স্পেনে মুসলিম শাসন (৭১১-১৪৯২)
ভূমিকা
মধ্যযুগে যেসকল স্থানে আরব সভ্যতা গড়ে উঠেছিল এর মধ্যে স্পেন অন্যতম। ৭১১ সালে এ অঞ্চলটি মুসলিম শাসনাধীনে আসে। মুসলিমরা এর নাম দিয়েছিল আন্দালুসিয়া বা আল-আন্দালুস। শুরুতে স্পেন দামেস্কের উমাইয়া খিলাফতের অধীনে একটি প্রদেশ হিসেবে পরিণত হয়। ৭৫৬ সালে আব্দুর রহমান আদ্-দাখিল এখানে একটি স্বাধীন উমাইয়া আমীরাত প্রতিষ্ঠা করেন। ৯২৯ সালে তৃতীয় আব্দুর রহমান এই আমীরাতকে খিলাফতে উন্নীত করেন। ১০৩১ সালে উমাইয়া খিলাফতের অবসানের পর স্পেনে আরব, বার্বার ও স্লাভরা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজবংশের সৃষ্টি করে শাসন করতে থাকে। উত্তরের খ্রিস্টানরা ক্রমাগত আক্রমণ করে যখন ক্ষুদ্র রাজ্যগুলি একে একে গ্রাস করছিল সেসময় উত্তর আফ্রিকার মরক্কো হতে মুরাবিতুন (১০৯১-১১৪৬) রাজবংশ স্পেনের রাজক্ষমতা গ্রহণ করে এবং মরক্কো হতেই স্পেন শাসন করতে থাকে। এরপর মুরাবিতুনদের হটিয়ে মুয়াহিদুন (১১৪৬-১২৪৮) রাজবংশ মরক্কো হতে স্পেন শাসন করে। স্পেনে মুসলিমদের শেষ রাজবংশ ছিল গ্রানাডার নসর বংশ (১২৩২-১৪৯২)। ১৪৯২ সালে এই বংশের পতনের মধ্য দিয়ে স্পেনে মুসলিম শাসনের চির অবসান হয়। পরবর্তী প্রায় ১০০ বছর খ্রিস্টানদের ধর্মান্তকরণ, অত্যাচার, নিপীড়ন, নিষ্পেষণ, বহিস্কার ও হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে মুসলিমদের চূড়ান্ত উচ্ছেদ সম্পন্ন করে। সপ্তদশ শতকের গোড়ার দিকে এই উচ্ছেদ প্রক্রিয়া সমাপ্ত হবার পর সেখানে প্রকাশ্যে কোন মুসলিমের অস্তিত্ব ছিলনা। তবে দীর্ঘ প্রায় ৮০০ বছর শাসন করে মুসলিমরা স্পেনে একটি সমৃদ্ধ সভ্যতার জন্ম দিয়েছিল যা ইউরোপীয় রেনেসা সৃষ্টিতেও বিরাট ভূমিকা রেখেছিল ।
এই ইউনিটের পাঠসমূহ
পাঠ-৯.১ : স্পেনের ভৌগোলিক অবস্থা
পাঠ-৯.২ : মুসলিম বিজয়ের পূর্বে স্পেনের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় অবস্থা পাঠ-
৯.৩ : মুসলিমদের স্পেন বিজয় ও উমাইয়া আমীরাত প্রতিষ্ঠা
পাঠ-৯.৪ : টুরসের যুদ্ধ পাঠ-৯.৫ : প্রথম আব্দুর রহমান
পাঠ-৯.৬ : প্রথম হিশাম
পাঠ-৯.৭ : দ্বিতীয় আব্দুর রহমান
পাঠ-৯.৮ : উমর বিন বিন হাসুন
পাঠ-৯.৯ : তৃতীয় আব্দুর রহমান
পাঠ-৯.১০ : দ্বিতীয় হিশাম ও হাজিব আল মনসুর পাঠ-
৯.১১ : স্পেনে মুসলিম শাসনের অবসান
পাঠ-৯.১২ : শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে স্পেনের মুসলিমদের ভূমিকা
সংযোগ সৃষ্টি করেছে। কিন্তু এই গিরিপথগুলো বছরের প্রায় ছয় মাস তুষার আবৃত থাকে। অন্যান্য পর্বতমালার মধ্যে উত্তর-পশ্চিম দিকের ক্যান্টাব্রিয়ান পর্বতমালা, দক্ষিণের সিয়েরা মরেনো পর্বতমালা, পূর্বদিকের আইবেরিয়ান পর্বতমালা এবং গোয়াদালকুইভির নদী ও ভূমধ্যসাগরের মধ্যভাগে অবস্থিত সিয়েরা নাভাদা পর্বতমালা উল্লেখযোগ্য। সিয়েরা নাভাদা পর্বতমালার মধ্যে অনেক হ্রদ ও হিমবাহের পলি দ্বারা সৃষ্ট গ্রাবরেখা রয়েছে।
যাতায়াত ও যোগাযোগ ব্যবস্থা : মেসেতা মালভূমির সীমানায় অবস্থিত গিরিপথসমূহ, বিভিন্ন উপত্যাকা, নদী ও নদীর অববাহিকা অনুসরণ করে স্পেনের যাতায়াত ও যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। পার্বত্য অঞ্চল হওয়া সত্ত্বেও রোমান এবং আরব শাসনাধীনে স্পেনে চমৎকার যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। রোমানদের তৈরী ৩৪টি রাস্তা ৩৭২টি শহরের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করেছিল। আরব শাসনামলে যোগাযোগ ব্যবস্থার আরও উন্নয়ন হয়েছিল।
নদ-নদী : স্পেনে অনেক নদ-নদী রয়েছে। এগুলোর মধ্যে তাগুস, গোয়াদিয়ানা, গোয়াদালকুইভার ও ডুরো- এ চারটি বৃহত্তর নদী ।
নদী । এছাড়া রয়েছে ইবরো ও মিনহো নদীসহ আরও অনেক ছোট ছোট নদ-নদী। তাগুস স্পেনের সবচেয়ে বড় হ্রদ : স্পেনে অনেক হ্রদ রয়েছে। এগুলোর মধ্যে ভ্যালেন্সিয়ার আল-বুফেরা, মুরসিয়ার মার মেনর, কেডিজের ল্যাগুনা দে- জান্দা অন্যতম। এছাড়া মেসেতা মালভূমিতে কিছু লবন হ্রদ রয়েছে।
জলবায়ু : স্পেনের জলবায়ু বৈচিত্রময়। দেশের এক স্থানের আবহাওয়া অন্য স্থান থেকে পৃথক। শীতকালে আবহাওয়া কোমল, আর্দ্র ও বৃষ্টিবহুল এবং গ্রীষ্মকালে উষ্ণ ও শুষ্ক থাকে। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের আবহাওয়া গরম এবং উত্তরাঞ্চলের আবহাওয়া অত্যাধিক ঠাণ্ডা। গ্যালেসিয়া ও ক্যান্টাব্রিয়া অঞ্চলে অধিক বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে। শীতকালে মেসেতা ঘূর্ণিঝড়ের কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয়।
উৎপাদন ব্যবস্থা : আইবেরীয় উপদ্বীপের প্রায় অর্ধাংশ অনুর্বর পর্বতমালা ও গভীর জঙ্গলে পরিপূর্ণ। দুই-পঞ্চমাংশেরও কম ভূমি কৃষি কাজের উপযোগী। ভূমির বৈচিত্র্যতা, উচ্চতা ও আবহাওয়ার ভিন্নতার কারণে স্বাভাবিকভাবেই উৎপাদন ব্যবস্থায় বৈচিত্র লক্ষ্য করা যায়। দেশের পূর্ব ও দক্ষিণ উপকূলের সমতল ভূমি খুবই উর্বর। এখানে প্রচুর পরিমাণে গম, জলপাই, আঙ্গুর, ধান, কমলালেবু, বাদাম, ডুমুর ইত্যাদি উৎপন্ন হয়। পার্বত্য এলাকাসমূহ বনজ ও খনিজ সম্পদে পরিপূর্ণ। সোনা, রূপা, তামা, লোহা ইত্যাদি প্রধান প্রধান খনিজ সম্পদ। এশিয়া ও ইউরোপের জীব-জন্তু এখানে পাওয়া যায় ।
জনসংখ্যা : স্পেনের সবচেয়ে প্রাচীন অধিবাসী জাতির নাম ‘আইবেরি’ । কালক্রমে এখানে বাস্ক, ফিনিশীয়, গ্রিক, সেল্ট, কার্থেজেনিয়ান ও রোমানরা আগমন করে। রোমানদের হটিয়ে কয়েকটি বর্বর জাতি যথা-এ্যালান, ভ্যান্ডাল, সুয়েভী ও ভিজিগথ্রা এখানে আগমন করে। সবশেষে ভিজিগদের প্রায় ৩শত বছরের (৪০৯-৭১১) শাসনের অবসান ঘটিয়ে মুসলিমরা উপদ্বীপের শাসনক্ষমতা গ্রহণ করে। স্পেনের মুসলিমদেরকে বলা হত মুর। রোমানদের শাসনামলে এখানকার জনসংখ্যা বেশ ঘনবসতিপূর্ণ ছিল। কিন্তু বর্বরদের অধীনে বিশেষ করে ভিজিগদের আমলে জনসংখ্যা বিশেষভাবে হ্রাস পায়। এর কারণ হল ভিজিগথ্রা ইহুদি ও বুদ্ধিজীবিসহ বিভিন্ন সম্প্রদায়, শ্রেণী ও পেশার মানুষদের নানা কারণে হত্যা ও বহিষ্কার করে। মুসলিম আমলে স্পেনের জনসংখ্যা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। দেশের দক্ষিণ ও ভূমধ্যসাগরীয় উপকূলীয় অঞ্চল সবচেয়ে বেশি জনবহুল ছিল। দক্ষিণাঞ্চলের অধিবাসীদের অধিকাংশই ছিল মুসলিম এবং উত্তারাঞ্চলের অধিবাসীদের অধিকাংশই ছিল খ্রিস্টান। খ্রিস্টানরা পুনরায় স্পেন অধিকার করে মুসলিম ও ইহুদিদের বিতাড়ন করে। মুসলিম আমলে কর্ডোভা, গ্রানাডা ও অন্যান্য প্রধান শহরগুলোর জনসংখ্যা বর্তমান সময়ের চেয়েও কয়েকগুণ বেশি ছিল ।
ভৌগোলিক অবস্থার প্রভাব : আইবেরীয় উপদ্বীপের ভৌগোলিক অবস্থা সেখানকার জনজীবন ও ইতিহাসকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছে। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে স্পেন আফ্রিকার সাথে ইউরোপের, প্রাচ্যের সাথে পাশ্চাত্যের এবং আটলান্টিক মহাসাগরের সাথে ভূমধ্যসাগরের যাতায়াত ও ব্যবসা-বাণিজ্যে সুযোগ-সুবিধা লাভ করতে পেরেছে। বৈচিত্র্যময় আবহাওয়া ও বিভিন্ন অঞ্চলের বিচ্ছিন্নতার কারণে এখানকার অধিবাসীরা তাদের আলাদা নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য, আচার-আচরণ ও প্রথা বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে। মেসেতা মালভূমির উচ্চতা, ভূমির অসমতা এবং উচু-নিচু পর্বতমালা সহজ গমনাগমনের জন্য বাধা সৃষ্টি করে এবং যোগাযোগ ব্যবস্থাকে জটিল করে তোলে। ভৌগোলিক বিচ্ছিন্নতার দরুন অধিবাসীদের মধ্যে কেন্দ্রবিমূখ ও আত্মকেন্দ্রিক মানসিকতা গড়ে ওঠে এবং শক্তিশালী শাসক ও সামরিক বাহিনী ছাড়া সমগ্র অঞ্চলের উপর আধিপত্য বজায় রাখা কঠিন ছিল। এ কারণে যখনই কেন্দ্রিয় শাসন দুর্বল হয়ে পড়ে তখনই কেন্দ্ৰ
হতে দূরবর্তী অঞ্চলের উচ্চাভিলাষী ও স্বার্থপর শাসনকর্তা বা গোত্রপ্রধানগণ ভৌগোলিক বিচ্ছিন্নতার সুযোগ গ্রহণ করে বিদ্রোহ ঘোষণা করে এবং স্বাধীন শাসক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা চালায়। স্পেনের সম্পদের প্রাচুর্য আক্রমণকারীদের আকৃষ্ট করেছে এবং সেখানকার স্থানীয় মানুষদের কেন্দ্রবিমূখতা ও আত্মকেন্দ্রিকতা এবং ভৌগোলিক বিচ্ছিন্নতা আক্রমণকারীদের সাফল্য দিয়েছে।
সারসংক্ষেপ:
স্পেন বা আন্দালুসিয়ার দক্ষিণ দিকে রয়েছে জিব্রাল্টার প্রণালী, উত্তর দিকে পিরেনীজ পর্বতমালা, পূর্ব দিকে ভূমধ্যসাগর ও পশ্চিম দিকে আটলান্টিক মহাসাগর। স্পেনের প্রায় আট ভাগের সাত ভাগ সমুেেদ্রর দিকে উম্মুক্ত। পিরেনীজ পর্বতমালা স্পেনকে ফ্রান্স হতে পৃথক করেছে। এর অর্ধেকেরও বেশি জায়গা জুড়ে আছে মেসেতা মালভূমি। তাগুস, গোয়াদিয়ানা ও গোয়াদালকুইভির স্পেনের উল্লেখযোগ্য নদ-নদী। এর জলবায়ু, ভূমি ও উৎপাদন ব্যবস্থায় বৈচিত্র্যতা লক্ষ্য করা যায়। স্পেনের ভৌগোলিক অবস্থা এর জনজীবন ও ইতিহাসের উপর ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে।
পাঠ-৯.২
মুসলিম বিজয়ের পূর্বে স্পেনের রাজনৈতিক, আর্থ-সামাজিক ও ধর্মীয় অবস্থা
উদ্দেশ্য
এ পাঠ শেষে আপনি-
প্রাক্-মুসলিম স্পেনের বিভিন্ন সামাজিক শ্রেণী ও তাদের সামাজিক অবস্থা বর্ণনা করতে পারবেন।
স্পেনের ইহুদীদের উপর ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের অত্যাচারের প্রকৃতি বর্ণনা দিতে পারবেন। মুসলিম বিজয়ের পূর্বে স্পেনের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার বিবরণ দিতে পারবেন।
মুখ্য শব্দ
এ্যালান, ভ্যান্ডাল, সুয়েভী, ভিজিগথ্, রাজা রিকার্ড, ক্যাথলিক ধর্ম, রডারিক, উইতিজা, আচিলা, কাউন্ট জুলিয়ান, মুসা বিন নুসাইর ও ফ্লোরিন্ডা
ভূমিকা : স্পেন ইউরোপ মহাদেশের একটি দেশ। মুসলিমদের আগমনের আগে ভিজিগথ্রা প্রায় তিনশত বৎসর (৪০৯-৭১১) স্পেন শাসন করে। এসময় স্পেনের অবস্থা পূর্ববর্তী রোমানদের থেকে আরও খারাপ হয়ে যায়। ভিজিগথ্ শাসনামলে স্পেনের বিভিন্ন সামাজিক শ্রেণীর মধ্যে চরম বিভাজন তৈরী হয়, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে স্পেন দৈন্যদশায় পতিত হয়, ধর্মীয় ক্ষেত্রে চরম অসহিষ্ণুতা বিরাজ করে এবং রাজনৈতিক অঙ্গণে অস্থিরতা ও অস্থিতিশীলতার সৃষ্টি হয়।
সামাজিক অবস্থা: স্পেনে মুসলিমদের আগমনের পূর্বে সেখানকার সামাজিক অবস্থা খুবই খারাপ ছিল। প্রাক-মুসলিম স্পেনীয় সমাজকে প্রধানত দুই ভাগে ভাগে করা যায়। শাসক শ্রেণী বা উচ্চবিত্ত শ্রেণী ও শাসিত শ্রেণী বা প্রজা শ্ৰেণী । রাজা, ধর্মযাজক এবং অভিজাতদের নিয়ে উচ্চবিত্ত শাসক শ্রেণী গড়ে উঠেছিল। শাসিত শ্রেণী আবার দু'ভাগে বিভক্ত: মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত শ্রেণী। বর্গাদারগণ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। নিম্নবিত্ত শ্রেণীর মধ্যে ছিল ভূমিদাস ও ক্রীতদাস । এছাড়া শিক্ষিত ইহুদী সম্প্রদায়ের লোকেরা শাসিত বা প্রজা শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত ছিল।
উচ্চবিত্ত বা শাসক শ্রেণী : স্পেনের উচ্চবিত্ত বা শাসক শ্রেণী সুবিধাভোগী শ্রেণী হিসেবে পরিচিত ছিল। রাজা, ধর্মযাজক এবং অভিজাতদের নিয়ে গঠিত এই শ্রেণী সব ধরনের করের ভার হতে সম্পূর্ণ মুক্ত ছিল। তারা প্রজা সাধারণের উপর নানারকম অত্যাচার ও নির্যাতন চালাত। রাজা ও ধর্মযাজকদের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা ছিল। তবে ধর্মযাজকদের জনগণের সাথে সরাসরি যোগাযোগ এবং তাদের উপর ব্যাপক প্রভাব থাকায় রাজার উপর ধর্মযাজকদের প্রাধান্য ছিল। যুবরাজ ও সামন্তপ্রভূদের সমন্বয়ে স্পেনের অভিজাত শ্রেণী গড়ে ওঠে। তারা বিলাসী জীবন-যাপন করত। তারা মদ, জুয়া, ঘোড়দৌড় ও ভোজনের মধ্য দিয়ে জীবন পরিচালনা করত। তারা বসবাস করত সুরম্য রাজপ্রাসাদে। প্রজাদের কল্যাণে তাদের কোন মনোযোগ ছিলনা। এক কথায় তারা অসীম ক্ষমতা ও সম্পদ উপভোগ করত ।
নিম্নবিত্ত শ্রেণী : স্পেনের নিম্নবিত্ত শ্রেণীটি ছিল ভূমিদাস ও ক্রীতদাসদের নিয়ে। ভূমিদাসরা ছিল চাষী। তাদের দায়িত্ব ছিল কৃষিকাজের জন্য শ্রমিক ও সেনাবাহিনীর জন্য সৈন্য সরবরাহ করা। তারা ছিল ভূমির অবিচ্ছেদ্য অংশ। জমি বিক্রয় করা মানে হল জমির সাথে সংশ্লিষ্ট ভূমিদাসদেরও বিক্রয় করা। সামান্য ভুল-ত্রুটির জন্য তাদের উপর দৈহিক নির্যাতন চালানো হত। ক্রীতদাসদের অবস্থা ছিল আরও খারাপ। স্পেনীয় সমাজে ক্রীতদাস প্রথা ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল। বাজারে ক্রীতদাস ক্রয়-বিক্রয় হত। তারা কৃষক, মেষপালক, জেলে অথবা সাধারণ কর্মচারি হিসেবে কাজ করত। ভিজিগথ্ শাসনামলে ভূমিদাস ও ক্রীতদাসদের মানবীয় অধিকার সম্পূর্ণভাবে ক্ষুণ্ন করা হয়। প্রতিবেশি দুই জমিদারের দাসদের মধ্যে বিবাহ হলে তাদের সন্তান-সন্তুতি উভয় জমিদার ভাগ-ভাটোয়ারা করে নিত। সমাজের উচ্চবিত্তদের অত্যাচার হতে বাঁচার জন্য তারাও মধ্যবিত্তের ন্যায় বনে-জঙ্গলে আত্মগোপন করে দস্যুতা ও লুটতরাজ শুরু করে।
অর্থনৈতিক অবস্থা : মুসলিম বিজয়ের পূর্বে স্পেনের অর্থনৈতিক অবস্থা ছিল অত্যন্ত শোচনীয়। তখন স্পেনে যথেষ্ট প্রাকৃতিক সম্পদ ছিল। কিন্তু এই সম্পদের অসম বন্টন এবং ইচ্ছামত অর্থের অপচয়ের কারণে স্পেনের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙ্গে গিয়েছিল। উচ্চবিত্ত শ্রেণীকে কোন প্রকার কর প্রদান করতে হতনা। উচ্চবিত্ত শ্রেণীর জাঁকজমক জীবন- যাপনের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের যোগান দিত মধ্যবিত্ত শ্রেণী। মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উপর অতিরিক্ত কর আরোপের ফলে তাদের
