মানুষের অন্যতম প্রধান মৌলিক চাহিদা খাদ্য। কৃষি উন্নয়নে যে সব জীবপ্রযুক্তিগত পদ্ধতি ব্যবহৃত হয় নিচে সেগুলোর বর্ণনা দেওয়া হলো ।
১. টিস্যু কালচার (আবাদ) : এ পদ্ধতিতে উদ্ভিদের বর্ধনশীল (meristematic) অঙ্গের ক্ষুদ্র অংশ; যেমন মূল, কাণ্ড, পাতা, অঙ্কুরিত চারার বিভিন্ন অংশ ইত্যাদি নির্ধারিত পুষ্টিমাধ্যমে এবং জীবাণুমুক্ত ও নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে আবাদ করা হয়। এই কালচারের ফলে এসব বর্ধনশীল অঙ্গ থেকে অসংখ্য ক্ষুদ্রচারা উৎপন্ন হয়। এসব ক্ষুদ্রচারার প্রত্যেকে পরে উপযুক্ত পরিবেশে পৃথক পৃথক পূর্ণাঙ্গ উদ্ভিদে পরিণত হয় ।
২. অধিক ফলনশীল উদ্ভিদের জাত সৃষ্টি : কোন বন্য উদ্ভিদের উৎকৃষ্ট জিন ফসলী উদ্ভিদে প্রতিস্থাপন করে কিংবা জিনের গঠন বা বিন্যাসে পরিবর্তন ঘটিয়ে উন্নত জাতের উদ্ভিদ সৃষ্টি করা হয়। এভাবে ধান, গম, তেলবীজ সহ অনেক শস্যের অধিক ফলনশীল উন্নত জাত উদ্ভাবন করা হয়।
৩. গুণগত মান উন্নয়নে : জীবপ্রযুক্তি প্রয়োগ করে প্রাণী ও উদ্ভিদজাত দ্রব্যাদির গঠন, বর্ণ, পুষ্টিগুণ, স্বাদ ইত্যাদির উন্নয়ন করা সম্ভব হয়েছে। যেমন- অস্ট্রেলিয়ায় ভেড়ার লোমকে উন্নতমানের করতে তাদের খাদ্যে ক্লোভার ঘাসে রিকম্বিনেন্ট DNA প্রযুক্তির মাধ্যমে সূর্যমুখীর সালফার অ্যামিনো এসিড সৃষ্টিকারী জিন স্থানান্তর করা হয়েছে। ফলে খাদ্য হিসেবে এই ঘাস খেলেই ভেড়ার লোম উন্নতমানের হচ্ছে, পৃথকভাবে সালফার সমৃদ্ধ খাবার দেয়ার প্রয়োজন হচ্ছে না।
৪. সুপার রাইস সৃষ্টি : সুইডেনের বিজ্ঞানী /Potrykus ও তাঁর সহযোগীরা সুপার রাইস বা গোল্ডেন রাইস নামক এক ধরনের ধান উদ্ভাবন করেছেন। তাঁরা জীবপ্রযুক্তির মাধ্যমে Japonica টাইপ ধানে ড্যাফোডিল উদ্ভিদের বিটা ক্যারোটিন ও আয়রন উৎপাদন জিন প্রতিস্থাপন করে সুপার রাইস উদ্ভাবন করেন। এ ধানের ভাত খেলে শিশুরা ভিটামিন ও আয়রনের অভাবজনিত রোগে আক্রান্ত হবে না। এতে এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার কোটি কোটি শিশু পুষ্টিহীনতা থেকে রক্ষা পাবে।
৫. ভিটামিন সমৃদ্ধ ভূট্টার জাত সৃষ্টি : সম্প্রতি (এপ্রিল, ২০০৯) স্পেনের ইউনিভার্সিটি অব এলইয়েডার গবেষক ড. পল ক্রিস্টো এবং তাঁর সহকর্মীরা জেনেটিক্যালি মডিফাইড M-37W প্রকরণের ভূট্টার বীজ উদ্ভাবন করেছেন যাতে ভিটামিন সি, বিটা ক্যারোটিন ও ফলিক এসিড পাওয়া যাবে। এক শস্যে তিন ধরনের ভিটামিন থাকায় এই ভুট্টা ব্যালেন্স ডায়েটের পাশাপাশি গরীব দেশগুলোর মানুষের অপুষ্টি দূর করবে।
