ফোকলোর সোসাইটির কাজ কী? 

Created: 1 year ago | Updated: 2 months ago
Updated: 2 months ago

পল্লিগ্রামে শহরের মতো গায়ক, বাদক, নর্তক না থাকলেও তার অভাব নেই। চারদিকে কোকিল, দোয়েল,পাপিয়া প্রভৃতি পাখির কলগান, নদীর কুলকুল ধ্বনি, পাতার মর্মর শব্দ, শ্যামল শস্যের ভঙ্গিময় হিলাদুলা প্রচুর পরিমাণে শহরের অভাব এখানে পূর্ণ করে দিচ্ছে। পল্লির ঘাটে মাঠে, পল্লির আলোবাতাসে, পল্লির প্রত্যেক পরতে পরতে সাহিত্য ছড়িয়ে আছে। কিন্তু বাতাসের মধ্যে বাস করে যেমন আমরা ভুলে যাই বায়ু- সাগরে আমরা ডুবে আছি, তেমনি পাড়াগাঁয়ে থেকে আমাদের মনেই হয় না যে কত বড়ো সাহিত্য ও সাহিত্যের উপকরণ ছড়িয়ে আছে ।
শ্রদ্ধেয় ডক্টর দীনেশচন্দ্র সেন মৈমনসিংহ গীতিকা সংগ্রহ করে দেখিয়েছেন, সাহিত্যের কী এক অমূল্য খনি পল্লিজননীর বুকের কোণে লুকিয়ে আছে। সুদূর পশ্চিমের সাহিত্যরসিক রোমাঁ রোলাঁ পর্যন্ত ময়মনসিংহের মদিনা বিবির সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়েছেন। মনসুর বয়াতির মতো আরও কত পল্লিকবি শহুরে চক্ষুর অগোচরে পল্লিতে আত্মগোপন করে আছেন, কে তাঁদের সাহিত্যের মজলিসে এসে জগতের সঙ্গে চেনাশোনা করিয়ে দেবে? আজ যদি বাংলাদেশের প্রত্যেক পল্লি থেকে এইসব অজানা অচেনা কবিদের গাথা সংগ্রহ করে প্রকাশ করা হতো, তাহলে দেখা যেত বাংলার মুসলমানও সাহিত্য সম্পদে কত ধনী। কিন্তু হায়! এ কাজের জন্য স্বেচ্ছাসেবক দল কই?
আমরা পল্লিগ্রামে বুড়োবুড়ির মুখে কোনো ঝিল্লিমুখর সন্ধ্যাকালে যেসব কথা শুনতে শুনতে ছেলেবেলায় ঘুমিয়ে পড়েছি, সেগুলি না কত মনোহর! কত চমকপ্রদ! আরব্য উপন্যাসের আলাউদ্দিনের আশ্চর্য প্রদীপ, আলিবাবা ও চল্লিশ দস্যু প্রভৃতির চেয়ে পল্লির উপকথাগুলোর মূল্য কম নয়। আধুনিক শিক্ষার কর্মনাশা স্রোতে সেগুলো বিস্মৃতির অতল গর্ভে তলিয়ে যাচ্ছে। এখনকার শিক্ষিত জননী সন্তানকে আর রাখালের পিঠা গাছের কথা, রাক্ষসপুরীর ঘুমন্ত রাজকন্যার কথা বা পঙ্খিরাজ ঘোড়ার কথা শুনান না, তাদের কাছে বলেন আরব্য উপন্যাসের গল্প কিংবা Lambs Tales from Shakespeare এর গল্পের অনুবাদ। ফলে কোনো সুদূর অতীতের সাক্ষীস্বরূপ এই রূপকথা নষ্ট হয়ে অতীতের সঙ্গে আমাদের সম্বন্ধ লোপ করে দিচ্ছে। যদি আজ বাংলার সমস্ত রূপকথা সংগৃহীত হতো, তবে কোনো প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা করে দেখিয়ে দিতে পারতেন যে, বাংলার নিভৃত কোণের কোনো কোনো পিতামহী মাতামহীর গল্প ভারতীয় উপমহাদেশের অন্য প্রান্তে কিংবা ভারত উপমহাদেশের বাইরে সিংহল, সুমাত্রা, যাভা, কম্বোডিয়া প্রভৃতি স্থানে এমনিভাবে প্রচলিত আছে। হয়তো এশিয়ার বাইরে ইউরোপখণ্ডে লিথোনিয়া কিংবা ওয়েলসের কোনো পল্লিরমণী এখনও হুবহু বা কিছু রূপান্তরিতভাবে সেই উপকথাগুলো তার ছেলেপুলে বা নাতি-পোতাকে শোনাচ্ছে। কে আছে এই উপকথাগুলো সংগ্রহ করে তাদের অবশ্যম্ভাবী ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করবে? ইউরোপ, আমেরিকা দেশে বড়ো বড়ো বিদ্বানদের সভা আছে, যাকে বলা হয় Folklore Society। তাদের কাজ হচ্ছে এইসব সংগ্রহ করা এবং অন্য সভ্য দেশের উপকথার সঙ্গে সাদৃশ্য নিয়ে বিচার করা । এগুলো নৃতত্ত্বের মূল্যবান উপকরণ বলে পণ্ডিত সমাজে গৃহীত হয়। শ্রীযুক্ত দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারের ‘ঠাকুরমার ঝুলি’ বা ‘ঠাকুরদার থলে' যথেষ্ট নয়। বাংলাদেশের সমস্ত উপকথা এক জায়গায় জড় করলে বিশ্বকোষের মতো কয়েক বালামে তার সংকুলান হতো না ।
আমরা Shakespeare-এ পড়েছি রাক্ষসদের বাঁধা বুলি হচ্ছে Fi, Fie, foh, fun ! ও smell the blood of a British man- এর সঙ্গে তুলনা করে পল্লির ‘হাঁউ, মাউ, খাঁউ, মানুষের গন্ধ পাঁউ, এ সাদৃশ্য হলো কোথা থেকে? তবে কি একদিন ঐ সাদা ইংরেজ ও এই কালো বাঙালির পূর্ব পুরুষগণ ভাই ভাই রূপে একই তাঁবুর নিচে বাস করত? সে আজ কত দিনের কথা কে জানে? আমরা কথায় কথায় প্রবাদ বাক্য জুড়ে দিই- যেমন ‘দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা নেই’, ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি', আপনি বাঁচলে বাপের নাম', এই রকম আরও কত কী! তারপর ডাকের কথা আছে, খনার বচন আছে ।
যেমন ধরুন— কলা রুয়ে না কেটো পাত,
তাতেই কাপড় তাতেই ভাত ।
প্রবাদ বাক্যে এবং ডাক ও খনার বচনে কত যুগের ভূয়োদর্শনের পরিপক্ব ফল সঞ্চিত হয়ে আছে, কে তা অস্বীকার করতে পারে? শুধু তাই নয়, জাতির পুরনো ইতিহাসের অনেক গোপন কথাও এর মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় ।
আমরা আজও বলি— ‘পিঁড়েয় বসে পেঁড়োর খবর।’এই প্রবাদ বাক্যটি সেই সময়ের কথা মনে করিয়ে দেয়, যখন পাণ্ডুয়া বঙ্গের রাজধানী ছিল। কে এই প্রবাদ বাক্য, ডাক, খনার বচনগুলি সংগ্রহ করে তাদের চিরকাল জীবন্ত করে রাখবে?
তারপর ধরুন, ছড়ার কথা। কথায় কথায় ছেলেমেয়েগুলো ছড়া কাটতে থাকে। রোদের সময় বৃষ্টি হচ্ছে, অমনি তারা সমস্বরে ঝংকার দিয়ে ওঠে—
রোদ হচ্ছে, পানি হচ্ছে,
খেঁকশিয়ালীর বিয়ে হচ্ছে ।
এর সঙ্গে সঙ্গে মনে করুন মায়ের সেই ঘুমপাড়ানী গান, সেই খোকা-খুকির ছড়া। এগুলি সরস প্রাণের জীবন্ত উৎস, কিন্তু আজ দুঃখে দৈন্যে প্রাণে সুখ নেই। ছড়াও ক্রমে লোকে ভুলে যাচ্ছে। কে এগুলিকে বইয়ের পাতায় অমর করে রাখবে ?