ভূমির সাথে সংযুক্ত প্রজা সাধারণকেও করের বোঝা বহন করতে হয়। বৈষম্যমূলক ও অতিরিক্ত কর আরোপের কারণে শিল্পকারখানা এবং ব্যবসা-বাণিজ্য প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। এর ফলে সাধারণ মানুষের উপর নেমে আসে আর্থিক বিপর্যয়। অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা ও রাজপথে দস্যুতা-রাহাজানির কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যেও অচলাবস্থা বিরাজ করছিল।
ধর্মীয় অবস্থা : স্পেনে সে সময় খ্রিস্টান ও ইহুদী -এই দুইটি ধর্ম চালু ছিল। খ্রিস্টানরা রাষ্টীয় ক্ষমতায় থাকার কারণে ইহুদীরা ছিল নির্যাতিত। বিশেষ করে ৫৮৭ খ্রিষ্টব্দে রাজা রিকার্ড ক্ষমতায় এসে ক্যাথলিক ধর্মকে রাষ্টীয় ধর্ম হিসাবে প্রতিষ্ঠা করেন এবং ইহুদীদের উপর অমানুষিক অত্যাচার চালান। তাদের জোরপূর্বক খ্রিস্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত করা হয়। খ্রিস্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত না হলে তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়। তাদেরকে নির্বাসনে পাঠানো হয়। তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য, বিবাহ, ধর্মীয় ও অন্যান্য অনুষ্ঠানাদি নিষিদ্ধ হয়। এমনকি তাদেরকে তাদের পুত্র-কন্যাসহ ক্রীতদাসরূপে বিক্রয় করা হয়। ফলে ইহুদীরা বাঁচার জন্য আশপাশের মুসলিম দেশে আশ্রয় গ্রহণ করতে থাকে ।
রাজনৈতিক অবস্থা : সে সময়ে স্পেনে রাজনৈতিক অস্থিরতা বিরাজ করছিল। সর্বশেষ ভিজিগখ্ শাসক রডারিক পূর্ববর্তী শাসক উইতিজাকে হত্যা করে ক্ষমতায় আসেন এবং স্বৈরাচারী শাসন শুরু করেন। ফলে সেনাবাহিনীর মধ্যে অসন্তুষ্টি দেখা দেয়। অভিজাত সম্প্রদায়ের মধ্যে সিংহাসন অধিকার নিয়ে শুরু হয় প্রাসাদ ষড়যন্ত্র। কেন্দ্রিয় শাসনের দুর্বলতার কারণে প্রাদেশিক ও আঞ্চলিক শাসনকর্তা ও বিদ্রোহী নেতাগণ তাদের স্ব স্ব এলাকায় স্বাধীনতা লাভের সুযোগ খুঁজতে থাকে। এ অবস্থায় মুসলিমগণ স্পেনে অভিযান প্রেরণ করে সহজেই বিজয় লাভ করতে সক্ষম হয়।
সারসংক্ষেপ:
মুসলিম বিজয়ের পূর্বে ভিজিগথ্রা প্রায় তিনশত বৎসর (৪০৯-৭১১) স্পেন শাসন করে। এ সময় স্পেনের সামাজিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক অঙ্গণে অস্থিরতা ও অস্থিতিশীলতার সৃষ্টি হয়। প্রাক-মুসলিম স্পেনীয় সমাজে শাসক ও শাসিত শ্রেণীর মধ্যে বিরাট ব্যবধান ছিল। মুসলিম বিজয়ের পূর্বে স্পেনের অর্থনৈতিক অবস্থা ছিল অত্যন্ত শোচনীয়। ভিজিগথ্রা ক্যাথলিক ধর্মকে রাষ্ট্রীয় ধর্ম হিসাবে প্রতিষ্ঠা করে এবং ইহুদীদের উপর অমানুষিক অত্যাচার চালায়। ভিজিগথ্ শাসক রডারিক পূর্ববর্তী শাসক উইতিজাকে হত্যা করে ক্ষমতায় আসেন এবং স্বৈরাচারী শাসন শুরু করেন।
পাঠ-৯.৩
মুসলিমদের স্পেন বিজয় ও উমাইয়া আমীরাত প্ৰতিষ্ঠা
উদ্দেশ্য
এ পাঠ শেষে আপনি
মুসলিমদের স্পেন বিজয়ের কারণ ব্যাখ্যা করতে পারবেন।
মুসলিমদের স্পেন বিজয়ের ঘটনা বর্ণনা দিতে পারবেন।
মুসলিমদের স্পেন বিজয়ের ফলাফল উল্লেখ করতে পারবেন।
মুখ্য শব্দ
উইতিজা, রডারিক, কাউন্ট জুলিয়ান, ফ্লোরিন্ডা, মুসা বিন নুসাইর, তারিফ বিন মালিক, তারিক বিন-যিয়াদ, জাবালুত তারিক ও ওয়াদী লাক্কোর যুদ্ধ
মুসলিমদের স্পেন বিজয় ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। উমাইয়া খলিফা আল-ওয়ালিদের সময়ে আফ্রিকার শাসনকর্তা মূসা বিন নুসাইর তাঁর সেনাপতি তারিক বিন যিয়াদের মাধ্যমে ৭১১ সালে স্পেন জয় করেন। প্রায় তিনশত বৎসর বর্বর ভিজিগদের দুঃশাসনের (৪০৯-৭১১) পর স্পেন মুসলিম শাসনাধীনে আসে এবং সেখানে উমাইয়া আমীরাত প্রতিষ্ঠা করা হয়।
মুসলিমদের স্পেন বিজয়ের কারণ :
সামাজিক কারণ : স্পেনে মুসলিমদের আগমনের আগে সেখানকার সামাজিক অবস্থা খুবই খারাপ ছিল। প্রাক-মুসলিম স্পেনীয় সমাজ প্রধানত দুই ভাগে বিভক্ত ছিল। শাসক ও প্রজা শ্রেণী। রাজা, ধর্মযাজক এবং অভিজাতদের নিয়ে শাসক শ্রেণী গড়ে উঠেছিল। স্পেনের শাসক শ্রেণী প্রজা-সাধারণের উপর নানারকম অত্যাচার ও নির্যাতন চালাত। তাদের উপর সীমাহীন কর আরোপ করা হত। সাধারণ মানুষ এ অবস্থায় মুসলিমদের ত্রাণকর্তা হিসেবে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল ।
রাজনৈতিক কারণ : সে সময়ে স্পেনে রাজনৈতিক অস্থিরতা বিরাজ করছিল। ভিজিগখ্ শাসক রডারিক পূর্ববর্তী শাসক উইতিজাকে হত্যা করে ক্ষমতায় আসেন এবং স্বৈরাচারী শাসন শুরু করেন। ফলে সেনাবাহিনীর মধ্যে অসন্তুষ্টি ও কেন্দ্রিয় শাসনের দুর্বলতার কারণে প্রাদেশিক ও আঞ্চলিক শাসনকর্তা ও বিদ্রোহী নেতাগণ তাদের স্ব স্ব এলাকায় স্বাধীনতা লাভের সুযোগ খুঁজতে থাকে । ফলে স্পেনে কার্যকরী শাসন ব্যবস্থা বলতে কিছুই ছিলনা। মুসলিমরা এই সুযোগটি গ্রহণ করে।
অর্থনৈতিক কারণ : মুসলিম বিজয়ের পূর্বে স্পেনের অর্থনৈতিক অবস্থা ছিল অত্যন্ত শোচনীয়। শাসক শ্রেণীর ইচ্ছামত অর্থের অপচয়ের কারণে স্পেনের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙ্গে গিয়েছিল। প্রজা সাধারণের উপর অতিরিক্ত কর আরোপের ফলে তাদের জীবনে নেমে আসে আর্থিক বিপর্যয়। এ সময় মুসলিমগণ স্পেন অভিযানে অগ্রসর হলে সাধারণ মানুষ তাদের
স্বাগত জানায়।
ধর্মীয় কারণ : স্পেনে সে সময় কোন ধর্মীয় সহিষ্ণুতা বা উদারতা ছিলনা। ক্ষমতাসীন ক্যাথলিক খ্রিস্টানরা জ্ঞানদীপ্ত ইহুদিদের জোরপূর্বক খ্রিস্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত করে, তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয় এবং নির্বাসনে পাঠানো হয়। তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য, বিবাহ, ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও অন্যান্য অনুষ্ঠানাদি নিষিদ্ধ করা হয়। এমনকি তাদেরকে তাদের পুত্র-কন্যাসহ ক্রীতদাসরূপে বিক্রয় করা হয়। ফলে ইহুদীরা বাঁচার জন্য আশপাশের মুসলিম দেশে আশ্রয় গ্রহণ করতে থাকে। এ সময় মুসলিমরা স্পেনে অভিযান চালালে জনগণ ধর্মীয় আশীর্বাদ হিসাবে তাদেরকে সাদরে গ্রহণ করে ।
সামরিক কারণ : সে সময় স্পেনের সামরিক অবস্থা সুসংগঠিত ছিল না। প্রয়োজনের সময় সৈন্য সংগ্রহ করা হতো । তাছাড়া ক্রীতদাসদেরকে জোরপূর্বক সেনাবাহিনীতে ভর্তি করা হত। ফলে সেনাবাহিনীর সামরিক মান সন্তোষজনক ছিল না। শৃঙ্খলা, দেশপ্রেম এবং ঐক্য তাদের মধ্যে লক্ষ্য করা যায়নি। তাই সংখ্যায় বেশি হলেও রডারিকের লক্ষাধিক সৈন্য মাত্র ১২ হাজার মুসলিম সৈন্যের কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়।
মুসা ও তারিক ও বার্বারদের দক্ষতা : মুসা বিন নুসাইর ছিলেন বিচক্ষণ ও দূরদর্শী মুসলিম বীর। তিনি উত্তর আফ্রিকার সাহসী বার্বারদের নিয়ে তাঁর সেনাবাহিনী গঠন করেন। তিনি মুসলিম বীর তারিক বিন যিয়াদকে সেনাপতি করে স্পেনে পাঠান। এই তারিক বিন যিয়াদ অসাধারণ নৈপূণ্যে স্পেন বিজয়ের দ্বার উম্মুক্ত করেন।
প্রত্যক্ষ কারণ :
কাউন্ট জুলিয়ানের আমন্ত্রণ : মুসলিমদের স্পেন বিজয়ের প্রত্যক্ষ কারণ ছিল কাউন্ট জুলিয়ান কর্তৃক উত্তর আফ্রিকার মুসলিম গভর্নর মুসা বিন নুসাইরকে আমন্ত্রণ। কাউন্ট জুলিয়ান ছিলেন উইতিজার জামাতা এবং উত্তর আফ্রিকার সিউটার গভর্নর। তাঁর মেয়ে ফ্লোরিন্ডাকে প্রথা অনুসারে রাজকীয় চাল-চলন ও রীতি-নীতি শিক্ষা করার জন্য রাজা রডারিকের রাজ দরবারে পাঠানো হয়। পরমা সুন্দরী ফ্লোরিন্ডা রাজা রডারিক কর্তৃক রাজ প্রাসাদে শারীরিকভাবে লাঞ্চিত ও অপমানিত হন। এ ঘটনায় কাউন্ট জুলিয়ান ক্ষুব্ধ হন এবং প্রতিশোধের পথ খুঁজতে থাকেন এবং উত্তর আফ্রিকার মুসলিম গভর্নর মুসা বিন নুসাইরকে স্পেন বিজয়ের জন্য আমন্ত্রণ জানান । কাউন্ট জুলিয়ান স্পেনের যাবতীয় তথ্য ও সহযোগিতা দিয়ে মুসলিমদের স্পেন বিজয়ের পথ সুগম করে দেন ।
স্পেন বিজয়ের ঘটনা
শ্বশুর হত্যা ও কন্যার অপমানের প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য কাউন্ট জুলিয়ান স্পেন আক্রমণের জন্য মুসা বিন নুসাইরকে আমন্ত্রণ জানান । কাউন্ট জুলিয়ানের আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে মুসা ৭১০ খ্রিস্টাব্দে স্পেনের বাস্তব অবস্থা অনুধাবনের জন্য তাঁর একজন ক্রীতদাস তারিফ বিন মালিককে স্পেনে প্রেরণ করেন। তিনি স্পেনের দক্ষিণ উপকূল জরিপ এবং প্রাথমিক পর্যবেক্ষণ করে প্রত্যাবর্তন করেন। তিনি সেখানে বিজয়াভিযান প্রেরণের অনুকূল অবস্থা জানালে মুসা তার অপর একজন সেনাপতি তারিক বিন যিয়াদকে ৭১১ সালে ৭ হাজার সৈন্যসহ স্পেন বিজয়ে প্রেরণ করেন। তারিক বিন যিয়াদ জুলিয়ানের সাহায্যে মোট ১২ হাজার সৈন্যসহ জিব্রাল্টার প্রণালী অতিক্রম করে স্পেনের দক্ষিণ-পূর্বের এক উচ্চ ভূমিতে অবতরণ করেন। তারিকের নামানুসারে উক্ত স্থানের নাম হয় জাবালুত তারিক। ‘জাবাল’ আরবী শব্দ যার অর্থ পাহাড়। ‘জাবালুত তারিক' মানে তারিকের পাহাড় (ইংরেজিতে The rock of Tariq)। বর্তমানে এই স্থানটির পরিবর্তিত নাম জিব্রাল্টার। তারিকের আগমনের সংবাদে রডারিক ১ লক্ষ ২০ হাজার সৈন্য নিয়ে মুসলিম বাহিনীর বিরুদ্ধে অগ্রসর হন। গুয়াডেল্ট নদীর তীরে মেডিনা সিডোনিয়া শহরের নিকটবর্তী ওয়াদী লাক্কো নামক স্থানে উভয় পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ হয়। রডারিকের সৈন্যবাহিনী পরাজিত ও বিধ্বস্ত হয়। রডারিক পলায়নকালে নদী গর্ভে নিমজ্জত হয়ে প্রাণ হারান। তারিক রাজধানী টলেডোসহ কর্ডোভা, মুর্সিয়া, ভ্যালেন্সিয়া, আলমেরিয়া, মালাগা ইত্যাদি অঞ্চল দখল করেন। মুসা এ সংবাদ শুনে আরও ১৮ হাজার সৈন্য নিয়ে স্পেনে আসেন এবং বাকী বিজয় কার্য সম্পাদন করেন।
মুসলিমদের স্পেন বিজয়ের ফলাফল মুসলিমদের স্পেন বিজয়ের ফলে সমাজে সাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়। ধনী-দরিদ্র সমমর্যাদা লাভ করে। উচ্চ শ্রেণী ও ধর্মযাজকদের বিশেষ সুবিধা লোপ পায়। মধ্যবিত্তের করের বোঝা লাঘব করা হয়। দাসদের মুক্ত করা হয়। কৃষক, শ্রমিক, মজুর ও ইহুদী সম্প্রদায় পূর্ববর্তী শাসনের অত্যাচার হতে মুক্ত হয় এবং তারা স্বাধীনভাবে জীবন-যাপন শুরু করে। ফলে সমাজে সামাজিক নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠিত হয়। মুসলিম শাসনামলে বিজয়ী এবং বিজীতদের মধ্যে আন্ত:বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়। এর ফলে সেখানে মিশ্র সংস্কৃতি গড়ে উঠে। মুসলিমদের উদার ও প্রগতিশীল শাসনের কারণে সুষ্ঠু পরিবেশের সৃষ্টি হয় এবং এই সুষ্ঠু পরিবেশ কৃষ্টি ও সভ্যতা বিকাশের পক্ষে সহজ হয়। অল্প দিনের মধ্যে অন্ধকারাচ্ছন্ন স্পেন বিশ্ব সভ্যতা ও সংস্কৃতির কেন্দ্রভূমিতে পরিণত হয়। মুসলিম স্পেনের আলোকোজ্জ্বল সভ্যতার ছোঁয়ায় ইউরোপ আলোকিত হয়। আধুনিক সভ্যতার পেছনেও স্পেনের অবদান অনস্বীকার্য। মুসলিমদের স্পেন বিজয়ের ফলে সেখানে ধর্মীয় ক্ষেত্রে এক নব অধ্যায়ের সূচনা হয়। জনগণ স্বাধীনভাবে নিজ নিজ ধর্ম-কর্ম পালনের অধিকার লাভ করে। মুসলিমগণ অন্য ধর্মমতের প্রতি ছিল অত্যন্ত উদার ও সহনশীল। তাদের ধর্মীয় উদারতা ও সহনশীলতায় মুগ্ধ হয়ে স্পেনবাসী দলে দলে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। আর যারা মুসলিম হয়নি তারাও মুসলিমদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে পড়ে।
পাঠ-৯.৪
টুরসের যুদ্ধ
উদ্দেশ্য
এ পাঠ শেষে আপনি
টুসের যুদ্ধের প্রেক্ষাপট বা কারণ আলোচনা করতে পারবেন।
টুরসের যুদ্ধের ঘটনা ও মুসলিমদের পরাজয়ের কারণ উল্লেখ করতে পারবেন।
টুরসের যুদ্ধের ফলাফল বা তাৎপর্য বিশ্লেষণ করতে পারবেন।
মুখ্য শব্দ
আব্দুর রহমান আল-গাফিকি, চার্লস মার্টেল, একুইটেন, ডিউক ইউডেস, মেরোভিনজিয়ান রাজবংশ, পইটিয়ার্স ও শহীদদের স্মৃতিক্ষেত্র
৭১১ খ্রিস্টাব্দে মুসলিমরা স্পেন বিজয় করে। এরপর থেকে স্পেন দামেস্কের উমাইয়া খিলাফতের অধীনে একটি প্রদেশে পরিণত হয়। ৭১১ থেকে ৭৫৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত স্পেনের উমাইয়া শাসনকে বলা হয় পরাধীন উমাইয়া আমীরাত। এ সময়কালের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হল টুরসের যুদ্ধ। ইসলাম ও ইউরোপের ইতিহাসে এই যুদ্ধের ফলাফল খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।
টুসের যুদ্ধের প্রেক্ষাপট :
আব্দুর রহমান আল গাফিকির শাসনভার লাভ: আব্দুর রহমান আল-গাফিকি ৭৩২ সালে স্পেনের শাসনভার লাভ করেন। ৭২৫ সাল থেকে ৭৩০ সাল পর্যন্ত স্পেনের শাসনব্যবস্থায় সংকটের সৃষ্টি হয়। এ সময় ৬ জন শাসনকর্তা সেনাবাহিনী কর্তৃক নিযুক্ত হন। এ অবস্থায় দামেস্কের উমাইয়া খলিফা হিশাম তাঁকে স্পেনের আমীর হিসেবে নিয়োগ দেন।