৬. স্টেরাইল ইনসেক্ট টেকনিক : শাক-সব্জি, ফল ও শুটকির ক্ষতিকর পতঙ্গ, মশা ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণে স্টেরাইল ইনসেক্ট টেকনিক (SIT) একটি আধুনিক জীব প্রযুক্তি। পুরুষ পতঙ্গকে রেডিয়েশন দ্বারা বন্ধ্যাকরণ করে এই প্রযুক্তিতে পতঙ্গ নিয়ন্ত্রণ করা হয়। জাপান, ফিলিপিনস, থাইল্যান্ড, গুয়াতেমালা, ব্রাজিল, হাওয়াই প্রভৃতি দেশে এই প্রযুক্তি ব্যাপক প্রচলিত। বাংলাদেশের সাভারে অবস্থিত পরমাণু শক্তি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের Insect Biotechnology Laboratory-র একদল বিজ্ঞানী সব্জির পোকা Bacocera cucurbitae-কে এই প্রযুক্তিতে নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্যাপক গবেষণা করছেন।
৭. দূর সংকরায়ন ও ভ্রূণ উদ্ধার ( Wide hybridization and embryo rescue ) : কাঙ্খিত বৈচিত্র্যের মাত্রা বাড়ানোর আরেক কৌশল হচ্ছে আস্তঃপ্রজাতিক (interspectific) ও আন্তঃগণিক (intergeneric) সংকরায়ন। এর ফলে চাষযোগ্য শস্যে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, ফলনশীলতা ও অভিযোজন ক্ষমতা বেড়েছে।
৮. পুংকেশর ও পরাগ কালচার (Anther and microspore culture): অধুনা দূর সংকরায়ন ও ভ্রণ উদ্ধার এবং পুংকেশর কালচারের মাধ্যমে হ্যাপ্লয়েড উদ্ভিদ সৃষ্টি করা হচ্ছে। এসব পদ্ধতির মধ্যে পুংকেশর কালচারের পদ্ধতিই বেশি ব্যবহৃত হয়। ১৯৬৭, খ্রিস্টাব্দে থেকে গম, বার্লি, ভুট্টা, ধান, রাই, তুলা, আলু, তামাক প্রভৃতি শস্য প্রজাতির হ্যাপ্লয়েড উদ্ভিদ উদ্ভাবনের জন্য ব্যাপক ব্যবহৃত হচ্ছে।
৯. ট্রান্সজেনিক উদ্ভিদ (Transgenic plants) প্রকৌশলের মাধ্যমে জিনের স্থানান্তর ঘটিয়ে যে সব উদ্ভিদ সৃষ্টি করা হয় সেগুলোকে ট্রান্সজেনিক উদ্ভিদ বলে। এ প্রক্রিয়ায় রিকম্বিনেন্ট DNA কৌশল প্রয়োগ করে উৎপন্ন জীবকে হয় কোনো বাহকের মাধ্যমে নয়তো মাইক্রোইঞ্জেকশনের মাধ্যমে উদ্ভিদের প্রোটোপ্লাস্টে প্রবেশ করানো হয়। বর্তমান সময় পর্যন্ত প্রায় ৬০টি উচ্চতর উদ্ভিদ প্রজাতিতে এ প্রক্রিয়ার সফল প্রয়োগ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে তামাক, টম্যাটো, আলু, মিষ্টি আলু, লেটুস, সূর্যমুখী, বাঁধাকপি, তুলা, সয়াবিন, মটর, শসা, গাজর, মূলা, পেঁপে, আঙ্গুর কৃষ্ণচূড়া, গোলাপ, আপেল, নাশপাতি, নিম, ধান, গম, রাই, ভূট্টা প্রভৃতি।
ট্রান্সজেনিক উদ্ভিদ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ও অর্থকরী ফসলকে আগাছানাশক, পতঙ্গ, ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাক প্রতিরোধী করে উৎপাদন করা হচ্ছে। অনেক উদ্ভিদকে উষ্ণতা, শৈত্য, লবণাক্ততা, ভারী ধাতু, ফাইটোহরমোন, নাইট্রোজেন প্রভৃতি মোকাবিলায় সক্ষম করে তোলা হয়েছে। পাকা টমেটোর ত্বক নরম হয়ে যাওয়া প্রতিরোধে কিংবা দেরীতে পাকানো অথবা সুক্রোজের পরিমাণ বাড়িয়ে স্টার্চের পরিমাণ কমিয়ে টম্যাটো উৎপাদন ট্রান্সজেনিক প্রক্রিয়ারই সুফল। আলুতে ২০-৪০% স্টার্চ বাড়ানোও সম্ভব হয়েছে এ প্রক্রিয়ায়।