শুধু ছড়া কেন? খেলাধুলার না কত বাঁধা গৎ আছে বা ছিল আমাদের এ দেশে । যখন ফুটবল, ব্যাটবলের নাম কারও জানা ছিল না, তখন কপাটি খেলার খুব ধুম ছিল। সে খেলার সঙ্গে কত না বাঁধা বুলি ছেলেরা ব্যবহার করত—
এক হাত বোল্লা বার হাত শিং
উড়ে যায় বোল্লা ধা তিং তিং ৷
বিদেশি খেলার প্রচলনের সঙ্গে সঙ্গে এসব লোপ পাবার উপক্রম হয়েছে। কে এদের বাঁচিয়ে রাখবে? তারপর ধরুন, পল্লিগানের কথা। পল্লিসাহিত্য সম্পদের মধ্যে এই গানগুলি অমূল্য রত্নবিশেষ। সেই জারি গান, সেই ভাটিয়ালি গান, সেই রাখালি গান, মারফতি গান- গানের এক অফুরন্ত ভাণ্ডার পল্লির ঘাটে, মাঠে ছড়ানো রয়েছে। তাতে কত প্রেম, কত আনন্দ, কত সৌন্দর্য, কত তত্ত্বজ্ঞান ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। শহুরে গানের প্রভাবে সেগুলো এখন বর্বর চাষার গান বলে ভদ্রসমাজে আর বিকায় না । কিন্তু -
মনমাঝি তোর বৈঠা নে রে
আমি আর বাইতে পারলাম না ।
এই গানটির সঙ্গে আপনার শহুরে গানের কোনো তুলনা হতে পারে? কিন্তু ধারাবাহিকরূপে সেগুলো সংগ্রহের জন্য কোনো চেষ্টা হচ্ছে কি?
এ পর্যন্ত যা বললাম সেগুলো হচ্ছে পল্লির প্রাচীন সম্পদ। সাহিত্যের ভাণ্ডারে দান করবার মতো পল্লির নতুন সম্পদেরও অভাব নেই। আজকাল বাংলাসাহিত্য বলে যে সাহিত্য চলছে, তার পনেরো আনা হচ্ছে শহুরে সাহিত্য, সাধু ভাষায় বলতে গেলে নাগরিক সাহিত্য। সে সাহিত্যে আছে রাজ-রাজড়ার কথা, বাবু-বিবির কথা, মোটরগাড়ির কথা, বিজলি বাতির কথা, সিনেমা থিয়েটারের কথা, চায়ের বাটিতে ফুঁ দেবার কথা। এইসব কথা নিয়ে গল্প, উপন্যাস, কবিতা, নাটক রাশি রাশি লেখা হচ্ছে। পল্লির গৃহস্থ কৃষকদের, জেলে-মাঝি, মুটে-মজুরের কোনো কথা তাতে ঠাঁই নাই। তাদের সুখ-দুঃখ, তাদের পাপ-পুণ্য, তাদের আশা- আকাঙ্ক্ষার কথায় কজন মাথা ঘামাচ্ছে? আমাদের বিশ্ববরেণ্য কবিসম্রাটও একবার ‘এবার ফিরাও মোরে' বলে আবার পুরানো পথে নাগরিক সাহিত্য নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন। ধানগাছে তক্তা হয় কিনা, এখন শহুরে লোকেরা এটা জানলেও পাড়াগাঁয়ের জীবন তাদের কাছে এক অজানা রাজ্য। সেটা কারো কাছে একেবারে পচা জঘন্য, আর কারো কাছে একেবারে চাঁদের জ্যোৎস্না দিয়ে ঘেরা। তাঁরা পল্লির মর্মকথা কী করে জানবেন? কী করেই বা তার মুখচ্ছবিখানি আঁকবেন? আমাদের আজ দরকার হয়েছে শহুরে সাহিত্যের বালাখানার পাশে গেঁয়ো সাহিত্যের জোড়াবাংলা ঘর তুলতে। আজ অনেকের আত্মা ইট-পাথর ও লোহার কৃত্রিম বাঁধন থেকে মুক্ত হয়ে মাটির ঘরে মাটির মানুষ হয়ে থাকতে চাচ্ছে। তাদের জন্য আমাদের কিছু গড়াগাঁথার দরকার আছে। ইউরোপ, আমেরিকায় আজ এই Proletariat সাহিত্য ক্রমে আদরের আসন পাচ্ছে, আমাদের দেশেও পাবে। কিন্তু কোথায় সে পল্লির কবি, ঔপন্যাসিক ও সাহিত্যিক, যাঁরা নিখুঁতভাবে এই পল্লির ছবি শহরের চশমা আঁটা চোখের সামনে ধরতে পারবেন?