অভ্যন্তরীণ বিবাদ দূরীকরণ : আব্দুর রহমান আল-গাফিকি একজন যোগ্য শাসনকর্তা ও সুদক্ষ সেনাপতি ছিলেন। শাসনক্ষমতা লাভ করে তিনি অভ্যন্তরীণ কলহ-বিবাদ দূরীকরণ এবং শাসন ব্যবস্থা পুনর্গঠনের উপর নযর দেন। সে সময় স্পেনের মুসলিমদের মধ্যে গোত্র-কলহে এবং বিশেষ করে দক্ষিণ আরবের হিমারীয় ও উত্তর আরবের মুদারীয়দের এবং আরবদের সাথে বার্বারদের দ্বন্দ্বে স্পেন ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে গিয়েছিল। তিনি তাঁদের মধ্যে ঐক্য স্থাপন করেন। হিমারীয় ও মুদারীয় উভয় গোত্রের মধ্যে তিনি সমানভাবে গ্রহণযোগ্য ছিলেন এবং তারা তাঁকে তাদের নেতারূপে মেনে নেয়।
ঐক্যবদ্ধ হয়। শাসন ব্যবস্থা পুনর্গঠন : দেশের শাসন ও বিচার ব্যবস্থা পুনর্গঠনের জন্য তিনি সমগ্র দেশ সফর করেন। ফলে অতি অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি একজন জনপ্রিয় শাসকে পরিণত হন এবং সমগ্র জাতি তাঁর নেতৃত্বে ইউরোপ জয়ের চেষ্টা : আব্দুর রহমান আল-গাফিকির মূল লক্ষ্য ছিল তারিক বিন যিয়াদ ও মুসা বিন নুসাইরের অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করা। তারিক ও মুসার স্বপ্ন ছিল ফ্রান্স, ইতালি, জার্মানি ও বাইজানটাইন সাম্রাজ্যসহ ইউরোপের বিস্তীর্ণ অঞ্চলকে মুসলিম স্পেনের সাথে একত্রিত করে বিশাল ইসলামী সাম্রাজ্য গড়ে তোলা। ৭২১ সালে স্পেনের গভর্নর আল- সামাহ (৭১৯-২১) পিরেনীজ অতিক্রম করে ফ্রান্সে অভিযান চালান। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তুলুস-এর যুদ্ধে তিনি পরাজিত ও নিহত হন। মুসলিমরা এ পরাজয় ভুলে যায়নি। কিন্তু অভ্যন্তরীণ অবস্থা স্থিতিশীল না থাকার কারণে তারা এর প্রতিশোধ
গ্রহণ করতে পারেনি। ১১ বছর পর আব্দুর রহমান আল-গাফিকির নেতৃত্বে তারা এর সুযোগ পায় । উসমানকে পরাজিত ও হত্যা : দক্ষিণ ফ্রান্সের শাসনকর্তা ও বার্বার নেতা উসমান বিন আবু নিসা এ সময় একুইটেনের স্বাধীন শাসক ডিউক ইউডেসের কন্যাকে বিবাহ করে তার সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আব্দুর রহমান আল-গাফিকির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। আব্দুর রহমান আল-গাফিকি সেনাবাহিনী পাঠিয়ে তাকে পরাজিত ও হত্যা করেন।
ডিউক ইউডেসের বিরুদ্ধে অভিযান : ৭৩২ সালে আব্দুর রহমান আল-গাফিকি ১ লক্ষ সৈন্য নিয়ে পিরেনীজ অতিক্রম করে ফ্রান্সে প্রবেশ করেন। তিনি আর্লেস নগর দখল করেন। এরপর তিনি একুইটেনের শাসক ডিউক ইউডেসকে পরাজিত করে একে একে বার্তিমাস্ক, বুরন্ডি, লিওন, বেসাসকোন এবং দক্ষিণ ফ্রান্সের আরও কয়েকটি শহর দখল করেন।
টুরসের যুদ্ধের ঘটনা
সে সময় ফ্রান্সে মেরোভিনজিয়ান রাজবংশের (৪৯৬-৭৫১) শাসন চলছিল। এ বংশের শেষ দিকে শাসকরা দুর্বল হয়ে পড়ে এবং প্রকৃত ক্ষমতা চলে যায় প্রাসাদের মেয়র বা প্রধানমন্ত্রীর হাতে। তখন রাজা ছিলেন লোথায়ের। তিনি শাসক হিসেবে দুর্বল ছিলেন এবং তার মেয়র ছিলেন চার্লস যিনি প্রকৃত ক্ষমতা ভোগ করতেন। পরে অবশ্য চার্লস রাজা হয়েছিলেন। এদিকে ডিউক ইউডেস তার শত্রু চার্লসের সাথে বিবাদ দূর করে তার সাহায্য কামনা করেন। ৭৩২ সালের অক্টোবর মাসে উত্তর ফ্রান্সের টুস ও পইটিয়ার্সের মধ্যবর্তী সমতল ভূমিতে আব্দুর রহমান আল-গাফিকির বাহিনী এবং চার্লস ও ডিউক ইউডেসের সম্মিলিত বাহিনীর মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়। কয়েকদিন ধরে যুদ্ধ চলে। যুদ্ধে মুসলিমদের জয়লাভ যখন প্রায় নিশ্চিত হয়ে যায় তখন মুসলিম সেনাদের মধ্যে বিশৃংখলা শুরু হয়ে যায়। আব্দুর রহমান আল-গাফিকি তাঁর বাহিনীতে শৃংখলা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। যুদ্ধের দশম দিবসে আব্দুর রহমান আল-গাফিকি তীরবিদ্ধ হয়ে নিহত হন। এরপর মুসলিমরা একজন নতুন সেনাপতি নির্বাচনে ব্যর্থ হয় এবং যুদ্ধে পরাজয় বরণ করে যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করে।
টুরসের যুদ্ধে মুসলিমদের পরাজয়ের কারণ :
টুরসের যুদ্ধে মুসলিমদের পরাজয়ের পেছনে কতগুলো কারণ রয়েছে-
মুসলিম গোয়েন্দাদের ব্যর্থতা : চার্লস ও ইউডেসের মধ্যে সন্ধি সম্পর্কে মুসলিম গোয়েন্দারা কোন তথ্য সংগ্রহ করতে পারেনি। ফলে আব্দুর রহমান আল-গাফিকি খ্রিস্টান সৈন্যদের প্রকৃত শক্তি পরিমাপ করতে পরেননি। তাই এই সন্ধি এবং খ্রিস্টানদের শক্তি সম্পর্কে মুসলিম গোয়েন্দাদের অজ্ঞতা যুদ্ধে মুসলিমদের পরাজয়ের অন্যতম কারণ ।
গোত্রীয় কলহ : যুদ্ধ চলাকালে মুদারীয়, হিমারীয় ও বার্বারদের মধ্যে পুরাতন গোত্রীয় কোন্দল আবার নতুনভাবে শুরু হয়।
আব্দুর রহমান আল-গাফিকি সাময়িকভাবে বিবাদমান গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে ঐক্য সৃষ্টি করলেও তা স্থায়ী হয়নি।
সেনাপতি নির্বাচনে ব্যর্থতা : যুদ্ধের দশম দিবসে আব্দুর রহমান আল-গাফিকির মৃত্যু অবস্থা পাল্টে দেয়। তাঁর মৃত্যুতে মুসলিম বাহিনীর মনোবল ভেঙ্গে যায়। এছাড়া তাঁর মৃত্যুর পর প্রতিনিধি বা সেনাপতি নির্বাচন নিয়ে মুসলিম সেনাদের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়। ফলে সেনাপতি নির্বাচনে ব্যর্থ হয়ে রাতের অন্ধকারে তারা যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করে ।
গনিমতের মাল সংগ্রহে প্রতিযোগিতা : যুদ্ধে জয়লাভ যখন অত্যাসন্ন তখন মুসলিম সৈন্যরা শৃংখলা ভঙ্গ করে গনীমতের
মাল সংগ্রহ করে এবং এই মালের হিফাজতের দিকে দৃষ্টি দেয়। ফলে তারা খ্রিস্টানদের পাল্টা আক্রমণ সম্পর্কে ভাবা ও
এর জন্য নিজেদেরকে সামরিক ও মানসিক দিক দিয়ে যথেষ্ঠ প্রস্তুত করতে পারেনি। গুজব : যুদ্ধ চলাকালে গুজব ওঠে যে খ্রিস্টানরা মুসলিম সেনা ছাউনিতে আক্রমণ করেছে। মুসলিম সেনারা গুজবের যথার্থতা পরীক্ষা না করেই যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করে নিজেদের স্ত্রী-সন্তান ও সম্পদ রক্ষায় তাঁবুতে ফিরে আসে। ফলে মুসলিম বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় এবং খ্রিস্টানদের আক্রমণ ও জয়লাভ সহজ হয়।
টুরসের যুদ্ধের ফলাফল :
টুরসের যুদ্ধ ইতিহাসের চূড়ান্ত যুদ্ধগুলির মধ্যে অন্যতম। টুরসের যুদ্ধে মুসলিমদের পরাজয়ের পর চার্লস আহত মুসলিমদের হত্যা করে মার্টেল (Martel) উপাধি লাভ করেন।‘মার্টেল’ অর্থ হাতুড়ি (hammer)। হাতুড়ি দিয়ে যেভাবে লোহা বা কঠিন পদার্থকে অবদমিত করা হয় তেমনি ভাবে চার্লস মুসলিমদের পরাজিত করে তাদের বিজয়ের ধারা থামিয়ে দিয়েছেন এবং তাদের মর্যাদাকেও অবনমন করেছেন। আরবের বাইরে এই প্রথম কোন যুদ্ধে মুসলিমরা সৈন্য সংখ্যায় বেশি থাকা সত্ত্বেও পরাজিত হল। মুসলিমদের নিকট টুরসের যুদ্ধক্ষেত্র শহীদদের স্মৃতিক্ষেত্র রূপে পরিগণিত। এ যুদ্ধের ফলে খ্রিস্টান ইউরোপে মুসলিমদের প্রবেশ চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়। এই যুদ্ধে চার্লস পরাজয় বরণ করলে সমগ্র ইউরোপের বিপর্যয় ঘটতে পারত। অন্যদিকে P. K. Hitti (গ্রন্থ: History of the Arabs) এর মতে, এ যুদ্ধে আরবরা জয়লাভ করলে গীবন এবং তাঁর পরবর্তী ঐতিহাসিকরা প্যারিসে এবং লন্ডনের যেখানে এখন গির্জা রয়েছে এর পরিবর্তে সেখানে মসজিদ দেখতে
পাঠ-৯.৫
প্রথম আব্দুর রহমান
উদ্দেশ্য
এ পাঠ শেষে আপনি
প্রথম আব্দুর রহমানের পরিচয় ও তাঁর স্পেনে আগমনের প্রেক্ষাপট আলোচনা করতে পারবেন।
স্পেনে স্বাধীন উমাইয়া আমীরাত প্রতিষ্ঠায় তাঁর ভূমিকা জানতে পারবেন ।
স্পেনে স্বাধীন উমাইয়া আমীরাত সুদৃঢ়করণে তাঁর কৃতিত্ব মূল্যায়ন করতে পারবেন।
মুখ্য শব্দ
আদ্-দাখিল, ইউসুফ আল-ফিহরি, মাসারার যুদ্ধ, লোকসার যুদ্ধ, কুরায়েশদের
বাজপাখি, কর্ডোভা মসজিদ, কর্ডোভা বিশ্ববিদ্যালয় ও ‘মুন্যাত আল-রুসাফা’
৭১১ সাল থকে ৭৫৬ সাল পর্যন্ত স্পেনের উমাইয়া শাসনকে দামেস্কের উমাইয়া খিলাফতের অধীনস্ত বা পরাধীন উমাইয়া আমীরাত বলা হয়। ৭৫৬ সালে প্রথম আব্দুর রহমান (৭৫৬-৮৮) এই পরাধীন উমাইয়া আমীরাতকে স্বাধীন উমাইয়া আমীরাতে পরিণত করেন।
প্রথম আব্দুর রহমানের পরিচয় : প্রথম আব্দুর রহমান ছিলেন একজন উমাইয়া রাজপুত্র। তিনি উমাইয়া বংশের দশম খলিফা হিশামের দৌহিত্র ছিলেন। স্পেনের ইতিহাসে তিনি ‘আদ্-দাখিল' নামে পরিচিত। ‘আদ্-দাখিল' শব্দের অর্থ প্রবেশকারী বা সূচনাকারী। তিনি স্পেনে স্বাধীন উমাইয়া আমীরাতের সূচনা করায় অথবা পরাধীন উমাইয়া আমীরাত থেকে তিনি স্বাধীন উমাইয়া আমীরাতের সূচনা করায় তাঁকে এই উপাধি দেয়া হয়। স্পেনের উমাইয়াদের মধ্যে আব্দুর রহমান নামে আরও দুই জন বিখ্যাত শাসক থাকায় ইতিহাসে তিনি প্রথম আব্দুর রহমান নামে পরিচিতি লাভ করেন।
উত্তর আফ্রিকায় আগমন : ৭৫০ সালে জাব নদীর তীরে আব্বাসীয়দের হাতে উমাইয়াদের পতনের পর হিশামের পৌত্র
আব্দুর রহমান তাঁর ক্রীতদাস বদরকে নিয়ে প্যালেস্টাইন ও মিসর অতিক্রম করে উত্তর আফ্রিকায় গমন করেন। উত্তর আফ্রিকা ও স্পেন তখনও আব্বাসীয়দের অধীনতা স্বীকার করেনি। তখন উত্তর আফ্রিকার শাসক ছিলেন আব্দুর রহমান আল-হাবীব আল-ফিহরি এবং স্পেনে তাঁর পুত্র ইউসুফ আল-ফিহরি। আল-ফিহরি এ উমাইয়া উদ্বাস্তু রাজপুত্রকে সাদরে গ্রহণ করেন নি। এমনকি তিনি তাঁকে হত্যারও চেষ্টা করেন। কিন্তু তিনি অল্পের জন্য বেঁচে যান। এরপর তিনি সিউটায় তাঁর মাতুল বার্বার গোত্রের মধ্যে আশ্রয় গ্রহণ করেন। কিন্তু আফ্রিকায় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবেনা ভেবে তিনি স্পেনে গমন ও সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করেন।
স্পেনে আগমন : স্পেনে সে সময় রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ চলছিল যা আব্দুর রহমানের পক্ষে সহায়ক হয়েছিল। আব্দুর রহমান বাস্তব অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য ক্রীতদাস বদরকে গুপ্তচর হিসেবে স্পেনে প্রেরণ করেন। বদর ফিরে এসে সেখানকার অনুকূল অবস্থা বর্ণনা করেন। অন্যদিকে স্পেনের দক্ষিণ আরবীয় বা ইয়ামেনী নেতা আবদুল্লাহ্ ও উবায়দুল্লাহকে আব্দুর রহমান একটি চিঠি দিয়েছিলেন। চিঠি পেয়ে তারা ইয়ামেনীদের ঐক্যবদ্ধ করে আব্দুর রহমানকে একটি নৌকা পাঠিয়ে স্পেনে আগমনের আমন্ত্রণ জানান। আব্দুর রহমান এরকম একটি সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন। তিনি ৭৫৫ সালে আল- মুনেকার বন্দরে অবতরণ করেন। সেখান থেকে এভিরার মাটিতে পদার্পণ করেন। ইয়ামেনীরা তাঁর পতাকাতলে সমবেত হতে থাকে। আব্দুর রহমান প্রথমে কোন প্রতিরোধ ছাড়াই দক্ষিণ দিকের শহরগুলো দখল করলেন। এরপর তিনি কর্ডোভা অভিমূখে যাত্রা করেন।
মাসারার যুদ্ধ ও স্বাধীন উমাইয়া আমীরাত প্রতিষ্ঠা : ৭৫৬ সালে কর্ডোভার মাসারা নামক স্থানে উত্তর আরবীয়দের সাথে আব্দুর রহমানের এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়। মাসারার যুদ্ধে আব্দুর রহমান জয়ী হন এবং কর্ডোভা দখল করেন। ফলে দামেস্কের উমাইয়া সাম্রাজ্যের পতনের ৬ বছর পর স্পেনে উমাইয়া রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হল। Syed Ameer Ali (গ্রন্থ: A Short History of the Saracens) বলেন, “নির্বাসিত, পলায়নপর, ভবঘুরে এবার তাঁর উচ্চাভিলাষের শিখরে পৌঁছে যান।”
এভাবে মাসারার যুদ্ধে জয়লাভ করে তিনি স্পেনে স্বাধীন উমাইয়া আমীরাত প্রতিষ্ঠা করেন।
ইউসুফ ও সুমায়েলের বিদ্রোহ দমন : মাসারার যুদ্ধে পরাজিত হয়ে ইউসুফ টলেডোতে এবং তার সেনাপতি সুমায়েল জায়েনে পালিয়ে যান। পরে ইউসুফ জায়েনে সুমায়েলের সাথে মিলিত হয়ে বিচ্ছিন্ন সেনাবাহিনীকে ঐক্যবদ্ধ করেন। ইউসুফ কর্ডোভা দখল করেন। কিন্তু পরে রাজকীয় বাহিনীর অপ্রতিরোধ্য শক্তির মোকাবেলা করে নিজের ভবিষ্যত নিয়ে শংকিত হয়ে অব্দুর রহমানের সাথে চুক্তি করেন। চুক্তি অনুযায়ী তার দুইপুত্র আবু জায়িদ ও আবুল আসওয়াদ মুহম্মদকে আব্দুর রহমান যামিন হিসেবে রাখেন এবং ইউসুফ ও সুমায়েল নির্বিঘ্নে তাদের সম্পত্তি ভোগ-দখলে রাখেন। এর ফলে দুবছর উভয়ের মধ্যে শান্তি বজায় থাকে। এরপর উভয়ের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি হলে ইউসুফ পালিয়ে মেরিদায় গমন করেন এবং ২০ হাজার সৈন্য নিয়ে আব্দুর রহমানের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করেন। ৭৫৮ সালে লোকসার যুদ্ধে তিনি আব্দুর রহমানের বাহিনীর হাতে পরাজিত ও আহত হন এবং এর এক বছর পর টলেডোতে তার এক শত্রুর দ্বারা নিহত হন। তার পুত্র আবু জায়িদকে হত্যা করা হয়, আবুল আসওয়াদ বহুদিন কারাবাসের পর পালিয়ে রক্ষা পান। সুমায়েল কারারুদ্ধ হন এবং বিষ প্রয়োগে নিহত হন ।
ইয়ামেনীদের বিদ্রোহ দমন : ক্ষমতা লাভের পর আব্দুর রহমানকে বিভিন্ন আরব গোত্রীয় কোন্দল ও ষড়যন্ত্রের মোকাবিলা করতে হয়। ৭৬০ সালে আরজাক বিন নুমান গাচ্ছানি বিদ্রোহ করে সেভিল দখল করেন। রাজকীয় বাহিনী পাঠিয়ে সেভিল উদ্ধার করা হয় এবং আরজাক আত্মসমর্পণ করেন। ইয়ামেনী নেতা ও সেভিলের গভর্নর আবু সাব্বাহ আব্দুর রহমানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করলে ৭৬৬ সালে তিনি ক্ষমতাচ্যূত ও নিহত হন। এতে অন্যান্য ইয়ামেনী নেতাগণ বিদ্রোহী হয়ে অনেক মুদারীয়কে হত্যা করে। ৭৭৪ সালে আমীর তাদের বিদ্রোহ দমন করেন এবং তাদের ২০ হাজার সৈন্য নিহত হয়।
টলেডোর বিদ্রোহ দমন : ৭৬১ সালে টলেডোর প্রাক্তন শাসনকর্তা হিশাম বিন উরউয়াহ্ বিদ্রোহ করেন। তাঁর বিরুদ্ধে কয়েকবার অভিযান প্রেরণ করা হয়। শেষ পর্যন্ত ৭৬৪ সালে তিনি আত্মসমর্পণ করেন এবং তাঁকে কর্ডোভায় এনে ফাঁসি দেয়া হয়।
