিভক্ত হয়ে উওগোনিয়া (oogonia, একবচনে- oogonium) সৃষ্টি করে। উওগোনিয়ামে ডিপ্লয়েড (2n) সংখ্যক ক্রোমোজোম থাকে।
২. পরিবর্ধন পর্যায় (Growth phase): সাইটোপ্লাজমে লিপিড, প্রোটিন ইত্যাদি কুসুম আকারে জমা হওয়ায় উওগোনিয়ামটি আয়তনে বড় হয়। একই সময়ে নিউক্লিয়াসের আয়তন ও বিপাকীয় কাজসহ প্রোটিন সংশ্লেষণ অনেক বৃদ্ধি পায়। পরিবর্ধিত এ উওগোনিয়ামকে প্রাইমারি উওসাইট (primary oocyte) বলে। প্রতিটি প্রাইমারি উওসাইট (2n) একস্তর গ্রানুলোসা বা ফলিকল কোষ (granulosa or follicle cells)-এ আবৃত হয়ে প্রাইমারি ফলিকল (primary follicle)-এ পরিণত হয়।
৩. পূর্ণতাপ্রাপ্তি পর্যায় (Maturation phase): বয়ঃসন্ধিকাল থেকে প্রতি মাসে কিছু প্রাইমারি ফলিকল বৃদ্ধি লাভ করে। এর মধ্যে সাধারণত একটি পরিণত হয়, অন্যগুলো বিলুপ্ত হয়। পরিণত প্রাইমারি ফলিকলকে গ্রাফিয়ান ফলিকল (graafian follicle) বলে। বৃদ্ধিরত প্রাইমারি ফলিকলের অভ্যন্তরস্থ প্রাইমারি উওসাইট প্রথম মিয়োটিক বিভাজন-এর মাধ্যমে দুটি অসম কোষ উৎপন্ন করে। বড় কোষটিকে সেকেন্ডারি উওসাইট (secondary oocyte, n) এবং ছোট কোষটিকে ১ম পোলার বডি (1st polar body) বলে। এরপর ১ম পোলার বডি মাইটোসিস প্রক্রিয়ায় বিভাজিত হয়ে দুটি পোলার বডি সৃষ্টি করে। অন্যদিকে, সেকেন্ডারি উওসাইটটি নিষেকের জন্য প্রস্তুত হতে থাকে। সেকেন্ডারি উওসাইট অবস্থায় ডিম্বপাত বা ওভ্যুলেশন (ovulation) ঘটে। নিষেকের সময় কোন শুক্রাণু ডিম্বাণুর জোনা পেলুসিডা ভেদ করতে পারলে তখন সেকেন্ডারি উওসাইটে দ্বিতীয় মিয়োটিক বিভাজন সম্পন্ন হয়। এ বিভাজনে সেকেন্ডারি উওসাইটটি অসমভাবে বিভক্ত হয়ে একটি বড় হ্যাপ্লয়েড উওটিড (ootid) ও একটি ছোট পোলার বডি (n) সৃষ্টি করে। এভাবে পূর্ণতাপ্রাপ্তি পর্যায়ে একটি প্রাইমারি উওসাইট থেকে একটি বড় উওটিড ও তিনটি ছোট পোলার বডি সৃষ্টি হয়।
৪. রূপান্তর পর্যায়: এ পর্যায়ে উওটিড রূপান্তরিত হয়ে কার্যকর ওভাম (ovum) বা ডিম্বাণু-তে পরিণত হয়। তবে শুক্রাণুর মতো এক্ষেত্রে আকৃতি ও আকারে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে না। কেবল নিষেকের প্রস্তুতি লাভের জন্য এর ভিতরের পদার্থের সামান্য পরিবর্তন ঘটে। সকল পোলার বডি বিনষ্ট হয়ে পরিত্যক্ত হয়।
মানুষের ডিম্বাণুর গঠন (Structure of Human ovum or egg)
প্রতিটি পরিপক্ক ডিম্বাণুকে তিনটি অংশে ভাগ করা যায়, যথা: ডিম্বাণু ঝিল্লি, নিউক্লিয়াস ও সাইটোপ্লাজম। নিচে এদের বর্ণনা দেয়া হলো।