এই সমস্ত রূপকথা, পল্লিগাথা, ছড়া প্রভৃতি দেশের আলোবাতাসের মতো সকলেরই সাধারণ সম্পত্তি। তাতে হিন্দু মুসলমান কোনো ভেদ নেই। যেরূপ মাতৃস্তন্যে সন্তান মাত্রেরই অধিকার, সেরূপ এই পল্লিসাহিত্যে পল্লিজননীর হিন্দু মুসলমান সকল সন্তানেরই সমান অধিকার ।
এক বিরাট পল্লিসাহিত্য বাংলায় ছিল। তার কঙ্কালবিশেষ এখনও কিছু আছে, সময়ের ও রুচির পরিবর্তনে সে অনাদৃত হয়ে ধ্বংসের পথে দাঁড়িয়েছে। নেহাত সেকেলে পাড়াগাঁয়ের লোক ছাড়া সেগুলোর আর কেউ আদর করে না। কিন্তু একদিন ছিল যখন নায়ের দাঁড়ি-মাঝি থেকে গৃহস্থের বউ-ঝি পর্যন্ত, বালক থেকে বুড়ো পর্যন্ত, আমির থেকে গরিব পর্যন্ত সকলকেই এগুলো আনন্দ উপদেশ বিলাতো। যদি পল্লিসাহিত্যের দিকে পল্লিজননীর সন্তানেরা মনোযোগ দেয়, তবেই আমার মনে হয় এরূপ পল্লিসাহিত্য সভার আয়োজন সার্থক হবে, নচেৎ এ সকল কেবলি ভুয়া, কেবলি ফক্কিকার।

Content added By
Promotion