আব্বাসীয় অভিযান প্রতিহত : আব্দুর রহমান আব্বাসীয় খলিফা আল-মনসুরের নামে খুত্বা পাঠ করলেও পরে তা বন্ধ করে দেন । আল-মনসুর স্পেনকে আব্বাসীয় খিলাফতের বলয়ে নিয়ে আসার জন্য কায়রোওয়ানের আব্বাসীয় গভর্নর আলা বিন মুগীসকে ৭৬৩ সালে স্পেনে পাঠান। আলা বিন মুগীস ৭০০০ বার্বার সৈন্যসহ নিহত হন। তাঁর মস্তক ছিন্ন করে আব্বাসীয় খলিফা আল-মনসুরের নিকট প্রেরণ করা হয়। খলিফা আব্দুর রহমানকে ‘সাকর কুরায়িশ” বা ‘কুরায়িশদের বাজপাখি' (Falcon of the Quraysh) আখ্যা দেন। দ্রুততম সময়ে এবং বুদ্ধিমত্তার সাথে স্পেনে স্বাধীন উমাইয়া আমীরাত প্রতিষ্ঠা করার জন্য তাঁকে বাজপাখির সাথে তুলনা করা হয়। এছাড়া আব্দুর রহমানের বীরত্ব ও দক্ষতায় কিছুটা আতঙ্কবোধ করে আল-মনসুর বলেছিলেন,“আমাদের ও এমন এক শত্রুর মধ্যে একটি সমুদ্র (ভূমধ্যসাগর) সৃষ্টির জন্য আল্লাহকে ধন্যবাদ।”
বার্বার বিদ্রোহ দমন : সান্তাব্রিয়াতে বার্বাররা আবদুল্লাহ্ নামের একজন স্কুল শিক্ষকের নেতৃত্বে বিদ্রোহ করে এবং তাদের এই বিদ্রোহ প্রায় ১০ বছর স্থায়ী হয়। ৭৬৮ সালে তার বিরুদ্ধে একটি অভিযান প্রেরিত হলে তিনি জঙ্গলে আত্মগোপণ করেন এবং ৯ বছর পর অর্থাৎ ৭৭৭ সালে তিনি তার ২জন সহচরের হাতে নিহত হন ।
শার্লিমেনের অভিযান প্রতিহত : আব্দুর রহমান যখন দক্ষিণে বিদ্রোহী আরব ও বার্বারদের দমনে ব্যস্ত তখন উত্তর স্পেনের কতিপয় আরব নেতা ফ্রান্সের রাজা শার্লিমেনের সাথে মিত্রতা স্থাপন করে স্পেন আক্রমণে প্ররোচনা দেয়। ৭৭৭ সালে শার্লিমেন পিরেনীজ অতিক্রম করে স্পেন আক্রমণ করেন এবং উত্তর স্পেনের কয়েকটি প্রদেশের ধ্বংস সাধন করেন। ৭৭৮ সালে তিনি সারাগোসায় আব্দুর রহমানের বাহিনীর কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়ে ফ্রান্সে ফিরে যান ।
আব্দুর রহমানের কৃতিত্ব : আব্দুর রহমান ৭৮৮ সালে ৫৯ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি ৩২ বছর স্পেন শাসনকরে উমাইয়া আমীরাতকে সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি তাঁর রাজ্যকে ছয়টি প্রদেশে বিভক্ত করেন এবং প্রত্যেক প্রদেশের শাসনভার একজন গভর্নরের উপর ন্যস্ত করেন। তিনি একটি উপদেষ্টা পরিষদের পরামর্শক্রমে শাসনব্যবস্থা পরিচালনা করতেন। প্রশাসনের বিভিন্ন পদে যোগ্য ব্যক্তিদের নিয়োগ দিয়ে তিনি সুষ্ঠু শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। মুদ্রা তৈরির জন্য তিনি কর্ডোভায় একটি টাকশাল নির্মাণ করেন। কর্ডোভার বিশ্ববিখ্যাত মসজিদটি তিনিই নির্মাণ করেন। এ মসজিদ সংলগ্ন
একটি মাদ্রাসা নির্মিত হয়, যা পরবর্তীকালে কর্ডোভা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়। তিনি প্রকৃতি-প্রেমিক ছিলেন এবং বাগান তৈরি করার ব্যাপারে তাঁর বিশেষ শখ ছিল । কর্ডোভা নগরীর পশ্চিম দিকে ‘মুন্যাত আল-রুসাফা' নামে একটি বাগান বাড়ি তৈরি করেন এবং পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে বিভিন্ন প্রজাতির গাছ সংগ্রহ করে এখানে রোপণ করেন। এখানে পানি সরবরাহের জন্য একটি জলপ্রণালী নির্মাণ করেন। নগরের জনসাধারণও অবশ্য এই জলাধার থেকে পানি সংগ্রহ করতে পারত। তিনি সুবিচারক ও প্রজাহিতৈষী ছিলেন। তিনি প্রায়শই প্রজাদের অভাব-অভিযোগ ও কর্মচারীদের আচরণ সম্পর্কে খবর সংগ্রহের জন্য বের হতেন। তিনি ছিলেন সংস্কৃতিমনা, সু-সাহিত্যিক ও জ্ঞানী-গুণীজনদের পৃষ্ঠপোষক। তিনি মাঝে মাঝে জ্ঞানী-গুণীদের আমন্ত্রণ জানিয়ে সাহিত্য সভার আয়োজন করতেন। ইয়াহিয়া বিন ইয়াহিয়া, ঈসা বিন দিনার, আবু মুসা হাওয়ারী, সাইদ বিন হাসান, ইবনে কায়েস প্রমূখ মনীষীগণ তাঁর দরবার অলংকৃত করেন।
সারসংক্ষেপ:
খলিফা হিশামের পৌত্র আব্দুর রহমান স্পেনের ইতিহাসে প্রথম আব্দুর রহমান বা আব্দুর রহমান আদ্-দাখিল নামে পরিচিত। আব্বাসীয় খলিফা আল-মনসুর তাঁর নাম দেন ‘কুরায়েশদের বাজপাখি'। ৭৫৬ সালে তিনি স্পেনে স্বাধীন উমাইয়া আমীরাত প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ দমন এবং আব্বাসীয় ও ফ্রান্সের শার্লিমেনের অভিযান প্রতিহত করেন। তিনি ৩২ বছর স্পেন শাসন করে উমাইয়া আমীরাতকে সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করেন।
পাঠ-৯.৬
প্ৰথম হিশাম
উদ্দেশ্য
এ পাঠ শেষে আপনি
প্রথম হিশামের অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ দমন ও অভিযান সম্পর্কে আলোচনা করতে পারবেন;
স্পেনে মালিকী মাযহাব প্রবর্তন বিষয়ে আলোকপাত করতে পারবেন ও প্রথম হিশামের চরিত্র ও কৃতিত্ব মূল্যায়ন করতে পারবেন।
মুখ্য শব্দ
হুলাল, সুলাইমান, আবদুল্লাহ্, মুসা বিন ফরতুনিও, মাতরুহ, নার্বোন, জেরোনা, ডিউক উইলিয়াম, সেপ্টিমানিয়া, মালিকী মাযহাব ও দ্বিতীয় উমর
ভূমিকা
আব্দুর রহমান মৃত্যুর আগে তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র হিশামকে (৮৮৮-৯৬) উত্তরাধিকারী মনোনীত করেন। হিশাম ছিলেন হুলাল নামক একজন স্পেনীয় দাসীর গর্ভজাত সন্তান। আব্দুর রহমানের অন্য দুই পুত্র ছিলেন সুলাইমান ও আবদুল্লাহ্ যারা তাঁর সিরীয় স্ত্রীর গর্ভজাত সন্তান ছিলেন। হিশামের বুদ্ধিমত্তা ও ধার্মিকতার কারণে দাসীর সন্তান হওয়া সত্ত্বেও তাঁকে পরবর্তী আমীর হিসেবে মনোনীত করা হয়। পিতার আমলে তিনি মেরিদার গভর্নর ছিলেন। পিতার মৃত্যুর পর ৭৮৮ সালে ৩২ বছর বয়সে হিশাম নিজেকে স্পেনের আমীর হিসেবে ঘোষণা করেন। তাঁর শাসনামলে নানা ধরনের বিদ্রোহ দেখা দেয় এবং তিনি সবগুলো বিদ্রোহ সফলভাবে মোকাবিলা করেন।
ভাইদের বিদ্রোহ মোকাবিলা : সিংহাসন লাভ করেই তাকে প্রথমেই ভাইদের বিদ্রোহের মোকাবিলা করতে হয়। পিতা আব্দুর রহমানের জীবদ্দশায় হিশামের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতাদ্বয় সুলাইমান ও আবদুল্লাহ্ তাঁর মনোনয়নকে সমর্থন করলেও পিতার মৃত্যুর পর হিশাম শাসনক্ষমতা গ্রহণ করলে তাঁরা বিরুদ্ধাচরণ করতে থাকেন। ৭৮৯/৯০ সালে তাঁরা টলেডোতে মিলিত হয়ে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। আমীর তাঁদের সাথে শান্তি স্থাপনের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। অবশেষে যুদ্ধ হয় এবং সুলাইমান পরাজিত হয়ে মুর্সিয়াতে পলায়ন করেন। আবদুল্লাহ্ও সুলাইমানের পরাজয় এবং কম সৈন্যের কারণে বাধ্য হয়ে হিশামের বশ্যতা স্বীকার করেন। টলেডোর আশেপাশের জায়গা আবদুল্লাহকে জায়গীর দেয়া হয়। সুলায়মান মুর্সিয়াতে যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকেন। ৭৯০/৯১ সালে হিশামের পুত্র মুয়াবিয়া লোরকায় প্রচণ্ড যুদ্ধের পর চাচা সুলাইমানকে পরাজিত করেন। সুলাইমান ক্ষমা প্রার্থনা করলে তাঁকে ক্ষমা করা হয় এবং স্পেন ত্যাগ করার নির্দেশ দেয়া হয়।
পূর্ব স্পেনে বিদ্রোহ : হিশাম যখন ভাইদের সাথে দ্বন্দ্বে ব্যস্ত সেসময় পূর্ব স্পেনে ইয়ামেনীরা বিশৃংখলার সৃষ্টি করে। ৭৮৮ সালে সাইদ বিন হুসাইন বিন ইয়াহিয়া আল-আনসারীর নেতৃত্বে ইয়ামেনীরা তরতোসাতে বিদ্রোহ শুরু করে। এর ফলে বনু কাসী গোত্রের নও-মুসলিম নেতা মুসা বিন ফরতুনিও-এর নেতৃত্বে মুদারীয়গণ ঐক্যবদ্ধ হয় এবং উমাইয়া শাসনের পক্ষে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। সাইদ পরাজিত ও নিহত হন এবং তরতোসা মুসার হস্তগত হয়। এ সময় মাতরুহ নামের একজন নেতার নেতৃত্বে বিদ্রোহীরা বার্সিলোনায় বিদ্রোহ করে এবং মুসার সাথে যুদ্ধে জয়লাভ করে তরতোসা, সারাগোসা, বার্সিলোনা, তারাগোনা ও হুয়েস্কা দখল করে নেয়। ফলে এ সময় স্পেনে উমাইয়া অস্তিত্ব বিপন্ন হতে যাচ্ছিল। হিশাম তাদের দৃঢ় হস্তে দমনের চেষ্টা করেন। ৭৯১ সালে ভ্যালেন্সিয়ার গভর্নর আবু উসমান উবায়দুল্লাহ্ বিন উসমানকে মাতরুহের বিরুদ্ধে প্রেরণ করা হয়। সারাগোসা অবরুদ্ধ হয়। পরে মাতরুহ তাঁর নিজের লোকদের হাতে প্রাণ হারান। ফলে বিদ্রোহীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে ও পরাজিত হয়। মুসা বিন ফরতুনিওকে সারাগোসার গভর্নর নিয়োগ করা হয়।
ফ্রান্স অভিযান : অভ্যন্তরীণ শান্তি প্রতিষ্ঠার পর হিশাম মুসলিমদের পূর্ব শত্রু ও বিদ্রোহে উৎসাহদানকারী উত্তরের খ্রিস্টান নেতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। ৭৯২ সালে আবু উসমানের নেতৃত্বে মুসলিম সেনাবাহিনী দক্ষিণ ফ্রান্সে অগ্রসর হয়। পরে এই সেনাবাহিনী দুভাগে বিভক্ত হয়ে অভিযান করে। একদলের নেতৃত্বে ছিলেন আব্দুল
মালিক বিন আব্দুল ওয়াহিদ এবং আর একদলের নেতৃত্বে ছিলেন আব্দুল করিম বিন আব্দুল ওয়াহিদ। আব্দুল মালিক বিন আব্দুল ওয়াহিদের নেতৃত্বে সেনাবাহিনী নার্বোনে ফ্রাঙ্কদের পরাস্ত করে নার্বোন ও জেরোনা জয় করে। এ সময় ফ্রান্সের রাজা শার্লিমেন ও তাঁর পুত্র লুইস জার্মানী ও ইতালীতে যুদ্ধে ব্যস্ত ছিলেন। তুলুসের ডিউক উইলিয়াম মুসলিমদের বাধা প্রদান করেন এবং পরাজিত হয়ে পলায়ন করেন। মুসলিমরা সেপ্টিমানিয়া অধিকার করে নেয়। অন্যদিকে আব্দুল করিম বিন আব্দুল ওয়াহিদের নেতৃত্বে সেনাবাহিনী গ্যালেসিয়া ও আস্তুরিয়া আক্রমণ করে। আস্তুরিয়ার রাজা প্রথম বারমুডো ও দ্বিতীয় আলফান্সোর সাথে মুসলিম বাহিনীর কয়েকবার মোকাবিলা হয়। শেষ পর্যন্ত মুসলিম বাহিনী তাদের পরাস্ত করে। কিন্তু মুসলিম বাহিনী ফেরার পথে খ্রিস্টানরা আক্রমণ করে এবং এতে মুসলিমরা পরাজিত হয়। ফলে উত্তর স্পেনে খ্রিস্টানরা আধিপত্য ধরে রাখে এবং মুসলিম শাসনের বিরুদ্ধে অশান্তি ও বিশৃংখলা সৃষ্টি করে।
মালিকী মাযহাবের প্রবর্তন : হিশাম ধর্মানুরাগী ছিলেন। তিনি ফুকাহা বা ইসলামী আইন-বেত্তাদের দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। তিনি ছিলেন ইমাম মালিক বিন আনাসের ভক্ত ও শিষ্য। ইমাম মালিক ৭১৫ সালে মদীনায় জন্মগ্রহণ করেন। আব্বাসীয় আমলে শিয়া দাবীদার মুহম্মদ বিন আবদুল্লাহকে সমর্থন করার কারণে আল-মনসুর কর্তৃক তিনি নির্যাতনের শিকার হন। হিশাম তাঁকে স্পেনে আগমন ও বসতি স্থাপন করার অনুরোধ করেন। ইমাম মালিক আব্বাসীয় অত্যাচার সত্ত্বেও এই প্রস্তাবে রাযী হননি। তদুপরি হিশাম মদীনায় ইমাম মালিকের সাহচর্য এবং তাঁর থেকে জ্ঞান লাভ করার জন্য ছাত্রদের উৎসাহিত করতেন। তিনি এ মতবাদ স্পেনে প্রচারের জন্য প্রচেষ্টা চালান। স্পেনে ইমাম মালিকের শিষ্যদের মধ্যে ইয়াহিয়া বিন ইয়াহিয়া ও ঈসা বিন দিনার ছিলেন উল্লেখযোগ্য।
হিশামের চরিত্র ও কৃতিত্ব :
প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা : ৮ বছর শাসন করার পর ৭৯৬ সালে ৪০ বছর বয়সে হিশাম প্রাণত্যাগ করেন। হিশামকে উমাইয়া আমীরাতের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা বলা হয়। তিনি উমাইয়া রাজ্যকে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি তাঁর তিন পুত্র উমায়িদ আল-মালিক, মুয়াবিয়া ও হাকামের সাহায্যে বিদ্রোহীদের মোকাবিলা করতে সমর্থ হন। প্রশাসনিক পদক্ষেপসমূহ : তিনি প্রশাসনিক ব্যক্তিদের অপ্রয়োজনে পরিবর্তন করেন নি এবং পিতার নিযুক্ত উযির ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিজ নিজ পদে বহাল রাখেন। তবে দুর্নীতিপরায়ণ ও অসৎ কর্মচারীদের বরখাস্ত করেন এবং তাদের কখনও পুনঃনিয়োগ দিতেন না। তিনি বেআইনী কর আদায় বন্ধ করে দেন এবং যাকাত ও সাদকাহ্ আদায়ের আদেশ দেন। তিনি সুশিক্ষিত লোকদের বিচারক হিসেবে নিয়োগ দিয়ে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করেন।
জনকল্যাণমূলক কাজ : তিনি ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। তিনি রাস্তাঘাট নির্মাণ করেন এবং গোয়াদালকুইভির নদীর উপর নির্মিত সেতুর সংস্কার সাধন করেন। রাজধানীর সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য একটি সুন্দর ঝর্ণা নির্মাণ করেন। এছাড়া তিনি নতুন নতুন প্রাসাদ নির্মাণ ও পুরাতন সরকারী ভবন সংস্কার করেন। কর্ডোভার মসজিদের সংস্কার ও সম্প্রসারণ করেন। এর ফলে এর দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি পেয়ে হয় ৬০০ ফুট ও প্রস্থ হয় ২৫০ ফুট। ১২০০ বছর পরও এই মসজিদটির সৌন্দর্য ও আকর্ষণীয়তা বজায় রয়েছে। তিনি খাল ও পুকুর খনন করেন। তিনি দরিদ্রদের অর্থ বিতরণ করতেন।
ধার্মিকতা ও ন্যায়পরায়ণতা : চরিত্রের দিক দিয়ে তাঁকে উমাইয়া খলিফা দ্বিতীয় উমরের (উমর বিন আব্দুল আযীয) সাথে তুলনা করা হয়। কারণ তিনি দ্বিতীয় উমরের মতই ধার্মিক ও ন্যায়পরায়ণ ছিলেন। দ্বিতীয় উমরের মত তিনিও তাঁর গোপন প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের অবস্থা দর্শন এবং প্রাদেশিক গভর্নর ও সরকারী কর্মকর্তাদের যোগ্যতা নিরূপণ ও তাদের কাজ-কর্মের খবরাখবর সংগ্রহ করতেন। তাদের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ প্রমাণিত হলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতেন অথবা তাদের চাকুরী হতে বরখাস্ত করতেন। তিনি ধর্মীয় শিক্ষাকে উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করতেন। আরবী শিক্ষার জন্য অনেক বিদ্যালয় নির্মাণ করেন।
কাব্যপ্রীতি : কাব্যের প্রতি তাঁর অনুরাগ ছিল এবং তিনি নিজেও একজন কবি ছিলেন। আমর বিন আলী গাফ্ফার তাঁর দরবারের বিখ্যাত কবি ছিলেন ।
পাঠ-৯.৭
দ্বিতীয় আব্দুর রহমান
উদ্দেশ্য
এ পাঠ শেষে আপনি
দ্বিতীয় আব্দুর রহমানের অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ দমন ও বৈদেশিক সম্পর্কের বর্ণনা দিতে পারবেন;