১. ডিম্বাণু ঝিল্লি (Egg membrane): ডিম্বাশয় থেকে যে ডিম্বাণুর নির্গমন ঘটে তা সম্পূর্ণ পরিণত ডিম্বাণু নয়। প্রকৃতপক্ষে এটি সেকেন্ডারি উওসাইট যা আরেক দফা বিভাজনের মাধ্যমে (দ্বিতীয় মিয়োটিক বিভাজন) দ্বিতীয় পোলার বডি সৃষ্টি ও ত্যাগ করবে। এ অবস্থায় সম্পূর্ণ ডিম্বাণু গ্লাইকোপ্রোটিন সমৃদ্ধ জোনা পেলুসিডা (zona pellucida) নামক একটি প্রাইমারি আবরণে দৃঢ়ভাবে আবৃত থাকে। পরবর্তী সময়ে চারদিকে জোনা পেলুসিডা ও সাইটোপ্লাজমের মধ্যবর্তী অংশ তরলে পূর্ণ জায়গায় পরিবৃত হয়। এ জায়গাটিকে পেরিভাইটেলাইন ফাঁক (perivitelline space) বলে। প্রথম পোলার বডিকে এ ফাঁকা স্থানে দেখা যায়। ডিম্বাশয় থেকে যখন ডিম্বাণু মুক্ত হয় তখন জোনা পেলুসিড়া চারদিক ঘিরে ফলিকল কোষের স্তর বয়ে করে আনে। এ স্তরটি করোনা রেডিয়েটা (coron radiata) নামে পরিচিত। ডিম্বনালি বেয়ে নামার সময় এ স্তরের কোষগুলো খসে পড়ে।
২. সাইটোপ্লাজম বা উওপ্লাজম (ooplasm): ডিম্বাণুর সাইটোপ্লাজম উওপ্লাজম নামে পরিচিত। এতে প্রচুর গলজি বডি, মাইটোকন্ড্রিয়া, এন্ডোপ্লাজমিক রেটিকুলাম ও কর্টিক্যাল গ্র্যানিউল (cortical granule) থাকে। মানুষের ডিম্বাণুতে কুসুমের পরিমাণ অতিসামান্য এবং সাইটোপ্লজমে সমানভাবে ছড়ানো থাকে। তাই মানুষের ডিম্বাণুকে মাইক্রোলেসিথাল ডিম্বাণু (microlecithal egg) বলে।
৩. নিউক্লিয়াস (Nucleus): ডিম্বাণুর নিউক্লিয়াস বেশ বড়, কেন্দ্র থেকে একটু সরে অবস্থান করলেও নিষেকের সময় কেন্দ্রে চলে আসে। নিউক্লিয়াসে প্রচুর RNA ও ২৩টি ক্রোমোজোম থাকে।
গ্যামেটোজেনেসিস এর তাৎপর্য (Importance of Gametogenesis):
১. যৌন জননে অংশগ্রহণকারী জীব গ্যামেটোজেনেসিসের মাধ্যমে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ক্রোমোজোম সংখ্যা অপরিবর্তিত রাখে। গ্যামেটোজেনেসিস ছাড়া জেনেটিক ভারসাম্যযুক্ত অপত্য জীব সৃষ্টি সম্ভব হতোনা।
২. গ্যামেটোজেনেসিসের সময় মিয়োসিস বিভাজন সংঘটিত হয়। এ সময় ক্রসিং ওভারের মাধ্যমে ভিন্ন ভিন্ন জেনেটিক গঠন বিশিষ্ট জনন কোষ উৎপন্ন হয়, যা জীবজগতে প্রকরণের উদ্ভব ঘটায়।
৩. উওজেনেসিস প্রক্রিয়ায় প্রতিমাসে সাধারণত একটি নিশ্চল ডিম্বাণু সৃষ্টি হয়। অন্যদিকে স্পার্মাটোজেনেসিস প্রক্রিয়ায় প্রতিদিন কোটি কোটি সচল শুক্রাণু উৎপন্ন হয়। এটি নিষেক ঘটার সম্ভাবনাকে নিশ্চিত করে এবং প্রজাতির ধারা অব্যাহত রাখে।
৪. ডিম্বাণুতে সঞ্চিত কুসুম নিষেক পরবর্তী ভ্রূণ বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টির যোগান দেয়।
আরও দেখুন...