খ্রিস্টান ধর্মান্ধ আন্দোলন সম্পর্কে অলোকপাত করতে পারবেন ও দ্বিতীয় আব্দুর রহমানের উপর চার ব্যক্তির প্রভাব আলোচনা করতে পারবেন।
মুখ্য শব্দ
আল-আওসাত, ধর্মান্ধ আন্দোলন, মোযারব, ইয়াহিয়া বিন ইয়াহিয়া, যিরীয়াব, নসর ও তারুব
৮২২ সালে পিতা হাকামের (৭৯৬-৮২২) মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র দ্বিতীয় আব্দুর রহমান (৮২২-৫২) পিতৃ- সিংহাসন লাভ করেন। স্পেনের স্বাধীন উমাইয়া আমীরাতে আব্দুর রহমান নামে তিনজন বিখ্যাত শাসকের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। সেজন্য তাঁকে ‘আল-আওসাত’ বা মধ্যবর্তী বলা হয়।
আবদুল্লাহ্ বিদ্রোহ : দ্বিতীয় আব্দুর রহমান ক্ষমতা গ্রহণ করার পর বয়োবৃদ্ধ আবদুল্লাহ্ (প্রথম হিশামের ভাই) তাঞ্জিয়ার হতে সৈন্য সংগ্রহ করে স্পেনে আগমন করেন এবং বিদ্রোহ করে পরাজিত ও বন্দী হন। তাঁর পুত্রদ্বয় আসবাগ ও কাশিম বিদ্রোহী পিতাকে সাহায্য করেননি। পুত্রদ্বয়ের পক্ষ থেকে ক্ষমা প্রার্থনা করা হলে তাঁকে ক্ষমা করে দেয়া হয় এবং তাঁকে মুরসিয়ার গভর্নর নিয়োগ করা হয়। দু'বৎসর পর সেখানে তাঁর মৃত্যু হয়।
তুমির ও মেরিদায় বিদ্রোহ : তাঁর সময় তুমিরে হিমারীয় ও মুদারীয়দের মধ্যে সংঘর্ষ দেখা দেয়। মুদারীয়রা ছিল বেশি অশান্ত। মুদারীয় নেতা আবুল শামাখ মুহম্মদ বিন ইব্রাহিমকে রাজকীয় সেনাবাহিনীতে ভর্তি করা হয় এবং তুদমির-এর রাজধানী লোরকা থেকে মুর্সিয়াতে স্থানান্তর করা হয়। এতে সংঘর্ষের অবসান হয়। মেরিদায় আব্দুল জব্বার ও সুলাইমান বিন মার্তিনের নেতৃত্বে খ্রিস্টান ও ইহুদিরা বিদ্রোহ করে। আমীর তাদের বিদ্রোহ দমন করে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেন। টলেডোতে বিদ্রোহ : টলেডোতে হাশিম নামের এক কর্মকার নও-মুসলিমের নেতৃত্বে খ্রিস্টান, নও-মুসলিম ও ইহুদিরা
বিদ্রোহ করে। ৮২৯ সালে কর্ডোভা থেকে হাশিম পরিবার টলেডোতে আগমন করে এবং লুটতরাজ, আরব-বার্বারদের গৃহ
ধ্বংস, দুর্গ ধ্বংস এবং প্রহরীদের হত্যা করে। ৮৩১ সালে তাঁর বিরুদ্ধে সীমান্তের গভর্নর মুহম্মদ বিন ওয়াসিমকে পাঠিয়ে
তাকে পরাজিত ও হত্যা করা হয়।
খ্রিস্টান শাসকদের সাথে সংঘাত : এ সময় লিওনের প্রধান দ্বিতীয় আলফান্সো মুসলিম সীমান্তে তৎপরতা চালায় এবং উত্তরের অন্যান্য দলপতিরা তাকে অনুসরণ করে। আমীর ৮২৫ সালে আব্দুল করিম বিন মুগিস ও উবায়দুল্লাহকে পাঠিয়ে তাদের পরাজিত করেন এবং চুক্তির মাধ্যমে শান্তি স্থাপন করা হয়। এ চুক্তি দশ বছর পর্যন্ত বলবৎ থাকে। পরবর্তীতে আস্তুরিয়া, গ্যালেসিয়া, আলভা ও ক্যাস্টিলে বিদ্রোহ দেখা দেয় এবং বিদ্রোহীরা পাম্পলোনা ও বার্সিলোনা দখল করে নেয়। পরে আমীর সেনাবাহিনী পাঠিয়ে পাম্পলোনা, বার্সিলোনা, গ্যালিসিয়া, মদীনাতুস সালিম পুনরুদ্ধার করেন।
নরম্যান জলদস্যুদের দমন : ৮৪৪ সালে জার্মান নরম্যানরা ৮টি জাহাজ নিয়ে লুসিতানিয়া, লিসবন ও কেডিজ লুট করে । এরপর সেভিলে আসে এবং লুন্ঠন ও অসংখ্য মানুষকে হত্যা করে । কর্ডোভা থেকে প্রেরিত আমীরের নৌবহর ও সেনাদলের তাড়া খেয়ে তারা আজেসিরাস ও উপকূলীয় অঞ্চলে হানা দেয়। সর্বশেষে তাদের সেখান থেকেও পলায়ন করতে বাধ্য করা হয়। এরপর আমীর একটি শক্তিশালী নৌবহর গড়ে তোলেন। সেভিলে একটি জাহাজ নির্মাণ কারখানা গড়ে তোলা হয় এবং উপকূলীয় শহরগুলো সুরক্ষিত করা হয়।
ধর্মান্ধ আন্দোলন : দ্বিতীয় আব্দুর রহমানের সময় স্পেনের ধর্মান্ধ খ্রিস্টান সম্প্রদায় এক উদ্ভট ও অযৌক্তিক আন্দোলনের
সূত্রপাত করে যা ‘ধর্মান্ধ আন্দোলন' নামে পরিচিত। এই আন্দোলনের কারণ হল :
১. ইসলামের অধিকতর গ্রহণযোগ্যতার ফলে বহু খ্রিস্টান ইসলামে দীক্ষিত হয়। এতে ধর্মান্ধ খ্রিস্টানদের ঈর্ষা জন্মে।
২. আরব সভ্যতা, কৃষ্টি ও সংস্কৃতির প্রতি একদল খ্রিস্টান আকৃষ্ট হয় এবং তারা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ না করেও আরবী ভাষা ব্যবহার, আরবীয় পোশাক-পরিচ্ছদ, আচার-ব্যবহার ইত্যাদিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। এদেরকে বলা হয় ‘মোযারব’। তারা আরবী ভাষা, কৃষ্টি ও সংস্কৃতি সম্পর্কে শিক্ষা লাভ করতে থাকে। এর ফলে ধর্মান্ধ খ্রিস্টানরা খ্রিস্টান ধর্মের ভবিষ্যৎ নিয়ে শংকিত হয়ে পড়ে।
৩. ক্যাথলিক ধর্মের মধ্যে দ্বন্দ্বের কারণে এসময় ইসলামের বিকাশ ঘটতে থাকে। ফলে খ্রিস্টান পাদ্রিরা নিজেদের ধর্মকে শক্তিশালী করার জন্য ইসলামের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালায় ।
৪. স্পেনের খ্রিস্টানরা বরাবরই মুসলিমদের অনুপ্রবেশকারী মনে করে এবং তারা তাদের হারানো রাজ্য পুনরুদ্ধার ও
মুসলিমদের বিতাড়নের জন্য জঘন্য প্রচারণায় লিপ্ত হয়। ধর্মান্ধ খ্রিস্টানরা ইসলামের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালায় এবং নবী মুহম্মদের (স.) বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা করে। তাদের আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয় ইউলোজিয়াস, আলভারো, ফ্লোরা, মেরী, পারফেকটাস, আইজাক, সাঞ্চো, লিওক্রাটিয়া প্রমূখ। দ্বিতীয় আব্দুর রহমান তাদেরকে আন্দোলন হতে নিভৃত করতে খ্রিস্টান ধর্মযাজকদের নিয়ে মহাসম্মেলনের আয়োজন করেন। সম্মেলনে ধর্মান্ধদের অন্য ধর্মের বিরুদ্ধে অপপ্রচার বন্ধের আহ্বান জানালেও তারা তা অমান্য করে আন্দোলন অব্যাহত রাখে। ৮৫০ সালে আমীর তাদের মধ্যে ১১ জন ধর্মান্ধকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত ও বহু সংখ্যককে কারারুদ্ধ করলে আন্দোলন সাময়িকভাবে স্তিমিত হয়। পরে প্রথম মুহম্মদের (৮৫২-৮৬) সময় আন্দোলন আবার চাঙ্গা হয়। ৮৫৯ সালে শীর্ষ নেতাদের ফাঁসি দেয়ার মাধ্যমে এই আন্দোলন বন্ধ হয়।
বৈদেশিক সম্পর্ক : ৮৪০ সালে বাইজানটাইন সম্রাট থিওফিলাস মূল্যবান উপহারসহ কর্ডোভায় একটি প্রতিনিধিদল পাঠান। জবাবে তিনিও কনস্টানটিনোপোলে একটি প্রতিনিধিদল পাঠান। এ সময় নাভারের কাউন্ট ফ্রান্সের অধীনতা থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং একটি শক্তিশালী মিত্রের সন্ধানে কর্ডোভায় একটি প্রতিনিধিদল পাঠান। একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এতে বলা হয় মুসলিমরা কাউন্টকে বহিঃশক্তির আগ্রাসন থেকে রক্ষা করবে এবং নাভারে এর বিনিময়ে পিরেনীজ অতিক্রম করে তাদের ফ্রান্সে আক্রমণে সাহায্য করবে।
চার ব্যক্তির প্রভাব : দ্বিতীয় আব্দুর রহমান তাঁর শাসনকালব্যাপী ৪ জন ব্যক্তি দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। এঁরা হলেন ধর্মতত্ত্ববিদ ইয়াহিয়া বিন ইয়াহিয়া, সঙ্গীতজ্ঞ যিরীয়াব, খোজা নসর ও সুলতানা তারুব। ইয়াহিয়া বিন ইয়াহিয়া প্ৰথম হিশামের সময় ইমাম মালিক বিন আনাসের শিষ্যত্ব গ্রহণ করে স্পেনে মালিকী মাযহাব ও কিতাবুল মুয়াত্তা গ্রন্থের ব্যাপক প্রচার ঘটান। প্রথম হাকামের বিরুদ্ধে ফকীহ ও নও-মুসলিমদের আন্দোলনের নেতৃত্ব দিলেও তাঁর জনপ্রিয়তা হ্রাস পায়নি। দ্বিতীয় আব্দুর রহমানের সময় তিনি অতি বৃদ্ধ হলেও আমীর তাঁকে খুব ভক্তি, শ্রদ্ধা ও সমাদর করতেন এবং দরবারের শ্রেষ্ঠ আসন প্রদান করেন। জনগণ তাঁর মাধ্যমে ফরিয়াদ করলে আমীর তা মঞ্জুর করতেন। পারস্যের অধিবাসী যিরীয়াব প্রথমে আব্বাসীয় দরবারের সঙ্গীতজ্ঞ ছিলেন। ওস্তাদ ইসহাক মওসিলির নির্দেশে বাগদাদ ত্যাগ করে আঘলাবী দরবারে যান। সেখানেও তাঁর স্থান হয়নি। অবশেষে দ্বিতীয় হাকামের আমন্ত্রণে স্পেনে আসেন। কিন্তু তিনি স্পেনে পৌঁছার পূর্বেই হাকামের মৃত্যু ঘটে। দ্বিতীয় আব্দুর রহমান ক্ষমতালাভ করে তাঁকে আন্তরিকভাবে গ্রহণ করেন এবং তাঁর জন্য ভাল বেতন- ভাতার ব্যবস্থা করেন। সঙ্গীতে বিভিন্ন সুর, ছন্দ তৈরী করেন; বীণায় ৫ম তারের সংযোজন করেন; বিভিন্ন যন্ত্র আবিস্কার করেন; এবং স্পেনে সঙ্গীত নিকেতন প্রতিষ্ঠা করেন। সঙ্গীতের পাশাপাশি তিনি অঙ্গসজ্জা, রূপচর্চা, গৃহসজ্জা, ভোজন, পোশাকের ব্যবহার রীতি ইত্যাদি ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনয়নের ব্যাপারেও অবদান রাখেন। অর্থাৎ স্পেনে বিভিন্ন ফ্যাশন ও পারসিক রীতি প্রবর্তন হয় তাঁর মাধ্যমে। ক্রীতদাস খোজা নসর সুলতানা তারুবের প্রিয়পাত্র ছিলেন এবং রাজকার্যে প্রচুর দক্ষতার জন্য তিনি প্রধান সচিব পদ লাভ করেছিলেন। তাঁর উপর আমীর রাজকাজের দায়িত্ব দিয়ে সঙ্গীত আসরে বিনোদন করতেন। কিন্তু সুলতানা তারুব তাঁকে দিয়ে যুবরাজ আবদুল্লাহকে বিষ প্রয়োগে হত্যার চেষ্টা করেন। ষড়যন্ত্র ফাঁস হয়ে গেলে তাঁকে সেই বিষ পাণ করিয়েই হত্যা করা হয়। দ্বিতীয় আব্দুর রহমানের স্ত্রী তারুব ছিলেন অপরূপ সুন্দরী। স্বর্ণালংকারের প্রতি তাঁর বিশেষ লোভ ছিল। আমীর তাঁর সব চাহিদা পূরণ করতেন। কিন্তু পুত্র আবদুল্লাহকে হত্যার ষড়যন্ত্রের পর আমীর তাঁকে অন্য চোখে দেখতেন এবং তাঁর প্রভাব দিনে দিনে কমতে থাকে।
পাঠ-৯.৮
উমর বিন বিন হাসুন
উদ্দেশ্য
এ পাঠ শেষে আপনি-
উমর বিন হানের পরিচয় ও বোবাস্ট্র দুর্গে তাঁর আধিপত্য বিস্তার সম্পর্কে বর্ণনা দিতে পরবেন। মুহম্মদ, মুরি, আবদুল্লাহ্ ও তৃতীয় আব্দুর রহমানের সাথে তাঁর সংঘর্ষের বিবরণ দিতে পারবেন।
তিনি জাতীয়তাবাদী নেতা কিনা সে সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে পারবেন।
মুখ্য শব্দ
বোবাস্ট্র দুর্গ, ইজনাট, প্রথম মুহম্মদ, হাশিম, মুরি, আবদুল্লাহ্, পলির যুদ্ধ, স্যামুয়েল ও টোলক্স দুর্গ
আমীর মুহম্মদের শাসনামলে (৮৫২-৮৬) স্পেনের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে বোবাস্ট্র পর্বতের পাদদেশে উমর বিন হাসুন নামে এক বিদ্রোহী নেতার নাটকীয় উত্থান ঘটে। স্পেনের ইতিহাসে উমর বিন হান একজন বিতর্কিত ব্যক্তি। মুসলিমদের নিকট তিনি একজন ধর্মদ্রোহী বিদ্রোহী নেতা হলেও স্বজাতির অনেকের নিকট তিনি জাতীয়তাবাদী নেতা হিসেবে বিবেচিত। মুহম্মদ, মুরি, আবদুল্লাহ্ ও তৃতীয় আব্দুর রহমান- এ চারজন আমীরের বিরুদ্ধে তিনি ক্রমাগতভাবে যুদ্ধ চালিয়ে যান।
উমর বিন হানের পরিচয় ও বোবাস্ট্র দুর্গে আধিপত্য বিস্তার : উমর বিন হাসুন ৮৬০ সালে রোন্দার নিকটবর্তী ইজনাটে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম হাফ্স্ বিন উমর বিন জাফর আল-ইসলামী। হাসুন একজন সম্ভ্রান্ত বংশীয় লোক হলেও তাঁর পুত্র উমর ছিলেন উগ্র মেজাযী এবং দস্যু প্রকৃতির। ফলে তিনি পিতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত হন এবং পর্বতের পাদদেশে গহীন অরণ্যের মধ্যে দস্যুদের সাথে মিলিত হয়ে দস্যু জীবন শুরু করেন। উমর একবার একজন স্থানীয় সরকারী কর্মচারীকে হত্যা করে পিতার সাথে বোবাস্ট্র পর্বতের পাদদেশে অবস্থিত সেরেনিয়া ডে রোন্দায় পলায়ন করেন। তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরওয়ানা জারী করা হলে তিনি উত্তর আফ্রিকায় পলায়ন করেন। ৮৮০ সালে তিনি বোবাস্ট্রতে ফিরে আসেন। চাচা মুজাহিরের সহযোগিতায় ৪০ জনের একটি ডাকাত দল গঠন করে বোবাস্ট্র দুর্গে বসবাস শুরু করেন। বহু মোযারব ও নও-মুসলিম তাঁর দলে যোগদান করে এবং তিনি তাদের নিয়ে একটি শক্তিশালী সেনাবাহিনী গঠনে আত্মনিয়োগ করেন। ধীরে ধীরে নগরের বিদ্রোহীরাও তার দলে যোগদান করে। তিনি বোবাস্ট্র দুর্গের পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন গ্রামের উপর আধিপত্য বিস্তার করতে থাকেন।
প্রথম মুহম্মদের সাথে সংঘর্ষ : প্রথম মুহম্মদ (৮৫২-৮৮৬) উমরের বিরুদ্ধে দুটি অভিযান প্রেরণ করেন এবং অভিযান দুটি উমর কর্তৃক পরাজিত হয়। এরপর মুহম্মদের প্রধানমন্ত্রী হাশিম তাঁকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করেন। তবে উমরের বীরত্বে মুগ্ধ হয়ে হাশিম তাকে ৮৮৩ সালে রাজকীয় সেনা অফিসার হিসেবে নিয়োগ দান করেন। সেনা অফিসার হিসেবে নিয়োগের পর তিনি একাধিক যুদ্ধে কৃতিত্বের পরিচয় দেন। সৈন্যদের জন্য অত্যন্ত নিম্নমানের খাবার সরবরাহ করার কারণে কর্ডোভার নগর-প্রধান মুহম্মদ বিন ওয়ালিদের সাথে তাঁর মনোমালিন্য হয় এবং প্রধানমন্ত্রী হাশিমের কাছে এ বিষয়ে তিনি অভিযোগ করেন। কিন্তু কোন প্রতিকার না পেয়ে রাগান্বিত হয়ে ৮৮৪ সালে মুহম্মদের সেনাবাহিনী ত্যাগ করেন এবং বোবাস্ট্রতে গিয়ে তাঁর দুর্গ সুরক্ষিত করে প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য মুহম্মদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করতে থাকেন। নও- মুসলিমদের ভাগ্য পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে তার দলের লোকসংখ্যা বৃদ্ধি করতে থাকেন এবং জায়েন ও আশেপাশের অঞ্চলগুলিতে দস্যুবৃত্তি অব্যাহত রাখেন। আমীর তাঁর বিরুদ্ধে জায়িদ বিন কাসিমকে প্রেরণ করেন। উমর রাজকীয় বাহিনীকে মোকাবিলা না করে ক্ষমা প্রার্থনা করেন এবং করদানে স্বীকৃত হন। তাঁকে ক্ষমা প্রদর্শন করা হয়। কিন্তু বিশ্বাসঘাতকতা করে তিনি রাতে হঠাৎ রাজকীয় বাহিনীর উপর আক্রমণ করে সেনাপতি জায়িদকে হত্যা করেন। ৮৮৬ সালে যুবরাজ মুযির আল-হামা দুর্গে উমরের এক সহযোগী বিদ্রোহীকে পরাজিত করে তার মস্তক রাজধানীতে প্রেরণ
করেন। উমরও এ যুদ্ধে অংশ নেন এবং আহত অবস্থায় পলায়ন করেন। ঠিক এ সময়ে পিতার মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে মুরি রাজধানীতে প্রত্যাবর্তন করেন।
মুনিরের সাথে সংঘর্ষ : আমীর মুরি (৮৮৬-৮৮) রাজধানীতে প্রত্যাবর্তন করলে উমর নিজের অবস্থা সুরক্ষিত করতে সময় ও সুযোগ পান। তিনি সারাগোসা, হিউয়েসকা ও টলেডোতে তাঁর রাজ্য বিস্তৃত করেন। মুন্নির প্রথমে উমরের সহযোগী আর্চিদোনা দুর্গের অধিপতি নও-মুসলিম আইসুনের বিরুদ্ধে ৮৮৮ সালে অভিযান প্রেরণ করেন। আমীর সহজেই দুর্গটি দখল করেন । আর্চিদোনা দখলের পর তিনি বোবাস্ট্র দুর্গ অবরোধ করেন। উমর উপয়ান্তর না দেখে কয়েকটি শর্তে বশ্যতা স্বীকার করেন: ১. তিনি বোবাস্ট্র ত্যাগ করে কর্ডোভাতে বসবাস করবেন, ২. রাজকীয় বাহিনীতে যোগ দেবেন, ৩. তাঁর পুত্রগণ আমীরের নিকট যামিন হিসেবে থাকবে এবং ৪. তাঁর আসবাবপত্র বহনের জন্য আমীর ১০০ খচ্চর প্রেরণ করবেন। আমীর তাঁর কথায় বিশ্বাস করে ১০০ খচ্চর বোবাস্ট্রতে প্রেরণ করেন। কিন্তু উমর রাতের অন্ধকারে আমীরের তাঁবু হতে পলায়ন করে নিজের আস্তানায় চলে আসেন এবং দলবল নিয়ে ১০০ খচ্চর হস্তগত করেন। মুযির প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য যুদ্ধে অবতীর্ণ হন এবং বোবাস্ট্র দুর্গ অবরোধ করেন। কিন্তু ভাই আবদুল্লাহ্র প্ররোচনায় চিকিৎসকের বিষপ্রয়োগে তিনি নিহত হন। ফলে উমরকে পরাস্ত করা এবারও সম্ভব হয়নি।
আবদুল্লাহ্র সাথে সংঘর্ষ : মুরের পর আবদুল্লাহ্র শাসনামলে (৮৮৮-৯১২) রাজ্যব্যাপী গোলযোগের সুযোগে উমর বোবাস্ট্রো দুর্গ সুরক্ষিত করে পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে প্রভাব বৃদ্ধি করতে থাকেন। তিনি উমরকে পরাস্ত করতে না পেরে তাঁর সাথে একটি চুক্তি করেন। সেখানে উল্লেখ থাকে যে উমর তাঁর অধিকৃত এলাকায় আমীরের প্রতিনিধি হিসেবে শাসন করবেন। কিন্তু উমরের অনুচররা এই নিয়মতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ শাসনে বিশ্বাসী ছিলনা। কারণ তারা লুণ্ঠনবৃত্তিকে পেশা হিসেবে গ্রহন করেছিল এবং এজন্যই উমরের প্রতি তাদের আনুগত্য ছিল। এ সময় আমীর অভ্যন্তরীণ সংকট নিরসণে বিশেষ করে আরব নেতাদের দমনে উমরের সাহায্য কামনা করেন। ফলে উমর রাজকীয় বাহিনীতে যোগদান করেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল নিজকে শক্তিশালী করা এবং রাজকীয় বাহিনীকে পঙ্গু করা। তিনি জায়েনের শাসনকর্তা ইবনে মুসতানার সাথে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন এবং কর্ডোভার খ্রিস্টানদের সমর্থনে গোয়াদালকুইভার নদীর দক্ষিণ দিকে প্রভাব বৃদ্ধি করেন। এমনকি তাদের সহযোগিতায় তিনি কর্ডোভাতেও প্রভাব বিস্তার শুরু করেন। আমীর তাঁর সেনাপতি আব্দুল মালিককে উমরের বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন এবং ৮৯১ সালে পোলির যুদ্ধে তাঁকে পরাজিত করেন। এরপর পোলি দখল করেন এবং বোবাস্ট্র অবরোধ করেন। কিন্তু রণক্লান্ত সৈন্যরা অধিককাল রণাঙ্গণে থাকতে সম্মত না হওয়ায় বোবাস্ট্র অধিকার সম্পন্ন না করেই রাজধানীতে প্রত্যাবর্তন করে। এরপর উমর পোলি, এছিজা, আর্চিদোনা, এলভিরা, গ্রানাডা ও জায়েন দখল করেন। ক্রমাগত যুদ্ধ সাফল্যে উমর গর্বিত হয়ে ওঠেন এবং ৮৯৯ সালে ইসলাম-ধর্ম ত্যাগ করে স্যামুয়েল নাম নিয়ে খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করেন। উদ্দেশ্য ছিল খ্রিস্টান নরপতিদের সাহায্য ও সমর্থন লাভ করা। কিন্তু খ্রিস্টানগণ তাঁকে বিশ্বাস করতে পারেনি। মুসলিমরাও তাঁর পক্ষ ত্যাগ করে। ৯১০ সালে তিনি উত্তর আফ্রিকার ফাতিমিদের সাথে মিত্রতা স্থাপন করেন।
তৃতীয় আব্দুর রহমানের সাথে সংঘর্ষ : উমর বিন হাসুন খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করার ফলে তাঁর জনপ্রিয়তা ব্যাপকভাবে হ্রাস পায় এবং তাঁর পার্বত্য দুর্গ ধীরে ধীরে আব্দুর রহমানের হস্তগত হতে শুরু করে। ফাতিমিদের সাথে তাঁর মিত্রতা তৃতীয় আব্দুর রহমানের (৯১২-৬১) রাজ্যে হুমকির সৃষ্টি করেছিল। আমীর গোয়দালকুইভার নদীর তীরে টোলক্স দুর্গে তাঁকে চূড়ান্তভাবে পরাজিত করেন এবং ৯১৭ সালে উমর মৃত্যুবরণ করেন। উমরের পুত্রগণ বোবাস্ট্রতে আরও কিছুকাল আধিপত্য বজায় রাখলেও ৯২৮ সালে চূড়ান্তভাবে এর পতন হয় ।
জাতীয়তাবাদের অগ্রনায়ক : মুসলিমদের কাছে উমর বিন হাসুন বিদ্রোহী হলেও খ্রিস্টানদের অনেকের কাছে তিনি জাতীয়তাবাদের অগ্রনায়ক ছিলেন। খ্রিস্টান-ধর্ম গ্রহণ করার পর স্পেনবাসী খ্রিস্টানরা তাঁর নেতৃত্বে তাদের হারানো রাজ্য ও কর্তৃত্ব ফিরে পেতে চেয়েছিল। অনেক খ্রিস্টান জাতীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে তাঁর দলে যোগদান করে। এ দিক থেকে বিচার করে অনেকে তাঁকে স্পেনের খ্রিস্টান জাতীয়তাবাদের অগ্রনায়ক বলতে চেয়েছেন। তবে সার্বিক বিচারে তাঁকে জাতীয়তাবাদী বলা যায়না। উমর বিন হাসুন ধর্মান্তরিত হবার কারণে তাঁর মধ্যে সঠিক কোন জাতীয়তাবোধ ছিল না। প্রথমত তিনি ছিলেন মুসলিম। তাই মুসলিম হয়ে মুসলিম রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে জাতীয়তাবাদী হবার প্রশ্ন অবান্তর। পরে তিনি খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করলেও তা ছিল রাজনৈতিক উদ্দেশ্য-প্রণোদিত। খ্রিস্টানরাও তাঁর উপর বিশ্বাস স্থাপন করতে পারেনি। ফলে কোন সম্প্রদায়েরই আন্তরিক বিশ্বাস ও সমর্থন তিনি লাভ করতে পারেননি। এছাড়া তাঁর প্রভাবাধীন এলাকা
কখনই রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি পায়নি। তাই তিনি কারও কারও নিকট জাতীয়তাবাদী হলেও অনেকের নিকট একজন বিদ্রোহী বা দুর্বৃত্ত হিসেবে পরিচিত।
উমর বিন হাসুন প্রায় অর্ধ-শতাব্দীকাল ধরে বিদ্রোহ, লুটতরাজ, লুণ্ঠন, দুর্বৃত্তপনার মাধ্যমে বোবাস্ট্রতে রাজ্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করলেও তা সফল হয়নি। আমীর তথা সেনাবাহিনীর দুর্বলতা, ভৌগোলিক প্রতিকূলতা এবং উমর বিন হানের ধূর্তামি তাঁর দীর্ঘদিন ধরে টিকে থাকার কারণ। তবে উমর বিন হাসুন রাজ্য প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হলেও তাঁর বিদ্রোহ সে সময়ে মুসলিম স্পেনের সংহতি অর্জনের ক্ষেত্রে একটি বিরাট অন্তরায় সৃষ্টি করেছিল।
সারসংক্ষেপ :
স্পেনের ইতিহাসে উমর বিন হান একজন বিতর্কিত ব্যক্তিত্ব। তিনি দক্ষিণ স্পেনের বোবাস্ট্রতে তাঁর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে মুহম্মদ, মুরি, আবদুল্লাহ্ ও তৃতীয় আব্দুর রহমান- এ চারজন আমীরের বিরুদ্ধে ক্রমাগতভাবে যুদ্ধ চালিয়ে যান। তিনি ইসলাম-ধর্ম ত্যাগ করে স্যামুয়েল নাম নিয়ে খ্রিস্টান-ধর্ম গ্রহণ করেন। তৃতীয় আব্দুর রহমান গোয়দালকুইভার নদীর তীরে টোলক্স দুর্গে তাঁকে চূড়ান্তভাবে পরাজিত করেন।
পাঠ-৯.৯
তৃতীয় আব্দুর রহমান
উদ্দেশ্য
এ পাঠ শেষে আপনি
তৃতীয় আব্দুর রহমানের পরিচয়, তাঁর অভ্যন্তরীণ নীতি ও বিদ্রোহ দমনের বর্ণনা দিতে পারবেন। তাঁর বৈদেশিক নীতি এবং খ্রিস্টান ও ফাতিমিদের সাথে সংঘর্ষের বিবরণ দিতে পারবেন ।
জনকল্যাণে ও রাষ্ট্রের উন্নতিতে তাঁর বিভিন্ন অবদান উল্লেখ করতে পারবেন ।
মুখ্য শব্দ
স্পেনের মুসলিম সাম্রাজ্যের ত্রাণকর্তা, বোবাস্ট্রের পতন, খলিফা ও আমীর-উল- মুমিনীন উপাধি গ্রহণ, কর্ডোভা বিশ্ববিদ্যাল ও আল-যাত্রা প্রাসাদ পিতামহ আবদুল্লাহ্র মৃত্যুর পর আব্দুর রহমান আল-নাসির ৯১২ সালে ২২ বছর বয়সে স্পেনের সিংহাসন লাভ করেন। স্পেনের ইতিহাসে তিনি তৃতীয় আব্দুর রহমান নামে পরিচিত। তিনি যখন সিংহাসন লাভ করেন তখন স্পেনে যুদ্ধ-বিগ্রহ, কলহ ও বিশৃংখলার কারণে কোন নিরাপত্তা ছিলনা। তিনি প্রায় ৪৯ বছর শাসনকালে (৯১২-৬১) স্বীয় প্রতিভাবলে সর্বপ্রকার বিশৃংখলা দূর করে স্পেনকে সমৃদ্ধির পথে নিয়ে যান। এজন্য তাঁকে স্পেনের মুসলিম সাম্রাজ্যের ত্রাণকর্তা (Saviour of Spain) বলা হয়। Reinhert Dozy (গ্রন্থ: The Spanish Islam) বলেন, æOf all the Umayyad princes who reigned in Spain Abd al-Rahman III was undoubtedly the greatest."
তৃতীয় আব্দুর রহমানের নীতি : সিংহাসন লাভ করার পর তিনি কতগুলো নতুন নীতি গ্রহণ করেন। যেমন: বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ, আরব আভিজাত্য খর্ব করার জন্য বিদেশীদের সেনাবাহিনীতে নিয়োগ, বিদ্রোহী নেতা ও সর্দারদের আনুগত্য স্বীকারে বাধ্য করার জন্য যুদ্ধ ঘোষণা এবং উত্তর ও দক্ষিণের সীমান্ত সংরক্ষণ ।
অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ দমন : তিনি হাজ্জাজ বংশের মুহম্মদ ও তার ভাতিজা আহমদ বিন মাসলামাহকে পরাজিত করে
সেভিল ও কারমোনায় কর্ডোভার শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি গোয়াদালকুইভার নদীর তীরে টোলক্স দুর্গে বোবাস্ট্রের অধিপতি উমর বিন হাসুনকে পরাজিত করে দুর্গটি দখল করেন। ৯১৭ সালে উমর বিন হানের মৃত্যু হয়। এরপর কিছুকাল বোবাস্ট্র তাঁর পুত্রদের অধীনে থাকলেও ৯২৮ সালে পুরোপুরিভাবে এর পতন ঘটে। তিনি তুদমির, মেরিদা, বেজা, জায়েন ও এভিরার বিশৃংখলা দূর করে শান্তি স্থাপন করেন। টলেডোর বনু কাসী, বার্বার, নও-মুসলিম ও স্পেনীয়রা তাঁর অধীনতা অস্বীকার করলে টলেডো অবরোধ করা হয় এবং দীর্ঘদিন অবরোধের পর টলেডো তাঁর অধীনে আসে ।
খ্রিস্টানদের সাথে সংঘর্ষ : ৯১৪ সালে লিওনের রাজা দ্বিতীয় ওরডোনা মেরিদা আক্রমণ করলে আব্দুর রহমান তাঁকে পরাস্ত করেন। পরাজিত হয়ে তিনি নাভারের রাজা সাঞ্চোর সাথে মিলিত হয়ে মুসলিম রাজ্যে আক্রমণ চালালে ৯২০ সালে তিনি তাঁদেরকেও পরাজিত করেন। ৯২৪ সালে সাঞ্চোর রাজধানী পাম্পলোনা তাঁর অধিকারে আসে। ৯২৫ সালে ওরডোনার মৃত্যুর তাঁর পুত্র দ্বিতীয় রামিরো লিওনের সিংহাসন লাভ করেন। সারাগোসার মুসলিম গভর্নরের সাথে তিনি ষড়যন্ত্র করে আব্দুর রহমানের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করলে তিনি বিদ্রোহী গভর্নরকে কঠোর শাস্তি প্রদান করেন। ৯৫০ সালে দ্বিতীয় রামিরোর পুত্র তৃতীয় ওরডোনা মুসলিমদের দ্বারা অক্রান্ত হয়ে তৃতীয় আব্দুর রহমানের সাথে সন্ধি স্থাপন করেন। ৯৬০ সালে সাঞ্চো খলিফার সাথে মিত্রতা স্থাপন করে লিওনের রাজা চতুর্থ ওরডোনাকে পরাস্ত করেন এবং খলিফার প্রতি আনুগত্য স্বীকার করে লিওন ও নাভারেতে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। ফলে লিওন ও নাভারে তাঁর করদ-রাজ্যে পরিণত হয়।
ফাতিমিদের সাথে সংঘর্ষ : ফাতিমি খলিফা উবায়দুল্লাহ্ আল-মাহ্দী উমর বিন হানের সাথে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে স্পেন আক্রমণের পরিকল্পনা করেন। উবায়দুল্লাহ্ আল-মাহ্দী স্পেনে ফাতিমি মতবাদ প্রচারের লক্ষ্যে একদল দক্ষ গুপ্তচর ও প্রচারক প্রেরণ করেন। তৃতীয় আব্দুর রহমান এ অবস্থা মোকাবিলায় ৯৩১ সালে সিউটা দখল করেন এবং উত্তর আফ্রিকার
নেতৃস্থানীয় বার্বার জানাতা গোত্র, শিয়া ইদ্রিসীয় এবং ইবাদিয়া খারিজি নেতাদের সাথে মিত্রতা স্থাপন করে ফাতিমিদের প্রতিরোধের চেষ্টা করেন। ৯৫২ সালে ফাতিমি খলিফা আল-মুইয স্পেনের উমাইয়া মিত্রদের উত্তর আফ্রিকা হতে বিতাড়িত করেন। ৯৫৫ সালে তৃতীয় আব্দুর রহমানের আলেকজান্দ্রিয়াগামী একটি বাণিজ্য জাহাজ আল-মুইযের মাহ্দীয়াগামী একটি সিসিলিয় জাহাজকে বিধ্বস্ত করে। আল-মুইযও সিসিলির শাসনকর্তা হাসান বিন আলীর মাধ্যমে স্পেনের উপকূল আক্ৰমণ করেন, আলমেরিয়া বিধ্বস্ত করেন এবং অনেক স্পেনীয় জাহাজ দখল করেন । প্রত্যুত্তরে খলিফা তৃতীয় আব্দুর রহমানও গালিব ও আহম্মদ বিন ইয়ালার মাধ্যমে আফ্রিকার উপকূলে দুবার অভিযান চালান ।
বৈদেশিক নীতি : তিনি একজন অমায়িক, ন্যায়পরায়ন, প্রজাহিতৈষী, নম্র ও উদার শাসক ছিলেন বলে তাঁর খ্যাতি দেশ- বিদেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। কনস্টানটিনোপোল, জার্মান, ইতালি ও ফ্রান্সের নরপতিগণ তাঁর দরবারে দূত প্রেরণ করে বন্ধুত্ব স্থাপন করেছিলেন ।
সেনাবাহিনী পুনর্গঠন : তিনি বার্বার, স্লাভ, আরব ও খ্রিস্টানদের সমন্বয়ে সেনাবাহিনী গঠন করেন। সেনাবাহিনীতে প্রায় দেড় লক্ষ নিয়মিত ও অসংখ্য অনিয়মিত সৈন্য ছিল। তাঁর সেনাবাহিনী তৎকালীন জগতের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ছিল ।
‘খলিফা' উপাধি গ্রহণ : তাঁর আগে স্পেনের শাসকগণ আমীর ও সুলতান উপাধি নিয়েই সন্তুষ্ট ছিলেন। কিন্তু ৯২৯ সালে তিনি ‘খলিফা’ ও ‘আমীর-উল-মুমিনীন' উপাধি গ্রহণ করেন। একদিকে বাগদাদের ক্ষয়িষ্ণু সুন্নি আব্বাসীয় খিলাফত এবং অন্যদিকে মিসরের প্রতিদ্ধন্দ্বি শিয়া ফাতিমি খিলাফতের প্রাধান্য তাঁর 'খলিফা' উপাধি গ্রহণের মূল কারণ। তাছাড়া শাসক হিসেবেও তিনি সমসাময়িক মুসলিম শাসকদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ছিলেন এবং খলিফা হবার সব গুণাবলী তাঁর মধ্যে ছিল।
কৃষি : তাঁর সময় কৃষি ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটায় নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য সামগ্রীর দাম কম ছিল। সমাজে ভিক্ষাবৃত্তি ছিলনা। ইবনে হাওকল বলেন যে, ফলমূল এত সস্তায় বিক্রয় হত যে মনে হত কোন মূল্যই নেই। উন্নতমানের শস্য উৎপাদনের জন্য কৃষি ও উদ্যানবিদ্যায় নতুন নতুন কৌশল আনয়ন করা হয়। ফলে তাঁর সময় উন্নত চাষাবাদ ও উচ্চ ফলনমূলক বাগান গড়ে ওঠে। অনুর্বর, অসমতল ও পাহাড়ী ভূমিকে চাষের আওতায় আনা হয়। কৃষি কাজের জন্য পাথরের মধ্য দিয়ে খাল কেটে সেচের ব্যবস্থা করা হয়। খাদ্য সামগ্রীর প্রাচুর্য ও স্বল্প মূল্যের কারণে মুসলিম স্পেনের জনসংখ্যা দাঁড়ায় ৩ কোটিতে যেখানে শুধু কর্ডোভার লোকসংখ্যাই ছিল ১০ লক্ষের বেশি।
শিল্প : কৃষির উন্নতির ফলে স্পেনে শিল্পেরও বিকাশ ঘটে। কারণ শিল্পের জন্য প্রয়োজন হয় কাঁচামালের যা আসে কৃষি থেকে। স্পেনের বিভিন্ন শহরে শিল্প-কারখানা গড়ে ওঠে। কর্ডোভা, সেভিল ও অন্যান্য শহরে সিল্ক, সুতা, পশম, চামড়া ও ধাতব এর অসংখ্য শিল্প গড়ে ওঠে। একটি মাত্র প্রদেশেই ৩ হাজার গ্রাম গুটি পোকার লালন-পালনের ব্যবসার সাথে সম্পৃক্ত ছিল। শুধু কর্ডোভাতেই ১৩ হাজার তাঁতী ছিল। তরবারী, বর্ম, প্রদীপ ও লোহার দরজা তৈরির ক্ষেত্রে স্পেনের ধাতব শিল্পীদের বিশ্বজোড়া খ্যাতি ছিল। ইউরোপের বাজারে কর্ডোভার চামড়াজাত পণ্যও সমান ভাবে খ্যাতি লাভ করেছিল। উন্নতমানের কার্পেট ও নক্শীকরা কাপড়ের সমাদর ছিল পৃথিবীর সর্বত্র।
ব্যবসা-বাণিজ্য : স্পেনের ব্যবসা-বাণিজ্য দামেস্ক ও বাগদাদ থেকেও এক ধাপ এগিয়ে ছিল। দামেস্ক ও বাগদাদের ব্যবসা-বাণিজ্যের বেশিরভাগ উট-বাহিত ছিল। কিন্তু কর্ডোভার ব্যবসা-বাণিজ্যের বেশিরভাগ পরিচালিত হত বাণিজ্যিক জাহাজের মাধ্যমে। ১ হাজারেরও বেশি বাণিজ্য জাহাজের মাধ্যমে বাণিজ্য পরিচালিত হত। বাণিজ্য পণ্য বিক্রয়ের জন্য বিভিন্ন জায়গায় এজেন্সি গড়ে তোলা হত। কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্যের উন্নতির ফলে বার্ষিক রাজস্ব ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়।
শিক্ষা ও সংস্কৃতি : তৃতীয় আব্দুর রহমান জ্ঞান-বিজ্ঞানের পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় এ সময় উন্নয়ন সাধিত হয়। তাঁর সময় দর্শনে ইবনে মাসাররাহ, ইতিহাসে ইবনে আল-আমার ও ইবনে আল-কুতিয়া, জোতির্বিদ্যায় আহমদ বিন নসর ও মাসলামাহ বিন আল-কাসিম, চিকিৎসাবিদ্যায় আরিব বিন সাইদ ও ইয়াহিয়া বিন ইসহাক খ্যাতি লাভ করেন। তিনি কর্ডোভা মাদ্রাসাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত করেন।
স্থাপত্য শিল্প : তাঁর সময় কর্ডোভায় অসংখ্য মসজিদ, প্রাসাদ, গৃহ ও হাম্মামখানা ছিল। এ সময় বিশ্বে কর্ডোভার স্থান ছিল বাগদাদ ও কনস্টানটিনোপোলের পরই। আল-যাহ্রা প্রসাদ ছিল তাঁর একটি উল্লেখযোগ্য স্থাপত্য কর্ম। তাঁর উপপত্নী আল-যাত্রার নামে এর নামকরণ করা হয়। এছাড়া তিনি কর্ডোভা মসজিদের সম্প্রসারণ ও সৌন্দর্য বর্ধন করেন।
তৃতীয় আব্দুর রহমানের শাসনকাল স্পেনের ইতিহাসে অতি গৌরবের। তাঁকে ভারতের আকবর, আরবের খলিফা হযরত উমর ফারুক (রা.) এবং বাগদাদের খলিফা হারুন-অর-রশিদের সাথে তুলনা করা হয়। তিনি শুধু স্পেনের উমাইয়া শাসকদের মধ্যেই শ্রেষ্ঠ ছিলেন না; বিশ্বের শ্রেষ্ঠ শাসকদের মধ্যেও অন্যতম ছিলেন।
সারসংক্ষেপ:
তৃতীয় আব্দুর রহমানের শাসনকাল স্পেনের ইতিহাসে অতি গৌরবের। তাঁকে স্পেনের মুসলিম সাম্রাজ্যের ত্রাণকর্তা বলা হয়। তিনি অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক নীতির মাধ্যমে স্পেনে মুসলিম শাসন সুসংহত করেন।। তাঁর সেনাবাহিনী তৎকালীন জগতের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ছিল। তিনি ‘খলিফা’ ও ‘আমীর-উল-মুমিনীন' উপাধি গ্রহণ করেন। কৃষি, শিল্প ও ব্যবসা- বাণিজ্যে স্পেন ব্যাপকভাবে সমৃদ্ধি লাভ করে তাঁর সময়ে। শিক্ষা-সংস্কৃতি ও স্থাপত্য শিল্পে এসময় কর্ডোভার খ্যাতি ছিল বিশ্বজোড়া । তিনি কর্ডোভা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। আল-যাত্রা প্রাসাদ তাঁর একটি অসামান্য নির্মাণ-কর্ম।
পাঠ-৯.১০
দ্বিতীয় হিশাম ও হাজিব আল-মনসুর ও সুলতানা সুবাহ্, আল-মুশাফি, আবু আমির মুহম্মদ ও মদিনাত আল-জাহিরা
উদ্দেশ্য
এ পাঠ শেষে আপনি
দ্বিতীয় হিশাম ও হাজীব আল-মনসুরের পরিচয় সম্পর্কে বলতে পারবেন;
হাজীব আল-মনসুরের প্রাথমিক জীবন ও ‘হাজিব' পদ লাভ সম্পর্কে বর্ণনা দিতে পারবেন
হাজীব আল-মনসুরের কৃতিত্ব মূল্যায়ন করতে পারবেন ।
তৃতীয় আব্দুর রহমানের পর স্পেনের শাসন ক্ষমতায় বসেন খলিফা দ্বিতীয় হাকাম (৯৬১-৭৬)। দ্বিতীয় হাকামের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র হিশাম (৯৭৬-১০০৯) ১২ বছর বয়সে সিংহাসন লাভ করেন। রাজমাতা সুলতানা সুবাহ রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব দেন প্রধানমন্ত্রী আল-মুশাফি ও রাষ্ট্রাধ্যক্ষ আবু আমির মুহম্মদের উপর। আবু আমির মুহম্মদ পরবর্তীতে হাজিব বা প্রধানমন্ত্রী হয়ে ‘আল-মনসুর' উপাধি ধারণ করেন এবং স্পেনের ইতিহাসে তিনি ‘হাজীব আল-মনসুর' নামেই অধিক পরিচিত। হিশাম খলিফা হলেও প্রকৃত ক্ষমতা আল-মনসুরের হাতেই চলে গিয়েছিল । তিনি রাজবংশে জন্ম গ্রহণ না করেও এবং রাজা বা শাসক না হয়েও ইতিহাসপ্রসিদ্ধ ব্যক্তিত্বে পরিণত হন ।
আল-মনসুরের পরিচয় ও প্রাথমিক জীবন : আল-মনসুর ৯৪২ সালে কর্ডোভায় অতি সাধারণ এক আরব পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি কর্ডোভা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিষয়ে লেখাপড়া করেন। এরপর বিচারপতি মুহম্মদ আল-সলিমের অধীনে কর্মজীবন শুরু করেন। তিনি তাঁর সুন্দর ব্যবহারের মাধ্যমে অতি শীঘ্রই সুলতানা সুবাহর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। ৯৬৭ সালে তিনি তাঁকে বালক খলিফা হিশামের তত্ত্বাবধায়ক নিয়োগ করেন। এরপর তিনি তাঁর দক্ষতা ও মেধার মাধ্যমে বিভিন্ন পদ অলংকৃত করেন ।
‘হাজিব’ পদ লাভ : সে সময়ে খলিফা হিশামের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন মুশাফি। কিন্তু তাঁর বদমেজাজ ও রুক্ষ আচরণের কারণে আমত্যবর্গ ক্ষুব্ধ হয়। অন্যদিকে আবু আমীর মুহম্মদ তাঁর প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতার মাধ্যমে জনগণের আস্থা, ভালবাসা ও খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি সেনাপতি গালিবের কন্যাকে বিবাহ করেন এবং রাজকীয় তত্ত্বাবধানে এই বিবাহ সম্পন্ন হয় । এতে তাঁর প্রভাব আরও বৃদ্ধি পায় এবং সুলতানা সুবাহর অনুমোদন নিয়ে আল-মুশাফিকে অপসারণ করে গালিবকে প্রধানমন্ত্রীর পদে নিয়োগ দেন। ৯৮১ সালে গালিব ও আবু আমির মুহম্মদ একত্রে লিওনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়ে গালিব নিহত হন। এরপর আবু আমির রাজধানীতে প্রত্যাবর্তন করে ‘আল-মনসুর’ (বিজয়ী) উপাধি গ্রহণ করে ‘হাজিব’ বা প্রধানমন্ত্রী পদ লাভ করেন। হিশামের অভিভাবক হিসেবে তিনি রাষ্ট্রীয় সকল কার্য সম্পাদন করেন। খলিফার নামের সঙ্গে মুদ্রা, খুতবা ও রাজকীয় ফরমানে নিজের নাম সংযুক্ত করেন। এভাবে তিনি হাজিব হলেও স্পেনের একচ্ছত্র অধিপতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।
আলিমদের সাথে সুসম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা : সুলতানা সুবাহ্র সাথে কথিত সম্পর্ক নিয়ে তিনি সমালোচনার শিকার হন। ফকীহগণ তাঁকে ধর্মদ্রোহী বলে আখ্যা দেয় এবং তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করার ষড়যন্ত্র করে। ষড়যন্ত্র প্রকাশ হয়ে গেলে ষড়যন্ত্রকারীদের ফাঁসি ও নির্বাসন দেয়া হয়। পরে তিনি বিচারক ও আলিমদের খুশী রাখার জন্য আল-হাকামের লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত ধর্মের সাথে সাংঘর্ষিক দর্শনের গ্রন্থসমূহ জ্বালিয়ে দেন। এছাড়া তিনি তাঁদের সমর্থন লাভের জন্য স্বহস্তে কুরআনের অনুলিপি করেন।
সেনা সংস্কার : সে সময় সেনাবাহিনীতে বহু জাতির লোকদের সংমিশ্রণ থাকায় সেনাবাহিনীতে গোত্র-কলহ দেখা দেয়। তিনি গোত্র-কলহপ্রিয় সেনাদের অপসারণ করেন। আফ্রিকান, সিউটার বার্বার, সুদানী ও উত্তর অঞ্চলের খ্রিস্টানদের
সেনাবাহিনীতে নিয়োগদানের মাধ্যমে সেনাবাহিনী পুনর্গঠন ও সম্প্রসারণ করেন। সেনাদের পর্যাপ্ত বেতন ও সুযোগ-সুবিধা প্রদান করতেন। এভাবে তিনি সেনাবাহিনীতে শৃংখলা আনয়ন করেন ।
সমরাভিযান : ইবনে খালদুনের মতে, তিনি খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে ৫২টি অভিযান প্রেরণ করেন এবং এর একটিতেও পরাজিত হননি । তিনি লিওনের রাজা তৃতীয় রামিরো ও নাভারের রাজা সাঞ্চোকে পরাজিত করে লিওন ও নাভারেকে করদ রাজ্যে পরিণত করেন। পরে তৃতীয় রামিরোর উত্তরাধিকারী দ্বিতীয় বারমুডো বিদ্রোহ করলে তাঁকেও পরাজিত করা হয়। তিনি গ্যালিসিয়ানদেরকেও পরাজিত করেন। কাউন্ট বোরেলকে বিতাড়িত করে বার্সিলোনা জয় করেন। তিনি উত্তর আফ্রিকাতেও কয়েকটি স্বার্থক অভিযান চালান। এসব অভিযানের ফলে সাম্রাজ্যের সীমানা পিরেনীজের উত্তর অংশ পর্যন্ত বিস্তৃত হয় ।
উত্তর আফ্রিকায় অভিযান : ৯৮৫ সালে আল-মনসুরের সেনাপতি ইদ্রিসিয় শাসক হাসান ইবনে গানুনের রাজ্য অবরোধ করেন এবং তাঁকে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করেন। তিনি কর্ডেভায় প্রেরিত হন এবং সেখানে তাঁকে হত্যা করা হয়। ৯৯৭ সালে জিরি বিন আতিয়া আল-মাগরিবি কর্ডোভার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলে তাঁকে হত্যা করা হয় এবং এর মধ্য দিয়ে সমগ্র মরক্কো ও পশ্চিম আফ্রিকায় আল-মনসুরের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। জিরি বিন আতিয়ার উত্তরাধিকারী আল-মুইযও কর্ডোভার কঠোর নিয়ন্ত্রণে ছিলেন। আল-মনসুর খ্রিস্টান স্পেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য জানাতা ও সিন্হাজাহ গোত্রের নেতাদের স্পেনে নিয়ে আসেন। এছাড়া তাদের মধ্য থেকে অসংখ্য সৈন্য তাঁর বাহিনীতে ভর্তি করা হয়। এক সময়কার ফাতিমীয় অনুগত সেনাবাহিনী উমাইয়া সেনাবাহিনীতে ভর্তি করার কারণে তাদের মধ্যে দেশপ্রেমের অভাব পরিলক্ষিত হয় এবং তারা আল-মনসুরের পরবর্তী সময়ে স্পেনের রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে থাকে ।
কৃতিত্ব তৃতীয় আব্দুর রহমানের পর তিনিই ছিলেন দশম শতাব্দীর ইউরোপের শ্রেষ্ঠ সমরনায়ক ও রাজনীতিবিদ। সে : সময় উত্তর অঞ্চলের খ্রিস্টানগণ তাঁকে ছাড়া অন্য কোন নরপতিকে এত বেশি ভয় করত না। তিনি কৃষি, শিল্প, ব্যবসা- বাণিজ্য ও যাতায়াতের উন্নয়ন সাধন করেন। তিনি বংশগত আভিজাত্য ও কৌলিন্য প্রথা রহিত করেন। সামন্ত প্রথা ও জায়গীর প্রথা মূলোৎপাটন করেন। রাস্তাঘাট ও পুল নির্মাণ ও সংস্কার সাধন করেন। বহু হাসপাতাল, সেনানিবাস, অট্টালিকা ও মসজিদ নির্মাণ করেন। কর্ডোভা মসজিদের পুন:সংস্কার সাধন করেন। তিনি ‘মদিনাত আল-যাহিরা’ নির্মাণ করেন। তিনি জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে উন্নতি সাধন করেন। ডোজি বলেন যে, আল-মনসুর মুসলিম স্পেনে যে শক্তি ও সমৃদ্ধি আনেন মহামতি তৃতীয় আব্দুর রহমানের পক্ষেও তা সম্ভব হয়নি। তাঁকে বলা হয় দশম শতাব্দীর বিসমার্ক। বিসমার্ক (১৮৭০-৯০) যেভাবে যুদ্ধ জয়ের মধ্য দিয়ে জার্মানীকে একত্রিত করেন (১৮৭১) হাজিব আল-মনসুরও তেমনি যুদ্ধজয়ের মাধ্যমে মুসলিম স্পেনের সংহতি বজায় রাখেন। ১০০২ সালে তাঁর মৃত্যু হয় এবং মদিনা-তুস-সলিমে তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়। তাঁর মৃত্যুর পর যোগ্য শাসক বা প্রশাসকের অভাবে উমাইয়াদের পতন রোধ করা যায়নি।
সারসংক্ষেপ:
খলিফা দ্বিতীয় হিশাম (৯৭৬-১০০৯) ১২ বছর বয়সে সিংহাসন লাভ করেন। তার শাসনকালে প্রকৃত ক্ষমতা চলে যায় আল-মনসুরের হাতে। আল-মনসুর ৯৪২ সালে কর্ডোভায় অতি সাধারণ এক আরব পরিবারে জন্মগ্রহন করেন। তিনি কর্ডোভা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিষয়ে লেখাপড়া করেন। আল-মনসুর তাঁর দক্ষতা ও মেধার মাধ্যমে বিভিন্ন রাজকীয় পদ অলংকৃত করার পর সবশেষে হাজিব পদে আসীন হন। খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে ৫২টি অভিযান প্রেরণ করে প্রত্যেকটিতেই তিনি বিজয়ী হন। তিনি মদিনাত আল-যাহিরা নির্মাণ করেন। তাঁকে বলা হয় দশম শতাব্দীর বিসমার্ক। ১০০২ সালে তাঁর মৃত্যু হয় এবং মদিনা-তুস-সলিমে তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়।
পাঠ-৯.১১
স্পেনে মুসলিম শাসনের অবসান
উদ্দেশ্য
এ পাঠ শেষে আপনি
স্পেনে মুসলিম শাসন অবসানের কারণসমূহ বিশ্লেষণ করতে পারবেন;
স্পেনে মুসলিম শাসন অবসানের ঘটনাপ্রবাহ উল্লেখ করতে পারবেন মুসলিম শাসন অবসানের ফলাফল ব্যাখ্যা করতে পারবেন।
মুখ্য শব্দ
মুলুক আত্-তাওয়াইফ, মুরাবিতুন, মুয়াহিদুন, নসর বংশ, ফার্ডিন্যান্ড ও ইসাবেলা, আল- হামারা, বোয়াবদিল, আল-জাগাল, গ্রানাডার পতন ও মরিস্কো
১৪৯২ সালে স্পেন হতে মুসলিম শাসনের অবসান হয়। দীর্ঘ প্রায় ৮০০ বছরের মুসলিম শাসন অনেকটা সময় ধরে সুদৃঢ় থাকলেও বিভিন্ন সময় এই অবস্থা ভেঙ্গে পড়তে দেখা যায়। অবশেষে ফার্ডিন্যান্ড ও ইসাবেলার হাতে গ্রানাডার পতনের মধ্য দিয়ে স্পেনে মুসলিম শাসনের অবসান ঘটে
স্পেনে মুসলিম শাসন অবসানের কারণ
অনৈক্য ও গোত্রীয় কোন্দল : স্পেনে মুসলিম শাসনের শুরু থেকেই অনৈক্যের বীজ উপস্থিত ছিল। সেখানে আরব, সিরিয়ান, বার্বার, নও-মুসলিম, খ্রিস্টান, ইহুদি ইত্যাদি জাতি ও ধর্মের লোকেরা বসবাস করত। আরবরা আবার হিমারীয়, মুদারীয়, কালবী, কায়েসী ইত্যাদি ভাগে বিভক্ত ছিল। বার্বাররা সানহাজাহ, জানাতা ইত্যাদি ভাগে বিভক্ত ছিল। এসব গোত্র ও উপ-গোত্রের মধ্যে কোন্দল স্পেনের মাটিতে সর্বদাই পরিলক্ষিত হয়। গোত্রীয় কোন্দলের ফলে ১০৩১ সালে উমাইয়া শাসনের পতন ঘটে এবং এরপর স্পেন আরব, বার্বার, স্লাভ, নও-মুসলিম ও খ্রিস্টানদের মধ্যে বহু ক্ষুদ্র রাজ্যে ভাগ হয়ে যায় যেগুলোকে বলা হয় 'মুলুক আত্-তাওয়াইফ'। এরপর উত্তর আফ্রিকার মরক্কো হতে মুরাবিতুন (১০৯১-১১৪৬) ও মুয়াহিদুন (১১৪৬-১২৪৮) রাজবংশ স্পেন শাসন করলেও তারা সেখানে কার্যকরীভাবে তাদের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হয়। গ্রানাডার নসর বংশ (১২৩২-১৪৯২) মুসলিম শাসনের পতনলগ্নে মুসলিম শাসন ও সভ্যতার নিস্তেজ দণ্ডটিকে ধারণ করলেও পঞ্চদশ শতকে এসে এর সর্বশেষ উজ্জ্বলতাটুকুও নিষ্প্রভ হয়ে যায়।
দুর্বল সরকার : দুর্বল শাসকদের সময় স্পেনের প্রশাসন যন্ত্রের অবনতি ঘটে। সেনাবাহিনীতে বহুজাতির সংমিশ্রণের ফলে বিশৃংখলার সৃষ্টি হয়। আত্মকেন্দ্রিক ও দেশপ্রেম বিবর্জিত অভিজাত শ্রেণী সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরীণ গোলযোগ ও বিশৃংখলার জন্য দায়ী। তাছাড়া শাসকদের আয়েশী জীবন-যাপন প্রশাসন ব্যবস্থাকে দুর্বল করে তোলে। সুষ্ঠু উত্তরাধিকারী নীতির অভাবে গড়ে ওঠা প্রাসাদ ষড়যন্ত্র এবং সিংহাসনের দাবীদারদের মধ্যে শক্তি পরীক্ষা স্পেনীয় মুসলিম শাসনকে দুর্বল করে। এছাড়া শাসন ব্যবস্থা জনবিচ্ছিন্ন হবার কারণে সরকারের বিরুদ্ধে কোন বিদ্রোহে জনগণ কোন প্রতিবাদ জানাত না। ফলে বিদ্রোহী ও খ্রিস্টান অনুপ্রবেশকারীরা এই সুযোগ গ্রহণ করে ।
অর্থনৈতিক দুরবস্থা : ক্রমাগত যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, বিদ্রোহ দমন, রাজস্ব ঘাটতি ইত্যাদির ফলে অর্থনৈতিক অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়ে এবং রাজকোষ প্রায় শূণ্য হয়ে যায়। সরকারী কর বৃদ্ধি পাওয়ায় কৃষকরা তাদের কৃষিকাজ পরিত্যাগ করে অন্য জীবিকা গ্রহণ করে; তাদের মধ্যে কেউ কেউ দস্যুতে পরিণত হয়। ফলে কৃষি ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অর্থ সংকটের কারণে দুর্গ মেরামত, সেনাবাহিনীর বেতন প্রদান সম্ভব হয়না। ফলে সেনাবাহিনী দুর্বল হয়ে পড়ে এবং সামরিক অভিযান ব্যাহত হয়। আমদানী-রফতানী শুল্ক বৃদ্ধি পাওয়ায় ব্যবসা-বাণিজ্যে বিঘ্ন সৃষ্টি হয়। মুসলিম শাসনের শেষ দিকে খ্রিস্টান রাজাদের কর দিতে গিয়ে গরীব প্রজাদের উপর অতিরিক্ত কর আরোপ করতে হয়। ফলে জনগণ বিদ্রোহী হয়ে ওঠে।
ভৌগোলিক প্রতিকূলতা ও মুসলিম নীতির দুর্বলতা : স্পেনের পার্বত্য অঞ্চল ও আঁকাবাঁকা পথ সেনাবাহিনী গমনাগমণের জন্য অত্যন্ত অনুপযোগী ছিল বলে প্রত্যন্ত অঞ্চলের বিদ্রোহ দমন করা ছিল দুরুহ। দুর্বল শাসকদের সময় দেশের অভ্যন্তরে যাতায়াতও নিরাপদ ছিলনা। ভৌগোলিক প্রতিকূলতা নিরসনে মুসলিম শাসকদের উচিৎ ছিল সেনাবাহিনীকে সাহায্যের জন্য সর্বাবস্থায় রাজধানী-নির্ভর না করে বিভিন্ন কৌশলগত অবস্থানে সেনানিবাস নির্মাণ করে প্রয়োজনীয় রসদ ও সহযোগিতা নিশ্চিত করা। এতে ইউরোপে আর অগ্রসর হতে না পারলেও অধিকৃত এলাকা অধিকারে রাখা যেত।
খ্রিস্টানদের শত্রুতা : মুসলিমদের অদূরদর্শী নীতির ফলে খ্রিস্টানরা শহরের কেন্দ্রস্থলে বসবাসের সুযোগ লাভ করে । ফলে তারা মুসলিম সাম্রাজ্য ধ্বংসের লক্ষ্যে সুবিধাজনক সময়ে প্রয়োজনীয় তথ্য প্রদানসহ উত্তরাঞ্চলের স্বজাতীয়দের সাথে গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। খ্রিস্টানরা শুরু থেকেই মুসলিম শাসনকে সুনযরে দেখেনি। তারা মুসলিমদেরকে বিজাতীয় এবং অনুপ্রবেশকারী মনে করত। খ্রিস্টান ধর্মান্ধ আন্দোলন, খ্রিস্টান সমর্থনে উমর বিন হাঙ্গুনের বিদ্রোহ, ১০৮৫ সালে খ্রিস্টানদের টলেডো পুনর্দখল ইত্যাদি ঘটনা থেকেও মুসলিমরা শিক্ষা নেয়নি।
মুসলিম শাসন অবসানের ঘটনাপ্রবাহ :
ফার্ডিন্যান্ড ও ইসাবেলার উত্থান : গ্রানাডার শাসক আবুল হাসান আলীর সময় (১৪৬৫-৮২) খ্রিস্টান জগতে নতুন শক্তিজোটের উত্থান ঘটে। আরাগনের ফার্ডিন্যান্ড ও ক্যাস্টিলের ইসাবেলা ১৪৬৯ সালে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে যুগপৎভাবে গ্রানাডার মুসলিম আধিপত্য নির্মূলে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করে। এটা ছিল মুসলিম শাসন অবসানের ঘন্টাধ্বনি। ১৪৮২ সালে তারা আল-হামারা দুর্গ দখল করে। আল-হামারার পতন গ্রানাডার পতনের পূর্ব সংকেত ছিল। কিন্তু এই সংকটকালেও রাজ পরিবারের মধ্যে অর্ন্তদ্বন্দ্বে এতটুকু ভাটা পড়েনি। উত্তরাধিকার দ্বন্দ্বের সূত্র ধরে বোয়াবদিল (মুহম্মদ আবু আবদুল্লাহ্ বা একাদশ মুহম্মদ: ১৪৮২-৮৩/১৪৮৭-৯২) পিতা আবুল হাসানকে উৎখাত করে ক্ষমতা দখল করেন। তিনি আল-হামারা উদ্ধার করেন। কিন্তু লুছেনা আক্রমণ করতে গিয়ে খ্রিস্টানদের কাছে পরাজিত ও বন্দী হন। আবুল হাসান সিংহাসন উদ্ধার করেন এবং পরে ভাই আল-জাগালের (আবু আবদুল্লাহ্ মুহম্মদ বা দ্বাদশ মুহম্মদ: ১৪৮৩-৮৭) পক্ষে সিংহাসন ত্যাগ করেন।
গ্রানাডা দখল : খ্রিস্টানরা বন্দী বোয়াবদিলকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে এবং চাচা আল-জাগালের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে খ্রিস্টানদের সহায়তায় গ্রানাডা দখল করেন। ফার্ডিন্যান্ড ও ইসাবেলা এরপর বোয়াবদিলকে গ্রানাডা হস্তান্তরের দাবী জানালে তিনি তা প্রত্যাখান করেন। ফলে ব্যাপক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর ১৪৯২ সালের ২ জানুয়ারী কতিপয় শর্তসাপেক্ষে গ্রানাডা খ্রিস্টানদের নিকট হস্তান্তর করা হয়। এতে মুসলিমদের জান-মালের নিরাপত্তা, ধর্মীয় স্বাধীনতা, আচার-অনুষ্ঠান, রীতিনীতি, ভাষা ও পোশাক বহাল রাখার অধিকারসহ নানা বিষয়ে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। বোয়াবদিল ফেজে নির্বাসিত হন এবং সেখানে অতি দুঃখ-কষ্টে দিনাতিপাত করে ১৫৩৮ সালে মৃত্যুমুখে পতিত হন। অন্যদিকে বোয়াবদিলের প্রধান সেনাপতি মুসাও যুদ্ধে মারা যান। গ্রানাডার পতনের ফলে স্পেনে ৭৮০ বৎসরের মুসলিম শাসনের অবসান ঘটে ।
মুসলিম শাসন অবসানের ফলাফল : ১৪৯২ সালে গ্রানাডার পতনের ফলে মুসলিমদের ভাগ্যে নেমে আসে করুণ ও মর্মস্পর্শী বিপর্যয়। গ্রানাডার পতনের পর মুসলিমদের প্রথম ‘মরিস্কো’ বলে সম্বোধন করা হয়। এর আগে তাদের বলা হত ‘মুর’। বিশেষ করে ইসলাম থেকে খ্রিস্টান-ধর্মে ধর্মান্তরিতদের ‘মরিস্কো' নামে ডাকা হত। আর যেসব মুসলিম তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস বজায় রেখে খ্রিস্টান-শাসিত অঞ্চলে বসবাস করত তাদের বলা হত ‘মুদেজারেস'। গ্রানাডা দখলের পর ফার্ডিন্যান্ড চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করে মুসলিম প্রজাদের জোরপূর্বক খ্রিস্টান-ধর্মে ধর্মান্তরিত করতে শুরু করে এবং ধর্মান্তরিত না হলে মৃত্যুদণ্ড, বহিস্কার, কারাদণ্ড,সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত ইত্যাদি আরোপ করা হয়। তাদের মসজিদবদ্ধ করে পুড়িয়ে মারা হয়; তাদের ভাষা, পোশাক, রীতিনীতি নিষিদ্ধ হয়; গোসল নিষিদ্ধ করা হয়; শুক্রবার জুমুআর দিন তাদের গৃহসমূহ খুলে রাখতে বাধ্য করা হয়। কিছু অঞ্চলে বিশেষ করে ভ্যালেন্সিয়া ও আরাগন অঞ্চলে মুসলিম নিধন ও উচ্ছেদ প্রক্রিয়া বিলম্বিত হয়। এর কারণ কিছু সংখ্যক জমিদার ও শিল্পপতি তাদের স্বার্থে মুসলিমদের প্রতি আনুকূল্য দেখিয়েছিলেন। কারণ মুসলিমরা একচেটিয়া তাদের জমি চাষ করত এবং শিল্প প্রতিষ্ঠানে দক্ষ শ্রমিক ও কারিগর হিসেবে কাজ করত। তাই তারা স্পেনের অর্থনীতি, শিল্প কারখানা ও কৃষি ব্যবস্থাকে ধ্বংসের কবল থেকে রক্ষার জন্য কিছুকালব্যাপী রাজাদের ঘুষ প্রদান করে বা
অন্যভাবে প্রভাবিত করতে পেরেছিলেন। কিন্তু সপ্তদশ শতকের প্রথম দশকে নানা আইন পাশ করে তাদেরকে চূড়ান্তভাবে উচ্ছেদ করা হয়। ফলে মুসলিমরা আফ্রিকার উপ-কূলে বা আরও দূরবর্তী মুসলিম দেশগুলোতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। গ্রানাডার পতনের পর সপ্তদশ শতকের প্রথম দশকের মধ্যে প্রায় ৩০ লক্ষ মুসলিমকে নির্বাসিত বা হত্যা করা হয়। ১৬১৩ সালের মধ্যে এই চূড়ান্ত বহিষ্কার সম্পন্ন হয়েছিল এবং এর পর সেখানে প্রকাশ্যে কোন মুসলিমের অস্তিত্ব ছিলনা ।
বস্তুত ১৪৯২ সালে মুসলিম শাসনের অবসান মুসলিমদের স্পেন হতে চূড়ান্তভাবে বিতাড়নের ভাগ্য নির্ধারণ করে দিয়েছিল। শুধু স্পেনেই আরব সভ্যতা গড়ে উঠে টিকে থাকতে পারেনি। তবে এতদ্বসত্ত্বেও তাদের শিল্প, সভ্যতা ও সংস্কৃতি ইউরোপ গ্রহণ করেছিল এবং এর যথার্থ প্রতিফলন ঘটে ইউরোপীয় রেনেসায় । P. K. Hitti (গ্রন্থ: History of the Arabs) বলেন,“মূরেরা নির্বাসিত হল; কিছু সময়ের জন্য ধার করা আলোর বাহার নিয়ে স্পেনের বুকে খ্রিস্টধর্মের চাঁদের উদয় হল; তারপর শুরু হল চন্দ্রগ্রহণ এবং তখন থেকেই স্পেন সেই অন্ধকারের মধ্যে মুখ থুবড়ে পড়ল ।”
向 সারসংক্ষেপ :
১৪৯২ সালে স্পেন হতে মুসলিম শাসনের অবসান হয়। বিভিন্ন জাতি ও ধর্মের মধ্যে অনৈক্য, গোত্রীয় কোন্দল, অর্থনৈতিক সংকট, ভৌগোলিক প্রতিকূলতা, খ্রিস্টানদের শত্রুতা ইত্যাদি নানা কারণে স্পেনে মুসলিম শাসন দুর্বল হয়ে পড়ে। অবশেষে ফার্ডিন্যান্ড ও ইসাবেলার হাতে গ্রানাডার পতনের মধ্য দিয়ে স্পেনে মুসলিম শাসনের অবসান ঘটে।
পাঠ-৯.১২
শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে স্পেনের মুসলিমদের ভূমিকা
উদ্দেশ্য
এ পাঠ শেষে আপনি-
শিক্ষা ও সংস্কৃতির বিভিন্ন শাখায় স্পেনের মুসলিমদের ভূমিকা আলোচনা করতে পারবেন । সভ্যতার প্রাণকেন্দ্র কর্ডোভা নগরীর গুরুত্ব তুলে ধরতে পারবেন ।
ইউরোপের উপর মুসলিম স্পেনের শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রভাব উল্লেখ করতে পারবেন।
মুখ্য শব্দ ইবনে হাজম, কর্ডোভা বিশ্ববিদ্যালয়, দ্বিতীয় হাকামের লাইব্রেরি, ইবনে খালদুন, আল-
ইদ্রিসি, ইবনে রুশদ, কর্ডোভা মসজিদ, আল-হামারা ও কর্ডোভা
বলা হয়ে থাকে যে, আরবরাই জ্ঞানের বর্তিকা প্রাচ্য থেকে পাশ্চাত্যে বহন করে নিয়ে এসেছে। যখন সমগ্র ইউরোপ অন্ধকারাচ্ছন্ন তখন স্পেনীয় আরবরা বৌদ্ধিক জগতে ব্যাপক ও নজিরবিহীন অগ্রগতি সাধন করেছিল।
ভাষা ও সাহিত্য : ভাষার দিক দিয়ে আল-কালী ও আল-জুবায়দী, সাহিত্যে ইবনে আবদ-রাব্বিহ, আলী ইবনে হাজম, ইবনে খাতিব, ইবনে জায়দুন এবং মহিলা কবি উয়াল্লাদাহ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ছিলেন। তাঁদের রচনাগুলো এখনও উন্নতমানের বলে গণ্য করা হয়। আলী ইবনে হাজমকে বলা হয় মুসলিম স্পেনের শ্রেষ্ঠ পণ্ডিত ও মৌলিক চিন্তাবিদ। PK. Hitti (গ্রন্থ: History of the Arabs) তাঁকে ইসলামের দু-তিনজন চিন্তাশীল মনিষী ও সুপ্রসিদ্ধ লেখকদের মধ্যে একজন বলে উল্লেখ করেছেন। ইবনে জায়দুনকে কেউ কেউ আন্দালুসের শ্রেষ্ঠ কবি বলে গণ্য করে থাকেন।
শিক্ষা ও শিক্ষার উপকরণ : স্পেনীয় মুসলিমদের একটা বড় অংশ লিখতে ও পড়তে পারত। প্রধান প্রধান শহরগুলোর অনেকগুলোতেই বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছিল। সেগুলির মধ্যে কর্ডোভা, সেভিল, মালাগা ও গ্রানাডার বিশ্ববিদ্যালয় ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এখানে বিদেশী ছাত্ররাও পড়াশুনা করত। স্পেনে অনেক গ্রন্থাগার গড়ে উঠেছিল এবং সেগুলোতে বইয়ের ব্যাপক সংগ্রহ ছিল। দ্বিতীয় হাকামের লাইব্রেরীতে পাণ্ডুলিপির সংখ্যা ছিল প্রায় ৬ লক্ষ। স্পেনে লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা ও বিশাল বইয়ের সংগ্রহ গড়ে তোলা সম্ভব হয় স্থানীয়ভাবে কাগজ উৎপাদনের জন্য। কাগজ শিল্পের সাথে সম্পর্কিত ‘ream’ শব্দটি মূল আরবী শব্দ ‘rizmah’ থেকে উৎপত্তি লাভ করেছে যা স্পেনীয় ‘resma’ ও ফরাসি ‘rayme’ হতে বিবর্তিত হয়ে ইংরেজিতে 'ream' হিসেবে স্থান পেয়েছে। এটা কাগজ শিল্পে মুসলিমদের মৌলিক অবদানের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। পরে স্পেন থেকে কাগজ উৎপাদন কৌশল গোটা ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে।
ইতিহাসতত্ত্ব : মুসলিম স্পেনে অসংখ্য ঐতিহাসিক ইতিহাস-শাস্ত্রে অবদান রাখেন। স্পেনের ঐতিহাসিকদের মধ্যে ইবনে আল-কুতিয়া, ইবনে হাইয়ান, ইবনে আল-আব্বার, আবুল কাসিম সাইদ ইবনে আহম্মদ আল আন্দালুসী, ইবনে আল- খতিব, ইবনে খালদুন অন্যতম। ইবনে খালদুন ছিলেন পৃথিবীর সর্বযুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইতিহাস-দার্শনিক।
ভূগোল : স্পেনের ভূগোলবিদ, ভূগোল গ্রন্থকার ও মানচিত্রবিদদের মধ্যে অধিক উল্লেখযোগ্য ছিলেন আল-বারি ও আল- ইদ্রিসি। পর্যটকদের মধ্যে ইবনে যুবাইর, ইবনে আহম্মদ, আবু হামিদ ও মুহম্মদ আল-মাজিনি উল্লেখযোগ্য।
জ্যোতির্বিজ্ঞান, জ্যোতিষবিদ্যা ও গণিত : স্পেনের জ্যোতির্বিদদের মধ্যে আল-মাজরিতি, আল-জারকালি, আল- বিতরুজি এবং ইবনে আফলাহ উল্লেখযোগ্য। আন্দালুসিয়ার বেশিরভাগ জ্যোতির্বিদ বিশ্বাস করতেন যে, পৃথিবীতে মানুষের জন্ম ও মৃত্যুর মধ্যবর্তী সময়ের প্রধান ঘটনার পেছনে নক্ষত্রের প্রভাব আছে। আল-মাজরিতিকে আল-হাসিব বা অংকশাস্ত্রবিদ খেতাব দেয়া হয়েছিল। পরিমিতিসহ অংকশাস্ত্রের ক্ষেত্রে তাঁকে একজন পথ-প্রদর্শক বলে গণ্য করা হত। অংকশাস্ত্রে বিভিন্ন আরবী শব্দের ব্যবহার তাদের অবদানের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।